পঞ্চম অধ্যায় : অরিন্দমের নৈপুণ্য
অরিন্দম তখন সেই সিন্দুকের ভিতর হইতে একটি কাল বনাতের জামা এবং একগাছি কাল রঙের ভাঙা ছড়ি বাহির করিলেন। রক্তে সম্পূর্ণ ভিজিয়া সে কাল বনাতের জামাটি গাঢ় পাট্কিলা রঙের মত দেখাইতেছে। জামাটি পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, “এই জামা পরিয়াই সে খুন করিয়া থাকিবে, জামাটি রক্তাক্ত হওয়ায় ও ছড়িটি কোন রকমে ভাঙিয়া যাওয়ায় অব্যবহার্য্য্যবোধে এই সিন্দুকের ভিতরে চালান দিয়াছে। এই দুটিতে আমি সে লোকটার চেহারা কিরূপ, মনে একটা অনুমান করিয়া লইতে পারিব। লোকটি লম্বায় পাঁচ ফুট, ছয় ইঞ্চির বেশী হইবে না।”
যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “কেমন করিয়া আপনি জানিলেন?”
অরিন্দম সেই ভাঙা ছড়িটি দেখাইয়া বলিলেন, “যে খুন করিয়াছে, এই ছড়িটি যদি তাহার হয় এবং ছড়িটি যদি তাহার মানানসহি হয়, তাহা হইলে আমার অনুমান মিথ্যা নহে। মাপে ছড়িটি যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে ঐরূপ পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি মাপের লোকেরই ব্যবহার্য। লোকটি আরও চারি-পাঁচ ইঞ্চি লম্বা হইলে ছড়িটি আরও দুই ইঞ্চি বড় হইত। লোকটি তেমন খুব বেঁটে নয়, খুব লম্বাও নয়, লোকটির বুক প্রশস্ত, স্কন্ধ বিস্তৃত, কোমর তেমন মোটা নয়, বুকের মাপের অপেক্ষা কিছু কম। ইহাতে বুঝাইতেছে, লোকটি সে রকমের মোটা নহে; মাংসপেশীতে বক্ষ ও স্কন্ধ স্ফীত, গলাটা কিছু বেশী মোটা।”
যোগেন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিলেন, “বুঝিতে পারিলাম না, কিরূপে আপনি এমন অনুমান করিতেছেন।”
অরিন্দম বলিলেন, “এই জামার ছাঁট-কাট দেখিয়া আমি যাহা বলিলাম—আপনি জামাটি মাপিয়া দেখিলেই বুঝিতে পারিবেন। লোকটির চুলগুলি অল্প কুঞ্চিত। জামার বোতামের সঙ্গে দুই-চারি গাছি চুল জড়াইয়া আছে। বোধ হয়, সেই লোকটা খুন করিয়া নিজের মুখে, চোখে, মাথায় যে রক্ত লাগিয়াছিল, তাহা এই জামা দিয়া মুছিয়া থাকিবে; সেই সময়েই বোতামের সঙ্গে দুই-চারি গাছি চুল জড়াইয়া উঠিয়া আসিয়াছে—সকলগুলিই এক মাপের—অল্প অল্প কোঁকড়া।”
যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “এইগুলি মাথার চুল না হইয়া যদি দাড়ি গোঁফের চুল হয়? মাথা মুছিবার সময় অবশ্যই সে নিজের মুখখানাও একবার এই জামা দিয়া মুছিয়া থাকিবে।”
অরিন্দম বলিলেন, “না, তাহা হইলে জানিতে পারিতাম। দাড়ি কিম্বা গোঁফের চুল স্বভাবতঃ গোড়া হইতে ধনুকের মত একদিকে কিছু বাঁকা হইয়া থাকে; কিন্তু মাথার চুল গোড়া হইতেই আগে খানিকটা কিছু কম আধ ইঞ্চি সোজা হইয়া থাকে। যদি কোঁকড়া চুল হয়, তাহার পর ডগার দিকে বাঁকা হইয়া থাকে, আর যদি কাফ্রীদের চুলের মতন খুব কোঁকড়ান চুল হয়, সে স্বতন্ত্র কথা, তাহার আগাগোড়া প্রায় সমানই হয়। গোঁফ দাড়ি আর মাথার চুলে কত তফাৎ একটু চেষ্টা করিয়া দেখিলেই বুঝিতে পারিবেন। আরও ইহাতে বুঝিতে পারিতেছি লোকটার দাড়ি গোঁফ কিছুই নাই, তাহা হইলে গোঁফ দাড়ির চুলও দুই-একটি লাগিয়া থাকিতে দেখিতাম। অবশ্যই সে ইহাতে মুখ মাথা ভাল করিয়া জোর দিয়া মুছিয়া থাকিবে। কারণ রক্তের দাগ শীঘ্র উঠে না; বিশেষতঃ খুন করিবার সময়ে মানুষের হাতে পায়ে এমন এক পৈশাচিক শক্তির সঞ্চার হয় যে, মনুষ্য তখন যে কাজ করে, সকল কাজেই অনিচ্ছায় অযথা বলপ্রয়োগ করিয়া থাকে। অবশ্যই সেসময়ের এই গাত্রমার্জ্জনীরূপে ব্যবহৃত জামায় গোঁফ দাড়ি হইতে দুই-একটি চুল ইহাতে উঠিয়া আসিত। এই সকলের মধ্যে আরও একটি অনুমান করা যায়, লোকটা গৌরবর্ণ।”
যোগেন্দ্রনাথ অরিন্দমের কথা শুনিয়া বিস্মিত হইলেন; কিন্তু শেষে গৌরবর্ণের কথা শুনিয়া তিনি একটা উপহাস করিবার সুযোগ ত্যাগ করিতে পারিলেন না, “কেন অরিন্দমবাবু, গায়ের রং কি একটু জামার সঙ্গে উঠিয়া আসিয়াছে না কি?”
অরিন্দম বলিলেন, “নজর থাকিলে তাহাও দেখিতে পাওয়া যায়। শুধু নজর দিয়া তুমি আমি গাছপালা ঘরবাড়ী দেখিলে হয় না—চোখ বুজিয়া আরও এমন অনেক জিনিষ দেখা যায়—যা খোলা চোখের কর্ম্ম নয়।”
যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “জামার সঙ্গে গায়ের রং না উঠিয়া আসিলে আমি ত এমন কোন উপায়ই দেখিতে পাই না, যাহাতে সেই লোকটাকে গৌরবর্ণ বলিয়া বুঝিতে পারি।”
অরিন্দম বলিলেন, “কৃষ্ণবর্ণ লোকে কৃষ্ণবর্ণ বড় বেশী পছন্দ করে না, তাহা না হইলে জামা ছড়ি উভয়ই কাল রঙের হইত না। যদিও জামাটি কাল-রঙের হইত, ছড়িটি নিশ্চয়ই অন্য কোন রঙের হইত। লোকটার বয়স চল্লিশের কম নহে;তাহার এদিকে লোকে এত বড় একটা দুঃসাহসিকতার কাজ এমন নিপুণভাবে সম্পন্ন করিতে পারে—আমার এমন বিশ্বাস হয় না।”
যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তাহা হইলে আপনার অনুমানে লোকটার বয়স চল্লিশ বৎসর, গৌরবর্ণ, মাংসপেশীতে বক্ষ ও স্কন্ধ স্ফীত, কেশ অল্প কুঞ্চিত শ্মশ্রুগুম্ফহীন, লম্বা পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির বেশী নয়, গলাটা কিছু মোটা, কোমরটা কিছু সরু। যখন হত্যাকারী ধরা পড়িবে, তখন আপনার এই অনুমানগুলি কতদূর সত্য, বুঝিতে পারা যাইবে।”
অরিন্দম বলিলেন, “তাহাই হইবে; এখন চলিলাম।”
যোগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আবার কখন দেখা করিবেন?”
অরিন্দম বলিলেন, “যখনই দেখা করিবার কোন প্রয়োজন দেখিব। এই বালিকার একখানি ফোটোগ্রাফ তুলিয়া রাখিবেন।”
অরিন্দম তথা হইতে বাহির হইলেন।