ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : কুলসমের দুঃখ ও ক্রোধ
অরিন্দম বুঝাইয়া বলিতে লাগিলেন, “কুলসম, যাহা হইয়া গিয়াছে, সেজন্য এখন কাঁদিলে কোন ফল নাই। এখন যাহাতে এই সকলের ঠিক প্রতিশোধ হয়, তাহা করিবে না কি? যাহাতে তোমার সেই পিতৃঘ্ন, মাতৃঘ্ন, পাপী নিষ্কৃতি না পায়, তাহাই কি এখন তোমার একমাত্র কৰ্ত্তব্য নয়? উপযুক্ত প্রতিফল দিবে না?”
চক্ষু মুছিয়া, কুলসম মুখ তুলিয়া ক্ষণেক অরিন্দমের মুখের দিকে ক্রোধ-বিস্ফারিতনেত্রে চাহিয়া রহিল। তাহার পর বলিল, “সেই পাপীর গায়ে একটি আঁকুড় লাগিবার জন্য আমি আমার সৰ্ব্বস্ব ব্যয় করিব—উপযুক্ত প্রতিফল ত দূরের কথা। ফুলসাহেব আমাদের সোনার সংসার শ্মশান করিয়া দিয়াছে, এখন আমাকে কোনরকমে হত্যা করিতে পারিলে পিশাচ নিষ্কণ্টক হইতে পারে। আমাদিগের বাড়ীতে আর একজন লোক থাকিতেন, তাঁহার নাম সিরাজউদ্দীন। আজ একমাস হইল, ঐ পিশাচ আমার বিমাতার সঙ্গে পরামর্শ করিয়া তাঁহাকেও কোথায় সরাইয়াছে। আজও তাঁহার কোন সংবাদ নাই। পিতা তাঁহাকে বড় স্নেহ করিতেন। তিনি ফুলসাহেবকে কখনও চিনিতে পারেন নাই;ফুলসাহেবের ষড়যন্ত্রে যে সে কাজ হইয়াছিল, তাহা তিনি একবার সন্দেহও করিতে পারিলেন না। নিজে বিছানায় পড়িয়া; কি করিবেন ফুলসাহেবকেই সিরাজের সন্ধান করিতে বলিলেন, সুতরাং কাজে কিছুই হইল না। তবে এই পৰ্য্যন্ত বলিতে পারি, ফুলসাহেব তাঁহাকে ধরিয়া রাখিয়াছে;এখনও তাঁহাকে খুন করে নাই। সম্ভব, সেই বিখ্যাত ডাকাত কালু রায়ের কাছে সিরাজকে বন্দী করিয়া রাখিয়াছে।”
অরিন্দম বলিলেন, “সিরাজউদ্দীন তোমাদের কে হ’ন্?”
কুলসম বলিল, “সিরাজউদ্দীনের পিতা বসিরুদ্দীন আমার পিতার জমিদারীর প্রধান নায়েব ছিলেন; শুধু বসিরুদ্দীন কেন—বসিরুদ্দীনের পিতা, পিতামহ বংশানুক্রমে—আমাদিগের জমিদারী নায়েবী কাজে অনেক টাকা উপার্জ্জন করিয়া গিয়াছেন। বসিরুদ্দীন আমার পিতামহের আমল হইতে কাজ করিয়া আসিতেছিলেন। তাঁহার সংসারে ঐ একমাত্র পুত্র সিরাজ ছাড়া আর কেহই ছিল না। আজ পনেরো বৎসর হইল, বসিরুদ্দীনের মৃত্যু হয়; তখন তাঁহার পুত্রের বয়স দশ বৎসর মাত্র। মৃত্যুকালে বসিরুদ্দীন আমার পিতার হাতেই সিরাজউদ্দীনকে সমর্পণ করিয়া যান; সিরাজ আবার যেরূপ নম্র, বিনয়ী, বাধ্য, তাহাতে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি আমার পিতার খুব স্নেহভাজন হইয়া উঠিলেন। পিতা আপনার পুত্রের ন্যায় তাঁহাকে স্নেহ করিতেন। তিনি সিরাজউদ্দীনের ভরণপোষণের জন্য, বিদ্যাশিক্ষার জন্য কিছুতেই এ পর্যন্ত তাঁহার পৈতৃক সম্পত্তি হইতে এক কপৰ্দ্দক লইতেন না—নিজের ব্যয়ে সকলই নির্ব্বাহ করিতেন। সিরাজ ইদানীং কলিকাতায় একজন বিখ্যাত সাহেব চিত্রকরের নিকটে চিত্রবিদ্যা শিক্ষা করিতেন; সেজন্য বেতন ও বাসাখরচ ইত্যাদিতে প্রায় মাসে পঞ্চাশ টাকা লাগিল। তাহাও আমার পিতা তাঁহাকে দিতেন। সিরাজ ইদানীং কলিকাতা হইতে মধ্যে মধ্যে এখানে অসিতেন, তিন-চারদিন থাকিয়া আবার চলিয়া যাইতেন। ফুলসাহেব হইতেই যে আমাদিগের সংসার ক্রমে ধ্বংসের দিকে যাইতেছিল, তাহাও তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন, সেইজন্য তিনি বাবাকে কতবার বুঝাইয়াছিলেন; মায়াবী ফুলসাহেবের মোহমন্ত্রে বাবা এমনই মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিলেন, কিছুতেই ফুলসাহেবের উপরে তিলমাত্র সন্দেহ করিতে পারিতেন না;তথাপি সিরাজউদ্দীন যখনই এখানে আসিতেন, বাবাকে ফুলসাহেব সম্বন্ধে অনেক বুঝাইতেন।”
অরি। এই একমাত্র কারণেই কি ফুলসাহেব তাঁহাকে বন্দী করিয়া রাখিয়াছে, না তাহার আর কোন উদ্দেশ্য আছে?
“আরও একটা উদ্দেশ্য আছে, সেইটিই বোধহয় প্রধান”, বলিয়া কুলসম একটু লজ্জিতভাবে নতমুখী হইল।
অরি। কি?
কুলসম উত্তর করিল না। সেইরূপ অবনতমস্তকে চুপ্ করিয়া রহিল। অরিন্দম বলিলেন, “কুলসম, লজ্জা করিয়া আমার কাছে কোন কথা অপ্রকাশ রাখিও না।”
কুলসম নতমুখে বলিল, “তাঁহার সহিত আমার বিবাহ হইবার কথা ছিল।”
অরিন্দম বলিল, “আমিও তাহাই মনে করিতেছিলাম। কালু রায় ডাকাতের কাছে তিনি যে এখন বন্দী আছেন, এ-কথা তোমাকে কে বলিল?”
কু। একদিন ফুলসাহেবের সঙ্গে আমার বিমাতা এইরূপ পরামর্শ করিতেছিল। আমি অন্তরালে থাকিয়া শুনিয়াছিলাম।
অ। কালু রায় যেরূপ প্রবল পরাক্রান্ত দস্যু, তাহার হাত হইতে সিরাজউদ্দীনকে উদ্ধার করা সহজ কাজ নয়; তথাপি আমি তাঁহার উদ্ধারের জন্য প্রাণপণ করিব। এ পর্য্যন্ত কোন গোয়েন্দা কালু রায়কে ধরিতে পারে নাই। ধরা দূরে থাক্, সে কোথায় থাকিয়া ডাকাতি করে, সে সন্ধানও কেহ করিতে পারে নাই। অনেকে তাহাকে ধরিতে গিয়া তাহারই হাতে প্রাণ দিয়াছে। আমিও তাহাকে ধরিবার জন্য অনেকবার অনেক চেষ্টা করিয়া দেখিয়াছি—কাজে কিছুই করিয়া উঠিতে পারি নাই।
শুনিয়া কুলসমের মুখ শুকাইল। সে অরিন্দমের মুখে কালু রায়ের যে অখণ্ড প্রতাপের কথা শুনিল, তাহাতে তাহার হাত হইতে যে কখনও সিরাজ মুক্তি পাইবেন, এ আশা তখন আর কিছুতেই তাহার হৃদয়ে স্থান পাইল না; নিরাশার অপরিহার্য্য উৎপীড়নে তাহার হৃদয় অত্যন্ত আকুল হইয়া উঠিল। কুলসম সিরাজকে কত ভালবাসে, তাহা সে নিজেও কিছু বুঝিতে পারিত না; সে ভালবাসা উদ্দাম, পরিপূর্ণ, নিবিড়, অথচ অতি চঞ্চল, তথাপি ইহা অধীর যৌবনের একটা আরও অধীর আরও চঞ্চল আবেগময় মদিরোচ্ছ্বাস নহে; তাহা তাহার আজীবন ধরিয়া তিল তিল করিয়া, খেলায়-ধূলায়, হাস্য-পরিহাসে, গাথা-গল্পে একটা অতি প্রগাঢ় আত্মীয়তার মধ্য দিয়া, দিনে দিনে তাহার হৃদয় এমন অল্পে অল্পে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিয়াছিল যে, কুলসমকে তাহার বিন্দুবিসর্গও বুঝিতে দেয় নাই। তাহাতে বড় আসে যায় না। কুলসমের সে অপার্থিব অগাধ, অতি সরল একটা মনোবৃত্তি অটল নির্ভরতার সহিত প্রেমের মোহিনী মূর্ত্তিতে বাহির হইয়া যাহার পদপ্রান্তে ভাঙ্গিয়া পড়িতে চাহিতেছিল—সেই সিরাজ যে ইহার অনেকটা বুঝিতে পারিয়াছিলেন, এবং বুঝিতে পারিয়া, তিনি যে তাঁহার হৃদয়ের সকল দ্বার উদ্ঘাটন করিয়া, তাহারই জন্য সতত সমগ্ৰ হৃদয়কে উন্মুক্ত রাখিয়া দিয়াছিলেন ইহাই কুলসমের যথেষ্ট বলিয়া মনে হইত।
কুলসম শঙ্কাকুল হৃদয়ে অরিন্দমকে জিজ্ঞাসা করিল, “তবে কি তাঁহার উদ্ধারের কোন উপায় নাই?”
অরিন্দম বলিলেন, “উপস্থিত কোন উপায় দেখিতেছি না; সিরাজের উদ্ধারের জন্য শীঘ্রই আমি চেষ্টা করিয়া দেখিব। তুমি ফুলসাহেবকে তোমার বিমাতার সঙ্গে আর কোন বিষয়ে কোন পরামর্শ করিতে কখনও শুনিয়াছ? কামদেবপুরের থানায় একটি বালিকার লাস সমেত একটা কাঠের সিন্দুক চালান দেওয়া সম্বন্ধে তাহাদের মধ্যে কখনও কি কোন কথা উঠিয়াছিল?”
“তিন-চারিদিন হইল, একদিন ফুলসাহেব আমার বিমাতাকে এরকমের একটা কি কথা বলিতেছিল, আমি তাহা ভাল বুঝিতে পারি নাই; সেই কথায় তখন তাহাদের মধ্যে একটা খুব হাসি পড়িয়া গিয়াছিল।”
“সেই সময়ে তাহাদিগকে কাহারও নাম করিতে শুনিয়াছ?”
“তিন-চারিজনের নাম করিয়াছিল, সে সব নাম আমি আগে কখনও কাহারও মুখে শুনি নাই।”
“নামগুলি মনে আছে?”
“হ্যাঁ—গোরাচাঁদ, গোপালচন্দ্র।”
“আর কি? তুমি যে তিন-চারিজনের নাম শুনিয়াছ বলিলে?”
“আর দুইটি স্ত্রীলোকের নাম; বাঙ্গালী স্ত্রীলোকদিগের নাম আমাদের বড় মনে থাকে না—বিশেষতঃ সে নাম দুটি যেন কেন একটু নূতন রকমের।”
“রেবতী? রোহিণী?”
“হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলিয়াছেন, ঐ দুটি নামই তখন তাহাদের মুখে শুনিয়াছিলাম। এখন বেশ মনে পড়িতেছে।”
তখন অরিন্দমের চোখের উপর হইতে অত্যন্ত ভ্রমসঙ্কুল, সম্পূর্ণ রহস্যময় একটা অতি জটিল প্রহেলিকার দুর্ভেদ্য যবনিকা সহসা দূরে সরিয়া গেল—অরিন্দম স্তম্ভিত হইলেন। তিনি কুলসমকে বলিলেন, “তোমার এখন বাড়ীতে যাওয়া হইবে না, এইখানে থাক, সন্ধ্যার পূর্ব্বেই তোমাকে আমি রাখিয়া আসিব।”
“কেন?”
“পরে জানিতে পারিবে” বলিয়া অরিন্দম যোগেন্দ্রনাথের দিকে ফিরিয়া কহিলেন, “বন্ধুবর কুলসমকে বাড়ীর ভিতরে রাখিয়া আসুন।”
যোগেন্দ্রনাথ কুলসমকে অন্তঃপুরে স্ত্রীলোকদিগের নিকটে রাখিয়া আসিলেন। তাহার পর অরিন্দমকে লইয়া থানার দিকে চলিলেন।