Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মানভঞ্জন পালা || Sanjib Chattopadhyay

মানভঞ্জন পালা || Sanjib Chattopadhyay

মানভঞ্জন পালা

কথায় আছে, ব্যাচেলার বাঁচে প্রিন্সের মতো, আর মরে কুকুরের মতো। এই নীতিবাক্যটির রচয়িতা মনে হয় কোনও মেয়ের পিতা। কে কীভাবে মরবে বলা শক্ত। বিয়ে করলেই যে সুখের মৃত্যু হবে, এমন কথা কি হলফ করে বলা যায়! মৃত্যুর সময় স্ত্রী মাথার কাছে বসে থাকবেন এক চামচ গঙ্গাজল হাতে, এমন আশা এই নারী প্রগতির যুগে না করাই ভালো। আমাদের লৌকিক বিশ্বাসে এমন ধারণাও প্রচলিত আছে, পুত্র মুখাগ্নি না করলে আত্মার উদ্ধার নেই। আবার অপুত্রবতীকে গ্রাম্য ভাষায় যে শব্দে সম্বোধন করা হয় তা একপ্রকার গালাগালি। এমন রমণীর মুখদর্শনে দিন ভালো যায় না।

আমাদের সমাজ আসলে বিবাহের স্বপক্ষে আর সেটাই স্বাভাবিক। সন্ন্যাসী হয়ে সংসার ত্যাগ করা এক কথা। আর আইবুড়ো কার্তিক হয়ে সারাজীবন মজা মেরে বেড়ানোটা দোষের। প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ শাস্ত্র সমর্থন করে না। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নবাগত ভক্তকে নানা খোঁজখবর নিতে নিতে প্রশ্ন করতেন, বিয়ে করেচো? ভক্তটি যদি বলত, হ্যাঁ, বিয়ে করেচি, ঠাকুর অমনি হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে বলতেন, যাঃ, বিয়ে করে ফেলেছে রে! যেন বিয়ে করে ফেলাটা মহা অপরাধ। প্রথম পরিচয়ের পর স্বয়ং কথামৃতকার শ্রীমকেও ঠিক এই কথাই শুনতে হয়েছিল। তিনি খুব হতাশ। হয়েছিলেন এই ভেবে যে, জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেল। যে উদ্দেশ্যে মহাপুরুষের কাছে আসা, সেই উদ্দেশ্যসাধনের একমাত্র বাধা বিবাহ। ঠাকুরের অনেক বিবাহিত ভক্ত ছিলেন। তাঁদের একেবারে হতাশ না করে একটা মধ্যপথের সন্ধান দিয়েছিলেন। কামজয়ী হওয়া বড় কঠিন। প্রকৃতি ঘাড় ধরে তার কাজ করিয়ে নেবেন। কামিনী, কাঞ্চন বড় সাংঘাতিক আকর্ষণ। সাধুকেও বারে বারে বলতে হয়—ওরে সাধু সাবধান। যত ভক্তিমতী মহিলা হোক, সাধুর উচিত শত হস্ত দূরে থাকা। নির্জনে ধর্মালাপও পদ…লনের কারণ হতে পারে। নারীর চিত্রপট দর্শনেও মতিভ্রম হওয়া অসম্ভব নয়। গৃহী সম্পর্কে ঠাকুরকে সামান্য নরম হতে হয়েছিল। দুর্গে বসেই লড়াই করা ভালো। মন যখন আর কিছুতেই বশ মানছে না, তখন না হয় ওই সদারা সহবাসই হল। শ্রীরামকৃষ্ণ আবার স্ত্রী-র দুটি শ্রেণি করেছিলেন বিদ্যা আর অবিদ্যা। বিদ্যা স্ত্রী সর্বদা স্বামীর উন্নতির সহায় হন। স্বামীর সাধনসঙ্গী হন। যে ধারায় নারী নিয়ে সাধনার প্রথা প্রচলিত, সেই। ধারাকে ঠাকুর বলতেন বড় বিপজ্জনক। যে-কোনও মুহূর্তে সাধকের পতন হতে পারে।

এ কালে সাধন-ভজনের কথা কে আর ভাবে! যুগ বদলে গেছে। মানুষের আকাঙ্ক্ষার ধরনধারণ অন্যরকম হয়ে গেছে। মানুষের এখন বিষয়-আশয় ছাড়া অন্য কিছু তেমন আমলে আনে না। জীবনের বৃত্ত তৈরি হয়েছিল, সেই বৃত্তে বংশগতির ধারা অনুসরণ করে, চালাও পানসি। বেলঘরিয়া, খাটে শুয়ে ঘাটে চলে যাও। ছবি হয়ে ঝুলে পড়ো দেয়ালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাম্প, ইন্টারভিউ, ধরাকরা, চাকরি, বছর না-ঘুরতেই পেছন উলটে, পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনে চোখ বোলানো, চিঠি চালাচালি, মেয়ে দেখা, দেনাপাওনার ধস্তাধস্তি, ক’ভরি সোনা, সানাই, সাতপাক সংসার। আজকাল আবার বিয়ে করেই বিদেশে দৌড়োতে হয়। বিলিতি কায়দা। হানিমুনের ভারতীয় সংস্করণ। কতটা মধু আর কী চাঁদ সব বোঝা যাবে শেষ দেখে। ওই জন্যে বাংলায় প্রবাদই আছে—সব ভালো যার শেষ ভালো।

একালে দাম্পত্যজীবনের নিয়ামক হল অর্থনীতি। ধর্ম নয়, ষড়দর্শন নয়, উচ্চমার্গের আহ্বান নয়। একটিই বাণী—হাম দো, হামারা দো। নির্বিচারে বেড়োনা, ফ্ল্যাটে ধরবে না। ছেলের বাপ, বাপের বাপ কীভাবে মানুষ হয়েছিলেন, আর এ কালের নয়া জমানার হিরোদের কীভাবে মানুষ করতে হয়! পাড়ার ইস্কুলে পড়া হয় না। ধরনা দিতে হবে সেন্ট অথবা হোলি লাগানো ইস্কুলে। পাঁচুবাবু পাড়ার বিন্ধ্যবাসিনী বিদ্যালয়ের পাঁচ সিকে মাইনে দিয়ে পড়ে রেল কম্পানির ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে রিটায়ার করেছিলেন, আর একালের অগ্নিভ বা অয়স্কান্ত মাসে শ আড়াই হজম করেও দশটা ফিগার টোটাল দিতে সোলার ব্যাটারি লাগানো পকেট কম্পিউটার খোঁজে। আর ইংরেজি এখন ন্যাজ খসা টিকটিকি, হাফ আছে হাফ নেই, ফান্ডা, ক্যালি, ফ্যানিনি’র ছড়াছড়ি। রাইটিং-এ একটা টিনা দুটো টি, বেগি-এ একটা জি না দুটো জি, হালার ইংরেজি। বাংলা বানানের কোনও মা-বাপ নেই। ফলে ই, ঈ, উ, ঊ, শ, ষ, স সব একাকার। বাংলার পিতা যে সংস্কৃত, সেই সংস্কৃত এখন কুলাঙ্গার পুত্রের দশ দশা দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কার কমিটিতে নাম লিখিয়েছেন। যাঃ, সব এক করে দিলুম। একটাই, একটা উ, একটা শ। গায়েও ‘পাঞ্জাবি’, পথেও ‘পাঞ্জাবি’। বিধান সরণি লিখতে গিয়ে মনে হয়, রাস্তাঘাটের ইংরেজি নামই ভালো ছিল। দন্ত্য সনা তালব্য শ। দন্তন না মূর্ধন্য ন। ইনা ঈ! ‘পীড়াপীড়ি’র। ঝামেলায় কোথাও ‘পেড়াপেড়ি’তেও একই কাজ। এখন বেশিরভাগ শ্বাশুড়িই জামাই বাবাজীবনের কৃপায় ‘ব’ফলা যুক্ত। গোঁফ থাকলে শ্বশুর না থাকলেই শাশুড়ি।

আজকাল আবার এমন অমানবিক ঘটনা ঘটছে, পরিবার ছোট রাখতে গিয়ে গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট করিয়ে আসছেন সুপার-শিক্ষিত-মানুষ! এ নাকি নরহত্যা নয়! পরিবার পরিকল্পনা। সেকালের মানুষ বীর ছিল কত! বিয়ে করেছি! সংসার বাড়বে। কুছ পরোয়া নেই। খেদি আসবে, পটলা আসবে, পটলি আসবে, পাঁচি আসবে। সো হোয়াট! জিভ দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি। ডাল-ভাত, শাক-ভাত খেয়ে ঠিক মানুষ হয়ে উঠবে। ডিম, টোস্ট, ছানা, কলার প্রয়োজন নেই। একালের এই ছোট পরিবার, তুমি আমার আর আমি তোমাদের কালে, ছেলেমেয়েরা হয়ে উঠছে একলাফেঁড়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী। ছেলেবেলা থেকেই যারা শিখছে কেরিয়ার ছাড়া কিছু নেই। হিউম্যানিস্টের বদলে কেরিয়ারিস্ট।

এই চলতে থাকলে যা হবে, তা হল, আকাশের উঁচুতে পায়রার খুপরি। হোমিওপ্যাথিক ফ্যামিলি। অ্যালোপ্যাথিক ফ্যামিলি প্ল্যানিং। মনের খোরাক মেলামেশা নয়। টিভি, পপ ম্যাগাজিন, পপ সং।

প্রগতি আরও এগোলে এই হবে, স্বামীকে বা স্ত্রীকে সহ্য না হলে মামলা, বিচ্ছেদ, পুনর্বিবাহ। তুমি কার কে তোমার! বৃদ্ধের স্থান পথে, পার্কে। বৃদ্ধার স্থান দেবালয়ে। মৃত্যুর পর চটজলদি। বৈদ্যুতিক চুল্লিতে দাহ। আর ব্রাহ্মণকে মূল্য ধরে দিয়ে মাথার ঝুমকো চুল বাঁচানো। ঝুমকা গিরা রে। মানুষ বাঁচে মৃত্যুর পর কারুর না কারুর দু-ফোঁটা চোখের জলের আশায়। এই চাতক সভ্যতায় জল কোথায়! সাগর শুকোলো, মেঘ লুকোলো। ছাই রঙের আকাশে শুধুই পলিউশান। চোখে। বালি না পড়লে চোখের জল আর পড়বে না। সব রাগপ্রধান সংসারেই, একটি পালা—স্ত্রী-র মানভঞ্জন পালা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *