দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : কুলসমের উদ্বেগ
প্রভাতে যোগেন্দ্রনাথের গৃহদ্বারে একখানি পাল্কী আসিয়া দাঁড়াইল। তন্মধ্য হইতে একটি কৃতাবগুণ্ঠনা কিশোরী বাহির হইয়া বাটীমধ্যে প্রবেশ করিল। তখন যোগেন্দ্রনাথ গৃহেই ছিলেন। বাটীর বহিরঙ্গনে তাহার সহিত যোগেন্দ্রনাথের দেখা হইল। কিশোরী যোগেন্দ্রনাথকে দেখিয়া ব্যগ্রতার সহিত জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন আছেন, তিনি?”
যোগেন্দ্রনাথ সবিস্ময়ে কহিলেন, “কে কেমন আছেন? কাহার কথা আপনি বলিতেছেন?” কিশোরী। অরিন্দমবাবুর। তিনি কি বাঁচিয়া নাই?
যোগেন্দ্র। ডাক্তার ফুলসাহেব ত তাহাই বলিয়া গিয়াছেন।
কি। [ ক্রোধভরে ] কে, ডাক্তার ফুলসাহেব? পিশাচ? সে-ই অরিন্দমবাবুকে খুন করিয়াছে।
যো। বটে! আপনি কে?
কি। আমি কুলসম—তমীজউদ্দীনের কন্যা।
এই বলিয়া কুলসম অবগুণ্ঠন উন্মোচন করিল। বলিল, “আমি আগেই জানিতে পারিয়া, অরিন্দমবাবুকে সাবধান করিয়া দিয়াছিলাম। হায়, হয়ত তিনি আমাকে পাগল মনে করিয়া আমার কথা বিশ্বাস করেন নাই!’
যো। তুমি কেমন করিয়া জানিলে যে, ডাক্তার ফুলসাহেব অরিন্দমবাবুকে হত্যা করিয়াছে?
কু। আমি ফুলসাহেবের মুখ দেখিলে, তাহার মনের ভাব বেশ বুঝিতে পারি;আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করিতেছেন না?
যো। কেন বিশ্বাস করিব না? তুমি কি বলিতে আসিয়াছ বলো।
কু। অরিন্দমবাবু কি ফুলসাহেবের সেই বিষাক্ত চুরুট খাইয়াছেন?
যো। হ্যাঁ।
কু। [ অধীর হইয়া ] কি সৰ্ব্বনাশ! কোথায় তিনি? আমাকে তাঁহার কাছে লইয়া চলুন। কেমন আছেন তিনি?
যো। তুমি সেখানে গিয়ে কি করিবে?
কু। আমি তাঁহাকে বাঁচাইব। তিনি আমাকে মৃত্যুমুখ হইতে উদ্ধার করিয়াছেন, এসময়ে আমি তাঁহার জন্য প্রাণপণ করিব।
যো। কেমন করিয়া তুমি এখন তাঁহাকে বাঁচাইতে পারিবে?
কু। তিনি এখনও মরেন নাই—বিষে মৃতবৎ হইয়াছেন। এখন তাঁহাকে দেখিলে কোন চিকিৎসক তাঁহাকে জীবিত বলিয়া বুঝিতে পারিবে না। আমি ঐ বিষের সম্বন্ধে ফুলসাহেবের মুখে কিছু শুনিয়াছি। উহার প্রতিষেধক ঔষধের নামও তার মুখে শুনিয়াছি। একদিন আমার বিমাতাকে ঐ কথা ফুলসাহেব বলিয়াছিল, আমি গোপনে থাকিয়া সব শুনিয়াছিলাম।
যো। তিনি মরেন নাই—অনেক কষ্টে বাঁচিয়াছেন।
শুনিয়া কুলসমের মাথায় যেন কেমন একটা সুখের বজ্রাঘাত হইল। একটা নিরতিশয় আনন্দের বৈদ্যুতিক প্রবাহ সৰ্ব্বাঙ্গ বহিয়া তাহার মস্তকের ভিতরে সঞ্চালিত হইতে লাগিল; ঠিক সেই সময়ে অরিন্দম তাহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। অরিন্দমের মুখ ম্লান, জ্যোতিহীন দেহ শীর্ণ, চোখ দুটি ভিতরে বসিয়া গিয়াছে—যেন তিনি সে অরিন্দম নহেন, তেমন উজ্জ্বল বলময় দেহে কি যেন কালি মাড়িয়া দিয়াছে! অরিন্দম মৃদু হাসিয়া কুলসমকে বলিলেন, “কি কুলসম! আমাকে তুমি দেখিতে আসিয়াছ? আমি মরি নাই, বেশ বাঁচিয়া আছি। তুমি কেন কষ্ট করিয়া এতদূর আসিলে?”
কুলসম বলিল, “আপনি একদিন আমার জন্য নিজের প্রাণ বিপদাপন্ন করিতে পারিয়াছিলেন; আর আমি আপনার এরূপ দুর্ঘটনার কথা শুনিয়া একবার দেখিতে আসিয়াছি, ইহা কি বড় বেশী হইল?”
অরি। কুলসম। তোমাকে আমার কতকগুলি কথা জিজ্ঞাস্য আছে।
কুল। বলুন, আমি আপনার কাছে একটি বর্ণও গোপন করিব না। আমি মাতৃপিতৃহীনা, আপনার শরণাপন্না; আমি আপনার নিকট অনেক উপকারের আশা করি। এ-বিপদে আপনি যদি আমাকে না রাখেন, আমার আর অন্য উপায় নাই। আমি আবার ভয়ানক বিপদে পড়িয়াছি; যদি না আমি দুই- একদিনের মধ্যে ডাক্তার ফুলসাহেবকে বিবাহ করিতে সম্মত হই, তাহারা আমাকে খুন করিবে। তাহারা কাল যখন এইরূপ পরামর্শ করিতেছিল, তখন আমি গোপনে থাকিয়া তাহাদের অনেক কথা শুনিয়াছি।
অরি। তাহারা কে? তুমি আর কাহার কথা বলিতেছ?
কু। আর আমার সেই রাক্ষসী বিমাতা—
অ। তিনিও কি এই ষড়যন্ত্রের ভিতরে আছেন না কি?
কু। তাহারই ত এই ষড়যন্ত্র, ফুলসাহেব উপলক্ষ মাত্র। আমার বিমাতাকে বড় সহজ মনে করিবেন না। সে না করিতে পারে, এমন ভয়ানক কাজ পৃথিবীতে কিছুই নাই। শুনিয়াছি, আমার বিমাতা ফুলসাহেবের ভাগিনেয়ী। ফুলসাহেব যোগাড়-যন্ত্র করিয়া আমার পিতার সঙ্গে তাহার সেই ভাগিনেয়ীর বিবাহ দেয়;কিন্তু ফুলসাহেবের সহিত আমার বিমাতার যেরূপ ঘনিষ্ঠতা দেখি, তাহাতে মনে বড় ঘৃণা হয়—কখন ভদ্রঘরের মেয়ে বলিয়া বোধ হয় না।
অ। তুমি গোপনে থাকিয়া কাল তাহাদের মুখে কি শুনিয়াছ? আমার সম্বন্ধে কোন কথা উঠিয়াছিল কী।
কু। আগে আপনারই কথা হইতেছিল। ফুলসাহেব আপনাকে বিষাক্ত চুরুট খাওয়াইয়া, কেমন করিয়া আপনাকে মরণাপন্ন করিয়াছিল, তাহাই সে আমার বিমাতার কাছে হাসিতে হাসিতে গল্প করিতেছিল। তারপর আমার কিসে সর্ব্বনাশ হইবে, কেমন করিয়া আমার সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি ফাঁকি দিয়া লইবে, এই- সব গুপ্ত-পরামর্শ চলিতে লাগিল। শেষে স্থির হইল, যদি তাঁহাদের কার্য্যসিদ্ধি করিবার জন্য আমাকে খুন করিতে হয়, তাহাও করিবে। জানি না, বিধাতা কেন ফুলসাহেবরূপী পিশাচকে মনুষ্যশ্রেণীভুক্ত করিয়াছেন। ঐ ফুলসাহেব আমার করুণাময় পিতাকে খুন করিয়াছে, স্নেহময়ী মাতাকে খুন করিয়াছে, আমার একমাত্র ভ্রাতাকেও খুন করিয়াছে;এমনভাবে খুন করিল—কেহ জানিল না—কেহ বুঝিল না; অথচ তিনটি প্রাণী খুনীর বিষে এ জগৎ ছাড়িয়া কোথায় চলিয়া গেল! পিশাচ যে বিষ দিয়া তাঁহাদিগকে হত্যা করিয়াছে, তাহাতে মানুষ একদিনে মরে না—তিল তিল করিয়া মরিতে থাকে, কেবল আমিই এতদিন বাবাকে মরিতে দিই নাই; আমার বিমাতা বাবার খাবার জলের সঙ্গে প্রত্যহ বিষ মিশাইয়া রাখিত, আমি সুবিধা পাইলেই, সেই জল ফেলিয়া দিয়া অন্য জল খাইতে দিতাম। সকল দিন সুবিধা হইত না, পিতা শয্যাশায়ী হইয়াও এতদিন সেইজন্য বাঁচিয়াছিলেন; নতুবা বোধহয়, তিন মাসের মধ্যে তাঁহাকে ইহলোক ত্যাগ করিতে হইত। বিষ খাইয়াও বাবাকে এতদিন বাঁচিতে দেখিয়া ফুলসাহেব আর আমার বিমাতা অতিশয় চিন্তিত হইয়া উঠিয়াছিল। দুইজনে কেবল পরামর্শ করিত মধ্যে মধ্যে বিষের মাত্রা বাড়াইয়া দিত। বাবার কাছে একদিন এ-কথা তুলিয়াছিলাম। তাঁহার যেরূপ সরল মন আপনার মত সকলকেই সরল ভাবিতেন। নারকী ফুলসাহেবের উপরে,, আমার সেই দানবী বিমাতার উপরে তাঁহার অগাধ বিশ্বাস। তিনি আমার কথা বিশ্বাস করিলেন না—হাসিয়া উড়াইয়া দিলেন। হায়, এমন দুর্ভাগিনী আমি, এত করিয়া বাবাকে বাঁচাইতে পারিলাম না।
কুলসমের আয়ত চোখদুটি অশ্রুসজল হইয়া আসিল। বসনাঞ্চলে মুখ ঢাকিয়া কুলসম আকুল হৃদয়ে কাঁদিতে লাগিল।