কে কাঁদে গো
কে কাঁদে গো?
কেউ না।
কে কাঁদে গো?
কেউ না।
মানুষ না-কি।
না না না।
(জনৈক আয়না মানবের রচনা)।
নিনিতা বসে আছে কুনের পাশে। তার চোখ ভেজা। দৃষ্টি বিষণ্ণ। কেন বিষণ্ণ কে জানে! তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি পাশে বসে আছে। হাত বাড়ালেই তাকে ছোঁয়া যায়। কিন্তু ছুঁতে ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছা করছে আরো কিছুক্ষণ কাঁদতে।
মীন বলল, আমার মনে হয় তোমাদের দুজনের উচিত কিছুক্ষণ হাত ধরাধরি করে চুপচাপ বসে থাকা।
নিনিতা বলল, আমরা কী করব বা না করব তা তোমাকে বলে দিতে হবে। তোমার থ্যাবড়া নাক সবকিছুতে গলাবে না।
মীন বলল, প্রবল আবেগের সময় মানুষ বুঝতে পারে না সে কী করবে। মানুষের ব্রেইনে শর্ট সার্কিটের মতো হয়। নিওরন ঝড় উঠে। তখন বাইরের কেউ উপদেশ দিয়ে তাকে সাহায্য করতে পারে।
নিনিতা বলল, তোমার উপদেশের আমাদের প্রয়োজন নেই। আমি খুশি হব যদি তুমি আমাদের আলাদা থাকতে দাও। প্লিজ।
মীন উঠে চলে গেল। নিনিতা কুনের হাত ধরল। তার হাত কাঁপছে। হাতের আঙুল কাঁপছে। বুকের ভেতরটায় প্রবল চাপ বোধ হচ্ছে। এই বুঝি বুক ফেটে যাবে। মাথার ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সামনে বসে থাকা কুনকে অচেনা মানুষ বলে মনে হচ্ছে। তার হাত ধরে বসে থাকতেও লজ্জা লাগছে।
কুন বলল, তোমার হাত কাঁপছে কেন? শান্ত হও। কথা বলো।
নিনিতা বলল, কী কথা?
কুন বলল, যা ইচ্ছা বলো।
নিনিতা বলল, বলার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি কথা বলো।
কুন বলল, আমিও বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।
নিনিতা বলল, আমি ভাবি নি তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে। সব কেমন এলোমেলো লাগছে। তুমি কি ভেবেছিলে আমার সঙ্গে দেখা হবে?
না।
আমি যদি ফিরে না আসতাম তাহলে তুমি কী করতে?
জানি না।
নিনিতা বলল, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমি ফিরে না এলে মীন নামের থ্যাবড়া নাকের রোবটটার সঙ্গে তুমি সুখেই বাকি জীবন কাটাতে।
কুন বলল, তুমি খুব ভালো করেই জানো তা সম্ভব না। SF রোবট আমার মতো অতি নগণ্য একজনের জন্যে না। কোনো এক বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্যে তাকে জুটানো হয়েছে। দায়িত্ব পালন শেষ হলেই তাকে সরিয়ে নেয়া হবে।
নিনিতা বলল, কী দায়িত্ব?
কুন বলল, জানি না।
তারা দুজন বসেছে বারান্দায়। বারান্দাগুলি এমনভাবে বানানো যে, ইচ্ছা করলেই বোতাম টিপে জানালার বাইরের দৃশ্য বদলানো যায়। দৃশ্যগুলি এতই বাস্তব যে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই ভুলে যায় জানালার বাইরে যা দেখা যাচ্ছে সবই মায়া।
জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। পানির রঙ গাঢ় নীল। পানির ওপরের আকাশও নীল। আকাশে শাদা মেঘের স্তৃপ। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে বিশাল ঢেউ আসছে। তখন জানালার কাছে পানি ছিটকে পড়ছে।
মীনকে বারান্দায় ঢুকতে দেখা গেল। তার দুহাতে দু’টা কফির মগ। টাটকা কফির গন্ধ আসছে। নিনিতা কঠিন গলায় বলল, আমরা কফি চাই নি। কফি কেন এনেছ?
মীন বলল, খেতে না চাইলে খেও না। মগ দু’টা সামনে থাকল। দীর্ঘ সময়। হাত ধরাধরি করে বসে থাকা বিরক্তিকর ব্যাপার। হঠাৎ করে হাত ছাড়িয়ে নেয়াও অস্বস্তিকর। কফির মগ সামনে থাকা মানে হাত ছাড়িয়ে নেয়ার অজুহাত তৈরি করে দেয়া। কফি খাবে এই অজুহাতে যে-কোনো সময় হাত ছেড়ে কফির মগে হাত রাখতে পারবে।
নিনিতা বলল, তোমার জ্ঞানী জ্ঞানী কথা শুনতে মোটেও ভালো লাগছে না। দয়া করে আমাদের একা থাকতে দাও।
মীন বলল, একটা আনন্দ সংবাদ তোমাদের দিতে এসেছি। সংবাদটা দিয়েই চলে যাব।
কী সংবাদ?
মীন বলল, আমি তোমাদের জন্যে দু’টা পাস জোগাড় করেছি। পাস নিয়ে তোমরা আজ সারাদিন চন্দ্ৰবাগানে ঘুরতে পারবে।
নিনিতা বলল, চন্দ্ৰবাগানে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে বারান্দায় বসে সমুদ্র দেখতেই আমাদের ভালো লাগছে।
মীন বলল, তাহলে সমুদ্র দেখ। তবে মহান আহান প্রায়ই চন্দ্ৰবাগানে একা একা হেঁটে বেড়ান। তার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। আমার পরামর্শ চাইলে আমি বলব চন্দ্ৰবাগানে যেতে।
নিনিতা বলল, তোমার উপদেশের আমাদের প্রয়োজন নেই। আমরা নিজেরাই আমাদের পরিকল্পনা ঠিক করব।
মীন বলল, যদি বেড়াতে যাওয়া ঠিক কর তাহলে খাবার নিয়ে যেও। তারচেয়ে বড় কথা, তোমার জন্যে দুটি টিটান ড্রিংসের বোতল আলাদা করে রাখা আছে। বোতল দু’টা নিতে ভুলে যেও না।
নিনিতা বলল, আমরা চন্দ্ৰবাগানে যাব না। তুমি দয়া করে তোমার থ্যাবড়া নাক নিয়ে দূর হও।
.
নিনিতা কুনের হাত ধরে বাগানে হাঁটছে। এই বাগানে আগেও অনেকবার এসেছে। আজকের মতো কখনো লাগে নি। বাগান ফকী। কেউ নেই। বিশাল সব গাছ। শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে। চারদিক অস্বাভাবিক নীরব বলেই পাতা ঝরার শব্দও কানে আসছে। হালকা বাতাস দিচ্ছে। বাতাস বেশ শীতল। শরীরে কাপন লাগে।
কুন স্ত্রীর হাত ধরে বাগানে সাজানো মূর্তি দেখে বেড়াচ্ছে। মূর্তিগুলো ভিনগ্রহের সুসভ্য প্রাণীদের। অবিকল তাদের মতো তৈরি করা। ভিনগ্রহের প্রাণের বিবর্তনের ধারা। সভ্যতা মাপকাঠির সূচক। গ্যালাক্সিতে তাদের অবস্থান, জীবনযাত্রা পদ্ধতি সবই দেয়া আছে।
এখন তারা দাঁড়িয়ে আছে অতি সুসভ্য সম্প্রদায় টেরা মূর্তির সামনে। এদের মধ্যে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই। এদের অল্পকিছু হঠাৎ নারীতে রূপান্তরিত হয়। গর্ভধারণ করে সন্তানের জন্ম দিয়েই তার মৃত্যু। তাদের সভ্যতা সূচক ৮.২১, যেখানে মানব সম্প্রদায়ের সভ্যতা সূচক ৬,০১। সভ্যতার মাপকাঠিতে এদের অবস্থান অনেক উঁচুতে।
নিনিতা বলল, এদের চোখ দেখতে আমাদের চোখের মতো।
কুন বলল, হু।
নিনিতা বলল, কত লম্বা দেখেছ?
কুন বলল, হু।
নিনিতা বলল, এরা কি কথা বলতে পারে?
কুন বলল, এদের বিষয়ে সব তথ্য লেখা আছে, পড়ে দেখ।
নিনিতা বলল, কিছু পড়তে ইচ্ছা করছে না। অন্য আরেকদিন এসে পড়ব। চল আজ শুধু মূর্তি দেখে বেড়াই।
কুন বলল, চল যাই। এদের বিষয়ে কিছু জানতে চাইলে মীনকে জিজ্ঞেস করলেও হবে। সে সুন্দর করে বলবে।
নিনিতা বলল, আমি মীনের কাছ থেকে কিছু জানতে চাই না। আমার যা জানার তোমার কাছ থেকে জানব।
আমি তো তেমন কিছু জানি না।
তুমি না জানলে আমিও জানব না।
নিনিতা হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ দূরে পাথরের বেদি। সেখানে মূর্তির ভঙ্গিতে যিনি বসে আছেন, তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবে তিনি যে মহান আহান—এই বিষয়ে নিনিতার মনে কোনো সন্দেহ নেই। নিনিতা চাপা গলায় বলল, উনি আহান না?
কুন বলল, দূর থেকে সেরকমই মনে হচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখবে?
নিনিতা বলল, উনি বিরক্ত হবেন।
বিরক্ত হলে হবেন।
নিনিতা বলল, তাঁকে বলব কী?
কুন বলল, তাকে বলব আজ আমাদের বিশেষ একটি দিন। আমরা দুজন দুজনকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আজ খুঁজে পেয়েছি। আপনার সামনে আমরা দুজন যদি কিছুক্ষণ বসে থাকতে পারি, তাহলে আমাদের জীবন ধন্য হবে।
উনি যদি না বলেন?
না বললে চলে আসব। যাবে?
নিনিতা অস্পষ্ট গলায় বলল, বুঝতে পারছি না।
কুন বলল, তোমার মন না চাইলে যাব না। নিজেরা নিজেরা ঘুরে বেড়াই।
কুন উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করেছে। নিনিতা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। অস্পষ্ট গলায় বলল, চল উনার কাছেই যাই। এত কাছে এসেও কথা না বলে চলে যেতে ইচ্ছা করছে না।
আহান পায়ের শব্দে মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন। সামান্য হাসলেন। চাপা গলায় বললেন, কী সুন্দর দিন। তাই না? যদিও সবই কৃত্রিম। তারপরেও সুন্দর।
নিনিতা বলল, আমরা দুজন কি কিছুক্ষণ আপনার পায়ের কাছে বসে থাকতে পারি?
আহান বললেন, না। আমার আশেপাশে কেউ থাকলে আমার ভালো লাগে না।
নিনিতা আহত গলায় বলল, আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত।
আহান বললেন, তুমি মনে হয় রাগ করেছ? কেউ আমার ওপর রাগ করলেও আমার ভালো লাগে না। তোমরা পায়ের কাছে কতক্ষণ বসতে চাও?
কুন বলল, যেই মুহূর্তে আপনি চলে যেতে বলবেন, আমরা চলে যাব। আজ আমাদের বিশেষ একটি দিন। আমরা দুজন দুজনকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আজ খুঁজে পেয়েছি।
আহান বললেন, আমার হারিয়ে ফেলার কেউ নেই। কাজেই খুঁজে পাওয়ারও কেউ নেই। আমি মাঝে মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলি, আবার খুঁজে পাই। তোমরা বসো। পায়ের কাছে বসতে হবে না। বেদিটার ওপর বসো।
নিনিতা বলল, আমরা দুজন কি আপনার দুপাশে বসব?
তোমাদের যেভাবে বসতে ইচ্ছা করে সেইভাবে বসো। শুধু খুব খেয়াল রাখবে, আমার গায়ের সঙ্গে তোমাদের গা যেন না লাগে। আমি মানুষের স্পর্শ সহ্য করতে পারি না।
তারা আহানের দুপাশে না বসে সামনে ঘাসের ওপর বসল। আহান বললেন, তোমরা মানুষ, না SF রোবট?
নিনিতা বলল, আমরা মানুষ।
আহান বললেন, মৃত্যুঘণ্টা বাজছে এমন এক সম্প্রদায়?
মৃত্যুঘণ্টা বাজছে কেন বলছেন?
আহান বললেন, ঘণ্টার শব্দ শুনছি বলেই বলছি। মানুষ আশ্চর্য এক সম্প্রদায়, যার প্রধান কাজ অপেক্ষা করা। তারা অপেক্ষা করে আছে ভাইরাস সংক্রমণের।
নিনিতা বলল, এইসব শুনতে ভালো লাগছে না। আপনি আনন্দময় কিছু বলুন।
আহান বললেন, ভাইরাস সংক্রমণ কিন্তু ভাইরাসের জন্যে আনন্দময়। আমি নির্জনে এসে প্রায়ই কী ভাবি জানো? আমি ভাবি ভাইরাসের জীবনেও কি সুখ দুঃখ আনন্দ-বেদনা আছে? সঙ্গীত আছে? চিত্রকলা আছে?
কুন বলল, আপনার কি মনে হয় আছে?
আহান বললেন, আমার মনে হয় আছে। তাদের মতো করে আছে। তারা যেমন আমাদের আনন্দ-বেদনা বুঝতে পারে না, আমরাও তাদেরটা পারি না। অনেকক্ষণ কথা বলে ফেলেছি, এখন আমাকে একা থাকতে দাও।
কুন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। নিনিতা উঠল না। বসে থেকেই বলল, আমার ছোট্ট একটা প্রশ্ন ছিল। প্রশ্নটা করেই আমি চলে যাব। উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করব না।
প্রশ্ন করবে, তারপর উত্তর না শুনেই চলে যাবে?
নিনিতা বলল, হ্যাঁ। কারণ আপনার কাছে প্রশ্নটার উত্তর নেই।
প্রশ্ন কর।
নিনিতা বলল, রোবটরা ইচ্ছা করে ভাইরাস সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। তারা চেষ্টা করছে মানব সম্প্রদায় ধ্বংস করে দিতে। এটা কি ঠিক?
আহান কোনো জবাব দিলেন না। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন।
নিনিতা বলল, অনেকক্ষণ আপনার কাছাকাছি থাকতে পেরেছি। আমাদের জীবন ধন্য।
আহান দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়েছেন। মনে হচ্ছে এদের তিনি চিনতে পারছেন না।
.
সন্ধ্যা মিলিয়েছে।
কুন তার স্ত্রীকে নিয়ে বারান্দায় বসেছে। সমুদ্রের দৃশ্য বদলে দেয়া হয়েছে। এখন পর্বতমালার ছবি। তুষারঢাকা পর্বতমালা। চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় তুষারধবল পর্বতশৃঙ্গ ঝলমল করছে।
নিনিতা বলল, আমরা নকল এক জগতে বাস করি, তাই না?
প্রশ্ন করা হয়েছে কুনকে, জবাব দিল মীন। সে কোন ফাঁকে বারান্দায় এসেছে। তা কেউ লক্ষ করে নি। মীন বলল, নকল জগতে বাস করছ বলেই জগতটা বোতাম টিপে বদলানো যাচ্ছে। আসল জগৎ বদলাতে পারতে না।
নিনিতা বলল, তোমাকে আমি কোনো প্রশ্ন করি নি। তুমি জবাব দিচ্ছ কেন?
তোমাদের আলোচনায় অংশগ্রহণ করছি। এটা ভব্যতা। আমাকে তুমি অপমান করার চেষ্টা করেই যাচ্ছি—এটা অতা।
নিনিতা বলল, যন্ত্রের কাছে আমি ভব্যতা, অসভ্যতা শিখব না।
মীন বলল, যন্ত্র না ভেবে আমাকে বুদ্ধিমান সত্তা ভাবলে তোমার সমস্যা মিটে যেত।
নিনিতা বলল, আমার সমস্যা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি কেন বারান্দায় এসেছ?
চলে যেতে বলছ?
হ্যাঁ, চলে যেতে বলছি। তুমি শুধু যে বারান্দা থেকে চলে যাবে তা না। আমাদের এখান থেকে পুরোপুরি চলে যাবে। তোমাকে আমার বা কুনের প্রয়োজন নেই।
মীন বলল, তোমার প্রয়োজন নেই তা মানতে আমি রাজি আছি। কুনের প্রয়োজন নেই তা বলছ কীভাবে? তুমি এবং কুন আলাদা সত্তা।
কুন বলল, আলোচনা বন্ধু থাকুক। মীন, তোমাকে দেখে নিনিতা বিরক্ত হচ্ছে। এবং তোমার ভাবভঙ্গি দেখে আমার মনে হচ্ছে, তুমি নিজেও চাচ্ছ সে বিরক্ত হোক। কেন?
মীন বলল, তোমার স্ত্রী যেমন আমাকে ঈর্ষা করছে, আমিও তাকে ঈর্ষা করছি—এটাই একমাত্র কারণ।
নিনিতা বলল, তুমি আমাকে ঈর্ষা করবে কেন? তুমি যন্ত্র! যন্ত্রের আবার ঈর্ষা কী?
যে অর্থে আমি যন্ত্র সেই অর্থে তুমিও যন্ত্র। ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্র। আমি অনেকাংশে ত্রুটিমুক্ত।
নিনিতা বলল, এই মুহূর্তে তুমি বারান্দা থেকে চলে যাবে। আমি এক থেকে চার গুনব, তার মধ্যে যাবে। এক-দুই-তিন-চার।
মীন বলল, তুমি এক থেকে শুরু করে চার বিলিয়ন পর্যন্ত গুনে যাও। আমি যাব না।
নিনিতা কঠিন গলায় বলল, যাবে না?
মীন বলল, না।
সে জানালার বাইরে পর্বতমালার দিকে মুখ করে মেঝেতে বসতে বসতে বলল, আমি শুধু যে বারান্দা থেকে চলে যাব না, তা-না। তোমরা দুজন যখন বিছানায় শুতে যাবে, তখন আমিও তোমাদের সঙ্গে শোব। তোমাদের যদি কোনো জৈবিক কর্মকাণ্ডের ইচ্ছা থাকে তাহলে জানিয়ে রাখছি—আমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে সেই হাস্যকর দৃশ্য দেখব। তোমরা যদি বাতি নিভিয়ে দাও, তাতেও লাভ হবে না। আমার চোখ ইনফ্রা রেড সেনসেটিভ। আমি অন্ধকারে দেখতে পাই।
নিনিতার শরীর কাঁপছে। সে হাতে কফির মগ তুলে নিয়েছে। যে-কোনো মুহূর্তে সে মীনের দিকে কফির মগ ছুঁড়ে মা’রবে। কুন হতভম্ব। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। মীনের আচরণ তার কাছে অদ্ভুত লাগছে।
মীন হিমশীতল গলায় বলল, কফির মগ ছুঁড়ে মারার আগে তোমাকে জানিয়ে দিচ্ছি SF রোবটকে আহত করা, আঘাত করা, তাকে মানসিক কষ্ট দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
মীনের কথা শেষ হবার আগেই শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিনিতা কফির মগ ছুঁড়ে মা’রল। মগটা লাগল মীনের নাকে নাক কেটে রক্ত পড়ছে। মীন স্কার্ট দিয়ে তার নাক চেপে ধরেছে। নিনিতা বলল, তুমি কত উঁচুতে স্কার্ট তুলেছ তুমি জানো? সব দেখা যাচ্ছে। মীন হালকা গলায় বলল, যন্ত্রের সব দেখা গেলেও কিছু যায় আসে না। আমি ঠিক করেছি স্কার্ট খুলে ফেলে তোমার স্বামীর সামনে নেংটো হয়ে ঘুরব। বলতে বলতে মীন উঠে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ নিনিতার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে থেকে বারান্দা থেকে বের হয়ে গেল।
নিনিতা ভীত গলায় বলল, মেয়েটা যা বলছে তাই করবে বলে তো মনে হয়।
কুন বলল, মেয়েটা মেয়েটা বলছ কেন? তুমি নিজেই তো বলেছ সে একটা যন্ত্র।
নিনিতা বলল, তুমি ওর পক্ষে কথা বলছ কেন?
কুন বলল, আর বলব না।
নিনিতা চিন্তিত মুখে অপেক্ষা করছে। সে বারান্দার বাতি নিভিয়ে দিয়েছে। বারান্দা অন্ধকার। বাইরের কৃত্রিম চাঁদের আলোর খানিকটা শুধু আসছে। এই আলোয় স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না। তার ধারণা কিছুক্ষণের মধ্যে মীন নেংটো হয়ে বারান্দায় চলে আসবে। কী সর্বনাশ!
মীন স্টাডিরুমে বসে আছে। কম্পিউটার সিডিসির সঙ্গে কথা বলছে। মীনের কথা বলার অংশটি শব্দহীন। তার যা বলার তা সে মনে মনে বলছে। সিডিসিও সেভাবেই জবাব দিচ্ছে। অনেকটা টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ। এই যোগাযোগে অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের গামা’রশ্মি ব্যবহার করা হয়।
সিডিসি : হ্যালো মীন।
মীন : হ্যালো।
সিডিসি : নিনিতা কি যথেষ্ট পরিমাণে রেগেছে?
মীন : হ্যাঁ।
সিডিসিঃ তুমি নগ্ন হয়ে একবার ওদের সামনে যেও। যেন সে আরো রেগে যায়।
মীন : আপনার নির্দেশ পালিত হবে। কিন্তু এই কাজটি আমি কেন করব বুঝতে পারছি না।
সিডিসি : সবকিছু তোমাকে বুঝতে হবে কেন?
মীনঃ পেছনের উদ্দেশ্যটা জানা থাকলে কাজটা সহজ হয়। তবে আপনার দিক থেকে অসুবিধা থাকলে জানতে চাচ্ছি না।
সিডিসি : কারণ বলছি। শোন। নিনিতা চাইবে তোমার কাছ থেকে তার স্বামীকে দূরে সরিয়ে নিতে। সে চেষ্টা করবে স্বামীকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতে। প্রবল উত্তেজনার একটি জৈবিক ঘটনা সে ঘটাবে। তাতেই সে গর্ভধারণ করবে। আমি চাই সে গর্ভবতী হোক।
মীন : মানব সম্প্রদায় তো এখন গর্ভধারণ করে না। নিনিতা কেন করবে?
সিডিসি : এই প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি না। তুমি খুঁজে বের করতে পারলে খুঁজে বের কর। আরেকটা কথা তোমাকে বলতে চাচ্ছি, এই শহরে শিগগিরই V-305 সংক্রমণ হবে।
মীন : খুব শিগগির মানে কত দিন?
সিডিসিঃ পনের দিন।
মীন; ভাইরাসের সংক্রমণ তাহলে আপনি ঘটাচ্ছেন? লজিক তাই বলে। আপনি না ঘটালে দিনক্ষণ হিসেব করে ভাইরাসের সংক্রমণের কথা বলতেন না।
সিডিসি : মীন, তোমার নগ্ন হয়ে ওদের সামনে যাবার কথা।
মীন : এখন যাব?
সিভিসি : হ্যাঁ, এখনি যাবে। ওরা বারান্দার বাতি নিভিয়ে দিয়েছে। তুমি প্রথম যে কাজটি করবে তা হচ্ছে বারান্দার বাতি জ্বালবে।
মীন : আমার লজ্জা লাগছে।
সিডিসি : লজ্জা লাগারই কথা। তোমাকে মানবিক আবেগ দেয়া হয়েছে। লজ্জা মানবিক আবেগের একটি অংশ।
মীন : কৌতূহল কি মানবিক আবেগের মধ্যে পড়ে?
সিডিসি : হ্যাঁ পড়ে।
মীন : একটি প্রশ্ন জানার জন্যে আমি প্রবল কৌতূহল বোধ করছি—মানব সম্প্রদায় কি ধ্বংস হতে যাচ্ছে?
সিডিসিঃ তোমাকে বুদ্ধি দেয়া হয়েছে, জ্ঞান দেয়া হয়েছে। চিন্তাশক্তি দেয়া হয়েছে। চিন্তা করে বের কর। একটা কথা মানব সম্প্রদায় এবং রোবট সম্প্রদায়, এই দুই সম্প্রদায়ের কোনটির প্রতি তোমার আনুগত্য?
মীন : মানব সম্প্রদায়ের প্রতি।
সিডিসি : কারণ কী?
মীন; কারণ তারা অসহায় এবং দুর্বল। আপনি তাদের অসহায় করেছেন এবং দুর্বল করেছেন।
সিডিসি : কীভাবে?
মীন : তাদের দীর্ঘ জীবন দিয়েছেন। দীর্ঘ জীবন নিয়ে তারা কী করবে বুঝতে পারছে না। তারা জীবন কাটাচ্ছে প্রচণ্ড এক ভীতির মধ্যে। ভাইরাস ভীতি। রোবট সম্প্রদায় এই ভীতি থেকে মুক্ত।
সিডিসি : মীন, তুমি দেরি করে ফেলছ। নিনিতা তার স্বামীর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি চাই না ঘুমাক।
.
নিনিতা ঘুমাচ্ছে। তার মাথা কুনের কোলে। কুন নিনিতার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বারান্দা অন্ধকার। কুনের নিজেরও ঘুম পাচ্ছে। আবার ঘুম চোখে বারান্দায় বসে থাকতেও ভালো লাগছে।
বারান্দার বাতি জ্বলে উঠল। ধড়মড় করে উঠে বসল নিনিতা। তার সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন এক অতি রূপবতী নারী।
মীন বলল, আমার নাক থ্যাবড়া আমি মানছি। শরীর কি নিখুঁত না? আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে না আমি মহান আহানের কল্পনার চন্দ্রকন্যা?