চতুর্থ পরিচ্ছেদ : প্রহরী হত্যা
ফুলসাহেব আবার নিঃসব্দে উঠিতে লাগিল। আবার প্রাচীরের উপরে উঠিল। উঠিয়া প্রহরীর দিকে অগ্রসর হইল। এক হাতে সেই শাণিত সঙ্গীন। নিঃসব্দে প্রহরীর পাশে গিয়া দাঁড়াইল। প্ৰথম সুযোগেই বামহস্তে প্রহরীর গলদেশ সম্মুখদিক্ হইতে সবলে চাপিয়া ধরিল। প্রহরী একটিও শব্দ করিতে পারিল না; তৎক্ষণাৎ তাহার শ্বাস রুদ্ধ হইয়া গেল। প্রহরীকে সেইরূপ অবস্থায় রাখিয়া ফুলসাহেব অপর হস্তে সেই সঙ্গীনটা প্রহরীর বুকে আমূল বিদ্ধ করিয়া দিল। প্রহরী যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করিতে লাগিল। প্রহরীর হস্তপদাদির উৎক্ষেপে প্রাচীরগাত্রে দুম্ দুম্ করিয়া শব্দ হইতেছে দেখিয়া, ফুলসাহেব বামহস্তে তাহার গলদেশ ধরিয়া শূন্যে লম্বিতভাবে ঝুলাইয়া ধরিল, আর অপর হস্তে তাহার বক্ষে সেই তীক্ষ্ণাগ্র কিরীচ দিয়া সবলে বারংবার আঘাত করিতে লাগিল। প্রহরীর বক্ষোনিঃসৃত রক্তধারা বৃষ্টিজলের সহিত মিশিয়া প্রাচীর প্লাবিত করিতে লাগিল।
তখন ফুলসাহেবের সেই ভ্রুকুটিকুটিলমুখে সেই ভীষণ অমঙ্গলময় মৃদুতায় তীব্র হাসি ফুটিয়া উঠিল। ফুলসাহেব মনুষ্যের মূর্ত্তি ধরিয়া পিশাচ—এ-পিশাচে সকলই সম্ভব!
অনতিবিলম্বে প্রহরী মরিল। ফুলসাহেব তাহাকে সেই প্রাচীরের উপরে শোয়াইয়া দিল। তাহার বুক হইতে সঙ্গীনটা খুলিয়া লইয়া তাহারই রক্তসিক্ত পরিচ্ছেদে ভাল করিয়া মুছিয়া লইল। প্রহরীর কোর্তার ভিতরে একটা কিরীচ ছিল, সেটি বাহির করিয়া লইল। তাহার পর দ্রুতগতিতে সেইরূপ দড়ি বাহিয়া নিঃশঙ্কমনে নামিয়া আসিল।
নীচে নামিয়া আসিলে গোরাচাঁদ তহার সম্মুখে একটা কাপড়ের বুচকী ফেলিয়া দিল। ফুলসাহেব বেশ পরিবর্তন করিয়া গোরাচাদকে বলিল, “তুমি এখন এইখানে থাক, কোথায় কি হয়—কাল আমাকে খবর দিবে—আমি এখনই জুমেলিয়াকে লইয়া পলাশীর বাগানে, সেই বাগান-বাড়ীতে চলিলাম। সেইখানে দেখা করিয়ো, দেখা হইবে।”
গোরাচাঁদ বলিল, “এখন যেরূপ স্রোতের টান—গঙ্গা যেরূপ কূলে কূলে ভরিয়া উঠিয়াছে, কি করিয়া পার হইয়া যাইবেন? আপনি যদিও পারেন;কিন্তু জুমেলিয়াকে লইয়া কিরূপে পার হইবেন?” ফুলসাহেব বিরক্তভাবে বলিল, “সেজন্য তোমাকে ভাবিতে হইবে না—আমার কাজ আমি বুঝি, তোমাকে যাহা বলিলাম, তুমি তাহা কর, এখন আর বেশী কথা কহিবার সময় নাই।”
“যে আজ্ঞা,” বলিয়া গোরাচাঁদ তথা হইতে চলিয়া গেল।