মসৃণ পথের যাত্রী
আজ অর্ঘ্য র আঠাশ বছর পূর্ণ হল। দু’বছর আগে অর্ঘ্যর জন্মদিনে একটা গিটার উপহার দিয়েছিলাম। সেদিন জাঁক জমক করে ওর ছাব্বিশ বছরের জন্মদিন পালন করেছিলাম। আজ ওর বিয়ে। শান্তিপুরে ওর শ্বশুরবাড়ি। একেবারে ঘরের সাথে লাগোয়া বাড়ি। গতকাল থেকে উলুর ধ্বনি আর শাঁখে বাড়ি জমজমাট। মা বার বার বলেছে ওর বিয়েতে যেন আমি উপস্থিত থাকি। নইলে পাড়ায় ঢি পড়ে যাবে যে ওর সাথে আমার ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল , আমি প্রেমে আঘাত পেয়েছি। জানালার পর্দাটা একটু তুলে দেখার চেষ্টা করছিলাম অর্ঘ্য কে যদি একবার দেখতে পেতাম। নাঃ ও আজ একটু ব্যস্ত। তারপর নতুন বউকে হয়ত ফোন করছে।
– রিয়া স্নানে যা। আমি গায়ে হলুদের বরণ করতে যাব। তুই ভালো জামা পরে রেডি হয়ে নে। দুপুরে ওরা খেতে বলেছে।–এই বলে মা স্নানে চলে গেল।
– হ্যাঁ মা যাচ্ছি।
– গরম পড়ে গেছে বেশি সাজবো না মা। যে জামাটা বাইরে রয়েছে ওটাই পরে চলে যাব।
– এ কী রকম কথা রিয়া। লোকে কি বলবে। হালকা নীল রংয়ের ঘাগরাটা এখন পরবি।ওদের কত আত্মীয়-স্বজন এসেছে বাড়িতে। একটু সেজেগুজে যাবি, আমাকে তো তোর বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে?
– আচ্ছা মা, ওদের আত্মীয় এসেছে আর আমার বিয়ের সাথে সম্পর্ক কি?
– তোকে বুঝতে হবে না তুই স্নানে যা তাড়াতাড়ি।
– ও বাবা কি সুন্দর লাগছে রিয়া কে আজকে। তপতী দি,তোমার মেয়ে তো অনেক বড় হয়ে গেছে।
– হ্যাঁগো সুপর্ণা। আর ছোট নেই। আমাদের মাথার উপর অনেক চিন্তা। মেঘে মেঘে বেলা হল। চব্বিশ বছর এই আশ্বিন মাসে কমপ্লিট করবে। তোমাদের চেনা ভালো সম্বন্ধে থাকলে বোলো। ওর বাবা আর পারছে না। রিটায়ারের সময় হয়ে এলো। মেয়েকে ভালোয় ভালোয় পাত্রস্থ করতে পারলে আমাদের শান্তি।
– লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে গেছিল আজ রিয়ার। ঐসব কথা শোনার পর কোন মেয়ের ভালো লাগে। মাঝখানে মাকে বাধা দিতে পারছিল না। শুনতেও কষ্ট হচ্ছিল। তবু একবার মায়ের হাতে চিমটি কেটে ছিল। মা বুঝতে পারেনি। ভেবেছে হয়ত কোন পোকা কামড়িয়েছে।
– ও কাকিমা তুমি কখন এলে? প্রশ্নটা করে অর্ঘ্যর দিদি। এরা সকলেই রিয়া আর অর্ঘ্য র সম্পর্কটাকে পরিপূর্ণ হতে দেয়নি। তাই একটু আনন্দেই আছে।
– হ্যাঁ গো সোমা, এই পাঁচ মিনিট হল। তোমার কাকুর তো অফিস আছে। রান্না বান্না কাজকর্ম সেরে এই রিয়াকে নিয়ে এলাম।
– রিয়া তোকে আনতে হচ্ছে কেন? অর্ঘ্যর বিয়ে, তুই তো আগে এসে গুছাবি। কিছুক্ষণ অর্ঘ্যর পাশে থাক।
– অর্ঘ্য র দিদি বেশ চালাক, এমন অভিনয় করলো যেন আগের কোনো ঘটনা সে জানেনা।
– রিয়া অনেকক্ষণ অর্ঘ্য কে তার গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তারপর তার চোখ খুঁজছিল কোথায় অর্ঘ্যর উপস্থিতি।
– না আজ আর অর্ঘ্য রিয়ার কাছে আসেনি। ছাদেতে গায়ে হলুদে ব্যস্ত। রিয়া নীচের ঘরে অপেক্ষা করছিল।
– সন্ধ্যেবেলায় বর বেরিয়ে গেল। রিয়া সামনে আসতে পারেনি। লুকিয়ে লুকিয়ে বেশ খানিকক্ষণ কাঁদছিল। ইচ্ছে করছিলোনা বরযাত্রী যেতে। না গেলে মা-বাবা দুজনেই বকবে।
– প্রচুর উলুধ্বনি, রজনীগন্ধা ফুলের গন্ধ চারিদিক ভরে উঠেছে। অর্ঘ্য মাথায় টোপর পরে বর সেজে গাড়িতে উঠল। রিয়া অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল।
– সাতটার সময় একটা গাড়িতে রিয়ারা তিনজন উঠে বসলো। শান্তিপুরের উদ্দেশ্যে রওনা। রিয়া ভাবছিল তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া করে চলে আসবে। কিন্তু উপায় কোথায়। বাবা-মার কড়া শাসন।
– হঠাৎ করে একটা চেঁচামেচিতে সবাই এগিয়ে গেল। একে অপরকে কানে কানে কি যেন কথা বলছে। কিছুক্ষণ বাদে শোনা গেল নতুন বউ যাকে ভালোবাসত তার সঙ্গে চলে গেছে।
– ছিঃছিঃ রব শোনা গেল। এবার উপায় কি। হঠাৎ করে অর্ঘ্যর বাবা এসে রিয়ার হাতদুটো ধরেছেন। রিয়া মা এই বুড়োটার কথা রাখ মা। আমাদের সম্মান বাঁচুক। আজ তুই অর্ঘ্য কে বিয়ে করে নে। ডিয়ার মাথায় যেন পাথর এসে পড়ল। সে কি করে হয়। ওতো মনটাকে ঠিক করে নিয়েছে। কিছুক্ষণ বসে ভাবল। হঠাৎ মনে পড়ল বন্ধু তিতিনের কথা। খুব অসহায় অবস্থা মেয়েটির। লেখাপড়ায় সে তার সমকক্ষ। অপূর্ব রূপ তার। কিন্তু পিতৃহীন। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলো ওকে রেডি হওয়ার জন্য। তিতিন জানেনা ও বিয়ে বাড়িতে আছে। ভাবল পার্লারের কোন কাজে হয়তো ডাকছে। তাই সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে ওদের গাড়ির অপেক্ষা করতে লাগল। রিয়াদের গাড়ি ফিরে এলো তিতিনকে নিতে।তিতিন তাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল কি ধরনের সাজ হবে। কাপড় পরেছে না লেহেঙ্গা। রিয়া চতুরতার সঙ্গে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিল। গাড়ি গিয়ে থামল শান্তিপুরে। নতুন বউয়ের বাবা-মা খুব ভালো। তারা দাঁড়িয়ে থেকে তিতিন আর অর্ঘ্যর বিয়েটা দিল।
– রিয়াকে ওর মায়েরকাছে অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছিল। তবুও রিয়া ভাবে একটা যথার্থ কাজ করেছে।
– রিয়া আজ উত্তরবঙ্গের একটা স্কুলে শিক্ষকতা করতে ব্যাগ গুছিয়ে গাড়ির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। জয়নিং লেটার আগেই হাতে পেয়েছিল সে।