পঞ্চম পরিচ্ছেদ : মৰ্ম্মাহতা
অনতিবিলম্বে রুদ্ধদ্বার উদ্ঘাটন করিয়া এক ব্যক্তি সেই প্রকোষ্ঠমধ্যে প্রবেশ করিল। বালিকার শয়নের নিমিত্ত এক কোণে একটি কদর্য্য শয্যা ছিল, লোকটা তাহার উপর বসিল। বালিকা সেই শয্যার পার্শ্বেই দাঁড়াইয়া ছিল। তাহাকে নিকটস্থ হইতে দেখিয়া বালিকা অপর পার্শ্বে সরিয়া দাঁড়াইল।
সেই আগন্তুকের বয়স চল্লিশ বৎসরের কম নহে;কিন্তু তাহাকে দেখিয়া বত্রিশ বৎসরের অধিক বলিয়া বোধ হয় না। তাহার দেহ বলিষ্ঠ, হস্তপদাদি মাংসপেশীতে স্ফীত, বক্ষ উন্নত, প্রশস্ত এবং অটুট স্বাস্থ্যের ও অতুল শক্তির পরিচায়ক। মুখাকৃতি মন্দ নহে; তবে একসময়ে যৌবনের প্রারম্ভে ঐ মুখাকৃতি যে দেখিতে সুন্দর ছিল, সে অনুমানটা এখনও সহজেই করা যায়। দেহের বর্ণ গৌর।
বালিকাকে সম্বোধন করিয়া আগন্তুক বলিল, “রেবতী, কতদিন আর এমন যন্ত্রণা ভোগ করিবে? আমার কথায় আর অমত্ করিয়ো না। তোমার জন্য আমি এতদূর লালায়িত দেখিয়াও কি তোমার মনে একটুমাত্র দয়া হয় না?”
রেবতী কোন কথা কহিল না।
আগন্তুক আবার বলিল, “রেবতী, কথা কও, এতদূরে আসিয়া তোমার একটি মিষ্টবাক্য শুনিব, এমন অদৃষ্টও কি আমার নয়?”
রেবতী মৃদুনিক্ষিপ্তস্বরে বলিল, “আমি এখনও বলিতেছি, এ জীবন থাকিতে আমি কখনই তোমার প্রস্তাবে সম্মত হইব না। তোমাকে বিবাহ করিয়া, শত দাস-দাসী-পরিবেষ্টিত হইয়া অতুল ঐশ্বৰ্য্য উপভোগ করা অপেক্ষা এই বননিবাসে চিরবন্দিনী হইয়া থাকাও এখন আমার পক্ষে অতুল সুখ।”
আগন্তুক কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া, কি ভাবিয়া একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “তবে এই অতুল সুখের চিরজীবনটা এখানে কাটাও কিন্তু নিশ্চয় জানিয়ো, আমার কথা না শুনিলে কিছুতেই পরিত্রাণ নাই। তুমি যত কঠিন হইবে, আমিও কঠিন হৃদয়ে তোমার উপরে সেইরূপ কঠিন কঠিন ব্যবস্থাও ক্রমে চালাইতে থাকিব। চিরদিন আমি তোমার নিকটে এমনই বিনীত, এমনই অনুগ্রহপ্রার্থী থাকিব না; যেকোন প্রকারে হউক, আমি আমার কার্য্যোদ্ধার করিবই। এখন আমার বিবাহিতা স্ত্রী হইয়া যে সুখভোগ করিতে অনিচ্ছুক, তখন আমার উপপত্নী হইয়া স্বেচ্ছায় সে সুখের জন্য লালায়িত থাকিবে। এখন বুঝিতেছি, যতদিন তুমি সেই দেবা ছোঁড়াটাকে ভুলিতে না পারিবে, ততদিন আমার কথায় কিছুতেই সম্মত হইবে না। ভাল, শীঘ্রই তাহার ছিন্নমুণ্ড এইখানেই তোমার পদতলে বিলুণ্ঠিত হইতে দেখিবে।”
এই বলিয়া আগন্তুক এমন ভ্রুকুটিকুটিলমুখে সেই সরলা বালিকার দিকে চাহিল যে, বালিকা কি বলিতে যাইতেছিল, ভয়ে বলিতে পারিল না—ভয়ে তাহার কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসিল। তাহার শিরায় শিরায় উচ্ছ্বসিত রক্তস্রোত বিদ্যুদ্বেগে বহিয়া হৃৎপিণ্ড পূর্ণ করিতে লাগিল। বালিকা কাঁদিয়া ফেলিল—তাহার নিষ্প্রভতার চক্ষু দিয়া দরবিগলিতধারে অশ্রু বহিতে লাগিল।
ভীতবিহ্বলা রেবতী আগন্তুকের সম্মুখে আসিয়া, ক্ষিতিতলন্যস্তজানু হইয়া, বাত্যাবিচ্ছিন্ন- বাসন্ত্যবল্লরীবৎ ধূলিবলুণ্ঠিত হইয়া, বুকফাটা কণ্ঠে কাঁদিয়া বলিতে লাগিল, “কেশববাবু, আমি মাতৃপিতৃহীনা, দুর্ভাগিনী। আমার মুখ চাহিয়া, আমার এই যন্ত্রণা দেখিয়া কি তোমার কিছুমাত্র দুঃখ হয় না? দয়া হয় না? আমার কাকার সঙ্গে তোমার কত হৃদ্যতা—কাকা তোমায় কত যত্ন করেন, আমি ত তাঁহারই ভ্রাতুষ্পুত্রী। তবে কেন আমাকে এখানে রাখিয়া এমন অসহ্য পীড়ন করিতেছ? তুমি আজ প্রায় এক বৎসর ধরিয়া আমাদের বাড়ীতে কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করিতে প্রত্যহ যাইতে; আমাকে—আমার ছোট বোনকে তুমি কতই না স্নেহ করিতে কতই না ভালবাসিতে; কিন্তু সে ভালবাসায় ত এমন কোন অন্যভাব ছিল না। কাকাবাবু আমাদিগকে যেমন ভালবাসিতেন, তুমিও আমাদের সেইরূপ ভালবাসিতে; তখন ত তোমার চোখে একদিনের জন্য এ কলুষিত স্পৃহার কোন চিহ্ন ফুটিতে দেখি নাই। আমি তোমাকে পিতার ন্যায় ভক্তি করিতাম; সে ভক্তির বিনিময়ে আমি যে স্নেহ তোমার কাছে আকাঙ্ক্ষা করিতে পারি, তাহা না দিয়া তুমি আমার কাছে এ কি জঘন্য প্রস্তাব করিতেছ? কেশববাবু, আমাকে ছাড়িয়া দাও, আমাকে আমার বাড়ীতে পাঠাইয়া দাও; আমি প্রাণান্তে এসকল কথার একটি বর্ণও প্রকাশ করিব না। না জানি, আমার জন্য সেখানে এখন কী হাহাকারই পড়িয়া গেছে!”