Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মায়াবী || Panchkari Dey » Page 49

মায়াবী || Panchkari Dey

পূর্ব্বোক্ত ঘটনার সপ্তাহ পরে।

একদিন শরতের নির্ম্মলীকৃত আকাশে স্নিগ্ধকিরণময় চন্দ্র উঠিয়াছে। তাহার নিম্নে চঞ্চল, তরল, চন্দ্রকিরণোজ্জ্বল শ্বেতাম্বুদখণ্ডগুলি একখানির পর আর একখানি, তাহার পর আর একখানি চন্দ্রকে আলিঙ্গন করিয়া তৃপ্তচিত্তে দূর দূরান্তরে ছুটিয়া চলিয়াছে। রাত্রি তখন দ্বিতীয় প্রহর। এমন সময়ে একখানি নৌকা একটি যুবক আরোহীমাত্রকে লইয়া, হুগলীর গঙ্গা বহিয়া কলিকাতা অভিমুখে মন্থরগতিতে অগ্রসর হইতেছিল। পরিপ্লব চন্দ্রালোকে মুক্ত প্রকৃতি পরিপ্লাবিত। গঙ্গার উভয় তটে কোথায় অতি দূর বিস্তৃত শ্যামল শস্যক্ষেত্র মৃদু পবনে তরঙ্গায়িত; এবং কোথায় অতি দীর্ঘ তাল, তমাল ও নারিকেলের ঘনশ্রেণী নিঃশব্দে; কোথায় দিগন্ত-বিস্তৃত নিবিড় শ্যাম বনরেখা- চন্দ্রকিরণোদ্ভাসিত, বায়ুচঞ্চল, ঝিল্লিমন্দ্রিত, খদ্যোৎ-খচিত পাখী কলগীতিমুখরিত। কোথায় আমের বাগান, ভিতরে বসিয়া দোয়েল শিস্ দিতেছিল; এবং পাপিয়ার শব্দতরঙ্গে কোমল আকাশ বিদীর্ণ হইতেছিল; কোথায় দীর্ঘতৃণময় সুদূরব্যাপী চন্দ্রালোকিত প্রান্তর অতি মনোহর; সেখানে সেই শরৎ- প্রারম্ভে সুকোমল শ্যামল তৃণাস্তরের উপর জ্যোৎস্না নিদ্রিত ছিল। সেখানে নিস্তব্ধতা এত নিবিড়, সেখানে কেবল একটি সীমাশূন্য, দিশাশূন্য, শুভ্রতা এবং শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। নৌকারোহী যুবক মুগ্ধচিত্তে অন্যমনে ও অতিশয় বিস্ময়ের সহিত এইসকল দেখিতে দেখিতে যাইতেছিল; গঙ্গ বিক্ষঃ নিস্তরঙ্গ জ্যোৎস্নাময়। নৌকা উজান ঠেলিয়া অগ্রসর হইতেছিল; নৌকার দুই পাশে জল কল্ কল্ ডাকিয়া ছুটিতেছিল। সেই জলকলতান, অপর পারস্থ জ্যোৎস্নামণ্ডিত ঝাউশ্রেণীর অনুচ্চ দূরাগত শন্ শন্ শব্দ সেই প্রগাঢ় স্তব্ধতার মধ্যে, দিগন্তবিস্তৃত বিজনতার মধ্যে, এক অপূৰ্ব্ব, অপার্থিব ও অচিরশ্রুত সঙ্গীত স্রোত সুমধুরভাবে প্রবাহিত করিয়া দিতেছিল। তাহারই তালে তালে মাত্রায় মাত্রায় দাঁড় নিক্ষেপের ঝপ্ ঝপ্ শব্দ মৃদুমন্দ আঘাত করিতেছিল। এক-একবার সেই ক্ষেপণীয় শব্দ লয়চ্যুত ও তজ্জন্য শ্রুতিকটু হইয়া পরিশ্রান্ত নীড়স্থ কাকগুলিকে বিনিদ্র ও মুখর করিয়া তুলিতেছিল।

গঙ্গার পূর্ব্বতট ঘেঁসিয়া নৌকা যাইতেছিল। গঙ্গার সেদিকে তৃণাচ্ছাদিত সেই বিস্তৃত প্রান্তর। যুবক দেখিল, সেইখানে তটের উপরে দাঁড়াইয়া এক শুভ্রবসনাবৃতা নারী-মূর্তি। নাসাগ্র অবধি লম্বিত অবগুণ্ঠনে তাহার মুখমণ্ডল আবৃত। সেই সুন্দর মুখমণ্ডলের যেটুকু দেখা যাইতেছিল, তাহাতেই অপরিসীম সৌন্দর্য্যের বেশ একটু আভাস হৃদয়ের মধ্যে অনুভূত হইতেছিল। য়ুবক ভাবিয়া পাইল না, কে এই শুক্লবসনা সুন্দরী, ভয়হীনা? এত রাত্রে এমন নির্জ্জনে, এই জনমানবশূন্য প্রদেশে? তাহার পশ্চাতে দূরব্যাপী প্রান্তর ধূ-ধূ করিতেছে। যুবক ভাবিল, মাথার উপরে অসীম নীলিমার বুকে তরল অনিবিড় শ্বেতাম্বুদ-আবৃত চন্দ্রেরই কি এই অসীম প্রান্তর প্রান্তে নিশ্চলভাবে দণ্ডায়মানা শুক্লাবসনা নবীনা, একখানি অবিকল প্রতিচ্ছবি? না, ক্ষেপণী সঞ্চালনের শব্দে সেই প্রান্তরের সুকেমাল তৃণশয্যা হইতে ঘুমন্ত জ্যোৎস্না জাগিয়া উঠিয়া এখানে মূৰ্ত্তিমতী? ভাবিয়া যুবক ঠিক করিতে পারিল না; মনের ভিতরে বড় গোলমাল বাঁধিয়া গেল। যুবক নির্নিমেষ মুগ্ধনেত্রে, বিস্ময়-ব্যাকুল দৃষ্টিতে সেইদিকে চাহিয়া রহিল। ধীরে ধীরে নৌকা সেইদিকে অগ্রসর হইতে লাগিল।

যখন নৌকা ক্রমে তাহার নিকটস্থ হইল, তখন সেই অবগুণ্ঠিতা তটের উপর হইতে দ্রুতপদে নিম্নে আজানু জলে নামিয়া আসিল। তখন নৌকা দশ হাত দূরে—ক্রমে তাহার সম্মুখবৰ্ত্তী হইল, তখন কাতরকণ্ঠে সেই অবগুণ্ঠিতা রমণী নৌকারোহী যুবককে লক্ষ্য করিয়া কহিল, “মহাশয়, আমি বড়ই বিপদে পড়িয়াছি;এখানে এত রাত্রে আর কাহারও সাহায্য পাইব, এমন আশা নেই। একা আমি স্ত্রীলোক—আমার কি হইবে, কি করিব, কিছুই ভাবিয়া পাইতেছি না। আপনি যদি এসময়ে আমাকে বিশেষ অনুগ্রহ না করেন, তবে আমার অন্য উপায় নাই।”

কথাগুলি স্পষ্টরূপে যুবকের কর্ণে প্রবেশ লাভ করিল। যুবক মাঝিকে কিনারায় নৌকা লাগাইতে কহিল। নৌকা মুখ ফিরাইয়া তটে গিয়া আঘাত করিল। যুবক সেই স্ত্রীলোকটিকে বলিল, “বলুন, আমাকে কি করিতে হইবে? আমার দ্বারা আপনার যে-কোন উপকার সম্ভব হয়, তাহাতে আমি স্বীকৃত আছি।”

রমণী ব্যাকুলহৃদয়ে সবিনয়ে কহিল, “আমি কুলস্ত্রী। এতরাত্রে একজন অপরিচিতের সঙ্গে নির্জনে কথা কহা আমার পক্ষে সম্পূর্ণ অবিধি—বরং মৃত্যুও ভাল। কেবল নিজের জন্য হইলে কুলস্ত্রীর অমূল্য সম্মান খোয়াইয়া, এই অবিধেয় কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইতাম না। অসহায় অবস্থায় মরিতে হইত —মরিতাম; কেবল আমার স্বামী—তিনি পীড়িত, রুগ্ন তাঁহাকে কে দেখিবে? তাঁহার কি হইবে? মহাশয়, দয়া করিয়া যদি আমাকে আমার বাড়ীতে রাখিয়া আসেন, কি বলিব, তাহা হইলে আপনি এ অসহায় স্ত্রীলোকের কতদূর উপকার করিবেন!

যুবক বলিল, “আপনার বাড়ী এখান হইতে কতদূর? নিকটে?”

রমণী বলিল, “না, এই প্রান্তরের উত্তরদিকে অনেক দূরে। ঐ যে একটা আমবাগান দেখা যাইতেছে, আপনি বোধ হয়, আসিবার সময়ে দেখিয়া থাকিবেন; ঐ আমবাগানের মাঝখান দিয়া পূর্ব্বমুখে গ্রামের মধ্যে যাইবার একটা পথ আছে, ঐ পথ দিয়া কিছুদূর যাইতে হইবে। আমি একাকী যাইতে ভরসা করিতেছি না, পথে সহায়হীনা স্ত্রীলোকের অনেক বিপদ আছে।”

কথা শুনিয়া, বেশভূষা দেখিয়া, ভাবভঙ্গি দেখিয়া তাহাকে ভদ্রমহিলা বলিয়া যুবকের মনে হইল। এবং তাহার এরূপ অবস্থার কারণ জানিবার জন্য যুবকের মন অত্যন্ত কৌতুহলী হইয়া উঠিল। জিজ্ঞসা করিলেন, “আপনি কুলনারী হইয়া এই ভয়ানক স্থানে, এত রাত্রে কিজন্য আসিয়াছেন, বুঝিতে পারিলাম না।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress