ষোড়শ পরিচ্ছেদ : ভয় ও সন্দেহ
অগৌণে সেই রমণী একটি প্রজ্জ্বলিত দীপহস্তে দেবেন্দ্রবিজয়ের নিকট উপস্থিত হইল। পূর্বাপেক্ষা তাহার অবগুণ্ঠনের দীর্ঘতার এক্ষণে অনেক হ্রাস হইয়াছে তাহার স্বেদজড়িত চূর্ণালকবিশোভী অপ্রসর ললাটের কিয়দংশ আবৃত রাখিয়াছে মাত্র। কানের পাশ দিয়া তাহার বিপুলকৃষ্ণকেশরাশির একটা দীর্ঘ ও স্থূল গুচ্ছ, তাহার সেই সূক্ষ্ম বস্ত্রাবৃত পীন, পীবর ও উন্নত বক্ষের উপরে তরঙ্গায়িতভাবে লুটাইয়া পড়িয়াছে। সেই অপ্রশস্ত অবগুণ্ঠন ও কৃষ্ণকেশগুচ্ছে সেই আলোকজ্জ্বল মুখখানি বোধ হইতেছে, যেন একখণ্ড শ্বেত ও একখণ্ড কৃষ্ণ মেঘ বসন্ত পূর্ণিমার চন্দ্রকে উভয় পার্শ্ব হইতে বেষ্টন করিয়া রাখিয়াছে। হস্তস্থিত দীপালোকে রমণীর ইষল্লোহিতাভ মুখমণ্ডল ব্যাপিয়া ও সেই চঞ্চল, হাস্যময় কৃষ্ণোজ্জ্বল আকর্ণ চক্ষুর, প্রাখর্য্যে মনোহর ও তীক্ষ্ণতায় মধুর এবং চাঞ্চল্যে মধুরতর সে দৃষ্টির মধ্যে দিয়া একটা মুগ্ধকরী রমণীয়তা সম্পূর্ণভাবে বিকশিত হইয়া উঠিতেছে।
সেই ভুবনচাঞ্চল্যবিধায়িনী বিলোলকটাক্ষশালিনীর আগমনে ও তাহার সেই ললিতকোমল ভাবভঙ্গিতে মুগ্ধ দেবেন্দ্রবিজয় পূর্ব্বাপেক্ষা মুগ্ধ হইলেন। আপনার বিপদের কথা ভুলিয়া গেলেন মনে আর পূর্ব্বের ভাব কিছুই রহিল না। তখন মনে হইতে লাগিল, বৃহদরণ্যমধ্যবর্ত্তী অন্ধকারময় ভগ্নপ্রায় সেই প্রকাণ্ড জনবিরল নির্বান্ধব পুরীটাই তাঁহার ভয়ের একমাত্র কারণ, আর সেইখানে সেই অপরিচিতা রমণীই তাঁহার একমাত্র পরিচিতা। আর মনে হইতে লাগিল, অলক্ষ্যে থাকিয়া তাহার মুখে যেসকল ভয়াবহ কথা শুনিয়াছিলেন, সে আর কিছুই নহে, তাঁহার অলস মনেক চঞ্চল করিতে একটা অমূলক কল্পনা কখন অন্ধকারে অদৃশ্য ও অজ্ঞাতভাবে তাঁহার মস্তিষ্কে প্রবেশলাভ করিয়া, সেখানে একটা বাসা বাঁধিবার আয়োজন করিতেছিল। তিনি যাহা শুনিয়াছেন, তাহা ভুল—নিরর্থক—এবং তাহার কোন মানে হয় না।
যখন দেবেন্দ্রবিজয়ের মনের ভিতরে এইরূপ বিপ্লব, তখন রমণী তাঁহাকে মৃদুহাস্যে বলিল, “আপনি যে এখানে দাঁড়াইয়া আছেন দেখিতেছি, আমার সঙ্গে আসুন।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আর কেন, অনেকক্ষণ অসিয়াছি—আপনি একজন ভৃত্যকে বলুন আমাকে নৌকায় পৌঁছাইয়া দিয়া আসিবে। নিজে পথ চিনিয়া যাইতে পারিব না। “
রমণী বিনীতভাবে বলিল, “মহাশয় ক্ষমা করিবেন, কিছু জলযোগ না করিয়া আপনি কিছুতেই যাইতে পারিবেন না। “
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “সেজন্য আপনি আমাকে ক্ষমা করিবেন।”
রমণী বলিল, “তাহা হইলে আমরা অত্যন্ত দুঃখিত হইব। মহাশয়ের নামটি কি শুনিতে পাই না? এরূপ উপকারীর নাম আমাদের চিরকাল স্মরণ রাখা উচিত।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “দেবেন্দ্রবিজয়।”