মানুষের হাহাকার – দশ
ও মা আপনি বসে পড়লেন কেন?
মানু ছুটে আসছিল। সামনে এমন একজন তরুণী! খোলা মাঠ, নীল আকাশ এবং দূরে অশ্বারোহী মানুষ, গাড়ি যাচ্ছে দ্রুত, এ—সবের ভেতর মাথাটা তার গোলমাল করে ফেলছিল। সে সাপ্টে ধরবে, তারপর যা হবার সব হবে, ভেতরে সে এইসব ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে উঠছিল। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য অথবা মাতালের মতো টলতে টলতে ছুটে যাচ্ছিল। খোলা আকাশ নিচে দিবালোক, কিছুই তার খেয়াল ছিল না। সে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তারপরই মার মুখ চোখে ভেসে উঠল। মা, দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে! বাবা বারান্দায় পায়চারি করছে। এত সব নিজের মানুষরা নড়েচড়ে উঠলে, সে আর ছুটতে পারেনি। মাথা ধরে বসে পড়েছে। এটা সে কী করতে যাচ্ছে!
মীনা বলল, কী হয়েছে আপনার?
জবা বলল, আপনার কোনো অসুখ আছে?
মানু কোনোরকমে বলল, বোধহয় আছে।
বোধহয় আছে মানে! জবা সামান্য ঝুঁকে কথাটা বলল। এমন সুপুরুষ একজন যুবকের কথা বলতে কেন এত কষ্ট বুঝতে পারছে না।
মানু বসেই থাকল। বুড়ো মানুষের মতো লাগছে নিজেকে। সে খুব সময়মতো নিজেকে নিরস্ত করতে পেরেছিল। এবং এটাই তাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। কেন তার এটা হল! নিজের ওপর সে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। সবার কী হয় সে জানে না, কিন্তু তার এটা একটা খারাপ স্বভাব। কোনো সুন্দরমতো যুবতী দেখলে সে অনেকটা পথ তার পিছু পিছু হেঁটে যায়। হেঁটে যেতে ভালো লাগে। তীব্র আকর্ষণ বোধ করে। এবং যুবতীর সবকিছুতে যে রহস্য, সেই রহস্যের অভ্যন্তরে পৌঁছবার জন্য সে এইমাত্র ছুটে এসেছিল, অথচ বাহ্যিক সব নিয়মকানুন তাকে কারাগারে বন্দী মানুষের মতো করে রেখেছে। তার মনে হয়েছিল সে একটা আত্মহননের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। যদি মায়ের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাজার মুখ তার মাথায় বিদ্যুতের মতো ক্রিয়া না করত, যদি ঘটনাটা ঘটেই যেত, তবে কাল সকালে খবরের কাগজের শিরোনাম হয়ে যেত সে। এই দুঃসাহসী, দুঃসাহসী না লম্পট, কোন শব্দ ব্যবহার করত সাংবাদিকরা ঠিক এ মুহূর্তে তার মাথায় আসছে না। রাতে সে বাড়ি ফিরতে পারত না। ছাল চামড়া ছাড়িয়ে নিত সব সাধু ব্যক্তিরা। এত সাহস তোমায়! পুলিশ, ব্যাটনের গুঁতো মেরে বলত—হারামি বদমাস স্কাউন্ড্রেল! তুমি ভরদুপুরে ভদ্রলোকের মেয়েকে জড়িয়ে ধরেছ! শ্লীলতাহানি! তোর কী শূয়রের বাচ্চা মা বোন কেউ নেইরে!
জবা বলল, অসুখ থাকলে আসেন কেন?
হাঁটুতে জোর পাচ্ছে না—র মতো সে এলিয়ে দিয়েছে শরীর। এবং ঘাসের ভেতর হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। সামনে জবা মীনা দাঁড়িয়ে আছে, ওরা খুব বিব্রত বোধ করছে। সে কিছুই লক্ষ্য করল না! চোখ বুজে পড়ে থাকল। দিদি কোথাও রুমাল উড়িয়ে যাচ্ছে স্কুটারে। সে হাওয়ায় রুমাল উড়তে দেখল।
জবা মীনা ভীষণ অস্বস্তির ভেতর পড়ে গেছে। পিন্টু এবং গোপাল এলে এত ভয় লাগত না, ফেলে চলে যেতেও পারছে না। আজকাল কত রকমের ঘটনা ঘটছে শহরে। ব্যর্থ প্রেমে আত্মহত্যা নয় তো! মীনা বলল, কী খেয়েছেন?
মানুর খুব অবাক লাগল কথাটা শুনে। সে সোজাসুজি বলল, ভাত।
ভাত তো সবাই খায়। আর কিছু খাননি তো?
মাছ, ডাল, কাসুন্দি।
তবে চোখ আপনার টানছে কেন!
নেশাখোরের মতো লাগছে নাকি! সে তো নেশা করেনি। কিছুক্ষণ রোদে রোদে ঘুরেছে। কিছুক্ষণ নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথন হয়েছে। একসময় মনে হয়েছে সব মানুষের মাথা ঢিল মেরে ভেঙে দেবে। একসময় মনে হয়েছে পাশের মেয়েটিকে সাপ্টে ধরে তলপেটে চুমু খাবে। আর কিছু তো সে ভাবেনি। সে শুয়ে থেকেই বলল, আমাকে আপনারা মাতাল ভাবছেন?
চোখ লাল, বসে পড়লেন, টলছিলেন, আমাদের কী দোষ।
সে বলল, আমি যদি কিছু একটা করে ফেলতাম, মাতাল ভাবতে পারতেন। এই যদি জড়িয়ে টরিয়ে ধরতাম!
আপনি কিছু করতেই পারতেন না।
আমি পারি। কিন্তু আপনাদের এত বিশ্বাসের পর সত্যি আর পারব না।
মীনা বলল, আমাদের বন্ধুরা এসে পড়বে। আলাপ করিয়ে দেব।
জবা বলল, গোপাল খুব ভালো। খুব হাসাতে পারে।
মীনা বলল, পিন্টুর মুখে সব বিগ বিগ টক। রোববারে মাঠে আমরা ঘুরে বেড়াই। জ্যোৎস্না উঠলে বাড়ি ফিরি। কতদিন আমরা ওই যে গাছটা দেখছেন, তার নিচে বসে কেবল গান গেয়েছি।
ওর মনে হল সত্যি এমন মেয়েদের সঙ্গে বসে গান গাওয়া যায়। আর কিছু করা যায় না। আর কিছু করতে ভালোও লাগবে না।
কিছু দূরে ক্লাব টেন্টের পাশে মানু দেখল, একজন ফুচকাঅলা ফুচকা বিক্রি করছে। কোথা থেকে সব মানুষজন, ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে চারপাশে। এত বড় শহর এত মানুষজন, হাউসগুলোতে শো হচ্ছে, ভিড়, ফুচকাঅলা ফুচকা বিক্রি করছে, চা—অলা হেঁকে যাচ্ছে, চাই চা, কিছুই তার কাছে এখন খুব প্রয়োজনীয় নয়। জয়া কবিতা পাঠ করছে। কবিতা পাঠ না অন্য কিছু। দাদা দুপুরে বাড়ি এলই না। মন্দাকিনী বউদির কাছে সে রুপোর কৌটায় সোনার ভ্রমরের খোঁজ পেয়েছে বুঝি। সংসারে সবাই কী তবে কাজকর্মের ফাঁকে এমন একটা ইচ্ছের ভেতর ডুবে যেতে ভালোবাসে। খোঁড়া, অন্ধ, বেকার, ফেরেব্বাজ, কৃপণ, অকৃপণ, ধনী, দরিদ্র, এটা না হলে বুঝি বেঁচে থাকতে পারে না। একবার কলেজে নানুকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে নাকি! তারপরই মনে হল—বাবা! যা গম্ভীর ছেলে। হয়তো জবাবে এমন দার্শনিক কথা বাতলাতে শুরু করবে যে তার কোনো ছাই মাথামুণ্ডু বুঝবে না। তখন হাওয়ার গন্ধ ভেসে আসছিল, কেবল মেয়েদের সুঘ্রাণ চারপাশে।
জবা বলল, এই!
মীনা বলল, এই কী ভাবছেন?
মানু বলল, গন্ধ পান না?
জবা বলল, হ্যাঁ, পাই?
কীসের গন্ধ পান?
মুচকি হাসল জবা। বলল, আপনি কোথাকার কী লোক, বলব কেন?
খুব খারাপ লোক না। ভুবনেশ্বরে আমার একটা সেলস এম্পোরিয়ামে কাজের কথা চলছে। কাজটা হয়ে গেলেই সুন্দর মতো কোনো মেয়েকে আমি ভালোবেসে ফেলব ভেবেছি।
এ রাম! এখনও বাসেননি!
এখন তো সবাইকে ভালো লাগে। সুন্দর দেখলেই ইচ্ছে করে হাত ধরতে।
আমাদেরও ইচ্ছে করে।
সে বোকার মতো তাকিয়ে বলল, কী ইচ্ছে করে?
জবা বলল, কী পাজি, সব জানতে চায়। আপনাকে বলব কেন?
মানু বলল, বলুন না, এখানে তো আর কেউ শুনতে আসছে না।
মীনা বলল, কিছু বলিস না রে পেয়ে বসবে।
জবা বলল, ন্যাকা।
মানু মীনার দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা আমাকে ন্যাকা মনে হয়। তারপর কিছুই না ভেবে বলল, বসুন না। দাঁড়িয়ে আছেন কেন।
জবার বসতে অসুবিধা নেই। সে জিনস পরেছে। হাফ—হাতা টপ পরেছে। গলায় সরু সোনার হার। পুষ্ট শরীরে সব কিছু বাড়বাড়ন্ত। প্রতিটি নখে সুন্দর রূপালি পালিশ। আঙুল সরু সরু আর লম্বা। হালকা একটা রুপোর আংটি কড়ে আঙুলে। চুল শ্যাম্পু করা, কিছুটা বাদামি রঙের। সে সহজেই বসে পড়তে পারল।
মীনার লাল শাড়িতে রুপোলি চুমকি বসানো। হাতের বটুয়া লাল রঙের। বগলকাটা ব্লাউজ লাল রঙের। গলায় লাল পাথরের মালা। সে বসার সময় প্রথমে হাঁটু মুড়ে বসল। তারপর শাড়ি টেনে পায়ের পাতা ঢেকে দিল।
মানুর মনে হল সহসা চারপাশে একটা স্বপ্নের পৃথিবী তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কথা বললে সে ওদের জিভ দেখতে পাচ্ছে। টকটকে লাল! এদের দুজনের কেউ কনস্টিপেসনের রুগি নয়। যেমন তার বাবা মা এবং আজকাল দাদাও আয়নায় জিভ দেখে। পাকস্থলী পরিষ্কার রাখার জন্যে ঘুম থেকে উঠেই ত্রিফলার জল খায়। আসলে জবা মীনাদের শরীরের সব কোষগুলোই দারুণ তাজা! রক্তকণিকারা মাথা কুটে মরছে হাওয়া খাওয়ার জন্য।
বিকেলের মাঝামাঝি সময়। বেশ হাওয়া দিচ্ছে। গাছটা মাথার ওপর ছায়া দিচ্ছে নিরন্তর। দুটো একটা পাখি ডাকছিল। মানু পা গুটিয়ে বসেছিল। জবা মীনা মাঝে মাঝেই দূরে কিছু দেখছে। ওদের আসার কথা, ওরা আসছে না কেন! অথচ অন্যদিন ওরা এসে দেখেছে, গোপাল পিন্টু বসে আছে অথবা পায়চারি করছে। ট্রাম অথবা বাস থেকে নামতে না নামতেই ওরা দৌড়ে এসেছে। অবশ্য সব সময়ই এটা হয় না। আবার কোনোদিন ওরা আগে চলে এসেছে। আসলে কত আগে বের হওয়া যায়, বাড়িতে সময় কাটে না, রাস্তায় বের হতে পারলেই, কী যেন হিল্লোল বয়ে যায় শরীরে।
মানু মাঝে মাঝে চোখ তুলে দেখছে। মানুষের জীবন ভারি মায়াবী। জবা মীনাকে আর মনেই হয় না অপরিচিত। যেন সে তাদের কতবার দেখেছে, কত কালের চেনা। দূরে ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধ, সামনে সমান উঁচু ম্যাচ বাক্সের মতো বাড়িগুলো। ট্রামের ট্রাকশানে কখনও বিদ্যুতের ঝিলিক। পিছনে ফোর্ট উইলিয়াম। এবং কত প্রাচীন অথবা নবীনা এই শহর।
মানু বলল, হাফ—হাতা টপে আপনাকে দারুণ মানিয়েছে।
জবা নিজের বুকের দিকে তাকাল। বুকটা ধুকপুক করছে।
মীনার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে শাড়িতেই বেশি সুন্দর দেখায়। এটা আপনি বোঝেন কী করে!
মীনা হাঁটুর ওপর হাত রেখেছে আড়াআড়িভাবে। চিবুক রেখেছে হাতের ওপর। মীনা সোজা তাকিয়েই বলল, আমাদের খুব ভাগ্য ভালো!
মানু বলল, এ বয়সে মেয়েদের ভাগ্যটা ভালোই থাকে।
সে কথা বলছি না মশাই। বলছি, ভাগ্যিস তার সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি।
দেখা হলে কী হত?
স্বার্থপর হয়ে যেতেন না। আমরা যে আছি একবারও চোখ তুলে দেখতেন।
মানুর কী রকম যেন একটা বড় রকমের ব্যথা বুকের গভীরে বেজে উঠল। একটা ভারি দীর্ঘনিশ্বাস বয়ে গেল সত্যি। জয়ার কবিতা পাঠ বোধহয় জীবনেও শেষ হবে না। সে সত্যি কথা বলে ফেলল, আসলে মানুষ বোধহয় পবিত্র হয়ে গেলে কিছু আর গোপন রাখতে পছন্দ করে না। —জয়ার সঙ্গে শো দেখব বলে এসেছিলাম। হাউসে দেখা হতেই জয়া বলল, বাড়িতে দুজন কবি হাজির। কবিতা পাঠ আছে। আমাকে ফেলে ওদের সঙ্গে জয়া চলে গেল।
আর সেই থেকে একা ঘুরছেন? জবা বলল, আমরা হলে মারামারি করতাম।
মানু বলল, পারতেন।
খুব পারতাম।
মানু নীচের দিকে তাকাতে পারছে না। সেই জঙ্ঘার সন্ধিস্থলে দামি টেরিকটনের ভাঁজটা ওকে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক করে দিচ্ছিল। এবং সে চুরি করে যতবার সেদিকে তাকাতে গেছে, জবার চোখে চোখ পড়ে গেছে। তার মুখ অতর্কিতে জ্বলে উঠেই আবার নিভে গেছে।
আপনার লাভার বুঝি পদ্য লেখে?
লাভার! তা লাভারই বলতে পারেন। খুব লঘুস্বরে লাভার বললে, ছোটই করা হয় জয়াকে। সে মনে মনে বলল, আমি ঠিক কিছুই জানতাম না। জয়া চোখে চুমু খাবার পরই আমার মাথা গোলমাল হয়ে গেছে। আগে তো রোয়াকে বসে আড্ডা মারতুম, মেয়েদের দেখলে আমার বন্ধুরা টপ্পা গাইত, শিস দিত, কিন্তু জয়াটা আমার চোখে চুমো খেয়ে যে কী করল এটা! জয়ার কথা ভাবলেই মাথা এখন ঝিম ঝিম করে। চোখ বুজলে জয়াকে দেখতে পাই। দু’জনে আমরা একটা কিছু করে ফেলব এবার।
মীনা বলল, এই আবার আপনি ভাবতে শুরু করেছেন।
আমাকে বলছেন!
তবে কাকে? চলুন উঠুন। কোথাও বসে একটু খাওয়া যাক।
আমাকে আপনারা খাওয়াবেন!
আসুন না। দেখি কতটা কী খাওয়াতে পারি।
ওরা!
ওরা এসে দেখবে আমরা নেই।
মীনা, জবা এবং মানু মাঠ পার হয়ে চলে যাচ্ছে। এবং যদি কোনো গ্রহান্তরে টেলিপ্যাথি থাকে, ধরা যাবে, সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এক যুবক দুজন যুবতীর পিছু পিছু খাবার লোভে হেঁটে যাচ্ছে।
জবা মীনা গান গাইছে। হাত ধরাধরি করে ওরা দুজনে গান গাইতে গাইতে হেঁটে যাচ্ছে। শরীরে ভারি আনন্দ হিল্লোল। কোষে কোষে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ওরা বিহ্বল হয়ে পড়ছে। গানের ভেতর কেবল কিছু পাওয়ার জন্য পাগল।