Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

লেখকের বক্তব্য

এই উপন্যাসটি লালন ফকিরের প্রকৃত ঐতিহাসিক তথ্যভিত্তিক জীবনকাহিনি হিসেবে একেবারেই গণ্য করা যাবে না। কারণ তাঁর জীবনের ইতিহাস ও তথ্য খুব সামান্যই পাওয়া যায়। ভবিষ্যতে আর নতুন কিছু পাওয়ার সম্ভাবনাও খুব কম। জীবিতকালে লালন তাঁর অনুগত সঙ্গী-সাথী ও অনুগামীদের বাইরে একেবারেই পরিচিত ছিলেন না। তাঁর গান আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়লেও মানুষটাকে জানা যায়নি। লালন নিজেও ছিলেন পুরোপুরি প্রচার-বিমুখ এবং সেটা তাঁর জীবন-দর্শনেরও অঙ্গ।

লালনের মৃত্যুর কয়েকদিন পরই কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত ‘হিতকরী’ নামে একটি ক্ষুদ্র পত্রিকায় ‘মহাত্মা লালন ফকীর’ নামে একটি নিবন্ধ মুদ্রিত হয়। এই পত্রিকায় কোনও রচনাতেই লেখকের নাম থাকত না। পত্রিকাটির সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী ছিলেন পরবর্তীকালের প্রখ্যাত লেখক মীর মোশাররফ হোসেন এবং সহকারী সম্পাদক ছিলেন রাইচরণ দাস নামে এক উকিল। রচনাটি খুব সম্ভবত রাইচরণ দাসেরই লেখা, কেননা, মীরসাহেব তখন কুষ্টিয়ায় উপস্থিত ছিলেন না এবং তার ভাষাও ঠিক এরকম নয়।

নিবন্ধকার লালনকে স্বচক্ষে দেখেছেন বলে দাবি করলেও লিখেছেন যে, ‘ইহার জীবনী লিখিবার কোনও উপকরণ পাওয়া কঠিন।’ ওঁর শিষ্যরাও কিছু বলতে চাননি। কিছু কিছু লোকশ্রুতি অনুযায়ী, একটি জীবনীর খসড়া তৈরি করা হয়েছিল। তা এইরকম: কুষ্টিয়ারই কোনও গ্রামে লালনের জন্ম এক কায়স্থ পরিবারে, শৈশবেই পিতৃহীন, অল্প বয়েসেই বিবাহিত। বিধবা মা ও স্ত্রীকে নিয়ে সামান্য অবস্থায় দিনাতিপাত করতেন। একসময় একটি দলের সঙ্গে জুটে গিয়ে লালন গঙ্গাস্নানের পুণ্য অর্জন করার জন্য বহরমপুরে যান এবং ভয়ংকর বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। সঙ্গীরা তাঁকে মৃত মনে করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে গ্রামে ফিরে তার মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে দেয়। কিন্তু তখন লালনের মৃত্যু হয়নি, জীবত অবস্থায় তাকে এক মুসলমান রমণী সেবাশুশ্রুষা করে বাঁচিয়ে তোলেন। এই মহীয়সী রমণীর নামের উল্লেখ নেই কোথাও। লালন বেশ কিছুদিন পর বাড়ি ফিরে আসেন, কিন্তু মুসলমানের গৃহে অন্নগ্রহণ করেছেন বলে হিন্দুধর্মচ্যুত হয়েছেন, গ্রামবাসীরা এই অভিমত দেয়। তার মা এবং স্ত্রীও তাকে মুক্তমনে গ্রহণ করতে পারেননি। তখন ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে লালন ইহকালের মতো গৃহত্যাগ করেন।

লালন লেখাপড়া শেখেননি, অক্ষরজ্ঞানও ছিল না, কিন্তু নিজের চেষ্টায় ও ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় ইসলাম, হিন্দু ও বৈষ্ণব শাস্ত্র সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান অর্জন। করেন। এবং অনেকাংশে ছিলেন সুফিদের সঙ্গে সহমত। স্বতঃস্ফূর্তভাবে গান রচনারও বিস্ময়কর প্রতিভা ছিল তাঁর। লালন ধার্মিক ছিলেন কিন্তু কোনও বিশেষ ধর্মের রীতিনীতি পালনে আগ্রহী ছিলেন না। সব ধর্মের বন্ধন ছিন্ন করে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন জীবনে। এইজন্য গোঁড়া হিন্দু এবং শরিয়তপন্থী মুসলমান, উভয় সম্প্রদায়েরই চক্ষুশূল হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সমাজের নিম্নশ্রেণির এবং নিপীড়িত অনেক মানুষই লালনের অনুগামী হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমানের কোনও বিভেদ ছিল না। নিবন্ধকারের মতে, এই অনুগামীদের সংখ্যা লালনের জীবৎকালের মধ্যেই হয়েছিল অন্তত দশ হাজার।

আত্মানুসন্ধান এবং মনের মানুষকে খোঁজা এবং ঈশ্বর বা আল্লার সঙ্গে ভয় বা ভক্তির বদলে ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপনের ধারা আমাদের সাহিত্যে ও দর্শনে অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। লালন তারই একজন সার্থক উত্তরসূরি। লালনের কোনও উপদেশ বা বাণী কোথাও লিপিবদ্ধ নেই, সম্ভবত তিনি তা বিশ্বাসও করতেন না। তাঁর গানেই তার জীবন-দর্শন প্রতিফলিত। শোনা যায়, তিনি প্রায় এক হাজার গান রচনা করে মুখে মুখে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। সবগুলিরই মৌলিকত্ব প্রমাণ করার উপায় নেই। কিছু কিছু গানে পুনরুক্তি আছে এবং আমার মতে, তিনি রামপ্রসাদী গানের দ্বারা কিছুটা প্রভাবিত। নদীয়ার শ্রীচৈতন্য এবং বৈষ্ণব পদাবলি সম্পর্কেও তিনি অবহিত ছিলেন।

শোনা যায়, লালনের মৃত্যু হয়েছিল ১১৬ বছর বয়সে। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর। বয়সের হিসাবটা কী করে ধরা হয়েছিল, তা বলা মুশকিল। নিরক্ষর, দরিদ্র পরিবারে ঠিকঠাক বয়সের হিসেব রাখার কোনও প্রথাই তখন ছিল না। তিনি দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন, তা বলা যায়। কিন্তু যখন লেখা হয়, মৃত্যুর মাত্র পাঁচ মাস আগেও তিনি ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতেন, তখন মনে প্রশ্ন জাগে, বয়সটা সত্যি না ঘোড়াটা সত্যি? লালনকে সাঁই, ফকির এবং বাউল বলে অভিহিত করা হয়, এর তিনটিই সত্যি এবং একথাও ঠিক, তিনি গৃহস্থ সংসারী ছিলেন। তাঁর বিষয়াসক্তি ছিল না, তবে মৃত্যুকালে তিনি দু’হাজার টাকা রেখে গিয়েছিলেন, তৎকালে তা খুব কম নয়।

আমার এই উপন্যাসে, প্রকৃত তথ্যের স্বল্পতায় অনেক কাল্পনিক চরিত্র আনতে হয়েছে। কিছুকিছু ঐতিহাসিক চরিত্র, যেমনহরিনাথ মজুমদার (কাঙাল হরিনাথ নামে সমধিক পরিচিত), মীর মশারফ হোসেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগন হরকরা প্রমুখ কয়েকজনের কথা থাকলেও ঠিক ঠিক সময়সীমা মানা যায়নি। রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ ও উৎসাহেই লালনের গান বাংলার শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে অনেকখানি পরিচিত হয়। কিন্তু লালনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কখনও প্রত্যক্ষ আলাপ-পরিচয় হয়নি, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যে তা প্রমাণিত। তাই চরিত্র হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে আনা যায়নি। লালনের গানের একটি লিখিত সংগ্রহ রবীন্দ্রনাথ নিয়ে গিয়ে আর ফেরত দেননি, এমন একটা কথা প্রচারিত আছে। এসব কথা পরস্পর-বিরোধী মতামতে ভরা এবং গুজব, তা আর আলোচনার যোগ্যই নয়। রবীন্দ্রনাথ বাউল গানে মুগ্ধ ছিলেন, তাঁর রচনায় কিছু কিছু বাউল গানের প্রভাবও পড়েছে। নিজেকেও তিনি বাউল মনে করতেন, এসব তো আমরা জানিই। দুদ্দু শাহ নামে লালনের এক শিষ্যের নামে রচিত জীবনীতে লালনকে জন্মাবধি মুসলমান প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছিল। ঢাকা এবং কলতার গবেষকরা প্রমাণ করে দিয়েছেন, সে বইটি জাল। তাই উপন্যাসে সেই মত গ্রহণ করারও প্রশ্ন ওঠে না। লালনের জীবনের মূল ভাব ও আদর্শ ফুটিয়ে তোলাই আমার এই রচনার উদ্দেশ্য। কাহিনিটি আধার মাত্র। আর একটি কথাও উল্লেখ করা উচিত। সেকালের কুষ্টিয়া জেলার মানুষের মুখের ভাষা আমি সংলাপে ব্যবহার করিনি। তা আমার অসাধ্যও বটে। কোথাও কোথাও সামান্য আভাস দিয়েছি মাত্র।

প্রখ্যাত লালন-বিশেষজ্ঞ এবং লোক-সাহিত্যের গবেষক ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরী একসময় ঢাকায় আমাকে তাঁর ‘লালন সাঁইয়ের সন্ধানে’বইটি উপহার দিয়ে মৃদুকণ্ঠে বলেছিলেন, লালনের জীবন নিয়ে একটা উপন্যাসের কথা ভাবতে পারেন না? বস্তুত লালন ও হাসন রাজাকে নিয়ে কাহিনি নির্মাণের কথা আমার মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে। কিছু পড়াশুনোও করেছি। কিন্তু আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে আমার অপারগতার জন্য ভয় পেয়েছি। হঠাৎ মনে হল, মূল বাংলা ভাষায় লিখলেই বা ক্ষতি কী? তবু দ্বিধা কিংবা সংশয় থেকেই যায়। উপন্যাসটির অনেকটা অংশই রচনা করেছি প্রবাসে। তখন নিউ ইয়র্কের সৈয়দ শহীদ আমাকে লালন সংগীতের অনেকগুলি সিডি সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। লেখার সময় গানগুলি অনবরত কানের কাছে বাজত। আবুল আহসান চৌধুরী এবং সৈয়দ শহীদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

বেশ কিছু জায়গাতেই আমি লালন কিংবা সিরাজ সাঁই-এর সংলাপ নিজে বানাইনি। লালনের গান থেকেই যথাসাধ্য ভেঙে ভেঙে ব্যবহার করেছি। যেমন তিব্বতের বিবাহ প্রথা, যীশু এবং একই সঙ্গে শূকর ও গোমাংস ভক্ষণের নির্দেশ, আলিপুরের কাছাড়ি, রংমহল ইত্যাদি লালনের গানেই আছে। গল্পের গতি ব্যাহত হয় বলেই পুরো গান উদ্ধৃত করিনি। সেই জন্যেই, পরিশিষ্টে আমি লালনের গানের একটি নির্বাচিত সংকলন যোগ করার প্রয়োজন বোধ করেছি। কেউ যদি লালনের জীবন-দর্শন এবং তাঁর সমসাময়িক কাল সম্পর্কে আরও বেশি জানতে আগ্রহী হন, তাই কয়েকটি অতিপ্রয়োজনীয় গ্রন্থের নামও যুক্ত করা হল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
Pages ( 13 of 13 ): « পূর্ববর্তী1 ... 1112 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *