পঞ্চদশ অধ্যায় : মল্লযুদ্ধ
সেই অপরিচিত লোকটি অরিন্দমকে সঙ্গে লইয়া চলিল, উভয়েই নীরব; তিন-চারিটি বড় বড় জলাভূমি পার হইয়া চলিল। অবশেষে এমন এক স্থানে উভয়ে আসিয়া পড়িল যে, সেখান হইতে লোকালয়ের কোন চিহ্নই দেখিতে পাওয়া যায় না। রাত্রিকালে—রাত্রির কথা দূরে থাক্, কেহ কাহাকে হত্যা করিতে ইচ্ছা করিলে, এমনকি সেখানে প্রশস্ত দিবালোকে সে নির্বিঘ্নে সে কাজ সমাধা করিতে পারে।
সেই অপরিচিত ব্যক্তি সেইস্থানে আসিয়া মৃতদেহ খুঁজিবার ভানে নিকটস্থ একটি জঙ্গলের এদিক্ ওদিক্ দেখিয়া বলিল, “তাই ত বড়ই আশ্চর্য্য ব্যাপার!”
অরিন্দম সে কথায় কোন উত্তর করিলেন না।
অপরিচিত লোকটা আবার অরিন্দমকে শুনাইয়া বলিল, “তাই ত বড় আশ্চর্য্য ব্যাপার!”
তখনও অরিন্দম নীরব।
অপরিচিত। কই হে, লাসটা যে দেখতে পাচ্ছি না।
অরিন্দম। কোথায় গেল?
অপ। কি করিয়া বলিব?
অ। তোমার মনের কথাটা কি, ভেঙে বল দেখি?
অপ। তুমি কি মনে কর?
অ। আমি মনে করি, তুমি একটি ভয়ানক ধড়ীবাজ লোক। এর বেশী আর কি মনে করতে পারি? এখন কি মনে করে আমাকে এখানে নিয়ে এলে, প্রকাশ করে বল দেখি?
অপ! এই যে প্রকাশ করছি।
এই বলিয়া লোকটা একখানি দীর্ঘ ছুরি বাহির করিয়া অরিন্দমের দিকে অগ্রসর হইল। অরিন্দম একান্ত ভয়ার্ডের ন্যায় কাতরকণ্ঠে দুই হাত তুলিয়া বলিলেন, “কর কি কর কি—মের নামের না—দোহাই তোমার—দোহাই তোমার!”
অপরিচিত ব্যক্তি বলিল, “যদি তুমি আমার কথার ঠিক্ ঠিক্ জবাব দাও আমি তোমায় কিছু বলিব না।”
অরিন্দম বলিলেন, “বল, কি বলিতে হইবে?”
অপরিচিত ব্যক্তি বলিল, “সকল কথাই তোমাকে বলিতে হইবে; তুমি কে, তোমার নাম কি, কোথায় থাক, কি কর, কেনই বা আমার পিছু নিয়েছ?”
অরিন্দম বলিলেন, “আমি আবার কে? দেখছনা, একটি লোক আর কি, নামটা বড় ভাল নয়, কৃতান্তবাবু। থাকি খুনে-লোকের সঙ্গে সঙ্গে; করিবার মধ্যে তোমাদের মতন বদমায়েদের ধরিয়া বেড়াই—আর তোমার যে পিছু নিয়েছি, কেবল তোমাকে ধরিবারই জন্য।”
অপ। কেন, আমি কি খুনী?
অ। সে বিষয়ে আর সন্দেহ আছে? তা’ না, হ’লে এত বড় একখানা ছুরি নিয়ে তুমি দিনরাত ঘুরে বেড়াও।
অপরিচিত ব্যক্তি আবার সেই ছুরি লইয়া অরিন্দমকে মারিতে গেল। অরিন্দম আবার সেইরূপ—যেন কত ভয় পাইয়াছেন, এইরূপ ভাব দেখাইলেন; অনেক কাকুতি-মিনতি করিয়া সেবারও পার পাইলেন। অপরিচিত ব্যক্তি বলিল, “এখন বল্, তুই কে, কোথায় থাকিস্?”
অরিন্দম বলিলেন, “বলছি—বলছি—ঐ যে অনেক দূরে একটি নারিকেলগাছ দেখছ—তার পরে আরও দূরে একটি তালগাছ—ঐ জ্যোৎস্নার আলোকে বেশ দেখা যাচ্ছে।” এই বলিয়া তাহার পাশে দাঁড়াইয়া অরিন্দম অঙ্গুলি নির্দেশে দেখাইতে লাগিলেন। বস্তুতঃ সেখানে তালগাছ কি নারিকেলগাছ—কিছুই ছিল না।
অঙ্গুলিসঙ্কেতনীতনয়নে চাহিতে চাহিতে অপরিচিত ব্যক্তি বলিল, “কই হে, কোথায় তোমার তালগাছ?”
অরিন্দম পাশে দাঁড়াইয়াছিলেন, তখনই সুবিধা বুঝিয়া আগে তাহার হাত হইতে সেই ছুরিখানা কাড়িয়া লইলেন; সঙ্গে সঙ্গে তাহার পায়ের উপর পা দিয়া চাপিয়া এমন এক ধাক্কা দিলেন যে, সে ধাক্কা তাহাকে আর সাম্লাইতে হইল না, সশব্দে সেইখানে পড়িয়া গেল। তাহার পর অরিন্দম তাহার বুকের উপর চাপিয়া বসিলেন। লোকটি জোর করিতে লাগিল। অরিন্দম তাহার গলাটি বাম হাতে চাপিয়া ধরাতে সে গোঁ গোঁ শব্দ করিতে লাগিল। লোকটি একটু অবসন্ন হইয়া পড়িলে, তাহার গলাটি ছাড়িয়া দিয়া অরিন্দম বলিলেন, “কিগো, বড় যে বাড়াবাড়ি আরম্ভ করেছিলে? এখন আমি কি করি বল দেখি, তোমায় ছেড়ে দিই, না তোমার প্রাণটা এইখানকার বাতাসের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে যাই?”
অপরিচিত লোকটি কোন উত্তর করিল না।
অরিন্দম বলিলেন, “না, তোমার মত একটি এতবড় কাৎলাকে যেকালে ছিপে গেঁথেছি, তখন হঠাৎ তুলে ফেলা হবে না—ভাল ক’রে না খেলিয়ে তুলে হাতের সুখ হবে না।” তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন। বলিলেন, “মনে ক’রো না, এখন ছাড়িয়া দিলাম বলিয়া, তুমি আমার হাত হইতে নিস্তার পাইলে; যখনই মনে করিব, তখনই আবার তোমাকে ধরিব। কোন একটু আবশ্যক ছিল বলিয়াই তোমাকে এতটা বিরক্ত করিলাম। আবার যখন কোন আবশ্যক বোধ করিব তখন তোমার সঙ্গে দেখা করিব। যাও, এখন কথা না কহিয়া এই সোজা পথটি ধরিয়া স্বস্থানে প্রস্থান কর;নতুবা তোমার ছুরি তোমারই বুকে বসাতে কুণ্ঠিত হব না।”
অপরিচিত ব্যক্তি মাথা হেঁট করিয়া, কথাটি মাত্র না কহিয়া তথা হইতে খুব একটি নিরীহ ভাল মানুষের মত ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।