Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

সারারাত রাসবিহারী ভয়ংকর উচাটনের মধ্যে কাটিয়েছেন। নানু রাতে বাড়ি ফেরেনি। সকালে তিনি তবু একবার কী ভেবে দোতলায় নানুর ঘরে উঁকি দিয়েছিলেন, না নেই। দরজার শেকল তোলা। তিনি এখন কী করবেন বুঝতে পারছেন না। পুলিশে জানাবেন? অবনীশকে! আজকাল যত্রতত্র মানুষ খুন হচ্ছে। পুলিশ তাড়া করে নিয়ে যাচ্ছে, তারপর মাঠে কিংবা নদীর পাড়ে লাশ ফেলে রেখে চলে আসছে। সারা পশ্চিমবঙ্গে নরমেধ যজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। আর কার কাছে খবরটা দেওয়া যায়। ঘুম না হওয়ায় চোখ জ্বালা করছে। তিনি ধীরে ধীরে নেমে আসছেন সিঁড়ি ধরে। এখনও এ—বাড়ির কেউ জানেই না নানু রাতে বাড়ি ফেরেনি। কারণ নানুর ফেরার জন্য শেষ খাওয়ার পর কিছু কথাবার্তা থাকলে হেমর, অথবা হেম যদি প্রসন্ন থাকে, একটু পান জর্দা খাবার ফাঁকে পাড়ার কারও কারও বাড়ির গুপ্ত খবর দিতে যতটুকু দেরি কিংবা যাকে বলা যায় অপেক্ষা—ততটুকুই নানুর জন্য অন্য সবার চিন্তা। অন্য সব বলতে অবশ্য দু’জনই। হেম আর মিতা। এরা কেউ নানুর জন্য এর বেশি কোনো টান বোধ করে না।

হেমর ঘরের দরজা বন্ধ। ঘুম থেকে ওঠেনি। মিতার ঘুম ভাঙতে বেলা হয়। সবারই আলাদা ঘর। ঘরগুলির পাশ কাটিয়ে গেলেন—কাউকে ডাকলে না। খুব সকালে তিনি সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠেছেন—আকাশ ভালো ফর্সা হয়নি। সিঁড়ি ধরে নেমে করিডোর দিয়ে হেঁটে যাবার সময় মনে হল, আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। ভিতর ঘরটা পার হলেই হেমর ঘর। তারপর তাঁর ঘর, শেষে বসার ঘর। হেঁটে যেতে যেতে তিনি বুঝতে পারছিলেন, আলাদা ঘরে থেকে সবাই ক্রমে সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছে।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই তিনি কাচের জার থেকে খালি পেটে এক পেট জল খান। যৌবন থেকেই কনস্টিপেসান। যৌবন থেকেই এই জল খাবার অভ্যাস। ইদানীং তিনি সকালে পায়চারি করে ভালো ফল পেয়েছেন। জলটা খেয়েই পথে কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়ান এবং এক সময় তার ঠিক বাথরুমে যাবার সময় হয়ে যায়। তিনি আজকাল আরও একটি অভ্যাস গড়ে তুলেছেন। সকাল বিকাল বাথরুমে যাবার আগে সামান্য খৈনি মুখে দেন। এটি নিধুর দান। নিধুই তাঁকে শেষ বয়সে একটা নেশার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তিনি হাতে সামান্য খৈনি পাতা এবং চুন কৌটা থেকে বের করে নিলেন।

আশ্চর্য এখন তাঁর এসব ভাববার সময় নয়। তিনি যে সারারাত ঘুমোননি, কেউ এটা টেরই পায়নি। ঘর বারান্দা লন এই সারারাত করেছেন। এখন তিনি ঢক ঢক করে জল খাচ্ছেন—যদি অবনীশের বাড়িতে নানু থেকে যায়, তবে ফিরতে সাতটা আটটা হবে। এই সময়টুকু তাঁকে অপেক্ষা করে দেখতে হবে। তারপরই কেমন তিনি সংসারের সবার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। যেন সবাই মিলে তাঁর বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র করছে। ষড়যন্ত্রটা এই নানুকে কেন্দ্র করে মনে হল তাঁর। এই বয়সে এত ভাবনা তিনি আর বইতে পারছেন না।

অথচ রাসবিহারীকে দেখলে মনে হবে না ভিতরে ভিতরে এতটা বিচলিত তিনি। নিধু বারান্দায় এসে ডাকল, বাবু।

রাসবিহারী বাইরে বের হয়ে এলেন।

কিছু বলবি?

দড়ি কিনতে হবে। টেপি দড়ি ছিঁড়ে ফেলেছে।

কিনে আনবি।

নিধু চলে যাচ্ছিল। তিনি ফের ডাকলেন, কারণ কাল রাতে কেবল নিধুকেই বলা হয়নি। নিধু কাছে এলে বললেন, দাদাবাবু তোকে কাল কিছু বলে গেছে?

না ত।

ওতো রাতে ফিরে আসেনি।

কোথাও থেকে গেছে।

কোথায় থাকবে।

কেন তেনার জ্যাঠার বাড়িতে।

জানি না। রাস্তাঘাটের যা অবস্থা। এত করে বলেছি পকেটে ঠিকানা রাখবি।

নিধু ঠিক বুঝতে পারছিল না, পকেটে ঠিকানা রাখলে কী হয়। সে চলে যাচ্ছিল।

রাসবিহারী বললেন, এই শোন।

নিধু কাছে এসে দাঁড়াল।

কোথাও কোনো গণ্ডগোল হয়েছে?

কীসের গণ্ডগোল।

এই মানে…তারপরই মনে হল কতটা বিচলিত হলে এমন হয় এই প্রথম তিনি টের পেলেন। যেন সারা কলকাতা শহরের কোথাও গণ্ডগোল হওয়ায় ট্রাম বা বাস বন্ধ ছিল এবং সেজন্য নানু ফিরতে পারেনি। রাতে অবশ্য নিধুকে একবার ডেকে তুলে বলেছিলেন, পঁয়তাল্লিশ নম্বর বাস চলছে কিনা দেখে আয় তো।

সে রাস্তা থেকে দেখে এসে বলেছিল, চলছে বাবু।

তারপর তিনি বলেছিলেন, ফোন করবেন। কিন্তু কাকে—তখন রাত বারোটা। সবাই ঘুমে মরে আছে। রিসিভার হাতে নিয়ে বসেছিলেন, পুলিশ বাদে আর কাকে এত রাতে ফোন করা যায়। তাঁর একবার মনে হয়েছিল, কাউকে করা যায় না। সবাই তাঁর উচাটনে বিরক্ত বোধ করবে। তিনি রিসিভার তুলে নামিয়ে রেখেছিলেন।

তাঁর মনে হয়েছিল, বেলঘরেতে মেজ—জামাইকে খবরটা দেওয়া দরকার। অরুণকে দেওয়া দরকার। এবং তাঁর মনে হয়েছিল, নানুর খুব রাত করে ফেরার অভ্যাস বলে মাঝে মাঝেই খুব বেশি বিচলিত হয়ে পড়লে এমন দরকারের কথা মনে পড়ছে তাঁর। এসব যখন ভাবতেন তখনই দেখতে পেতেন সদর খুলে একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি লনে ঢুকছে। কালও ভেবেছিলেন, নানু ঠিক এসে যাবে। অনেক দূর পর্যন্ত তিনি অস্পষ্ট অন্ধকারে তাকিয়ে থেকেছেন—রাস্তায় কেউ ফিরলেই মনে হয়েছে, বোধহয় নানু আসছে। পাতা নড়লে মনে হয়েছে কারও ছায়া নড়ছে। কুকুর হেঁটে গেলে মনে হয়েছে, হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে আসছে কেউ। এবং এসব করতে করতেই রাতটা কাবার হয়ে গেল। সদর খুলে একবার তিনি একা রাস্তায় গিয়েও দাঁড়িয়েছিলেন কিছুক্ষণ। কেউ আর ফিরছে না। সব বাড়িগুলির দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল, বড়ই সৌভাগ্যবান এরা। এদের সবাই অন্তত আজকের রাতের মতো ফিরে এসেছে। তাঁর একজন এখনও আসেনি। তারপরই মনে হয়েছিল এত রাতে একা দরজা খোলা রেখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক না। তিনি নিধুকে সঙ্গে নিতে পারতেন। কিন্তু নিধু ঠিক পরদিন হেমকে বলবে এবং নাতির দুশ্চিন্তায় ঘুম হচ্ছে না ভেবে মুখ বেঁকিয়ে হাসবে হেম। কারণ নানু ওদের কাছে জাহান্নামে যাওয়া ছেলে। ইদানীং ওটা নানুর আরও বেড়েছে। এই বাড়ার মূলেও আছেন তিনি। বড়ই উভয় সংকটে পড়ে গেছেন রাসবিহারী।

তখনই মনে হল হেম দরজা খুলে বের হয়ে এসেছে। হেম এই সময় ঈশ্বরের নাম করতে করতে বের হয়ে আসে। হেম যে কার মঙ্গল প্রার্থনা করে রাসবিহারী ঠিক বুঝতে পারেন না। আসলে হেম নিজেরই জন্য প্রার্থনা করে বোধহয়। পৃথিবীতে এমন স্বার্থপর এবং নিষ্ঠুর রমণীর হাতে তাঁর জীবনটা কেটে গেল। পরজন্মে বিশ্বাস আছে বলেই রক্ষে। কিন্তু এতসব কথা কী তখন আর মনে থাকবে।

রাসবিহারীর একবার ইচ্ছে হল বলে, নানু ফিরে আসেনি। কিন্তু কী হবে বলে। তিনি খৈনিটা ঠোঁটের ফাঁকে ফেলে দিলেন। তারপর দেখলেন বীণা সদর দরজা দিয়ে ঢুকছে। বীণাকে ঢুকতে দেখেই বললেন, তোমাদের নানুবাবু কাল ফেরেননি।

কোথায় গেছেন?

কোথায় গেছেন তিনিই জানেন। তারপরই একটু থেমে বললেন, তোমাদের ওদিকে কোনো গণ্ডগোল হয়েছে?

ন তো!

কিছুটা স্বস্তি। রাসবিহারী ফের বললেন, যা রাস্তাঘাট! রোজই কোথাও না কোথাও গণ্ডগোল।

বীণা বলল, কোথাও থেকে গেছে। বন্ধুবান্ধবের কাছে। খুব নিজের লোকের মতো কথাগুলো বলল বীণা।

ওরতো বন্ধুবান্ধবও নেই।

কেন ওই যে মানুবাবুর কথা বলে!

মানুবাবুরা কোথায় থাকে তুমি জানো?

এ বাড়িতে নানুবাবুর সঙ্গে বীণার তবু কিছু কথা হয়। রাসবিহারীর সঙ্গে কিছু কথাবার্তা এবং মিতার সঙ্গে নানুবাবু খুব প্রয়োজনে কথা বলে থাকে। অথবা এক ধরনের জেদ দেখা দিলে মাথায় মিতাদির পেছনে লাগার স্বভাব নানুবাবুর। সে মাসে দু—মাসে এক আধবার। অন্যসময় নানুবাবু নিজের ঘরেই শুয়ে বসে কাটিয়ে দেয়। বই পড়ে, খবরের কাগজ পড়ে, কলেজ যায়, রাত করে ফেরে—জামাকাপড় কেচে দেয় বীণা, ঘর ঝাঁট দেয় বীণা, চা—জলখাবার দেয় বীণা—সুতরাং এ—বাড়িতে রাসবিহারীর পরই নানুর সঙ্গে বীণার সামান্য মধুর সম্পর্ক। সুতরাং মানুবাবুর কথাও তার জানার কথা থাকতে পারে। সে বলল, না বাবু।

কেমন বিরক্ত হলেন রাসবিহারী।

তোমরা কোনো খবরই রাখো না।

বীণার কাজ অনেক। এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুধু কথা বললে চলবে না। হেমর খুব পছন্দও নয় বাড়ির কর্তাব্যক্তি এভাবে সাতসকালে এত কথাবার্তা বলুক। রাসবিহারী বললেন, ঠিক আছে যাও।

আসলে রাসবিহারীর আশঙ্কা—যদি নানু গণ্ডগোলের মধ্যে পড়ে যায়, কিংবা জড়িয়ে যায়। যদি নানু আর না ফেরে—যদি নানু তার বাবার মতো কিছু একটা করে ফেলে। দুর্ঘটনার জন্য তিনি সবসময় নানুর পকেটে একটা ছোট চিরকুট রাখতে পছন্দ করেন। চিরকুটে ঠিকানাটা লেখা থাকে। যেখানেই দুর্ঘটনাটা ঘটুক খবর পেতে যেন দেরি না হয়। প্রথম প্রথম তিনি বলতেন, বুঝলে নানু, কলকাতার রাস্তাঘাট খুবই খারাপ। কাগজ খুললেই দেখতে পাবে দুর্ঘটনায় মৃত্যু। সঙ্গে একটা ঠিকানা রেখে দেবে সবসময়।

নানু হেসে বলেছিল, ওটা কী মৃতসঞ্জীবনী।

রাসবিহারীর চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছিল, সবকিছু নিয়ে তোর ঠাট্টা।

তুমিই বল দাদু যদি ঘটেই যায়, ওটা আমার কতটা উপকারে আসবে।

আমাদের খবরাখবর পেতে হবে না। এমন বলতে গিয়ে সেদিন রাসবিহারীর মনে হয়েছিল—বড় স্বার্থপরের মতো কথাটা শোনাবে। তিনি আর তাকে কিছু বলেননি—শুধু বিকেলে তিনি সেদিন নানুর ঘরে বসে ওর বইখাতায় সর্বত্র এ—বাড়ির ঠিকানা লিখে রেখেছিলেন। অর্থাৎ কলেজ করে বাড়ি ফিরতে দেরি হলে যেন ভাবনার নেই। খাতাটায় ঠিকানা লেখা আছে। পুলিশের চোখে, না হয় অন্য কারও চোখে এটা পড়বেই। এবং একটা সুন্দর ডায়েরিতে ঠিকানা লিখে নানুকে দিয়ে বলেছিলেন, ডায়েরি ব্যবহার করতে শেখো, সঙ্গে রাখতে শেখো। ভবিষ্যতে কাজে আসবে।

নানু কলেজে অথবা বাড়ির বাইরে বের হলেই রাসবিহারী ওর ঘরে ঢুকে দেখতেন, সঙ্গে ডায়েরিটা নিল কিনা। প্রশ্ন করলে এমন ট্যারা জবাব দেবে যে আর একটাও কথা বলতে ইচ্ছা হবে না। আসলে ওর মাথার মধ্যে সেই যে রেলগাড়িটা ঢুকে গেল আর বের হল না। নানুই বলেছিল, দাদু বিরক্ত করবে না। মগজের মধ্যে আস্ত একটা রেলগাড়ি ঢুকে আছে। রাসবিহারী ওর কথাবার্তার ধরন দেখেই বুঝতে পারেন কখন সেটা ঢুকে যায়, কখন সেটা বের হয়ে আসে। তিনি ওর টেবিল হাটকেই দেখতে পেতেন, লাল ডায়েরিটা টেবিলে পড়ে আছে। সঙ্গে নিচ্ছে না। মাঝে মাঝে সেজন্য চিরকূট রেখে দিতেন ওর জামা অথবা প্যান্টের পকেটে। একদিন নানু হেসে বলেছিল, দাদু তুমি বড় ভীতু স্বভাবের মানুষ। অথচ দাদু, তোমার মেয়েরা এক একজন কংকাবতী। এটা কেমন করে হয়।

রাসবিহারী ঢোক গিলে ফেলতেন। নানুর কথার জবাব দিতে পারতেন না। পারতেন না যে তা ঠিক নয়, পারতেন। তবে খুব রূঢ় শোনাত। এমনিতে মাথাটা গেছে, তার ওপর বাপের মৃত্যুর জন্য দায়ী আসামিদের এখন খুঁজে বেড়াচ্ছে। কী যে হবে! এবং তখনই তিনি হেঁকে উঠলেন নিধু—নিধু, দেখত কাগজ দিতে এত দেরি করছে কেন!

নিধু রাস্তার দিকে চেয়ে বলল, আজ্ঞে আসবে। সময় হয়নি বাবু।

তিনি এখন কী যে করেন! বাথরুমেও ঢুকতে পারছেন না। যদি কাগজটা এসে যায়। কাগজটা পড়লে তিনি কিছুটা স্বস্তি পাবেন। কোনো গণ্ডগোলের খবর থাকলে কাগজে ঠিক থাকে। সে শহরের যেখানেই ঘটুক। এই কাগজটা পড়ার পর চিন্তা করবেন, কোথায় কীভাবে খোঁজখবর নেওয়া যায়।

এবং কাগজটা এলে প্রথমেই সারা পাতায় তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন। কাগজে একটাও মৃত্যুর খবর নেই। শুধু কিছু নিরুদ্দেশের খবর আছে। এই কলমে নানুর একটা ছবি মাপতে হবে। যা একখানা বাড়ি, নানুর ছবিও হয়তো সময়কালে ঠিক হাতের কাছে পাওয়া যাবে না। আর তখনই মিতা হাই তুলতে তুলতে ঘর থেকে বের হয় আসছে। সামনে মিতাকে দেখেই তিনি কাগজটা সরিয়ে রেখে বললেন, হ্যাঁরে নানুর ছবি আছে বাড়িতে?

এই সাতসকালে বাবা নানুর ছবির কথা জিজ্ঞেস করায় খুব অবাক হয়ে গেল মিতা। সে বলল, কেন নাতির বিয়ে ঠিক করেছ নাকি।

রাসবিহারী বুঝতে পারেন সবকিছুর মূলে হেম। মেয়েরাও ঠিক তাকে সমীহ করে না। এ ছাড়া এই বাড়িতে নানুকে জায়গা দেবার পর থেকেই সবাই কেমন তাঁর ওপর বিরূপ হয়ে উঠেছে। তিনি বললেন, আছে কী না বলো। বিয়ে দেব কী দেব না সেটা আমি বুঝব।

তুমি রেগে যাচ্ছ কেন বাবা?

এমন কথা তোরা বলিস। জানিস কাল রাতে নানু ফেরেনি। কেমন ছেলেমানুষের মতো নালিশ জানালেন যেন রাসবিহারী।

মিতা দেখল তার বাবা, তার বাবা রাসবিহারী, শ্যামলা রঙের দোহারা চেহারার মানুষ। চোখে নিকেলের চশমা। হাতে কাগজ। দুশ্চিন্তায় চোখের নিচে কালি। তিনি ধুতি পাট করে পরে আছেন। তাই পরে থাকেন। এবং তাঁর দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন। বাবার জন্য বুকটা মিতার ভিতরে কেমন গুড় গুড় করে উঠল। এমন শূন্য দৃষ্টি সে বাবার চোখে কখনও দেখেনি। বলল, বাবা ও ফেরেনি, ফিরবে।

কখন আর ফিরবে।

মিতা খুব যেন বয়সি মেয়ে হয়ে যাচ্ছে। তার আর হাই উঠছিল না। সে বাবার পাশে বসে বলল, তুমি সেজদিকে বরং লিখে দাও, সে যেন তার ছেলেকে নিয়ে যায়। ওর জন্য তোমার আয়ুক্ষয় হচ্ছে বাবা।

রাসবিহারী মনে মনে এ—কথাটা সত্য ভাবেন। যদি বুড়ো বয়সে এই উটকো ঝামেলা ঘাড়ে এসে না চাপত তবে তিনি আরও কিছু বেশিদিন বাঁচতেন। হেমর নিষ্ঠুরতার জন্যও একসময় তাঁর এ কথাটা মনে হত। দীর্ঘদিন সয়ে সয়ে ওটা ভুলে গেছিলেন। নানু আসার পর থেকে আবার সেই আয়ুক্ষয়টা চলছে এমন মনে হল তাঁর।

দুপুরেই রাসবিহারী সব আত্মীয়স্বজনকে ফোনে জানালেন, নানু কাল রাতে বাড়ি ফেরেনি। পুলিশে খবর দেওয়া হবে কিনা এটা যেন বসে সবাই ঠিক করে। কারণ রাসবিহারী এখন আর একজন উঠতি যুবকের দায় নিজের ঘাড়ে একা রাখতে সাহস পাচ্ছেন না। কোথাও গিয়ে নানু যদি আত্মহত্যাই করে বসে তবে আবার একটা কেলেঙ্কারি। এখন বসে ঠিক করা দরকার কী করা হবে।

প্রথমে তিন জামাইয়ের অফিসে ফোন, তারপর অবনীশের অফিসে। রাসবিহারী বললেন, আমি রাসবিহারী বলছি।

অঃ তাওইমশাই ভালো আছেন? নানুকে একবার দেখতে যাব ভাবছিলাম, কিন্তু আপনাদের মেয়ের শরীরটাতো ভালো না, রাস্তায় চলাও আজকাল ভেরি রিসক। কখন কোথায় কারা পুলিশ খুন করছে, স্কুলে আগুন দিচ্ছে, বিদ্যেসাগর মশাইর মুন্ডু উড়িয়ে দিচ্ছে—কী অরাজক অবস্থা—বাড়ি থেকে বের হতেই ভয় করে। ইয়েস অ্যানাদার কোয়েশ্চান হচ্ছে নানুর মা চিঠি দিয়েছে? আমরা তো অনেকদিন পাইনি। নানুর ব্রেন ভেরি ব্যাডলি অ্যাফেকটেড। ওটাও ওর মাকে জানানো দরকার। আপনার কী মনে হয়?

যাক তবু কথা শেষ করল। তিনি জানেন, তাঁর এই আত্মীয়টি হরবকত কেবল কথা বলে! কথা বলতে আরম্ভ করলে শেষ করতে চায় না। ভদ্রতা বোধটা পর্যন্ত গেছে। অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় রাসবিহারী বললেন, নানু কাল রাতে ফেরেনি।

মাই গড। হোয়াট হেপেনড!

কী হেপেনড আমি জানিনা। তোমাকে জানানো দরকার তাই জানালাম। ফোন নামিয়ে রাখবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু ও—প্রান্ত থেকে গলা সরু করে সে অজস্র কথা বলে যাচ্ছে—নাথিং কেন বি ডান। বলুন আপনি কী করতে পারেন। আমাদের সামাজিক স্ট্রাকচারটা ভেঙে না ফেললে কিছু করা যাবে না। নানু এই সামাজিক স্ট্রাকচারের এগজামপল।

রাসবিহারী অধৈর্য হয়ে পড়ছিলেন—কিন্তু কথা শেষ না হলে ছাড়েন কী করে!

আমরা ওকে সামারিলি ডিসমিস করে দিয়েছি। নো হোপ। যত পড়ান আই মিন, ডে বিফোর ইয়েসটারডে নানু কেম টু মাই হোম, অঃ হো নো নো, নট ডে বিফোর ইয়েসটারডে। ইট ইজ অন সিকসটিনথ। এসেই আমাদের মেড—সারভেন্টের ঠিকানা চাইল। সব তো বলা যায় না। স্ক্যান্ডাল। পারিবারিক স্ক্যান্ডাল।

রাসবিহারী যেন কোনো সূত্র খুঁজে পাচ্ছেন—তিনি অধীর গলায় বললেন, বল বল তারপর কী!

তারপর স্ক্যান্ডাল! বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় এটা হবেই। ইট মাস্ট হেপেন।

রাসবিহারী জানেন, এখনই ঠিকমতো ধরিয়ে দিতে না পারলে, তাঁর এই পরম আত্মীয়টি কথার সূত্র হারিয়ে ফেলবে। তিনি বললেন, নানু কবে গেছিল তোমার ওখানে যেন?

সিকসটিনথ।

কী বলল নানু যেন?

বলল লীলা কোথায়?

লীলা।

আমাদের মেড—সারভেন্ট। আমরা বাড়ি থাকি না, নানু মাঝে মাঝে বাড়ি না থাকলে চলে আসত। তারপরই যেন দৃঢ়তার সঙ্গে বললে, আফটার অল উই লিভ ইন সোসাইটি। সব করা যায় কিন্তু সোসাইটির ভ্রূকুটিকে সামারিলি ডিসমিস করা যায় না।

রাসবিহারী ভাবলেন, এই রে আবার অন্য নৌকায় উঠে পড়তে চাইছে। প্রায় তিনি ঠ্যাং চেপে ধরার মতো বললেন,

নানু কী বলল?

বলল, লীলা কোথায়?

সে কোথায়?

ওকে তো আপনাদের মেয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। নানু ইজ আওয়ার কমপ্লিটলি লস্ট বয়। কী বলব, পারিবারিক কথা, মেয়েটা নেই জেনে নানু আপনাদের মেয়েকে খুন করবে বলে শাসিয়ে গেছে। বাট দিস মার্ডার ইউ থিংক হাউ আগলি টক। সমাজব্যবস্থা কতটা জাহান্নামে যেতে বসেছে ভাবুন। তুই তোর মাতৃসমাকে একথা বলতে পারলি। তোর কী এই শিক্ষা হল। তুই প্রীতিশের ছেলে, আর তুই আমার ভাইপো হয়ে জেঠিকে খুন করতে চাস!

রাসবিহারী এত সব কিছুই জানতে চান না। নাতির জন্য তাঁর মধ্যে যে উদ্বেগ ছিল, সেটা যেন কিছুটা প্রশমিত হচ্ছে। হয়তো নানুর আরও খবর ওর জেঠা এখন দেবে। তিনি বললেন, তারপর ও কোথায় গেছে জান?

কী হবে জেনে! হোয়াই আই স্যাল ফিল এনি ইনটারেস্ট—আপনি বলুন, ইফ ইট উড বি ইয়োর কেস আপনি কী করতেন!

রাসবিহারী বললেন, সত্যি। কী করব বলো কোথায় ফেলি! তোমাদের ওখান থেকে কোথাও যাবে কিছু বলেছে?

ইয়েস যাবে বলেই নানু ক্লাইমেকসে এসে গেল। বলল, ঠিকানা না দিলে খুন করব।

কার ঠিকানা?

আর কার সেই মেয়েটার।

তোমরা ওকে ঠিকানা দিয়েছ?

না দিয়ে উপায়। খুন হওয়ার চেয়ে ঠিকানা দেওয়া কত সহজ কাজ বলুন। এট লাস্ট উই গেভ দ্য অ্যাড্রেস।

ভালো করেছ।

ভালো করিনি বলুন। যদি খুন হয়ে যেত, তবে আবার পুলিশের ঝামেলা, কোর্ট কাছারি, উই হ্যাভ টু সুট এ কেস এগেইনস্ট হিম।

রাসবিহারী বুঝতে পারলেন, ফোনে এত কথা হয় না। তবে নানু মেয়েটির ঠিকানা নিয়ে চলে যেতে পারে কারণ সে তার টাকাপয়সাও বুঝে নিয়েছে, এ অবস্থায় রাসবিহারীর আপাতত কিছু করার নেই। এখন জামাইদের নিয়ে এ বিষয়ে কিছু একটা স্থির সিদ্ধান্তে আসা দরকার। এই বয়সে আর এত উদ্বেগ বয়ে বেড়াতে পারছেন না। তারপরই মনে তিনি কেমন প্রশান্তি বোধ করলেন। নানুর মধ্যে ভালোবাসার জন্ম হচ্ছে। ভালোবাসা শব্দটি কতদিন পর বড় প্রিয় শব্দ মনে হল তার। কাজ করতে করতে আর সংসার করতে করতে হেমর সঙ্গে একসময় সব মানুষের মতো ভালোবাসা শব্দটি তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। সব বিস্তারিত জানা দরকার। ফোনে সব শোনা যায় না ভালো করে। তিনি অবনীশকে বললেন, বিকেলে আমার তিন জামাই আসবে। বিষয় নানু। যদি তুমি আসো খুব ভালো হয়। তোমাদের পরামর্শ এখন আমার খুবই দরকার। যদিও রাসবিহারী জানেন, এই মানুষটির কাছে তার পরামর্শ চাইবার মতো কিছু নেই, কিন্তু নানুর জেঠু এই স্বত্বাধিকারে পরামর্শ করা বাঞ্ছনীয়। পরে যেন কোনো অনুযোগের ভাগী হতে না হয়। রাসবিহারী ফোন ছেড়ে দিতে যাচ্ছিলেন, তখনই আশ্চর্য কান্না কান্না গলা অবনীশের—আই ক্যান সেড টিয়ার্স ফর নানু বাট আই ক্যান ডু নাথিং মোর। সো হোপলেস আই অ্যাম তাওইমশাই।

তুমি এসো।

যাব।

তারপরই রাসবিহারী মিতাকে ডেকে বললেন, নানুর কিছুটা খোঁজ পাওয়া গেছে। ওর জেঠু বলল সব। নানু আমাদের হাতের বাইরে চলে গেল। কিন্তু ঘটনাটা কী মেয়েকে বললেন না। লজ্জা বোধ করলেন। তারপরই মনে হল কলঙ্ক। একটা ঝি—মেয়ের জন্য নানুর মতিভ্রম হবে তিনি কখনও এমন ভাবেননি। কিন্তু ভালোবাসা শব্দটি কতদিন পর মাথায় এসেছে। এটা মাথায় এলে নানু কখনও আর আত্মহত্যা করতে পারে না। রাসবিহারী সহসা আশ্চর্য রকমের হালকা বোধ করলেন কথাটা ভেবে। তিনি প্রায় লাফিয়ে সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে যেতে থাকলেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *