ইঞ্জিন চালু করে
ইঞ্জিন চালু করে অর্জুনের মনে হল, ব্যাপারটা স্বাভাবিক। শিবরাম ঠিক সময়ে পৌঁছোতে না পারায় ডেভিড অন্য কাজে চলে গিয়েছে। হরিরামবাবুর ইঙ্গিত বুঝলে ধরে নিতে হবে, ডেভিড কোনও বেআইনি ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত। তা, এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার মানুষ বেআইনি কাজ করে যাচ্ছে। তাদের নিয়ে মাথা ঘামানোর দায়িত্ব কেউ তাকে দেয়নি।
রেললাইন পার হওয়ার সময় স্টেশনমাস্টারের মুখ মনে এল। সেই একই লোক আছে, না বদলি হয়ে গিয়েছে? কৌতূহলী অর্জুন বাইক ঘোরাল। দূর থেকেই দেখতে পেল প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা, তাসের আসর বসেনি। মানুষ দূরের কথা, একটা ছাগলও চরছে না প্ল্যাটফর্মের ঘাসে। একটাই ঘর। বাকিগুলো বহুদিন থেকেই তালা বন্ধ। বাইক থেকে নেমে অর্জুন চিৎকার করল, মাস্টারমশাই!
ওপাশ থেকে গলা ভেসে এল, আসছি।
সেদিকে এগিয়ে দৃশ্যটা দেখতে পেল অর্জুন। একটা গোরুকে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে আসছেন গেঞ্জি আর লুঙ্গি-পরা স্টেশনমাস্টার। কাছে এসেই চিনতে পারলেন তিনি, আরে! আপনি? কী আশ্চর্য! .
গোরুটা কি ঝামেলা করেছিল?
পালিয়ে গিয়েছিল, ধরে নিয়ে এলাম। একটা খুঁটিতে ওটাকে বেঁধে হাত ঝেড়ে স্টেশনমাস্টার জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, বলুন?
এদিকে এসেছিলাম। ভাবলাম, দেখে আসি আপনি আছেন কিনা? অর্জুন হাসল।
নো চান্স। একশো আটটা অ্যাপ্লিকেশন দিয়েছি। রেল আমার জায়গায় বদলি করার লোকই পাচ্ছে না। ভাবুন ব্যাপারটা! শেষতক ভাবলাম, ভালই তো আছি। কোনওদিন ট্রেন আসে, তো কোনওদিন আসে না। আমি গোরু ছাগল, বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে এখানে শান্তিতেই আছি। স্টেশনমাস্টার বললেন।
আপনাদের তাস-পার্টি?
বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে এক ব্যাটা খেলতে আসত। সে নাকি পাকা চোর। কী করে জানব বলুন? পুলিশ এসে এখান থেকে হাতেনাতে ধরে নিয়ে গেল লোকটাকে। তারপর থেকে খেলা বন্ধ করে দিয়েছি। স্টেশনমাস্টার বললেন।
অর্জুন বাঁ দিকে তাকাতেই দূরে রেলের বাতিল বাংলোগুলো দেখতে পেল। সে জিজ্ঞেস করল, আগে তো ওই বাংলোগুলো বন্ধ থাকত, এখন কি লোক থাকছে?
স্টেশনমাস্টার বললেন, কিছু বলার নেই মশাই। উপরতলার চিঠি নিয়ে এসেছে। ওই পোড়ো বাড়িতে মানুষ যেত না ভুতের ভয়ে। আচ্ছা, ইংরেজিতে কথা বললে দিশি ভূত ভয় দেখাতে পারে না, না?
হেসে ফেলল অর্জুন, ব্যাপারটা আমি জানি না।
আপনি হাসছেন, কিন্তু ওরা ওখানে দিব্যি আছে। হোটেল থেকে খাবার আনিয়ে খায়। ইংরেজি ছাড়া কথা বলে না। ভেবেছিলাম, গিয়ে খোঁজ নেব। কিন্তু স্পোকেন ইংলিশটা ভাল নয় বলে, সাহস করলাম না। স্টেশনমাস্টার বললেন।
লোকগুলো কি অবাঙালি?
ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কাজের লোক রাখলে তার কাছ থেকে জানা যেত। একটা ড্রাইভার আছে, কিন্তু সে কারও সঙ্গে মেশে না। একজনকে দেখলে সাহেব বলে মনে হয়। গায়ের রং টকটকে ফরসা, চোখে রোদচশমা। বেশ লম্বা। একবারই তাকে দেখতে পেয়েছিলাম দূর থেকে।
লোকটার নাম কি ডেভিড?
তা তো জানি না।
কিন্তু আপনার উচিত, দূর থেকে নজর রাখা। হাজার হোক বাংলোটা রেলের সম্পত্তি। মানুষ আর যাই হোক, ভূতের সঙ্গে পেরে উঠবে না। কিন্তু বলা তো যায় না। অর্জুন বাইকে ফিরে গেল। হঠাৎ কথাটা মনে পড়তে অর্জুন চেঁচিয়ে ডাকল, মাস্টারমশাই?
ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন, ইয়েস! বলুন?
যাকে সাহেব বলছেন, তার মুখটা মনে আছে?
ভদ্রলোক চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলেন।
ওর ঠোঁটের পাশে কোনও কাটা দাগ দেখেছেন?
নাঃ। দূর থেকে দেখা তো, বাইনোকুলার তো নেই!
অর্জুন আর দাঁড়াল না। শৈশবের ছবি দেখালে কোনও কাজ হবে না।
.
পরদিন সকালে শুভেন্দুশেখরের বাড়িতে গেল অর্জুন। ভদ্রলোক তখন হুইলচেয়ারে বসে হ্যারি পটার পড়ছিলেন। কাজের লোক অর্জুনকে উপরে নিয়ে এলে বই পাশে সরিয়ে বললেন, এসো, এসো।
সামনের চেয়ারে বসে অর্জুন বলল, আপনি হ্যারি পটার পড়েন?
ওয়েল রিটন। সময়টা চমৎকার কাটে। কিন্তু আপশোস হয়।
কেন?
আমাদের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র আধুনিক সংস্করণ হল এই বই। ঠিকঠাক প্রচারিত হলে ঠাকুরমার ঝুলিকে বিদেশিরা লুফে নিত। তা এবার বলো, কত পারিশ্রমিক নেবে? শুভেন্দুশেখর জিজ্ঞেস করলেন।
অর্জুন হাসল, ওটা নিয়ে এত চিন্তা করছেন কেন? এখনও আমি বুঝতে পারছি না, কী করে নভেন্দুবাবুর সন্ধান পাব। ওকে খুঁজতে আমাকে হয়তো বাংলাদেশেও যেতে হতে পারে।
বেশ তো। তোমার পাসপোর্ট আমাকে দিয়ে যাও। কলকাতার এক চেনা ট্রাভেল এজেন্টের কাছে পাঠিয়ে দিলে সে ভিসা করে দেবে। এদিকে সমস্যা বেড়েছে। নিমা কাল দিল্লিতে নামছে। সেখান থেকে প্লেন ধরে বাগডোগরায় আসবে। এসে কী লাভ হবে তার, আমি জানি না। ভদ্রতা রাখতে না বলতে পারিনি। শুভেন্দুশেখর মাথা নাড়লেন।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, উনি নিশ্চয়ই এই প্রথম ভারতবর্ষে আসছেন? বাগডোগরায় নেমে এখানে পৌঁছোবার রাস্তা জেনে নিয়েছেন?
ঠিকানা এবং টেলিফোন নম্বর জানা থাকলে পৌঁছোতে অসুবিধে হবে না। তা এখন বলো, কত দূর এগিয়েছ তুমি? শুভেন্দুশেখর জিজ্ঞেস করলেন।
নভেন্দুবাবুর কোনও খবর এখনও পাইনি। আচ্ছা, ওঁর কি কোনও ডাকনাম আছে?
আছে। মাথা নাড়লেন শুভেন্দুশেখর।
ডেভিড?
না তো। ওকে আমরা ‘নবু বলে ডাকতাম। শোনো অর্জুন, তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো, ওর সন্ধান এনে দাও। না হলে আমি বিপদে পড়ে যাব।
কেন?
তোমাকে তো বলেইছি, ওর ধারণা, আমি মারা গেলে ও লাভবান হবে।
এই ব্যাপারে আপনি ইচ্ছে করলে সিকিউরিটি বাড়াতে পারেন।
ওসব আমার জানা আছে। দাঁড়াও। হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে ভিতরে চলে গেলেন শুভেন্দুশেখর। ফিরে এলেন একটু পরে, হাতে খাম।
এটা রাখো। দশ হাজার আছে। খোঁজখবর করার সময় টাকার অভাবে যাতে অসুবিধেয় না পড়ো, তাই দিচ্ছি।
অর্জুন তাকাল। তারপর চুপচাপ খামটা নিয়ে নিল।
ধন্যবাদ। শুভেন্দুশেখর বললেন।
উঠে দাঁড়াল অর্জুন। তারপর স্টেশনমাস্টারের দেখা প্রায়সাহেব লোকটার বর্ণনা শুনিয়ে জিজ্ঞেস করল, নভেন্দুবাবুকে কি এরকম দেখতে?
সে ফরসা, লম্বা, গগল্স পরে। তা এরকম লক্ষ লক্ষ ছেলেকে দেখতে পাবে। কাটা দাগ আছে? শুভেন্দুবাবু বিরক্ত হলেন।
যিনি দেখেছেন, তিনি দূর থেকে সেটা লক্ষ করতে পারেননি। অর্জুন আর কথা বাড়াল । আসছি’ বলে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
.
বিকেলে অমল সোমের বাড়িতে গেল অর্জুন। এই বাড়ির গেট খুলে ঢুকলেই অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়। অমল সোম এখন কদাচিৎ আসেন। ওঁর কাজের লোক হাবুরও বয়স হয়েছে। গত বছর মারাত্মক আহত হয়ে হাসপাতালে কিছুদিন থাকতে হয়েছিল বেচারাকে। তখন অমল সোম ওকে দেখতে এসেছিলেন। হাবু সুস্থ হওয়ার পর আবার ফিরে গিয়েছেন পাহাড়ে। সত্যান্বেষণের হাতেখড়ি যার কাছে, তিনি এখন আধ্যাত্মিক জগতে বিচরণ করেন। যদিও সন্ন্যাসী হয়ে যাননি। এই বাড়িতে ঢুকলেই অর্জুনের আত্মবিশ্বাস কেমন করে যেন বেড়ে যায়।
হাবু বসে ছিল বারান্দায়। নীচে অনেকটা উঁচু খড়ের গাদা। সেদিকে তাকিয়ে ভাবছিল কিছু। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার হাবু?
হাবু কথা বলতে পারে না। কিন্তু ওর ইশারার অর্থ অর্জুন বোঝে। হাবু খুব চিন্তিত মুখে আঙুলের ইশারায় জানাল, সে একটা সেফটিপিন খুঁজে পাচ্ছে না। ওখানে ঘাসের উপর খড় ছিল। তার উপর পড়েছে। অনেক খুঁজে শেষ পর্যন্ত খড়গুলো এক জায়গায় ভঁই করে রেখেছে। ওর ধারণা, ওর মধ্যেই সেফটিপিন লুকিয়ে আছে।
অর্জুন বলল, ছেড়ে দাও। আর যদি না থাকে, তো কয়েকটা কিনে দিচ্ছি।
হাবু তীব্রবেগে মাথা নেড়ে আঙুল ঘুরিয়ে জানাল, সে কিনবে না, ওটাকেই খুঁজে বের করবে।
অমলদার কোনও চিঠি এসেছে?
মাথা নাড়ল হাবু, না। তারপর কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় তড়াক করে উঠে ভিতরে চলে গেল। হাবুকে এখন বয়সের তুলনায় অনেক বেশি বয়স্ক দেখাচ্ছে। অমলদার উচিত, এখান থেকে সরিয়ে ওকে নিজের সঙ্গে রাখা। কথাটা বলেওছিল সে। অমলদা বলেছিলেন, এ-বাড়ি বিক্রি করার কোনও বাসনা আমার নেই। উইল করেছি, আমার মৃত্যুর পরে হাবু এই বাড়ির মালিক হবে। তখন যদি ও বিক্রি করে, করতে পারে। সেই কারণেই ওর এখানে থাকা দরকার।
মিনিট পাঁচেক পর এক কাপ চা এনে হাবু অর্জুনকে দিল।
অর্জুন বলল, বাঃ। চমৎকার। শব্দ করে চুমুক দিল অর্জুন।
সেটা শুনে কপালে ভাঁজ পড়ল হাবুর। সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে চলে গেল সে। ফিরে এল একটা ধাতব কাঠি নিয়ে। কাঠিটাকে খড়ের গাদায় ঢুকিয়ে একটু ঘুরিয়ে বের করে দেখতে লাগল হাবু। ওটা যে চুম্বক, তা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগল অর্জুনের। হাবু যে এতটা বুদ্ধিমান, তা আন্দাজ করতে পারেনি সে। চুমুকের আওয়াজ ওর কানে যেতে পারে না। কারণ, সে কানে প্রায় শোনেই না। হয়তো চুমুক দেওয়ার সময় তার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে অনুমান করে নিয়েছে। চুমুক থেকে চুম্বকের কথা মনে পড়েছে ওর।
হঠাৎ হাবু লাফাতে লাগল। তার চুম্বকের প্রান্তে সেফটিপিন। বহু খুঁজেও যেটাকে সে পায়নি, তা চুম্বকের সাহায্যে পেয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে নভেন্দুর কথা মনে পড়ল অর্জুনের। ওই খড়ের গাদায় হারিয়ে যাওয়া সেফটিপিনের মতো নভেন্দু সীমান্তের এপারে অথবা ওপারে কোথায় লুকিয়ে আছে। তার কোনও হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। একটা চুম্বক যেমন সেফটিপিনটাকে খুঁজে বের করে আনল, তেমন যদি কিছু পাওয়া যেত।
বাড়ি ফেরার পথে করলা নদীর ব্রিজের উপর বাইক থামাল অর্জুন। তার মাথায় এইমাত্র যে ভাবনাটা চলকে উঠল, তা কি সত্যি হবে? নভেন্দুকে খুঁজে বের করার জন্য একটা চুম্বকের প্রয়োজন। নিমা সেই চুম্বক হতে পারে? নিমা দেশের এই প্রান্তে এসেছে শুনলে নিশ্চয়ই নভেন্দু একটু সন্ত্রস্ত হবে। হয়তো ওর সঙ্গে যোগাযোগ করে সমঝোতায় আসতে চাইতে পারে। আবার এও হতে পারে, যে সূত্র থেকে নিমা জেনেছে নভেন্দু ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে রয়েছে, সেই সূত্র ওকে নভেন্দুর সঠিক ঠিকানা জানিয়ে দিতে পারে। অর্জুন ঠিক করল, আগামী কাল বাগডোগরায় যাবে। শুভেন্দুশেখর বলেছেন যে, আগামী কাল নিমা আমেরিকা থেকে এসে দিল্লিতে নামবে। সাধারণত আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো শেষ রাতে ভারতের এয়ারপোর্টে নামে। তারপর নিমা যদি বাগডোগরার ফ্লাইট ধরে, তা হলে দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে যাবে।
.
বাইক নয়, মিনিবাসে শিলিগুড়িতে পৌঁছে অটো রিকশায় বাগডোগরা এয়ারপোর্টে যখন অর্জুন চলে এল, তখন ঘড়িতে দুপুর বারোটা। জানতে পারল, দিল্লির ফ্লাইট আর চল্লিশ মিনিটের মধ্যে ওখানে ল্যান্ড করবে। নিমা কি আমেরিকান? এখন অনেক আমেরিকান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। তবে নিমা নামটি কখনওই আমেরিকান হতে পারে না। নিশ্চয়ই ভদ্রমহিলা শাড়ি পরে আসবে না। প্যান্টই স্বাভাবিক! অর্জুন দেখল, প্লেনটা আকাশ ছেড়ে ধীরে ধীরে মাটিতে নেমে এল। অ্যারাইভাল লাউঞ্জের এক পাশে গিয়ে দাঁড়াল অর্জুন। যেসব যাত্রীর সঙ্গে হ্যান্ডব্যাগ ছাড়া কিছু নেই, তাঁরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন। মিনিট দশেক বাদে মালপত্র ট্রলিতে চাপিয়ে বাকিরা বেরিয়ে এলেন। কয়েকজন তরুণীর পরনে প্যান্ট, কিন্তু তারা বিদেশ থেকে আসছে বলে মনে হল না অর্জুনের। এই সময় সালোয়ার-কামিজ পরা একজন যুবতীর দিকে তাকাতে অর্জুন ধন্দে পড়ল। মহিলার চেহারা, হাবভাব দেখে এদেশীয় ভাবার কোনও কারণ নেই। ওঁর ট্রলিতে রাখা সুটকেসের চেহারাও একই কথা বলছে। মহিলা হাঁটছেন একাই। ইনি নিমা নয়তো? অর্জুন এগোল।
গেটের ওপাশে অনেকেই হাতে নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনওটায় যাত্রীর নাম, কোনওটায় কোম্পানির নাম। একটা প্ল্যাকার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে দেখলেন মহিলা। লোকটাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন। লোকটি মাথা নেড়ে প্ল্যাকার্ড নামিয়ে এগিয়ে গেল পার্কিং-এর দিকে, ভদ্রমহিলার সুটকেস বহন করার ভদ্রতা দেখাল না।
ভদ্রমহিলা যখন লোকটার জন্য অপেক্ষা করছেন, তখন অর্জুন এগিয়ে গেল তাঁর কাছে। হেসে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি আমেরিকা থেকে আসছেন?
হ্যাঁ, কেন? ভদ্রমহিলা অবাক।
আপনার নাম জানতে পারি?
কেন আপনাকে আমি আমার নাম জানাতে যাব? চোয়াল শক্ত ভদ্রমহিলার।
বেশ। আপনি কি কাউকে এয়ারপোর্টে গাড়ি পাঠাতে বলেছিলেন?
হ্যাঁ। আর কিছু?
এই সময় লোকটা গাড়ি নিয়ে আসছে দেখে অর্জুন সরে দাঁড়াল এবং তখনই তার নজরে পড়ল, সুটকেসের পাশের দিকে এন এবং আই অক্ষর দুটো লেখা রয়েছে। তা হলে কি শুভেন্দুশেখর মত পরিবর্তন করে তাঁর অতিথির জন্য গাড়ি পাঠিয়েছেন? তা যদি হয়, তা হলে ড্রাইভার লোকটা একফোঁটা সৌজন্য দেখাল না কেন?
দ্রুত ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে চলে আসতেই ভীম প্রধানকে দেখতে পেল অর্জুন। খাটো, রোগা চেহারার ভীম তার ট্যাক্সির পাশে দাঁড়িয়ে সদ্য নামা এক যাত্রীর সঙ্গে কথা বলছে। সাহাব, ভীম প্রধান কখনও কোনও কাস্টমারের কাছে যায় না। তারাই আসে। যেমন আপনি এসেছেন। আপনার যদি মনে হয়, আমি বেশি টাকা চাইছি, তা হলে অন্য ট্যাক্সিওয়ালার কাছে চলে যান।
ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে সরে যেতেই অর্জুনকে দেখতে পেল ভীম। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে হাসি ফুটল, আরে দাদা, আপনি? কাউকে ছাড়তে এসেছিলেন?
না, রিসিভ করতে এসেছিলাম। কিন্তু তাকে আর-একজন নিয়ে চলে গেল। তুমি পার ঘণ্টা কত টাকা নাও? অর্জুন কাছে এল।
দরজা খুলে দিল ভীম, উঠুন, আপনি জলপাইগুড়িতে যাচ্ছেন না বুঝতে পারছি।
ট্যাক্সিতে উঠে অর্জুন বলল, আমি জানি না কোথায় যাচ্ছি। একটা প্রাইভেট গাড়ি এইমাত্র এয়ারপোর্ট ছেড়েছে। ওটা যেখানে যাবে, সেখানে যাব।
কী গাড়ি?
অ্যাম্বাসাডর। নম্বরটা বলল অর্জুন।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই প্রতিটি গাড়িতে লাইন দিয়ে অথরিটির কাছে জমা দেওয়া লাইসেন্স ফেরত নিতে হয়। একটু সময় লাগে সেখানে। ভীম ট্যাক্সিটা দাঁড় করিয়ে হেঁটে গেল অপেক্ষায় থাকা গাড়িগুলোর পাশ দিয়ে। ফিরে এল পাঁচ মিনিট পরে। অর্জুন বলল, তাড়াতাড়ি হয়ে গেল!
দাদা, ভীমকে সবাই ভালবাসে। নীল রঙের গাড়ি, পিছনে লেডিস আছে।
নর্থ বেঙ্গলের বাস কনডাক্টর, ট্যাক্সি ড্রাইভাররা লেডি এবং লেডিসের মধ্যে কোনও ফারাক করে না। ভীম প্রধানও করল না। তার ট্যাক্সি স্ট্যান্ড কদমতলায়। যেতে-আসতে অনেকবার দেখা হয়েছে, অর্জুনকে দেখেই চেঁচিয়ে বলেছে, নমস্কার দাদা। বাংলা উচ্চারণ এত নিখুঁত যে, নেপালি বলে মনেই হয় না।
হাইওয়েতে ওঠার পর গাড়িটাকে দেখতে পেল অর্জুন। ভীম এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সে বাধা দিল, কাছে যেয়ো না। ওরা যেন বুঝতে না পারে, আমরা ফলো করছি। ও যেখানে যাবে, সেখানেই আমরা যাব।
কী করেছে ওই মেমসাহাব? খুন না জালিয়াতি? ভীম জিজ্ঞেস করল।
কোনওটাই না। উনি কিছু করেননি। মনে হচ্ছে, ওঁকে ভুল বুঝিয়ে কেউ নিয়ে যাচ্ছে।
আচ্ছা! তা হলে ওকে ধরে মার লাগালেই তো হয়।
না। আমি জানতে চাইছি, মেমসাহেবকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?
ও, বুঝতে পেরেছি।
শিলিগুড়িতে না ঢুকে বাইপাস দিয়ে সেবকের রাস্তা ধরল অ্যাম্বাসাডর। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তোমার গাড়িতে কত তেল আছে?
ফুল ট্যাঙ্কি।
দুটো গাড়ির মধ্যে দেড়শো গজের পার্থক্য। মাঝে মাঝে দ্রুতগামী গাড়িগুলো তাদের ওভারটেক করে এগিয়ে যাচ্ছে। তখন কিছুক্ষণের জন্য নীল অ্যাম্বাসাডরকে দেখা যাচ্ছে না। চট করে যদি গাড়িটা বাঁ বা ডান দিকের জঙ্গলে ঢুকে যায়, তা হলে তারা দেখতে পাবে না। অবশ্য এর ফলে সামনের ড্রাইভারের মনে সন্দেহও জাগছে না।
কালিম্পং-এর দিকে না গিয়ে তিস্তা-সেবক ব্রিজ পেরিয়ে নীল অ্যাম্বাসাডর মালবাজারের রাস্তা ধরল। দু’পাশে বড় বড় গাছের জঙ্গল, জনমানবশূন্য এলাকায় কালো পিচের রাস্তাটা গম্ভীর ভঙ্গিতে শুয়ে আছে।
ইতিমধ্যে অর্জুনের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে, শুভেন্দুশেখর নিমাকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে গাড়ি পাঠাননি। নিমা যে আসছে এবং কবে কোন ফ্লাইটে, তা নভেন্দু জানত। নিমা যদি জানিয়ে থাকে, তা হলে ওর কাছে নভেন্দুর ঠিকানা আছে। তখনই অর্জুনের মনে হল, নিমাকে নভেন্দুর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া উচিত হবে না। এমনও হতে পারে, নিমা শুভেন্দুশেখরকে মিথ্যে বলেছে। হয়তো নভেন্দুর সঙ্গে এক হয়ে ষড়যন্ত্র করছে।
জঙ্গল কমে গেলে ঘটনটা ঘটল। দশ-বারোটা গোরু নিয়ে একটা লোক হঠাৎ রাস্তা পার হয়ে ওপারে যেতেই নীল অ্যাম্বাসাডর ব্রেক কষল। আশি নব্বই মাইল গতিতে ছোটা গাড়িটা ব্রেক সামলাতে পারল না। চাকা স্কিড করে একটা গোরুর গায়ে ধাক্কা মারল। গোরুটা পড়ে গিয়ে ছটফট করতে লাগল। পাহারাদার লোকটা ক্ষিপ্ত হয়ে ছুটে গেল গাড়ির কাছে। দরজা খুলে ড্রাইভার লোকটাকে বের করে লাঠি মারতে লাগল হিংস্র হয়ে। লোকটা কোনও বাধাই দিতে পারছিল না। ইতিমধ্যে আরও কয়েকটা লোক ছুটে এসেছে জঙ্গল থেকে। ভীম খানিকটা দূরে তার ট্যাক্সি থামিয়ে দিয়েছিল।
অর্জুন দেখল, বাকি লোকগুলো এসে অনেক সুঝিয়ে রাগী লোকটাকে থামাল। এবার তারা নীল অ্যাম্বাসাডরের ড্রাইভারকে দড়ি দিয়ে বেঁধে পাশের একটা গাছে আটকে দিল।
অর্জুন এবং ভীম ট্যাক্সি থেকে নেমে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখল, নীল অ্যাম্বাসাডরের ড্রাইভারের মুখ-মাথা থেকে রক্ত পড়ছে। মাথা নিচু করে রয়েছে সে।
অর্জুনকে দেখে লোকগুলো এগিয়ে এল। একজন জিজ্ঞেস করল, আপনি ওকে চেনেন?
মাথা নাড়ল অর্জুন, না। তারপর জিজ্ঞেস করল, ওকে তো যথেষ্ট মেরেছ। কিন্তু তারপর বেঁধে রেখেছ কেন?
ওর লোক আসুক। তারা টাকা দিলে তবে ওকে ছাড়া হবে। আমাদের গোরুটা আর বাঁচবে না। এই গোরুটা অন্তত পাঁচটা বাচ্চা দিত। তাদের কত দুধ হত ভাবুন তো? আমরা দশ হাজার টাকা পেলে ওকে ছেড়ে দেব। দলের নেতা বলল।
কিন্তু ওর মাথা দিয়ে রক্ত পড়ছে। চিকিৎসার প্রয়োজন।
আপনার যখন এত দরদ, তখন আপনি টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যান।
অর্জুন গাড়ির ভিতরটা দেখল। নিমা তখনও ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি। দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে।
অর্জুন গলা তুলল, শুনছেন? দশ হাজার না দিলে আপনার ড্রাইভারকে ওরা ছাড়বে না। গোরু মারার শাস্তি। আপনি দিতে পারবেন?
নিমা হাত নামাল। ব্যাগ খুলে দেখল। তারপর ইংরেজিতে বলল, দুশো ডলারে হবে? আমার কাছে ইন্ডিয়ান কারেন্সি বেশি নেই।
অর্জুন তাকাল লোকগুলোর দিকে, উনি দুশো ডলার দিচ্ছেন। প্রায় ন’হাজার টাকা। ডলার নেবে তোমরা?
দলনেতা বলল, সেটা কী জিনিস?
আমেরিকার টাকা।
মাথা খারাপ! পাশের দেশ বাংলাদেশের টাকাই আজকাল দোকানদাররা নিতে চায় না, তো কত দূরের আমেরিকার টাকা কেন নেবে! দলনেতা বলল।
অর্জুন গাছে বাঁধা লোকটার সামনে গেল, নাম কী ভাই?
ননী, ননীগোপাল। বিড়বিড় করল লোকটা।
কোথায় যাচ্ছিলে? টেলিফোন নম্বর জানা আছে?
হ্যাঁ। নম্বরটা বলল ননীগোপাল।
এটা কোথাকার নম্বর?
দোমহনির।
কার নম্বর?
জানি না। আমার গাড়ি ভাড়ার। আমাকে বাঁচান বাবু।
অর্জুন ফিরে এল রাস্তায়, তোমাদের টাকা পাবে। কিন্তু ও মরে গেলে কিছুই পাবে না। ওর বাঁধন খুলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। আমি ফোন করে খবর দিচ্ছি। লোক এসে তোমাদের টাকা দিয়ে যাবে।
প্রস্তাব শুনে লোকগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল। অর্জুন এগিয়ে গেল গাড়ির কাছে, ওরা ডলার নেবে না। আপনি যেখানে যাচ্ছিলেন, তার ঠিকানা জানেন? তা হলে আমরা আপনাকে পৌঁছে দিতে পারি।
মাথা নাড়ল নিমা, আমি টেলিফোন নম্বর জানি।
বলুন।
অর্জুন বলতেই ব্যাগ থেকে ছোট ডায়েরি বের করে নম্বর পড়ল নিমা।
নম্বর শুনে চিনতে পারল অর্জুন। ওটা শুভেন্দুশেখরের নম্বর।
আপনার যদি আপত্তি না থাকে, তা হলে আপনাকে পৌঁছে দিতে পারি? এখানে বসে থাকলে কেউ না আসা পর্যন্ত যেতে পারবেন না। বিকেল থেকেই এই রাস্তায় বুনো হাতির দল পায়চারি করে।
কিন্তু আমি আপনাকে চিনি না… নিমা এবার মনে করতে পারল। তার মুখের চেহারা বদলাল।
আপনি, আপনি কে?
আমি আপনার হিতৈষী। মিস্টার শুভেন্দুশেখর আপনার কথা বলেছেন আমাকে। যাক গে, আপনি ইচ্ছে করলে আমার ট্যাক্সিতে উঠতে পারেন। আমি আপনাকে শুভেন্দুশেখরের বাড়িতে পৌঁছে দেব। চাপা পড়া গোরুটা মরে যাওয়ার আগে চলে যাওয়া ভাল। অর্জুন পরামর্শ দিল।
নিমা দরজা খুলল।
অর্জুন লোকগুলোকে বলল, আমরা মালবাজার থেকে ফোন করে দিচ্ছি, যাতে ওই লোকটিকে ছাড়াতে দশ হাজার টাকা নিয়ে কেউ চলে আসে।
দলনেতা একটু আশ্বস্ত হয়ে আদেশ দিলে নীল অ্যাম্বাসাডরের ড্রাইভারের বাঁধন খুলে নামিয়ে আনল দুটো লোক। শুইয়ে দিল রাস্তার পাশে।
ভীম নিমার মালপত্র নিজের ট্যাক্সিতে তুলে নিয়েছিল। এবার অর্জুন বসল সামনে, ভীমের পাশে। পিছনে নিমা। ট্যাক্সি চলল মালবাজারের দিকে। কেউ কোনও কথা বলছিল না। হঠাৎ ভীম শব্দ করে হাসল।
অর্জুন তাকাতে সে বলল, একবার আমি একটা মুরগি চাপা দিয়েছিলাম। লোকজন এসে ধরল, ক্ষতিপূরণ দাও। এক কেজি ওজনের মুরগি। আমি ষাট টাকা দিতে ওরা প্রায় মারতে এল। হ্যাঁ, মুরগিটার দাম গোটা কিনলে ষাট টাকা হতে পারে, কিন্তু ও অন্তত একশোটা ডিম দিত। তার দাম দুশো টাকা। সেই ডিম থেকে অন্তত দশটা বাচ্চা হত। ষাট টাকা করে হলে দশটার দাম হত ছ’শো টাকা। মোট আটশো ষাট টাকা। মানুষ চাপা পড়লে লোকে এত টাকা চায় না!
মালবাজার পৌঁছে একটা টেলিফোন বুথে ঢকল অর্জুন। নীল অ্যাম্বাসাডরের ড্রাইভারের বলা নম্বরটা ডায়াল করল সে। কম্পিউটার জানাল, দিস নম্বর ইজ নট অ্যাভেলে। অর্জুন হকচকিয়ে গেল। শোনা নম্বর মনে রাখতে গিয়ে ভুল করে বসল সে! না, তা তো হওয়ার কথা নয়। তা হলে লোকটাই তাকে মিথ্যে নম্বর দিয়েছে? ওই অবস্থায় তা কি কেউ দেয়? রি-ডায়াল বোতাম টিপল অর্জুন। পাঁচ গোনার আগেই রিং শুনতে পেল সে। তারপরেই একটা মোটা গলা ‘হ্যালো’ বলল।
অর্জুন গলাটা যতটা সম্ভব সহজ করল, হ্যালো! আমি মালবাজার থেকে বলছি। একটা নীল অ্যাম্বাসাডরের ড্রাইভার বাগরাকোটের কাছে হাইওয়ের উপর বড় অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। হ্যালো, শুনতে পাচ্ছেন?
তো আমি কী করব?
ড্রাইভারকে লোকজন বেঁধে রেখেছে। একটা গোরু মারা গিয়েছে। ওরা দশ হাজার টাকা না দিলে কিছুতেই ছাড়বে না। অর্জুন বলল, ড্রাইভারের নাম ননীগোপাল। সে-ই আপনার নম্বর দিয়ে ফোন করতে বলল।
খানিকক্ষণ চুপচাপ। তারপর লোকটা জিজ্ঞেস করল, ঠিক কোন জায়গায়?
মালবাজার থেকে হাইওয়ে ধরে গেলে মিনিট আটেক দুরে।
কেউ মারা গিয়েছে?
এতক্ষণে গিয়েছে, একটা গোরু।
গাড়িতে আর কেউ ছিল?
হ্যাঁ। বলেই লাইনটা কেটে রিসিভার নামিয়ে রাখল অর্জুন। লোকটার ফোনে যদি সি এল আই থাকে, তা হলে নম্বর দেখে এখনই ফোন করতে পারে। ফোনের টাকা দিতে গিয়ে অর্জুন বুঝল, সে মোবাইলে ফোন করেছে। এই নম্বরটা সে মনে রেখেছিল ঠিকই, কিন্তু খেয়াল করেনি। ফেরত নিয়ে সে বিড়বিড় করল, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, কোচবিহারে যেতে হবে এখন। কথাটা নিশ্চয়ই এসটিডি বুথের ছেলেটি মনে রাখবে। কেউ খোঁজ করতে এলে জানিয়ে দেবে কোচবিহার যাওয়ার কথা।
দোমহনি হয়ে না গিয়ে, ময়নাগুড়ির মোড় ঘুরে তিস্তা ব্রিজের সামনে এসে ভীমকে গাড়ি থামাতে বলল অর্জুন। গাড়ি থেমে গেলে পিছন ফিরে দেখল, নিমা শক্ত হয়ে বসে আছে। অর্জুন বলল, আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে নেওয়া দরকার।
নিমা নিশূপ।
এয়ারপোর্টে নামার পর লোকটার গাড়িতে উঠেছিলেন আপনি। কোথায় যাচ্ছিলেন? .
আবার ডায়েরি দেখল নিমা, জলপাইগুড়ি।
আপনি কি ভেবেছিলেন, জলপাইগুড়ি থেকে মিস্টার শুভেন্দুশেখর আপনার জন্য গাড়ি পাঠিয়েছিলেন?
আর কেউ তো জানে না আমি ওই ফ্লাইটে আসছি।
আপনি সত্যি কথা বলছেন?
আপনি কী বলতে চাইছেন?
আপনার বন্ধু নভেন্দু জানে আপনি আসছেন?
একসময় সে আমার বন্ধু ছিল, এখন নয়। তা ছাড়া আমার আসার কথা। তার জানা সম্ভব নয়।
আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি মিস্টার শুভেন্দুশেখর পাঠাননি, পাঠিয়েছিল নভেন্দু। অর্জুন বলল।
অসম্ভব। সে আমার সঙ্গে যোগাযোগই রাখে না। নিমা মাথা নাড়ল, কিন্তু এসব কথা আপনি কী করে জানলেন?
মিস্টার শুভেন্দুশেখর আমাকে বলেছেন।
কেন?
উত্তরটা ওঁর কাছেই জানতে চাইবেন। এয়ারপোর্টে গাড়ি উনি পাঠাননি। পাঠালে, ড্রাইভার আপনাকে জলপাইগুড়ির উলটো রাস্তায় নিয়ে যেত না।
উলটো রাস্তায়?
হ্যাঁ। অ্যাকসিডেন্টটা হওয়ায় আপনি বেঁচে গিয়েছেন। অবশ্য আপনার কথা যদি সত্যি হয়। ঘুরে বসল অর্জুন। ভীম গাড়ি চালু করল।
.
শুভেন্দুশেখর কোনও উত্তাপ দেখালেন না। মাথা নেড়ে বললেন, ওয়েলকাম, আমার এই বাড়িতে কোনও মহিলা নেই। থাকতে অসুবিধে হলে তোমাকে মানিয়ে নিতে হবে।
অনেক ধন্যবাদ। তারপর অর্জুনের দিকে তাকিয়ে নিমা বলল, আপনাকেও।
শুভেন্দুশেখর বললেন, তোমার সঙ্গে নিমার দেখা হল কী করে?
অর্জুন বৃত্তান্ত সংক্ষেপে জানাল।
চুপচাপ শুনে শুভেন্দুশেখর বললেন, নিমা এসেছে নভেন্দুর সন্ধানে। ওই গাড়িতে থাকলে নিশ্চয়ই তার দেখা পেয়ে যেত। তুমি বাগড়া দিলে কেন? কথাগুলো ভদ্রলোক বলছিলেন বাংলায়।
নিশ্চয়ই পেতেন। তারপর ওঁর কী হত, সেটাও কল্পনা করতে পারি।
কীরকম?
আপনার কথা শুনে আমার মনে হয়েছে, এক লক্ষ ডলার নিমা কখনওই ওর কাছ থেকে আদায় করতে পারবেন না। নিমাকে হাতের মুঠোয় পেলে ও ওঁর মুখ বন্ধ করে দেবে অনায়াসে। তা ছাড়া যেখানে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, সেখানে নভেন্দু কখনওই নিজে আসবে না। লোক পাঠাত। তারাই নিমাকে নিয়ে যেত। আমরা নভেন্দুর হদিশ আর পেতাম না। অর্জুন বলল।
এখন কী করে পাবে?
এত দিন নিমা-ই নভেন্দুকে খুঁজেছেন, এখন নভেন্দু ওঁকে খুঁজবে। নিমা কার সঙ্গে কোথায় গিয়েছেন, তা ড্রাইভার ননীগোপালের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। এসটিডি বুথের ছেলেটা বলবে, যে ফোন করেছিল সে কোচবিহার গিয়েছে। তাই না?
শুভেন্দুশেখর মাথা নাড়লেন, এসব না করে কিডন্যাপিং-এর অভিযোগ এনে ড্রাইভারটাকে পুলিশের হাতে তুলে দিলে সে-ই নভেন্দুকে ধরিয়ে দিত।
পুলিশ কেন ধরবে নভেন্দুকে? ওর বিরুদ্ধে কী চার্জ আনবে? মাথা নাড়ল অর্জুন। আপনি এঁকে দু-তিন দিন এই বাড়ির বাইরে যেতে দেবেন না।
এতক্ষণ নিমা চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। একটি পাকিস্তানি মেয়ের পক্ষে বাংলা বোঝা সম্ভব নয়। এবার সে ইংরেজিতে বলল, এই ভদ্রলোক বলছেন, আমার আসার কথা নভেন্দু জানে। একেবারেই অসম্ভব। আমি তার ঠিকানা জানি না। আমাকে এড়িয়ে বেড়াচ্ছে সে। একমাত্র আপনাকে ছাড়া আমি কাউকে জানাইনি।
তা হলে কে তোমাকে জলপাইগুড়ির উলটো দিকে নিয়ে যেতে গাড়ি পাঠাল?
আমি জানি না। হয়তো ড্রাইভারটা ভেবেছিল, আমার কাছে অনেক ডলার আছে। নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে ছিনতাই করবে বলে ভেবেছিল। নিমা বলল।
তা হলে আপনার নাম প্ল্যাকার্ডে লিখে গেটে দাঁড়াবে কী করে?
ব্যাপারটা ভাবেনি নিমা। এবার বলল, ও, মাই গড!
শুভেন্দুশেখর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি প্লেনের টিকিট কিনেছিলে এয়ারলাইন্সের অফিসে গিয়ে না এজেন্টকে ফোন করেছিলে?
এজেন্টের কাছ থেকে। লোকটা খুব পপুলার বাংলাদেশি।
কী করে চিনলে ওকে? নভেন্দু কি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল?
সঙ্গে সঙ্গে চোখ বড় হয়ে গেল নিমার। নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
তা হলে অর্জুন যা সন্দেহ করছে, তাই ঠিক। ওই এজেন্টের সঙ্গে নভেন্দুর এখনও যোগাযোগ রয়েছে। তোমার আসার খবর তার কাছ থেকেই পেয়েছে।
অর্জুন বলল, এখন আমি উঠি।
নিমা তাকাল। তারপর শুভেন্দুশেখরকে জিজ্ঞেস করল, ইনি কে?
ওর নাম অর্জুন। টুথ ইনভেস্টিগেটর। আমি ওকে একটা দায়িত্ব দিয়েছি। শুভেন্দুশেখর গম্ভীর গলায় বলে বেল টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে কাজের লোক পৌঁছে গেল।
শুভেন্দুশেখর বললেন, মেমসাহেবকে গেস্টরুমে নিয়ে যা। আমেরিকা থেকে এসেছেন। ওর খাওয়া-থাকার যেন কোনও অসুবিধে না হয়!
অর্জুন বেরিয়ে এল।
.
পরের দিন সকালে খবরের কাগজের তিন নম্বর পাতায় নজর আটকে গেল অর্জুনের। বাগরাকোটের কাছে দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করে রিপোর্টার জানিয়েছেন, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ড্রাইভারের পরিচিত লোক এসে দশ হাজার টাকা দিয়ে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। ড্রাইভার ততক্ষণে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। এখন অবধি তাকে কোনও হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছে কিনা, জানা যায়নি। খবর পেয়ে ড্রাইভারের স্ত্রী উদবিগ্ন হয়ে থানায় খোঁজ করে বিফল হয়। সে এখন কোথায়, তা পুলিশ বলতে পারেনি।
রির্পোটারটিকে অর্জুন চেনে। ডায়েরি থেকে নম্বর বের করে ফোন করল সে।
রিপোর্টার বললেন, আপনি এই কেসটা নিয়ে ইন্টারেস্টেড হলেন বলে ভাল লাগছে। ননীগোপালের স্ত্রীকে পুলিশ বিন্দুমাত্র সাহায্য করছে না।
ননীগোপালের বাড়ি কোথায়?
বার্নিশে। বার্নিশ বাজারের যে কেউ বলে দেবে।
যে-লোকটা টাকা মিটিয়ে ননীগোপালকে নিয়ে গিয়েছে, তার নাম জানা গিয়েছে?
না। গ্রামের লোকগুলো টাকা পেয়ে আর পরিচয় নিয়ে মাথা ঘামায়নি।
লোকটা ননীগোপালকে নিয়ে কোথায় যেতে পারে বলে মনে হয় আপনার?
আমি বুঝতে পারছি না। কোনও হাসপাতালে যে নিয়ে যায়নি, তা আমি জানি।
টেলিফোন রেখে বাইক নিয়ে বের হল অর্জুন।
.
বার্নিশ পৌঁছোতে মিনিট কুড়ি লাগল। বাজারে ননীগোপালের খোঁজ করতে তিন-চারজন জুটে গেল। এরা সবাই জেনে গিয়েছে ননীগোপালের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে এবং তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। অর্জুনকে পুলিশের লোক বলে ভুল করেছিল ওরা।
অর্জুনকে একটু মিথ্যে বলতে হল, আমি খবরের কাগজ থেকে আসছি। আপনারা ননীগোপালকে চিনতেন?
একজন বয়স্ক লোক বললেন, ছেলেবেলা থেকে চিনি ওকে।
কীরকম লোক?
আগে তো ভালই ছিল। রোজ রাতে ট্যাক্সি চালিয়ে ফিরে আসত। মাসখানেক হল সাত দিন-দশ দিন পরে আসে। থাকে না, চলে যায়। শুনেছি, ওর বউকে নাকি মোটা টাকা দিয়ে যায়। বয়স্ক লোক বললেন।
কোথায় কাজ নিয়েছিল, কিছু বলেছে?
না। মাসখানেক হল, বাড়িতে এলে পাড়ার লোকদের এড়িয়ে চলত।
ওর স্ত্রী?
সে তো সকাল থেকে থানায় গিয়ে বসে আছে।
থানায় চলে এল অর্জুন। বারান্দার বেঞ্চিতে গ্রাম্য চেহারার একটি মহিলা চুপ করে বসে আছে। বাইক থেকে নেমে তার সামনে গিয়ে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি কি ননীগোপালের স্ত্রী?
অবাক হয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল মহিলা।
ওর কোনও খবর পেলেন?
না।
পুলিশ কী বলছে?
কিছু না।
ডায়েরি করেছেন?
আমার সঙ্গে কথাই বলছে না।
আসুন আমার সঙ্গে।
অর্জুন ভিতরে ঢুকল। একনজর তাকিয়েই বুঝল, এখানকার কাউকে সে চেনে না। একজন সাব ইনস্পেক্টর চেঁচিয়ে উঠলেন, এই যে! আবার ভিতরে ঢুকেছ? তোমাকে নিষেধ করেছিলাম না। যাও, বাড়ি যাও।
অর্জুন অফিসারকে বলল, উনি আমার সঙ্গে এসেছেন।
আপনি কে?
বলছি। তার আগে বলুন, ওঁর স্বামীকে পাওয়া যাচ্ছে না, অথচ আপনারা এই অভিযোগটা ডায়েরিতে লিখছেন না কেন?
আমরা কী করছি বা না করছি, তার কৈফিয়ত আপনাকে কেন দেব? খিঁচিয়ে উঠলেন অফিসার, সবে একটা রাত গিয়েছে, হয়তো কোথাও বেড়াতে গিয়ে আটকে গিয়েছে ওর স্বামী, পাগল করে দিল!
চেয়ার টেনে বসল অর্জুন, ননীগোপালের বেড়াতে যাওয়া দূরের কথা, হাঁটার ক্ষমতাও ছিল না। একটা অ্যাকসিডেন্ট করার জন্য ওকে প্রচুর মারধর করা হয়েছিল। তারপর ওর পরিচিত কেউ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোনও হাসপাতালে ওকে ভরতি করা হয়নি। আমার আশঙ্কা, ও বেঁচে না-ও থাকতে পারে।
আপনার আশঙ্কা? আপনি ননীগোপালের কে হন?
কেউ না।
তা হলে আমাদের কাজ করতে দিন।
অফিসার, এটাও কাজ।
ভদ্রলোক জবাব না দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, উঠে তাঁর সামনে দাঁড়াল অর্জুন, ব্যাপারটা জানার পরেও আপনি ডায়েরি নিচ্ছেন না কেন?
তা হলে দিনে হাজারখানেক ডায়েরি নিতে হয়!
এবার আপনার সততা সম্পর্কে সন্দেহ হচ্ছে আমার।
তার মানে?
মনে হচ্ছে, কারও নির্দেশে আপনি নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন।
তার মানে? একথা বলার জন্য আপনাকে আমি অ্যারেস্ট করতে পারি।
ক্ষমতা হাতে থাকলে মনে হয় সব কিছু করা যায়। কিন্তু মুশকিল হল, যে-কোনও ক্ষমতার একটা সীমা থাকে। অর্জুন হাসল।
এই সময় সাদা পোশাকের এক প্রবীণ ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার সাহা?
সাব ইনস্পেক্টর উত্তেজিত হয়ে ভদ্রলোকের কাছে অভিযোগ জানালেন।
অত্যন্ত অন্যায় কথা। ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, আপনি কী বলতে চাইছেন? কার নির্দেশে আমরা নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে পারি?
আপনি?
আমি এই থানার ওসি।।
নমস্কার। আমি অভিযোগ ওঁর সম্পর্কে করেছি, আপনাদের কথা বলিনি।
আপনি কোথায় থাকেন?
জলপাইগুড়িতে।
কী নাম?
অর্জুন।
অর্জুনবাবু, আমি ভেবে পাচ্ছি না, দোমহনির এক ড্রাইভারের ব্যাপারে আপনি জলপাইগুড়ি থেকে এখানে ছুটে এসেছেন কেন? ওসি জিজ্ঞেস করলেন।
অর্জুন পকেট থেকে কার্ড বের করে এগিয়ে দিল।
ওসি সেটা নিয়ে দেখলেন, ও মাই গড! সরি অর্জুনবাবু, আপনাকে আমি চিনতে পারিনি। আসুন, আমার ঘরে আসুন।
মিনিট দশেকের মধ্যে ডায়েরি লেখা হয়ে গেল। ননীগোপালের স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন ওসি। ইতিমধ্যে চায়ের হুকুম দিয়েছিলেন। চা এল। অর্জুন বলল, এবার বলুন তো, ডায়েরি নিচ্ছিলেন না কেন?
ব্যাপারটা হল, এই এলাকার লোকজন এত আজেবাজে ব্যাপার নিয়ে থানায় নালিশ জানাতে আসে যে, সেগুলো খাতায় তুলে দেখা যায়, এনকোয়্যারি করার কোনও মানে হয় না। অবশ্য এই ব্যাপারটা সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। সাহাই হ্যাঁন্ডেল করছিল। ওসি কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে বললেন।
এখন ডায়েরি হওয়ার পরে যদি দয়া করে মিস্টার সাহা ছাড়া অন্য কাউকে দিয়ে তদন্ত করান, তা হলে ভাল হয়। অর্জুন বলল।
কেন বলুন তো? ওসির চোখ ছোট হল, এনি ফাউল প্লে?
না না। উনি তো ননীগোপালের স্ত্রীর উপর বেশ বিরক্ত হয়ে আছেন; তাই।
ও কে! আপনাকে কথা দিচ্ছি, এই কেসটা আমি নিজেই দেখব।
আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তা হলে কয়েকটা পয়েন্ট বলতে পারি?
শিয়োর। প্যাড টেনে নিয়ে কলম খুললেন ওসি।
এক নম্বর হল, ননীগোপাল গত এক মাস ধরে কার জন্য ট্যাক্সি চালাচ্ছে? ওর পরিচিতজনরা বলেছে, এর জন্য ও ভাল টাকা পেয়েছে। দুই, কাজের চাপে ও প্রায়ই বাড়ি ফিরতে পারত না। কোথায় থাকত? তিন, গতকাল দুপুরে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে ও কার নির্দেশে গিয়েছিল? ও হ্যাঁ, আপনার মোবাইল নম্বর পেতে পারি?
নিশ্চয়ই। পুলিশ জানার আগেই আপনারা যে কী করে এত জেনে যান!
অর্জুন উঠে দাঁড়াল। ওসি তাকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, ওই ব্যাপারটা ভুলে যান অর্জুনবাবু। বড়সাহেবদের কানে কথাটা… পকেট থেকে কার্ড বের করে দিলেন তিনি।
না না। একান্ত বাধ্য না হলে নালিশ করার অভ্যেস আমার নেই। অর্জুন কার্ড পকেটে রাখল। সাব ইনস্পেক্টর সাহাকে ধারে-কাছে দেখতে পেল না অর্জুন।
বাইক নিয়ে জলপাইগুড়িতে ফিরতে গিয়ে মত বদলাল সে। অনুমান সত্যি হয়েছে কিনা, তা মিলিয়ে নেওয়া দরকার। ঝড়ের মতো বাইক চালিয়ে সে মালবাজারে পৌঁছে গেল পঞ্চাশ মিনিটে। গতকালের সেই টেলিফোন বুথে ঢুকে দেখল, ছেলেটা উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে। কালকের ছেলেটাই। অর্জুন তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, চিনতে পারছ ভাই?
মাথা নাড়ল ছেলেটি, না।
এত লোক সারাদিনে ফোন করে যায়, মনে রাখা মুশকিল।
গতকাল এখানে ফোন করতে এসেছিলাম। একটা কাগজে নম্বরটা লেখা ছিল। বোধহয় এখানেই ফেলে গিয়েছি কাগজটা। অর্জুন বলল।
না। আমি দেখতে পাইনি।
ওঃ! কোথায় যে ফেললাম। তখন কোচবিহারে যাওয়ার এত তাড়া ছিল যে… আচ্ছা! অর্জুন ঘুরে দাঁড়াল।
দাঁড়ান, দাঁড়ান। ছেলেটি উত্তেজিত হল, মনে পড়েছে। আপনি এখান থেকে ফোন করেছিলেন। তারপর… আচমকা থেমে গেল ছেলেটি।
আমার খোঁজ করতে কেউ এসেছিল। তাই তো?
হ্যাঁ। আমি তাকে বলেছিলাম, আপনি কোচবিহারে চলে গিয়েছেন। লোকটা জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি কোচবিহারের কাউকে ফোন করেছেন কিনা? করেননি শুনে হতাশ হয়ে চলে গেল! ছেলেটা দ্রুত গতকালের রসিদ দেখে একটা কাগজে নম্বরটা লিখে এগিয়ে দিল, যদি লোকটা আবার আসে, তা হলে আপনার ঠিকানাটা বলব?
আমার কোনও ঠিকানা নেই। কাগজটা পকেটে রেখে বেরিয়ে এল অর্জুন। অনুমান সত্যি হলে বেশ ভাল লাগে।
.
পরের দিন সকালে শুভেন্দুশেখরের ফোন এল, অর্জুন, একবার এসো। বলেই রিসিভার রেখে দিলেন। ভদ্রলোকের স্বভাবে একনায়কতান্ত্রিক মেজাজ আছে। এমন মানুষই পারেন ছেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।
বাইকটা কাল একটু গোলমাল করেছিল। ওটাকে গ্যারাজে দিয়ে রূপশ্রীর সামনে আসতেই নিজের নাম শুনতে পেল অর্জুন। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, নির্মাল্য দাঁড়িয়ে আছে। অর্জুন কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুই বলেছিলি দিল্লি ফিরে যাবি, তাই আর খোঁজ করিনি। তা হলে ক’দিন আছিস?
হ্যাঁ। থাকতে হচ্ছে।
সন্ধেবেলায় থাকবি? আড্ডা মারতে যেতে পারি। অর্জুন হাসল।
তোর কি এখন কোনও কাজ আছে? নির্মাল্য জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ। এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করব। মিনিট পনেরো লাগবে।
এক কাজ কর, ঠিক চল্লিশ মিনিট পরে রাজবাড়ির গেটের সামনে চলে আয়। দেরি হবে বুঝলে আসিস না। আমি পাঁচ মিনিট তোর জন্য অপেক্ষা করব।
কী ব্যাপার রে?
তুই ঘুরে আয়, বলব। তোর সাহায্য চাই।
ঠিক আছে। অর্জুন একটা রিকশা নিল।