একাদশ পরিচ্ছেদ : জবানবন্দি
পাঠক, এখন কেশবচন্দ্র, গোরাচাঁদ, মোহিনী ইত্যাদির কথা রাখিয়া তৃতীয় পরিচ্ছেদে যে দুর্ঘটনার কথা বলিতেছিলাম, তাহাই এখন আমাদিগের আখ্যায়িকার পুনরবলম্বন হইল। সেই দীর্ঘিকার অদূরবর্তী জঙ্গলমধ্যে যে রক্তমাখা কাপড়, দীর্ঘ ছুরি ইত্যাদি পড়িয়াছিল, তাহা লইয়া পরদিন প্রত্যুষে গ্রামমধ্যে এমন একটা হৈ-চৈ পড়িয়া গেল যে, কথাটা রঞ্জিত—ক্রমে অতিরঞ্জিত হইয়া গ্রামবাসী আবালবৃদ্ধবনিতার মুখে মুখে ফিরিতে লাগিল।
গোবর্দ্ধনের ঘরের সম্মুখে স্নিগ্ধচ্ছায়াচ্ছন্ন বটগাছের তলায় তৃণাস্তরণে বসিয়া হুঁকা হস্তে, কাসিকণ্ঠে, গম্ভীরমুখে এবং স্তিমিতনেত্রে প্রাচীনেরা সেই কথারই আলোচনা করিতে লাগিল। ঘাটে কলসী কক্ষে বামা, উচ্ছিষ্ট-মলিন তৈজস-স্তূপহস্তে শ্যামা, একরাশি ক্ষারসিদ্ধ বস্ত্রস্কন্ধে শম্ভুর মা, এবং তৈলাক্তদেহে কামিনী সেই প্রসঙ্গের উপরে নিজেদের মতামতের এক একটা অলঙ্ঘ্য দৃঢ় ব্যবস্থা করিতে লাগিল
প্রভাতোদয়ের সঙ্গে যোগেন্দ্রনাথ ও অরিন্দম ঘটনাস্থলে দেখা দিলেন। সঙ্গে পাঁচ-সাতজন পাহারাওয়ালাও আসিল। বলাই মণ্ডল ও তাহার সঙ্গিগণের জবানবন্দি অরিন্দম একে একে লিপিবদ্ধ করিয়া লইলেন। তাহারা যাহা জানিত, ঠিক ঠিক বলিয়া গেল; জেরার ঘোর-ফেরে তাহাদের বড়- একটা পড়িতে হইল না। যেখানে একটু মিথ্যার গন্ধ আছে, সেইখানে গোলযোগ; সেই গোলযোগে যদুনাথ গোস্বামী একটু জড়াইয়া গেলেন। অরিন্দম তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কাল রাত্রে তেমন দুৰ্য্যোগে কোথা হইতে আসিতেছিলেন?“
যদু। গোঁসাই পাড়ায় আমার ভগ্নীপতির বাড়ী, আমার ভগ্নী পীড়িতা, তাই তাহাকে দেখিতে গিয়াছিলাম। সেইখান হইতে ফিরিতেছিলাম।
অরি। ফিরিয়া অসিবার সময়ে আপনি কি আগে এই রক্তমাখা কাপড় দেখিতে পাইয়াছিলেন?, না, আপনার সঙ্গে আর কেহ তখন ছিল, সে আপনাকে দেখাইয়া দিয়াছিল?
য। না, আমার সঙ্গে আর কেহ ছিল না, আমিই আগে দেখিতে পাই।
অ। ভাল, দেখিবার পূর্ব্বে এই জঙ্গলের মধ্যে যাইবার আপনার তখন কোন আবশ্যক হইয়াছিল কি?
য। না, আমি উহার ভিতরে যাইব কেন?
অ। তবে কেমন করিয়া আপনি যে তেমন অন্ধকারে ঐ কাপড়খানা জঙ্গলের ভিতরে পড়িয়া থাকিতে দেখিতে পাইলেন, বুঝিতে পারিতেছি না।
য। কেন? বিদ্যুতের আলোতে আমি দেখিতে পাইয়াছিলাম।
অ। কাপড়খানা দেখিবার পর, বলাই মণ্ডলের সঙ্গে দেখা হইবার আগে আপনি ঐ জঙ্গলের মধ্যে ঢুকিয়াছিলেন?
য। [ ক্ষণেক চিন্তা]
অ। বলুন না, ইহাতে ভাবিয়া বলিবার কি আছে?
য। না।
অ। এই চল্লিশোর্দ্ধ বয়সেও আপনার দৃষ্টিশক্তি এরূপ তীক্ষ্ণ আছে দেখিয়া আশ্চর্য হইলাম। দিবালোকে চেষ্টা করিয়া দেখিলে বাহির হইতে বোধ হয়, এ কাপড়খানা কিছুতেই দেখিতে পাওয়া যাইত না;রাত্রে বিদ্যুতের আলোকে তাহাও আপনি দেখিতে পাইয়াছিলেন;তা’ ছাড়া কাপড়খানা যে রক্তমাখা, তাহাও বাহির হইতে আপনি স্থির করিতে পারিয়াছিলেন। কেমন গোস্বামী মহাশয়, এসকল যেন কিছু অসম্ভব বলিয়া বোধ হইতেছে না?
য। আপনি কি মনে করিতেছেন যে আমি আপনাকে মিথ্যা কথা বলিলাম?
অ। তা’ কি মনে করিতে পারি? তবে যে আপনি সত্যকথা বলিতেছেন, ইহাও মনে করিতে পারিতেছি না। দেখুন, গোস্বামী মহাশয়, আপনি আমাকে বলাই মণ্ডলের মত একজন সরল বিশ্বাসী বলিয়া মনে করিবেন না যে, আপনি যাহা বলিয়া যাইবেন, তাহাই বিশ্বাস করিব। আর আমরা চোখ-বাঁধা বিশ্বাসেও কোন কাজ করি না। প্রত্যেক লোকের প্রত্যেক কথাটির উপরে সন্দেহ করিয়া করিয়া তবে একটি সূত্র পাই; সেই সূত্র ধরিয়াই আমাদের কাজ করিতে হয়। যতক্ষণ লোকে কোন বিষয় গোপন না করিয়া অকপটচিত্তে প্রকৃত কথা আমাদিগকে শুনাইয়া যায়, ততক্ষণ আমরা আমাদের কার্য্যোদ্ধারের কোন উপায় দেখিতে পাই না। তাহার ভিতর একটু মিথ্যার ছায়া দেখিতে পাইলেই অনেকটা আশা করিয়া থাকি আপনার দুই একটি কথা শুনিয়াই আমার মনে সেই রকমের অনেকটা আশা হইয়াছে যে, আমি আপনার সাহায্যেই শীঘ্র কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিব। আপনি যেন এ খুন- রহস্যের ভিতর একটু-না-একটু জড়িত আছেন, আপনার কথা শুনিয়া এমন একটু বোধ হইতেছে। দেখা যাক্, কি হয়।
য। [রাগভরে] না হয়, আমিই, খুন করিয়াছি, আমাকেই তবে চালান দিন্। সাত পো অধৰ্ম্ম না হ’লে কেউ পুলিসের হাঙ্গামে পড়ে না। আপনারা থানার লোক, আপনারা সব করতে পারেন।
অ। [ মৃদুহাস্যে] আঃ! আপনি রাগ করেন কেন? আপনি এখন স্বচ্ছন্দে স্বস্থানে প্রস্থান করতে পারেন, আপনাকে আর আমার কোন কথা জিজ্ঞাসা করবার নাই।
যদুনাথ গোস্বামী মুখ ভার করিয়া তথা হইতে চলিয়া গেলেন। যতক্ষণ তাঁহাকে দেখা গেল, অরিন্দম তাঁহার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন।