অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : রেবতীর সন্দেহ
পত্র পড়িয়া রেবতীর মাথা ঘুরিয়া গেল। সর্ব্বাঙ্গ অবশ করিয়া যেন সমস্ত শোণিত হৃৎপিণ্ডে প্রবিষ্ট হইয়া গুরুভারে বুকটা বড় ভারী করিয়া তুলিল। তাহার অজ্ঞাতসারে তাহার মুখ দিয়া বাহির হইল, “আমি যে কিছুতেই ইহা বিশ্বাস করিতে পারিতেছি না।”
অরিন্দম বলিলেন, “যদুনাথ গোস্বামীর হস্তাক্ষরের সঙ্গে মিলাইয়া দেখিলেই বিশ্বাস করিতে পারিবে।”
রে। আমি তাহার হস্তাক্ষর জানি।
অ। এ কি তাঁহার হাতের লেখা নয়?
রে। তাঁহারই হাতের লেখা, এই সইও তাঁহার। গোঁসাই-ঠাকুর আমাদের গুরু হ’ন্, আবশ্যক মত আমাদের বাড়ীতে পত্রাদি পাঠাইতেন, তাহাতেই আমি তাঁহার হাতের লেখা ও সই অনেকবার দেখিয়াছি। দেখিলেই বেশ চিনিতে পারি। আপনি এ-পত্র কোথায় পাইলেন?
অ। যদি আমাকে বিশ্বাস করিতে পার, কোন কথা গোপন করিয়ো না। তুমি কে, কোথায় তামার বাড়ী, পিতার নাম কি, এই কেশববাবু কে, গোরাচাঁদ কে, তোমার অবস্থান্তরের কারণ কি, তুমি যাহা জান, সমস্তই অকপটে আমায় বল, আমার দ্বারা তোমার কোন অনিষ্ট হইবে না।
রেবতী পুনরপি বলিল, “আপনি এ পত্রখানা কোথায় পাইলেন?”
অরিন্দম বলিলেন, “কাল রাত্রে গোঁসাই-ঠাকুরের সঙ্গে পরামর্শ শেষ করিয়া যখন পত্রখানি লইয়া গোরাচাঁদ বাহির হয়, তখন আমি এই পত্রখানি হস্তগত করিবার জন্য তাহার অনুসরণ করি। পথে দুই-একটি কথায় তার সঙ্গে আলাপ করিয়া তোমার কথা তুলি, তোমার মৃতদেহ দেখাইবে বলিয়া, সে আমাকে একটি নির্জ্জন প্রান্তে লইয়া গিয়া, হত্যা করিবে মনে করিয়া আমাকে তার সঙ্গে যাইতে বলে। আমি তাহা বুঝিতে পারিয়াও তাহার সঙ্গে যাই। সেখানে সেই নিৰ্জ্জনে আমাকে একা পাইয়া সে যেমন আমাকে ছুরি মারিতে আসে, আমি তাহাকে মাটিতে ফেলিয়া তাহার বুকের উপর উঠিয়া বসি; সেই সময়েই আমি তাহার অজ্ঞাতসারে এই পত্রখানি হস্তগত করিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিই।”
রেবতী সন্দিগ্ধমনে বলিল, “বুঝিতে পারিতেছি না, আপনার মনের অভিপ্রায় কি? কেনই বা আপনি এই সকল ব্যাপারে লিপ্ত হইয়াছেন?”
অ। আমি একজন পুলিশকর্ম্মচারী। তোমার বিপদের কথা আমি অনুমানে কিছু কিছু বুঝিতে পারিয়াছি। যে সঙ্কল্প করিয়া আমি এ কাজে হাত দিয়াছি, তোমাকে এই উপস্থিত বিপদের মুখ হইতে দূরে রাখিতে পারিলে, তাহা অনেকটা সফল হইবে।
রেবতীর মনের অবস্থা তখন কিরূপ, তাহা ঠিক বর্ণনা করা যায় না। অবিশ্বাস এবং সংশয়, ভয় এবং বিস্ময়, উৎকণ্ঠা এবং হতাশা, এবং ঘোরতর সন্দেহ এইসকল একত্রে মিলিয়া তাহার দুৰ্ব্বল হৃদয়কে মথিত করিতেছিল। রেবতী অস্থিরচিত্তে বলিল, “আপনি যদি পুলিস-কৰ্ম্মচারী তবে গোরাচাঁদকে ধরিয়া আবার ছাড়িয়া দিলেন কেন?”
অরিন্দম বলিলেন, “ছাড়িয়া দিয়াছি বটে, যখনই মনে করিব, তখনই আবার তাহাকে ধরিব তাহার মুখখানি যখন একবার চিনিয়া লইতে পারিয়াছি সে তখন ধরা পড়াই আছে। শীঘ্র শীঘ্র একটি লোককে গ্রেপ্তার করা আমার অভ্যাস নহে। তাহাতে শীঘ্র পাপী ধৃত হয় বটে, শীঘ্র বিচারে তাহার যাহা হয়, একটা দণ্ডও হয়; সে দণ্ড অনেক স্থলে কোথায় লঘু পাপে গুরু—কোথায় গুরু পাপে লঘু। যাহাকে বন্দী করিয়া বিচারালয়ে দিতে হইবে, তাহার যাহা কিছু জানিবার সমস্তটুকু যতক্ষণ না জানিতে পারি; নিজের পাপের কথা, নিজের স্বভাব চরিত্রের কথা সে যেমন নিজে জানে, আমিও সেইসকল ঠিক তাহারই মতন যতক্ষণ না সম্পূর্ণরূপে জানিতে পারি, ততক্ষণ তাহাকে আমি গ্রেপ্তার করি না। বুঝিয়াছি, তাহাকেছাড়িয়া দিয়াছি বলিয়া, তুমি আমাকে সন্দেহ করিতেছ। এখনও বলিতেছি, ইহাতে তোমার ভাল হইবে না। যদি আমাকে বিশ্বাস করিতে পার, কোন কথা আমার কাছে গোপন করিও না—তুমি কে, তোমাদের বাড়ী কোথায়, তোমার পিতার নাম কি, তোমার এই দুরবস্থার কারণই বা কি, এসকল তুমি যাহা জান, সমস্ত আমাকে অকপটে বলো;আমি বার বার বলিতেছি, আমার দ্বারা তোমার কোন অনিষ্ট হবে না।”