মনের মানুষ
ছোটবেলা থেকেই বই পড়তে ভালবাসত মেয়েটি। মাত্র দশ বছর বয়সে ক্ষুধিত পাষাণ থেকে ডাকঘর, নৌকাডুবি থেকে জীবনস্মৃতি, ছিন্নপত্র, রাজর্ষি, বৌঠাকুরাণীর হাট, শারদোৎসব থেকে গল্পগুচ্ছের নানা লেখা – পড়েছে । যিনি এত সুন্দর গল্প-কবিতা লিখতে পারেন, না জানি কত সুন্দর মনের মানুষ তিনি! এমনই এক মুগ্ধতা মেশানো কল্পনা নিয়েই কিশোরী চিঠি লিখল রবিঠাকুরকে৷ আর কী আশ্চর্য, উত্তরও এল সেই চিঠির! কিশোরী পাঠিকার সরল উচ্ছ্বাস বড় ভালো লেগেছিল প্রৌঢ় মানুষটির। একটু একটু করে পত্রমিতালি গড়ে উঠেছিল অসমবয়সী দুজন মানুষের মধ্যে। এক চিঠিতে কিশোরী লিখল, “আপনাকে দেখতে আমার খু-উ-উ-উ-উ-উ-উ-ব ইচ্ছে করে।”
কিশোরী রাণুর বয়স তখন ১৪।সেই আশ্চর্য মেয়ে, রাণু অধিকারী, ইতিহাস যাকে চেনে লেডি রাণু মুখার্জি নামে।রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রাণুর প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে শান্তিনিকেতনে। সন্তানশোকে বিমর্ষ রবীন্দ্রনাথ স্নেহে-প্রেমে আঁকড়ে ধরলেন রাণুকে। একের পর এক চিঠিতে দুজনেই উজাড় করে দিয়েছেন নিজেদের সবটুকু। বয়সের ব্যবধানেও কখন অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি সেই স্নেহ-প্রীতির সম্পর্ক। সেসময় রবীন্দ্রনাথ রাণুকে লিখছিলেন ”খুব বেদনার সময় তুমি যখন তোমার সরল এবং সরস জীবনটি নিয়ে খুব সহজে আমার কাছে এলে এবং এক মুহূর্তে আমার স্নেহ অধিকার করলে তখন আমার জীবন আপন কাজে বল পেলে”এই কাজ, সাহিত্যসাধনা৷ শোক কাটিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন। কবিতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, সাহিত্যিক চিঠি- লেখার যেন বান ডেকেছে। তাঁর এই আশ্চর্য কর্মদক্ষতায় সেদিন চমকে উঠেছিল সবাই । এই বিপুল কর্মযজ্ঞের প্রেরণাবিন্দুটিকে খোঁজার চেষ্টাও চলছিল। সেই ইন্সপিরেশন যে কিশোরী পাঠিকা রাণু স্বয়ং, সেকথা লুকোননি রবীন্দ্রনাথ।
বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রতি নতুন বউঠান কাদম্বরীর আগ্রহ দেখেই রাধাকৃষ্ণ প্রেম’কে বিষয় করে কবিতা লেখায় মন দিয়েছিলেন কিশোর রবি। ভানুসিংহ ছদ্মনামে লিখে ফেলেছিলেন পদাবলী। সেই শেষ। ১৮৮৪ সালে আত্মহত্যা করেন কাদম্বরী দেবী। বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রতি নতুন নতুন বউঠানের স্মৃতিতে বহু কবিতা লিখলেও ভানুসিংহ নামের আড়ালে আর কখনও কবিতা লিখতে দেখা যায়নি রবীন্দ্রনাথকে৷
কাদম্বরীর মৃত্যুর প্রায় ৪৬ বছর পর, ১৯৩০ সাল নাগাদ প্রকাশ পেল ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পত্রাবলি’। আশ্চর্যজনকভাবে আবার ফিরে এসেছিলেন ভানুসিংহ। ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের সে এক আশ্চর্য সম্ভার। পত্রাবলীর প্রথম পাতায় কিশোরী রাণুকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি
তুমি আমাকে রবি বাবু বলে ডেকো না, ওটা সবার জন্য। তুমি আমাকে ভানু দাদা বলতে পারো, যদিও ভানু নামটি খুব সুখশ্রাব্য নয়, তবুও একসময় আমি ওই নামটি নিজেকে দিয়েছিলাম।” রাণুর হাত ধরেই ভানুর এই পুনর্জন্ম, তাতে সন্দেহ নেই৷ কিন্তু সে কি শুধুই ধ্বনি মিলের খাতিরে? প্রৌঢ় কবির ভিতরে রাণুই আবার জাগিয়ে তুলেছিল জীবনরসে ভরপুর, উদ্দাম, উচ্ছল এক নবীনকিশোরকে, যাকে বহুবছর আগে এক বসন্ত সন্ধ্যায় শোক-সন্তাপের অন্ধকারে হারিয়ে ফেলেছিলেন কবি।
লেডি রাণু মুখার্জির চেহারার সঙ্গে কাদম্বরী দেবীর চেহারার না কি মিল ছিল খুব! তেমনই লম্বাটে মুখের ছাঁদ, টানা টানা নাক-চোখ… সেই সাদৃশ্যই কি তবে প্রৌঢ় রবিকে আরও একবার উদ্বেলিত করেছিল! মনে পড়ে গেছিল, হারিয়ে যাওয়া আর এক প্রিয় মানুষের মুখ!
শিলং-এ বেড়াতে গিয়ে কবিকে পথে-পথে দেখা গেল বছর সতেরোর এক তরুণীর সঙ্গে। কে সেই তরুণী? এ ব্যাপারে ইতিহাস একেবারে নীরব। যদিও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলে সে মেয়ের ধরণধারণ, সাজপোশাক অনেকটা যেন কাদ্ম্বরীর মতো। কে বলবে অসমবয়সী দুজন? কবির সঙ্গিনীর কাছে তিনি যে ‘সাতাশ’ বছরের নব্যযুবক। রসিকতায় কম যান না ৬২ র চিরতরুণ কবিও। উত্তরে তিনি না কি বলেছিলেন, “সাতাশ’কে লোকে ‘সাতাশি’ শুনবে, বরং ‘ছাব্বিশ’ ভাল! “
‘শেষের কবিতা’র লাবণ্য আসলে রাণুরই প্রতিমূর্তি। লাবণ্যর রূপ থেকে পরিবার, সব বর্ণনাই যেন হুবহু মিলে যায় রাণু অধিকারীর সঙ্গে। লাবণ্য’র বাবার মতো রাণুর বাবা ফণীভূষণ অধিকারীও ছিলেন অধ্যক্ষ, কাশীর হিন্দু কলেজে পড়াতেন। রাশভারী, গম্ভীর, বইমুখো মানুষ তিনিও। লাবণ্যর রবীন্দ্রানুরাগ, সেও যেন রাণুরই ছায়ায়। আর উপন্যাসের শেষে অমিত-লাবণ্য’র প্রেমের ইতি ঘটেছিল লাবণ্য’র বিবাহে।বাস্তবেও রাণু আর ভানুর জীবনে একই মিল দেখি।
এই সময় রাণু আর ভানুকে নিয়ে কথা চালাচালি হয়েছিল শান্তিনিকেতনে। প্রবল রবীন্দ্র-অনুরাগী মা-ই চাইলেন তাঁর একমাত্র মেয়েকে রবীন্দ্র-বলয় থেকে সরিয়ে নিতে। এই জোর করে তৈরি করা দূরত্বে আপত্তি ছিল রবীন্দ্রনাথের। রাণু যেখানেই যাক রাণুর সাথে তার রবিদাদার যোগাযোগ না থাকলে রাণুর অস্তিত্ব-সংকট দেখা যাবে, এমন ভয়ও পেয়েছিলেন। পরে কী ভেবে কে জানে নিজেই গুটিয়ে যান। একের পর এক চিঠি লিখেও আদরের ভানুদাদার কাছ থেকে সাড়া পেত না রাণু। ততদিনে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো প্রভাব ফেলেছে রবীন্দ্রমানসে। কিন্তু অতশত রাণু বুঝবে কেন! প্রবল অভিমান নিয়ে ১৯২৫ সালে এক চিঠিতে ১৮ বছরের যুবতি রাণু লিখলেন ৬৩ বছরের রবীন্দ্রনাথকে-
“আমি কাউকেই বিয়ে করবো না– আপনার সঙ্গে তো বিয়ে হয়ে গেছে। ভানুদাদা, আপনি হয়তো মানবেন না কিন্তু আমি মানি… মনে মনে জানব যে একদিন আমি ভানু দাদার সমস্ত আদর পেয়েছি”
এ চিঠি লেখার কিছুদিনের মধ্যেই রাণুর বিয়ে হয়ে যায় স্যার বীরেন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সেই রাণু অধিকারী পরিচিত হলেন লেডি রাণু মুখার্জি নামে। কবির ঢেউ খেলানো চুলের প্রতি ভারী মোহ ছিল রাণুর। তাই বিয়ের রাতে সোনার কাসকেটে সাজিয়ে নিজের মাথার কয়েকগুছি চুল রাণুকে উপহার স্বরূপ পাঠিয়েছিলেন কবি।
দাম্পত্য-সঙ্গী হিসাবে বীরেন্দ্রনাথ মন্দ ছিলেন না। কিন্তু তাঁর উপস্থিতিই যেন দূরে ঠেলে দিয়েছিল রাণুর ভানুদাদাকে। রাণুকে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “তোমার নিমন্ত্রণ আমি ভুলব না- হয়তো তোমাদের বাড়িতে একদিন যাব, কিন্তু তার আগে তুমি যদি আর-কোনো বাড়িতে চলে যাও? সংসারে এই রকম করেই গল্প ঠিক জায়গায় সম্পূর্ণ হয় না।”
রাণুও কি ভুলতে পেরেছিলেন ভানুদাদাকে। জীবনের শেষদিকে একটা চিঠিতে ৯৪ বছরের একাকী প্রৌঢ়া তাঁর হারিয়ে যাওয়া ভানুদাদার উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন- ‘আমার পনেরো বছর বয়েসের শরীর তোমার চোখে ছিল ভরা পূর্ণিমা, তুমি সেকথা জানিয়েছ তোমার একটি গানে, ওই গানেই বলেছ আমি যখন ঘুমিয়ে থাকি তখন তুমি আমার ঘুমের সুবাস পাও। সে গন্ধ তোমার কাছে প্রথম আষাঢ়ের কেতকী ফুলের সৌরভের মতন। ভানুদাদা, পৃথিবীর আর কোনও পুরুষ কখনও আমার ঘুমের সুগন্ধ পায়নি!’
সমস্ত রকম জাগতিক চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে যে প্রেম, কবিগুরুর প্রতি তেমনই এক অতিমানবিক ভালোবাসা ছিল লেডি রাণুর। তাই দূরত্ব এলেও পারস্পরিক অনুভবের পথে তা বাধা হয়নি কখনও। কবির শেষ বয়সে অসুস্থতার সময়ও পাশে নিঃশব্দে এসেছিলেন। শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এমনই আশ্চর্য বন্ধন অটুট ছিল । বাইরের পৃথিবীর চোখরাঙানিকে হেলায় হারিয়ে দুজনে থেকে গেছেন দুজনের মনের কাছাকাছি…