এগারো ঘণ্টা ডিউটি
এগারো ঘণ্টা সমানে ডিউটিতে থাকবার পরে বিমল, এ্যালিস, সুরেশ্বর ও মিনি বাইরের ফুটপাথে পা দিলে।
চ্যাং সো লিন অ্যাভিনিউ প্রসিদ্ধ দেশনায়ক চ্যাং সো লির নামে হয়েছে- রেডশার্টদের প্রভাবে। সাংহাইয়ের মধ্যে এটা একটি প্রসিদ্ধ রাস্তা, রাস্তার ধারে ফুটপাথে শামিয়ানার নীচে চা ও শুয়োরের মাংসের দোকান। লোকজনের বেজায় ভিড়।
এই অ্যাভিনিউয়ের ধারেই গভর্নমেন্ট হাসপাতাল। ওরা যখন ফুটপাথে পা দিলে, তখন হাসপাতালের বাঁ অংশে মহা-হইচই চলছে। সেপটিক-ওয়ার্ড জাপানি বোমায় চূর্ণ হয়ে গিয়েছে–সম্ভবত একটা রোগীও বাঁচেনি সে ওয়ার্ডের।
মিনি দেখতে যাচ্ছিল–বিমল বারণ করলে।
ওদিকে গিয়ে দেখে আর কী হবে মিনি? চলো আগে কোথাও একটু গরম চা খাওয়া যাক। বোমা-ফেলা ও হত্যা ব্যাপারটা দেখে দেখে ক-দিনে ওদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। শুধু ওদের নয়, সাংহাই-এর লোকজন, দোকানি, পথিকদেরও। নতুবা গত আধঘণ্টা ধরে হাসপাতালের ওপর বোমাবর্ষণ চলছে, চোখের সামনে এই ভীষণ প্রলয়লীলা ও মাথার ওপরে চক্রাকারে উড়নশীল তিনখানা জাপানি বম্বারকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চ্যাং সো লিন অ্যাভিনিউর চায়ের দোকান, মাংসের দোকান, ভাত-তরকারির দোকান সব খোলা। লোকজনের দিব্যি ভিড়।
রাত পৌনে আটটা।
হঠাৎ এ্যালিস জিজ্ঞেস করলে– ছেলেটি মারা গেল, তখন ক-টা?
বিমল বললে–ঠিক সাড়ে সাতটা। ওকথা ভেবো না এ্যালিস। চলো আর একটু এগিয়ে। এক্ষুনি লাশ নিয়ে যাওয়ার ভ্যান আসবে হাসপাতালে। আমরা একটু তফাতে যাই।
একটা শামিয়ানার নীচে ওরা চা খেতে বসল।
দোকানের মালিক একজন রোগা চেহারার চীনা স্ত্রীলোক। সে এসে পিজিন ইংলিশে বললে –কী দেব?
বিমল বললে–খাবার কী আছে?
ভাজা মাছ, রুটি, মাখন আর ব্যাঙের—
থাক থাক, রুটি মাখন ভাজা মাছ নিয়ে এসো–
রুটি-মাখন অন্যত্র চীনা দোকানে পাওয়া যায় না; তবে চ্যাং সো লিন অ্যাভিনিউর দোকানগুলি কিছু শৌখীন ও বিদেশি-ঘেঁষা। ধূমায়িত চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বিমল একটি আরামের নিঃশ্বাস ফেললে। সুরেশ্বর তো গোগ্রাসে রুটি ও মাখনের সদব্যবহার করতে লাগল, খানিকক্ষণ কারো মুখে কথা নেই।
মিনি বললে–একটা গল্প বলি শোনো সবাই। আমি তখন স্কুলে পড়ি, মেল্টোনে, ক্যালিফোর্নিয়ায়। আমার বাবা আমায় একটি চিনচিলা কিনে দিয়েছিলেন–
সুরেশ্বর বললে– সে কী?
মিনি হেসে বললে–জান না? একরকম ছোটো কাঠবিড়ালির চেয়ে একটু বড়ো জানোয়ার। খুব চমৎকার নোম গায়ে–লোমের জন্যে ওদের শিকার করা হয়। তারপর আমার সেই পোষা চিনচিলাটা–
বুম–ম–ম!–বিকট আওয়াজ!
সবাই চমকে উঠল। তিনখানা বাড়ির পরে একটা বাড়ির ওপরে জাপানি বম্বার ঘুরছে দেখা গেল–কিন্তু ধোঁয়া উড়ছে বাড়িটার সামনের রাস্তা থেকে। লোকজন দেখতে দেখতে যে যেখানে পারলে আড়ালে ঢুকে পড়ল। একটু পরে একখানা রিকশা টেনে দু-জন লোককে সেদিক থেকে ওদের দোকানের সামনে দিয়ে যেতে দেখা গেল–রিকশায় আধশোয়া আধবসা অবস্থায় একটা রক্তাক্ত মৃতদেহ। তার মুখটা থেঁতলে রক্ত গড়িয়ে বুকের সামনে জামাটা রাঙিয়ে দিয়েছে।
শামিয়ানার নীচে আরও তিনটি চীনা খদ্দের বসে চা খাচ্ছিল। তারা উত্তেজিত ভাবে চীনা ভাষায় দোকানিকে কী বললে। দোকানিও তার কী জবাব দিলে, তারপরে ওদের মধ্যে একজন একটি সিগারেট ধরালে।
জাপানি বোমারু প্লেন ঘড় ঘড় শব্দ করে যেন ওদের মাথার ওপরে ঘুরছে। বিমল একবার চেয়ে দেখলে। না : একটু দূরে বাঁ-দিকে। ঠিক মাথার ওপরে নয়।
মিনি বললে–তারপর শোনো, আমার সেই চিনচিলাটা–
এ্যালিস অধীরভাবে বললে–আঃ মিনি, থাক চিনচিলার গল্প। খাও এখন ভালো করে। আমার তো বেজায় ঘুম পাচ্ছে! বিমল, দোকানিকে জিগ্যেস করো না, স্যাণ্ডউইচ রাখে না?
বিমল বললে–ব্যাঙের মাংসের স্যাণ্ডউইচ বলছে এ্যালিস–দিতে বলব?
সুরেশ্বর ও মিনি একসঙ্গে হো-হো করে হেসে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই ওদের খাবার জায়গাটা তীব্র সার্চলাইটের আলোয় আলো হতেই ওরা আকাশের দিকে চেয়ে দেখলে। ভীষণ ধ্বংসের যন্ত্র সেই চক্রাকারে ভ্রাম্যমাণ জাপানি বম্বরখানা থেকে রাস্তায় যে অংশে ওরা বসে চা খাচ্ছে, সে দিকে সার্চলাইট ফেলেছে।
দোকানি চীনা স্ত্রীলোকটি চিৎকার করে উঠে কী বললে।
সঙ্গেসঙ্গে হুড় হুড় দুড় দুড় শব্দ–তিনজন চীনা খদ্দের ও রাস্তার পথিকদের মধ্যে জন দুই ছুটে এসে বিমলদের চায়ের টেবিলের তলায় ঢুকে মাথা গুঁজে বসে পড়ল।
মিনি বললে–আঃ এগুলি কী বোকা? টেবিলের তলায় বাঁচবে এরা, আমার পেয়ালাটা উলটে ফেলে দিলে মাঝ থেকে—
এ্যালিস বললে–আমারও। দোকানি, তোমার চায়ের দাম নিয়ে নাও, আমরা অন্য জায়গায় চা খেতে যাই–এ কীরকম উপদ্রব?
বিমল বললে–ঠিক তো। মহিলাদের চায়ের টেবিলের তলায় ঢুকে উৎপাত! বোমা খাবি রাস্তায় দাঁড়িয়ে খা ভদ্রলোকের মতো–
মিনি হঠাৎ আঙুল দিয়ে আকাশের দিকে দেখিয়ে বললে–ওই দেখো, দেখো—
তিনখানা চীনা এরোপ্লেন তিন দিকে জাপানি বম্বরখানাকে তাড়া করছে। একখানা চীনা প্লেন বম্বারখানার খুব কাছে এসে পড়েছে–একটু পরেই সেখান থেকে মেশিনগানের পট পট আওয়াজ শোনা গেল–পেছনের আর একখানা চীনা সাহায্যকারী প্লেন ওদের ওপরে নীলাভ তীব্র সার্চলাইট ফেলতেই জাপানি বম্বরখানা বেশ স্পষ্ট দেখা গেল।
ততক্ষণ সবাই আড়াল থেকে মুখ বাড়িয়ে উঁকি মেরে আকাশের দিকে চেয়ে ব্যাপারটা দেখছে। আরও দু-জন চীনা খদ্দের অন্য টেবিলে চা খেতে বসে গেল। দোকানি স্ত্রীলোকটি তাদের খাবার দিলে। মিনি তাদের টেবিলের দিকে চেয়ে বললে–ওই ওরা ব্যাঙের স্যাণ্ডউইচ খাচ্ছে–
মেশিনগানের আওয়াজ তখন বড়ো বেড়েছে। জাপানি প্লেনখানা পাক দিয়ে ঘুরছে। হঠাৎ পালাবে না।
বিমল বললে–না; একটু নিরিবিলি চা খেতে এলাম আর অমনি মাথার ওপরে চীন জাপানের যুদ্ধ বেধে গেল–পোড়া বরাত এমনি–
একজন ফিরিওয়ালা এসে শামিয়ানার বাইরে দাঁড়িয়ে বললে– মোমের ফুল–খুব চমৎকার মোমের ফুল গোলাপ, ক্রিসেনথিমাম, গাঁদা–ভারি সস্তা মোমের ফুল–
এমন সময়ে একজন খবরের কাগজওয়ালা সাংহাই ডেলি নিউজ বলে হেঁকে যাচ্ছে দেখে বিমল ডেকে একখানা কাগজ কিনলে। এ কাগজের একদিকে চীনা ভাষায় অন্য দিকে ইংরেজি ভাষায় লেখা খবর–চীনাদের পরিচালিত।
রাস্তায় লোক ভিড় করে কাগজ কিনছে, কাগজ এইমাত্র বেরিয়েছে, এ বেলায় যুদ্ধের খবর নিয়ে সবাই–যুদ্ধের খবর জানতে চায়।
এ্যালিস বললে–যুদ্ধের খবর কী?
তারপর সবাই মিলে ঝুঁকে পড়ে কাগজখানা পড়ে দেখতে লাগল। শেনসু প্রাচীরের কাছে জাপানি সৈন্য চীনাদের কাছে ধাক্কা খেয়ে হটে গিয়েছে। জাপানিদের বহু সৈন্য মারা পড়েছে।
সুরেশ্বর বললে–সর্বৈব মিথ্যা। জাপানিরা জিতছে। ভুল খবর দিচ্ছে আমাদের, পাছে শহরে আতঙ্ক উপস্থিত হয়। দেখছ না বোমা ফেলবার কান্ড? চীনারা জিতছে! ফু:–
ওদের অত্যন্ত আশ্চর্য মনে হল, মাত্র তিন মাইল দূরে শেনসু প্রাচীরের কাছে যুদ্ধ চলছে, অথচ ওদের খবরের কাগজ পড়ে জানতে হচ্ছে যুদ্ধের ফলাফল, যেমন কলকাতায় বসে বা আমেরিকায় বসে লোকে জেনে থাকে। তিন মাইল দূরে থেকেও বোঝবার কোনো উপায় নেই যুদ্ধের আসল খবরটা কী। চীনা সামরিক কর্তৃপক্ষ যে সংবাদ পাঠাচ্ছে সেই সংবাদই ছাপা হচ্ছে। এইরকমই হয় সর্বত্রই, অথচ খবরের কাগজের পাঠকেরা তা জেনেও জানে না। খবরের কাগজে লিখিত সংবাদ বাইবেল বা পুরাণের মতো অভ্রান্ত সত্য হিসেবে মেনে নেয়, এইটেই আশ্চর্য। এ সম্বন্ধে ওদের অভিজ্ঞতা আরও পরে যা হয়েছিল তা আরও অদ্ভুত।
কাগজের এক কোণে একটি সংবাদের দিকে মিনি ওদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করলে। মার্শাল চিয়াং কেই শেক চা-পেই পল্লির বোমাবিধ্বস্ত অঞ্চল পরিদর্শনে আসবেন রাত নটার সময়ে।
মিনি হাতঘড়ি দেখে বললে–এখন পৌনে ন-টা।
বিমল বললে–তাহলে হাসপাতালেও যাবেন, চলো আমরা হাসপাতালে ফিরি। মার্শাল চিয়াংকে কখনো দেখিনি, দেখা যাবে এখন।
এমন সময়ে ওদের সামনের রাস্তায় একটি হইচই উঠল। রাস্তার দু-ধারে লোকজন সারবন্দি হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। চীনা পুলিশম্যান রাস্তার মাঝখানে লোক হটিয়ে দিলে। এক মিনিটের মধ্যে পর পর ছ-খানা মোটরকার দ্রুত বেগে বেরিয়ে গেল। রাস্তার জনতা চীনা ভাষায় চিৎকার করে বলে উঠল–মহাচীনের জয়! মার্শাল চিয়াং-এর জয়! টেনথ রুট আর্মির জয়!
এ্যালিস বললে–এই মার্শাল চিয়াং গেলেন!
বিমল বললে–তবে আর হাসপাতালে এখন ফিরে কী হবে? চলো কনসেশনে ফিরি। রাত হয়েছে, এ অঞ্চল এখন রাত্রে বেড়াবার পক্ষে নিরাপদ নয়। জাপানি বোমা তো আছেই,
তা ছাড়া তার চেয়েও খারাপ চীনা দস্যুদের উপদ্রব। সঙ্গে মেয়েরা
সুরেশ্বর বললে–তা ছাড়া ঘুমোতেও তো হবে। কাল সকাল থেকে আবার ডিউটি—
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়।
কনসেশনে ফিরবার পথে ওদের বিপদ ঘটল।
কনসেশনে ফিরবার পথে ওরা চ্যাং সো লিন অ্যাভিনিউ দিয়ে খানিকটা এসে পড়ল একটা জনবহুল পাড়াতে। সেখানে দু-খানা রিকশাভাড়া করে ওরা তাদের কনসেশনে যেতে বললে। তারপর ওরা গল্প ও গুজবে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে–যখন ওরা আবার রাস্তার দিকে নজর করলে তখন দেখলে রিকশা একটা নির্জন জায়গা দিয়ে যাচ্ছে। দু-ধারে দরিদ্র লোকেদের কাঁচা মাটির খাপরা-ছাওয়া ঘর। রাস্তা জনশূন্য–দূরে দূরে খোলা মাঠের মধ্যে কী যেন মাঝে মাঝে জ্বলে উঠছে।
বিমল বললে–এ কোথায় নিয়ে এসে ফেল্লে হে?
সুরেশ্বর পিজিন ইংলিশে একজন রিকশাওয়ালাকে বললে–কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস রে? এ পথ তো নয়?
রিকশাওয়ালা কোনো উত্তর না দিয়েই জোরে ছুটতে লাগল।
বিমলের মনে সন্দেহ হল। সে বললে–এর মনে কোনো বদমাইশি মতলব আছে মনে হচ্ছে। আমরা তো একেবারে নিরস্ত্র। সঙ্গে মেয়েরা রয়েছে–
মিনি ও এ্যালিস তখন একটু ভয় পেয়ে গিয়েছে। ওরাও বললে–আর গিয়ে দরকার নেই –চীনা গুন্ডা এই সময় দেশ ছেয়ে ফেলেছে। নামো এখানে সব।
দু-খানা রিকশাই পাশাপাশি যাচ্ছিল। এবার মিনিদের রিকশাখানা এগিয়ে গেল এবং বিমল কিছু বলবার পূর্বেই রিকশাখানা হঠাৎ পথের মোড় ঘুরে পাশের একটা সংকীর্ণ গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল।
বিমলদের রিকশাখানা কিন্তু তখন সোজা রাস্তা বেয়েই দ্রুত চলেছে। বিমলের ও সুরেশ্বরের চিৎকারে সে আদৌ কর্ণপাত করলে না।
বিমল লাফ দিয়ে রিকশাওয়ালার ঘাড়ে পড়ল রিকশা থেকে। রিকশাখানা উলটে গেল সঙ্গেসঙ্গে। সুরেশ্বর রিকশার সঙ্গে চিৎপাত হয়ে পড়ে গেল। রিকশাওয়ালাটা সেখানে বসে পড়ল–ওর ওপর বিমল!
রিকশাওয়ালটা একটু পরেই গা ঝেড়ে উঠে, চীনা ভাষায় কী একটি দুর্বোধ্য কথা বলে উঠে, ওদের দিকে এগিয়ে এল।
বিমল চেঁচিয়ে বলে উঠল–সুরেশ্বর, সাবধান!
রিকশাওয়ালার হাতে একখানা বড়ো চকচকে ছোরা দেখা গেল।
সুরেশ্বর পেছন থেকে তাকে জোরে এক ধাক্কা লাগালে, সে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল আবার বিমলেরই উপর। বিমলের সঙ্গে তার ভীষণ ধস্তাধ্বস্তি শুরু হল। বিমলের রীতিমতো শরীরচর্চা করা ছিল। মিনিট পাঁচ-ছয়ের মধ্যে রিকশাওয়ালাকে মাটিতে ফেলে, বিমল তার হাত মুচড়ে ছোরাখানা টান দিয়ে ফেলে বললে–ওখানা তুলে নাও সুরেশ্বর–তারপর এই বদমাইশটার গলায় বসিয়ে দাও–
ছোরা হাত থেকে খসে যাওয়াতে বদমাইশটা নিরুৎসাহ ও ভীত হয়ে পড়ল–এইবার ছোরা বসানোর কথা শুনে, সে বিমলের কাছ থেকে নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট দিলে। সব ব্যাপারটা ঘটে গেল পাঁচ-ছ-মিনিটের মধ্যে।
বিমল ঝেড়ে উঠে একটু দম নিয়ে বললে–সুরেশ্বর, মেয়েদের গাড়িখানা!
তারপর ওরা দু-জনেই ছুটল সেই গলিটার দিকে–যেটার মধ্যে মিনিদের রিকশাখানা ঢুকেছে। গলিটা নিতান্ত নোংরা, দু-ধারে কাঁচা টালির ছাদওয়ালা নীচু নীচু বাড়ি–কিছুদূরে একটি সাধারণ স্নানাগার–এখানে নীচশ্রেণির মেয়ে-পুরুষে সাধারণত স্নান করে না– করলেও রাত্রে করে। স্নানাগারের সামনে দু-জন চীনেম্যান দাঁড়িয়ে আছে দেখে, বিমল তাদের পিজিন ইংলিশে জিজ্ঞেস করলে–একখানা রিকশা কোন দিকে গেল দেখেছ?
তাদের মধ্যে একজন বললে–এই বাড়িটার সামনে একখানা রিকশা দাঁড়িয়েছিল একটু আগে।
বিমল ও সুরেশ্বর বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ডাকাডাকি করেও কারো সাড়া পাওয়া গেল না। তখন বিমল বললে–চলো বাড়ির মধ্যে ঢুকি–
ঘরটা ঢুকেই ওদের মনে হল, এটা একটা চড়ুর আড্ডা। ঘরের মধ্যে চার-পাঁচটা চীনা বাঁশের চেয়ার, একদিকে একটি নীচু বাঁশের তক্তাপোশ। চন্ডু খাবার লম্বা নল, ছিটেগুলি গালার বড়ো পাত্রে, চন্ডুর আড্ডার সব জিনিসই মজুদ। দেওয়ালে চীনা দেবতার ভীষণ প্রতিকৃতি। ঘরটি লোকশূন্য, নির্জন। এ ধরনের চড়ুর আজ্ঞা ওরা সিঙ্গাপুরে দেখেছে! কিন্তু বাড়ির লোকজন কোথায়? বিমল ও সুরেশ্বর বাড়িটার মধ্যে ঢুকে গেল।
একটা বড়ো ঘরের মধ্যে অনেকগুলি লোক বসে মা জং খেলছে। বিমল বুঝতে পারলে, জায়গাটা শুধু চন্ডু নয়, নীচু শ্রেণির জুয়াড়িদের আড্ডাও বটে। ওদের দেখে দু-জন লোক উঠে দাঁড়াল। ওদের মধ্যে একজন কর্কশ কন্ঠে পিজিন ইংলিশে বললে–কী চাই? কে তোমরা? বিমলের মাথায় চট করে এক বুদ্ধি খেলে গেল। সে কর্তৃত্বের গ্রাম-ভারি চালে বললে, আমরা ব্রিটিশ কনসেশনের পুলিশের লোক। আমাদের সঙ্গে দশজন কনস্টেবল গলির মোড়ে অপেক্ষা করছে। আমাদের সঙ্গে বন্দুক ও রিভলবার আছে! দু-জন মেমসাহেবকে এই আড্ডায় গুম করা হয়েছে–বার করে দাও, নইলে আমরা জোর করে ভেতরে ঢুকে সন্ধান করব। দরকার হলে গুলি চালাব।
এবার একজন প্রৌঢ় লম্বা ধরনের লোক এককোণ থেকে বলে উঠল–আমরা কনসেশনের পুলিশ মানি নে–সাংহাইয়ের পুলিশ মার্শালের সই করা ওয়ারেন্ট দেখাও
বিমল বললে–তুমি জান এটা যুদ্ধের সময়। আমরা জোর করে ঢুকব এবং দরকার হলে এই মা জং-এর জুয়ার আড্ডার প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করে সাংহাই পুলিশের হাতে দেব-এর জন্যে যদি কোনো কৈফিয়ৎ দিতে হয় পুলিশ মার্শালের কাছে আমরা দেব–তুমি মেম সাহেবদের বার করে দেবে কিনা বলো—
লোকটা বললে কোন মেমসাহেবের কথা বলছ? মেমসাহেবের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ কী? আমি ভাবছিলুম, তুমি জুয়া আর চড়ুর আড্ডা হিসেবে বাড়ি সার্চ করবে বলছ।
বিমল বললে–বেশি কথায় সময় নষ্ট করতে চাইনে–তাহলে আমাদের জোর করতে হল–সুরেশ্বর কনস্টেবলদের ডাকো–
হঠাৎ চিৎকার করে সে বলে উঠল–মাথা নীচু করে বসে পড়ো–বসে পড়ো সুরেশ।
সাঁ করে একটা শব্দ হল এবং ঝকঝকে কী একটা জিনিস ওদের চোখের সামনে এক ঝলক খেলে গেল–ওরা তখন দু-জনেই বসে পড়েছে। সঙ্গেসঙ্গে ওদের পেছনের দেওয়ালে একটা ভারি জিনিস ঠক করে লাগবার শব্দ হল।
সুরেশ্বর পেছন ফিরে চকিতে চেয়ে দেখলে–একখানা বাঁকা ধারালো চকচকে চীনে ছোরা, ছুঁড়ে-মারা ছোরা, ছুঁড়ে মারবার জন্যেই এগুলি ব্যবহৃত হয়– ছোরাখানা সবেগে দেওয়ালে প্রতিহত হয়ে, আধখানা ফলাসুদ্ধ দেওয়ালের গায়ে গেঁথে গিয়েছে।
সুরেশ্বর শিউরে উঠল–ওরই গলা লক্ষ করে ছোরাখানা ছোড়া হয়েছিল।
ওদের সঙ্গে সত্যিই হাতাহাতি বাধলে বা সবাই একযোগে আক্রমণ করলে নিরস্ত্র বিমল ও সুরেশের কী দশা হত বলা যায় না, কিন্তু বিমল মাটি থেকে উঠেই দেখলে ঘরের মধ্যে আর একজন লোকও নেই।
পালায়নি–হয়তো-বা ওরা লোক ডাকতে গিয়েছে! সুরেশ্বর নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে, খানিকটা দিশাহার হয়ে পড়েছিল। বিমল গিয়ে তার হাত ধরে টেনে তুলে বললে–সুরেশ্বর, এই বেলা উঠে বাড়িটা খুঁজি এসো–এখুনি সব চলে আসতে পারে। একটা ঘর বন্ধ ছিল–বাইরে থেকে তালা দেওয়া। আর সব ঘর খোলা–সেগুলি জনশূন্য। সুরেশ্বর ও বিমল দু-জনেই একযোগে ঘরের দরজায় লাথি মারতে লাগল।
–মিনি–মিনি–এ্যালিস–এ্যালিস—
ঘর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
বিমল বললে–কী ব্যাপার! ঘরের মধ্যে কেউ নেই নাকি?
দু-জনের সম্মিলিত লাথির ধাক্কাতেও দরজার কিছুই হল না। বেজায় মজবুত সেগুন কাঠের দরজা। হঠাৎ বিমলের চোখ পড়ল ঘরের দেওয়ালের ওপরের দিকে। সেখানে একটা ছোটো ঘুলঘুলি রয়েছে। কিন্তু অত উঁচুতে ওঠা এক মহাসমস্যা। বিমল খুঁজতে খুঁজতে একটা জলের টব আবিষ্কার করলে। সেটা উপুড় করে পেতে, মা জং খেলার ঘর থেকে বাঁশের চেয়ার এনে, তার ওপর চাপিয়ে উঁচু করে, বিমল তার ওপর অতি কষ্টে উঠল। সার্কাসের খেলোয়াড় না হলে ওভাবে ওঠা এবং নিজেকে ঠিকমতো দাঁড় করিয়ে রাখা অতীব কঠিন।
সুরেশ্বর টবটা ধরে রইল–বিমল সন্তর্পণে উঠে ঘুলঘুলির কাছে মুখ নিয়ে গেল। নীচে থেকে সুরেশ্বর ব্যথভাবে জিজ্ঞেস করলে–কী দেখছ? কেউ আছে?
–ঘোর অন্ধকার–কিছু তো চোখে পড়ছে না।
–ওদের পরনে নার্সের সাদা পোশাক আছে, অন্ধকারেও তো খানিকটা ধরা যাবে– ভালো করে দেখো
বিমল ভালো করে চেয়ে দেখবার চেষ্টা করে বলে–উঁহু, কিছুই তো তেমন দেখছিনে– সাদা তো কিছুই নেই–সব কালোয় কালো। আমার মনে হচ্ছে ঘরটায় কিছুই নেই–
উপায়?
দাঁড়াও আগে নামি। উপায় ভাবতে হবে, তার আগে দরজা ভেঙে ফেলতে হবে যে করেই হোক।
নীচে নেমে বিমল গম্ভীর মুখে বললে–সুরেশ্বর, মিনি বা এ্যালিসকে এ ভাবে হারিয়ে আমরা কনসেশনে ফিরে যেতে পারব না। দরকার হলে এজন্য প্রাণ পর্যন্ত পণ–খুঁজে তাদের বার করতেই হবে। তবে তারা যে এই বাড়িতেই বা এই ঘরেই আছে তারও তো কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি। তবুও এই ঘরের দরজা ভেঙে, ভেতরটা না দেখে আমরা এখান থেকে অন্য জায়গায় যাব না। তুমি এক কাজ করো। আমি এখানে থাকি–তুমি বাইরে যাও, চীনা পুলিশকে খবর দাও। তাদের বলো কনসেশনে টেলিফোন করতে। দরকার হলে কনসেশনের পুলিশ আসুক। আজ রাতের মধ্যেই তাদের খুঁজে বার করতেই হবে– নইলে তাদের ঘোর বিপদের সম্ভাবনা। তুমি দেরি কোরো না, চট করে বাইরে চলে যাও।
সুরেশ্বর বললে- তোমাকে একা ফেলে যাব? ওরা যদি দল পাকিয়ে আসে? তুমি নিরস্ত্র।
সেজন্যে ভেব না। মিনি ও এ্যালিস তার চেয়েও অসহায়। সকলের আগে ওদের কথা ভাবতে হবে আমাদের।
সুরেশ্বর চলে গেল।
বিমল একা বাড়িটাতে। উত্তেজনার প্রথম মুহূর্ত কেটে গেলে বিমল এইবার ব্যাপারের গুরুত্বটা বুঝতে পারছে ধীরে ধীরে। মিনি আর এ্যালিস নেই! গুন্ডারা তাদের ধরে নিয়ে গিয়েছে। ওর মনে হল, কনসেশনের ডাক্তার বেডফোর্ড বলেছিলেন–চীনা-সাংহাইতে মধ্য এশিয়ার বর্বরতার সঙ্গে বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতা মিলছে। এখানে কনসেশনের বাইরে মানুষের ধনপ্রাণ নিরাপদ নয়। বিশেষ করে এই যুদ্ধ দুর্দিনের সময়ে, দেশে আইন নেই, পুলিশ নেই–প্রত্যেক সবল মানুষ নিজেই পুলিশ। সাবধানে চলাফেরা না করলে পদে পদে বিপদের সম্ভাবনা।
কী ভুলই করেছে অতরাত্রে অজানা রাস্তায় অজানা চীনে রিকশাওয়ালার গাড়িতে চড়ে, সঙ্গে যখন মেয়েরা রয়েছে। তার চেয়েও ভুল, সঙ্গে রিভলবার নিয়ে না বেরোনো।
এখান উপায় কী? যদি ওদের সন্ধান না-ই মেলে! কনসেশনে, সে আর সুরেশ্বর মুখ দেখাবে কেমন করে?
স্তব্ধ নির্জন বাড়িটা। সাড়াশব্দ নেই কোনো দিকে। মা জং খেলার ঘরে একটি চীনে লণ্ঠন ঝুলছে। আধো আলো অন্ধকারে বিকট মূর্তি চীনা দেবতার ছবিটা যেন এক হিংস্র দৈত্যের প্রতিকৃতির মতো দেখাচ্ছে সেই একমাত্র আলো সারাবাড়িটাতে। বাকিটা অন্ধকার। আশ্চর্য, কোথায় কলকাতার শাঁখারিটোলা লেন, আর কোথায় সাংহাই-এর এক নীচ শ্রেণির জুয়াড়ির আড্ডা! অবস্থার ফেরে কোথা থেকে মানুষকে কোথায় নিয়ে এসে ফেলে!
এ্যালিস চমৎকার মেয়ে, মিনিও চমৎকার মেয়ে; ওদের বিন্দুমাত্র অনিষ্ট হলে সে নিজেকে ক্ষমা করবে না। ওদের জন্যে বিমলই দায়ি। হাসপাতাল থেকে বার হয়ে কনসেশনে ফেরা উচিত ছিল।
প্রায় কুড়ি মিনিট হয়ে গিয়েছে। সুরেশ্বরের দেখা নেই। সে কী কনসেশনে ফিরে গিয়েছে নিজেই খবর দিতে?
বিমল আকাশ-পাতাল ভাবছে, এমন সময় এক ব্যাপার ঘটল। রাস্তার আলো হঠাৎ যেন নিবে গিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। এ আবার কী কান্ড!
মিনিট পাঁচ-ছয় কী দশ পরে বাইরে থেকে কে একজন উত্তেজিত গলায় চীনা ভাষায় কী বললে– কোনো সাড়া না পেয়ে আবার বললে। ঠিক যেন কাউকে ডাকছে।
বিমল অবাক হয়ে ভাবছে গুন্ডারা ফিরে এল নাকি!
হঠাৎ দু-জন চীনা ইউনিফর্ম পরা পুলিশম্যান বাড়ির মধ্যে খানিকটা ঢুকে রাগের ও গালাগালির সুরে চেঁচিয়ে কী কথা বলে উঠল।
বিমল ভাবলে সুরেশ্বরের আনীত পুলিশম্যান বাড়ি খুঁজতে এসেছে। ও এগিয়ে যেতে পুলিশম্যান দু-জন একটু আশ্চর্য হল। তারপর পিজিন ইংলিশে উত্তেজিত কণ্ঠে মা জং খেলার ঘরের আলোর দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে–আলো এখুনি নিবোও। আমাদের বাঁশি শুনতে পাওনি? আলো জ্বেলে রেখেছ কেন?
বিমল হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে বললে–আলো, জ্বেলে রেখেছি কেন?
হ্যাঁ, আলো জ্বালিয়ে রেখেছ কেন? আলো, আলো, লণ্ঠন–যা থেকে আলো বার হয়, অন্ধকার দূর করে সেই আলো–
আমি তো জ্বেলে রাখিনি। এ আমার বাড়ি নয়।
চীনা পুলিশম্যান দু-জন মুখ চাওয়াচাওয়ি করলে। এ বাড়ির যে এ লোক নয়, তারা সেকথা আগেই বুঝেছিল।
বিমল এতক্ষণে যেন সংবিৎ ফিরে পেল। বললে–দাঁড়াও, তোমরা যেও না! প্রথমে বলো আলো নিবিয়ে দেব কেন?
মিস্টার, সাংহাই পুলিশ-মার্শালের নোটিশ দেখনি? রাত এগারোটার পরে শহরের সব আলো নিবিয়ে দিতে হবে। ব্ল্যাক আউট। বোমা ফেলছে জাপানিরা। তোমার কি বাড়ি?
আমার এ বাড়ি নয়। সব বলছি, আমি কনসেশনের লোক–যুদ্ধের ডাক্তার, ভারতবর্ষ থেকে তোমাদের সাহায্য করতে এসেছি। আমরা চারজনে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এইপথে রিকশা করে যাচ্ছিলুম–সঙ্গে ছিলেন দু-টি মার্কিন মহিলা। রিকশাওয়ালা তাঁদের নিরে কোথায় পালিয়েছে। আমাদের রিকশা অন্য পথে নিয়ে গেলে আমরা এই গলির মধ্যে ঢুকে সন্ধান পাই এই বাড়িটার সামনে রিকশাটা মেয়েদের নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমরা বাড়িতে ঢুকে দেখি, এটা মা জং জুয়াড়িদেরও চন্ডুর আড্ডা। ওদের সঙ্গে মারামারি হয়ে যাওয়ার পরে ওরা কোথায় পালিয়েছে। আমার বন্ধু পুলিশ ডাকতে গিয়েছে। তোমরা এসেছ ভালোই হয়েছে, এই তালা-বন্ধ ঘরটা খোলো–আমার বিশ্বাস এরই মধ্যে মহিলা দু-টিকে আটকে রেখেছে।
পুলিশম্যান দু-জন আবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করলে। তারা যে বেজায় আশ্চর্য হয়ে গিয়েছে, মা জং খেলার ঘরে চীনে লণ্ঠনের ক্ষীণ আলোয়ও ওদের মুখ দেখে বিমলের সেটা বুঝতে দেরি হল না। যেন ওরা কখনো ওদের ক্ষুদ্র পুলিশ জীবনে এমন একটা আজগুবি ব্যাপারের সম্মুখীন হয়নি–ভাবখানা এই রকম।
একজন পুলিশ চৌকিদার এগিয়ে বন্ধ ঘরের তালাবদ্ধ দরজাটার কাছে দাঁড়িয়ে বললে– এই ঘর? কই, কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না তো?
না, সাড়া দেবে কে? ধরো অজ্ঞান করে রেখে দিয়েছে।
পুলিশম্যান দুটির মধ্যে একজন বিজ্ঞ ও বুদ্ধিমানের মতো অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে ঘাড় নেড়ে বললে–না, আমার তা মনে হয় না মিস্টার। তুমি জান না এইসব জুয়াড়ি ও চন্ডুর আড্ডাধারী বদমাইশদের। এ ঘরে ওদের রাখেনি। ওদের গায়ে গহনা ছিল?
একজনের গলায় একটা ঝুটো মুক্তোর মালা ছিল–দু-জনের হাতে দুটো সোনার হাতঘড়ি আর সোনার পাতলা বালা–
এমন সময় বাইরে মোটরের আওয়াজ শোনা গেল, সঙ্গেসঙ্গে হুড়মুড় করে বাড়িতে ঢুকল–আগে-আগে সুরেশ্বর, পেছনে একদল চীনা পুলিশ সঙ্গে একজন কনসেশন পুলিশ।
সুরেশ্বর ঢুকেই বললে–টেলিফোন করে দিয়েছি কনসেশনে–পুলিশ মার্শালকে জানানো হয়েছে। এই একজন কনসেশনের পুলিশম্যানকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে আনলুম। এদিকে মহামুশকিল, শহরে ব্ল্যাক-আউট, আলো জ্বালবার জো নেই–সব ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।
ভাঙো দরজা সবাই মিলে।
সকলের সমবেত চেষ্টায় ও ধাক্কায় হুড়মুড় করে দরজা ভেঙে পড়ল।
বিমল সকলের আগে ঘরে ঢুকলে। পেছনে ছটা পুলিশ টর্চ জ্বেলে ঢুকল। তিনটি বড়ো বড়ো জালা ছাড়া ঘরে কিছু নেই। মানুষের চিহ্ন তো নেই-ই।
একজন পুলিশ উঁকি মেরে জালার মধ্যে দেখলে। জালাতে মানুষ তো দূরের কথা, একবিন্দু জল পর্যন্ত নেই। খালি জালা।
মাথার ওপর আকাশে আবার অনেকগুলি এরোপ্লেনের ঘড়ঘড় আওয়াজ শোনা গেল। দু জন পুলিশম্যান উঠোনে গিয়ে হেঁকে বললে–আলো নিবিয়ে দাও, নিবিয়ে দাও, জাপানি বম্বার–
সুরেশ্বর বললে–আরে, এরা বেশ তো! সারা সন্ধ্যেবেলা জাপানিরা বোমা ফেললে, তখন ব্ল্যাক-আউট করলে না–আর এখন এদের হুঁশ হল–
বিমল উপরের দিকে মুখ তুলে বললে–হাঁ, জাপানি কাওয়াসাকি বহুবার। মিনি চিনিয়ে দিয়েছিল কনসেশনে–মনে আছে?
সমস্ত সাংহাই শহর অন্ধকার। সেই আধো আলো আধো অন্ধকারের মধ্যে–কারণ নক্ষত্রের আলো সাংহাইয়ের পুলিশ মার্শালের আদেশ মানেনি–জাপানি বোমারু প্লেনগুলির শব্দ মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল, তাও সবসময় নয়। মাঝে মাঝে যেন সেগুলি কোনদিকে চলে যায়, আবার খানিক পরে মাথার ওপরে আসে।
বিমল ভাবছিল, জাপানি বম্বার থেকে আর বোমা ফেলছে না তো!
সুরেশ্বরকে কথাটা বলতে সে বললে–ব্ল্যাক আউটের জন্যে নিশ্চয়। সবাই লুকিয়েছে, রাস্তাঘাটে জনপ্রাণী নেই। কোনোদিকে কোনো শব্দ আছে?
দু-জন চীনা পুলিশ বললে তোমরা বোঝোনি মিস্টার। ওরা বোমা ফেলবে না, এখন সুবিধে খুঁজছে হাই এক্সপ্লোসিভ বোমা ফেলবার। সেই বোমা ফেলে লোকদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার পরে, যেমন সব ভয়ে রাস্তাঘাটে বেরোবে কী পালাতে যাবে, অমনি গ্যাসের বোমা ফেলবে। এখন গ্যাসের বোমা ফেললে তো মানুষ মরবে না, কারণ সব ঘরের মধ্যে জানালা দরজার আড়ালে আশ্রয় নিয়েছে। সেখান থেকে ওদের আগে বার করবে রাস্তায়–পরে সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসের বোমা ছাড়বে, এ-ই করে আসছে দেখছি আজ ক-দিন থেকে–
একটু পরে কনসেশনের পুলিশ এল, চীনা পুলিশের ডেপুটি মার্শাল স্বয়ং এলেন বহু লোকজন নিয়ে। ওদের দিয়ে চড়ুর ও জুয়াড়িদের আড্ডার ছোট্ট উঠোনটা ভরে গেল।
ডেপুটি মার্শাল বললেন–শহরে ব্ল্যাক আউট, ঘুটঘুঁটে অন্ধকার চারিধারে–এক্ষুনি জাপানিরা হাইএক্সপ্লোসিভ বম্ব ফেলবে, তারপরে ফসপেন গ্যাসের বোমায় বিষ ছাড়বে। এ অবস্থায় কী করা যায়? মেয়ে দু-টিকে কোথায় আটকে রেখেছে, কী করে খুঁজি।
কনসেশন পুলিশের কর্মচারীরা বললেন–আপনার এলাকায় যত বদমাইশের আড্ডা আছে, সব হানা দিই চলুন।
কিন্তু তাতে সময় নেবে। এখুনি যেসব ছত্রাকার হয়ে চারিদিকে ছুটে বেরিয়ে পড়বে। দেখছেন না ওপরকার অবস্থা? ওদের প্ল্যান করে নিতে যা দেরি! আচ্ছা, দেখি কতদূর কী হয়। মেয়ে দু-টিকে গুন্ডারা আটকে রেখেছে, মুক্তিপণ আদায় করবার উদ্দেশ্যে। সুতরাং, তাদের প্রাণের ভয় বর্তমানে নেই একথা ঠিকই। সাংহাইতে এ-রকম অনবরত হচ্ছে। এই ভদ্রলোক দু-টি এত রাতে মেয়েদের নিয়ে চা-পেই পল্লিতে বেরিয়ে বড়ো বিবেচনার অভাব দেখিয়েছেন। যত গুন্ডা আর বদমাইশের আড্ডা এই পাড়ায়।
পুলিশের লিস্ট দেখে কাছাকাছি দু-টি বদমাইশের আড্ডায় হানা দেওয়া হল–কিন্তু কোথাও কিছু সন্ধান মিলল না।
তারপর–রাত তখন দেড়টা–এমন এক ভীষণ ব্যাপারের সূত্রপাত হয়ে গেল যে, এর আগে যেসব বোমা ফেলার কান্ড সুরেশ্বর ও বিমল দেখেছে–এর কাছে সেগুলো সব একেবারে ম্লান হয়ে নিষ্প্রভ হয়ে মুছে গেল।
বিমল আর সুরেশ্বরের মনে হল, আকাশ থেকে চারিধারে একসঙ্গে যেন দেবরাজ ইন্দ্রের বজ্ৰ পড়তে শুরু হয়েছে–অসংখ্য। অনেক, অনেক–গুনে শেষ করা যায় না! সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণের আওয়াজ, ইট টালি ছোটার শব্দ, দেওয়াল পড়ার ছাদ পড়ার শব্দ–মানুষের কলরব, হইচই, কান্না, পুলিশের হুইসল, মাথার ওপর ঘর্ঘর শব্দ–সবসুদ্ধ মিলিয়ে একটা সুপ্ত দৈত্যপুরীর দৈত্যরা যেন হঠাৎ জেগে উঠে উন্মাদ হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে!
ডেপুটি মার্শাল অর্ডার দিলেন, সব কনস্টেবল একত্র হয়ে গেল। কনসেশন পুলিশের কর্মচারীরা সাহায্য করতে চাইলে, হতাহতদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে। সেই অন্ধকারের মধ্যে টর্চ জ্বেলে অট্টালিকার ভগ্নস্তূপ অনুসন্ধান করে আহত ও চাপা-পড়া মানুষের সন্ধান চলতে লাগল। কাজ এগোয় না। ভাঙা বাড়ির ইটের রাশি পদে পদে ওদের বাধা দিতে লাগল। একটি চীনা মন্দিরের কাছে চারজন লোক মরে পড়ে আছে। দু-টি ছোটো বাড়ি চুরমার হয়ে সেখানে এমনভাবে রাস্তা আটকেছে যে, মৃতদেহগুলো টেনে বার করবার উপায়ও রাখেনি। ইটের স্কুপের ওপর উঠে আবার ওদিক দিয়ে নেমে যেতে হল–তবে জায়গাটা পার হওয়া সম্ভব হল।
বিমল চেঁচিয়ে বলে উঠল–সামনে প্রকান্ড বোমার গর্ত, সাবধান!
সবাই চেয়ে দেখলে আন্দাজ ত্রিশফুট ব্যাসযুক্ত একটা প্রকান্ড গহ্বর থেকে এখনও ধোঁয়া উঠছে–এবং গর্তের ধারে এখনও ছটকানো ধাতুর খোলা-ভাঙা টুকরো পড়ে আছে, বিমল টুকরোটা হাতে তুলে নিয়েই ফেলে দিলে–গরম আগুন!
কর্ডাইটের উগ্র গন্ধ জায়গাটায়! ওরা সবাই অবাক হয়ে সেই ভীষণ গর্তটার দিকে চেয়ে রইল।
এমন সময়ে দেখা গেল, ছ-খানা জাপানি প্লেন সারবন্দি হয়ে দক্ষিণ দিক থেকে উড়ে আসছে–ওদের মাথার উপর। বোধ হয় ওদের টর্চের আলো দেখেই আসছে। চীনা পুলিশের ডেপুটি মার্শাল ঘেঁকে বললেন–সাবধান! বোমার গর্তে লাফ দাও!
সবাই বুঝলে এ অবস্থায় ত্রিশফুট ব্যাসযুক্ত এবং আন্দাজ প্রায় পনেরো ফুট গভীর বোমার গর্তটাই সব চেয়ে নিরাপদ স্থান, সারা চা-পেই পল্লি অঞ্চলের মধ্যে।
ঝুপঝাঁপ! দু-সেকেণ্ডের মধ্যে ওপরে আর কেউ নেই–সবাই গর্তটার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। বিমল ওদের সঙ্গে লাফ দিয়েছিল–সঙ্গেসঙ্গে ওর হাঁটু পর্যন্ত পাঁকে পুঁতে গেল, গর্তটার মধ্যে কাদা আর জল-কাদার সঙ্গে বোমার ভাঙা টুকরো মেশানো–সবাই কোনো রকমে জল কাদার মধ্যে মাথা গুঁজে রইল ধার ঘেঁষে–কারণ মাঝখানে থাকলে অনেকখানি নক্ষত্ৰ-খচিত অন্ধকার আকাশ দেখা যায়–তখন আর নিজেকে খুব নিরাপদ বলে মনে হয় না।
ওদের মধ্যে একজন আমেরিকান পুলিশম্যান ওদের বোঝাচ্ছিল যে, এ অবস্থায় কোনো এরোপ্লেন থেকে বোমা ফেললে ওদের লাগবার কথা নয়– সে নাকি মাথুকুও রণক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা থেকে জানে–বোমার গর্তই সর্বাপেক্ষা নিরাপদ স্থান।
আর একজন বললে– কেন, যদি মেশিনগান চালায়?
আগের লোকটা বললে-ফু :! মেশিনগান! এই অন্ধকারে!
এমন সময় হঠাৎ দেখা গেল সেই ছ-খানা প্লেন ঠিক ওদের গর্তের ওপর এসে চক্রাকারে উড়ছে এবং ক্রমে নীচু হয়ে নামছে যেন।
কে একজন বললে–আমাদের টের পেলে নাকি!
মুখের কথা সবারই ওষ্ঠাগ্রে যেন জমাট বেঁধে গিয়েছে–বুকের রক্ত পর্যন্ত জমাট বেঁধে গেল সকলের। কেবল আগের পুলিশম্যানটি বলতে লাগল– কোনো ভয় নেই–ওরা মেশিনগান ছুঁড়ে কিছু করতে পারবে না–কাওয়াসাকি বম্বারের মেশিনগানের তরিবৎ সুবিধের নয়– হত যদি জার্মান হেঙ্কেল ফিফটিওয়ান, কী স্কুলজ-ব্যাঙ্ক এক-শো এগারো–
সবাই চাপা গলায় বিষম রাগের সঙ্গে একসঙ্গে বলে উঠল–আঃ–চুপ! সঙ্গেসঙ্গে প্লেনগুলো অনেকখানি নেমে এল এবং অকস্মাৎ এক তীব্র সার্চলাইটের আলোয় ওদের বোমার গর্ত এবং চারপাশের আরও অনেক দূর পর্যন্ত আলোকিত হয়ে উঠল–ওঠবার সঙ্গেসঙ্গে পটকা বাজির মতো মেশিনগান ছোঁড়ার শব্দে ওদের কানে তালা ধরবার উপক্রম হল।
একজন ফিস ফিস করে বললে–যদি বাঁচতে চাও তো সবাই মড়ার মতো পড়ে থাকো –ভান করো যেন সবাই মরে গিয়েছ–
আগের সেই মার্কিন পুলিশম্যানটি যুক্তিতর্কে অদম্য। সে বলে উঠল–কিছু হবে না দেখো হ্যাঁ হত যদি হেঙ্কেল ফিফটিওয়ান কিংবা—
আবার!
সেই কাদাজলের মধ্যে হাত-পা গুটিয়ে উপুড় হয়ে নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে থেকে বিমল অতীত বা ভবিষ্যতের কোনো কথা ভাবছিল না। তার চিন্তা শুধু বর্তমানকে আশ্রয় করে। সংসার নেই, অতীত নেই, ভবিষ্যৎ–শুধু সে আছে, আর আছে–এই দুর্ধর্ষ, বিভীষণ, নিষ্ঠুর বর্তমান। যেকোনো মুহূর্তে মেশিনগানের গুলি ওর জীবলীলা, ওর সমস্ত চৈতন্যের অবসান করে দিতে পারে, সারাদুনিয়া ওর কাছ থেকে মুছে যেতে পারে এক মুহূর্তে যেকোনো মুহূর্তে। কাদার মধ্যে মুখ গুঁজে, চোখ বুজে ও পড়ে রইল–ওর পাশে সবাই সেইভাবেই আছে–বীরত্ব দেখাবার অবকাশ নেই, বাহুবল বা সাহস দেখাবার অবসর নেই– খোঁয়াড়ের শুয়োরের দলের মতো ভয়ে কাদার মধ্যে ঘাড় গুঁজে থাকা–এর নাম বর্তমান যুগের যুদ্ধ! ওরা আজ দেশপ্রেমিক বীর সৈনিক দল হলেও এর বেশি কিছু করতে পারত না–এই একই উপায় অবলম্বন করতেই হত–অন্য গত্যন্তর ছিল না। অন্য কিছু করা আত্মহত্যার নামান্তর মাত্র। কানের এত কাছে এরোপ্লেনের শব্দ বিমল কখনো পায়নি। এরোপ্লেনের বিরাট আওয়াজ কানে একেবারে তালা ধরাল যে! ওর ভয়ানক আগ্রহ হচ্ছে। একবার মুখ তুলে ওপরের দিকে চোখ চেয়ে দেখে, এরোপ্লেনগুলি গর্তটার কত ওপরে এসেছে।
আওয়াজ–আওয়াজ–এরোপ্লেনের আওয়াজ, মেশিনগানের আওয়াজ। কিন্তু আওয়াজ যত হল, কাজ তত হল না। মেশিনগানের একটি গুলিও বোমার গর্তের মধ্যে পড়ল না। দু তিনবার প্লেনগুলি গর্তের দিকে নেমে এল পুরো দমে, কিন্তু কিছু করতে পারলে না। আওয়াজ, কেবলই আওয়াজ। ক্রমে প্লেনগুলি সরে গেল গর্তের ওপর থেকে, হয়তো দেখে ভাবলে গর্তের লোকগুলি সব মরে গিয়েছে। মড়ার ওপর মেশিনগানের দামি গুলি চালিয়ে বৃথা অপব্যয় করা কেন?
ওরা সবাই গর্ত থেকে উঠে এল। পরস্পরের দিকে চেয়ে দেখলে, কী অদ্ভুত কাদামাখা চেহারা হয়েছে সকলকার! পুলিশের স্মার্ট ইউনিফর্ম একেবারে কাদায় আর ঘোলা জলে নষ্ট হয়ে ভিজে-কাঁথা হয়ে গিয়েছে। মার্কিন পুলিশম্যানটি গর্ত থেকে ঠেলে উঠেই বললে– বলিনি তোমাদের, এরা মেশিনগান ছুঁড়ে সুবিধা করতে পারে না ও এরোপ্লেন থেকে? স্কুলজ ব্যাঙ্কস এক-শো এগারো যদি হত, তবে দেখতে একটি প্রাণীও আজ বাঁচতাম না।
মিনিট পনেরো কেটে গেল। বোমারু প্লেনগুলি আকাশের অন্য দিকে চলে গিয়েছে। কী ভীষণ আওয়াজ! বিমলের মনে পড়ল, এ্যালিস তার নরম সাদা হাত দু-টি তুলে কান ঢেকে বসত– হোয়াট-এ্যান-অ-ফুল রকেট! এ্যালিসের সেই ভঙ্গিটা, তার মুখের কথা মনে পড়তেই বিমলের বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল।
এ্যালিস–মিনি–বেচারি এ্যালিস!–কী ভীষণ কালরাত্রি আজ ওদের পক্ষে। সাংহাইয়ের এই দুর্যোগের রাত্রির কথা বিমল কি কখনো ভুলবে জীবনে? কোথায় সে সিঙ্গাপুরে ডাক্তারি করবে বলে বাড়ি থেকে রওনা হল–অদৃষ্ট তাকে কোথায় কী অবস্থায় নিয়ে এসে ফেলেছে।
হঠাৎ পিনাং-এর মন্দিরে সেই নিষ্ঠুর-মূর্তি চীনা রণদেবতার কুটি-কুটিল মুখ মনে পড়ল ওর। রণদেবতা ওদের তাঁর ফাঁদে ফেলেছেন–
একটা প্লেন দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটা বস্তির ওপরে দুটো বোমা ফেললে–ভীষণ আওয়াজ হল–অন্ধকারের মধ্যে একটা আগুনের শিখার চমক দেখা গেল, কিন্তু লোকজনের চেঁচামেচি শোনা গেল না। মার্কিন পুলিশম্যানটি বললে–পঞ্চাশ পাউণ্ডের বোমা! দেখেছ কী কান্ডটা করলে বস্তিতে! লোক সব নিশ্চয় পালিয়েছে।
সুরেশ্বর বললে–ওই দেখো, আর একদল বহুবার দেখা দিয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে—
অন্তত বারোখানো সারবন্দি হয়ে এগিয়ে আসছে। এরা যে এলেমেলো ভাবে বোমা ফেলছে না, তা বেশ বোঝা গেল–এদের ধ্বংসলীলার মধ্যে প্ল্যান আছে, শৃঙ্খলা আছে, সমস্ত শহরটা এবং তার প্রান্তস্থিত এই দরিদ্র পল্লি চা-পেই ও অন্যান্য ছড়ানো গ্রামগুলিকে ওরা যেন কতকগুলি কাল্পনিক অংশে ভাগ করে নিয়েছে এবং নিয়ম করে প্রত্যেক অংশে বোমা ফেলছে–কোনো অংশ পরিত্রাণ না পায়।
বিমল লক্ষ করলে অন্ধকারের মধ্যে বস্তির লোকজনেরা খানা-নালার মধ্যে অনেকে মুখ খুঁজে পড়ে আছে–একটা লোক একটা গাছের গুঁড়িতে প্রাণপণে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে কারো মুখ দেখা যায় না– মেয়ে কী পুরুষ বোঝা যাচ্ছে না, যেন ভীত, সন্ত্রস্ত প্রেমূর্তি। সন্ধ্যাবেলার সেই বেপরোয়া ভাব আর নেই।
একমুঠো ছড়ানো নক্ষত্রের মতো কতকগুলি বোমা পড়ল দূরের একটা পাড়ায়– সাংহাইয়ের ব্যাবসাবাণিজ্যের কেন্দ্র সে জায়গাটা–পুলিশম্যানগুলো বলাবলি করছে। ওদিকে সেই প্লেনগুলো আবার আসছে, তবে এবার সার্চলাইট জ্বালায়নি, অন্ধকারেই আসছে। কাছেই একটা পল্লিতে ওরা ছ-টা বোমা ফেললে, আন্দাজ এক-একটা পঞ্চাশ পাউণ্ড ওজনের। পুলিশের ডেপুটি মার্শালের আদেশে ওরা সবাই সেদিকে ছুটল। সেখানে এক ভীষণ দৃশ্য! রাস্তায় লোকে লোকারণ্য, ভয়ের চোটে সতর্কতা ভুলে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাড়িঘর চুরমার, আয়না, মাদুর, টেবিল, ছবি সব ছিটকে রাস্তায় এসে ছত্রাকার হয়ে পড়েছে–তারই মধ্যে এক জায়গায় একটা প্রৌঢ়া মহিলার ছিন্নভিন্ন বিকৃত মৃতদেহ। কিছু দূরে একটি সুন্দরী বালিকার দেহ দু-টুকরো হয়ে পড়ে আছে, তলপেটের নাড়ি ভুড়ি খানিকটা বেরিয়ে ধুলোতে লুটিয়ে পড়েছে।
এইসব বীভৎস দৃশ্যের মাঝখানে এক জায়গায় একটা ছোটো মেয়ে ভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে চোখ বুজে ছুটে একটা ছোটো মাঠ পার হয়ে পালাচ্ছিল–পুলিশের লোক ওকে ধরে ফেলল। মেয়েটির বয়স ন-বছর– সে ভয়ে এমনি দিশেহারা হয়ে পড়েছে যে প্রথম কিছুক্ষণ কথা বলতেই পারলে না।
ওর হাতে একটা পুটুলি। পুঁটুলির মধ্যে কিছু শুকনো শুয়োরের মাংসের টুকরো আর গোটাকতক কিশমিশ। তাকে খানিকক্ষণ ধরে জিজ্ঞেস করার পরে জানা গেল তাদের বাড়িতে বোমা পড়বার পরে বাড়ি ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কে, কোথায় গিয়েছে তা সে জানে না। সে কিছু খাবার সংগ্রহ করে পুটুলি বেঁধে নিয়ে পালাচ্ছে–তার বিশ্বাস, চোখ বুজে ছুটে পালালে বোমা ফেলে যারা, তারা ওকে দেখতে পাবে না। তাকে ডেকে নিয়ে প্রৌঢ়া মহিলার মৃতদেহ দেখানো হল।
খুকি চিৎকার করে কেঁদে উঠল, ওই তার মা। পাশের বালিকাটি তার দিদি। ডেপুটি মার্শাল পাড়ার একজন লোক ডেকে মেয়েটির নাম-ধাম, বাপের নাম ঠিকানা জেনে নিলেন, কারণ ছেলেমানুষ পুলিশের প্রশ্নের উত্তর ঠিকমতো দিতে পারবে না। মেয়েটি পুলিশের জিম্মাতেই রইল–কারণ শোনা গেল ওর বাবা বছর-তিন মারা গিয়েছেন, বিধবা মা আর দিদি ছাড়া সংসারে ওর আর কেউ ছিল না।
একদল লোককে দেখা গেল ভাঙা বাড়িগুলো থেকে জিনিসপত্র, মৃতদেহ টেনে বার করছে। ওরা টর্চ জ্বেলে টর্চের মুখ নীচের দিকে নামিয়ে মৃতদেহ কী জ্যান্ত মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে, পাছে ওপর থেকে বোমারু প্লেনগুলি টের পায়।
বিমল তাদের মধ্যে একজনকে চিনতে পারলে। সাগ্রহে সে ছুটে গেল– প্রোফেসর লি, প্রোফেসর লি–
অন্ধকারের মধ্যে বিমলকে উনি চিনলেন। বললেন–আমি আমার ছাত্রের দল নিয়ে বেরিয়েছি, দেখি যদি কিছু করতে পারি। আমার মেয়েরা কোথায়?
এই সৌম্যদর্শন, পরহিতব্রতী বৃদ্ধের স্নেহ-সম্ভাষণে বিমলের মন আদ্র হয়ে উঠল। বললে –সে অনেক কথা। আমার মনে হয় আপনি এবং আপনার দলই এ বিষয়ে আমায় সাহায্য করতে পারবেন।
প্রোফেসর লি হাসিমুখে বললেন–যুদ্ধের সময়কার মনস্তত্ত্ব আলোচনা করতে এসেছিলুম জানেন তো? এর চেয়ে উপযুক্ত ক্ষেত্র আর কোথায় পাব সে আলোচনার?
হঠাৎ একটা প্লেন মাথার ওপর এল। সবাই কথা বন্ধ করে ওপর দিকে চাইলে।
মার্কিন পুলিশম্যানটি চেঁচিয়ে উঠল–কভার! কভার!
কোথায় আর আশ্রয় নেবে, সেই ভাঙা বাড়ির ইটকাঠের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকা ছাড়া সবাই সেই দিকে ছুটল। বিমলও চীনা খুকিটার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল সেই দিকে।
প্লেন থেকে বোমা পড়ল না। পড়ল কতকগুলি চকচকে রুপোর বাতিদানের মতো লম্বা লম্বা জিনিস। প্লেনটা চলে গেলে ওরা সেগুলি দূর থেকে ভয়ে ভয়ে দেখলে। সরু সরু রুপোর নলের মতো জিনিস, হাতখানেক লম্বা। ঝকঝকে সাদা। মার্কিন পুলিশম্যান একটা হাতে তুলে নিয়ে বললে–ইনসেনডিয়ারি বম্ব–আগুন লাগাবার বোমা–অ্যালুমিনিয়ম আর ইলেকট্রনের খোল, ভেতরে অ্যালুমিনিয়ম পাউডার আর আয়রন অক্সাইড ভরতি। এই দেখো ছ-টা করে ফুটো টিউবের গোড়ার দিকে। এই দিয়ে আগুনের ফুলকি বার হয়ে আসবে। এ আগুন নিবানো যায় না।
জাপানিদের মতলব এবার স্পষ্ট বোঝা গেল। হাই এক্সপ্লোসিভ বোমা ফেলবার পর লোকজন ভয়ে দিশেহারা হয়ে যে যেদিকে পালাবে, তখন ওরা শহরে ইনসেনডিয়ারি বম্ব ফেলে আগুন লাগিয়ে দেবে, আগুন নিবোতে কে এগোবে তখন!
কী ভীষণ ধ্বংসের আয়োজন! বিমল সেই ঝকঝকে পালিশ করা সরু টিউবটা হাতে নিয়ে শিউরে উঠল। এই টিউবের মধ্যে সুপ্ত অগ্নিদেব এখুনি জেগে উঠে এই এত বড়ো সাংহাই শহরটা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেবে, তারই আয়োজন চলছে।
মার্কিন পুলিশম্যানটি বললে–পঁয়ষট্টি গ্রাম অ্যালুমিনিয়াম পাউডার আর পঁয়ত্রিশ গ্রাম আয়রন অক্সাইড। আমাদের মার্কিন নৌবহরের উড়োজাহাজে আজকাল এর চেয়েও ভালো বোমা তৈরি হচ্ছে–আয়রন অক্সাইডের বদলে দিচ্ছে—
কাছেই আরও দু-তিনটে রুপোর বাতিদান পড়ল।