Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মাফিয়া রহস্য || Syed Mustafa Siraj » Page 5

মাফিয়া রহস্য || Syed Mustafa Siraj

ইলিয়ট রোডে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের ফ্ল্যাটটা একটা ছোটখাট যাদুঘর বললেই চলে। কিন্তু যাদুঘরটার বৈশিষ্ট্য আছে। ওখানে নানান খুনখারাবির কেস সংক্রান্ত বেসরকারি রেকর্ডের ফাইল যেমন আছে, তেমনি আছে অনেকগুলো মার্ডার-উইপন্স। কোনটাই সাম্প্রতিককালের নয়। অন্তত পঞ্চাশ-ষাট থেকে আরও অনেক বছরের পুরনো। যেমন আফগানিস্তানের এক আমীর ফরিদ খানকে যে ছোরা দিয়ে খুন করা হয়েছিল, সেই ছোরাটা। যে পিস্তলে ইংরেজ পুলিশ কমিশনার হার্বাট খুন হন, সেই পিস্তল। রাজাবাজারের এক খুনী সাতটা খুন করেছিল যে ভোজালি দিয়ে, সেই মারাত্মক ভোজালি। এইরকম সব সাংঘাতিক অস্ত্র কাঁচের বাক্সে রাখা আছে। হত্যা সম্পর্কে কর্নেলের আগ্রহের শেষ নেই।

ঘরের অন্য কোনায় নিজের সংগ্রহ করা কিছু ফসিল রয়েছে। তাতে প্রাণী ও উদ্ভিদের ছাপ। কর্নেল শুধু বেসরকারি গোয়েন্দা নন, একজন প্রকৃতিবিদও। দুর্লভ জাতের কীটপতঙ্গ পাখি বা উদ্ভিদ সম্পর্কে প্রচুর আগ্রহ। সেজন্যে অনেক সময়, অর্থ আর শক্তি খরচ করতে পিছপা হন না। প্রজাপতি ধরা জাল নিয়ে পাহাড় জঙ্গলে মাঝে মাঝে উধাও হন। ওঁর একটা অদ্ভুত ক্যামেরা আছে রাতের অন্ধকারেও ছবি তুলতে পারে। সেই সব ছবি এবং মরা ও জ্যান্ত কীটপতঙ্গ পাখি প্রজাপতির সংগ্রহ দেখলে তাজ্জব হতে হয়। ষাটের বেশি বয়স ওঁর। এ বয়সে এখনও যুবকের মতো কর্মক্ষম আর শক্তিমান মানুষ।

গতরাতে কর্নেল ফিরেছেন চন্দনপুর অন-সী থেকে। একজাতের সামুদ্রিক পাখির ছবি তুলতে গিয়েছিলেন। অনেক রাত অব্দি ছবিগুলো ডেভালাপ করেছেন। প্রিন্ট করে জলে ডুবিয়ে রেখেছেন। ভোরে উঠে ছবিগুলো নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। আজ বুধবার, ৩রা জুন। এখন সকাল নটা। কর্নেল ছবি দেখছিলেন এবং একটা প্রকাণ্ড বইয়ের পাতায় কী সব পড়ছিলেন–যেন মিলিয়ে নিচ্ছিলেন কিছু।

এই সময় ফোন বাজল। ফোন তুলতেই টের পেলেন, ট্রাঙ্ক কল। একটু পরে যে ফোন করেছে, তার আওয়াজ শোনা গেল কর্নেল! কর্নেল সরকার! হ্যালো! কর্নেল?

কর্নেল বললেন–বলছি–কে আপনি? হ্যালো হ্যালো হ্যালো….কর্নেল বলছি।

আমি জয়ন্ত। জয়ন্ত চৌধুরী।

কর্নেল অবাক হয়ে গেলেন।–জয়ন্ত! ডার্লিং। সত্যি কি তুমি?

–হ্যাঁ শুনুন। মোহনপুর থেকে বলছি..

–মাই গুডনেস! মোহনপুর! কোন মোহনপুর?

–মোহনপুর অন-দা গ্যাঞ্জেস!

–দৈনিক সত্যসেবক কি ওখানে তোমায় সত্যের সেবা করতে পাঠাল?

–প্লিজ রসিকতার সময় নয়। আজকের সত্যসেবক পড়েননি?

না তুমি জানো, আমি তোমার ওই ট্র্যাস কাগজ পড়িনে!

–আপনি সাহেব মানুষ। যাকগে, শুনুন–আমাদের এক সাংবাদিক অশনি দাশগুপ্ত গতকাল এখানে এসে খুন হয়েছেন। অফিস খবর পেয়েই আমাকে পাঠিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে পৌঁছেছি। খুব রহস্যময় ব্যাপার। আপনি চলে আসুন।

মাই গুডনেস! কর্নেল অভ্যাসমতো দ্রুত সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে নিলেন।

–সব এখানে এসে শুনবেন। চলে আসুন প্লিজ! আমার মাথা খান!

–তোমার মাথা অনেক আগেই খেয়ে ফেলেছি, ডার্লিং! খেয়ে ভুল করেছি।

–প্লিজ কর্নেল!…

এই সময় কর্নেলের দরজার ঘণ্টা বাজল। অন্যমনস্ক হলেন। তারপর বললেন–হ্যালো হ্যালো হ্যালো! জয়ন্ত! হ্যালো!

লাইন কেটে দিয়েছে। ফোন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দরজার কাছে মেয়েলি কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। পরিচারক ষষ্ঠীচরণ কার সঙ্গে কথা বলছে। কে এল আবার? ক্ষুগ্ন হলেন কর্নেল। আচমকা জয়ন্তের ওই ট্রাঙ্ককল, এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে–অথচ এই সময় কোন মহিলা এসে পড়ল! তার আবার কী ট্রাবল কে জানে। আর ট্রাবলশুটিং ভাল লাগে না। ভেবেছিলেন, চন্দনপুর-অন-সির পাখি নিয়ে বিদেশী কোন পত্রিকার জন্য ইন্টারেস্টিং নিবন্ধ লিখতে বসবেন। অথচ হঠাৎ জয়ন্ত খুনখারাবি এনে ফেলল সামনে।

মুশকিল এটাই যে জয়ন্তকে অগ্রাহ্য করা যায় না। অনেকানেক বিচিত্র ঘটনায়, বিস্তর রহস্যময় কেসে আর খুনখারাবিতে দৈনিক সত্যসেবকের রিপোর্টের জয়ন্ত চৌধুরী তার সঙ্গে ছায়ার মতো থেকেছে। বাইরে কোথাও বেড়াতে যেতে হলে পারতপক্ষে তাঁকে ছাড়া যান না কর্নেল। সঙ্গী হিসেবে যুবকটিকে তার দারুণ ভাল লাগে। হুঁ, সে যেচে নাক গলাতে গিয়ে অনেক রহস্যের সূত্র ফাঁসিয়ে দেয়–সেও এক সমস্যা। সেটা তার বয়সোচিত চাপল্য অবশ্য বুদ্ধিহীনতা নয়। সে দারুণ সাহসী, বেপরোয়া। নানারকম জুডোর প্যাঁচও জানে। ঘুষি লড়তে পারে। শিকারের সখও আছে জয়ন্তের। নিজের রাইফেল আছে। একটা রিভলবারও আছে। অতএব এক বেসরকারি রহস্যসন্ধানীর সঙ্গী হিসেবে তার উপযোগিতা প্রচুর।

এবার চন্দনপুর অন-সিতে সে তার সঙ্গে যেতে পারেনি। খবরের কাগজের একটা জরুরি অ্যাসাইনমেন্ট ছিল, তাই।

কর্নেল মনশ্চক্ষে দেখলেন, বেচারা তার সঙ্গীর হত্যাকাণ্ডে রাগে শোকে ফুঁসছে–আর পুলিশের গতানুগতিক ক্রিয়াকর্ম দেখে ভাবছে–আহা থাকত যদি সেই বুড়ো ঘুঘু! হ্যাঁ, কর্নেল সরকারকে কী কেন্দ্র, কী রাজ্য–সবখানে গোয়েন্দা দপ্তর বুড়ো ঘুঘু নামেই বর্ণনা করে।

কর্নেল পাখির ছবিগুলো বইয়ের ভেতর রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই তার নিয়তি! প্রকৃতিতত্ত্বে তাকে ধীরে সুস্থে বসে ডুবতে দিল না! সব সময় তার সামনে একটা নিহত মানুষের শরীর ফেলে দেওয়া হচ্ছে যেন। চ্যালেজ্ঞ করা হচ্ছে–চলে এস। এবার দেখা যাক্। এই পাঞ্জালড়ার খেলা কোন কুক্ষণে যে শুরু করেছিলেন!

ষষ্ঠী এসে বলল,একটি মেয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। বললুম, বাবামশাই এখন ব্যস্ত সবে বাইরে থেকে ফিরেছেন। ও শুনবে না! এখন কী করব, বলুন।

কথাটা বলেই ষষ্ঠী কিচেনে চলে গেল। সে বরাবর দেখেছে, কর্নেল মুখে যতই বারণ করুন, আগন্তুককে ফেরাবেন না। কর্নেল দাড়ি চুলকে এবং তারপর অভ্যাসমতো টাকে হাত বুলিয়ে চুরুটের বাক্সো খুললেন। একটা চুরুট ধরিয়ে দরজায় গেলেন।

ষষ্ঠী মেয়ে বলল কেন, বুঝলেন না কর্নেল, লেডি বলাই উচিত। এবং হাই সোসাইটির ছাপ তার চেহারা ও ব্যক্তিত্বে রয়েছে। দাম্পত্য সমস্যা কি? মহিলার মুখে বাঙালি গড়ন–অর্থাৎ বাঙালি সৌন্দর্য। সিঁথিতে সিঁদুর না থাকাটা ওসব সমাজে কিছু প্রমাণ করে না। তবে সহজাত বোধে অবিবাহিতা বলেই মনে হল। বয়স পঁচিশ হতে পারে তিরিশও হতে পারে। তবে পঁচিশের কম তো নয়ই। কর্নেলকে দেখে সে উঠে দাঁড়াল। বলল গুড মর্নিং কর্নেল।

কর্নেল সোফায় মুখোমুখি বসে বললেন–মর্নিং! তারপর বিশুদ্ধ বাংলায় একটু হেসে বললেন বসুন। এই বৃদ্ধের কাছে সচরাচর মহিলারা আসেন না। কারণ, তারা জানেন, তাদের সমস্যার সমাধান করা এর পক্ষে অসম্ভব। পুরুষেরা আসেন–তাঁদের সমস্যা বহির্জগতের।….

-আপনি বাঙালি! আশ্চর্য তো!

–হ্যাঁ। আমার নাম তো নীলাদ্রি সরকার। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

–আপনার পুরো নাম আমার জানা নেই। জাস্ট শুনেছিলাম নাম কর্নেল! আপনিই সেই বিখ্যাত প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার। আমার এক বন্ধু বলল।

বিখ্যাত কি না জানিনে। একটু-আধটু অপরাধতত্ত্ব চর্চা করি মাত্র।

–আপনাকে কিন্তু একেবারে ফরেনার দেখাচ্ছে!

কর্নেল মহিলাটির সরলতায় হো হো করে হেসে ফেললেন। তার মানে সায়েবদের মতো! হ্যাঁ, এ ভুল সবাই করে। হ্যাঁ, আগে নাম বলুন দয়া করে।

–আমার নাম রুবি চ্যাটার্জি।

কোথায় থাকেন?

ক্যামাক স্ট্রিটে। ..এবার রুবি একদমে বলতে থাকল। আমি কাবাডিয়া অ্যান্ড লাখোটিয়া কর্পোরেশনের মার্কেটেং সেকসনের সুপারভাইজার। এক্সপোর্ট মার্কেট নয়–লোকাল। অবশ্য বাইরে বেশি একটা ঘুরতে হয় না। টেবিলে বসেই ডাটা অ্যানালিসিস করতে হয়। আর…

কর্নেল হাত তুলে বললেন–আপনি অবিবাহিতা?

রুবি ঈষৎ রক্তিম হয়ে বলল–হ্যাঁ।

ক্যামাক স্ট্রিটে একা থাকেন?

–হ্যাঁ, একটা ফ্ল্যাট কিনেছি। বাড়িটা দেখে থাকবেন সানডে হাউস। তার সিক্সথ ফ্লোরে।

এবার বলুন, কী করতে পারি আপনার জন্যে?

রুবি একটু ইতস্তত করে মুখ নামাল। ম্যানিকিওর করা নখগুলোর দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল–আমি আপনার মেয়ের মতো। প্লিজ, আমাকে আপনি বলবেন না।

কর্নেল একটু হেসে সস্নেহে বললেন–বেশ। বলো, কেন এসেছ এ বুড়োর কাছে!

রুবি মুখ তুলল। একটু কেসে গলা সাফ করে নিল। তারপর শুরু করল।

–পরশু বিকেল সাড়ে চারটের সময় আমাদের ফরেন মার্কেট সেকশানের ইনচার্জ সুনীথ ব্যানার্জি হঠাৎ আমায় ডেকে পাঠালেন।

হঠাৎ মানে, আর কোনদিন ডাকতেন না?

না, ডাকতেন। …রুবি আবার একটু কাশল। তাকে নাভাস দেখাচ্ছিল।

কর্নেল বললেন–ঠিক আছে। আগে সবটা বলে যাও। তারপর প্রশ্ন।

রুবি ফের বলতে লাগল। পয়লা জুন বিকেলে যা যা ঘটেছিল–সব বলল।

এক ফাঁকে ষষ্ঠীচরণ কফি রেখে গিয়েছিল। পরে কাপ প্লেট ট্রে নিয়ে গেছে। রুবির মনে হল, তার সামনে বসে থাকা বুড়ো মানুষটিকে এখন অন্য রকম দেখাচ্ছে। চঞ্চল, অন্যমনস্ক। চোখ দুটোর দৃষ্টিশক্তি যেন বেড়ে গিয়ে জ্বল জ্বল করছে। সে আস্তে বলল–নিজের ভয়ে আমি আসিনি। সুনীথ ওভাবে চলে গেল। ওখানে আমাদের কোম্পানির কারখানা আছে। অফিস আছে। ট্রাঙ্ক করেছিলুম গতকাল সকালে একবার বিকেলে আবার। ওরা বলল, সুনীথ যায়নি। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, কী একটা গণ্ডগোলে জড়িয়ে গেছে ও।

–ওর স্ত্রী তোরা ব্যানার্জিকে ফোন করেছিলে?

না কর্নেল। ভোরা সেটা …

–হুম! ঠিকভাবে নেবে না।

–তবে সুনীথ ফেরেনি, সে খবর আমি অন্য সোর্সে জেনেছি। আমাদের অফিসের পিওনকে সুনীথের খবর নিতে পাঠিয়েছিলেন কাবাড়িয়া সায়েব। পরশু রাতের পার্টিতে গেল না। অফিসেও এল না গতকাল, তাই। মিসেস ব্যানার্জি অবাক হয়ে বলেছে, বাইরে গেছে। সে তো কোম্পানির কাজেই গেছে! তার মানে সুনীথ স্ত্রীকে তাই বলে চলে গেছে।

–এক মিনিট। চিঠির কথাগুলো অবিকল লিখে দাও। ..বলে কর্নেল টেবিলের তলা থেকে একটা স্লিপ দিলেন ওকে।

রুবি লিখে দিয়ে বলল–জিরো আট নয় সাতটা কী হতে পারে বলে মনে করছেন কর্নেল?

কর্নেল সে কথার জবাব না দিয়ে হঠাৎ বললেন–তুমি বাংলা কাগজ পড়ো?

রুবি মাথা দোলাল। পড়ে না।

–দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার কারো সঙ্গে চেনা আছে?

না তো? কেন বলুন তো?

–অশনি দাশগুপ্ত বলে কাউকে চেনো?

না। কে তিনি?

–সে কথারও কোন উত্তর দিলেন না কর্নেল। বললেন-তোমাদের কোম্পানি কি শিগগির বিদেশে কোন মাল-টাল রফতানি করছেন?

রুবি একটু ভেবে জবাব দিল–কিছু ইলেকট্রনিক গুড়সের কনসাইনমেন্ট হবে শুনেছি।

–কোন তারিখে?

–ফিফথ জুন।

তার মানে আগামী পরশু?

–হ্যাঁ। তবে গতকাল অবধি শিপিং অ্যারেঞ্জমেন্ট করা যায়নি।

–দয়াময়ী ট্রেডিংস তোমাদের কোম্পানির সঙ্গে কী কারবার করে?

কখনও এজেন্সি সংক্রান্ত কাজকর্ম, কখনও প্যাকিংএর কাজ।

–৫ই জুনের কনসাইনমেন্টে দয়াময়ী ট্রেডিংস কিছু করছে?

–হ্যাঁ। প্যাকিং ছাড়াং অ্যারেঞ্জমেন্ট ওরা করে দেবে এজেন্ট হিসাবে।

–মালগুলো চলে গেছে ওদের জিম্মায়?

–ঠিক জানিনে। আমার হাতে তো লোকাল মার্কেট। সুনীথ সব জানে।

কর্নেল হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। আচ্ছা রুবি, তুমি এখন এসো। এতে তোমার ভাববার কিছু নেই। আমার মনে হচ্ছে, তুমি কোনদিক থেকে আক্রান্ত হবে না। তবে অন্য কারও কানে তোলনি, এতে তোমার বুদ্ধির প্রমাণ পাচ্ছি। হুম, তোমার। কোন বন্ধুর কাছে আমার কথা শুনেছ বললে। তাকে কিছু বলেছ নাকি?

রুবি বলল–না। আমরা গল্প করছিলুম নানা ব্যাপার নিয়ে। কথায় কথায় ও বোম্বেতে অ্যান্টিস্মাগলিং ড্রাইভের গল্প করতে থাকল। ওর স্বামী ওখানে থাকে। খুব থ্রিলিং জব। তারপর হঠাৎ আপনার কথা তুলল। বলল, ইলিয়ট রোডে সাম কর্নেল থাকেন। তিনি একবার নাকি বড় একটা গ্যাং ধরেছিলেন। তিনি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার নাকি। শুধু এটুকু সম্বল করেই এসেছিলুম ইলিয়ট রোডে। খুঁজেই পেতুম না। তবে রাস্তা ঘোট তো। একটা পানের দোকানে জিজ্ঞেস করলুম। এখানে কোথায় এক কর্নেলসায়েব থাকেন? সে বাড়িটা দেখিয়ে দিল। তখন চলে এলুম। দৈবাৎ খুঁজে পাওয়া বলতে পারেন। অবশ্য দরজায় আপনার নেমপ্লেটে শুধু কর্নেল দেখেই আর তাকাইনি। চোখ বুজে বোতাম টিপেছি।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন হুম! অ্যান্টিস্মাগলিং এর সঙ্গে কর্নেলের সম্পর্ক থাকতে পারে। কিন্তু তোমার আর সুনীথবাবুর ব্যাপারটার সঙ্গে তুমি যখন এই বৃদ্ধকে জড়িয়ে ফেলতে চাইলে, তখন সহজে বোঝা যাচ্ছে তোমার মনে স্মাগলিং কথাটা খুব তীব্র হয়ে বাজছিল। অর্থাৎ তুমি ভেবেছ যে তোমাদের এই রহস্যজনক ঘটনার সঙ্গে স্মাগলিং এর সম্পর্ক আছে। তাই না রুবি?

রুবি বড় বড় চোখে অবাক হয়ে বললসত্যি তো! কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি তো…

–হুম! সচেতন মনে ভাবোনি। অচেতনে ভেবেছ। যাক্ গে, আমার একটু তাড়া আছে। তেমন কিছু ঘটলে রিং করো!..বলে কর্নেল কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন। ফের বললেন–উঁহু। আমি আজ দুপুরে বেরোচ্ছি। বাইরে যাব। ফিরতে দুই-তিন দিন দেরি হওয়াও বিচিত্র নয়। এক কাজ কোরো বরং। কিছু ঘটলে আমার কাজের লোকটিকে একটা কাগজে অবিকল লিখে দিয়ে যেও। সে আমাকে জানাবে।

কর্নেল ডাকলেন–যষ্ঠি।

ষষ্ঠীচরণ হন্তদন্ত হয়ে এসে দাঁড়াল। কর্নেল বললেন এঁকে চিনে রাখ ষষ্ঠী! কেমন? দরকার হলে আমার জন্য মেসেজ দিয়ে যাবে তোকে।

একটু পরে রুবি চলে গেল। ষষ্ঠী ঢুকল কিচেনে। কর্নেল রুবির লেখা চিরকুটটা নিয়ে বেডরুমে ঢুকলেন।

অভ্যাসমতো দাড়ি ও টাক যথাক্রমে চুলকে ঘড়ি দেখলেন। তারপর ফোন তুললেন। রেলের রিজার্ভেশন পাবেন কি না ঠিক নেই। উদ্বিগ্নমুখে চেনা রেলদফতরের একজন অফিসারের নম্বর ডায়াল করতে থাকলেন।

মোহনপুর ছাড়া এখন মাথায় কিছু নেই। এই তার স্বভাব।…

দুপুর বারোটা নাগাদ একটা গাড়ি ছাড়ে শেয়ালদা থেকে। সেটা সোজা মোহনপুর যায় না। তাই গাড়ি বদলাতে হয় অমৃতপুর জংশনে। তাছাড়া দিল্লি যায় ট্রেনটা। তাই রিজার্ভেশন পাওয়া অসম্ভব। মোহনপুর এক্সপ্রেস সেই সন্ধ্যার দিকে। হাওড়া থেকে ছাড়ে। মধ্যপথের প্রচুর যাত্রী রিজার্ভেশন করে। তাই শেষ অবধি কর্নেলের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছিল। একজন ভি.আই.পি. ভাগলপুর যবেন বলে বুক করেছিলেন। হঠাৎ যাত্রা বাতিল করেছেন। অতএব কর্নেল ফার্স্ট ক্লাস বার্থ পেয়ে গিয়েছিলেন।

ট্রেন পৌঁছল পরদিন সকাল আটটা বেয়াল্লিশে। মাত্র এক মিনিট লেট! গাড়ির যাত্রা এখানেই শেষ। সব যাত্রী নেমে গেলে কর্নেল দরজার কাছে গেলেন।

জয়ন্ত হতাশভাবে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দুবার কর্নেলের সামনে দিয়ে গেল সে। কিন্তু কর্নেলকে লক্ষ্য করল না। তৃতীয়বার কাছাকাছি আসতেই কর্নেল হাত বাড়িয়ে ওর কলার খামচে ধরলেন। জয়ন্ত চমকে উঠে মুখ তুলল। তারপর কর্নেলকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল–হ্যাল্লো কর্নেল!

কর্নেল চোখ টিপলেন ভর্ৎসনার ভঙ্গিতে। তারপর চাপা গলায় বললেন জনারণ্যে অমন করে চেঁচিয়ে আমার আগমনবার্তা না রটানোই ভাল, ডার্লিং!

জয়ন্ত জিভ কেটে বলল–সরি! বদঅভ্যেস! …বলে সে কুলি ডাকতে এগিয়ে এল। কর্নেল মাথার টুপিটা একটু কপালে টেনে চুরুট ধরালেন।

একটু পরে প্রকাণ্ড পলিথিনের বোঁচকা আর একটা বিশাল চামড়ার সুটকেশ কুলির মাথায় চাপিয়ে দুজন চলতে থাকলেন। কর্নেলের পোশক ট্যুরিস্টদের মতো অনেকটা। কাঁধে ক্যামেরা আর বাইনোকুলার ঝুলছে। পিঠের কিটব্যাগে প্রজাপতিধরা জালের স্টিক উঁকি মেরে আছে।

বাইরে বেরিয়ে কর্নেল বললেন–শোনো। আমি কিন্তু একজন ন্যাচারালিস্ট হিসাবেই এলুম–একথা কোনমতে ভুলবে না। পাহাড় আর জঙ্গল এ এলাকায় প্রচুর আছে। অতএব আমার এই অজুহাত খুব মজবুতই হবে।

জয়ন্ত বলল–ঠিক আছে। রিকশো করা যাক্। আমাদের পত্রিকার মালিক মশায়ের একটা বাড়ি আছে এখানে। সেখানেই আপনার থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছি। আমিও থাকছি আপনার সঙ্গে।

কর্নেল বললেন–আপাতত আর কথা নয়। রিকশো ডাকো। …

দুজনে রিকশোয় চেপে বসলেন। বাজার আর বসতি এলাকা পেরিয়ে বাঁদিকে একটু নিচের উপত্যকায় কলকারখানা দেখা যাচ্ছিল। ডাইনে শহরের সম্প্রসারণ ঘটেছে। অজস্র নতুন বাড়ি হয়েছে। সব একচালা এবং সুদৃশ্য লন ও বাগিচায় ঘেরা। টিলাগুলোর গায়েও বাড়ি রয়েছে। বিত্তশালীদের এলাকা এটা।

উতরাই-এর রাস্তা একটু ঘোরালো। টিলার গায়ে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। বাড়ি বলা ভুল, বাংলো। দৈনিক সত্যসেবকের মালিক মাঝে মাঝে এখানে এসে থাকেন। ভারি সুন্দর এ জায়গাটা। ডাইনে উঁচু সব জঙ্গুলে পাহাড়, সামনে আর বাঁদিকে অর্থাৎ দক্ষিণ ও পূর্বে উপত্যকা। উপত্যকায় নতুন টাউনশিপ গড়ে উঠেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে উত্তরে তাকালে অনেক দূরে মোহনপুর স্টেশনের ওপাশে বিশাল গঙ্গা চোখে পড়ে।

বাংলোর নাম সত্যভবন। দারোয়ান আর মালী থাকে সপরিবারে। দুজনে একসময় পৌঁছে গেলেন সত্যভবনে। ঘর দেখে খুব খুশি হলেন কর্নেল। …

বারান্দায় বসে কর্নেল বললেন–তোমাদের পত্রিকার মালিক ভদ্রলোকের সৌন্দর্যবোধ অসাধারণ। যাই হোক, তোমার মুখ দেখে বুঝতে পারছি তুমি তোমার কলিগের শোচনীয় পরিণতি আমাকে সবিস্তারে জানাতে উদ্গ্রীব হয়েছ। বেশ, তাই হোক।

জয়ন্ত বলল–আপনি সত্যসেবকে যা পড়েছেন…

হাত তুলে কর্নেল বললেন–পড়িনি। রিপোর্টিং-এ অনেক গণ্ডগোল থাকে। নিজে রিপোর্টার হয়ে তুমি তা বিলক্ষণ জানো, ডার্লিং। ভুল বর্ণনা পড়ে আগেই প্রেজুডিল্ড হওয়া ঠিক নয়।

জয়ন্ত হাসল। আমি রিপোর্টার বলে কি একই গণ্ডগোল করে ফেলব না?

করবে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমি তোমায় প্রশ্ন করতে পারব।

–ঠিক বলেছেন।

মালী এইসময় চায়ের ট্রে নিয়ে এল। দুজনে চা খেতে থাকলেন। তারপর জয়ন্ত বলল–অশনি দাশগুপ্ত সত্যসেবকের রিপোর্টার ছিল। ও ছিল পলিটিক্যাল খবরাখবরের চার্জে। হঠাৎ ফার্স্ট জুন সন্ধ্যায় হাওড়া স্টেশন থেকে ফোন করে আমাকে জানাল–জরুরি ব্যক্তিগত একটা ব্যাপারে মোহনপুর যাচ্ছে। যদি কোন ঘটনা ঘটে, আমি যেন তাকে সাহায্য করতে যাই। শুনে ওকে অনেক প্রশ্ন করলুম, জবাব পেলুম না।

কর্নেল বললেন–ওকথা পরে। আগে বলল : কোথায় কীভাবে খুন হলেন ভদ্রলোক? এবং কবে ঠিক কোন সময়ে? ডেডবডি কী হল? এই প্রাথমিক ব্যাপারগুলো আপাতত জরুরি।

জয়ন্ত বলল–খুন হয়েছে দোসরা জুন। পুলিশ আর ডাক্তারের মতে, বেলা এগারোটা নাগাদ। অর্থাৎ এখানে পৌঁছানোর ঘণ্টা আড়াই পরে। ও উঠেছিল এখানেই। মালী বা দারোয়ান ওকে খুবই চেনে। অসুবিধে হয়নি। দুজনেই বলেছে অশনি বেরিয়ে যায় দশটা নাগাদ। তারপর ওর ডেডবডির খবর আসে বারোটায়। দারোয়ান তক্ষুনি টেলিগ্রাম করে দেয় আমাদের কলকাতা অফিসে। ডেডবডি পড়েছিল ওই যে রাস্তাটা দেখছেন–ধারে ঝোঁপঝাড় আর বটগাছ রয়েছে, ওর মধ্যে। রিভলভারের গুলিতে মারা যায় অশনি। হার্টে গুলি করা হয়েছিল–একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে। ধস্তাধস্তির চিহ্ন আছে ওখানে। কিন্তু পাশের কোন বাড়ি থেকে কেউ চেঁচানি শোনেনি–গুলির শব্দও শোনেনি। এক ট্রাকড্রাইভার আসছিল খালি ট্রাক নিয়ে। দৈবাৎ তার চোখে পড়ে যায় ডেডবডিটা। সে থানায় খবর দেয়।

–ডেডবডি কী হল?

কালই অশনির আত্মীয়স্বজন এসেছিল। গঙ্গার ধারে দাহ করা হয়েছে।

–মর্গে পরীক্ষার পর?

–হ্যাঁ। মর্গ থেকে পরীক্ষা করার পর গতকাল সন্ধ্যায় বডি ডেলিভারি দেয়।

আত্মীয় মানে কে বা কারা?

–ওর মামা জগদ্বন্ধুবাবু আর তার ছেলে প্রশান্ত। অশনির বাবা-মা বেঁচে নেই। এক কাকা থাকেন কানাডায়।

–ওঁরা চলে গেছেন!

–হ্যাঁ। কাল রাতের ট্রেনেই ফিরে গেছেন।

–ওঁদের কাছে কোন সূত্র মেলেনি?

জয়ন্ত মাথা দোলাল। –না। ওঁদের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগও ছিল না। অশনির। তবে আমি একটা ব্যাপার আঁচ করেছি।

-কী?

–ওই পাশের ঘরটায় অশনি ছিল। ওর রিপোর্টিং স্লিপে নোটের মতো কয়েকটা কথা লেখা ছিল। স্লিপটা আমি এসেই হাতিয়েছিলুম। পুলিশ ওটার কোন গুরুত্ব দেয়নি। আপনাকে দেখাই।

কর্নেল হাত তুলে বললেন–দেখবখন। এবার বলো, এখানে কাবাডিয়া অ্যান্ড লাখোটিয়া কর্পোরেশনের কারখানাটা কোথায়?

জয়ন্ত একটু অবাক হয়ে বলল–ওই যে ওদিকটায়। আসার সময় ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকার পাশ দিয়ে এলুম আমরা। কেন বলুন তো?

কর্নেল ওর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন–এখানে ফোন আছে?

—আছে। কাকে ফোন করবেন?

–পুলিশ সুপার মুকেশ সিংকে। কোথাও আসার আগে ওসব খবর জেনে আসা আমার বরাবর অভ্যাস। আশা করি, তুমি তা জানো।…বলে কর্নেল গম্ভীর মুখে উঠলেন।

জয়ন্ত মাঝের বড় ঘরটায় নিয়ে গেল ওঁকে। বলল–মুকেশ সিং ভলোক বড্ড মেজাজী। হয়তো পাত্তাই দেবেন না আপনাকে।

কর্নেল ওর কথায় কান দিলেন না। ফোন তুলে বললেন–নাম্বারের জন্যে তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না, জয়ন্ত। আমি নিয়ে এসেছি।

ডায়াল করার পর বললেন–হ্যালো! পুলিশ সুপার মিঃ মুকেশ সিংকে দিন। বলুন, আমি কলকাতা থেকে এসেছি। কর্নেল সরকার বলুন-হ্যাঁ, কর্নেল সরকার। …হ্যালো হ্যালো হ্যালো! কেমন আছেন মিঃ সিং?..না, নাসত্যিই আমি এসেছি। এসে স্বচক্ষে দেখে যান নয়তো রংফুল পার্সোনিফিকেশনের জন্যে গারদে পুরবেন বরং। হাঃ হাঃ হাঃ!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress