মধ্য-এশিয়ার দিকসীমাহীন মরুভূমি
মধ্য-এশিয়ার দিক্সীমাহীন মরুভূমির মাঝখানে বালু ও বাতাসের খেলা। বিরামহীন অস্থির চঞ্চল খেলা। রাত্রি নাই, দিন নাই, সমগ্র মরুপ্রান্তর ব্যাপিয়া এই খেলা চলিতেছে।
খেলা বটে, কিন্তু নিষ্ঠুর খেলা; অবোধ শিশুর খেলার মতো প্রাণের প্রতি মমতাহীন ক্রুর খেলা। ক্ষুদ্র মানুষের সৃষ্ট ক্ষুদ্র নিয়মের এখানে মূল্য নাই; জীবনের কোনও মূল্য নাই। দয়া করুণা এখানে আপন শক্তিহীন ক্ষুদ্রতায় ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে।
প্রকৃতির নিষ্ঠুরতায় কোনও বিধি-বিধান নাই। কখনও পঞ্চাশ বৎসর ধরিয়া বায়ু ও বালুর দুর্লক্ষ্য ষড়যন্ত্রে একটি তৃণশ্যামল নিঝর-নিষিক্ত ওয়েসিস ধীরে ধীরে মরুভূমির জঠরস্থ হইতেছে; আবার কখনও একটি দিনের প্রচণ্ড বালুঝটিকায় তেমনই শ্যামল লোকালয়পূর্ণ ওয়েসিস বালুপের গর্ভে সমাহিত হইতেছে। দূরে বহু দূরে হয়তো আর একটি নূতন ওয়েসিসের সূচনা হইতেছে। এমনই অর্থহীন প্রয়োজনহীন ধ্বংস ও সৃজনের লীলা নিরন্তর চলিতেছে।
এই মরু-সমুদ্রের মাঝখানে ক্ষুদ্র একটি হরিদ্বর্ণ দ্বীপ—একটি ওয়েসিস। দূর হইতে দেখিলে মনে হয়, তৃষ্ণাদীর্ণ ধূসর বালুপ্রান্তরের উপর এক বিন্দু নিবিড় শ্যামলতা আকাশ হইতে ঝরিয়া পড়িয়াছে। কাছে আসিলে দেখিতে পাওয়া যায়, শতহস্তব্যাসবিশিষ্ট একটি শম্পাঞ্চিত স্থান কয়েকটি খর্জুর বৃক্ষের ধ্বজা উড়াইয়া এখনও মরুভূমির নির্দয় অবরোধ প্রত্যাহত করিতেছে। খর্জুর-ছায়ার অন্তরাল দিয়া একটি প্রস্তরনির্মিত সঙ্ঘারামের অর্ধপ্রোথিত ঊর্ধ্বাঙ্গ দেখা যায়। মধ্য-এশিয়ার মরুভূমিতে প্রাকৃতিক নির্মমতার কেন্দ্রস্থলে মহাকারুণিক বুদ্ধ তথাগতের সঙ্ঘারাম মাথা জাগাইয়া আছে।
একদিন এই স্থান জনকোলাহলমুখরিত সমৃদ্ধ জনপদ ছিল—দশ ক্রোশ স্থান ব্যাপিয়া নগর হাট উদ্যান চৈত্য বিরাজিত ছিল। শত ক্রোশ দূর হইতে সার্থবাহ বণিক উষ্ট্রপৃষ্ঠে পণ্য লইয়া মরুবালুকার উপর কঙ্কাল-চিহ্নিত পথ ধরিয়া এখানে উপস্থিত হইত। ক্ষুদ্র রাজ্যে একজন ক্ষুদ্র শাসনকতাও ছিল; কিন্তু এখন আর কিছু নাই। এমন কি, যে কঙ্কালশ্রেণী মরুপথে বহির্জগতের সহিত সংযোগ রক্ষা করিত, তাহাও লুপ্ত হইয়া গিয়াছে।
কিঞ্চিদূন পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে বালু ও বাতাস এই স্থানটিকে লইয়া নৃশংস খেয়ালের খেলা আরম্ভ করিয়াছিল। মরু এবং ওয়েসিসের সীমান্ত চিহ্নিত করিয়া খর্জুর বৃক্ষের সারি চক্রাকার প্রাকারের মতো ওয়েসিসকে ঘিরিয়া রাখিয়াছে; এই সীমান্তভূমির উপর সূক্ষ্ম বালুকার পলি পড়িতে লাগিল। কেহ লক্ষ্য করিল না। দুই-তিন বৎসর কাটিল। সহসা একদিন একটি উৎসের জলধারা শুকাইয়া গেল। লক্ষ্য করিলেও কেহ গ্রাহ্য করিল না। আরও অনেক উৎস আছে।
দশ বৎসর কাটিল। তারপর একদিন সকলে সত্রাসে হৃদয়ঙ্গম করিল—ওয়েসিস সঙ্কুচিত। হইয়া আসিতেছে; অলক্ষিতে মরুভূমি অনেকখানি সীমানা গ্রাস করিয়া লইয়াছে।
অতঃপর ফাঁসির দড়ি যে-ভাবে ধীরে ধীরে কণ্ঠ চাপিয়া প্রাণবায়ু রোধ করিয়া ধরে, তেমনই ভাবে মরুভূমি ওয়েসিসকে চারিদিক হইতে চাপিয়া ক্ষুদ্র হইতে ক্ষুদ্রতর করিয়া আনিতে লাগিল। প্রথমে আহার্য-পানীয়ের অপ্রতুলতা, তারপর বসবাসের স্থানাভাব হইল। যাহারা পারিল পলায়ন করিল; উষ্ট্র-গর্দভপৃষ্ঠে যথাসম্ভব ধনসম্পত্তি লইয়া অন্য বাসস্থানের উদ্দেশে বাহির হইয়া পড়িল। যাহারা তাহা পারিল না, তাহারা শঙ্কাকুলচিত্তে মরুর পানে তাকাইয়া অনিবার্য। পরিসমাপ্তির জন্য প্রতীক্ষ্ণ করিতে লাগিল। জনপদের জনসংখ্যা অর্ধেকের অধিক কমিয়া গেল।
মরুভূমির ত্বরা নাই, ব্যস্ততা নাই। নাগ কবলিত ভেকের ন্যায় ওয়েসিস অল্পে অল্পে মরুর জঠরস্থ হইতে লাগিল।
এক পুরুষ কাটিয়া গেল। যাহারা যুবক ছিল তাহারা এই অনির্বাণ আতঙ্ক বুকে লইয়া বৃদ্ধ হইল। কিন্তু সৃষ্টির বিরতি নাই; ধ্বংসের করাল ছায়ার তলে নবতর সৃষ্টি জন্মগ্রহণ করিয়া বর্ধিত হইয়া উঠিতে লাগিল।
একদিন গ্রীষ্মের তাম্রতপ্ত দ্বিপ্রহরে দিগন্তরাল হইতে কৃষ্ণবর্ণ আঁধি উঠিয়া আসিল। মরুভূমির এই আঁধির সহিত তুলনা করিতে পারি পৃথিবীতে এমন কিছু নাই। মহাপ্রলয়ের দিনে শুষ্ক জীর্ণ পৃথিবী বোধ হয় এমনই উন্মত্ত বালুঝটিকার আবর্তে চূর্ণ হইয়া শূন্যে মিলাইয়া যাইবে।
দুই দিন পরে আকাশ পরিষ্কার হইয়া প্রখর সূর্য দেখা দিল। বিজয়িনী প্রকৃতির সগর্ব হাসির আলোয় ওয়েসিস উদ্ভাসিত হইল। দেখা গেল ওয়েসিস আর নাই, পর্বতপ্রমাণ বালুকার তলায় চাপা পড়িয়াছে; কেবল উচ্চ ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত সঙ্ঘারামের অর্ধনিমজ্জিত চূড়া ঘিরিয়া কয়েকটি খর্জুর বৃক্ষ শোকার্তভাবে দাঁড়াইয়া এই সমাধিস্থল পাহারা দিতেছে। মানুষের চিহ্নমাত্র কোথাও নাই।
দ্বিপ্রহরে সঙেঘর উপরিতলের একটি বালু-সমাহিত গবাক্ষ হইতে অতি কষ্টে বালুকা সরাইয়া বিবরবাসী সরীসৃপের ন্যায় দুইটি প্রাণী বাহির হইল। মানুষই বটে; একজন বৃদ্ধ, দ্বিতীয়টি বলিষ্ঠদেহ যুবা বলিয়া প্রতীয়মান হয়। যুবা বৃদ্ধকে টানিয়া বাহির করিয়া আনিল। তারপরে উভয়ে বহুক্ষণ গবাক্ষের বাহিরে বালুর উপর পড়িয়া দীর্ঘ শিহরিত প্রশ্বাসে মুক্ত আকাশের প্রাণদায়ী বায়ু গ্রহণ করিতে লাগিল। ক্রমে তাহাদের তৃষ্ণা-বিদীর্ণ অধরোষ্ঠে কালিমালিপ্ত মুখে মানুষী ভাব ফিরিয়া আসিল। চিনিবার মতো কেহ থাকিলে চিনিতে পারিত, একজন সঙ্ঘ-স্থবির পিথুমিত্ত, দ্বিতীয় ভিক্ষু উচণ্ড। বালুঝটিকা আরম্ভ হইবার সময় সঙ্ঘের অন্যান্য সকলেই ভীত হইয়া বাহিরে আসিয়াছিল, তাহারা কেহ বাঁচে নাই; কেবল এই দুই জন সঙ্ঘের দ্বিতলস্থ পরিবেণে অবরুদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলেন, দৈবক্রমে রক্ষা পাইয়াছেন।
বালুকার স্থূপ ঢালু হইয়া সঙ্ঘের গাত্র হইতে নামিয়া গিয়াছে। উভয়ের বায়ুক্ষুধা কথঞ্চিৎ প্রশমিত হইলে তাঁহারা টলিতে টলিতে নিম্নভিমুখে অবতরণ করিতে লাগিলেন। বাঁচিতে হইলে জল চাই। সঙ্ঘের পাদমূলে খর্জুরকুঞ্জের মধ্যে একটি প্রস্তর-গুহা হইতে প্রস্রবণ নির্গত হইত, সেখানে দুই জনে উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, প্রস্রবণের মুখ বুজিয়া গিয়াছে বটে, কিন্তু বালুবন্ধ উৎসের স্বতঃপ্রবাহ রোধ করিতে পারে নাই; গুহামুখের বালুকা সিক্ত হইয়া উঠিয়াছে। আরও দেখিলেন, সেই সিক্ত সিকতার উপর—দুইটি মানবশিশু। প্রথমটি পাঁচ-ছয় বৎসরের বালক, নিদ্রিত অথবা মূৰ্ছিত হইয়া পড়িয়া আছে; তাহার মেরুসংলগ্ন জঠর ধীরে ধীরে উঠিতেছে। পড়িতেছে। দ্বিতীয়টি অনুমান দেড় বৎসরের একটি বালিকা। শুভ্র নগ্নদেহে একাকিনী খেলা করিতেছে, খজুর বৃক্ষের চ্যুত প ফল কুড়াইয়া খাইতেছে, আর নীল নেত্র মেলিয়া আপন মনে কলস্বরে হাসিতেছে। মৃত বা জীবিত আর কেহ কোথাও নাই। প্রকৃতির দুরবগাহ রহস্য। প্রভঞ্জনের ধ্বংস-তাণ্ডবের মধ্যে এই দুইটি সুকুমার জীবন কণিকা কি করিয়া রক্ষা পাইল?
দুই ভিক্ষু প্রথমে বালু খনন করিয়া জল বাহির করিলেন। একদণ্ড কাল অঙ্গুলি সাহায্যে গুহামুখ খনন করিবার পর উৎসের পথ মুক্ত হইল—উভয়ে অঞ্জলি ভরিয়া জল পান করিলেন।
প্রচণ্ড সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলিয়া পড়িয়াছে—খর্জুর বৃক্ষের ছায়া পূর্ব দিগন্তের দিকে দীর্ঘতর অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কোন্ অনাদি রহস্যের ইঙ্গিত জানাইতেছে। সঙ্ঘ-স্থবির পিথুমিত্ত একবার এই সমাধিস্কৃপের চারিদিকে চাহিলেন; ঊর্ধ্বে সঙেঘর বালু-মগ্ন শিখর, নিম্নে তরঙ্গায়িত বালুকারাশি দিপ্রান্তে মিশিয়াছে। তাঁহার শীর্ণ গণ্ড বাহিয়া অশ্রুর দুইটি ধারা গড়াইয়া পড়িল। শিশু দুটিকে নিজ ক্রোড়ে টানিয়া লইয়া স্থলিত কণ্ঠে বলিলেন, তথাগত!
অতঃপর মরুভূমির একান্ত নির্জনতার মাঝখানে, বুদ্ধ তথাগতের সঙ্ঘ-ছায়ায় এই চারিটি মানবজীবনের ক্রিয়া আবার নূতন করিয়া আরম্ভ হইল। স্থবির পিথুমিত্ত বালকের নাম রাখিলেন নির্বাণ। বালিকার নাম হইল—ইতি।