Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মনের মানুষ || Sunil Gangopadhyay

মনের মানুষ || Sunil Gangopadhyay

একজন চোর ধরা পড়েছে

একজন চোর ধরা পড়েছে মাঝ রাত্তিরে। তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে উঠোনে একটা খুঁটিতে। সকালবেলা তার বিচার হবে।

গড়াই নদীর ধারে কবিরাজ কৃষ্ণপ্রসন্ন সেনের বাসগৃহে মানুষজনের সংখ্যা অনেক। তাঁর দুই স্ত্রী ও সাতটি পুত্র-কন্যা, আত্মীয়-পরিজন ও আশ্রিত, সব মিলিয়ে উনিশজন। পাকের ঘরে উনুনের আগুন নেভে না, উদয়-অস্ত চলে অন্ন-ব্যঞ্জন রন্ধন। একটি বেশ বড় বৃত্তাকার উঠোন ঘিরে মোট সাতটি টিনের চালার ঘর, একদিকে একটি কোঠা বাড়ি। গাছপালা প্রচুর।

এই গৃহ চত্বরের দুদিকে দুটি পুষ্করিণী। তার একটির ধারে ধারে কয়েক ঘর ধোপা, নাপিত ও জেলের বাস। কবিরাজ মশাই-ই তাদের জমি দিয়েছেন, তাই সংবৎসর সেবা পান। গোয়ালঘরে আছে পাঁচটি গরু এবং পাশের আস্তাবলে একটি ঘোড়া।

কবিরাজ মশাই প্রতিদিন ব্রাহ্ম মুহূর্তে শয্যা ত্যাগ করেন। তারপর এ-বাড়ির আর কারও ঘুমিয়ে থাকার উপায় নেই। ভোর হতে না-হতেই শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। রাত্তিরেও সব কিছু মিটিয়ে বাতি নিভিয়ে দিতে অনেক দেরি হয়। তার পরেও দুজন ব্যক্তি বল্লম হাতে পাহারায় থাকে। সুতরাং এ-বাড়িতে চোর আসা অতি দুর্লভ ঘটনা।

গাত্রোত্থানের পরই কবিরাজমশাইকে চোর ধরা পড়ার খবর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি প্রাতঃকৃত্য ও স্নানের পর পুজোয় বসেন এবং পুজো শেষ করার আগে তিনি বিশেষ কথা বলেন না। কোনওদিন তাঁর এই নিয়মের ব্যত্যয় হয় না।

খুঁটির সঙ্গে বাঁধা চোরটির বয়স হবে চব্বিশ-পঁচিশ। ডাকাত বললেই যেমন গুম্ফধারী ষণ্ডমার্কা চেহারার পুরুষের কথা মনে হয়, তেমন চোর শুনলেই মনে হয় যেন রোগা, ক্যাংলা, কালো কালো চেহারার মানুষ। এ চোর কিন্তু তেমন নয়, গৌরবর্ণ, দীর্ঘকায়, মাথা-ভরতি চুল। একটা ছেঁড়া ধুতি মালকোঁচা মেরে পরা, খালি গা। যথেষ্ট মার খেয়েছে, পিঠে সেই দাগ।

বেলা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গরমও বেড়ে যায়। এখন রৌদ্র অতি প্রখর। আকাশে কিছু কিছু মেঘও জমছে, তাই ঘামে বুক ও পিঠ ভিজে যায়। চোরটিও এখন ঘর্মাক্ত, সে মুখ নিচু করে আছে, তাকাচ্ছে না কারুর দিকে, শুধু মাঝে মাঝে কাশছে খুক খুক করে।

বাড়ির বাচ্চা-কাচ্চারা সার বেঁধে বসে আছে একটু দূরে। তাদের সবার চোখে বিস্ময়। আরও কিছু মানুষ ভিড় জমিয়েছে, কবিরাজমশাই কী বিচার করেন, তা জানার জন্যই সকলের কৌতূহল। কিছুদিন আগে কুমারখালিতে এক চোরকে হাত বেঁধে একটা অশত্থগাছের উঁচু ডালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল, দুদিন পরে সেখানেই সে অক্কা পায়। একটা তক্ষক সাপ নাকি তাকে দংশেছিল।

রোদ ওঠার পর খড়ম খটখটিয়ে কবিরাজমশাই এসে দাঁড়ালেন উঠোনে। তাঁর পরনে পট্টবস্ত্র ও একটি উড়নি। শীত-গ্রীষ্ম কোনও সময়েই তিনি সেলাই করা বস্ত্র পরিধান করেন না। বয়স হয়েছে ঢের, কিন্তু এখনও বার্ধক্য তাঁকে কাবু করতে পারেনি। মাথার চুল সব সাদা।

একটুক্ষণ চোরের দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, জিনিসপত্র কিছু সরিয়েছে?

যদু ও জগাই নামে দুই পাহারাদার এসে দাঁড়িয়েছে কাছে। চোর ধরার কৃতিত্ব এদেরই।

জগাই বলল, না হুজুর, কিছু সরাতে পারেনি। তার আগেই হাতে-নাতে ধরেছি।

কোথায় ধরলি?

রাত্তির তখন দুই প্রহর হবে, হুজুর। হঠাৎ শুনি ঘোড়াটা চিঁহি করে উঠল। তারপর লাফালাফি করতে লাগল। সন্দেহ হতেই আমরা দুইজন দৌড়ায়ে গেলাম। তখন দেখি এ সম্বুন্ধির পো ঘোড়ার বাঁধন খুলতেছে–

চোরটির থুতনি বুকে ঠেকে গিয়েছিল, এবার সে মুখ তুলে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, না কর্তা, আমি বাঁধন দিতেছিলাম!

জগাই চেঁচিয়ে বলল, চোপ! কথা কবি না?

কবিরাজমশাই বললেন, ওরে, আমার জলচৌকিটা নিয়ে আয়।

একজন কেউ দৌড়ে ভেতর বাড়ি থেকে একটা জলচৌকি নিয়ে এল। কবিরাজমশাই তার ওপর বসে বললেন, তামাক দে।

তারপর চোরের দিকে চেয়ে বললেন, আমার ঘোড়া চুরি করতে এসেছিলি। তুই তো মহা বলদ! এই ঘোড়া সবাই চেনে। তোর কাছ থেকে কে খরিদ করত? কেউ না!

ঘোর বর্ষার সময় সব দিক জলমগ্ন হয়ে যায়। তখন নৌকো ছাড়া যাতায়াতের কোনও অন্য উপায় থাকে না। শীত-গ্রীষ্মে হাঁটা পথ। একটু দূরে রুগি দেখতে যেতে হলে কৃষ্ণপ্রসন্ন ঘোড়াতেই যান। অনেকদিনের অভ্যাস। এই টাট্ট ঘোড়াটির নাম মানিকচাঁদ।

কৃষ্ণপ্রসন্ন সম্পন্ন গৃহস্থ। জমি জমা ও ফলের বাগান আছে। বাড়িতে দুধ-ঘি ও মাছ-ভাতের অভাব নেই। এই বয়সে অর্থ উপার্জনের জন্য তাঁর আর রুগি দেখার জন্য দূর-দূরান্তে যাবার প্রয়োজন হয় না, তবু কোনও সংকটাপন্ন রুগির বাড়ি থেকে ব্যাকুল ডাক এলে তিনি প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না।

চোর আবার বলল, কর্তা, আমি ঘোড়া চুরি করি নাই। ফিরত দিতে এসেছিলাম।

এ-কথায় অন্যদের মধ্যে একটা হাসির তরঙ্গ খেলে গেল।

কবিরাজমশাইও হেসে বললেন, সে কী রে, ঘোড়া আমার। তোরে কি কখনও দিছি যে, তুই ফিরত দিবি? চোরে কোনওদিন কি কিছু ফিরত দেয়?

যদু ধমক দিয়ে বলল, চোপ! তোরে আমরা বাঁধন খোলতে দেখছি।

চোর আবার শান্তভাবে বলল, না, খোলতে দেখো নাই। যখন আমি নিছিলাম, তখন বাঁধন ছিল না, ছাড়াই ছিল।

লোকটার কণ্ঠস্বরের সারল্যে কবিরাজ খানিকটা বিস্মিত হলেন। ঘাঘু চোরেরা এভাবে কথা বলে না। তিনি কয়েক মুহূর্ত তার দিকে চেয়ে থেকে বললেন, এই হারামজাদাটা কয় কী! আমার মানিকচাঁদরে আগেই নিছিল। কই রে, তামাক দিলি না? আর এই চোরটার হাতের দড়ি খুলে আমার সামনে নিয়ে আয়।

কবিরাজমশাই এসব আদেশ কোনও ব্যক্তিবিশেষের দিকে তাকিয়ে করেন। সবসময় তাঁর হুকুম পালনের জন্য কাছাকাছি একগন্ডা লোক থাকে।

একজন তাঁর হাতে হুঁকো এনে ধরিয়ে দিল। যদু ও জগাই খুঁটি থেকে চোরটিকে খুলে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এল মনিবের সামনে। সে মাটিতে হাঁটু গেড়ে, হাতজোড় করে বসল।

কবিরাজ হুঁকোয় দুটান দেবার পর জিজ্ঞেস করলেন, কী কইলি, ঠিক করে ক তো! হেঁয়ালি করবি তো এই খড়ম দেখছিস। তোর মাথায় ভাঙব। তুই আমার ঘোড়া চুরি করতে আসিস নাই?

না কর্তা।

মিথ্যা কথা বলে পার পাবি? আমারে চেনোস না। আরও কাছে আয়, মাথাটা ঝুঁকা।

কবিরাজ সেই চোরের কপালটা ভালো করে দেখলেন। একটা আঙুল রাখলেন দুই ভুরুর মাঝখানে।

বিড়বিড় করে আপনমনে বললেন, এটা যে চোর, তা তো ললাটে লেখা নাই, বরং দেখি বড় একটা ফাঁড়া আছে। দুই এক বৎসরের মধ্যে মৃত্যুযোগ। আবার চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লে তো পিট্টি খেয়েই মরবি!

চোর এবার যা খুলে বলল, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য মনে হয়। ঘোড়া চুরি করা তার উদ্দেশ্য নয়। গতকাল রাতে সে ঘোড়াটাকে নিয়ে গিয়েছিল অনেক আগে, তখন কেউ টের পায়নি। ফিরিয়ে দিতে আসার পর সে দুবার কেশে ওঠে, তাতেই ধরা পড়ে। এর আগেও কয়েকবার সে ঘোড়াটাকে নিয়ে গিয়ে চড়েছে। তাতে কোনও দোষ হয় বলে সে বোঝেনি, সে ক্ষমা চাইছে।

কবিরাজ প্রশ্ন করলেন, ঘোড়া নিয়ে তুই কোথায় যাস?

চোর বলল, কোথাও যাই না, কর্তা। মাঠের মধ্যে ঘুরি, বড় ভালো লাগে। এক এক সময় মনে হয়, কোন দুর দেশে চলে গেছি, কোথাও কেউ নাই, কুলকুল করে নদী বয়ে যাচ্ছে।

তাকে থামিয়ে দিয়ে কবিরাজ বললেন, তুই সত্য কথা বলছিস কি না এখনই বোঝা যাবে। ওরে, কেউ আমার মানিকচাঁদরে এখানে নিয়ে আয়।

কেউ একজন দৌড়ে গিয়ে টাট্টু ঘোড়াটাকে লাগাম ধরে নিয়ে এল।

কবিরাজ চোরকে বললেন, তুই ওর পিঠে চাপ দেখি আমার সামনে। আমার মানিকচাঁদ কোনও অচেনা মানুষরে পিঠে রাখবেই না!

চোর উঠে দাঁড়িয়ে প্রথমে মানিকচাদের গলকম্বলে হাত দিয়ে একটু আদর করল। তারপর তড়াক করে চেপে বসল তার পিঠে।

মানিকচাঁদ স্থির রইল। অর্থাৎ এই সওয়ারকে সে চেনে।

চোর এবার ঘোড়াটাকে নিয়ে উঠোনে ঘুরপাক দিল দুবার। এখন হঠাৎ যেন তার চেহারাটা বদলে গেছে। ছেঁড়া ধুতি পরা, নগ্ন পিঠে রক্তের দাগ, মাথার চুলে ধুলো, তবু সে যেন এক অজানা দেশের মানুষ।

কবিরাজ বললেন, ঠিক আছে, নাম। তোর যা হয়েছে, তারে বলে গরিবের ঘোড়া রোগ। এই রোগের নিদান নাই। দেখিস, তোর কপালে কিন্তু ফাঁড়া আছে।

উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ফিরত দিস আর যাই-ই করিস, না-বলে নিছিলি, তারে তো চুরিই বলে। সেজন্য তো শাস্তি পেতে হবে। তোর দুই হাতের দুইটা বুড়া আঙুল কেটে দিলে তুই জীবনে আর কিছু চুরি করতে পারবি না। কি? না, না, তোর ভয় নাই, তোরে আমি লঘু শাস্তি দেব।

এক পাশে ফিরে বললেন, ওরে, পরশু রাতের ঝড়ে যে-জারুলগাছটা উলটে পড়েছিল, সেটা কাটা হয়েছে?

কেউ একজন বলল, না, হুজুর, এখনও কাটা শুরু হয় নাই।

কবিরাজ বললেন, হু। এরে পুকুর ধারে নিয়ে যা, একটা কুড়াল দে। এই শোন, ওই বড় গাছটার সব ডালপালা কাট। পুকুরের ঘাটলার ডাইন দিকে সব কাঠ সাজিয়ে রাখবি, এই তোর সাজা।

তিনি চলে গেলেন কাছারি ঘরের দিকে।

এর মধ্যেই কিছু রুগি এসে অপেক্ষা করে আছে। কবিরাজমশাইকে রুগি দেখার আগে কিছুটা সময় বিষয়-কর্মে ব্যয় করতে হয়। বছরের এই সময়টায় স্বয়ং জমিদার আসেন কলকাতা থেকে। শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে গিয়ে তাঁকে নজরানা দিতে হয়। খাজনার হিসাবপত্রও সব তৈরি রাখা দরকার।

আজ আবার পাশের দুটি গ্রামে দুজন রুগি দেখতে যেতে হবে, তাদের মধ্যে একজন প্রায় মরণাপন্ন। কিন্তু মধ্যাহ্নভোজনের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম না নিয়ে তিনি কোথাও যান না। দ্বিতীয় রুগিটির বাড়ির লোক এসে বসে আছে, তা থাকুক, তাঁকে তো নিজের শরীর-স্বাস্থ্যের কথাও ভাবতে হবে। যার আয়ু শেষ হয়ে এসেছে, তাকে তো তিনি ঔষধ দিয়েও বাঁচাতে পারবেন না।

বিকেলের রোদ একটু নরম হলে কবিরাজমশাই রওনা দিলেন।

তিনি যান ঘোড়ার পিঠে, ওষুধের বাক্স আর বল্লম হাতে নিয়ে যদু যায় এক পাশে, আর অন্য পাশে রুগির বাড়ির লোক। তিনি জোরে ঘোড়া ছোটান না, যান দুলকি চালে, পাশের লোকদেরও দৌড়োতে হয় না।

কবিরাজের অর্থ লোভ নেই, কিন্তু তাঁর ভিজিট দুটাকা ধার্য করা আছে। নইলে রুগির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না, অনেকেই তো তাঁকে বাড়ি নিয়ে যেতে চায়।

যাদের ভিজিট দেবার সামর্থ্য নেই, তারা গ্রামের রাস্তায় কবিরাজকে আসতে দেখলেই ছুটে আসে! কত মানুষের কতরকম রোগ-ব্যাধি, চিকিৎসার সুযোগ নেই। কবিরাজ কিন্তু ঘোড়া থামান না, যদু সামনে থেকে লোকজনদের সরিয়ে দেয়, তিনি লোকের অসুখের বিবরণ শুনতে শুনতেই দু-একটা আলগা উপদেশ দিয়ে চলে যান।

ফিরে আসতে আসতে তাঁর সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। আকাশ কিছুটা মেঘলা থাকলেও অল্প অল্প জ্যোৎস্না আছে, তাই খুব অসুবিধে হয়নি। তা ছাড়া ফেরার সময় মানিকচাঁদ নিজেই পথ চিনে চলে আসে।

বাড়িতে ঢোকার আগে বামদিকের পুষ্করিণীর ঘাটে নেমে ভালো করে। মুখ-হাত-পা ধুয়ে নিতে হয়। ওষুধের পেটিকার মধ্যে একটা ছোট মাটির ঘটে গঙ্গাজল থাকে। সেই পবিত্রজলের একটুখানি মাথায় ছিটিয়ে নিলেই শরীর শুদ্ধ হয়ে যায়।

এই গঙ্গা বর্জিত দেশে গঙ্গার জল অনেক কাজে লাগে বটে, তবে দামও আছে। এক একটা ঘটের দাম দশ পয়সা। শেঠ কোম্পানির গঙ্গাজলই বিশ্বাসযোগ্য।

কবিরাজমশাই ঘাটে নেমে হাত পা ধুতে ধুতে কাছেই কোথাও খটাখট শব্দ শুনতে পেলেন।

কৌতূহলী হয়ে তিনি যদুকে বললেন, ও কীসের শব্দ, দ্যাখ তো?

যদু দৌড়ে গিয়ে দেখে এসে বলল, জারুলগাছটা কাটা চলতাছে।

কবিরাজ জিজ্ঞেস করলেন, এই রাত্তিরে কে গাছ কাটে?

যদু বলল, সেই চোরটা। আপনে আজ্ঞা দিছিলেন।

সারাদিনের ব্যস্ততায় কবিরাজ ভুলেই গিয়েছিলেন চোরের কথা। বিস্মিতভাবে বললেন, সে এখনও… ডাক তো তাকে!

যদু তার হাত ধরে টেনে নিয়ে এল।

ফ্যাকাশে জ্যোৎস্নায় তার ঘর্মাক্ত শরীরের দিকে তাকিয়ে কবিরাজ বললেন, সেই সকাল থেকে তুই এখনও গাছ কেটে চলেছিস?

চোর বলল, বড় গাছ। জারুল কাঠ শক্ত হয়, শেষ হয় নাই। শেষ না-করে যাব কী করে কর্তা!

সারাদিন ধরে তুই গাছ কেটেই চলেছিস?

আজ্ঞে না। অপরাধ মাপ করবেন। একসময় একটু ঘুমায়ে পড়েছিলাম। কাল রাইতে তো ঘুম হয় নাই, হঠাৎ ঘুম এসে গেছে, সেই সময়টায় কাজ করতে পারি নাই।

সারাদিন খেয়েছিস কিছু?

চোর এবার চুপ করে রইল। কবিরাজ সে নীরবতার অর্থ বুঝলেন। এ চোরটির সব কিছুই বড় বিচিত্র। ঘোড়া চুরি করে, আবার ফেরত দেয়। গাছ কাটতে বলা হয়েছে, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খেটেই চলেছে। কেউ পাহারায় নেই, তবু পালায়নি। সারাদিন না খেয়ে আছে।

কবিরাজ আবার জিজ্ঞেস করলেন, তোর নাম কী? থাকিস কোথায়?

সে বলল, কর্তা, এই অধমের নাম লালমোহন কর। পিতার নাম ঈশ্বর রাধামাধব কর। তবে সবাই লালু বলেই ডাকে। থাকি দাসপাড়ায়।

কবিরাজ বললেন, বুঝলাম, তুই জাত-চোর না। তবে একটা কথা কই শুনে রাখ। যখন নিজে উপার্জন করে ঘোড়া কিনতে পারবি, তখনই ঘোড়ায় চড়িস। অন্যের ঘোড়ায় চাপার শখ থাকলে, সারাজীবন কপালে দুঃখই থাকবে। এখন যা, তোর ছুটি।

কবিরাজের দুই পত্নী থাকে দুটি মহলে। জ্যেষ্ঠাটিই সংসারের গৃহিণী। সকলের খাওয়া-পরা, দেখাশোনার ভার তাঁর ওপর। তাঁর নাম গিরিবালা। ইদানীং কবিরাজমশাই রাত্রি কাটান ছোট বউ শোভাময়ীর কাছে, কিন্তু রাত্রির আহার করেন গিরিবালার পরিবেশনায়। তাতে কারুরই কোনও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ থাকে না।

রাত্রিবেলা কবিরাজ রান্না করা আহার্য গ্রহণ করেন না। প্রতি রাতেই ফলাহার। চিঁড়ে, দই, কলা বা আম, গুড়, ক্ষীর ইত্যাদি।

পশমের আসনে বসে খাওয়া শুরু করার পর তিনি গিরিবালার কাছে সংসারের খবরাখবর নেন। ছেলে-মেয়েদের কথাও এই সময়েই শোনেন।

কিছুক্ষণ কথা বলার পর তিনি বললেন, দিঘির ধারে একটা লোককে ঝড়ে উলটানো গাছটা কাটতে বলে গেছিলাম, তাকে কিছু খাবার দাও নাই?

গিরিবালা বললেন, আমারে তো কিছু বলে যান নাই! কেউ আমারে কিছু খবরও দেয় নাই। কে লোকটা?

ওই যে ঘোড়া চুরির দায়ে ধরা পড়েছিল। তাকে ওই শাস্তি দিছিলাম।

চোর? তাকে বাড়িতে ডেকে এনে জামাই-আদর করে খাবার দিতে হবে? কোন অজাত-কুজাত তা কে জানে!

চোরটা কিন্তু খুব বিশ্বাসী। সেই সকালে গাছ কাটতে বলে গেছি। একটা আস্ত জারুল গাছ। ও রাত পর্যন্ত কেটেই চলেছিল। ভেগে পড়েনি, এমন কখনও শুনেছ।

গিরিবালা গালে হাত দিয়ে বললেন, এদিকে বলছেন চোর, আবার বলছেন বিশ্বাসী। এমন কথাও তো কখনও শুনি নাই। চোরের কথা শুনলেই আমার ডর লাগে।

গিরিবালার পেছনে একজন দাসী বসে আছে। সে ফিসফিস করে বলল, কত্তামা, ওই লোকটারে আমি আগে দেখেছি, ভাঁড়ারার হাটতলায় যে-যাত্রা হয়, গৌর-নিতাই পালা, তাতে ওই লোকটা গান গাইছে। ভালো গায়।

গিরিবালা বললেন, তুই চুপ কর!

কবিরাজমশাই কৌতূহলী হয়ে বললেন, তাই নাকি? চোর আবার গান করতেও পারে? তুই নিজের কানে শুনেছিস?

দাসীটির নাম বীণা, সে বলল, আঁইজ্ঞা কত্তা, দোল পুন্নিমার সময় নেত্যবাবুর আটচালায় যে তিন দিন যাত্রা হইল, তাইতে একদিন ও নেতাই সেজেছিল। দুই হাত তুলে গান…

বাপের বাড়ি থেকে আনা দাসীর এরকম আগ বাড়িয়ে কথা বলার বেয়াদপি গিরিবালার সহ্য হল না। তিনি ধমক দিয়ে বললেন, তুই যাত্রাপালা শুনতে গেছিলি কার হুকুমে? অ্যাঁ? খুব পাড়া বেড়াইন্যা মাইয়া হইছোস, তাই না?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
Pages ( 1 of 13 ): 1 23 ... 13পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress