Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

স্ত্রীলোকটি যখন বুঝতে পারলে যে এরা ডাকাত নয় বা বিদ্রোহী রেড আর্মির লোকও নয়, তখন সে উঠে ঘরে গিয়ে জল নিয়ে এসে সবাইকে খাওয়ালে।

ধাতুপাত্র বা চীনা মাটির পাত্র নেই বাড়িতে, এত গরিব সাধারণ লোক। লাউয়ের খোেলায় জল রেখেছে।

চীনের বিশ্ববিখ্যাত মাটির বাসন, মিং রাজত্বের অপূর্ব প্রাচীন শিল্প, পুতুল, খেলনা, বুদ্ধ, দানব, এসব এই গরিবদের জন্যে নয়।

রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে খুব ভিড়। একখানা সৈন্যবাহী ট্রেন সিনকিউ থেকে সাংহাই যাচ্ছে –প্রত্যেক স্টেশনে আবার নতুন ভরতি-করা সৈন্যদের ওই ট্রেনেই উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সুরেশ্বর বিমলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ট্রেনের ছাদের দিকে।

সব কামরার ছাদে কাঁচা ডালপালা চাপানো–কোনোটায় শুকনো খড় বিচালি ছাওয়া।

বিমল বললে–এরোপ্লেন পাছে বোমা ফেলে ট্রেনে, তাই ওরকম করেছে বলে মনে হয়।

সাংহাই ৪৫০ মাইল দূরে।

হঠর হঠর করে করে সারাদিন ট্রেন কৃষিক্ষেত্র, অনুচ্চ পাহাড়, গ্রাম আর বস্তি পার হয়ে চলেছে, চলেছে। ট্রেনের গতি মন্দ নয়, পুরোনো আমলের ইঞ্জিন বদলে নতুন ইঞ্জিন কেনা হয়েছে, বেশ জোরেই ট্রেন যাচ্ছে।

ওদের কামরাতে সাধারণ সৈন্যদল নেই অবিশ্যি। মাত্র জন্য আষ্টেক লোক, সবাই অফিসার শ্রেণির, কিন্তু কেউ ইংরেজি জানে না। মহা অসুবিধেয় পড়ে গেল ওরা–কিছু দরকার হলে চাওয়া যায় না, নতুন কিছু দেখলে জিজ্ঞেস করা যায় না যে সেটা কী।

দুপুরের দিকে একটা ছোটো শহরে গাড়ি দাঁড়াল এবং ওদের কামরাতে একজন সাদা সরু একগুচ্ছ লম্বা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ সৌম্যমূর্তি ভদ্রলোক উঠলেন, সঙ্গে তাঁর এগারোটি তরুণ যুবা। এদের সবারই বেশ সুন্দর কমনীয় চেহারা।

বিমল বললে–গুড মর্নিং স্যার।

বৃদ্ধের মুখ দেখে মনে হয় জগতে তাঁর আপন-পর কেউ নেই। তিনি সবাইয়ের ওপর সন্তুষ্ট, জীবনে সবাইকে ভালোবেসেছেন।

তিনি হাসিমুখে ইংরেজিতে বললেন–গুড মর্নিং, আপনারা কোথায় যাবেন।

বিমল বললে–সাংহাই। আপনারা কী অনেকদূর যাবেন?

আমরা যাচ্ছি সাংহাই। আমি এখানকার কলেজের প্রোফেসর। আমার নাম লি। আমি সেখানে যাচ্ছি, যুদ্ধের সময়কার মনস্তত্ত্ব অধ্যয়ন করতে। এদেরও নিয়ে যাচ্ছি, এরা সবাই আমার ছাত্র। সদানন্দ বৃদ্ধ কথা শেষ করে গর্বিত দৃষ্টিতে তাঁর এগারোটি তরুণ ছাত্রের দিকে চাইলেন। বিমল ও সুরেশ্বরের বড়ো অদ্ভুত মনে হল। এই ভয়ানক দিনে ইনি মনস্তত্ত্ব অধ্যয়ন করতে চলেছেন সাংহাইতে, এতগুলি বালকের জীবন বিপন্ন করে।

একটু পরে বৃদ্ধের একটি ছাত্র একটি বেতের বাক্স থেকে কীসব খাবার বার করে সবাইকে খেতে দিলে। বৃদ্ধ সুরেশ্বর ও বিমলকেও তাঁদের সঙ্গে খেতে আহ্বান করলেন।

সুরেশ্বর নিম্নস্বরে বললে–খেয়ে না বিমল। ইঁদুর ভাজা কিংবা আরশোলা চচ্চড়ি বোধ হয়।

কিন্তু সেসব কিছু নয়। শরবতি লেবুর রস দেওয়া কুমড়োর বিচি ভাজা আর শসার আচার।

বিমল বললে, প্রোফেসর লি, আপনি সাংহাইতে কোথায় উঠবেন। আমাদের সঙ্গে থাকুন না, আমরা যেখানে থাকব? হঠাৎ এরোপ্লেনের আওয়াজ কানে গেল–গাড়িসুদ্ধ সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে জানালার কাছে গিয়ে আকাশের দিকে চোখ তুলে দেখবার চেষ্টা করলে কোনদিক থেকে আওয়াজটা আসছে।

ছ-খানা এরোপ্লেন সারবন্দি হয়ে উড়ে পুব থেকে পশ্চিমের দিকে আসছে। ট্রেনখানার বেগ হঠাৎ বড়ো বেড়ে গেল। সকলেই উদবিগ্ন হয়ে পড়েছে, পরস্পরের মুখের দিকে চাইছে। কিন্তু এরোপ্লেনের সারি ট্রেনের ঠিক ওপর দিয়েই উড়ে চলে গেল শান্তভাবেই।

প্রোফেসর লি দিব্যি নির্বিকার ভাবেই বসেছিলেন। তিনি বললেন–আমাদের গভর্নমেন্টের এরোপ্লেন।

একটা স্টেশনে প্ল্যাটফর্ম থেকে নারীকণ্ঠের কান্না শুনে বিমল ও সুরেশ্বর মুখ বাড়িয়ে দেখলে, কতকগুলি সৈন্য একটি দরিদ্রা স্ত্রীলোকের চারিধারে ঘিরে হাসছে–স্ত্রীলোকটির সামনে একটা শূন্য ফলের ঝুড়ি–এদিকে সৈন্যদের প্রত্যেকের হাতে এক-একটা খরমুজ।

বিমল বললে–প্রোফেসর লি, আমরা তো নতুন দেশে এসেছি, কিছু বুঝিনে এদেশের ভাষা। বোধ হয় খরমুজওয়ালির সব ফল এরা কেড়ে নিয়ে দাম দিচ্ছে না। আপনি একবার দেখুন না।

বৃদ্ধ তাঁর এগারোটি ছাত্র নিয়ে প্ল্যাটফর্মে গিয়ে বাধা দিলেন সৈন্যদের। চীনা ভাষায় তুবড়ি ছুটল উভয় পক্ষেই।

বৃদ্ধের ছাত্রগণও তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দরকার হলে মারামারি করবে। মারামারি একটা ঘটত হয়তো, কিন্তু সেই সময় জনৈক চীনা সামরিক অফিসার গোলমাল দেখে সেখানে উপস্থিত হতেই সৈন্যরা খরমুজ রেখে যে যার কামরায় উঠে বসলে। খরমুজওয়ালি গোটাকতক ফল লি ও তাঁর ছাত্রদের খেতে দিলে–বৃদ্ধ তার দাম দিয়ে দিলেন, খরমুজওয়ালির প্রতিবাদ শুনলেন না।

সন্ধ্যার সময় ট্রেন ফু-চু পোঁছোলো।

ফু-চু থেকে অনেকগুলি সৈন্য উঠল। ট্রেন কিন্তু ছাড়তে চায় না–খবর পাওয়া গেল, সামনের রেলপথে কী একটা গোলমালের দরুন ট্রেন ছাড়বার আদেশ নেই।

এ দেশে সময়ের কোনো মূল্য নেই। চার-পাঁচ ঘণ্টা ওদের ট্রেনখানা প্ল্যাটফর্মের ধারে দাঁড়িয়ে রইল। সৈন্যদল নেমে যে-যার খুশিমতো স্টেশনে পায়চারি করছে, তারের বেড়া ডিঙিয়ে ওপাশের বাজারের মধ্যে ঢুকে হল্লা করছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে বেড়াচ্ছে।

একটা ছোটো ছেলে তারের একরকম যন্ত্র বাজিয়ে গাড়িতে গাড়িতে ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছিল। প্রোফেসর লি তাকে ডেকে কী জিজ্ঞেস করলেন, তাকে কিছু খাবার দিলেন। তাঁরই মুখে বিমল ও সুরেশ্বর শুনলে ছেলেটি অনাথ, স্থানীয় আমেরিকান মিশনে প্রতিপালিত হয়েছিল–এখন সেখানে আর থাকে না।

সন্ধ্যার আগে ট্রেন ছাড়ল। সারারাতের মধ্যে যে কত স্টেশন পার হল, কত স্টেশনে বিনা কারণে কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে রইল–তার লেখাজোখা নেই। এইরকম ধরনের রেলভ্রমণ বিমল ও সুরেশ্বর কখনো করেনি।

ভোরের দিকে ট্রেনখানা একজায়গায় হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল।

বিমল ঘুমোচ্ছিল–ঝাঁকুনি খেয়ে ট্রেনখানা দাঁড়াতেই ওর ঘুম ভেঙে গেল। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বিমল দেখলে দু-ধারের মাঠে ঘন কুয়াশা হয়েছে, দশহাত দূরের জিনিস দেখা যায় না–সামনের দিকে লাইনের ওপর আর একখানা ট্রেন যেন দাঁড়িয়ে–কুয়াশায় তার পেছনের গাড়ির লাল আলো ক্ষীণভাবে জ্বলছে।

প্রোফেসর লি-ও ইতিমধ্যে উঠেছেন।

তিনি বললেন–ব্যাপারটা কী?

বিমল বললে–সামনে দু-খানা ট্রেন দাঁড়িয়ে এই তো দেখছি। ঘোর কুয়াশা, বিশেষ কিছু দেখা যায় না।

ট্রেন থেকে লোকজন নেমে দেখতে গেল সামনের দিকে এগিয়ে। খুব একটা গোলমাল যেন শোনা যাচ্ছে সামনে।

সুরেশ্বরও উঠেছিল, বললে–চলো বিমল, এগিয়ে দেখে আসি।

প্রোফেসর লি-ও নামলেন ওদের সঙ্গে। দু-খানা ট্রেনকে ঘন কুয়াশার মধ্যে অতিক্রম করে রেললাইনের সামনে গিয়ে যে দৃশ্য চোখে পড়ল তা যেমন বীভৎস, তেমনি করুণ।

সেখানে আর একখানা ছোটো সৈন্যবাহী ট্রেন দাঁড়িয়ে–কিন্তু বর্তমানে সেখানাকে ট্রেন বলে চিনে নেওয়ার উপায় নেই বললেই হয়। ছাদ উড়ে গিয়েছে, মোটা মোটা লোহার দন্ড বেঁকে দুমড়ে লাইনের পাশের খাদে ছিটকে পড়েছে–জানলা-দরজার চিহ্ন বড়ো একটা নেই। কেবল ইঞ্জিনের কিছু হয়নি। শোনা গেল ট্রেনখানার ওপর বোমা পড়েছে এই কিছুক্ষণ আগে–কিন্তু সুখের বিষয় গাড়িখানা একদম খালি যাচ্ছিল। এখানা কোনো টাইমটেবলভুক্ত যাত্রী বা সৈন্যবাহী ট্রেন নয়। খালি ট্রেনখানা ফু-চু থেকে সাংহাই যাচ্ছিল, ডাউন লাইনে বড়োগাড়ির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে এর কামরাগুলি এই উদ্দেশ্যে। গার্ড ও ড্রাইভার বেঁচে গিয়েছে। কোনো প্রাণহানি হয়নি।

লাইন পরিষ্কার করতে বেলা এগারোটা বেজে গেল। মাত্র পনেরো মাইল দূরে সাংহাই, সেখানে পৌঁছোতে বেজে গেল একটা।

সাংহাই নেমে বিমল ও সুরেশ্বর বুঝলে এ অতি বৃহৎ শহর; সাংহাই-এর রাস্তাঘাট খুব চওড়া ও আধুনিক ধরনে তৈরি, বড়ো বড়ো বাড়ি, দোকান, হোটেল, অফিস, স্কুল, কলেজ–চীনা ও ইংরেজি ভাষায় নানা সাইনবোর্ড চারিদিকে, মোটরের ও রিকশা-গাড়ির ভিড়, রাস্তাঘাট লোকে লোকারণ্য, চায়ের দোকান, চীনা ভাতের দোকানে ছোটো-বড়ো ইঁদুর ভাজা ঝোলানো রয়েছে, ফলওয়ালি রাস্তার ধারে বসে ফল বিক্রি করছে–এত বড়ো শহরের লোকজন ও ব্যাবসাবাণিজ্য দেখলে কেউ বলতে পারবে না যে এই সাংহাই শহরের ওপর বর্তমানে জাপানি সৈন্যবাহিনী আক্রমণ করতে আসছে পিকিং থেকে।

কিছু বদলায়নি যেন, মনে হয় প্রতিদিনের জীবনযাত্রা সহজ ও উদবেগ শূন্য ভাবেই চলেছে।

এখানে প্রোফেসর লি ওদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। খুব বড়ো ধূসর রংয়ের সামরিক লরিতে চড়ে ওরা একটা বড়ো লম্বামতো বাড়ির সামনে নীত হল।

বাড়িটা সামরিক বিভাগের একটা বড়ো দপ্তরখানা, এ ওদের বুঝতে দেরি হল না– ইউনিফর্ম পরা সৈন্যদল ও অফিসারে ভরতি। প্রতি কামরায় চীনা ভাষায় সাইনবোর্ড আঁটা। অফিসার দল ঢুকছে-বেরোচ্ছে, সকলের মুখেই ব্যস্ততার ভাব, উদবেগের চিহ্ন।

দু-তিন জায়গায় ওদের নাম লেখা হল–ওদের সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে যে চীনা অফিসার, সে প্রত্যেক জায়গায় একটা লম্বা হলদে চীনা ভাষায় লিখিত কাগজ খুলে ধরলে টেবিলের ওপর।

তবুও আইনকানুন শেষ হল না–অবশেষে একটা কামরার সামনে ওদের দাঁড় করালে। কামরার মধ্যে নিশ্চয় কোনো বড়ো কর্মচারীর আড্ডা, কারণ কামরার সামনে দর্শনপ্রার্থী সামরিক অফিসার ও অন্যান্য লোকের ভিড় লেগেছে।

ভিড় ঠেলে একটু কাছে গিয়ে বিমল পড়লে দরজার গায়ে পিতলের ফলকে ইংরেজিতে লেখা আছে–জেনারেল চু-সিন-টে, অফিসার কমাণ্ডিং, নাইনটিনথ রুট আর্মি। ওদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি–জেনারেল সাহেবের কামরায় শীঘ্রই ডাক পড়ল। বড়ো টেবিলের ওপাশে এক সুশ্রী, সামরিক ইউনিফর্ম পরিহিত যুবা বসে, ইনিই জেনারেল চু-টে, পূর্বে বিদ্রোহী কমিউনিস্ট সৈন্যদলের নেতা ছিলেন, বর্তমানে জেনারেল চিয়াং-কাই-শেক-এর বিশিষ্ট সহকর্মী।

হাসিমুখে জেনারেল চু-টে মার্জিত ইংরেজিতে বললেন, গুড মর্নিং, আপনাদের কোনো কষ্ট হয়নি পথে?

এরাও হাসিমুখে কিছু সৌজন্যসূচক কথা বললে।

জেনারেল চুটে বললেন–আমি ভারতবর্ষের লোকদের বড়ো ভালোবাসি। আপনারা আমাদের পর নন।

বিমল বললে–আমরাও তাই ভাবি।

–মহাত্মা গান্ধী কেমন আছেন? ওই একজন মস্ত লোক আপনাদের দেশের!

জেনারেল চু-টে-র মুখে মহাত্মা গান্ধীর নাম শুনে বিমল ও সুরেশ্বর দু-জনেই আশ্চর্য হয়ে গেল। তবে মহাত্মা গান্ধী তো আর ওদের বাড়ির পাশের প্রতিবেশী ছিলেন না, সুতরাং তাঁর দৈনন্দিন স্বাস্থ্য সম্বন্ধে ওদের কোনো জ্ঞান নেই–তার ওপর ওরা আজ দু-মাস দেশ ছাড়া।

–ভালোই আছেন। ধন্যবাদ

–মি. জহরলাল নেহেরু ভালো আছেন? আমি তাঁকে শিগগির একটা চিঠি লিখছি। আমাদের দেশের জন্য ভারতের সাহায্য, কংগ্রেসের সাহায্য চেয়ে।

বিমল ও সুরেশ্বরের বুক গর্বে ফুলে উঠল। একজন স্বাধীন দেশের বীর সেনানায়কের মুখে তাদের দরিদ্র ভারতের নেতাদের কথা শুনে চীনদেশ ভারতের কাছে সাহায্যপ্রার্থী একথা শুনে ওরা যেন নতুন মানুষ হয়ে গেছে।

জেনারেল চুটে বললেন–আমার এক সময় অত্যন্ত ইচ্ছে ছিল ভারতে বেড়াতে যাব। নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। ভারতে ভালো বৈমানিক তৈরি হচ্ছে? এরোপ্লেন চালাবার ভালো স্কুল কোথায় স্থাপিত হয়েছে?

বিমলেরা এ খবর রাখে না। দমদমায় একটা যেন ওই ধরনের কিছু আছে–তবে তার বিশেষ কোনো বিবরণ ওরা জানে না।

চুটে বললেন–আপনাদের ধন্যবাদ, এদেশকে আপনারা সাহায্য করতে এসেছেন। আপনাদের ঋণ কখনো চীন শোধ দিতে পারবে না। আপনারা পথ দেখিয়েছেন। আপনাদের প্রদর্শিত পথে দুই দেশের মিলন আরও সহজ হোক এই কামনা করি।

বিমল বললে–এখন কি আমাদের সাংহাইতে থাকতে হবে?

কিছুদিন। বৈদেশিক মেডিকেল ইউনিটে আমেরিকান ডাক্তার ব্লুমফিল্ডের অধীনে। এখন আপনাদের থাকতে হবে মার্কিন কনসেশনে–সাধারণ শহরে নয় আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে চীন গভর্নমেন্ট আপনাদের জীবনের জন্য দায়ী। সাধারণ শহরে বোমা পড়বে, হাতাহাতি যুদ্ধ হবে–এখানে কারো জীবন নিরাপদ নয়। আন্তর্জাতিক কনসেশনে আমরা হাসপাতাল খুলেছি। সেখানে আপনারা কাজ করবেন।

ইওর এক্সেলেন্সি। একটা কথা জিজ্ঞাসা করব, যদি বেয়াদবি না হয়!

বলুন?

সাংহাই কি জাপানিরা আক্রমণ করবে বলে আপনি ভাবেন?

জেনারেল চুটে বললেন–এ তো আন্দাজের কথা নয়–সাংহাই-এর দিকেই তো ওরা পিকিং থেকে আসছে। সেনসি হচ্ছে লুংহাউ রেলের শেষপ্রান্ত। সেখানে আমরা সৈন্য জড়ো করছি ওদের বাধা দিতে। যাতে উত্তর-পশ্চিম চীনে আর না এগোতে পারে। তবে সাংহাইতে একটা বড়ো যুদ্ধ হবে অল্পদিনের মধ্যেই। মেডিকেল ইউনিটের আরও সেইজন্যে সাংহাইতেই এখন দরকার।

সুরেশ্বর ও বিমল অভিবাদন করে বিদায় নিলে।

সৈন্যবিভাগের দপ্তরখানা থেকে বার হয়ে ওরা মোটরে চড়ে আন্তর্জাতিক কনসেশনে পৌঁছোলো। বিমল ও সুরেশ্বর লক্ষ করলে ব্রিটিশ প্রজা হলেও ওদের ব্রিটিশ কনসেশনে না নিয়ে গিয়ে ফরাসি কনসেশনে নিয়ে যাওয়া হল! ওদের সঙ্গে দু-জন চীনা সামরিক কর্মচারী ছিল, আবশ্যকীয় কাগজপত্র তারাই দেখালে বা সই করলে।

প্রকান্ড ব্যারাক। কড়া সামরিক আইনকানুন। হুকুম না নিয়ে কনসেশনের সীমার বাইরে যাবার নিয়ম নেই, ঢোকবারও নিয়ম নেই। ফরাসি সান্ত্রী রাইফেল হাতে সর্বদা পাহারা দিচ্ছে। ফরাসি জাতীয় পতাকা উড়ছে ব্যারাকের পতাকা মন্দিরে। ওদের যাবার দু-দিন পরে একদল আমেরিকান যুবক কনসেশনে এসে পৌঁছোলো–এরা বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এসেছে চীন গভর্নমেন্টকে সাহায্য করতে, নিজেদের সুখসুবিধা বিসর্জন দিয়ে, প্রাণ পর্যন্ত বিপন্ন করে। এদের মধ্যে তিনটি তরুণী ছাত্রীও ছিল, এরা এল সেদিন সন্ধ্যাবেলা। এদের কনসেশনে ঢোকানো নিয়ে চীনা গভর্নমেন্টকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল।

একটি মেয়ের নাম অ্যালিস ই. হুইটবার্ন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। বিমলের সঙ্গে সে যেচে আলাপ করলে। যেমনি সুশ্রী তেমনি অদ্ভুত ধরনের প্রাণবন্ত, সজীব মেয়ে। কুড়ি-একুশ বয়েস–চোখেমুখে বুদ্ধির কী দীপ্তি!

বিমল তাকে বললে–মিস হুইটবার্ন, তুমি ডাক্তারির ছাত্রী ছিলে?

মেয়েটি বললে–না! আমি নার্স হব আন্তর্জাতিক রেডক্রসে কিংবা চীনা সামরিক বিভাগের হাসপাতালে।

তোমার বাপ-মা আছেন?

আছেন। আমার বাবা ঘোড়ার শিক্ষক। খুব নামকরা লোক আমাদের কাউন্টিতে।

তাঁরা তোমাকে ছেড়ে দিলেন?

তাঁদের বুঝিয়ে বললাম। জগতের এক হতভাগা জাতি যখন এত দুর্দশা ভোগ করছে, তখন পড়াশুনো বা বিলাসিতা কি ভালো লাগে? আমি আমার সেন্ট আর পাউডারের টাকা জমিয়ে, টকির পয়সা জমিয়ে, পাঠিয়ে দিয়েছিলাম এদের সাহায্যের জন্যে মার্কিন রেডক্রস ফাণ্ডে। তারপর নিজেই না এসে পারলুম না–তুমিই বলো না মি. বোস পারা যায় থাকতে?

বিমল মুগ্ধ হয়ে গেল এই বিদেশিনি বালিকার হৃদয়ের উদারতার পরিচয় পেয়ে। স্বাধীন দেশের মেয়ে বটে! সংস্কারের পুঁটুলি নয়।

মেয়েটা বললে–আমাকে এ্যালিস বলে ডেকো। একসঙ্গে কাজ করব, অত আড়ষ্ট ভদ্রতার দরকার নেই। আমার একখানা ফোটো দেব তোমায়, চলো তুলিয়ে আনি দোকান থেকে।

কনসেশনের মধ্যে প্রায়ই সব আমেরিকান দোকান। মেয়েটি বললে, চলো সাংহাই শহরের মধ্যে একটু বেড়িয়ে আসি–কোনো চীনা দোকানে ফোটো তুলব। ওরা দু-পয়সা পাবে।

অনুমতি নিয়ে আসতে আধঘণ্টা কেটে গেল, তারপর বিমল আর এ্যালিস কনসেশনের বড়ো ফটক দিয়ে সাংহাইয়ে যাবার রাস্তার ওপরে উঠে একখানা রিকশা ভাড়া করলে।

কনসেশনে রাস্তাঘাটের নাম ইংরাজিতে ও ফরাসি ভাষায়। সাংহাই শহরে চীনা ভাষায়। কিছু বোঝা যায় না। ঢলঢলে নীল ইজের ও স্ট্র হ্যাট পরে চীনা রিকশাওয়ালা রিকশা টানছে কিন্তু এ অংশেও বহু বিদেশি লোক ও বিদেশি দোকান পসারের সারি। সাংহাই-এর আসল চীনাপল্লি আলাদা–রাস্তা সেখানে আরও সরু সরু–একথা বিমল ইতিমধ্যে চীনা অফিসারদের মধ্যে শুনেছিল।

এ্যালিস বললে–চলো, চীনাপাড়া দেখে আসি, মি. বোস।

রিকশাওয়ালাকে চীনাপাড়ার কথা বলতেই সে বারণ করলে। বললে– সেখানে কেন যাবে। এ সময় সেসব জায়গা ভালো না। বিপদে পড়তে পার। তোমাদের সেখানে নিয়ে গেলে আমায় পুলিশে ধরবে।

এ্যালিস ভয় পাবার মেয়েই নয়। বললে–চলো, মি. বোস, আমরা হেঁটেই যাব। ওকে বিপদে ফেলতে চাই নে। ওর ভাড়া মিটিয়ে দিই।

বিমল রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে দিলে, এ্যালিসকে দিতে দিলে না। কিন্তু রাস্তা দু-জনে কেউই জানে না।

বিমল বললে–একখানা ট্যাক্সি নিই, এ্যালিস! সে অনেকদূর, রাস্তা না জানলে ঘুরে হয়রান হব।

হঠাৎ এ্যালিস ওপরের দিকে চেয়ে বললে–ও কি ও, মি. বোস? এরোপ্লেনের শব্দ শুনছ? অনেকগুলো এরোপ্লেন একসঙ্গে আসছে যেন। কোনদিকে বলো তো?

বিমলও শুনলে। বললে–গভর্নমেন্টের এরোপ্লেন।

কিন্তু চক্ষের নিমেষে একটা কান্ডের সূত্রপাত হল, যা বিমলের অভিজ্ঞতার বাইরে।

সামনে একটা প্রকান্ড বাড়ির ওপর বিকট এক আওয়াজ হল–বাজপড়ার আওয়াজের মতো–সঙ্গেসঙ্গে এদিকে-ওদিকে, সামনে-পেছনে পরপর সেইরকম ভীষণ আওয়াজ। ইট, চুন, টালি চারিদিকে ছুটতে লাগাল। বিরাট শব্দ করে সামনে সেই বাড়িটার তেতলার ছাদ ধসে পড়ল ফুটপাথের ওপর। বাড়িধসা চুন সুরকির ধুলোয় ও কীসের ঘন শ্বাসরোধকারী ধোঁয়ায় বিমল ও এ্যালিসকে ঘিরে ফেললে।

সঙ্গে সঙ্গে উঠল মানুষের গলার আর্ত চিৎকার, গোলমাল, গোঙানি, কাতর কাকুতি অনুনয়ের শব্দ, দুড়দাড় শব্দে ছুটে চলার পায়ের শব্দ, কান্নার শব্দ, সে এক ভয়ানক কান্ড!

বিমল প্রথমটা বুঝতে না পেরে সেই ঘন ধূম আর ধূলির মধ্যে হতভম্বের মতো খানিক দাঁড়িয়ে রইল–ব্যাপার কী? তারপরেই বিদ্যুৎ চমকের মতো তার মনে হল এ জাপানি এরোপ্লেনের বোমা বর্ষণ!

এ্যালিস কই? একহাতের দূরের মানুষ চোখে পড়ে না, সেই ধোঁয়া ধুলো আর গোলমালের মধ্যে। ওর কানে গেল এ্যালিসের উচ্চ ও সশঙ্ক কণ্ঠস্বর–মি. বোস, এসো–আমার হাত ধরো–বোমা পড়ছে–দৌড় দাও!

অন্ধকারের মধ্যে বিমল এ্যালিসের হাত শক্ত মুঠোয় ধরে বললে– কোথাও নোড়ো না এ্যালিস, নড়লেই মারা যাবে। দাঁড়াও এখানে।

কিন্তু তখন আর ছোটবার বা পালাবার পথও নেই। পরবর্তী পাঁচ মিনিট কালের ঠিক হিসেব বিমল দিতে পারবে না। সে নিজেও জানে না। বাঁশঝাড়ে আগুন লাগলে যেমন গাঁটওয়ালা বাঁশ ফটফট করে একটার পর একটা ফাটে তেমনি চারিদিকে দুমদাম শুধু বোমা ফাটার বিকট আওয়াজ।

পায়ের তলায় মাটি যেন দুলছে, টলছে ভূমিকম্পের মতো ধোঁয়া, বাড়ি ধসে পড়ার হুড়মুড় শব্দ, আর্তনাদ–তারপরে সব চুপচাপ, বোমার আওয়াজ থেমে গেল। বিমল চেয়ে দেখলে এরোপ্লেনগুলো মাথার ওপরে চক্রাকারে দু-বার ঘুরে যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকে চলে গেল–বেশ যেন নিরুপদ্রব, শান্ত ভাবেই।

ধোঁয়ায় মিনিট দুই তিন কিছু দেখা গেল না–যদিও গোলমাল, চিৎকার লোক জড়ো হওয়ার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশের তীব্র হুইসল বেজে উঠল একবার–দু-বার, তিনবার।

ক্রমে ক্রমে ধুলো আর ধোঁয়ার আবরণ কেটে যেতেই এ্যালিস বললে–চলো এগিয়ে গিয়ে দেখি, মি. বোস—

সামনে একজায়গায় ফুটপাথের ওপর বেজায় লোক জড়ো হয়েছে। একটা বাড়ি পড়েছে ভেঙে। অতি বীভৎস দৃশ্য ফুটপাথের ওপর। অনেকগুলি ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়ের ছিন্ন ভিন্ন দেহ ছিটকে ছড়িয়ে পড়ে আছে সেখানটায়! বাড়িটা বোধ হয় একটা চীনা স্কুল ছিল– বেলা এগারোটা, ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছিল, কতক ছিল স্কুলবাড়ির মধ্যে। বাড়িখানা একেবারে হুমড়ি খেয়ে ভেঙে পড়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ফুটপাথ ও রাস্তার খানিকদূর পর্যন্ত।

হর্ন বাজিয়ে দু-খানা রেডক্রশ অ্যাম্বুলেন্স এল! একটা ছোটো ছেলে এখনও নড়ছে– এ্যালিস ছুটে তার পাশে গিয়ে বসল। বিমল এক চমক দেখেই বললে– কোনো আশা নেই মিস হুইটবার্ন–ও এখুনি যাবে।

বিমলের গা তখনও কাঁপছে। জীবনে এ-রকম দৃশ্য কখনো দেখবার কল্পনাও সে করেনি। যুদ্ধ না শিশুপাল বধ!

এ্যালিস-বিমলের কাজ অনেক সংক্ষেপে হয়ে গিয়েছিল।

ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আহত কেউ ছিল না–সবাই মৃত।

সব শেষ হয়ে যাবার পরে বিমল বললে–এ্যালিস, এখন কী করবে? আর কি চীনে পল্লিতে যাবে এখন?

এ্যালিস বললে–যেতাম কিন্তু এই যে বোমা ফেলা হয়ে গেল, এর শোরগোল অনেকদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে তো। কনসেশনের সবাই আমাদের জন্যে চিন্তিত হয়ে পড়বে। সুতরাং চলো ফেরা যাক। কিছুদূরে যেতেই দেখলে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ছুটোছুটি করছে। চীনা গভর্নমেন্টের অ্যান্টি-এয়ারক্র্যাফট কামানগুলি চারদিক থেকে ছোঁড়া হতে লাগল–কিন্তু তখন জাপানি বিমান কোথায়? আকাশের কোনো দিকেই তার পাত্তা নেই।

ওরা কনসেশনে ফিরে এল। সুরেশ্বরের কাছে বিমল খুব বকুনি খেল, তাকে ফেলে যাওয়ার জন্যে।

এ্যালিস বললে–ওকে বকছ কেন–আমি ভেবেছি আজ বিকেলে আবার চীনাপাড়ায় যাবার চেষ্টা করব। তুমি চল না, সুরেশ্বর।

এবার ওদের সঙ্গে আর একটি মেয়ে যাবে বললে। এ্যালিসের সঙ্গে পড়ত, নাম তার মিনি –মিনি বেরিংটন।

বিকেলে ওরা ট্যাক্সি আনালে। ওদের ট্যাক্সি কনসেশনের গেট পর্যন্ত এসেছে–এমন সময় একজন তরুণ চীনা সামরিক কর্মচারী ওদের ট্যাক্সিখানা থামালো।

বললে–আপনারা কোথায় যাবেন?

বিমল বললে–শহর বেড়াতে।

যাবেন না। আমরা গুপ্ত খবর পেয়েছি, জাপানি যুদ্ধজাহাজ বন্দরের বাইরের সমুদ্র থেকে লম্বা পাল্লার কামানে গোলাবর্ষণ শুরু করবে আজ সন্ধ্যার সময়ে–সেই সঙ্গে জাপানি উড়ো জাহাজও যোগ দেবে বোমা ফেলতে।

ধন্যবাদ। আমরা একটু ঘুরে এখুনি চলে আসব।

একথা বললে এ্যালিস–কাজেই বিমল বা সুরেশ্বর কিছু বলতে পারলে না। শহরের মধ্যে এসে দেখলে, পুলিশ সকলের হাতে চীনা ভাষায় মুদ্রিত এক এক টুকরো কাগজ বিলি করছে। চীনা ছাত্রদের একটা লম্বা দল পতাকা উড়িয়ে মুখে কী বলতে বলতে শোভাযাত্রা করে চলেছে।

সাংহাই অতিপ্রকান্ড শহর। এত বড়ো শহর বিমল দেখেনি–সুরেশ্বরও না। কলকাতা এর কাছে লাগেই না।

চীনাপল্লির নাম চা-পেই। সে-জায়গাটায় রাস্তাঘাট কিন্তু অপরিসর নয়–তবে বড়ো ঘিঞ্জি বসতি। প্রত্যেক মোড়ে খাবারের দোকান, ছোটো-বড়ো হঁদুর ভাজা ঝুলছে। বাঁকে করে ফিরিওয়ালা ভাত-তরকারি বিক্রি করছে।

বিমলের ভারি ভালো লাগল এই চীনাপাড়ার জীবনস্রোত। এক জায়গায় একটা বুড়ি বসে ভিক্ষে করছে–টাকাপয়সার বদলে সে পেয়েছে ভাত-তরকারি, ওর মুখে এমন একটি উদার ভালোবাসার ভাব, চোখে সন্তোষ ও তৃপ্তির দৃষ্টি। বোধ হয় আশাতীত ভাত-তরকারি পেয়েছে। বলে এত খুশি হয়ে উঠেছে মনে মনে। প্রাচ্য-ভূখন্ডের দারিদ্র্য ও সহজ-সরল সন্তোষের ছবি যেন এই বৃদ্ধা ভিখারিনির মধ্যে মূর্তি পরিগ্রহ করেছে।

হঠাৎ আকাশে কী একটা অদ্ভুত ধরনের শব্দ শুনে ওরা মুখ তুলে চাইলে। একটা চাপা সোঁ-ও-ও শব্দ। মিনি সর্বপ্রথমে বলে উঠল–এ শেলের শব্দ! সর্বনাশ, এ্যালিস, চলো আমরা ফিরি–জাপানি যুদ্ধজাহাজের কামান থেকে শেল ছুড়ছে! দুম! দুম!–দূরে অস্পষ্ট কামানের আওয়াজ শোনা গেল।

কাছেই কোথায় একটা ভীষণ বিস্ফোরণের আওয়াজ হল সঙ্গেসঙ্গে। লোকজন চারিধারে ছুটতে লাগল–ওরাও ছুটল তাদের পিছু পিছু। বসতি যেখানে খুব ঘিঞ্জি, সেখানে একটা বাড়িতে গোলা পড়েছে। বাড়িটার সামনের অংশ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে–ইট, চুন, টালিতে সামনের রাস্তাটা প্রায় বন্ধ–কে মরেছে না মরেছে বোঝা যাচ্ছে না, সেখানে লোকজনের বেজায় ভিড়।

আবার সেই রকম সোঁ—সোঁ–ও–ও শব্দ!

কাছেই আর একটা জায়গায় গোলা পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে আকাশে সারবন্দি একদল এরোপ্লেন দেখা গেল। তারা অনেক উঁচু দিয়ে যাচ্ছে, পাছে চীনা বিমানধ্বংসী কামানের গোলা খেতে হয় এই ভয়ে।

এ্যালিস বললে–ওরা পাল্লা ঠিক করে দিচ্ছে যুদ্ধজাহাজের গোলন্দাজদের। চলো এখানে আর থাকা নয়–এই চীনা পাড়াটা ওদের লক্ষ।

কিন্তু ওদের যাওয়া হল না। এ্যালিসের কথা শেষ হতে-না-হতেই, যেন একটা ভীষণ ভূমিকম্পে, পায়ের তলায় মাটি দুলে উঠল এবং একসঙ্গে দু-তিনটি শেলের বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ ও সেই সঙ্গে প্রচুর ধোঁয়া ও বিশ্রী শ্বাসরোধকারী কর্ডাইট-এর উগ্র গন্ধ পাওয়া গেল। তুমুল হইচই, আর্তনাদ, কলরব ও পুলিশের হুইসলের মাঝে এ্যালিসের হাত ধরলে বিমল, মিনির হাত ধরলে সুরেশ্বর, কিন্তু পালাবার পথ নেই তখন কোনো দিকেই। ওদের ট্যাক্সিখানা দাঁড়িয়ে আছে বটে, ট্যাক্সিওয়ালার সন্ধান নেই– সে বোধ হয় পালিয়েছে।

চা-পেই পল্লির ওপর কেন বিশেষ লক্ষ জাপানি তোপের, একথা বোঝা গেল না, কারণ এখানে চীনা গৃহস্থদের বাড়িঘর মাত্র, কোনো সামরিক ঘাঁটি তো নেই এখানে। দেখতে দেখতে বাড়িঘর ভেঙে গুড়ো হয়ে পড়ে সামনের-পেছনের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল। লোকজন আগে যা কিছু মারা পড়েছিল–এখন সবাই পালিয়েছে, কেবল যারা ভাঙাবাড়ির মধ্যে আটকে পড়েছে তাদেরই আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে।

একটা ভগ্নস্তূপের মধ্যে যেন ছোটো ছেলের কান্নার শব্দ। এ্যালিস বললে–দাঁড়াও বিমল –এখানে সবাই দাঁড়াও।

গোলাবর্ষণ তখনও চলছে, কিন্তু চীনাপল্লির অন্য অঞ্চলে। এদিকে এখন শুধু গোঙানি, চিৎকার, হইচই কলরব ও কাতরোক্তি।

এ্যালিস আগে চড়ল গিয়ে ধ্বংসস্তূপের ওপরে। পেছনে মিনি ও সুরেশ্বর। বিমল নীচে দাঁড়িয়ে রইল। একটা কড়িকাঠ সরিয়ে ওরা তিনজনে একটা দরজা পেলে। তারপর একটা ছোটো ঘর। এ্যালিস অতি কষ্টে ঘরে ঢুকল–সুরেশ্বর ওকে সাহায্য করলে। একটা ন-দশ মাসের শিশু সেই ঘরের মেঝেতে অক্ষত অবস্থায় শুয়ে শুয়ে কাঁদছে।

এ্যালিস তাকে সন্তর্পণে মেঝে থেকে তুলে সুরেশ্বরের হাতে দিলে। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে, ঘরটার মধ্যে অন্ধকার। তিনজনে ঘরের মধ্যে থেকে ইটকাঠের স্তূপটার ওপরে উঠে শুনলে, বিমল উত্তেজিত ভাবে ডাকছে–আঃ কোথায় গেলে তোমরা? চট করে নেমে এসো–বড়ো বিপদ!

চারিদিকের গোলা ফাটবার আওয়াজ ও ছুটন্ত শেলের চাপা

সোঁও-ও রব খুব বেড়েছে। একটা একটা শেল মাঝে মাঝে আকাশেই সশব্দে ফেটে তারাবাজির মতো অনেকখানি আকাশ আলো করে ছড়িয়ে পড়ছে।

এ্যালিস বললে–কী হয়েছে?

বিমল বললে–জাপানি সৈন্যদল যুদ্ধজাহাজ থেকে নেমেছে শহরে–তারা শহর আক্রমণ করছে শুনছি। এইদিকেই আসছে। তাদের হাতে পড়া আদৌ আনন্দদায়ক ব্যাপার হবে না–তোমার হাতে ওকী?

মিনি বললে–একটা ছোট্ট ছেলে। একে কোথায় রাখি বলো তো এখন?

সুরেশ্বর একজন ব্যস্ত ও উত্তেজিত পুলিশম্যানকে জিজ্ঞেস করে জানলে–সমুদ্রের ধারে জাপানি সৈন্যদের সঙ্গে চীনাদের হাতাহাতি যুদ্ধ চলছে। জাপানিরা নগরে প্রবেশ করবার চেষ্টা করছে।

এ্যালিস বললে–আমরা এখন ছোটো ছেলেটিকে কোথায় রাখি বলো না? কনসেশনের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না। ওর বাপ-মা এই অঞ্চলের অধিবাসী। ছেলের সন্ধান পাবে না কনসেশনে নিয়ে গেলে।

বিমল বললে–পুলিশম্যানদের জিম্মা করে দাও না।

এ্যালিস ও মিনি তাতে রাজি হল না। এই সব চীনা পুলিশম্যান দায়িত্বজ্ঞানহীন, ওদের হাতে ছোট্ট ছেলেকে ওরা দেবে না।

সমস্ত গলিটা বিরাট ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে লোকজন অন্ধকারে তার মধ্যে কী-সব খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এমন সময়ে পাশের একটা স্কুপে দু-তিনটি হারিকেন লণ্ঠন ও টর্চ জ্বালিয়ে একদল ছোকরা একটি মৃতদেহের ঠ্যাং ধরে বার করছে দেখা গেল।

বিমল উত্তেজিত সুরে বলে উঠল– প্রোফেসর লি! প্রোফেসর লি!

তারপরেই সে ছুটে গেল ছোকরার দলের দিকে। সুরেশ্বর দেখলে ছোকরার দলের নেতা হচ্ছেন দাড়িওয়ালা একজন বৃদ্ধ–এবং তিনি তাদের পূর্বপরিচিত প্রোফেসর লি।

সেই মুমূর্যদের আর্তনাদ ও পথের লোকের চিৎকারের মধ্যে তিনজনের ব্যাকুল প্রশ্ন বিনিময় হল। প্রোফেসর লি তাঁর ছাত্রদল নিয়ে নিকটেই এক সরাইখানায় ছিলেন–হঠাৎ এই বোমাবর্ষণের দুর্যোগ–এখন তিনি সেবাব্রতী, ছাত্রদের নিয়ে হতাহতদের টেনে বার করা ও তাদের হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করছেন।

এ্যালিস ও মিনির সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দেওয়া হল।

বিমল বললে– প্রোফেসর লি, এই ছোটো ছেলেটির কী ব্যবস্থা করা যায় বলুন তো?

সদানন্দ, সৌম্য বৃদ্ধ হাত পেতে বললেন–আমায় দাও। তোমরা ওর বাপ-মায়ের সন্ধান করতে পারবে না, আমি পারব। আর কী জান, ছেলে অনেকগুলি জমেছে–চ্যাং, এদের নিয়ে চলো তো? দেখবে এসো তোমরা–যাবার পথে একটু দূর গিয়েই বিমল বলে উঠল– আঃ, কী ব্যাপার দেখো!

সকলেই দেখলে, সে-দৃশ্য যেমন বীভৎস তেমনি করুণ। সেই বৃদ্ধা ভিখারিনি ঠ্যাং ছড়িয়ে মরে পড়ে আছে–সেই জায়গাতেই। একখানা হাত প্রায় চূর্ণ হয়ে গিয়েছে–পাশেই তার ভিক্ষালব্ধ ভাত-তরকারিগুলি রক্তমাখা অবস্থায় পড়ে! আশার জিনিসগুলি–মুখেও দিতে পারেনি হয়তো।

এ্যালিসের চোখে জল এল। বিমল ও সুরেশ্বর মাথার টুপি খুলে বসল। মিনি চোখে রুমাল দিয়ে অন্য দিকে মুখ ফেরালে। কেবল অবিচলিত রইলেন প্রোফেসর লি। তিনি ছাত্রদের বললেন, এই মড়াটাকে একটা কিছু ঢাকা দাও তো হে! এ আর কী? আমাদের দেশের এ তো রোজকার ব্যাপার! এতে বিচলিত হলে চলে না মাদাম!

নিকটেই একটা ঘরের মধ্য প্রোফেসর লি ওদের নিয়ে গেলেন। হারিকেন লণ্ঠনের আলোয় দেখা গেল সে-ঘরের মেঝেতে পাঁচ-ছ-টি নয়-দশমাসের কী এক বছরের শিশু অনাবৃত মেঝের ওপর পড়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে, কেউ কাঁদছে, কেউ হাসছে।

এ্যালিস ছুটে গিয়ে তাদের ওপর ঝুঁকে পড়ে বললে– ও ইউ পুওর ডিয়ারিজ!

প্রোফেসর লি হেসে বললেন–সন্ধ্যা থেকে এতগুলি উদ্ধার করেছি স্তূপ থেকে। আপনাদেরটিও দিন। আমার দু-টি ছাত্র এখানে পাহারা দিচ্ছে–আমরা খুঁজে এনে এখানে জড়ো করছি–রাখো এখানে।

গোলমাল ও ভিড় তখন একটু কমেছে। প্রোফেসর লি সকলকে বললেন–আসুন, একটু চা খাওয়া যাক–রাত্রে আর ঘুম হবে না আজ, সারারাত এইরকম চলবে দেখছি–

যে-ঘরে শিশুগুলিকে জড়ো করা হয়েছে, তার পাশেই একটি ছোটো বাড়িতে লি থাকেন তাঁর ছাত্রবৃন্দ নিয়ে। দু-জন ছাত্রকে শিশুদের কাছে রেখে বাকি সকলে ওদের নিয়ে গেল তাদের সেই বাসায়।

ছোটো ছোটো পেয়ালায় দুধ-চিনি-বিহীন সবুজ চা, শসার বিচি ভাজা, শরবতি লেবুর টুকরো এবং বাঙালি মেয়েদের পাঁয়জোড়ের মতো দেখতে শুয়োরের চর্বিতে ভাজা এক প্রকার কী খাবার।

সুরেশ্বর ও বিমল শেষোক্ত খাবার ঠেলে রেখে দিলে, সে কী এক ধরনের বিশ্রী গন্ধ খাবারে!

প্রোফেসর লি বললেন–আপনারা বিদেশি। আমাদের দেশকে সাহায্য করতে এসেছেন, কিন্তু আমাদের দেশের এখনও কিছুই দেখেননি, দেখলে আপনাদের দয়া হবে। এত গরিব দেশ আর এমন হতভাগ্য–

মিনি বললে–আমাদের সব দেখাবেন দয়া করে প্রোফেসর লি। দেখতেই তো এসেছি– এ্যালিস বললে–আর একটি দেশ আছে প্রোফেসর লি। ভারতবর্ষ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বুটের তলায় পড়ে আছে। ছেলেবেলা থেকে দুস্থ ভারতবর্ষের কথা শুনলে কষ্টে আমার বুক ফেটে যায়।

বিমল এ্যালিসের দিকে কৃতজ্ঞতাপূর্ণ চোখে চাইলে–বড়ো ভালো লাগল এই বিদেশিনি বালিকার এই নিষ্কপট নিঃস্বার্থ সহানুভূতি তার দরিদ্র স্বদেশের জন্যে।

এ্যালিস বললে–শিশুগুলির কে আছে? পুওর লিটল মাইটস। আমায় একটি খোকা দেবেন প্রোফেসর লি?

প্রোফেসর লি হেসে বললেন–কী করবে মিস—

এ্যালিস বললে–আমাদের নাম ধরে ডাকবেন প্রোফেসর লি, ওর নাম মিনি, আমার নাম এ্যালিস। আমরা আপনাকে দাদু বলে ডাকব–কেমন?

এই সদানন্দ উদার, সৌম্যমূর্তি বৃদ্ধকে এ্যালিসের বড়ো ভালো লেগে গেল। কিউরিও দোকানে বিক্রি হয় যে চীনে মাটির হাস্যমুখ বুদ্ধ-বৃদ্ধের মুখখানা ঠিক যেন তেমনি পরিপূর্ণ সন্তোষ, আনন্দ ও প্রেমের ভাব মাখানো।

প্রোফেসর লি-র মুখ উদার হাসিতে ভরে গেল। বললেন–বেশ তাই হবে।

একটা বড়ো রকমের আওয়াজের দিকে এই সময় প্রোফেসর লি-র জনৈক ছাত্র ওদের সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করলে।

বিমল বললে–বন্দরের দিকে এখনও গোলাবর্ষণ চলছে, হাতাহাতি যুদ্ধও চলছে– ঠিক এই সময় পুলিশম্যান ঘরের দোরের কাছে এসে চীনাভাষায় কী জিজ্ঞেস করলে– লোকটা যেন খুব ব্যস্ত ও উত্তেজিত–সে চলে গেলে প্রোফেসর বললেন–ও বলে গেল খাওয়াদাওয়া শেষ করে কেউ যেন আজ ঘরের বার না হয়–বিশেষত মেয়েরা। জাপানিরা বেওনেট চার্জ করেছিল–আমাদের সৈন্যরা হটিয়ে দিয়েছে শেনসু প্রাচীরের পূর্ব কোণে। কিন্তু আজ রাত্রে আবার ওরা গোলা মারবে, বোমাও ছুড়বে।

চা পান শেষ হল। বিমল বললে– প্রোফেসর লি, মেয়েরা রয়েছেন সঙ্গে, আজ যাই। কনসেশনে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে।

এ্যালিস বললে–দাদু, আমার একটা খোকা?

প্রোফেসর লি এ্যালিসের মাথায় হাত দিয়ে খেলার ছলে সস্নেহে বলেন– বেওয়ারিশ যদি কোনো খোকা থাকে, পাবে এ্যালিস। কিন্তু কী করবে চীনা ছেলে নিয়ে?

এ্যালিসের এ হাস্যকর অনুরোধ শুনে মিনি তো হেসেই খুন।

চলো চলো এ্যালিস কনসেশনে একটা জ্যান্ত খোকা নিয়ে তোমায় ঢুকতে দেবে কি?

ওরা যখন ফিরে আসছে, দূরে মাঝে মাঝে দুমদাম বিস্ফোরণের শব্দ এবং সাহায্যকারী এরোপ্লেনের হাউইয়ের সাদা অগ্নিময় ধূম দেখা যাচ্ছিল। তবে যেন পূর্বাপেক্ষা অনেক মন্দীভূত হয়ে এসেছে।

সেই রাত্রে কীসের বিষম আওয়াজে বিমলের ঘুম ভেঙে গেল– সে ধড়মড় করে উঠে বিছানার ওপর বসল–কর্ডাইটের শ্বাসরোধকারী ধূমে ও বিশ্রী গন্ধে ঘরটা ভরে গিয়েছে।

ও ডাকলে–সুরেশ্বর–সুরেশ্বর ওঠো–কনসেশনে বোমা পড়ছে!

সঙ্গেসঙ্গে যথেষ্ট হইচই উঠল চারিদিকে।

বোমা! বোমা!

ওরা জানালা দিয়ে দেখলে, যে-ঘরের মধ্যে ওরা শুয়েছিল–তার পুব দিকে আর একটা ঘরের দেওয়াল চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ভেঙে পড়েছে। সেই গোলমালের মধ্যে ভিড় ঠেলে এ্যালিস ছুটতে ছুটতে ওদের ঘরের মধ্যে ঢুকে ডাকলে বিমল! বিমল!

বিমল বললে–এই যে এ্যালিস, তোমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি? মিনি কোথায়?

বলতে বলতে মিনিও ঘরে ঢুকল। বললে–বাইরে এসো, দেখো শিগগির–চট করে এসো–

ওরা বাইরে গেল। কনসেশনের পুলিশের ডেপুটি মার্শাল এসে পৌঁছেছেন দুর্ঘটনার স্থানে। সবাই আকাশের দিকে চাইলে, দু-খানা এরোপ্লেন চলে যাচ্ছে–আলো নিবিয়ে। জনৈক ফরাসি কর্মচারী দেখে বললে–কাওয়াসাকি বহুবার!

বিমল বললে–এ্যালিস, কী করে চেনা গেল জিজ্ঞেস করো না?

মিনি বললে–আমি জানি। নীচের দিকে উইং-এ কালো আঁজি কাটা ছুঁচোমুখ প্লেন এই হল জাপানিদের বিখ্যাত বোমা ফেলবার প্লেন কাওয়াসাকি বহুবার। কিন্তু কনসেশনে বোমা! এ-রকম তো কখনো–

সে-রাত্রে আর কারো ঘুম হল না। বিমল খুব খুশি না হয়ে পারলে না, তার মঙ্গলা মঙ্গলের দিকে এ্যালিসের এত আগ্রহদৃষ্টি দেখে। সেই রাত্রে বোমা পড়েছে শুনে এ্যালিস সকলের আগে এসেছে তাঁকে দেখতে, সে কেমন আছে।

শেষ রাত্রের দিকে সবাই একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল কিন্তু শোরগোলে ওদের ঘুম ভেঙে গেল।

ভীষণ গোলাবর্ষণের শব্দ আসছে–সাংহাই শহরে জাপানি যুদ্ধজাহাজ ও এরোপ্লেন থেকে একযোগে গোলা ও বোমা বৃষ্টি হচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে সাংহাই শহর থেকে দলে দলে স্ত্রী-পুরুষ ছেলে-মেয়ে পালিয়ে আসছে। কনসেশনে–বাক্স, তেরঙ্গ, পোঁটলা-পুঁটুলি নিয়ে, ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের হাত ধরে। এদের সবারই মুখে ভীষণ ভয়ের চিহ্ন–এদের চক্ষু উদবেগে ও রাত্রি জাগরণে রক্তবর্ণ, চুল রুক্ষ; পাশব বলের কাছে মানুষের কী শোচনীয় পরাজয়!

বেলা দশটার মধ্যে ব্রিটিশ কনসেশনের হাসপাতাল ও মার্কিন রেডক্রশের বড়ো হাসপাতাল আহতের ভিড়ে পরিপূর্ণ হয়ে গেল।

কী ভীষণ আওয়াজ ও গোলমাল পেনসু প্রাচীরের দিকে, সমুদ্রের থেকে মাইল দুই দূরে পূর্ব কোণে। সেখানে চীনা টেনথ রুট আর্মির সঙ্গে জাপানি নৌসৈন্যদের যুদ্ধ চলছে। কনসেশন থেকে যুদ্ধস্থলের দূরত্ব প্রায় তিন মাইল, বিমল জিজ্ঞেস করে জানলে। এ ছাড়াও গোলাবর্ষণ চলছে শহরের বিভিন্ন স্থানে।

টেলিফোনে অর্ডার এল মেডিকেল ইউনিটের বড়ো ডাক্তারের কাছে থেকে–বিমল, সুরেশ্বর, এ্যালিস ও মিনিকে চ্যাং-লিন অ্যাভিনিউতে চীনা সামরিক হাসপাতালে যাবার জন্যে।

ওরা আমেরিকান রেডক্রস মোটরে সামরিক হাসপাতালের দিকে ছুটল। ড্রাইভার খুব বড়ো একটা রেডক্রশ পতাকা গাড়ির বনেটে উড়িয়ে দিলে–এ ছাড়া গাড়ির ছাদের বাইরের পিঠে সারা ছাদ জুড়ে একটা প্রকান্ড লাল ক্রস আঁকা। এত সাবধানতা সত্ত্বেও ড্রাইভার বললে– যদি আপনারা হাসপাতালে পৌঁছোতে পারেন, সে খুব জোর বরাত বুঝতে হবে আপনাদের।

সুরেশ্বর ও বিমল একযোগে বললে কেন?

কনসেশন বা রেডক্রশ কিছুই মানছে না জাপানি বোমারু প্লেন। কালও আমাদের রেডক্রশ ভ্যানে বোমা ফেলেছে– শোনেননি আপনারা সে-কথা?

সে-কথা না শোনাই ভালো। ওদের মোটর কনসেশন থেকে বার হয়ে খানিকটা ফাঁকা মাঠ দিয়ে তির বেগে ছুটল। বিমল দেখলে ড্রাইভার মাঝে মাঝে উপরের দিকে উদবিগ্নদৃষ্টিতে চেয়ে কী দেখছে।

বিমল বললে–কী দেখছ?

বোমারু প্লেন আসছে কিনা দেখছি! এখন আপনাদের পৌঁছে দিতে পারব কিনা জানিনে –তবে চেষ্টা করব–

বলতে বলতে একখানা এরোপ্লেনের আওয়াজ শোনা গেল মাথার ওপর। বিমলের মুখ শুকিয়ে গেল–সামনে উদ্যত মৃত্যুকে কে না ভয় করে? সবাই ওপরের দিকে চাইলে। ড্রাইভার অ্যাক্সিলারেটর পা দিয়ে চেপে স্পিড তুললে হঠাৎ বেজায়।

বিমল চেয়ে দেখলে এরোপ্লেনখানা যেন আরও নীচে নামল–কিন্তু ভাগ্যের জোরেই হোক বা অন্য কারণেই হোক– শেষপর্যন্ত সেখানা ওদের ছেড়ে দিয়ে অন্য দিকে চলে গেল।

ড্রাইভার বললে–জাপানি কাওয়াসাকি বম্বার–ভীষণ জিনিস–নীচু হয়ে দেখলে এ গাড়িতে চীনেম্যান আছে কিনা, থাকলে বোমা ফেলত।

সুরেশ্বর বললে–উঃ কানের কাছ দিয়ে তির গিয়েছে।

এতক্ষণ যেন গাড়ির সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে ছিল, এইবার একযোগে নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল।

হাসপাতালে পৌঁছে দেখলে সেখানে এত আহত নর-নারী এনে ফেলা হয়েছে যে কোথাও এতটুকু জায়গা নেই। এদের বেশিরভাগ স্ত্রীলোক ও বালক-বালিকা। যুদ্ধের সৈন্যও আছে– তবে তাদের সংখ্যা তত বেশি নয়।

একটি দশ-এগারো বছরের ফুটফুটে সুন্দর-মুখ বালকের একখানা পা একেবারে গুঁড়িয়ে গিয়েছে–আশ্চর্যের বিষয় ছেলেটি তখনও বেঁচে আছে এবং কিছুক্ষণ আগে অজ্ঞান হয়ে থাকলেও এখন তার জ্ঞান হয়েছে এবং যন্ত্রণায় সে আর্তনাদ করছে। বিমলের ওয়ার্ডেই সে বালকটি আছে। এ্যালিস সেই ওয়ার্ডেই নার্স।

এ্যালিস পেশাদার নার্স নয়, বয়সেও নিতান্ত তরুণী, চোখের জল রাখতে পারলে না ছেলেটির যন্ত্রণা দেখে। বিমলকে বললে–একে মরফিয়া খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখো না?

বিমল বললে–তা উচিত হবে না। ওকে এখুনি ক্লোরোফর্মে অজ্ঞান করে পা কেটে ফেলতে হবে। অপারেশন টেবিল একটাও খালি নেই, সব ভরতি। একটা টেবিল খালি পেলেই ওকে চড়িয়ে দেবে।

এ্যালিস বালকটির শিয়রে বসে কতরকমে তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলে–কিন্তু ওদের সবারই মুশকিল চীনা ভাষা সামান্য এক-আধটু বুঝতে পারলেও বলতে আদৌ পারে না।

সুরেশ্বর হাসপাতালে ঔষধালয়ে সহকারী কম্পাউণ্ডার হয়েছে। সে দু-খানা চীনা বর্ণপরিচয় কোথা থেকে জোগাড় করে এনে ওদের দিয়েছে। এ্যালিস বললে–সুরেশ ঠিক বলছিল সেদিন, এসো তুমি, আমি, মিনি ভালো করে চীনে ভাষা শিখি, নইলে কাজ করতে পারব না–

আর্ত বালকটির শয়নশিয়রে এ্যালিসকে যেন করুণাময়ী দেবীর মতো দেখাচ্ছে, বিমল সে দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। এ্যালিসের প্রতি শ্রদ্ধায় তার মন ভরে উঠল।

সন্ধ্যা সাতটার সময় টেবিল খালি হল।

বালকটিকে টেবিলে নিয়ে গিয়ে তোলা হয়েছে, কতকগুলি ডাক্তারি ছাত্র কিছুদূরে একটা গ্যালারিতে বসে আছে, হাসপাতালের সহকারী সার্জন চীনাম্যান, তিনি ছাত্রদের দিকে চেয়ে কী বলছেন আর একজন ছাত্র ক্লোরোফর্ম পাম্প করছে। বিমল ও এ্যালিস সার্জনকে সাহায্য করবার জন্যে তৈরি হয়ে আছে। সার্জন হেসে বললেন, সকাল থেকে অপারেশনে টেবিলে মরেছে একুশটা, টেবিল থেকে নামাবার তর সয়নি–গরম জলটা সরিয়ে দাও নার্স

এমন সময়ে মাথার ওপরে কোথায় এরোপ্লেনের শব্দ শোনা গেল।

বাইরে যারা ছিল, তারা দৌড়ে ভেতরে এলে, একটা ছুটোছুটি শুরু হল চারিদিকে।

কে একজন বললে–জাপানি বম্বার!

এ্যালিস বললে– রেডক্রসের লাল আলো জ্বলছে বাইরে–হাসপাতাল বলে বুঝতে পারবে–

সার্জন হেসে বললে–নার্স, ওরা কি কিছু মানছে? শক্ত করে ধরে থাকো তুলোটা—

বালক অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। সার্জন ক্ষিপ্র ও কৌশলী হাতে ছুরি চালাচ্ছেন। বিমল নাড়ি ধরে আছে।

বুম-ম-ম-ম!–বিকট বিস্ফোরণের শব্দ কোথাও কাছেই। তুমুল গোলমাল হইচই, আর্তনাদ, হাসপাতালের বাঁ-দিকের অংশে বোমা পড়েছে। উগ্র ধোঁয়া ও নাইট্রোগ্লিসারিনের গন্ধে ঘর ভরে গেল। সার্জন, বিমল বা এ্যালিসের দৃষ্টি কোনোদিকে নেই–ওরা একমনে কাজ করছে। সার্জন দৃঢ় অবিকম্পিত হস্তে ছুরি চালিয়ে যাচ্ছেন, যেন তার অপারেশন টেবিলের থেকে এক-শো গজের মধ্যে প্রলয়কান্ড ঘটেনি, যেন তনি মোটা ফি নিয়ে বড়োলোক রোগীর বাড়ি গিয়ে নিজের নৈপুণ্য দেখাতে ব্যস্ত; গরম জলের পাত্রে ডোবানো ছুরি, ফরসেপ ঘুচ ক্ষিপ্রহস্তে একমনে সার্জনকে জুগিয়ে চলেছে এ্যালিস, একমনে ব্যাণ্ডেজের সারি গুছিয়ে রাখছে, পাতলা লিন্ট-কাপড়ে মলম মাখাচ্ছে। বিমল নাড়ি ধরে আছে।

বাইরে বিকট শব্দ–হুড়মুড় করে হাসপাতালের বাঁ-দিকের উইং-এর ছাদ ভেঙে পড়ল। মহাপ্রলয় চলেছে সে-দিকে–

সার্জন বললেন–নাড়ির বেগ কত?

বিমল–সত্তর।

কে একজন ছুটতে ছুটতে এসে বললে–স্যার, বাঁ-দিকের উইং গুঁড়ো হয়ে গোটা সেপটিক ওয়ার্ডের রোগী চাপা পড়েছে–এদিকেও বোমা পড়তে পারে–তিনখানা বহুবার–

সার্জন বললেন–পড়লে উপায় কী? নার্স বড়ো ফরসেপটা—

উগ্র ধোঁয়ায় সবারই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আর একটা শব্দ অন্য কোনদিকে হল– আর একটা বোমা পড়েছে–বেজায় ধোঁয়া আসছে ঘরে।

বিমল বললে–স্যার, ধোঁয়ায় রোগী দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে যে? ক্লোরোফর্মের রোগী, এভাবে কতক্ষণ রাখা যাবে?

সার্জন ছুরি ফেলে বললেন–হয়ে গিয়েছে। লিন্ট দাও, নার্স।

বিমল বললে–স্যার, রোগীর নাড়ি নেই। হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল।

সার্জন এসে নাড়ি দেখলেন। এ্যালিস নীরবে ওদের মুখের দিকে চেয়ে রইল।

নাড়ি থেকে হাত নামিয়ে সার্জন গম্ভীর মুখে বললেন–বাইশটা পুরল।

এ্যালিস নিস্পন্দ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে দেখে বললেন–চলো নার্স, স্ট্রেচার-ওয়ালারা এসে লাশ নিয়ে যাবে–এখন সবাই বাইরে চলো যাই–

ওপরওয়ালার আদেশ পেয়ে বিমল আগে এ্যালিসের কাছে এল এবং তাকে আস্তে আস্তে হাত ধরে ধূম্রলোক থেকে উদ্ধার করে ডান দিকের বড়ো দরজা দিয়ে কম্পাউণ্ডের খোলা হাওয়ায় নিয়ে এল।

আকাশের দিকে চোখ তুলে দেখেই এ্যালিসকে বললে–ওই দেখো এ্যালিস, তিনখানা জাপানি বম্বার!—

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress