চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ : আশ্চর্য্য রোগী
রমণী চলিয়া গেলে, রোগী দুই-একটা যন্ত্রণাসূচক শব্দ করিয়া স্বপ্নোত্থিতের নায় উঠিয়া বসিল। যুবককে দেখিয়া তাহার দৃষ্টিতে একটা বিস্ময়জনক ভাব প্রকটিকৃত হইল। অনুচ্চস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “কে আপনি? আপনার নাম?”
যুবক। আমার নাম দেবেন্দ্রবিজয় মিত্র।
রোগী। কই, এ নাম ত কখনও পূৰ্ব্বে শুনি নাই?
যু। আমি এখানে থাকি না; আমার বাড়ী ভবানীপুর; কলিকাতার কিছু দক্ষিণে।
রো। হবে, তা’ আপনি এখানে কিরূপে আসিলেন? কে আপনাকে এখানে আনিল?
যু। আপনি আপনার স্ত্রীকে নদীর ধারে একা ফেলিয়া রাখিয়া আসিয়াছিলেন। তিনি এতদূর একা ফিরিয়া আসিতে সাহস করিতেছিলেন না। সেই সময়ে আমি সেইখান দিয়া নৌকা করিয়া যাইতেছিলাম। আমাকে দেখিয়া আপনার স্ত্রী তাঁহাকে এখানে রাখিয়া যাইবার জন্য বিশেষ করিয়া বলেন; তাই তাঁহাকে রাখিতে আসিয়াছিলাম। তাঁহার মুখে শুনিলাম, আপনি পীড়িত। আমি ডাক্তার, সুতরাং একবার আপনাকে দেখিতে এখানে আসিলাম।
রো। ডাক্তার আপনি? ডাক্তারের উপরে যে আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নাই, তাহা কি আমার স্ত্রীর মুখে শুনেন নাই?
যু। হ্যাঁ, তিনি একবার বলিয়াছিলেন, বটে।
রো। তবে আবার আপনি কষ্ট স্বীকার করিয়া আমাকে দেখিতে আসিলেন কেন? তিনিই বা আপনাকে অনর্থক আনিলেন কেন?
যু। আপনি মূৰ্চ্ছিত হইয়া মৃতবৎ পড়িয়াছিলেন। এখন আপনাকে প্রকৃতিস্থ দেখিতেছি, আর আমার এখানে থাকিবার কোন আবশ্যকতা নাই। আমি এখন যাইতে পারি। (গমনোদ্যোগ)
রো। বসুন, রাগ করিলেন না কি? আমাকে মাফ করিবেন। আপনার সহিত যে-কালে সাক্ষাৎ পরিচয় হইল, তখন আপনার হাতে একবার ডাক্তারী চিকিৎসার শেষ পরীক্ষা লইতে পারি! আপনি আমার এ রোগের যাহাতে শীঘ্র উপশম হয়, এমন কোন বন্দোবস্ত করিতে পারেন কী?
যু। একবার সাধ্যমত চেষ্টা করিয়া দেখিতে পারি। তবে কথা হইতেছে, আগে রোগী আর চিকিৎসকের পরস্পর পরস্পরকে বুঝিয়া দেখা একান্ত আবশ্যক। তাহার পর রোগের চিকিৎসা। আপনি যদি আমার নিকটে রোগ গোপন করেন, আর আমি আজীন ধরিয়া যদি অনবরত চেষ্টা করি, তথাপি আপনার রোগের কিছুই করিতে পারিব না। আমার মনের ভাব আমি আগেই বলিতেছি, আমি যখন প্রথমে আপনাকে আসিয়া দেখিলাম, তখন আপনি মূৰ্চ্ছিতবৎ ছিলেন, কিন্তু আপনি যথার্থ মূৰ্চ্ছা হন্ নাই—ভান করিয়া পড়িয়াছিলেন। কি বলেন?
রো। আপনি ঠিক বলিয়াছেন। আমি অজ্ঞানের ভান করিয়া পড়িয়াছিলাম, তখন আমার বেশ জ্ঞান ছিল।
যু। এরূপ করিবার কারণ কি?
যুবকের এরূপ প্রশ্নে রোগীর চক্ষু একবার ক্ষণেকের জন্য জ্বলিয়া উঠিয়া পূর্ব্বভাব ধারণ করিল। তাহার পর শূন্যদৃষ্টিতে একবার দ্বারের দিকে চাহিয়া, চারিদিকে চাহিল; আবার সেই দ্বারের দিকে চাহিয়া চাহিয়া, উদ্বেগ কম্পিতকণ্ঠে বলিতে লাগিল, “কেবল আমার স্ত্রীর জন্য—আর কিছু না। ডাক্তারবাবু, কোনরকমে আমার এই মুর্ছাটি চব্বিশঘণ্টা স্থায়ী করিয়া দিতে পারেন, এমন কোন উপায় আছে কি? যখন মুৰ্চ্ছিত থাকি তখন আমি নীরোগ, তখন আমি বেশ ভাল থাকি! তাহার পর যখন বেশ জ্ঞান হয়, তখন কেবল যন্ত্রণা, বুকের যন্ত্রণা—মাথার যন্ত্রণা—বুক ফেটে যায়—মাথা ছিঁড়ে পড়ে—এমনই ভয়ানক যন্ত্রণা! আমি জানি, আমার এ যন্ত্রণা ইচ্ছাকৃত। আত্মপ্রবঞ্চনা ভিন্ন আর কিছুই নহে। ইহাতেই যে একদিন আমার এ জীবনের অবসান হইবে, তাহাও আমি জানি। সাধ করিয়া যে, আমি নরকাগ্নি বুকের মধ্যে জ্বালিয়াছি, তাহা আমি জানি, কিন্তু প্রাণান্তেও আমি সে কথা কাহারও কাছে প্রকাশ করি নাই—পরেও করিব না। আপনি এখন এক কাজ করুন, আপনি এখন অন্য ঘরে গিয়া বসুন। আমি এখন একা থাকিতে পারিলে অনেকটা সুস্থ হইব। আপনাকে যেসকল কথা বলিলাম, অনুগ্রহ করিয়া আমার স্ত্রীর কাছে তাহার একটি বর্ণও প্রকাশ করিবেন না। তাঁহাকেও এখন এখানে আসিতে মানা করিবেন। আমি আপাততঃ কিছুক্ষণ একা থাকিতে চাই। একটু সুস্থ হইলে পরে আপনাকে ডাকিব।” এই বলিয়া তিনি শয্যা হইতে উঠিয়া গিয়া একটা উন্মুক্ত গবাক্ষের সম্মুখে করতললগ্নশীর্ষ, হইয়া বসিলেন; এবং ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলিতে লাগিলেন।
যুবক তাহার কথার ভাব কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। ভাবিলেন, লোকটার মাথা বোধ হয় কোনরকমে খারাপ হইয়া গিয়াছে। তখন তিনি সেই অদ্ভুত রোগীর কক্ষ হইতে বাহির হইয়া বারান্দায় দাঁড়াইলেন। এমন সময়ে সেই রুগ্ন ব্যক্তির স্ত্রী দ্রুতপদে তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল। যুবককে বাহিরে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া বলিল, “আপনি যে একাকী এখানে দাঁড়াইয়া আছেন- তিনি কি—”
যুবক বাধা দিয়া বলিলেন, “তিনি এখন প্রকৃতিস্থ হইতে পারিয়াছেন। উঠিয়া জানালার নিকটে বাতাসের মুখে বসিয়াছেন, এখন তিনি একা থাকিতে চাহেন। বোধ করি, আপনার স্বামীর মনের ভিতরে কোন শোক বা দুঃখের এমন একটা আঘাত লাগিয়াছে, সেজন্য তিনি একান্ত অধীর ও উৎকণ্ঠিত হইয়া পড়িয়াছেন; বোধ করি, মাথাও কিছু বিগড়াইয়া গিয়াছে—কিছুতেই তিনি আপনাকে সাম্লাইয়া উঠিতে পারিতেছেন না।