ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : সর্পিণী ও সর্পিণী
ফুলসাহেব মোহিনীর কথা শুনিয়া কিয়ৎক্ষণ নীরবে থাকিয়া তাহার পর বলিল, “সেসকল কথা এখন কেন? মোহিনী, এখন আমার সকল অপরাধ মার্জ্জনা করিয়া আমাকে রক্ষা কর; তোমার অঞ্চলটা ফেলিয়া দাও, তাহা হইলে আমার জীবন রক্ষা হয়; এখানকার জলের টান এত অধিক, কিছুতেই আমি উঠিতে পারিতেছি না। এরূপ অবস্থায় আর এক মুহূৰ্ত্তও কাটে না—বড় কষ্ট হইতেছে। একবার হাত ছাড়িয়া গেলে, সম্মুখের দহে পড়িয়া প্রাণ হারাইতে হইবে। মোহিনী! বাঁচাও―রক্ষা কর—আমি এখন বড়ই বিপন্ন। এরূপভাবে আর মুহূর্ত্তও থাকিতে পারিতেছি না।”
“এরূপভাবে যাহাতে আর এক মুহূর্ত্তও থাকিতে না হয়, তাহার উপায় করিতেছি,” বলিয়া মোহিনী সেই বটশাখার উপর একটি শিকড় ধরিয়া ঝুঁকিয়া পড়িয়া যে-শিকড় ধরিয়া ফুলসাহেব অতিকষ্টে জীবনটাকে মৃত্যুর মুখ হইতে এতক্ষণ তুলিয়া রাখিয়াছিল, তদুপরি ছুরিকার আঘাত করিতে লাগিল।
ফুলসাহেব কাতরস্বরে বলিতে লাগিল, “সৰ্ব্বনাশ! মোহিনী, তুমি কি করিতেছ, আমাকে জলে ডুবাইয়া মারিও না—রক্ষা কর—বাঁচাও—মোহিনী আমাকে ক্ষমা কর—বাঁচাও!”
মোহিনী সহাস্যে বলিল, “তোমার অপরাধের ক্ষমা নাই—থাকিলে করিতাম। এমন এক বাণে দুটি পাখী মারিবার লোভ কি সহজে ত্যাগ করা যায়, বিনোদ? তোমাকে জলে ডুবাইয়া কি, যদি তোমাকে পুড়াইয়া মারিতে পারিতাম, তাহা হইলে আরও সুখী হইতাম।” সেইরূপ ভাবে মোহিনী আবার শিকড় ছেদন করিতে লাগিল।
ফুলসাহেব ব্যাকুলান্তঃকরণে প্রাণভয়ে, প্রাণপণে, কাতরকণ্ঠে চীৎকার করিয়া উঠিল, “মোহিনী! এখনও—এখনও এ সঙ্কল্প ত্যাগ কর—এখনও বাঁচাও—এখনও রক্ষা কর—আমি করজোড়ে তোমার কাছে প্রাণ-ভিক্ষা চাহিতেছি, দয়া কর—ক্ষমা কর—”
বাধা দিয়া মোহিনী রোষতীব্রকণ্ঠে বলিল, “কিসের দয়া—কিসের ক্ষমা? পাপী তুমি—তোমার মৃত্যু এ জগতে বাঞ্ছনীয়। পাপী, পিশাচ, তুমি যে গঙ্গার পবিত্র জলে মরিতে পারিতেছ, ইহা একটা তোমার মত নারকীর পরম সৌভাগ্য বিবেচনা না করিয়া কাতর হইতেছ? ধিক্ তোমায়!” মোহিনী পূর্ব্ববৎ ছুরিকা দিয়া সেই শিকড়ের উপর আঘাতের পর আঘাত, করিতে লাগিল।
আসন্নবিপদে নিরুপায় হইয়া ফুলসাহেব আত্মহারা হইয়া উঠিল—মাথা ঘুরিয়া গেল। আঘাতপ্রাপ্ত স্ফীতজট সিংহের ন্যায় গৰ্জ্জন করিতে লাগিল,—”মোহিনী—পিশাচি—রাক্ষসী—এখনও কথা রাখ্ যদি কোনরকমে বাঁচিতে পারি, ইহার সমুচিত প্রতিফল পাবি। ফুলসাহেবের হাত হইতে কখনই রক্ষা পাইবি না।”
উন্মাদিনী মোহিনী ছুরিকা চালনায় পূর্ব্ববৎ তৎপর থাকিয়া বলিল, “এখন নিজেকে রক্ষা করিবার চেষ্টা কর;ইহার পর আমার ভাবনা ভাবিবার অনেক অবসর পাইবে। পিশাচ, তুমি কতদিন প্রসন্নমুখে কত নিরপরাধের প্রাণ লইয়াছ; তোমার বিষে—ছুরিতে কত লোকের প্রাণ এ পৃথিবী হইতে চির- বিদায় লইয়াছে, তাহাদের যন্ত্রণাময় মৃত্যু হাসিমুখে দেখিয়াছ। আর আজ তুমি কিনা, এত বড় একটা বীরপুরুষ হইয়া নিজের মৃত্যুভয়ে ব্যাকুল হইতেছ? মৃত্যুত নিশ্চয়ই একদিন হইবে, এখন আর ইহার পর—ইহার জন্য এত কাতরতা? ছিঃছিঃ! তোমাকে এত শীঘ্র মারিবার আরও একটা প্রয়োজন—বড় দুঃখের বিষয়, কিছুতেই আমি তোমার আশা ত্যাগ করিতে পারিলাম না। তা যদি পারিতাম, তোমাকে এমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করিতে আসিতাম না। তোমাকে না মারিয়া আমি কিছুতেই মরিতে পারিতেছি না; এ জগতে তোমাকে পাইলাম না। দেখি, তোমাকে মারিয়া, তাহার পর আমি নিজে মরিয়া পর-জগতে—তা’ নরকেই হ’ক্—আর যেখানেই হ’ক্—তোমার সহিত মিলিত হইতে পারি কি না। দেখি, যেভাবে প্রথম একবার দেখা দিয়েছিলে, সেইভাবে তোমাকে পাই কি না?”
ফুলসাহেব বলিল, “মোহিনী, এখন আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি, তোমার উপরে আমি অত্যন্ত অন্যায় ব্যবহার করিয়াছি। আমাকে বাঁচাও—আবার আমি তোমারই হইব—সেইরূপ তোমাকে ভালবাসিব।”
হাসিয়া মোহিনী বলিল, “বিনোদ, আর ভুলাইতে চেষ্টা করিও না। একবার ভুলিয়া নিজের মাথা নিজে খাইয়াছি। তুমি কি মনে কর, তোমার মত একটা প্রতারকের কথায় মোহিনী আবার ভুলিবে? এ এখন আর সে-মোহিনী নাই—এ এখন তোমার ভালবাসা চাহে না, তোমার আদর চাহে না, তোমার স্নেহসিক্তস্বরের সুমধুর আলাপ চাহে না; চাহে তোমার রক্ত—তোমার মৃত্যু, তোমার পাপদেহ পদতলে দলিত করিতে। বড়ই দুঃখের বিষয় বিনোদ, সে-মোহিনীর এমনই একটা অসম্ভব পরিবর্ত্তন ঘটিয়া গেছে।”
ফুলসাহেব তখন হতাশ হইয়া মর্মভেদীস্বরে বলিল, “মোহিনী! পিশাচী—রাক্ষসী—কিছুতেই তোর দয়া হইল না!”
বিদ্রূপ করিয়া মোহিনী কহিল, “রাক্ষসীর কাছে, পিশাচীর কাছে দয়া ভিক্ষা করা তোমার যে একটা মস্ত ভুল, বিনোদ!”
জুমেলিয়া দেখিল, শিকড় দ্বিখণ্ড হইতে আর বড় বিলম্ব নাই, অনতিবিলম্বে অদূরস্থ ঘূর্ণাবর্ত্তের তিমিরময় গর্ভে তাহদিগকে চির আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইবে। এতক্ষণ নীরবে অন্তরস্থ শঙ্কার সহিত প্রাণপণে যুঝিতেছিল, আর থাকিতে পারিল না। একান্ত বিনীতভাবে স্নেহমধুর সম্বোধনে মোহিনীকে বলিল, “ভগিনী এ বিপদে তুমি যদি আমাদিগকে দয়া না কর, আর কোন উপায় নাই—”
বাধা দিয়া মোহিনী কহিল, “চুপ্ কর্, পিশাচী—মরিবার সময়ে আল্লার নাম নে—অনেক পাপ করিয়াছিস্।”
জুমেলিয়া অপমানিত হইয়া শীঘ্র আর কোন কথা কহিতে পারিল না। এ-অপমানটা শক্তিশেলের মত তাহার বুকে গিয়া বিধিল। এবং বুকের ভিতরে তীব্রজ্বালাময় বিষ ঢালিয়া দিল। লাঙ্গুলাবসৃষ্ট সর্পিণীর ন্যায় সে গর্জ্জন করিতে লাগিল। তাহার দীপ্তকৃষ্ণকায় চক্ষু দিয়া বহ্নিশিখা বাহির হইতে লাগিল! জুমেলিয়া ভ্রূভঙ্গী করিয়া সরোষ-গর্জ্জনে বলিল, “যদি কোনরকমে তোর কাছে যাইতে পারিতাম, তাহা হইলে এই পিশাচীর পরিচয় তোকে আজ ভাল করিয়া দিতাম; দেখতিস, এক পলকে কেমন করিয়া তোর রক্তাক্ত দেহ আমার পদতলে লুটাইয়া পড়িত। দেখি, মরিতে বসিয়া ও পিশাচী জুমেলিয়া তোর কোন অপকার করিতে পারে কি না!”
এই বলিয়া জুমেলিয়া কটিদেশ হইতে মৃত প্রহরীর নিকটে প্রাপ্ত সেই কিরীচখানি হইয়া, সজোরে মোহিনীকে লক্ষ্য করিয়া নিক্ষেপ করিল। যে-বামহস্তে শিকড় ধরিয়া মোহিনী নিজ দেহভার সম্মুখের দিকে প্রসারিত করিয়া দিয়াছিল, সেই বামহস্তের মধ্যস্থলে কিরীচখানি আমূল বিদ্ধ হইয়া গেল। সেই সঙ্গে প্রবলবেগে রক্ত ছুটিতে লাগিল। মরিয়া উন্মাদিনী মোহিনী সেদিকে লক্ষ্য না করিয়া দ্বিগুণ উদ্যমে সেই শিকড় ছেদনে মনোনিবেশ করিল। তেমন আঘাতেও ক্ষণেকের জন্য তাহার মুখে যন্ত্রণা প্রকাশের কোন চিহ্ন প্রকটিত হইল না। যেমনি নিরুদ্বিগ্ন, তেমনি অটল, স্থির ও অবিচলিতভাবে আপনার কর্ত্তব্য কার্য্যে নিযুক্ত রহিল।
ফুলসাহেব দেখিল, মোহিনীর নিকটে তখন আর তিলমাত্র দয়ালাভের আশামাত্রও নাই; তখন সে মোহিনীকে লক্ষ্য করিয়া সেই বন্দুকের সঙ্গীনটা সজোরে ছুড়িয়া মারিল। অন্ধকারে লক্ষ্য ঠিক হইল না। সেটা সেই বটবৃক্ষমূলে সশব্দে—এত জোরে গিয়া পড়িল যে, কিয়দংশ তন্মধ্যে প্রোথিত হইয়া গেল।
মোহিনী হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। অকৃতকাৰ্য্য হইয়া ফুলসাহেব অবনতমস্তকে রহিল। মোহিনী তখন আরও জোরে ছুরিকা দিয়া সেই শিকড়ের উপরে আঘাত করিতে লাগিল। তৎক্ষণাৎ সেই শিকড় দ্বিখণ্ড হইয়া গেল। সেই সঙ্গে ফুলসাহেব ও জুমেলিয়া প্রবল স্রোতের মধ্যে সবেগে ভাসিয়া গিয়া অদূরস্থ সেই ঘূর্ণাবর্ত্তে পড়িল। দুই-একটা পাক খাইয়া অনন্তজলরাশির মধ্যে তাহারা কোথায় বিলীন হইয়া গেল, আর দেখা গেল না।
তাহার পর জল সেইখানে পূর্ব্ববৎ তেমনি ঘুরিতে লাগিল—তেমনি উচ্ছ্বসিত হইতে লাগিল এবং তেমনি গৰ্জ্জন করিতে লাগিল; জল তেমনি অশান্ত বেগবান্ ঘূর্ণমান, সশব্দ। তখন আর একবার মোহিনীর সেই অট্টহাস্য নৈশগগন কম্পিত করিয়া অনেকদূর পর্য্যন্ত প্রসারিত হইল। দূর বনান্তের গঙ্গার অপর পারে তাহারই একটা প্রতিধ্বনি জাগিয়া ঝটিকা গর্জ্জনের সহিত, অবিরাম, জলকল্লোলের সহিত মিশিয়া গেল।