তৃতীয় পরিচ্ছেদ : ফুলসাহেব
অল্পক্ষণ পরেই ডাক্তার ফুলসাহেব উপস্থিত হইলেন। সর্ব্বাগ্রে বৃদ্ধ তমীজ্উদ্দীনকে দেখিতে গেলেন। দেখিয়া বলিলেন, “না, জীবিত নাই;বুঝিতে পারিতেছি না, কেন এমন হঠাৎ মৃত্যু হইল।”
মতিবিবি বলিলেন, “কুলসমই যত অনর্থের মূল;যদি না আজ জলে ডুবিয়া মরিতে যাইত, তাহা হইলে কি এমন সর্বনাশ হয়!” তাহার দরবিগলিতধারে দুই গণ্ড প্লাবিত করিয়া অশ্রু ঝরিতেছিল তথাপি সেই মুখে একবার একটু হাসির রেখা ফুটিয়া উঠিয়া মিলাইয়া গেল।
অরিন্দম ডাক্তার ফুলসাহেবকে আনুপূর্বিক সমস্তই বলিলেন। ফুলসাহেব মনোযোগ দিয়া শুনিতে লাগিলেন। কেহ দেখিল না, তখন তাঁহার শ্মশ্রুগুম্ফশূন্য ওষ্ঠাধরের একপার্শ্বে একপ্রকার বিদ্রূপব্যঞ্জক হাসি খেলিয়া বেড়াইতেছিল। অরিন্দমের কথা শেষ হইলে ফুলসাহেব নিতান্ত বিনীতের ন্যায় বলিলেন, “মহাশয়ের নামটি কি, জানিতে পারি?”
অ। অরিন্দম বসু।
ফু। বটে!
সহসা ফুলসাহেবের মুখের ভাব পরিবর্ত্তিত হইয়া গেল, এবং সে ভাব সাম্লাইয়া তিনি আরও বিনীতভাবে বলিলেন, “মহাশয়ের কোথায় থাকা হয়? যদি কোন বাধা না থাকে—”
অ। রঘুনাথপুর;এখান হইতে তিন ক্রোশ পথ হইবে, কোন কাজে এখানে আসিয়াছিলাম। বলেন যদি আমি এখন যাইতে পারি।
ফুলসাহেব সে কথার কোন উত্তর না দিয়া, কুলসমের হাত ধরিয়া বলিলেন, “তুমি আর এখানে থাকিয়ো না, যেরূপ শুনিলাম, তাহাতে তোমার স্বাস্থ্য এখন তেমন ভাল বোধ করি না। যাও তোমার মাকে লইয়া তোমার ঘরে যাও।” তাহার পর অরিন্দমের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আপনি অনুগ্রহপূর্বক আর একটু অপেক্ষা করুন।”
কুলসম উঠিয়া দাঁড়াইল। কোন কথা কহিল না; কিন্তু সে এমন ভাবে একটা ঘৃণার দৃষ্টিতে একবার ডাক্তারের মুখের দিকে চাহিল—ডাক্তারই সে দৃষ্টির অর্থ বুঝিলেন। তখন ফুলসাহেবের মুখের ভাব অন্য কোন ভাবাপন্ন না হইলেও, একবার ক্ষণেকের জন্য ললাট কুঞ্চিত হইয়া মিলাইয়া গেল; সেই সঙ্গে তাঁহার সেই দৃষ্টিতে যেন একটা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইয়া, সেইরূপ চকিতে মিলাইয়া গেল। ফুলসাহেব বলিলেন, “যাও কুলসম, অবাধ্য হইয়ো না—তোমার মাকে সঙ্গে লইয়া তোমার ঘরে যাও।”
মতিবিবি উঠিয়া গেলেন। কুলসমও উঠিল। যাইবার সময়ে সে দ্বারসম্মুখে দাঁড়াইয়া অরিন্দমকে বলিল, “মহাশয়, আমাকে যদি সেই সময়ে মরিতে দিতেন, ভাল করিতেন। এখনও বলিতেছি, আপনি ভাল কাজ করেন নাই।” কুলসম দ্রুতপদে চলিয়া গেল।
তখন ডাক্তার ফুলসাহেব একটা অতি দীর্ঘ অস্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “কেহ মরিলে স্ত্রীলোকেরা যেন কাঁদিবার একটা মহা সুযোগ পায়—কাঁদিয়া বাড়ী ফাটাইতে থাকে, যত শীঘ্র উহাদের হাত হইতে মুক্তিলাভ করা যায়, সে চেষ্টা আমি আগে করি।” বলিয়া তিনি ভৃত্যদের নাম ধরিয়া ডাকিতে লাগিলেন। তিন-চারিজন ভৃত্য ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া আসিল। অরিন্দম দেখিলেন, তাহারা সকলেই সশঙ্ক, ত্রস্ত, সকলেই ডাক্তারবাবুকে অতিশয় ভয় করে। তাহাদের মুখভাবে ইহাও বেশ বুঝিতে পারা যায়, যেমন অতিশয় ভয় করে, তেমনি তাঁহাকে তাহারা মনে মনে অতিশয় ঘৃণাও করে।
ফুলসাহেব তখন ভৃত্যদের যাহাকে যাহা করিতে হইবে, বলিয়া দিলেন;তাহারা যে যাহার কাজে চলিয়া গেল। অরিন্দম চুপ করিয়া বসিয়াছিলেন, দুইবার তিনি যাইবার জন্য উঠিলেন, ডাক্তার ফুলসাহেব দুইবারই তাঁহাকে অপেক্ষা করিবার জন্য অনুরোধ করিলেন।
সেই মৃতদেহ সম্বন্ধে অন্যান্য বন্দোবস্ত করিতে ফুলসাহেবের আরও প্রায় অৰ্দ্ধ ঘণ্টা অতিবাহিত হইল। তাহার পর তিনি অরিন্দমকে বলিলেন, “অরিন্দমবাবু আরও যদি আপনি একটু অপেক্ষা করেন, ভাল হয়; আমি একবার মতিবিবি ও কুলসমের সঙ্গে দেখা করিয়া আসিতেছি; তাহার পর এক সঙ্গে যাইব, কি বলেন?”
অরিন্দম বলিলেন, “ক্ষমা করিবেন, আমার কিছু আবশ্যক আছে—অধিকক্ষণ বসিতে পারিব না—আমি উঠিলাম।”
ফুলসাহেব বলিলেন, “না না’ বসুন আপনি, আমি এখনই আসিতেছি; আপনার সঙ্গে দুই-একটি কথা আছে। আপাততঃ মতিবিবি আর কুলসমকে এ সময়ে যা’ যা’ করিতে হইবে, বলিয়া আসিতেছি এখনি আসিব।”
ফুলসাহেব উঠিয়া গেলেন।