লিলির ঘর
লিলির ঘর। দিবাকর টেলিফোন রাখিয়া ফিরিয়া আসিল। মন্মথর এতক্ষণে জ্ঞান হইয়াছে; সে মেঝেয় বসিয়া বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো মাথাটি দক্ষিণে বামে আন্দোলিত করিতেছে।
দিবাকর লিলিকে বলিল—তুমিও সোফায় গিয়ে বোসো-ওদের মাঝখানে। হাত তোলো।
লিলি আদেশ পালন করিল। দিবাকর মন্মথর বাহু ধরিয়া টানিয়া দাঁড় করাইল। মন্মথ বিভ্রান্তভাবে বলিল—অ্যাঁ–কি?…আমার সূর্যমণি!
দিবাকর বলিল—কোথায় সূর্যমণি?
মন্মথ ফ্যালফ্যাল করিয়া এদিক ওদিক তাকাইল, লিলির উপর তাহার দৃষ্টি পড়িল।
ঐ–লিলি! আমার সূর্যমণি নিয়েছে।
লিলি বলিল—আমি নিইনি। ঐ যে আপনার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে নিয়েছে। ও কে জানেন? কানামাছি!
ত্রাস-বিকৃতমুখে মন্মথ দিবাকরের পানে তাকাইল।
অ্যাঁ–কানামাছি! দিবাকর কানামাছি! তবে আমার কি হবে! সূর্যমণি—আমার যে দুকূল গেল।
মন্মথ আর্তনাদ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। দিবাকর মন্মথর বাহু ধরিয়া নাড়া দিল। বলিল—কেঁদো না, মন্মথবাবু, তোমার দাদু এখনি আসছেন।
দাদু-আঁ, দাদু আসছেন! তবে এখন আমি কোথায় যাই!
দিবাকর ত্বরান্বিত স্বরে বলিল—মন্মথবাবু, পাগলামি কোরো না, তোমার দাদু আর নন্দা দেবী এখনি এসে পড়বেন। শোনো, আমি যা বলছি করো।
মন্মথ আবার ক্রন্দনোমুখ হইয়া বলিল—আঁ—কিন্তু আমি যে
দিবাকর প্রচণ্ড ধমক দিয়া বলিল—যা বলছি করো।
মন্মথ বলিল-আচ্ছা–কি করব?
দিবাকর মন্মথকে পিস্তল দিল—এই পিস্তল নাও। এইবার ওদের পিছনে গিয়ে দাঁড়াও।—বেশ, ওদের ওপর নজর রাখবে, কেউ একটু নড়লেই তাকে গুলি করবে।
ধমক খাইয়া মন্মথ একটু ধাতস্থ হইয়াছে। সে পিস্তল উঁচাইয়া সোফার পিছনে দাঁড়াইল। দিবাকর তখন দ্রুতপদে দ্বারের কাছে গিয়া শুনিল; বাহিরে মোটরের শব্দ হইল।
দিবাকর ঘরের দিকে ফিরিয়া দাঁড়াইল; তাহার মুখ কঠিন, চোখে একটা অস্বাভাবিক দীপ্তি। ফৌজী কাপ্তেনের মতো কড়া সুরে সে বলিল—ওঁরা এসে পড়েছেন।—যদি প্রাণের মায়া থাকে, তোমরা কেউ একটি কথা বলবে না। যা বলবার আমি বলব।
তাহার হিংস্র চেহারা দেখিয়া কেহ বাঙ্নিষ্পত্তি করিল না। দিবাকর আসিয়া সোফার পাশে দাঁড়াইল; দুই হাত তুলিয়া এমনভাবে দাঁড়াইয়া রহিল যেন সেও দাশুদের দলে, মন্মথ পিস্তল দিয়া সকলকে শাসাইয়া রাখিয়াছে।
যদুনাথ প্রবেশ করিলেন; সঙ্গে নন্দা। ঘরের মধ্যে বিচিত্র পরিস্থিতি দেখিয়া দুজনেই দাঁড়াইয়া পড়িলেন।
এ কি! মন্মথ!—দিবাকর!
দিবাকর ছুটিয়া আসিয়া যদুনাথের পায়ের কাছে পড়িল। তাঁহার জানু জড়াইয়া ধরিয়া ব্যাকুলস্বরে বলিল-ক্ষমা করুন—আমাকে ক্ষমা করুন। আমি অপরাধ করেছি, আপনার সূর্যমণি চুরি করেছি।
যদুনাথ ক্ষণকালের জন্য হতভম্ব হইয়া গেলেন।
আমার সূর্যমণি! চুরি করেছ! কোথায় আমার সূর্যমণি?
দিবাকর সূর্যমণি তাঁহার হাতে দিয়া বলিয়া চলিল—আমি আর এই তিনজন মিলে (সোফায় উপবিষ্ট তিনজকে দেখাইয়া) সূর্যমণি চুরি করে এখানে নিয়ে আসি কিন্তু মন্মথবাবু কি করে আমাদের মতলব জানতে পেরেছিলেন তিনি এসে আমাদের ধরে ফেলেছেন।
মন্মথ অবাক হইয়া শুনিতেছিল এবং দিবাকরের প্ল্যান বুঝিতে আরম্ভ করিয়াছিল। নন্দাও চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া শুনিতেছিল, কিন্তু একটা কথাও বিশ্বাস করে নাই। সত্য ঘটনা যে কী তাহা সে কতকটা অনুমান করিতে পারিয়াছিল।
যদুনাথ বিহ্বলভাবে গিয়া মন্মথকে জড়াইয়া ধরিলেন।
মন্মথ, তুই আজ বংশের মুখ রক্ষে করেছিস।
এদিকে নন্দা ও দিবাকরের কাছে কেহ ছিল না। নন্দা দিবাকরকে চাপা গলায় বলিল
কেন মিছে কথা বলছ! তুমি সূর্যমণি চুরি করনি।
দিবাকর তেমন চাপা স্বরে বলিল-নন্দা, আমাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে দাও। তুমি শপথ করেছ আমাকে সাহায্য করবে।
নন্দা অধর দংশন করিয়া বলিল—কিন্তু
দিবাকর বলিল—সাহায্য করবার এই সময়। ঐ টেলিফোন রয়েছে, যাও, পুলিসে খবর দাও।
নন্দা দ্বিধান্বিতভাবে দাঁড়াইয়া রহিল। যদুনাথ মন্মথকে ছাড়িয়া দিবাকরের কাছে ফিরিয়া আসিলেন, ক্ষুব্ধ ব্যথিত ভর্ৎসনার কণ্ঠে বলিলেন-দিবাকর, তুমি যে আমার সূর্যমণি চুরি করবে এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু যখন অপরাধ করেছ তখন তোমাকে শান্তি পেতে হবে। বুঝতে পেরেছি তোমার লজ্জা হয়েছে, অনুশোচনা হয়েছে। কিন্তু তোমাকে ক্ষমা করার অধিকার আমার নেই। মন্মথ, পুলিসে খবর দিতে হবে।
মন্মথ অভিভূতের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিল। দিবাকর নন্দাকে চোখের ইশারা করিল। নন্দার চোখ জলে ভরিয়া উঠিল, কিন্তু সে অবরুদ্ধস্বরে বলিল—দাদু, আমি পুলিসকে টেলিফোন করছি
নন্দা ঘরের কোণে গিয়া টেলিফোন তুলিয়া লইল।
রাত্রি শেষ হইয়া আসিতেছে।
যদুনাথের গৃহ। নন্দা নিজের ঘরে চেয়ারে বসিয়া আছে; তাহার হাঁটুতে মাথা রাখিয়া মন্মথ মেঝের উপর নতজানু হইয়া আছে। নন্দার মুখ রক্তহীন, চোখের কোলে কালো ছায়া।
মন্মথ সহসা মুখ তুলিয়া বলিল-নন্দা, আমি আর পারছি না। আমি যাই, দাদুকে সত্যি কথা বলি।
নন্দার অধর কাঁপিতে লাগিল।
তাতে কোনও লাভ হবে না। এর ওপর আবার এতবড় ঘা খেলে দাদু বাঁচবেন না। তুমি বুঝতে পারছ না দাদা, শুধু তোমার জন্যে নয়, দাদুকে বাঁচাবার জন্যেও তিনি এই অপরাধের বোঝা নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছেন।
মন্মথ বলিল–কিন্তু কেন? কেন? আমরা তার কে? কি দরকার ছিল আমাদের জন্যে এ কাজ করবার?
নন্দা নরম স্বরে বলিল—হয়তো একদিন বুঝতে পারবে। তুমি যে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছ আপাতত এই যথেষ্ট।
মন্মথ বলিল—যা বোন, আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি, আর কখনও ও-পথে যাব না।
সে আবার নন্দার হাঁটুতে মাথা রাখিল। নন্দা নীরবে তাহার চুলের উপর হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল।
প্রায় একমাস কাটিয়া গিয়াছে।
সকালবেলা হল-ঘরের টেবিলের সম্মুখে বসিয়া যদুনাথ খবরের কাগজ পড়িতেছেন। টেবিলের উপর তাঁহার চা ও প্রাতরাশ রাখা রহিয়াছে, কিন্তু তিনি তাহা স্পর্শ করেন নাই। তাঁহার মুখ বেদনা-পীড়িত।
সংবাদপত্রে স্থূল শিরোনামায় লেখা রহিয়াছে
কানামাছির কারাবাস।
তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ড ইত্যাদি—
যদুনাথ কাগজ পড়িতেছেন, সেবক আসিয়া তাঁহার চেয়ারের পিছনে দাঁড়াইল; কুণ্ঠিত স্বরে বলিল— বাবু, মোকদ্দমার কিছু খবর আছে নাকি?
যদুনাথ কাগজ মুড়িয়া সরাইয়া রাখিলেন। বলিলেন
হ্যাঁ, রায় বেরিয়েছে। দিবাকরকে তিন বছর জেল দিয়েছে। দিবাকর চোর ছিল সত্যি; কম বয়সে দুরবস্থায় পড়ে মন্দ পথে গিয়েছিল। কিন্তু তবু
তবু কি বাবু?
কোথায় যেন একটা গলদ আছে। দিবাকর আমার সূর্যমণি চুরি করেছিল এ যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। বড় ভাল ছেলে ছিল রে। কপাল—সবই কপাল। ওর ভাগ্য তো আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।
নিশ্বাস ফেলিয়া যদুনাথ চায়ের পেয়ালা টানিয়া লইলেন। এই সময় দেখা গেল নন্দা ও মন্মথ পাশাপাশি সিঁড়ি দিয়া নামিয়া আসিতেছে। মন্মথর পরিধানে ধুতিচাদর; দেশী পোশাক।
তাহারা আসিয়া যদুনাথের সম্মুখে দাঁড়াইল।
নন্দা বলিল—দাদু, আমরা একটু বেরুচ্ছি।
যদুনাথ বলিলেন—ও—তা বেশ তো। কোথায় যাচ্ছ?
নন্দা বলিল—একটি বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।
যদুনাথ বলিলেন—আচ্ছা, এস।
নন্দা ও মন্মথ দ্বারের দিকে চলিল। যদুনাথ চায়ে চুমুক দিতে গিয়া হঠাৎ থামিয়া গেলেন; ত্বরিতে চাশের চশমা খুলিয়া একদৃষ্টে তাহাদের পানে চাহিয়া রহিলেন; যেন অনুমানে বুঝিতে পারিলেন তাহারা কোন্ বন্ধুর সহিত দেখা করিতে যাইতেছে। তিনি দুই তিনবার আনুকূল্যসূচক ঘাড় নাড়িলেন। তাঁহার মুখ ঈষৎ উৎফুল্ল হইল।
জেলখানার ভীম লৌহদ্বার পার হইয়া নন্দা ও মন্মথ পাষাণপুরীতে প্রবেশ করিল।
দিবাকর নিজ প্রকোষ্ঠে ছিল; সেইখানেই সাক্ষাৎ হইল। তিনজনেই কুণ্ঠিত, অপ্রতিভ। নন্দা চোখের জল চাপিবার চেষ্টা করিতেছে।
মন্মথ সহসা দিবাকরের হাত চাপিয়া ধরিয়া আবেগপূর্ণ কণ্ঠে বলিয়া উঠিল—দিবাকরবাবু, আমি আপনার কাছে মাফ চাইতে এসেছি। আমাকে মাফ করুন।
দিবাকর শান্তকণ্ঠে বলিল—মাফ করবার কিছু নেই, মন্মথবাবু। আমি যা করেছি, নিজের প্রয়োজনেই করেছি। তিন বছর পরে আমি যখন জেল থেকে বেরুব, তখন আমার অপরাধ ধুয়ে যাবে; তখন আমি নতুন মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করব। —মন্মথবাবু, আমি দেখেছি, ভাল মেয়ের ভালবাসা অতি অধম মানুষকেও সৎ পথে টেনে আনে; আর মন্দ মেয়ের মোহ সাধু লোককেও নরকে টেনে নিয়ে যায়। আশা করি আপনি যে শিক্ষা পেয়েছেন তা সহজে ভুলবেন না।
মন্মথ গাঢ়স্বরে বলিল—না, ভুলব না।
নন্দা চোখ মুছিল। তারপর হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল—
দাদু দাদার বিয়ের ঠিক করেছেন।
মন্মথ সঙ্কুচিতভাবে সরিয়া গেল।
দিবাকর বলিল—বাঃ বেশ। (ঈষৎ হাসিয়া) আর তোমার বিয়ে? কর্তা এখনও তোমার বিয়ে ঠিক করেননি, না?
নন্দা অপলক-চক্ষে দিবাকরের পানে চাহিয়া ধীরে ধীরে বলিল—আমার বিয়েও ঠিক হয়ে। আছে। কিন্তু দাদু বলেছেন, তিন বছরের মধ্যে আমার বিয়ের যোগ নেই।
দিবাকরের চোখের সহিত নন্দার চোখ নিবিড় আশ্লেষে আবদ্ধ হইয়া গেল।