মানবিক দৃষ্টিতে মেঘনাদবধ কাব্য
কবি মধুসূদন দত্ত রচিত মেঘনাদবধ কাব্য আসলে মানবিকতার জয়গান ঘোষণা করেছে রাক্ষস বীর্যবতার অন্তরালে। ভারতাত্মার প্রতীক রামায়ণ ও মহাভারত মহাকাব্যের একটি কে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। ভারতবর্ষের নিজস্ব সম্পদ থেকেই তুলে ধরলেন একটি বিপ্রতীপ দৃষ্টিকোণ। কোথাও মহৎ চরিত্রের কুৎসা নেই বরং মহান অবতার বলে বর্ণিত চরিত্র যে আসলে মানুষ এবং মানবিক দুর্বলতা যে তারো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাই তুলে ধরলেন এই মেঘনাদবধ কাব্যে। তিনি মহাকাব্যিক চরিত্র গুলির বিনির্মাণ করলেন। বিনির্মাণ বলতে বোঝায় প্রচলিত কাহিনী ও সংশ্লিষ্ট চরিত্র গুলির বিশ্লেষণ দ্বারা প্রধান নায়ক চরিত্রটি দুর্বলতাগুলিকে আলোয় আনা। যে সব খল চরিত্র আঁকা হয়েছে তাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সৎ গুনগুলিকে তুলে ধরা। এর ফলে নায়ক প্রতি নায়ক এ পর্যবসিত হলেন প্রতিনায়ক নায়কে। কিন্তু এটি করতে গিয়ে লেখক কিন্তু মূল মহাকাব্যের কাহিনী থেকে সরলেন না।
মহাভারতের ব্যাককূটে যা প্রতিপদের রহস্যের উন্মোচনে আদি কবির বক্তব্যকে নতুন আলোয় চেনা যায় ঠিক তেমনি রামায়ণ মহাকাব্যের কাহিনীর আড়ালে লুকিয়ে কূট রহস্য উদঘাটন করে চরিত্রের আড়ালে লুকিয়ে থাকা দেবোপম চরিত্র গুলির দুর্বলতা পাঠকের চোখের সামনে আনলেন মধুসূদন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় প্রমীলা লঙ্কা পুরীতে প্রবেশ করতে চলেছেন সখি দল সঙ্গে। পবন পুত্র হনুমান প্রহরায় —তিনি বাধা দিলেন! প্রমীলা তাকে জানালেন রামের সাথে কথা বলবেন নরেতর বানরের সাথে নয়। রাম বিনা দ্বিধায় প্রমীলাকে লঙ্কায় প্রবেশ করতে দিলেন। প্রমীলা লঙ্কায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে রাম হনুমানকে বললেন প্রমীলার সঙ্গে যুদ্ধে তিনি কখনোই জয়ী হতে পারতেন না। অবতারের মুখে এমন কথা শুনিয়েছেন মধুসূদন।
নিরস্ত্র মেঘনাদকে লক্ষণ আক্রমণ করছে একটি মূল রামায়ণে আছে অথচ ক্ষত্রিয়ের ধর্মে নিরস্তকে। যুদ্ধে আহ্বান করা ধর্মবিরুদ্ধ। কবি এই একটি অন্যায় কেই জনসমক্ষে তুলে ধরলেন। যুদ্ধজয়ের জন্য মহামান্য অবতার ও এমন অন্যায় আশ্রয় করেছেন। এই ছলনার কারণ মেঘনাদ প্রতিপক্ষ হিসাবে প্রবল ছিলেন। সম্মুখ সমরে তাকে পরাজিত করা অসম্ভব। এই ঘটনায় অবতার এক মুহূর্তেই দেবতা থেকে মানুষ এ পরিণত হলেন। অন্যদিকে যিনি রাক্ষস তিনি ক্ষাত্রধর্ম মেনে প্রজাপালন থেকে যুদ্ধ করে থাকেন। সাধারণ মানুষ হয়েও তিনি দেব গুণ সম্পন্ন। মেঘনাদের পিতৃ ভক্তি রামচন্দ্রের পিতৃ ভক্তি কেও ছাড়িয়ে যায়। এখানেই মধুসূদনের লেখনীর অনোন্যতা।
তিনি প্রথম আমাদের দেখিয়েছেন যে রামায়ণ আসলে এক সম্পন্ন প্রজাপ্রিয় সমরকুশল সম্রাটের অন্যায় যুদ্ধে পরাজয়ের কাহিনী। এই পরাজয় আসলে তার নৈতিক জয়ের কথাই বলে। মধুসূদনের রাবণ শক্তিশালী হয়েও ভাগ্যবিডম্বিত। এক নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রের শিকার। চারিত্রিক দুর্বলতা সত্ত্বেও তিনি প্রজাপ্রিয়, স্নেহময় পিতা ও স্বামী, সিংহ হৃদয় এবং জগতে পরাজিত এক মহান সম্রাট! কবির কাব্যের নায়ক ইন্দ্রজিৎ। শুচিশুভ্র চরিত্র তার। ক্ষাত্রধর্ম পালন থেকে শুরু করে প্রেমিক ইন্দ্রজিৎ, মাতাপিতার প্রতি নিঃশর্ত ভক্তি তাকে সব রকম জাগতিক কালিমার ঊর্ধ্বে রাখে। এই কাব্যের নায়ক ইন্দ্রজিত কবির মানস সন্তান। এ কাব্যের নায়ক সর্ববিধ সুস্থতার প্রতীক। সে দক্ষ সেনানি, প্রেমময় স্বামী ,স্নেহ কাতর পিতা জনপ্রিয় শাসক ও সুতনু নর! বাঙালি সমাজে যা কিছু চাওয়া সেই সব গুণের অধিকারী! এই মহাকাব্য কোন ভিত্তিহীন রচনা নয়— মহাকাব্য কে নতুন যুগের আলোয় রেখে দেখা।