তৃতীয় পরিচ্ছেদ : প্রাচীর উলঙ্ঘনে
সেই রাত্রি। প্রলয়ঙ্করী মূর্তি ধরিয়া তখন সেই মেঘাচ্ছায়ান্ধকারভীষণা রাত্রি সমস্ত জগৎ বিভীষিকাময় করিয়া তুলিয়াছে। প্রবলবেগে ঝড়বৃষ্টি আরম্ভ হইয়াছে এবং ঝটিকাসংক্ষুব্ধ প্রকাণ্ড গাছগুলো মাতৃহারা দৈত্যশিশুর মত বিকটরবে মর্ম্মকাতরতা দিদিগন্তে বিস্তৃত করিতেছে;রূপকথার রাজ-অতিথি ছদ্মবেশী নিশীথে কর্তব্যপরায়ণ বুভুক্ষিত রাক্ষসের মত ঝড় বিকট গৰ্জ্জন করিয়া ছুটিতেছে। সেই প্রবল ঝড়ের সহিত মিলিয়া, কৃষ্ণ, নিবিড়, ছিদ্রশূন্য, অকাতরবর্ষণসচেষ্ট বৃষ্টি মেঘ—ও একটা তুমুল বিপ্লবের মধ্যে ফেলিয়া সমস্ত পৃথিবীটাকে একটা পৈশাচিক তাণ্ডবক্ষেত্রে পরিণত করিয়াছে।
এমন সময়ে জেলখানার ভিতরে পূর্ব্বদিক্কার অত্যুচ্চ প্রাচীরের কিঞ্চিৎদূরে একটা বটগাছের তলে দাঁড়াইয়া ফুলসাহেব ও জুমেলিয়া;কাহারও মুখে কথা নাই—উভয়েই চিন্তামগ্ন। এখন কোনরকমে এই শেষ বাধা অতিক্রম করিতে পারিলেই, তাহারা সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ্ হইতে পারে। প্রত্যেকদিকের প্রাচীরের উপরে সশস্ত্র প্রহরীরা নতশিরে দ্রুতপদে ফিরিতেছে। মস্তকের উপরে অনবরত ধারাপাত হইতেছে, ভীষণ ঝটিকায় তাহাদিগকে পতনোন্মুখ করিতেছে; তথাপি প্রভুভক্ত তাহারা কর্তব্যপরাজুখ কত্তব্যপরাঙ্মুখ নহে। এক-একবার গগনভেদী “জুড়ীদার হো” শব্দে পরস্পর সরস্পরের অস্তিত্বের প্রমাণ লইতেছে।
এখন সকল কয়েদীই যে যাহার ঘরে আবদ্ধ। সারাদিনের অস্থিভেদী উৎকট পরিশ্রমের পর তাহাদিগের এখনও যে কেহ জাগিয়া আছে, এমন বোধ হয় না; তথাপি প্রহরীরা আজ এত সাবধান কেন? কেবল সেই শঠ-শিরোমণি ফুলসাহেবের জন্যই তাহারা ঝড় বৃষ্টি মাথায় করিয়া, আজ এই দুর্যোগেও কৰ্ত্তব্যভ্রষ্ট হওয়া অনুচিত বোধে প্রাচীরের উপর সতর্কচিত্তে সত্বরপদে পরিক্রমণ করিতেছে।
এমন সময় জেলখানার ঘড়ীতে একটা বাজিল। যে প্রহরী পূর্ব্বদিকে প্রাচীরের উপরে পরিক্রমণ করিতেছিল, সে অভ্রভেদীকণ্ঠে হাঁকিল “জুড়ীদার ভেইয়া হো।” প্রতিধ্বনির ন্যায় সেই সঙ্গেই বহুদূরে—অপর দিক্ হইতে পরবর্ত্তী প্রহরী তীব্রতরকণ্ঠে হাঁকিল, “জুড়ীদার ভেইয়া হো।” তাহার পর একদিক্ হইতে অপর একদিকে—এইরূপ চারিদিকে “জুড়ীদার ভেইয়া হো” শব্দে বহুদূর পর্য্যন্ত সেই মেঘকৃষ্ণ নৈশগগন পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।
শুনিয়া ফুলসাহেব একবার হাসিল; হাসিয়া বলিল, “জুমেলা, আমি ঠিক সময়েই আসিয়াছি। এখন গোরাচাঁদ যদি নিজের কর্ত্তব্য না ভুলিয়া থাকে, তাহা হইলে শীঘ্রই আমরা মুক্ত হইব। কাল হইতে অরিন্দম পলাতক কয়েদীর অনুসন্ধানে ফিরিবে।” শেষে শেষের দুই-একটি কথা ফুলসাহেবের মুখ হইতে মন্ত্রৌষধিরুদ্ধ বীর্য্যসপগৰ্জ্জনবৎ বাহির হইল, তাহা কিছুতেই মনুষ্যের মুখনিঃসৃতের মত শুনাইল না। যদি সেই অন্ধকারের মধ্যে কোনরকমে ফুলসাহেবের মুখখানা তখন দেখা যাইত, তাহা হইলে পাঠক, দেখিতে পাইতেন, তখনও সেই দানবচেতার মুখে সেই অমঙ্গলজনক– বিভীষিকা ও মৃদুতার অপূর্ব সংমিশ্রণে অপূর্ব্ব রহস্যপ্রাপ্ত সম্পূর্ণ অশুভসূচক ভীতিপ্রদ হাসি লাগিয়াছিল।
নিঃশব্দ পদক্ষেপে, সংযত নিঃশ্বাসে ফুলসাহেব জুমেলিয়াকে লইয়া, ধীরে ধীরে অগ্রসর হইয়া প্রাচীরের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইল। সেই নিকষকৃষ্ণ অন্ধকারের মধ্যে প্রহরী তিমিরে অনন্যকায় তাহাদিগকে দেখিতে পাইল না। সে তাহাদিগের মাথার উপর দিয়া একদিক্ হইতে অপরদিকে চলিয়া গেল। প্রহরী অনেক দূরে চলিয়া গেলে ফুলসাহেব একখণ্ড ক্ষুদ্র ইষ্টক লইয়া প্রাচীর-গাত্রে ধীরে ধীরে আঘাত করিল। তাহার পর প্রাচীরের উপর কান পাতিয়া দিল। তখন বাহির হইতে আবার সেইরূপ আঘাতের মৃদু শব্দ হইল। শুনিয়া অতি সাহসে ফুলসাহেবের বুক ফুলিয়া উঠিল এবং মুখ প্রসন্ন ও প্রফুল্ল হইল। ফুলসাহেব আবার সেইরূপ শব্দ করিল। জুমেলিয়াকে বলিল, “গোরাচাঁদ ভুলে নাই, সেই আসিয়াছে—আর ভয় করি না; একবার কোনরকমে প্রাচীরটা ডিঙাইতে পারিলে হয়;তখন একবার অরিন্দম আর যোগেন্দ্রনাথকে ভাল করিয়া বুঝিয়াইয়া দিব, ফুলসাহেবকে ঘাঁটাইয়া ভাল কাজ করে নাই। আরও তাহারা দেখিবে ফুলসাহেব কেমন করিয়া অতি সহজে তাহার প্রতিজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে পালন করিতে পারে। তাহারা ফুলসাহেবকে এখনও চেনে নাই, তাই তাহাদের মূর্খতা সীমা অতিক্রম করিয়া একেবারে এতদূর উঠিয়াছে।”
জুমেলিয়া মৃদুস্বরে বলিল, “গোরাচাঁদ এখন কি উপকার করিবে, আমি কিছুই বুঝিতে পারিলাম না।” ফুলসাহেব সেইরূপ মৃদুস্বরে বলিল, “আমি তাহাকে বলিয়া রাখিয়াছিলাম, যদি আমি কখন জেলের ভিতর আটক পড়ি, সে যেন প্রত্যহ রাত্রে—রাত একটার পর এইদিকে প্রাচীরের উপর একগাছি দড়ি ঝুলাইয়া দেয়।”
বলিতে-না বলিতে নৌকা বাঁধিবার কাছির মত মোটা একগাছি দড়ি উপর হইতে তাহাদিগের নিকট ঝপ্ করিয়া পড়িল। ফুলসাহেব সেই দড়িটি ধরিয়া সাধ্যমত জোরে একটা চান্ দিল, দড়ির অপর প্রান্ত বাহিরের দিকে ছিল, বাহির হইতে সেইরূপ একটা টান্ পড়িল। তখন ফুলসাহেব নিকটস্থ কোন বৃক্ষের মূলে দড়িটা বাঁধিল;তাহার পর জুমেলিয়াকে কোমরের কাপড় আঁটিয়া ধরিতে বলিয়া জুমেলিয়াকে লইয়া ধীরে ধীরে সেই দড়ি ধরিয়া উঠিতে লাগিল। জুমেলিয়া ফুলসাহেবের কটিদেশ দুই হাতে দৃঢ়রূপে বেষ্টন করিয়া, প্রাণপণে চাপিয়া ধরিয়া রহিল।
ফুলসাহেব জুমেলিয়াকে লইয়া প্রথমে ধীরে ধীরে—তারপর দ্রুত—আরও দ্রুত—আরও দ্রুত—আরও দ্রুত—আরও দ্রুত—উপরে উঠিতে লাগিল। যখন সেই অত্যুচ্চ প্রাচীরের ঊর্দ্ধসীমার সন্নিকটস্থ হইয়াছে—তখন যে প্রহরী প্রাচীরের উপরে পাহারা দিতেছিল, সে অপরদিক্ হইয়া সত্বর- পদে ফিরিতেছিল।
ফুলসাহেবের মাথা ঘুরিয়া গেল। ভয় হইল, এইবার, এইখানেই বুঝি তাহার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হইয়া যায়। ঘাটের নিকটস্থ হইয়া যদি নৌকা ডুবিয়া যায়, তাহার অপেক্ষা পরিতাপের বিষয় কি হইতে পারে। এইবার এই বুঝি, প্রথমবার ফুলসাহেবের সেই ভ্রুকুটিকুটিল, চিরহাস্যময় মুখখানি হাস্যশূন্য হইয়া শুকাইয়া গেল। তখন এক হস্তের উপর নিজের ও জুমেলিয়ার দেহভার বহন করিয়া অপর হস্তে কটিদেশ হইতে সেই বন্দুকের সঙ্গীনটা দৃঢ়মুষ্টিতে ধরিল। সেইরূপ অবস্থায় একগাছি দড়ির উপর নির্ভর করিয়া, একহস্তে দুইটি দেহভার বহন করিয়া এক মুহূর্ত্ত অতিবাহিত করা যতদূর কষ্টকর ব্যাপার আমরা মনে করিতেছি, ফুলসাহেব যেরূপ অসীম ক্ষমতাশালী, তাহাতে ইহা তাহার নিকটে একটা কঠিন কৰ্ম্ম বলিয়া গণ্য হইতে পারিল না। তাহার মনে ভয় হইতেছিল, পাছে প্রহরী সেই দড়িগাছটি দেখিতে পায়। যদি অন্ধকারে দেখিতে না পায়, যাইবার সময়ে যদি তাহার পায়ে ঠেকে, তবে কি হইবে? তাহা হইলে—তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ সঙ্গীনটা প্রহরীর বুকে সমূলে বসাইয়া দিবে—তাহার পর যাহা অদৃষ্টে থাকে, তাহাই হইবে। একান্ত অকর্ম্মণ্য বা নিশ্চেষ্টের ন্যায় বন্দী হওয়া নিতান্ত কাপুরুষতা। এইরূপ ভাবিয়া ফুলসাহেব সেই তীক্ষ্ণমুখ সঙ্গীনহস্তে প্রহরীর—কেবল প্রহরীর নহে একটা আশু বিপদের—একটা ভয়ানক দুর্ঘটনার অপেক্ষা করিতে লাগিল।
নিজের অসাবধানতার জন্যই হউক বা ফুলসাহেবের সৌভাগ্যবশতই হউক প্রহরী সেই দড়িটি দেখিতে পাইল না–পায়েও ঠেকিল না। সে সেই দড়িগাছা পার হইয়া অপর দিকে অগ্রসর হইল।
পথ পরিষ্কার হইল। ফুলসাহেব তখন সেই সঙ্গীনটা দত্তের মধ্যে চাপিয়া ধরিয়া আবার উঠিতে আরম্ভ করিল। আর বেশীদূর উঠিতে বাকী ছিল না; এখন পাঁচহাত উঠিতে পারিলেই প্রাচীরের উপরিভাগে উপস্থিত হওয়া যায়। দুই-তিনবার হস্ত চালনায় ফুলসাহেব প্রাচীরের উপরে উঠিয়া সেইরূপ অপর পার্শ্বে অবতরণ করিতে লাগিল। জুমেলিয়া সেইরূপ ফুলসাহেবের কটিদেশে সংলগ্ন রহিল।
অনকেদূর নামিয়া যখন আর দুই-তিন হাত মাত্র নামিতে বাকী আছে, তখন ফুলসাহেব লাফাইয়া ভূতলে পড়িল; যেখানে পড়িল, সেখানে একটা ইষ্টকস্তূপ ছিল ও তদুপরি কতকগুলি আগাছা জন্মিয়াছিল; সেখানে লাফাইয়া পড়িতে ইষ্টকখণ্ডগুলি পরস্পরে ঠেকিয়া, এবং আগাছাগুলির শুষ্ক শাখা প্রশাখা ভাঙ্গিয়া একটা শব্দ হইল। তেমন বেশী শব্দ না হইলেও শব্দটা প্রহরীর কানে গেল সে ফিরিয়া দাঁড়াইল। যেখানে শব্দ হইয়াছিল, সে-স্থানটা নিৰ্দ্দেশ করিতে না পারিয়া, সেইখানে বসিয়া ঝুঁকিয়া নিম্নবাগে সতর্কদৃষ্টিতে চাহিতে লাগিল। নীচে যেরূপ অন্ধকার, সেখানে দৃষ্টি চলে না; তথাপি প্রহরী সন্দিগ্ধমনে সেইরূপভাবে সেখানে বসিয়া, ঝুঁকিয়া পড়িয়া দৃষ্টিশক্তির উপরে সাধ্যমত বলপ্রয়োগ করিতে লাগিল। নীচে যেমন অন্ধকার, উপরের উন্মুক্ত স্থানে সেরূপ নহে ফুলসাহেব সেইখানে অদৃশ্য অবস্থায় থাকিয়া প্রহরীকে বেশ দেখিতে পাইতেছিল, এবং তাহার ভাব- ভঙ্গী দেখিয়া তাহার অভিপ্রায়টিও হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছিল।