Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মায়াবী || Panchkari Dey

মায়াবী || Panchkari Dey

মোহিনী ক্রমে আকুল হইয়া উঠিল। মোহিনী দিন-রাত কাহার কথা ভাবে, মোহিনী নিৰ্জ্জনে পা ছড়াইয়া কাঁদিতে বসে, মোহিনী কাঁদিবার সময় বুকে করাঘাত করে, এবং দুই হাতে নিজের মাথার চুল ছিঁড়িতে যায়। কখনও বা মোহিনী কাঁদিতে কাঁদিতে হাসে, আবার হাসিতে হাসিতে কাঁদে মোহিনী পাগল হইয়াছে, অথবা হইতে বসিয়াছে। মোহিনীর আর সে বিদ্যুদ্বর্ষী কটাক্ষ নাই; মোহিনীতে মোহিনী আর নাই। মোহিনীর এত দুঃখ কিসের? বলিতেছি।

অন্ধকার রাত্রি—পোহাইতে আর বড় বিলম্ব নাই। অনেকক্ষণ পূর্ব্বে একবার বেশ একপশলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে; তথাপি এখনও সমস্ত আকাশ মেঘ করিয়া রহিয়াছে, গগন ব্যাপিয়া মেঘ আরও নিবিড় হইতেছে; দেখিয়া বোধ হয়, আর এক পশলা না ঢালিয়া এক পা নড়িতেছে না। দুই-একটি রবের জন্য এই নীরব রজনীকে একেবারে নীরব-নিস্তব্ধ বলিতে পারা যায় না; সম্মুখস্থ নদীটির কলকলনাদ—নিরন্তর;নদীতীরস্থ লক্ষ ঝিল্লীর সমবেত আর্তনাদ—(আৰ্ত্তনাদই বটে!) ইহাও নিরন্তর নীড়স্থ বিনিদ্র কোন পক্ষীর পক্ষস্পন্দনশব্দ—কদাচিৎ; পার্শ্ববর্ত্তী লোকালয় হইতে কোন নিদ্রোত্থিত শিশুর করুণ ক্রন্দন—ক্বচিৎ; অনতিদূরস্থ কুক্কুর-রব—ইহাও ক্বচিৎ। নদীবক্ষে তরঙ্গে তরঙ্গে যে মেঘের ছায়া ও অন্ধকার একসঙ্গে নৃত্য করিতেছিল, তটে বসিয়া এক ব্যক্তি সেইদিকে অন্যমনে চাহিয়াছিল। তখন মেঘের সঙ্গে অন্ধকার আরও ঘনীভূত হইয়া অন্ধকারময় নদীবক্ষ আরও মসীম করিয়া তুলিতেছিল। বায়ু নিজের অস্তিত্ব সপ্রমাণ করিবার জন্য এক-একবার অল্প-স্বল্প চেষ্টা করিতেছিল—চেষ্টা মাত্ৰ।

নদীতটস্থ লোকটির পশ্চাতে, কিছুদূরে মোহিনী শাণিত ছুরিকা-হস্তে নিঃশব্দপদসঞ্চারে অগ্রসর হইতেছিল;এবং পিশাচীর চোখের মত তাহার চোখ দুটা উল্কাপিণ্ডবৎ, সেই সূচীভেদ্য অন্ধকারে বড় ভয়ানক জ্বলিতেছিল।

যখন মোহিনী প্রায় তার নিকটস্থ হইয়াছে, তখন সেই লোকটি মুখ না ফিরাইয়াই মৃদুহাস্যে বলিল, “মোহিনী, আজ আবার জ্বালাইতে আসিয়াছ? আর নিকটে আসিয়ো না—আমাকে মারিবে কি? তাহা হইলে তুমি নিজেই মরিবে।”

হতাশ হইয়া বিস্মিতের ন্যায় মোহিনী সেইখানে দাঁড়াইল। আর অগ্রসর না হইয়া বলিল, “আমি ত মরিয়াছি—এমন মরণ আর কি আছে? কিন্তু বিনোদ, আজও তুমি বড় বাঁচিয়া গেলে। একদিন—এমন দিন আসিবে, সেইদিন দেখিবে, এই ছুরিখানা তোমার বুকে আমূল বিদ্ধ রহিয়াছে।”

বিনোদলাল বিদ্রূপের হাসি হাসিয়া বলিল, “পাঁচ বৎসরের ছেলেকে এমন ভয় দেখান অসঙ্গ ত নয়; আমাকে কেন, মোহিনী?”

সে কথায় মোহিনী কোন উত্তর করিল না।

বিনোদলাল বলিল, “দেখ মোহিনী! তুমি এ সঙ্কল্প ত্যাগ কর, তুমি আমাকে হত্যা করিবে কি? কোন ক্রমে তুমি আমার গায়ে একটি আঁচড়ও দিতে পারিবে না;কিন্তু আমি যদি একবার ইচ্ছা করি, তখনই তোমার জীবনটা একেবারে শেষ করিয়া দিতে পারি; সে ক্ষমতা আমার আছে কি না, তাহা যে তুমি না জান, এমন নহে। তোমাকে যদি আমার তেমনই একটা শত্রু বলিয়া বোধ হইত—তোমার দ্বারা আমার কোন একটা অনিষ্ট হইতে পারে, তাহার একটু সম্ভাবনাও থাকিত, তাহা হইলে বিনোদলাল এতদিন তোমার সকল অপরাধ উপেক্ষা করিয়া তোমাকে বাঁচাইয়া রাখিত না। তুমি জান, আমার সন্ধানে কত গোয়েন্দা ফিরিতেছে—জীবিত কি মৃত, যেরূপ অবস্থায় হউক, তাহারা আমাকে ধরিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছে; আমি কি সেজন্য একটু ভয় করি—না একটু ভাবি? আর তুমি ত একটা স্ত্রীলোক—তোমাকে দেখিয়া—না তোমার হাতের ওই ছুরিখানা দেখিয়া আমি ভয়ে হতজ্ঞান হইব? সেইজন্য বলিতেছি, মনে করিয়ো না, আমি ভয় পাইয়া তোমাকে একথা বলিতেছি—তোমাকে ভালবাসি বলিয়াই বলিতেছি। এখনও আমি তোমাকে আগেকার মত তেমনই সুখে রাখিতে প্রস্তুত আছি; সেইরূপ বড় বাড়ীতে থাকিবে—দাস-দাসী থাকিবে; আর যাহা চাহিবে, তাহাই তখনি পাইবে—কিছুরই অভাব তোমাকে অনুভব করিতে হইবে না। এরূপ পথে পথে ঘুরিয়া কতদিন কাটাইবে?”

মোহিনী এক-একটি করিয়া বিনোদের সকল কথাই অত্যন্ত মনোযোগের সহিত শুনিতেছিল, আর ক্রোধে তাহার আপাদমস্তক জ্বলিতেছিল—ক্ৰমে অসহ্য হইয়া উঠিল; ক্ৰোধকম্পিতস্বরে বলিল, “পিশাচ, আবার প্রলোভন? মনে করিয়াছ মোহিনী আবার তোমার প্রলোভনে ভুলিবে? এখনও কি তৃপ্ত হও নাই? এখনও কি তোমার মনের বাসনা পূর্ণ হয় নাই? কোন্ সুখের আশায় আবার আমি তোমার দয়া ভিক্ষা করিব? যে ধর্ম্ম একবার হারাইলে আর তাহা ফিরাইয়া পাইবার নহে, তোমার কুহকে তাহাও গিয়াছে। মনে করিয়াছ, আবার, তোমার মোহমন্ত্রে ভুলিয়া মুসলমানী হইব? কখনই না। তুমি আমার কী সর্বনাশ না করিয়াছ? ধর্ম্মভ্রষ্টা রমণীর পরিণাম যে কি, তাহা আমি এখন দেখিতেছি, তুমিও দেখিতেছ, জগতে সকলেই দেখিতেছে—কিন্তু তুমি যে একজন বিধবার সৰ্ব্বস্ব হরণ করিয়া তাহাকে পথের ভিখারী করিয়াছ, ইহাতে কি তোমায় পাপের কোন ফলভোগ করিতে হইবে না? আজ দশ বৎসরের কথা বলিতেছি, যখন আমার বয়স আঠারো বৎসর, যখন প্রবল পরাক্রমে যৌবন এ অসহায় হৃদয়ে কী এক আত্মবিস্মৃতির তুমুল বিপ্লব উপস্থিত করিয়াছিল, যখন দিনান্তে একবারও মনে করিতে পারিতাম না যে—আমি বালবিধবা;কবে বিবাহ হইয়াছিল? কাহার সহিত? কে তিনি? কেমন? এখন কোথায়? এসকল স্মৃতি যখন উদ্দাম যৌবনের আত্মবিস্মৃতিময় সেই তুমুল বিপ্লবের ভিতর হারাইয়া গিয়াছিল, মনে পড়ে কি, তখন তুমি কোন্ নরকের সহস্র প্রলোভন লইয়া, আমার তৃষিত লালসাময় চোখের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলে? সহজেই তুমি এ অসহায় হৃদয় করতলগত করিলে। ক্রমে আমায় নরকের দিকে টানিয়া আনিলে, নিতান্ত মন্ত্রমুগ্ধার ন্যায় আমি তোমার অনুসরণ করিলাম। তখন একবার জন্মদাতা পিতার মুখ চাহিলাম না—স্নেহময়ী জননীর মুখ চাহিলাম না—উপরে যে ধর্ম্ম রহিয়াছে, সে কথাও একবার ভাবিলাম না—কুক্কুরীর ন্যায় তোমার অনুসরণ করিলাম; শেষে স্বামীদত্ত প্রায় সাত হাজার টাকার গহনা লইয়া তোমার সহিত কুলের বাহির হইলাম। তুমি একে একে দুই বৎসরের মধ্যে সে সকলই আত্মসাৎ করিয়া আমাকে পদাঘাতে দূর করিয়া দিলে। এমনই অর্থপিশাচ তুমি, কিছুদিন পরে অর্থলোভে মুসলমান হইলে, একটা মুসলমান রমণীকে বিবাহ করিলে; শেষে আমার যে দশা করিয়াছ, তাহারও সেই দশা করিলে। আমি পাপিনী—পাপের ফলভোগ করিতেছি, সে মরিয়া বাঁচিয়াছে। তাহার পর তুমি আট বৎসরের জন্য কোথায় চলিয়া গেলে, আর সন্ধান পাইলাম না। যখন ফিরিয়া আসিলে, তখন দেখিলাম, আবার আর একটিকে অঙ্কশোভিনী করিয়া ফিরিয়াছ। তুমি যেমন, এখন ঠিক তেমনই মিলিয়াছে যেমন তুমি পিশাচ—তেমনি পিশাচী তোমার জুটিয়াছে;এখন তুমি সুখী হইয়াছ;কিন্তু বিনোদ, মনেও করিয়ো না, আমার সুখ নষ্ট করিয়া তুমি সুখী হইবে—আর আমি দুঃখের ম্লানদৃষ্টিতে তোমার সুখশান্তির দিকে নিরীহ ভালমানুষটির মত শুধু দিন-রাত চাহিয়া থাকিব। এই ছুরিতে ইহার একদিন ঠিক প্রতিশোধ হইবেই হইবে। আমাকে যতদূর সহজ মনে কর—ততদূর নয়, একদিন তোমার সে ভ্রম ভাল করিয়া ঘুচাইয়া দিব; তখন দেখিবে, স্ত্রীলোক একবার ধর্ম্মভ্রষ্টা পাপিষ্ঠা হইলে, তাহারা সকলই করিতে পারে; তাহাদের অসাধ্য এ জগতে কিছুই থাকে না।”

ভ্রুকুটিকুটিলমুখে, সদর্প-পাদবিক্ষেপে মোহিনী তখনই তথা হইতে চলিয়া গেল। হাতে সেই উন্মুক্ত দীর্ঘ ছুরিখানা যেন তেমনি দর্পের সহিত ঘন ঘন দুলিতে লাগিল। বিনোদলাল নিতান্ত চিন্তিতের ন্যায় সেখানে আপ্রভাত বসিয়া রহিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86
Pages ( 1 of 86 ): 1 23 ... 86পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress