Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

সকাল সকাল নানুর আজ ঘুম ভেঙে গেল। সে উঠেই জানালা খুলে দিল! বাইরে এসে দাঁড়াল। রাস্তাটার ওপারে একটা ছোট্ট মতো লাল বাড়ি। বারান্দা থেকে বাড়িটার সব কিছুই স্পষ্ট। এই প্রথম সে লক্ষ্য করল, একটা বাচ্চা মেয়ে সাদা ফ্রক গায়ে দিয়ে লনে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর মনে হল, বাড়িটায় রয়েছে বড় একটা ছাতিম গাছ। ছাতিম ফুলের গন্ধ—আহা, একবার সে মেসোমশাই মা—

এই পর্যন্ত মনে হতেই তার চারপাশ অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকল। এক কুৎসিত জগৎ থেকে সে পরিত্রাণের কথা ভাবছিল। সবাইকে সে ক্ষমা করে দিয়েছে। কারণ তার এখন বনভূমিতে জ্যোৎস্না। নবনীতা, ভারি সুন্দর নাম। নবনীতা তার হাত কামড়ে দিয়েছিল। এবং সেই দাঁত আর তার নেই। নবনীতা এখন নতুন এক পৃথিবী তার কাছে।

অন্তত এমন সুন্দর পবিত্র ইচ্ছের কথা সে মানুষকে বলতে পারে। একদিন ওদিকে সে গিয়েছিল। মানুদের বাসাটা সে দেখে এসেছে। সুন্দর মতো এক যুবা গলা বাড়িয়ে বলেছে মানু নেই। মানু বাড়ির গল্প করতে খুব ভালোবাসে। দিদির গল্প, বাবার গল্প, মার গল্প—কিছুই বাদ রাখেনি। খুব খোলামেলা এবং সরল সাদাসিদে ছেলে। কিন্তু কী আশ্চর্য কিছুদিন থেকে সেই মানুও কেমন গম্ভীর। সংসারে মানুর তো তার মতো হারাবার কিছু নেই। মানু সবার ছোট। তার বাবা রিটায়ার করেছেন সাত আট বছর। এবং এ—সময়ে মনে হল বাবা যদি আরও কিছু বেশি দিন বেঁচে যেতে চেষ্টা করতেন। অন্তত মার চুলে পাক ধরা পর্যন্তও যদি তিনি অপেক্ষা করতেন।

তারপরই ফের নবনীতার কথা মনে হতেই শিস দিতে দিতে সে নীচে নেমে গেল।—ও দাদু তোমার ঘুম ভাঙল না। দিদিমা, মাসি তোমরা কোথায়—চা কই। এখনও তোমরা ঘুমাচ্ছ। মিতা দরজা খুলে দেখল নানু নীচের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছে। মিতা কাছে গিয়ে বলল, কী রে দিলি সকালের ঘুমটা মাটি করে।

—কেমন ঠান্ডা বাতাস। চল না সামনের রাস্তাটা পার হয়ে বড় মাঠটায় নেমে যাই।

এখনও এখানে একটা বড় মাঠ রয়েছে। এ—অঞ্চলে এখনও অনেক ফাঁকা জায়গা, গাছপালা আছে। হেঁটে গেলে অনেকটা দূর হেঁটে যেতে ইচ্ছে করে। দক্ষিণের মৃদুমন্দ হাওয়া গাছপালার মধ্যে বয়ে যায়। আশ্চর্য এক প্রশান্তি তখন বাড়ি—ঘরে। মনেই হয় না মানুষের কোনো দুঃখ আছে।

নানু আজ সকাল সকাল স্নান করল। চা, জলখাবার খেল দাদুর সঙ্গে। মাসি সকালবেলায় সহসা দুটো মেহেদি হাসানের গজল গেয়ে ফেলল। এবং মনেই হয় না কোথাও এ—বাড়িতে কারও কোনো গোপন দুঃখ আছে।

নানু আজ পড়ার বইগুলিও উলটে পালটে দেখল। তার মনে হচ্ছে এ—সব পড়ে মানুষের আখেরে কিছু হয় না। শুধু পণ্ডশ্রম। ফলে তার জোরে জোরে গান গাইতে ইচ্ছে করছে। বইগুলি সরিয়ে আয়নায় নিজের মুখ দেখল। নরম দাড়ি গালে। ভালো করে আজ আবার দাড়ি কামাল। গালে হাত রেখে বুঝল বেশ মসৃণ। চশমার ভেতর চোখ দুটো ভারি স্নিগ্ধ। কোনো জ্বালা নেই। তারপর খুব ধীরে সুস্থে দাদুর ঘরে এসে বসল। ফোন তুলে ভাবল নবনীতাকে ফোন করবে। তখনই মনে হল, নম্বর তার জানা নেই। বিকেলে আবার একবার যাওয়া দরকার। এবং সে ভাবল, গেলেই ত হবে না, একটা অজুহাতের দরকার। তখনই মনে হল, নবনীতাকে নিয়ে সেই বাড়িটায় একবার যাবে। যেখানে সে তার বাবা মা এবং ঠাকুমার সঙ্গে বছরের পর বছর ছিল।

তখন অবশ্য জেঠু তাদের সঙ্গে ছিল না। কোথায় সংসারে একটা কাঁটা বিধে যায়, জেঠু এক সকালে, সেই ধুমসো মোটা মতো মেয়েছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে এসে বলেছিল, এই হাসি। এম এ পাশ। মাস্টারি করে। আমি বিয়ে করব মা। অবনীশ শেষ পর্যন্ত এমন একটা রাক্ষুসে ডাইনির পাল্লায় পড়ে যাবে ঠাকুমা স্বপ্নেও ভাবেনি। রাক্ষুসীটা আসার পর থেকেই এমন একটা সুখী সংসার দুদিনে কেমন হতশ্রী হয়ে উঠল।

তখন সংসারে এটা থাকে না, ওটা থাকে না। খরচ কেন এত বেশি হয়। সে শুতে পায় না জেঠুর সঙ্গে। মা নিত্যদিন বাবাকে গালমন্দ করে। বাবার ভীষণ খরচের হাত। সংসারে জেঠুর টাকা পয়সা দেওয়া ক্রমে কমে যেতে থাকল। এবং এক সকালে সেই রাক্ষুসীটাকে নিয়ে অন্য বাসায় উঠে গেল। বাবা সেদিন এত বেশি আঘাত পেয়েছিলেন যে দু’দিন কিছুই খাননি। এসব মনে হলেই তার চোখ জ্বালা করতে থাকে এবং আক্রোশ জমে ওঠে। অথচ আজ সকালে সে ভেবেছিল—সব রকমের আক্রোশ মন থেকে সরিয়ে দেবে। সে তো সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছে।

রাসবিহারী সকালে নানুর এই পরিবর্তনে কিছুটা বিস্মিত হলেন। তিনি নানুকে বললেন, কাল তোমার ফিরতে এত দেরি হল কেন?

নানু কাগজ ওলটাচ্ছিল। সে দাদুর দিকে না তাকিয়েই বলল, এক জায়গায় গেছিলাম।

সে তো বুঝতে পারছি। সেটা কোথায়?

বেশি দূর না।

দিনকাল ভালো না। তোমার জন্য আমরা চিন্তা করি, সেটা একবার মনে রেখো।

আর হবে না।

রাসবিহারী নাতির এমন কথায় আরও অবাক হয়ে গেলেন। ভালো মানুষের যে স্বভাব, প্রায় সে রকম কথাবার্তা নানুর। তিনি বললেন, তোমার জেঠু কাল ফোন করেছিলেন।

কোত্থেকে?

অফিস থেকে।

কিছু বলল।

বলেছে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে।

তাই বুঝি। তারপর কাগজটা রেখে হাত পা সটান করে বলল, তুমি কী বললে?

তুই পড়াশোনা একদম করছিস না বললাম।

নানু আর কথা বলল না। সে ভাবল আজই দুপুরে একবার ফোন করবে জেঠুকে। অফিসে এলেই তার ফোন পাবে জেঠু। সে বলবে, কাল তোমার ওখানে যাব জেঠু। কতদিন তোমাকে দেখি না। সংসারে আমার বড়ই প্রিয়জনের দরকার।

তারপর আর কেন জানি তার সময় কাটে না। কলেজ যাবে কী যাবে না ভাবছিল। একবার মনে হল কলেজে গেলে, সময়টা দ্রুত কেটে যাবে। মানু ক’দিন ধরে কলেজ কামাই করছে। ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের খেলা এলেই সে কলেজে আসে না। আজ হয়তো আসতে পারে। এলে নবনীতার সঙ্গে তার যে আলাপ হয়েছে সে—কথা বলবে। জানতে চাইবে, নবনীতার এমন কথাবার্তায় কী মনে হয়। মনে হয় কী নবনীতা তাকে গোপনে কিছু দিতে চায়। তারপরই ভাবল—যা, সে এ—সব মানুকে বললে, নবনীতাকে ছোট করা হবে। বরং কোনো ক্রাইসিস দেখা দিলে সে মানুর পরামর্শ নেবে।

কলেজে আজ তিনটে ক্লাস—জে এমের ক্লাসে সে খুব মনোযোগ দিয়ে কনসাইনমেন্ট কাকে বলে, তার বিল ভাউচার কেমন হয় শুনল। এবং ব্যাংকিং—এর ক্লাসে সে আজ কিছু নোটও নিল। অনেকদিন পর মনে হয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য জীবনে এ—সব দরকার। কৃতী মানুষ না হতে পারলে নবনীতার মান সম্মান রাখতে পারবে না।

কলেজ ছুটির পর সে একটা রেস্টুরেন্টে বসে দুপিস পাউরুটি, ডিম এবং এক কাপ চা খেল। এবং তখনই মনে হল এ সময় রওনা হলে ঠিক পাঁচটার মধ্যে নবনীতার বাড়িতে পৌঁছতে পারবে।

যখন পার্কটায় এল, তখন মনে হল রোদের আঁচ এতটুকু কমেনি। গ্রীষ্মের দুপুর সহজে শেষ হতে চায় না যেন। নবনীতা এখন কী করছে! ওর পরীক্ষা আসছে বছরে। তারপরই মনে হল গ্রীষ্মের ছুটি, নবনীতাদের ছুটি হয়ে যেতে পারে। কাল বাদে পরশু তার কলেজও বন্ধ হয়ে যাবে। নবনীতা বাড়িতেই থাকবে—না কী নবনীতার অন্য কোনো প্রেমিক আছে—যদি থাকে তবে! এই প্রশ্নটা তাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিল।

নানু তাদের পুরানো বাসাবাড়িটা পার হয়ে যাচ্ছে। তার মনেই নেই এ সেই বাড়ি, যেখানে বসে সে বাপের আদ্যশ্রাদ্ধ করেছিল। মাথা নেড়া, গায়ে নতুন মার্কিন কাপড়, প্রায় সন্ন্যাসী বালকের মতো তাকে দেখাচ্ছিল।

এ—বাড়িতেই তার শৈশব কেটেছে বলা চলে—বাবা জেঠু ঠাকুমা মা এবং সে! মা তখন বাড়ির বধূ। বড় করে কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, সিঁথিতে লম্বা সিঁদুর এবং খুব সকালে প্রাতঃস্নান, তারপরই রান্নাঘরে ঢুকে বাড়ির মানুষদের জলখাবার থেকে অফিস স্কুলের সময়মতো ঝাল—ঝোল ভাতের ব্যবস্থা এক হাতে। জেঠু তাকে একটা মিশনারি স্কুলে দিয়ে আসত। তখন সব কিছুই ছিল মায়া মাখানো, এমনকি বাড়ির বেড়ালটাও খেল কী না লক্ষ্য থাকত সবার। অথচ আজ নানু বাড়িটা পার হয়ে গেল, লক্ষ্যই করল না বাড়িটার দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে। বাবা গ্রীষ্মের দিনে রোজ সকালে বাড়িটার রোয়াকে এসে বসত। কোথা থেকে বয়ে আসত ঠান্ডা হাওয়া। বাবার চুল উড়ত। সে পেছনে এসে কখনও ঝাঁপিয়ে পড়ত। বাবা তখন বলত, নানু পাশে বোস। ওই দেখ কে আসছে। ধরে নিয়ে যাবে। ওর ছোট বুকটা কেঁপে উঠত—যেন কেউ নিয়ে যাবার জন্য সত্যি আসছে। সে ভয় পেয়ে বলত, বাবা আমি দুষ্টুমি করব না। তোমার পাশে চুপচাপ বসে থাকব। বাবা বলত ঠিক আছে, বলে দেব, নানু খুব ভালো ছেলে। এত ভালো থেকেও শেষ পর্যন্ত কারা তার সর্বস্ব লুণ্ঠন করে নিয়ে গেল। এক অদৃশ্য অশুভ ভয়ংকর হাত তাকে উদাসীন মাঠে রেখে চলে গেছে। এখন সেই উদাসীন মাঠ থেকে সে দু—হাত তুলে ছুটছে—আর কিছুদূর গেলেই সে জলছত্র পেয়ে যাবে। নবনীতা সেখানে গাছের নীচে একজন দুঃখী মানুষকে কতদিন পরে জলদান করবে।

সে দূর থেকেই নবনীতাদের জানলা দেখতে পেল। বুকের ধুকপুকানি বাড়ছে। সহসা নবনীতা এত প্রিয়জন হল কী করে। চারপাশে সব লুণ্ঠনকারীরা। সে গোপনে বলল, নবনীতা আমি এসে গেছি।

তারপরই নানুর খেয়াল হল বাড়িটার দরজা জানালা বন্ধ!

সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। প্রথমত কেমন সংকোচ, সে যে—এত দূর আবার চলে এসেছে কাকিমা যদি টের পায়, আসলে নবনীতাই তার আকর্ষণ। এ—সব মনে হতেই যতটা দ্রুত ভেবেছিল, দরজায় দাঁড়িয়ে বেল টিপবে, ঠিক ততটা দ্রুত সে কিছু করতে পারল না। এবং মনে হল, সে গতকালই এখানে এসেছিল—একটা দিন মাঝে পার হয়নি, নবনীতাও লজ্জায় পড়ে যেতে পারে, বেহায়া ভাবতে পারে তাকে। এত সহজে উতলা হওয়া ঠিক না। সে বেল টিপল না। সারাদিন একবারও মনে হয়নি কথাটা। সে নীচে নেমে কী করা উচিত ভেবে দেখবার জন্য পার্কটায় গিয়ে বসবে ভাবল।

তখনই মনে হল কেউ ডাকছে, এই নানুদা চলে যাচ্ছ কেন?

সে ওপরে তাকিয়ে দেখল, জানালার ফাঁকে ভারি মিষ্টি মুখ। আধভেজানো জানালায় রোদ এসে পড়েছে, রোদে ওর চোখ মুখ চিক চিক করছিল।

তারপরই কেমন গম গম করে বেজে উঠল বাজনা—শরীরের রক্তে সেই নিবিড় ধ্বনিমাধুর্য নানুকে কেমন ভালোমানুষ করে তোলে।

দরজা খুলে দিলে নানু বলল, সব বন্ধ। ভাবলাম কোথাও চলে গেছ।

কোথায় যাব?

এই কোথাও। তারপর মাথা নীচু করে সেই আগের মতো নানু বলল, তোমার কাছে একটা বিশেষ কাজে এলাম নবনীতা।

আগে বোস। তারপর না হয় কাজের কথা বলবে।

কতদিন নানুর কোনো প্রিয়জন ছিল না। সে সবাইকে ঘৃণা করে এসেছে। মানুষের কিছুই তার ভালো ঠেকেনি। সবাইকে মনে হয়েছে ফেরেব্বাজ, ধান্দাবাজ। যা খুশি সে বলে ফেলতে পারত। কিন্তু এখন সে কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। সে লাজুক বালকের মতো শুধু বসে থাকল। নবনীতা তাকে বসতে বলেছে। তাকে দোতলার ঘর থেকে ডেকে ফিরিয়েছে—এতসব মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার ওপর কৃতজ্ঞতায় চোখ কেমন ঝাপসা হয়ে গেল।

নবনীতা বলল, তুমি বসো। আমি আসছি।

কিন্তু আশ্চর্য। বাড়িতে যেন আর কেউ নেই। নবনীতার ভাইবোনেরও কোনো সাড়া পাচ্ছে না। কাকিমা কোথাও যেতে পারে, নবনীতা একা বাড়িতে। ওর শরীরটা ভীষণ দুলে উঠল। সে বলল, ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করবেন—আমি পারব না।

নানুর এই স্বভাব, অর্থাৎ শরীরের মধ্যে কোনো অশুভ ইচ্ছের প্রভাব বাড়তে থাকলে সব সময় এমন বলে সংযম রক্ষা করতে চায়।

তখনই নবনীতা ফিরে এল। সে খুব তাড়াতাড়ি শাড়ি পরে এসেছে। শাড়ি পরলে নবনীতাকে যুবতীর চেয়েও বেশি নারী মনে হয়! একজন নারী জীবনে কত দরকার, নবনীতাকে দেখার আগে নানু টের পায়নি।

নবনীতা আঁচলে গা ঢেকে বসল। বলল, আপনাকে একটা সারপ্রাইজ দেব নানুদা।

নানু এবং নবনীতার মাঝখানে শুধু একটা সেন্টার টেবিল। মাঝখানে এক গজ রাস্তা পার হতে হয়। অথচ এই এক গজ রাস্তা কত যোজন দূরে মনে হচ্ছে। আহা এই নারী সুধা পারাবার। অস্থিমজ্জায় রক্তে মাংসে বড় বেশি পটু নবনীতা।

সে বলল, নবনীতা কাকিমা কোথায়?

মা রবীন্দ্রসদনে গেছে আদিপাউস দেখতে।

তুমি গেলে না। ওরা কোথায়! তোমার ভাইবোন।

বাবার সঙ্গে গেছে! তুমি আদিপাউস দেখনি।

না।

দেখলে না কেন?

কী হবে দেখে?

কী হবে আবার! মানুষ নাটক দেখে কেন? সিনেমা দেখে কেন! আমি তো আজকাল কবিতার সকাল শুনতে যাই। কেমন একটা নতুন জগৎ মনে হয়।

কতদিন কিছুই দেখিনি।

এয়ারপোর্ট দেখেছ?

না।

একদিন দেখে এসো।

তুমি সঙ্গে গেলে যাব।

বারে আমি যাব কী করে! মা আমাকে তোমার সঙ্গে যেতে দেবে কেন?

দিলে কী হবে?

নবনীতা হেসেছিল। —তুমি সত্যি বড় সরল নানুদা। তোমার মতো মানুষ এখনও তবে পৃথিবীতে দু—একজন আছে।

জানো আমার খুব ইচ্ছে করে….তারপরই নানুর মনে হল, একদিনের আলাপে নবনীতাকে তার ইচ্ছের কথা বলতে পারে কিনা। সে সামান্য থেমে নবনীতার দিকে তাকাল। নবনীতা ছাপা হলুদ কলকা পাড়ের সিল্ক পরেছে। গায়ে সবুজ ব্লাউজ। গলায় সাদা পাথরের মালা। চোখে কাজল কিংবা ভ্রূ—প্লাক করা হতে পারে—কিংবা নবনীতার ভ্রূ এতই সুন্দর যে দেখলে মনে হয় আলগা হয়ে বসে আছে ভ্রূজোড়া। তখনই নবনীতা বলল, নানুদা তুমি কিছু খাবে?

কী খাব?

যা বলবে?

কত কিছু খেতে ইচ্ছে করছে নবনীতা—কিন্তু কে দেয়।

খুব ফাজিল।

নানু নিজের দিকে তাকাল। সে খুবই চঞ্চল হয়ে পড়ছে। নবনীতা এই বয়সে সবই কি বুঝতে পারে। সে ভেতরে ভেতরে কতটা অস্থির হয়ে পড়েছে এটাও কি চোখ মুখে ধরা দেয়। এমন কেন হচ্ছে। না কী এমনই স্বভাব তার, সহজেই সব জয় করে নেবার স্বভাব। কেউ যদি চলে আসে—কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী তার। সে বলল, নবনীতা তোমার আর কোনো প্রেমিক নেই তো?

ও মা, কী সব বিতিকিচ্ছিরি কথা বলছ নানুদা।

না এমনি বললাম। আচ্ছা তুমি কখনও পাহাড়ে গেছ?

যাব না কেন। ওইতো সেদিন আমরা রাঁচি থেকে ঘুরে এলাম। পাহাড়ে গেলে মন ভারি উদাস হয়ে যায়, না নানুদা?

যাও না। জেঠিমাকে নিয়ে তো যেতেই পার। কেদারবদরি যাওয়া তো খুব সহজ। সোজা ট্রেনে হরিদ্বার…..

নানু বলল, মা আর আমাকে নিয়ে কোথাও যাবে না।

নবনীতা উঠে জানালার পর্দাটা আরও বেশি ঠিকঠাক করে দিল। তারপর রেকর্ড প্লেয়ার থেকে সুন্দর একটা ভেনচারের মিউজিক তুলে নিল। এবং নানুর দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন লাগে ভেনচারের মিউজিক। আর শুনবে?

নানু আজ যথার্থই সুন্দর এবং সতেজ। সে উঁচু লম্বা, তার ওপর উঁচু হিলের জুতো পরেছে। হাত—পা লম্বা, একজন তরুণের ঠিক যা যা থাকলে সুপুরুষ মনে হতে পারে নানুর সব আছে। এবং ওর দিকে সব সময় নবনীতা সোজা তাকাতে পারছে না। মাঝে মাঝে নানুদা ভারি সরল মানুষ হয়ে যায়—এটাই বড় বিপদ। সবাই তো আর একরকমের নয়। কে কোন কথার কী মানে করে বসবে কে জানে!

নানুদা তোমার লাল বলটা আছে?

লাল বলটা মানে?

ওই যে সকালেই দেখতাম তুমি একটা লাল বল নিয়ে পার্কের দিকে তোমার জেঠুর হাত ধরে চলে যাচ্ছ।

তুমি দেখতে।

বা, মা যে বলত, ওই দ্যাখ মিঃ চক্রবর্তীর ছেলে, কী সুন্দর। কাঁদে না।

তুমি বুঝি কাঁদতে খুব।

কে জানে!

জানো নবনীতা অনেকদিন থেকে সেই লাল বলটাই খুঁজছি। কীভাবে যে বলটা আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল। বলেই নানু কেমন দুঃখী মুখ করে ফেলল। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল। যেন কোনো সুদূরে সেই লাল বলটা গড়িয়ে চলে যাচ্ছে—সে ছুটে কিছুতেই আর তার নাগাল পাচ্ছে না। মার মনীষদাই প্রথম টের পাইয়ে দিল তাকে, বলটা চুরি গেছে। কোথাও তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

এবং সঙ্গে সঙ্গে মগজে সেই আগুনের আংরা ধিকি ধিকি জ্বলে উঠলে সে বলল, ঈশ্বর আমি তো সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি, তবে আর আমার মাথায় ধক ধক রেলগাড়ি চালাচ্ছ কেন। সে তাঁর ঈশ্বরের কথা এ—সময় শুনতে পেল। তিনি বলছেন, সামনে দ্যাখ। —কী দেখছ?

নবনীতা।

সে কেমন?

তুলনা হয় না।

মাথার মধ্যে রেলগাড়ি আর চলছে?

না।

নবনীতা বলল, কার সঙ্গে কথা বলছ?

ও না না। নবনীতা আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি।

তবে শুনতে পাচ্ছি না কেন?

শুনতে পাচ্ছ না। তবে জোরে বলি।

সে তখন খুব ধীরে ধীরে বলল, লাল বলটা খুঁজে পেয়েছি। নবনীতা আমার লাল বলটা এখন বুঝতে পারছি কার কাছে আছে।

কার কাছে? নবনীতা খুব হতচকিত গলায় বলল।

বলটা তোমার কাছে আছে। তুমিই আবার লাল বলটা আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারো।

আমার কাছে? কী বাজে বকছ নানুদা! আমি লাল বলটা দিয়ে কী করব!

তোমার কাছেই আছে। কাল সহসা জানলায় তোমার মুখ দেখে টের পাই। আশ্চর্য এক জ্যোৎস্না দেখতে পাই বনভূমিতে খেলা করে বেড়াচ্ছে।

নানুদা তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে না তো!

না, আমি ঠিক আছি। সত্যি বলছি আমার মাথার কোনো গণ্ডগোল নেই। আগে ছিল। হুঁসহাস রেলগাড়ি মাথার মধ্যে ঢুকে যেত। তোমাকে দেখার পর সব আমার নিরাময় হয়ে গেছে নবনীতা।

নবনীতা এবার উঠে দাঁড়াল। নানুর দিকে আর তাকাতে পারছে না সে। একজন অসহায় যুবক মাথা নীচু করে এ—ভাবে পায়ের কাছে বসে থাকলে বড়ই অস্বস্তি। সে অন্য প্রসঙ্গে যেতে চাইল। এখন আপাতত চা জলখাবার সামনে রাখার ইচ্ছে। সে ভিতরে ঢুকে কাজের মেয়েটিকে বলল, চা দাও! দেখ ফ্রিজে মিষ্টি আছে। বের করে দাও।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *