মহামায়ার সংসার
সকাল থেকেই কৈলাশের আকাশ থমথমে।মহামায়ার মুখে আসন্ন মেঘের পূর্বাভাস!হবে নাইবা কেন? বিলক্ষণ রেগে কাই মা ঠাকরুণ।বছরে তো মাত্তর আঙ্গুলে গোনা তিনটি দিন মর্তপুরে বাপের বাড়িতে যাবার সুযোগ পান,তাও সপরিবারেই যান। তবুও, ওই গাঁজাখোর উড়নচন্ডে বদমেজাজী মহাদেবটির সহ্য হয়না ।মা ঠাকরুণের বাপের বাড়ি যাবার সময় এলেই হাজার ফ্যাচাং,খিস্তিরী,গা-জ্বালানো, চিমটিকাটা বাক্যধারা বর্ষন করা চাই,যাতে যাওয়াটা কোনমতে বানচাল হয়।তা,মহামায়াও কম যান না,যতোই ওই মহাদেবটি কটুকথা বলুক না কেন, দাঁতে কামড় দিয়ে সহ্য করেন তবু বাপের বাড়ি যাবার নিমন্ত্রণ পন্ড হতে দেন না।
মহামায়া একধামা চাল বাছতে বসেছেন। আপনমনেই গজগজ করতে থাকেন–‘আশ্চর্য্য!এই মহাদেব মানুষটি কিন্তু আগে মোটেই এমনটি ছিলেন নাকো।এতো গাঁজা- টাজাও খেতেন না,কেমন আত্মভোলা সদাশিব সন্ন্যাসী গোছের মানুষ ছিলেন বলেই না কিশোরী বয়সে তার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছিলেন।কতো যে নিরম্বু উপোস, তপস্যা,জপতপ,সাধ্যিসাধনা করে তবেই না মন গলাতে পেরেছিলেন ।
বিয়ের পর ,প্রথম মধুচন্দ্রিমা তো এই মনোরম কৈলাশ পর্বতেই!এমা! একি ছিঃ ধেৎ! কিসব ভাবছেন !
মা ঠাকরুণের অনিন্দ্যসুন্দর মুখে লজ্জার লালিমা!
মা!ওমা,একটু চাল দাওতো,প্যাঁকপ্যা়কটা সকাল থেকে কিচ্ছুটি খাচ্ছেনা —–
মহামায়া ধামা থেকে একমুঠো চাল নিয়ে সরস্বতীর কোচড়ে ফেলেন।
ওমা,দ্যাখো,আমার হুতোমটাও উপুসে আছে, কিছুই মুখে তুলছেনা,কতো কি ,এটা -সেটাদিচ্ছি,তাই,ছুঁয়েও দেখছেনা ,মুখখানা কেমন ভার করে আছে,বেচারা!আমার বড্ড খারাপ লাগছে গো—-
লক্ষ্মীর কথা শুনে বিষন্ন হাসেন মহামায়া।
-তা,মন খারাপ তো হবেই রে।সারা বছর তো এই পাহাড়-পর্বতের মাঝেই কাটায়—-ক’টা দিন ,একটু খোলা হাওয়া ,হৈ-চৈ –হুল্লোড়—সবারইতো সাধ আহ্লাদ থাকে রে মা—–
ঠিক বলেছো মা,এ্যাই দ্যাখোনা,ময়ূরটা বড্ড বাঁদরামো শুরু করেছে,আমি না পারছি ওকে কিছু খাওয়াতে,না পারছি ,ওর পিঠে চাপতে।জানো,মা,ময়ূরটা আমাকে পিঠথেকে ফেলে দিয়েছে ,দ্যাখো,কনুইয়ের ছাল উঠে গেছে–কি করি বলোতো মা?বড্ড জ্বলছে গো–
মহামায়া চালের ধামাটা রেখে ঘর থেকে চূণ-হলুদ এনে কার্তিকের কনুইতে লাগিয়ে দিয়ে ময়ূরকে ডাকেন।
কৈ রে,এদিকে আয়তো ফুলটুসি–
মহামায়া আদর করে ময়ূরকে ফুলটুসি বলেই ডাকেন।
গভীর চোখে মহামায়ার দিকে তাকিয়ে ফুলটুসি পলকে এসে কোলে ওঠে।
স্বস্নেহে ওর রেশমী কোমল শরীরে হাত বুলিয়ে দেন মহামায়া।
কার্তিক তো অবাক ময়ূরকে অমন শান্ত হতে দেখে, খানিকটা নিশ্চিতও বোধ করে ।
মহামায়া বিলক্ষণ জানেন,নন্দী-ভৃঙ্গী এই দুই চ্যালারা যদি শুধু দু’বেলা রাঁধতে পারতো ,তাহলে ওই গাঁজাখোর গেজেলটি কস্মিনকালেও মর্ত্যপুরে যেতে চাইতো না।আসলে,ভালমন্দ খাবার ,তাও আবার মহামায়ার হাতের তৈরী খাবার ছাড়া ওর মুখেই রুচবেনা,আর এই মোক্ষম সত্যটা জানেন বলেই মহামায়াও নাছোড় ,বাপের বাড়ি যাবার ব্যাপারে।
অগত্যা,মহাদেবকে যে যেতেই হবে ল্যাংবোট হয়ে সেটা স্বয়ং মহাদেবটি ও জানেন বৈকি! তবুও ,পুরুষ বলে কথা! হার মানতে রাজি নন সহজে।
হৈ-হৈ-রৈ-রৈ করে লম্বা শুঁড় নাচিয়ে ,ধূতির কোঁচা সামলাতে ব্যস্ত গনেশ বিশাল ভুঁড়ি দুলিয়ে – হাঁপাতে হাঁপাতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ডাকছে–ও মূষি ,কোথায় গেলি রে ?নাহ্ তোকে নিয়ে আর পারিনে বাপু,আয় বলছি–নাহলে, সবগুলো কলা ষাঁড়কে দিয়ে দেবো —
ছেলে গনেশকে দেখে করুণা হয় মহামায়ার।
পেটুক ছেলেটা সকাল থেকে কিছুই খায়নি বুঝি!তাই মুখটা কেমন শুকনো দেখাচ্ছে ,অন্যদিন ,এরমধ্যেই গোটা পঞ্চাশেক বুন্দিয়া লাড্ডু,গোটা ত্রিশেক গজা খেয়ে ফেলে,আর মোদক পেলে তো মহাখুশি। মহামায়ার এই ছেলেটা খুব ভোজনরসিক তো বটেই,দু’দন্ড খালিপেটে থাকতে পারেনা ।
মহামায়া ঘর থেকে একথালা লাড্ডুওমুড়কি নিয়েআসেন
—এই নে,গনুবাবা,একটু সুস্থির হয়ে বসে খা দিকিনি–
গনেশের চোখ খাবারের থালার উপর পড়তেই চোখদুটো চকচক করে উঠলেও হাত বাড়ায় না ।
না,মা,আমি কিচ্ছুটি খাবোনা —
অবাক হন মহামায়া,সেকি ! ও বাবাগনু,খাবিনে কেনরে ?
ভালো লাগছেনা , কিচ্ছুটি খেতে ভালো লাগছেনা গো, ,আমার মন ভালো নেই মা —
মহামায়া বুঝতে পারেন ব্যাপারটা।সবারই এক দশা।লক্ষ্মী,সরস্বতী,কাআর্তিক-গনেশ তো বটেই ,ওদের পোষ্যগুলোর অব্দি মন খারাপ। আর ,এসবের মূলে ,ওই নাটের গুরু গাঁজাখোর ,তিরিক্ষে স্বভাবের ওই লোকটা !আর,ইস্ উনাকেই আবার মর্ত্যবাসীরা আহ্লাদ করে -‘আশুতোষ,ভোলানাথ’বলে পূজো করে, হুঁ যত্তোসব!কিছুতেই যার তুষ্টি নেই –সে কিনা আবার আশুতোষ!আবার ভোলানাথ ও!কৈ,মহামায়াকে কটুক্তি শোনাতে,চিমটি কেটে কথা শোনাতে ভুলেন না একবার ও,তবে? ভোলানাথ! হুঁ।আর মর্ত্যপুরে গিয়ে তো দিব্যি মাথার উপরে শিবনেত্র হয়ে বসে থাকেন ,আর ,চব্যচোষ্য গিলে গাঁজায় বুঁদ হয়ে থাকেন—-যেন ,ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেন না। ওই হাড়জ্বালানো মিনসে কে চিনতে বাকি নেই মহামায়ার।তবে হ্যাঁ,পতি বলে কথা ।একেবারে তাচ্ছিল্য বা হেনস্থা করতেও প্রাণ চায়না।
শত হোক ,ভালবাসার বিয়ে ! জেনেশুনে বিষপান করে এখন দোষারোপ করে কি হবে?ভাগ্যের লিখন বলে কথা। নইলে ,মহামায়ার অন্যবোনেরা তো বাপের পছন্দ করা পাত্র কেউ বিয়ে করেছিলো,সুখেও আছে।তিনিই তো মহাদেবের রূপে মজে ,তার প্রেমে পাগল হয়ে ,বাপের অমতে—-থাকগে্ পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ কি ?
অবশ্য যতোই মহাদেবকে গালমন্দ করুন না কেন ,উনি কিন্তু এক’দন্ড মহামায়া হীন হয়ে থাকতেই পারেন না।
ছেলেমেয়েরা এখন আর ছোটটি নেই।তবু ফাঁক পেলেই জাপ্টে ধরেন।
মহামায়া লজ্জায় রাঙ্গা হন,ছিঃ বুড়ো বয়সে ভীমরতি দেখে বাঁচিনে–
মহাদেব আবেগঘন চোখে তাকান,ও কথাটি বলোনা দুর্গে,তোমাকে দেখলেই ভেতরটা কেমন তুরুতুরু করে,তাছাড়া,পুরুষ মানুষ বুড়ো হয়না বুঝলে ?এখনো এ বুকে কতো যে প্রেমের কামবহ্নি –দেখবে?
সভয়ে পিছু হটেন মহামায়া।
রক্ষে করো বাপু ,রান্নাঘরে উনুনে ভাত উড়িয়েছি ,রান্না হয়নি এখনো—-
খাবার প্রসঙ্গ আসতেই উজ্জ্বল মুখে মহাদেব সাগ্রহে বলেন, ও দুর্গে ,শোনো না ,আজ ডাটাচচ্চড়ি করবে পুঁই পাতা দিয়ে,আর ঝিঙ্গেপোস্ত! ওতে একটু নারকেল দিও,তোমার হাতে ওদুটো রান্নার স্বাদ একেবারে অমৃতের মতো গো —
মহামায়া রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে মুচকি হেসে বলেন, তথাস্তু পেটুক মশাই —-
আনমনা মহামায়ার চিন্তাসূত্রের গ্রন্থি টা ছিঁড়ে যায় লক্ষ্মীর ডাকে।
ওমা!রান্না হয়েছে?নন্দী-ভৃঙ্গীর খুব ক্ষিদে পেয়েছে,বাবাও বলছিলো—-
চমকে উঠেন মহামায়া।মহাফাপড়ে পড়েন,তাইতো!আজ সকাল থেকেই সব কেমন যেনএলোমেলো,কোন কাজেই মন বসছে না —মেজাজটাতো কাল রাত থেকেই বিগড়েছে,মহাদেব কতোনা যাচ্ছেতা কথা শুনিয়েছেন ।বছর বছর বাপের বাড়ি যাবার বদ অভ্যেস নাকি তার,ঘর সংসারে মন টেকেনা।আশ্বিন মাসটা তাই মহাদেবের দু’চক্ষের বিষ! ওই মাস টা এলেই নাকি মহামায়ার পায়ের তলায় চুলকোতে থাকে আর সেই চুলকানো সেরেও যায় নাকি বাপের বাড়ি পা দেওয়ামাত্র।মায়ের দেখাদেখি,ছেলেমেয়েদের ও টো-টো বাতিক হয়েছে।
শুনতে শুনতে মহামায়া ও জ্বলে ওঠেন বারুদের মতো। চিবিয়ে চিবিয়ে ব্যঙ্গ করেন,ওফ্ তাই নাকি?তা,নিমন্ত্রণ করতে যখন পবন এলো,তখন নিষেধ করোনি কেন?
তখন তো একগাল হেসে আশ্বাস দিলে,যাবো রে ভাই,অবশ্য ই যাবো আমরা—–
মহাদেব ভ্রু-ভঙ্গি করেন একথা শুনে।
বাহ্ আমি কেন খামোকা নিষেধ করে ওদের কাছে মন্দ হতে যাবো? তোমার নিজের উচিত ছিল নিষেধ করা।তাছাড়া,মর্ত্যপুরে যেতেই তো সাতদিন লেগে যায়,তারপর, পূজোর তিনদিন, আবার ফিরে আসার হ্যা়ঁপা–
দু’জনের সেকি বাক্-বিতন্ডা !সারারাত চোখের পাতা বুঝেনি।আর তাইতে বিগড়ে আছে মহামায়ার মেজাজটাও।কখন যে বেলা গড়িয়ে দুপুর হলো টেরটি পাননি।রান্না–বান্নাও কিছুই হয়নি তাই। নন্দী-ভৃঙ্গীর জন্য মনটা হু হু করে উঠলেও লক্ষ্মী যেইমাত্র বাপের কথা বললো,অমনি মহামায়ার মুখ গম্ভীর।
আজ রান্না করতে পারবোনা, ধামায় –চিড়ে -মুড়ি,আছে,গুঁড় আছে,দুধ-কলা দিয়ে নন্দী-ভৃঙ্গীকে দিয়ে দে–,আর শোন, তোরাও খেয়ে নিস সবাই–
বিস্মিত লক্ষ্মী মাকে অপলকে দেখে চমকে ওঠে,মুখটা অমন দেখাচ্ছে কেন?শরীর খারাপ?
বাড়ির গুমোট পরিবেশের কারনটা সবারই জানা,মুখে না বল্লেও আড়ালে তাই নিয়ে নিজেদের মাঝে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই বটে।
মায়ের দিকে ফিরে নরমসুরে লক্ষ্মী বলে,তোমার নিশ্চয় কালরাতে ঘুম হয়নি তাইনা? ওমা একটু আদা-চা করে দেই তোমাকে?
মহামায়ার কপালের রগদু’টো দপদপ্ করছিলো।ক্লান্ত লাগছিল বড্ড। একটু আদাচা হলে মাথাধরাটা কমতে পারে।তাই মাথা নেড়ে সায় দেন।
আচ্ছা লখুমা,তাই দিস একটু —
খানিক পরে লখু চা নিয়ে আসে।
মহামায়া গরম চায়ে চুমুক দেন।লখু চা-টা বড় খাসা করে!শরীরের অবসাদ যেন ঝরে গেলো আদাচা খেয়ে।
লখু শুন্য কাপটা নিয়ে চলে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে।
–কিরে? দাঁড়িয়ে রইলি যে?কিছু বলবি নাকি ?
ঢোঁক গিলে কথাটা বলেই ফেলে লখু।
মা ,বাবাকে কি খেতে দেবো?
মহামায়া কড়াসুরে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যান,মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে জবাব দেন নিরাসক্তভাবে।
কেন?ঘরে তো বেল-কলা,মিষ্টিআলু কিছু আর কম নেই,ওসব তো ওনার অপছন্দের নয়–
লক্ষ্মী আর দাঁড়ায় না।
মহামায়ার সংসারের চিরপরিচিত হাস্যমুখর ছবিটা এদু’দিনে বেশ পাল্টে গেছে,আর এরকমটা তো প্রতিবছরের গা’সহা ব্যাপার।প্রতি বছর মর্ত্যপুর থেকে নিমন্ত্রণ আসে—আর এনিয়ে ক’দিন কৈলাশে–মহেশ্বর পরিবারে কর্তা–গিন্নীর মধ্যে বিস্তর বাক-বিতন্ডা–মান -অভিমান চলে,আর ,এসব কিছুর পরের চিত্রটা আরো মজাদার !
মহামায়া মুখে কুলুপ এঁটে চলেন,কলের পুতুলের মত কাজকর্ম করেন।তবে,মায়ের গুরুগম্ভীর মুখ,স্পিকটি নট ভাবমূর্তি,সন্তানদের পীড়া তো দেয়ই,খোদ মহাদেবের ধ্যানমগ্নতায় ও বিঘ্ন ঘটে।মহাদেবের ওই এক দোষ,রাগহলে নিজে পঞ্চমুখে যা খুশি তাই বলবেন, কিন্তু যাকে বলছেন সে যদি উল্টে গোমড়ামুখো হয়ে ঘুরে বেড়ায় তো সেটি বরদাস্ত করতে পারেন না।
কৈলাশ শিখরে বসে জগৎকল্যাণের নিমিত্ত ধ্যান মগ্ন হয়ে তপস্যা করতে যাবেন তো, ফোঁপানোর শব্দে চোখ খুলতেই লক্ষ্মী,সরস্বতী,কার্তক-গনেশ কে দেখতে পান—ওদের মলিন কান্নামাখা মুখ দেখে মনটা দ্রবীভূত হয়—-‘আহারে!বাছারা,কাঁদছিস কেনরে?তোদেরকে মা বকেছে বুঝি?
একসাথে মাথা নাড়ে চার ভাইবোনে।
অবাক হন মহাদেব,তাহলে , মিছিমিছি সবাই কাঁদছিস কেন তোরা?
এবারে সমস্বরে জবাব আসে।
মিছিমিছি নয় বাবা।বছরে একবারইতো আমরা মর্ত্যপুরে বেড়াতে যাই।মর্ত্যপুরের মানুষরা তো সারাবছর দেশ-বিদেশের ঘুরে বেড়ায় ,মা–বাবার সঙ্গে,আর ,আমরা—
গনেশ লম্বা শুঁড় দুলিয়ে বলে,আমার মূষিটা পর্যন্ত দুঃখে উপুস দিয়েছে তা জানো তুমি?
—–আর ,আমার ময়ূর!জানো বাবা,সারাটা কৈলাশ আমাকে পায়ে হেঁটে ছুটিয়ে মারছে,পিঠে চাপতেই দিচ্ছে না ।দেখো ,আমার হাত–পা ফেটে চৌচির,তোমার কি একটুও দয়া-মায়া হয়না বাবা?
লক্ষ্মী ও সরস্বতী দুবোনের কার্তিক -গনেশকে ধমকে ওঠে,ছিঃ ভাই,বড়দের সামনে অমন কঠোর সুরে কথা বলতে নেই—
মহাদেব মৃদু হেসে দু’মেয়ের দিকে তাকান।
তা,তোমরাও কিছু বলবে না?দুঃখটা তো সবারই,–
লক্ষ্মী ও সরস্বতী এসে মহাদেবের সামনে নতজানু হয়।
আসলে,বাবা,বছরে ওই তিনটি দিনের জন্য প্রতিক্ষায় স্বপ্নের জাল বুনি।ওখানে গেলে—মনটা যেন ডানা মেলে-
মর্ত্যপুর এতো সুন্দর!ওখানের শ্যামল প্রকৃতি, বিচিত্র বর্ণের ফুলের মেলা, পাখির কাকলি,কোকিলের কুহুতান,আর ,মর্ত্যবাসীদের প্রাণঢালা শ্রদ্ধা-ভক্তির সুবাস আমাদের মনকে অনাস্বাদিত পুলকে ভরিয়ে তুলে–
সরস্বতী যোগ করে, তাছাড়া ,কি অপূর্ব নৃত্যকলা,চিত্রশিল্পীর চিত্রাঙ্কণ, মৃৎশিল্পীর হাতের জাদু,গায়কের সুরেলাকন্ঠ—তারপর,, ওখানকার ছোটছোট ছেলেমেয়েদের অকুন্ঠ ভালবাসার নির্য্যাসের কাছে তো —স্বর্গের পারিজাত ও হার মানে—–
মহাদেবের মুখে জ্যোতির্ময় আলোর উচ্ছ্বাস।
তাইবুঝি! তা,তোদের মা কোথায়? তিনি তো যাবার কথাটি বলেছেন না।আমার সাথে তো আড়ি দিয়ে রেখেছেন। তাহলে,কি করি বলতো?
লক্ষ্মী খিল খিল হেসে সারা হয়,বারে! তুমিই তো মা কে ক্ষেপাও,ইচ্ছে করে ঝগড়া–তক্কো করো,সে বুঝি আমরা জানিনে?
সরস্বতী ও সায় দেয়, ঠিক কথা।প্রতিবছর তুমি অমন কান্ড করো,তারপর,নিয়েও যাও আমাদের সবাইকে মর্ত্যপুরে। মিছিমিছি কেন যে মায়ের সাথে অমন ক্যাচাল করো সে আমি বুঝি নে বাপু।কেন যে অমন করো—–
লক্ষ্মী মুচকি হাসে,এতো বুঝে তোর কাজ নেই সরু,সংসারের এতো কূটকচালি তুই বুঝবি নে।সারাজীবন তো কেবল কাঁড়ি কাঁড়ি বইনিয়ে কেবল বিদ্যেধরী হয়েছিস—-সংসার আর করলি কৈ?
মহাদেব মুচকি মুচকি হাসছেন ওদের কথায়।
তার লখু মেয়েটা খুব বুদ্ধিমতি।ঠিক ধরে ফেলেছে ক্যাচালের আসল কারনটা।
মেয়ের চোখে ধরা পড়তে একটু লজ্জিত ও হন বৈকি!
সেদিন মধুপূর্ণিমার রাত ছিলো।
পূর্ণিমার আলোয় সমস্ত কৈলাশ অপরূপ নয়নমনোহর রূপ ধরেছে।
ছেলেমেয়েরা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।ঘুম নেই কেবল মহামায়ার চোখে । ঘরে মন টিকছিলোনা।পায়ে পায়ে বেড়িয়ে এলেন । পূর্ণিমার বাঁধভাঙ্গা আলোর বন্যায় স্নাত কৈলাশের এক পাথর শিলায় বসে বসে কতো কি ভাবছেন। সহসা মনটা ছটফট করে উঠতে–নীচে–বহুনীচে— ভূলোকের পথে —আকুলতায় মর্ত্যপুরে বাপের বাড়ির সৌধটা দেখার জন্য বুভুক্ষু দৃষ্টিটা মেলে দিলেন———
পল–অনুপল–খসতে থাকে সময়ের খাম থেকে—–
দুর্গে!
আচমকা কানের কাছে আবেগমথিত পরিচিত কন্ঠের
সাড়া পেতে চমকে ওঠেন মহামায়া।
এ কি!প্রভু ,আপনি?এতো রাতে ধ্যান ভেঙ্গে!
মহাদেবের চোখেমুখে ব্যাকুল আর্তি ফুটে।
তুমি তো জানো দুর্গে, তুমিই আমার শক্তি।তোমাকে কাঁদিয়ে আমার কি ধ্যানে মন বসতে পারো বলো? তাছাড়া , তুমি তো জানো ,আমি ক্ষ্যাপা,তোমাকে রাগিয়ে ,ক্ষেপিয়ে,ঝগড়া করে কৌতুক করি, কিন্তু তোমাকে ছাড়া যে তোমার এই মাদারীপুর, জটাধারী, গাঁজাখোর,বদমেজাজী,উড়নচন্ডে স্বামীটির একদন্ড চলেনা,তা কি জানো না দুর্গে?
মহামায়া আপনমনে জিভকে শাসন করেন।
ছিঃ ছিঃ মিনসেটা যে সর্বজ্ঞ–সবজান্তা,রাগের মাথায় তাতো খেয়ালই ছিলোনা মহামায়ার।
মূহূর্তে সব রাগ-অভিমান মুছে যায়।
চট্ করে নতজানু হন মহাদেবের পায়ে ।
আমাকে ক্ষমা করো ত্রিকালজ্ঞ।আমি——-
মহাদেব দু’হাতে র বলিষ্ঠ বাহুর সপ্রেম আকর্ষনে বুকের মাঝে টেনে নেন মহামায়াকে।
মহামায়া কিছু বলতে যাবার আগেই উষ্ণ ঠোঁটের
চুম্বন আশ্লেষে হারিয়ে ফেলেন নিজেকে।
স্বর্গলোকে —দেবতারা তাদের উপর পুষ্পবৃষ্টি করতে থাকেন—
এদিকে ,মর্ত্যপুরে আগমনীর ডঙ্কা বেজে ওঠে উলুধ্বনি ও শঙ্খবাদ্যের সাথে ঢোলকের দ্রিমি দ্রিমি তালে—-