দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : নতূন বিপদ
অনতিবিলম্বে কুলসমকে লইয়া অরিন্দম ও প্রতিবেশীচতুষ্টয় তমীজউদ্দীনের বাটীতে উপস্থিত হইল। সে সংবাদ অন্তঃপুরে পৌঁছাইতে বড় বেশী বিলম্ব হইল না। দুই-তিনজন ভৃত্য আসিয়া কুলসমকে লইয়া গেল। এমন সময়ে কুলসমের পিতা তমীজউদ্দীন সেখানে আসিলেন, পশ্চাতে তাঁহার স্ত্রীও আসিলেন। তমীজউদ্দীনের বয়স পঞ্চাশ বৎসর হইবে, তাঁহার দেহ জীর্ণশীর্ণ; জরাতুর অশীতিপর বৃদ্ধের ন্যায় তাঁহার শরীর কটিদেশ হইতে ভাঙিয়া সম্মুখের দিকে অতিশয় ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। চলিয়া আসিবার সময়ে মাতালের মত তাঁহার পা টলিতেছিল।
কম্পিতকণ্ঠে তমীজ্উদ্দীন অরিন্দমের দিকে স্নানদৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন, “মহাশয়, আপনি আমার কন্যাকে রক্ষা করিয়াছেন, আপনি যদি না দেখিতেন, তাহা হইলে যে আজ আমার—” বলিতে বলিতে বলিতে পারিলেন না, কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া সহসা ঘড়ঘড়ি উঠিল। আবার কথা কহিতে চেষ্টা করিলেন, সে চেষ্টা ব্যর্থ হইয়া গেল। মুখ, চোখ লাল হইয়া উঠিল এবং আপাদমস্তক কাঁপিতে লাগিল। তাঁহাকে পতনোন্মুখ দেখিয়া অরিন্দম ধরিয়া ফেলিলেন। দুই হস্তে তাঁহাকে তুলিয়া বহির্ব্বাটীর একটি প্রশস্ত কক্ষে শয়ন করাইয়া দিলেন।
সশঙ্কচিত্তে আর সকলে সেই স্থলে প্রবেশ করিল। অরিন্দম দেখিলেন ইতোমধ্যেই তমীজউদ্দীনের মৃত্যু হইয়াছে।
তমীজউদ্দীনের স্ত্রীর নাম মতিবিবি; তাঁহার বয়ঃক্রম অতি অল্প পঞ্চবিংশতির বেশী নয়, বরং তাঁহাকে আরও ছোট দেখায়। মতিবিবি আকুল হইয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। চুল ছিঁড়িয়া, হাত পা আছড়াইয়া, বুক চাপড়াইয়া, ডাক্ ছাড়িয়া উঠানে কাঁদিতে বসিলেন।
অরিন্দম একজন ভৃত্যকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ বাড়ীতে কোন্ ডাক্তার চিকিৎসা করেন?”
ভৃত্যের নাম আমেদ। আমেদ বলিল “ফুলসাহেব।”
অরিন্দম বলিলেন, “এখনই তাঁহাকে ডাকিয়া আন।”
ছুটিয়া আমেদ চলিয়া গেল। অরিন্দম তমীজউদ্দীনের দেহ উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে লাগিলেন। মনে করিতে লাগিলেন, হয়ত তমীজউদ্দীন জীবিত আছেন; বোধহয়, এ একপ্রকার মৃগীরোগ হইবে। মতিবিবিকে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন। মতিবিবি আরও কাঁদিতে লাগিলেন।
এমন সময়ে সেখানে দ্রুতপদে কুলসম প্রবেশ করিল। যেখানে তাহার পিতার মৃতদেহ পড়িয়া ছিল, সেইদিকে অগ্রসর হইতে হইতে বলিল, “বাবা–বাবা–বাবা! কি হয়েছে, তোমার? এই যে আমি, বাবা কথা কও।” পিতার বুকে মাথা রাখিয়া বসিয়া পড়িল।
অরিন্দম বলিলেন, “বোধহয়, তোমার পিতা জীবিত নাই। একজন ভৃত্য ডাক্তার ডাকিতে গিয়াছে।”
শুনিয়া শিহরিত হইয়া কুলসম উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার চক্ষুদ্বয় বিস্ফারিত হইল;কর্তৃত্বের ভাবে মাথা তুলিয়া, ঘাড় বাঁকাইয়া বলিল, “কোন্ ডাক্তার?”
অরিন্দম বলিলেন, “ফুলসাহেব নামে যিনি তোমাদের বাড়ীতে চিকিৎসা করিয়া থাকেন।”
শুনিয়া এরূপ সময়েও কুলসমের মুখে হাসি আসিল। সম্মুখে তাহার পিতার মৃতদেহ পড়িয়া, পার্শ্বে মাতা আকুল হৃদয়ে রোদন করিতেছেন, এ ভয়ানক সময়ে কুলসমের মুখে সেই হাসি যেন কেমন এক-রকম বড় অস্বাভাবিক দেখাইল। তাহার পর সে অস্ফুটস্বরে বলিল, “ফুলসাহেব? হবে।”তখন আবার সে পিতার বুকের উপরে পড়িয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “বাবা! কোথায় তুমি? আর যে কেউ আমার নাই! বাবা! আমার কি হবে!” তাহার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল, মাথা ঘুরিতে লাগিল, হাত পা অবশ হইয়া আসিল। বলিল, “ফুলসাহেব—শত্রু—আমার পিতার শত্রু আমার শত্রু—এ সংসারের শত্রু—পিশাচ—পিশাচ—কি সৰ্ব্বনাশ!” আর বলিতে পারিল না—তাহার কাতর-কম্পিত দেহলতা সেইখানে পড়িয়া মাটিতে লুটাইল; কুলসম মূৰ্চ্ছিত হইল।
অরিন্দম তাড়াতাড়ি উঠিয়া কুলসমকে ধরিলেন। তাহার পর মতিবিবিকে বলিলেন, “এ সময়ে আপনি আকুল হইয়া কাঁদিলে চলিবে না। কুলসম অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছে;এখন আপনাকেই সকল দিক্ দেখিতে হইবে।”
মতিবিবি কুলসমের পাশে আসিয়া বসিলেন—চোখে মুখে জলের ছিটা দিতে কুলসমের শীঘ্র জ্ঞান হইল।