Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

ভুবনবাবু খেতে বসার সময় দেখছিলেন, মানু খুব তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠতে যাচ্ছে। সাধারণত ভুবনবাবু এবং মানু আজকাল এক সঙ্গেই খায়। তাড়াতাড়ি খেতে দেখে বলেছিলেন, আস্তে খা। বিষম খাবি। গলায় আটকে যাবে।

ভুবনবাবুর কথাতেই যেন মানু জল চেয়েছিল। গলায় সত্যি আটকে যেতে পারে। বড় বড় ড্যালা, খাদ্যনালির পক্ষে বা কষ্টকর এবং বেশি জোরে ঢোক না গিললে সবটা ভেতরে যায় না, যে—কোনো সময় কিছু একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে—বাবা তাকে সব সময় এত বেশি সাবধানে রাখতে চায় যে মাঝে মাঝে করুণা হয়। তবু সে যতটা পারে বাবাকে সমীহ করে চলে।

বোধ হয় ভুবনবাবু আরও কিছু বলতেন। নীরজা ভাতের থালা এগিয়ে দিয়েছিল। সামান্য ঘি, তিন—চার টুকরো পটল ভাজা, বড় স্টিলের থালার মাঝখানে নৈবেদ্যর মতো ভাত চুড়ো করা। এবং ছোট বাটির একবাটি মুগের ডাল। এমন সুন্দর খাবার দেখে ভুবনবাবু বোধহয় বাকিটুকু বলতে ভুলে গেছিলেন।

ঠিক ওঠার সময় তিনি মানুকে বললেন, যতীন সেনের কাছে একবার বিকেলে যা দেখি। বলবি, বাবা আপনাকে যেতে বলেছে। আর একটা ঠিকুজি এসেছে। ভানুর কুষ্ঠির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে।

মানু খুবই বিরক্ত। কুষ্টি ফুষ্টি তার ধাতে সয় না। সে বুজরুকি ভাবে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মোছার সময় সে বলল, কাল যাব।

আজ না গেলে ওর সঙ্গে দেখা হবে না।

মানু সাড়া না দিলে অগত্যা ভুবনবাবু বললেন, যাবে কোথায়!

ভুবনবাবু তখন ভাত মেখে খাচ্ছিলেন। নীরজা তাকিয়ে আছে। চৌকাঠের কাছে মানু। সে বাবার বাকি কথাটা শোনার জন্যে দাঁড়িয়ে!

তোর বুঝি অনেক কাজ? রাসবিহারীবাবু কালও ভানুর অফিসে লোক পাঠিয়ে খোঁজ নিয়েছেন।

আমার আবার কাজ! ম্যাটিনিতে টিকিট কাটা আছে।

তাহলে ফেরার পথে দেখা করে আসিস।

কী বলব?

ওইতো রাসবিহারীবাবু মেয়ের ঠিকুজী পাঠিয়েছেন।

মানু আর দেরি করেনি। রাসবিহারীবাবু, কেন লোক পাঠায় সে—সব জানার ইচ্ছে তার বিন্দুমাত্র নেই। বাবা ছক মিলিয়ে যাচ্ছেন। ছক ছাড়া কোনো কাজ হয় না। এবং এই নিয়ে কত যে ছক এ বাড়িতে এল। এবারে এসেছেন রাসবিহারীবাবু। সে মনে মনে হেসে ফেলল। তারপর সে ঘরে ঢুকে জামা গলিয়ে বের হয়ে পড়েছিল।

এবং ভুবনবাবু খেয়ে উঠে যখন করিডরে হেঁটে যাচ্ছিলেন—মনে হয় কেমন নিস্তব্ধ এই আবাস। কারও কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। ছুটির দিন, সবারই থাকার কথা, বড়টার তো একটায় বাড়ি ফিরে আসার কথা, আসেনি, বোধহয় প্রিয়নাথের বাড়িতে যাবে। প্রিয়নাথ দাবা খেলতে পছন্দ করে—খেলাটি প্রিয়নাথই ভানুকে শিখিয়ে নিয়েছে। প্রিয়নাথ ছেলের মৃত্যুর পর বাড়ি থেকে একেবারে বের হয় না। কেবল সন্ধ্যার দিকে পাশের আশ্রমে যায়। গীতাপাঠ, কীর্তন প্রভৃতির ভেতর কিছুক্ষণ ডুবে থাকতে ভালোবাসে। প্রিয়নাথ যৌবনে ঘোর নাস্তিক ছিল। সেই প্রিয়নাথ ধর্মে এমন মজে গেছে দেখে তার সামান্য হাসি পাচ্ছিল। প্রিয়নাথের নাতনি কাকলি মাঝে মাঝেই ভানুকে ডেকে নিয়ে যায়। কী যে জরুরি কাজ এত, তিনি বোঝেন না। ভানুকে আজকাল এ বাড়ির বড় ছেলে ভাবতে কষ্ট হয়। দায়—দায়িত্ব সবই ঠিকঠাক বহন করছে, কিন্তু তবু মনে হয় সংসার—বিচ্ছিন্ন মানুষ। দু—একবার মেয়ে পছন্দ করেছিলেন, কিন্তু ছেলের ভারি অমত। যা রোজগার তাতে বিয়ে করা বিলাস—ভুবনবাবু নিজের অক্ষমতাকেই যেন তখন বেশি করে দায়ী করেন। মা—বাবা ভাই বোনের দায় যার এত, বিয়ে করা তার পক্ষে শোভা পায় না। সে—জন্য একটা অপরাধবোধে মাঝে মাঝে ভীষণ কাবু হয়ে যান ভুবনবাবু। সংসারে ঠিক যেভাবে রাশ টেনে রাখা দরকার পারেন না। আলগা রশিতে সবই ঢিলেঢালা হয়ে যায়। তার গাম্ভীর্যকে কেউ আর বেশি আমল দেয় না।

তিনি তার বিছানায় এসে বসলেন। সামান্য শুয়ে থাকা। কিছু গাছপালা সম্পর্কিত বই, এবং তাঁর ভেষজ গুণাগুণ কী কী আছে, জানার খুব আগ্রহ তাঁর। এটা ইদানীং হয়েছে। পেটের নীচের দিকে একটা ব্যথা টের পান। মাঝে মাঝে ব্যথাটা তীব্র হয়ে ওঠে। মুখ ফুটে খুব একটা চিৎকার চেঁচামেচি করার স্বভাব না, তলপেটে হাত দিয়ে শুয়ে থাকেন অসার মানুষের মতো। ইদানীং কবিরাজি ওষুধে ভালো ফল পেয়েছেন। দেশীয় গাছ—গাছড়ার প্রতি এ—জন্য আকর্ষণ তার দিন দিন বাড়ছে। প্রিয়নাথের পুত্রবধূ বড় একটা পাঠাগারে কাজ নিয়েছে। সে—ই এ—সব পেলে তাকে পাঠিয়ে দেয়।

সুতরাং জানালা খুলে বসলেন তিনি। পাখা চালিয়ে খুব একটা লাভ নেই। গরম গুমোট হাওয়া। বরং গাছপালার অভ্যন্তরে যে হাওয়া বয়ে যায়, তাতে কিছুটা ঠান্ডা ভাব থাকে, পাখার হাওয়ায় শরীরে গিঁটে গিঁটে আজকাল ব্যথা ধরে যায়। সংসারের অনেক কিছুই আজকাল তার অপ্রয়োজনীয় ঠেকছে। পাখা না চালিয়ে বাইরের হাওয়ার জন্য জানালার কপাট আরও ভালো করে খুলে দিলেন।

তখন নীরজা একা রান্নাঘরে। কবে যে নীরজা এ—ভাবে ভারি একা হয়ে গেল, সব মানুষই বুঝি একদিন এ—ভাবে একা হয়ে যায়। তার সেই যৌবন, নীরজার মায়াবী মুখের কথা আর মনে পড়ে না। বাবা, মা, ছোট কাকা বড় পিসি সব মিলে যৌথ সংসারে নীরজা এসেছিল। তারপর নীরজার শহর বাস। সন্তানদের জন্যে সকাল বিকাল একদণ্ড তার বিশ্রাম ছিল না। কে স্কুল থেকে ফিরল, কার ফিরতে দেরি হচ্ছে, কেউ সময়মতো না ফিরলে বাসস্টপে ছুটে যাওয়া এবং ভুবনবাবুর তখন দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। সেই ছেলে মেয়েরা এখন বড় হয়ে গেছে, বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

কেউ একবার বলেও না, মা, তুমি কেমন আছ! ছুটির দিনে নীরজার আজকাল সবাইকে নিয়ে বেশ খাওয়া—দাওয়ার পর পুরানো দিনের গল্প করতে শখ জাগে কিনা একবার জিজ্ঞেস করবেন ভাবলেন। নীরজা তোমার ইচ্ছে হয় না, তক্তপোশের নিচ থেকে পানের বাটা বের করে পা ছড়িয়ে বসার। তুমি জাঁতিতে সুপুরি কাটতে কাটতে গল্প করবে, আমরা শুনব। অথচ দ্যাখ তোমার কেউ নেই। এত করে যে সবাইকে বড় করলে, ওরা কারা?

নীরজা বোধহয় খেতে বসেছে। নীরজা কী খায়, অথবা কীভাবে খায় দেখার ভারি ইচ্ছে হল। নীরজা কখনও খায় মনে হয় না। দুষ্টু বালকের মতো পা টিপে টিপে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন। অনেকদিন পরে স্ত্রীর সঙ্গে একটু দুষ্টুমি করার ইচ্ছে হল। তক্তপোশ থেকে নেমে সন্তর্পণে মুখ বাড়ালেন। নীরজা আলগা করে জল খাচ্ছে! সেই একটাই গ্লাস, গ্লাসটার সঙ্গে নীরজার বোধ হয় নাড়ির টান আছে। জল খাবার সময় নির্দিষ্ট গ্লাসটি তার চাই। অনেক উঁচু থেকে জল ঢেলে বেশ খাচ্ছে। বেশ অনেকক্ষণ ধরে। ভারি তৃষ্ণার্তের মতো! সংসারে এত তৃষ্ণা কীসের!

দরজায় ভুবনবাবু।

নীরজা চোখ মেলে তাকাল। ও মা তুমি! ঘুমাওনি! কী দ্যাখছ!

ভুবনবাবু বললেন, তোমাকে।

নীরজা খুব শান্ত গলায় বলল, আমার আর কিছু দেখার নেই।

ভুবনবাবু দরজার ওপর উবু হয়ে বসলেন।

শোও না গিয়ে।

ভুবনবাবু বললেন, তুমি খাও। আমি একটু বসি।

আর জায়গা পেলে না বসার?

নীরজা!

অসময়ে মানুষটার চোখ—মুখ খুব ভালো ঠেকছে না। নীরজা সামান্য মাছের ঝোল দিয়ে ভাত নেড়ে চেড়ে নিচ্ছিল। মানুষটা ঠায় বসে আছে। তার খাওয়া দেখছে।

নীরজা বলল, ঘুম আসছে না?

তুমি আর এক হাতা ভাত নাও। মনে হয় তোমার পেট ভরেনি।

নীরজা খেতে খেতে বলল, তবে এক হাতা ভাত দাও।

অনেকদিন আগের কথা মনে পড়ে গেল ভুবনবাবুর। তখন নীরজা আর সে। রাতের বেলা নীরজা খেতে বসে প্রায়ই ডাকত, ভাত দাও। ভাত লাগবে।

যেন নীরজা মানুষটাকে সব সময় কাছে কাছে রাখতে ভালোবাসত। এবং শরীরে তখন কী যে মোহ। শরীরে সব সময় আশ্চর্য সৌরভ মেখে ঘুমোত নীরজা। কাজে গেলে নীরজার জন্যে মনটা পড়ে থাকত বাসায়। কতক্ষণে ছুটি হবে, কতক্ষণে আবার দরজা খোলার সঙ্গে নীরজার মুখ দেখবে। এবং কত রকমের কূট চিন্তা যে মাথায় এসে ভিড় করত তার।

রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করবার সময় ভুবনবাবু বললেন, নীরজা একটা কথা আছে?

নীরজা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছছিল। —কী কথা।

লুডো খেলতে ইচ্ছে করছে।

বুড়ো বয়সে ও—সব শখ ভালো না!

খুব বুড়ো হয়েছি?

নীরজা কিছু বলল না। মানুষটা কিছুদিন থেকেই কেমন অন্যমনস্ক। রমার চাকরিটা হবার পর কিছুদিন ভারি খুশি ছিলেন, তারপর আবার আগের মতো। অরুণ এলে যতটা কথা বলা দরকার, ততটাই। এবং যেহেতু মানুর একটা চাকরি দরকার, অরুণের সঙ্গে বরং একটু বেশিই কথা বলেন। মাঝে মাঝে কথা বলতে গিয়ে হেসেও দেন।

দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর নীরজা বেশ পা ছড়িয়ে বসবে একটুক্ষণের জন্য। বেশ সুন্দর করে আপন মনে সুপুরি কাটবে। পান খাবে। তারপর একটু গড়িয়ে নেওয়া স্বভাব। তখন মানুষটা তক্তপোশে শুয়ে থাকে। ঘুমিয়ে থাকে কী জেগে থাকে বোঝা যায় না। খুব দরকারি কথা মনে পড়ে গেলেও জিজ্ঞেস করে না নীরজা। কারণ মানুষটার আজকাল ঘুম এমনিতেই কম হয়। সব সময় কেমন সন্ত্রস্ত থাকেন। নীরজা মাঝে মাঝে না বলে পারে না, এখন তো তুমি সুখের নাগাল পেয়েছ। এত ভাবার কী আছে বুঝি না।

সুখের নাগাল পেয়েছেন ঠিক। সংসারে হা—অন্ন বলতে আর কিছু নেই। বরং বেশ উঁচু মধ্যবিত্তের যা যা লাগে সবই একে একে ছেলে মেয়ে দুজনে মিলে করে ফেলেছে। বেশি ভাড়ার বাড়ি, বসার ঘর, সোফা সেট, এবং কদিন পর বাড়িতে একটা ফ্রিজ—টিজ হয়তো চলে আসবে। মানুর চাকরিটা হয়ে গেলেই বোধহয় ওটা হয়ে যাবে। এবং তিনি বুঝতে পারেন, তখন তিনি আরও একাকী। অরুণের পিছনে মেয়েটা ছুটছে। রমার এ—বয়সে এত স্বাধীনতা সহ্য হবে কিনা বুঝতে পারছেন না। যদিও তিনি এ—কালের বাবা, অথচ এ—কালের সন্তানদের ঠিক বুঝতে পারেন না যেন—কেমন দুঃখী মুখে একটা আশঙ্কা লেগে থাকে সব সময়।

তিনি বললেন, রমাকে নিয়ে অরুণ কোথায় গেল?

অফিসের কোন বাবুর যেন বউভাত।

আসলে সবই বলে গেছে রমা। কিন্তু কেউ কোনো গুরুত্ব দেয়নি। ভবিতব্য ভেবে ছেড়ে দেওয়া। বিয়ের জন্যে খুব পীড়াপীড়ি করতেও আজকাল ভরসা পাচ্ছেন না। ফের সংসারে আবার কিছুটা হা—অন্ন ঢুকে যেতে পারে। এত বড় সমস্যায় মানুষ কখনও পড়ে যায় ভুবনবাবুর জানা ছিল না।

নীরজা বলল, ওষুধ খেয়েছ?

না।

নীরজা জল ও ওষুধ দিলে ভুবনবাবু বললেন, ওরা কখন ফিরবে বলে গেছে?

মানু বলেছে শো দেখতে যাচ্ছে। ফিরতে সন্ধে হবে।

রমা?

ও কখন ফিরবে ঠিক নেই?

কেন ঠিক থাকে না, তুমি একবার ওটা ভেবে দেখেছ?

কিছু ভাবি না। অত ভাবলে সংসার চলে না।

রমার বিয়ে দেওয়া উচিত।

উচিত, করলেই হয়। কে বারণ করেছে। নীরজা ক্ষুণ্ণ গলায় কথাটা বলল।

মেয়ে তোমার রাজি হবে কিনা একবার জিজ্ঞেস কর তো?

রাজি হবে না কেন?

ভুবনবাবু আর কিছু বলতে সাহস পেলেন না। কেবল মুখ ফিরিয়ে বললেন, ওদের কোনো টান নেই।

নীরজা দু’কুচি সুপুরি আলগা করে মুখে ফেলে দিল। বলল, টান না থাকলে এত কেউ করে না।

ছুটির দিনে দেখেছ কেউ বাসায় থাকতে চায় না।

নীরজা ভুবনবাবুর দুঃখটা কোথায় বুঝতে পারছে। মানুষটা সব সময় সবাইকে কাছে পিঠে নিয়ে থাকতে চায়। কাজের দিনে এমনিতেই কেউ বাড়ি থাকতে পারে না। কথাও বিশেষ হয় না। বড় ছেলে আজকাল অফিস থেকে সোজা বাড়ি ফেরে না, প্রিয়নাথের বাড়িতে দাবা খেলে রাত করে ফেরে! তিনি সবাই না আসা পর্যন্ত বারান্দায় পায়চারি করেন, দোতলার বারান্দায় বসলে রাস্তার অনেকটা দেখা যায়। কে কতদূর আছে কে কখন ঢুকছে সবই তিনি টের পান। এবং সবাই এলে তিনি আর কোনো কথা বলেন না। ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েন। এ—বাড়িতে ভুবনবাবু বলে কেউ আছে তখন বোঝা যায় না। কেবল রমা এলে বলবে, বাবার খাওয়া হয়ে গেছে? বাবা শুয়ে পড়েছে? শুয়ে থেকে মেয়ের এমন দু—চারটে কথা শুনতে পান। রাতে আজকাল রমা প্রায়ই বাড়িতে খায় না। কোথাও না কোথাও সে খেয়ে আসে। বাইরের হাবিজাবি খাওয়া আজকাল এত বেড়েছে যে তিনি যথার্থই শঙ্কা বোধ করেন।

ভুবনবাবু বললেন, খুব দুঃসময় আমাদের।

নীরজা এ কথার কোনো তাৎপর্য খুঁজে পেল না। বলল, এ—কথা বলছ কেন?

এখন রাহুগ্রাসের সময়। সাবধানে থাকা ভালো। বৃষ রাশির পক্ষে সময়টা খুব শুভ নয়। মানুকে বললাম যতীন সেনের কাছে যেতে। ও আমাদের কুষ্ঠি বিচার করে রাখবে। শান্তি স্বস্ত্যয়নের দরকার হতে পারে। ছেলেরা কেউ কথা শোনে না। এত কী কাজ, আসার সময় যতীনের কাছে হয়ে এলে কী যে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে বুঝি না। তা—ছাড়া রাসবিহারীবাবুও তাঁর মেয়ের ঠিকুজী পাঠিয়েছেন। সেটাও দেখা দরকার।

মিলে গেলে আমি আর দেরি করব না নীরজা। বিয়েটা ভানুর দিয়ে দেওয়া দরকার।

বয়স বাড়লে মানুষ বাতিকগ্রস্ত হয়ে যায়। আজকাল মানুষটার খুব করকোষ্ঠীর প্রতি বিশ্বাস জন্মে গেছে। যাত্রা শুভ কী অশুভ, এসব বাছবিচার করে চলার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। নীরজার এতে খুব একটা অবিশ্বাস নেই, কিন্তু তার জন্যে সব সময় আতঙ্কিত হয়ে থাকা কেমন হাস্যকর লাগে। সে বলল, তুমি দিন দিন বড় ভীতু হয়ে পড়ছ।

নীরজা জানে মানুষটা এবার অনেক কথা বলবে। সে মেঝেতে ফল—ফুল আঁকা দামি সতরঞ্চি পেতে নিল! শুয়ে শুয়ে বাকিটুকু শোনা যাবে।

ভুবনবাবু বললেন, নীরজা তোমার ভয় করে না?

কীসের ভয়?

মেয়ে তোমার কিছু একটা করে ফেলতে পারে!

বড় হয়েছে। ছোট নেই। হলে ফলভোগ করবে। নীরজা কেমন উত্তপ্ত হয়ে উঠল। তোমার যখন এত সংশয়, মেয়েকে না ছাড়লেই পারতে। বাইরে বের হলে একটু স্বাধীনতা দিতেই হয়।

আগে বুঝতে পারিনি এতটা হবে।

যখন বুঝলে এতটা হচ্ছে তখন আর চুপ থাকা কেন। বলে দাও না, এ বাড়িতে থাকতে হলে চাকরি করা চলবে না। চাকরির জন্যে আগে তুমিও তো কম লোককে ধরাধরি করনি। ভাগ্যিস অরুণের সঙ্গে পরিচয় ছিল। এখন দুঃখ করে আর লাভ নেই।

তোমার বড় ছেলে দুপুরে কোথায় কী করছে তাও তুমি জান না।

সব জানি। বুঝি। কিন্তু এখন ওদের হাতে। কিছু বলতে পারি না।

আস্কারা দিয়েছ! বুঝবে।

আমার আর বোঝার কী আছে। সব বুঝে ফেলেছি। তুমি এখন বোঝো। সারাজীবন তো নিজের গোঁ নিয়ে থাকলে। কারও অধীন হয়ে থাকতে পারলে না। এখন নিজের কাছে নিজেই হেরে যাচ্ছ। মজা মন্দ না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *