মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর সভাকবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর সভাকবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরকে মূলাজোড়ে বসবাসের জন্য গঙ্গার তীরে একটি স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কবি, আপনার প্রতিভার পক্ষে গঙ্গাতীরবর্তী এই স্থানটি উপযুক্ত হবে। অদ্ভুত যোগাযোগ। অন্তরালে কার শক্তি! দুই রাজার সংগমে আর এক কলকাতার রাজা। বর্ধমানের মহারাজার দেওয়ান রামদেব নাগ মূলাজোড়ে জমিদারি পেলেন কীভাবে! এদিকটা তো মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জমিদারি? বর্গিরা তখন বাংলার ত্রাস। যা খুশি তাই করছে। ভয়ংকর এক আতঙ্ক। বর্ধমান তাদের টার্গেট। ওই পথেই পিল পিল করে ঢুকছে। সেই সময় বর্ধমানের মহারাজাধিরাজ তিলকচাঁদ রায়। বর্ধমান আর নিরাপদ নয়। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর বন্ধুস্থানীয়। কাউগাছি জায়গাটি কৃষ্ণচন্দ্রের খাস জমিদারিভুক্ত। বর্ধমানরাজ সেইখানে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করলেন।
ইতিহাসের কত কী বলার থাকে। নায়ক তো একজনই–কাল। আবার কাল শব্দটির আর এক অর্থ–অতীত। অনেক সুতো গোটানো লাটাই হাতে অদৃশ্য মহানায়ক বসে আছেন। সুতো ছেড়েই যাচ্ছেন, ছেড়েই যাচ্ছেন। একশো, দুশো, পাঁচশো বছর কিছুই নয়। এই। সেদিন। অতীত কলকাতার রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হত বঙ্গে বর্গি। সে কোন কাল?কত কাল?
১৭৪২ থেকে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দ। প্রায় দশ বছর স্থায়ী বিকট এক উৎপাত। বর্ধমানের মহারাজা তিলোকচাঁদ তাঁর রাজ্য ছাড়তে বাধ্য হলেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের খাস পতিত জমিরই বিরাট একটা অংশ কাউগাছি। বেশ নিরাপদ। পশ্চিমে ভাগীরথী, পূর্ব দিকে ঘন জঙ্গল ঘেরা বর্তির বিল। দক্ষিণে একটি খাল–নোয়াই খাল, উত্তরে মুক্তাপুরের খাল। দুটি খালই ভাগীরথীর সঙ্গে সংযুক্ত। মূলাজোড়ের অধিবাসী রামদেব নাগ, জায়গাটির সন্ধান দিলেন। গড়ে উঠল বর্ধমান রাজের বিকল্প রাজধানী। অবশ্যই বিশাল ব্যাপার। হাতি, ঘোড়া, লোক-লস্কর, পাইক-বরকন্দাজ। স্থানটির চেহারা ফিরে গেল।
বর্ধমান রাজপরিবার চিরকালই শিক্ষা ও সংস্কৃতির অনুরাগী পৃষ্ঠপোষক। কাউগাছিতে এসেই রাজমহিষী কৃষ্ণকুমারী জানতে পারলেন, পাশেই মূলাজোড় গ্রাম, সেখানে বাস করছেন বিখ্যাত কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। কৃষ্ণকুমারী আলোকিত রমণী, গুণী, ধর্মপ্রাণ। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্ৰ কবিকে ১৬ বিঘা জমি দান করেছিলেন! কৃষ্ণকুমারীর মনে হল লোক-লস্কর, অশ্ব গবাদি নিয়ে এই রাজপরিবারটি যেন কবির ঘাড়ে এক মহা উৎপাতের মতো এসে পড়েছে। কবির শান্তি নষ্ট করছে। ভারতচন্দ্র শুধু কবি নন, সাধক। তাঁকে আরও পরিসর দিতে হবে। তিনি যুগোত্তীর্ণ মানুষ। মহারানি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে একটি চিঠিতে অনুরোধ জানালেন, আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী। কথা আছে। জরুরি কথা। ভদ্র কৃষ্ণচন্দ্র এলেন। কৃষ্ণকুমারী ভারতচন্দ্রের প্রসঙ্গ তুলে বললেন, মহারাজ! ১৬ বিঘা পরিসর তাঁর পক্ষে যথেষ্ট নয়। আমরা পাশে এসে পড়ায় উৎপাত বেড়েছে। মূলাজোড় গ্রামটি আমাকে পত্তনি দিন। কৃষ্ণচন্দ্র খানিক চিন্তার পর বললেন, বেশ, ওই ষোলো বিঘা বাদ দিয়ে। আরও আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হল, কৃষ্ণচন্দ্র আনারপুরের গুস্তেগ্রামে কবিকে ১২১ বিঘা নিষ্কর ভূমি দান করবেন। কৃষ্ণকুমারী তখন নিজের নামে নয় তাঁদের অমাত্য রামদেব নাগের বেনামে পত্তনি পাট্টা সম্পাদন। করলেন। এই কাহিনিতে রামদেবের প্রবেশ এইভাবে। রাজারাজড়ার ব্যাপার। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়; আবার রাজায় রাজায় অনেক ভালো কাজও হয়।
বর্ধমানের অস্থায়ী রাজধানী এক সময় আবার বর্ধমান ফিরে গেল। গোপীমোহন নির্মাণ করলেন কাঙ্ক্ষিত দেবালয়। মূলাজোড়ে শুরু হল আর এক ইতিহাস। ভট্টপল্লির পরেই মূলাজোড় হল সংস্কৃতচর্চার কেন্দ্র। গোপীমোহন স্থাপন করলেন সংস্কৃত কলেজ, গ্রন্থাগার, দাঁতব্য চিকিৎসালয়। সংস্কৃত কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ভট্টপল্লির প্রখ্যাত নৈয়ায়িক শিবরাম সার্বভৌম। তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠল এক মহামণ্ডলী। ন্যায়শাস্ত্রের এই ধারা বিখ্যাত হল মূলাজোড় সম্প্রদায় নামে।
ভট্টপল্লির নাম কয়েকবার করা হল। কোনও অদৃশ্য শক্তি কী ভট্টপল্লির এক নিষ্ঠাবান পরিবারকে পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবারের দিকে ঠেলছে? হয়তো তাই! ভাটপাড়ার এক প্রাচীন মুখোপাধ্যায় বংশ। কৌলীন্যে তাঁরা ফুলের মুখুটি। ভরদ্বাজ গোত্র। শ্রীহর্ষের বংশ, ফুলেমেল। বহুঁকাল আগে ভাটপাড়ায় বসতি স্থাপন করেছিলেন গঙ্গাধর ঠাকুর। পরপর একাধিক পুরুষ–গঙ্গাধর, রামভদ্র, শুকদেব, হৃদয়রাম, ভবানীশঙ্কর, ভৈরবচন্দ্র। ভৈরবচন্দ্রে স্থির হব। তাঁর সন্তান পরমানন্দ। অন্য নাম জগন্মোহন। ভৈরবচন্দ্রইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। হিজলিকাঁথির লবণকুঠির সদর আমিন ছিলেন। এই জীবিকায় কোম্পানির আমলে বড়লোক হওয়ার অনেক সুযোগ ছিল। ভৈরবচন্দ্র তাই হলেন। অর্থের সঙ্গে সামাজিক প্রতিপত্তিও আসে। পার্সি ভাষায় তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। লোকে রসিকতা করে বলতেন, মৌলবি মুখুজ্যে। তিনি কিন্তু অত্যন্ত নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন। তাঁর জীবনকালে মুখুজ্যেবংশের কুলভঙ্গ হয়নি। যা হল সব তাঁর মৃত্যুর পরে।
ভৈরবচন্দ্রের পুত্র পরমানন্দ রূপবান এক যুবক। অন্যদিকে গোপীমোহন ঠাকুরের বড়ছেলে সূর্যকুমার। তাঁর দুই মেয়ে ত্রিপুরাসুন্দরী ও শ্যামাসুন্দরী। ঠাকুর পরিবারে নিয়ম ছিল সত্বংশে স্বাস্থ্যবান, রূপবান ছেলের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেওয়া। পরমানন্দের এক কাকা কলকাতায় যেতেন তাঁর কাজকর্মের জন্য। সেখানেই তাঁর বেশিরভাগ সময় থাকা। ঠাকুর পরিবারে তাঁর যাতায়াত ছিল। সূর্যকুমার একদিন পরমানন্দের খুল্লতাতকে বললেন, বড়মেয়ের বিয়ে দেব। সংশের সুচরিত্র ও সুপুরুষ একটি পাত্রের সন্ধান দিতে পারলে তোমাকে আমি পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেব। পরমানন্দের খুড়ো সঙ্গে সঙ্গে একটি পরিকল্পনা ঠিক করে ফেললেন। পাঁচ হাজার টাকা কী কম কথা! আর পাত্র তাঁর চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাঁর নাম পরমানন্দ। সমস্যা একটাই, তাঁর বিধবা জননী এই বিবাহ কিছুতেই সমর্থন করবেন না। কারণ কুলমর্যাদার হানি হবে। ঠিক আছে! কৌশল করতে। হবে। পরমানন্দের মাকে তিনি বললেন, কলকাতায় পার্বণ উপলক্ষে কালীঘাটে মহাসমারোহ হবে। পূজা-হোম-আমোদ-প্রমোদ। আমার খুব ইচ্ছে পরমানন্দকে একবার দেখিয়ে আনি। পরমানন্দের মা অতি সরল, তাঁর কোনও সন্দেহই হল না। তিনি বললেন, বেশ তো। খুড়োমশাই পরমানন্দকে নিয়ে সোজা চলে গেলেন সূর্যকুমারের বাড়িতে। বললেন, এই নিন পাত্র। পাঁচ হাজার টাকা পকেটে পুরে তিনি বিদায় নিলেন। সেকালের জমিদাররা যেভাবে জোর করে বিয়ে দিতেন সেই পদ্ধতিই শুরু হল। সেইদিনেই গায়ে হলুদ। বালক পরমানন্দ ভয়ে কাঁদতে শুরু করেছেন। সূর্যকুমার বহু মূল্য অলংকারাদি দিয়ে পরমানন্দকে ভুলিয়ে রাখলেন। সেই সন্ধ্যায় তড়িঘড়ি পরমানন্দের বিবাহ হল ত্রিপুরাসুন্দরীর সঙ্গে। যথাসময়ে পরমানন্দের আত্মীয়স্বজনরা সব জানতে পারলেন। ভাটপাড়া থেকে তাঁদের চলে আসতে হল কলকাতায়। ইতিমধ্যে ঠাকুর পরিবারের জাঁকজমক, ঐশ্বর্য, আদর-আপ্যায়নে তাঁরা মোহিত। পরমানন্দ হলেন কলকাতার ঠাকুর পরিবারের ঘরজামাই।
কলকাতায় তাঁর নাম হল জগন্মোহন। পরমানন্দ আর কেউ বললেন না। নাম পরিবর্তনের ব্যাপারটাও খুব মজার। সেকালে এই ঠাকুর পরিবারের নিয়ম ছিল বাড়ির জামাইয়ের নাম বাড়ির মেয়েদের পছন্দ না হলে তাঁরা তা পালটে দিতেন। পরমানন্দ নামটি মহিলাদের পছন্দ হয়নি। তাঁর স্ত্রী স্বামীর নাম বলতে গিয়ে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতেন। পরমানন্দের মধ্যে পরমান্ন শব্দটি খুঁজে পাওয়া যায়। স্বামীর নাম উচ্চারণ করা অত্যন্ত দোষের। অতএব পরমান্ন বলা যায় না, নাম পালটাও। অতি সুন্দর পুরুষ পরমানন্দ, নাম রাখা হল জগন্মোহন।
অনেক পরে এই পরিবারের একটি মামলায় আলিপুর কোর্টে সাক্ষ্য দিতে উঠেছিলেন মহারাজা স্যার যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর। তিনি গোপীমোহন ঠাকুরের পঞ্চম পুত্র হরকুমার ঠাকুরের সন্তান। সাক্ষ্যদানকালে তিনি বলেছিলেন, আমার জ্যাঠামশাইয়ের নাম সূর্যকুমার ঠাকুর। আমি শুনেছি যাঁর নাম পরমানন্দ তাঁরই পরিবর্তিত নাম জগন্মোহন। জগন্মোহনের পিতার নাম ভৈরবচন্দ্রমুখুজ্যে। জগন্মোহনের ভাই ছিল কি না জানি না! তিনি বিবাহের আগে উচ্চবর্ণের কুলীন ব্রাহ্মণ ছিলেন। আমাদের ফ্যামিলির নিয়ম ছিল যে, ভালো কুলীন দেখে বিবাহ দেওয়া। ভৈরবচন্দ্রের সঙ্গে আগে আমাদের কোনও কুটুম্বিতা ছিল না। এই বিবাহে প্রথম হল। আমাদের ঠাকুরদার ফ্যামিলিতে নিয়ম ছিল, ভালো কুলীনের ছেলে এনে। আমাদের ফ্যামিলিতে বিবাহ দেওয়া এবং ভালো করে প্রভিশন করে দেওয়া। জগন্মোহনের সময় এইরকমই হয়েছিল। আমার পিতামহ গোপীমোহন ঠাকুর জীবিত থাকার সময় এই বিবাহ হয়।
পরমানন্দের দুর্গাদাস নামে এক ভ্রাতা ছিলেন। খড়দহের বিখ্যাত গোস্বামী বংশেবিবাহ করে সেখানেই বাস করতেন। পরমানন্দ সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। দুটি ভাষার গ্রন্থই পাঠ করতেন। লেখাপড়াতেই সমস্ত জীবন অতিবাহিত করেন। অসাধারণ সুন্দর হাতের লেখা। পুঁথি লিখতেন।
সূর্যকুমারের কোনও পুত্রসন্তান হয়নি। দুটি কন্যা। পরমানন্দ প্রথমে ত্রিপুরাসুন্দরীকে বিবাহ করেছিলেন। সন্তান দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়। কালে এই দক্ষিণারঞ্জনই হয়ে উঠবেন ইতিহাস বিখ্যাত এক মানুষ। সূর্যকুমার অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন। একটি সওদাগরি ব্যাংকের প্রধান অংশীদার। পরিচালনার কাজে যথেষ্ট সাহায্য করতেন। পিতা গোপীমোহনের সমস্ত জমিদারির তত্বাবধান করতেন। এক ইউরোপীয়, নাম স্মিথ, একটি ডক ইয়ার্ড নির্মাণ করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। স্মিথ সাহেব একটি সমবায় স্থাপন করে গোপীমোহনের সাহায্য চান। তিনি প্রচুর অর্থ সেখানে বিনিয়োগ করেন। সূর্যকুমার এই সমবায়ের বেনিয়ান নিযুক্ত হন। পুরো পরিকল্পনাটাই ভেস্তে গেল। গোপীমোহনের সমস্ত টাকা জলে। সূর্যকুমার খুব অল্প বয়েসে মারা যান। মাত্র ত্রিশ বছর। ত্রিপুরাসুন্দরী পরমাসুন্দরী ছিলেন। তাঁর অনেক গুণ ছিল। দুর্ভাগ্য এই দক্ষিণারঞ্জনের জন্মের অল্পকাল পরেই তিনি মারা গেলেন। একেবারে শৈশবেই মাতৃহীন। পরমানন্দ সূর্যকুমারের দ্বিতীয় কন্যাশ্যামাসুন্দরীকে বিবাহ করলেন। শ্যামাসুন্দরীর স্নেহ ও যত্নে দক্ষিণারঞ্জনের কোনও সময়েই মনে হয়নি যে তাঁর মা নেই। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভেই চারটি সন্তান কালিকারঞ্জন, বিশ্বরঞ্জন, নিরঞ্জন, সর্বরঞ্জন।
এই কাহিনির নায়ক দক্ষিণারঞ্জন। কলকাতার বিখ্যাত রাজবাড়িতে যিনি বড় হচ্ছেন। পিতা জগন্মোহন জানতেন ইংরেজের ভারতে ইংরেজি না শিখলে ভবিষ্যতে কিছুই করা যাবে না। দক্ষিণারঞ্জন ভরতি হলেন হেয়ার সাহেবের স্কুলে। প্রাথমিক শিক্ষা এখানেই হল। এরপর হিন্দু কলেজ। ইংরেজরা এদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন করেননি। করেছিলেন কয়েকজন দূরদর্শী হিন্দু। কলকাতার কয়েকজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির দান ও আন্তরিক চেষ্টায়, সর্বোপরি ডেভিড হেয়ার ও স্যার হাইড-এর সহযোগিতায় স্থাপিত হয়েছিল হিন্দু কলেজ। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে। এ দেশীয় যাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন মহারাজা স্যার
যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, হরকুমার ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। অন্যান্য যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন। বর্ধমানের রাজা তেজচন্দ্র বাহাদুর, গোপীমোহন ঠাকুর, কালীপ্রসন্ন সিংহের পিতামহ জয়কৃষ্ণ সিংহ, স্যার রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের পিতা গোপীমোহন দেব, আর গঙ্গানারায়ণ দাস। রাজা তেজচন্দ্র বাহাদুর ও দক্ষিণারঞ্জনের খুল্লমাতামহ চন্দ্রকুমার ঠাকুর হিন্দু কলেজে প্রথম গভর্নর হিসেবে নির্বাচিত হন। কার্যনির্বাহক সমিতির সদস্য হলেন গোপীমোহন দেব, জয়কৃষ্ণ সিংহ ও গঙ্গানারায়ণ দাস। জাস্টিস অনুকূল মুখোঁপাধ্যায়ের পিতা বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় প্রথম। সম্পাদক। পরিদর্শক হিসাবে নিযুক্ত হলেন ডেভিড হেয়ার ও ডাক্তার হোরেস হেম্যান উইলসন।
দক্ষিণারঞ্জনের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, অসাধারণ মেধা আর অদ্ভুত অধ্যবসায়। শিক্ষকরা বিস্মিত হতেন। এই ছেলেটিকে হেয়ার সাহেব পুত্ৰাধিক স্নেহ করতেন। ডাক্তার উইলসনও তাঁর প্রশংসা করতেন। বিখ্যাত কৃষ্ণদাস পাল, বাগ্মী, স্বদেশহিতৈষী রামগোপাল ঘোষের জীবনচরিতে স্বীকার করেছেন নীচের ক্লাসে পড়ার সময় দক্ষিণারঞ্জন ও রামগোপাল ইংরেজিতে এতটাই পারদর্শী হয়েছিলেন যে প্রবন্ধ লিখতেন। আর ডাক্তার উইলসন সেইসব লেখা ওপরের ক্লাসের ছাত্রদের দেখিয়ে বলতেন, পড়ে দেখো, তোমাদের চেয়ে নীচের ক্লাসের দুই ছাত্র কী অসাধারণ লিখেছে। তোমরা এদের ধারে কাছে যেতে পারবে কি! দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে যাঁরা পড়তেন পরবর্তীকালে তাঁরাও বিখ্যাত হয়েছিলেন। যেমন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, রামগোপাল ঘোষের কথা তো বলাই হয়েছে। রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রামতনু। লাহিড়ি, রাধানাথ শিকদার। তাঁদের মধ্যে অনন্য ছিলেন দক্ষিণারঞ্জন। পরবর্তী জীবনে সেই পরিচয় পাওয়া যাবে।
দক্ষিণারঞ্জন হিন্দু কলেজে। আর সেখানে একজন অসাধারণ শিক্ষক–হেনরি লুই ভিভিয়ান। ডিরোজিও। তাঁর শিক্ষা প্রণালী ছিল অতি বিচিত্র। ছাত্রদের ওপর অসামান্য প্রভাব। বয়সে তিনি তরুণ, কিন্তু প্রতিভায় বিচ্ছুরিত। ডিরোজিও মনে করতেন, শুধু ভাষায় পারদর্শী হলে হবে না, বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে হবে। মেধার সঙ্গে হৃদয়ের যোগ ঘটাতে হবে। ছাত্রদের বলতেন, ভাবতে শেখো। এই দেশ প্রাচীন সংকীর্ণতা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। এই অন্ধকার থেকে বেরোতে হবে। ডিরোজিও মনস্তত্ব ও নীতিশাস্ত্রে উন্নত ছিলেন। ছাত্রদের এই দুটি বিষয়ে জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করতেন। ধৈর্য অসাধারণ। ছাত্রদের নিয়েই পড়ে থাকতেন।
সেই সব ইউরোপীয় দার্শনিকদের কথা বেশি করে বলতেন যাঁদের চিন্তায় মানুষই প্রাধান্য পেত। এইসব দার্শনিক হলেন লক, রিড, স্টুয়ার্ট ব্রাউন প্রমুখ। ছাত্রদের তিনি পর্যবেক্ষণ শক্তি বাড়াতে বলেছিলেন। উৎসাহ দিতেন ডিবেটে। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অন্যান্য বই পড়তে বলতেন। সুযোগ পেলেই নিজের বাড়িতে বা অন্য জায়গায় তর্কসভার আয়োজন করে ছাত্রদের নিয়ে বসতেন। ছাত্ররাই ছিলেন তাঁর ধ্যান ও জ্ঞান। নিজে ছিলেন কবি। দীর্ঘ একটি কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন–
অৰ্দ্ধস্ফুট পুষ্পদল সম, ধীরে ধীরে হয় বিকশিত
তোমাদের সুকুমার চিত, হেরি আমি উৎসুক নয়নে;
মানসিক শক্তিচয় যেন ছিল মন্ত্রমূর্হিত শয়নে,
সুবৰ্ণ–শলাকা–স্পর্শে এবে ক্রমে ক্রমে হয় উদ্বোধিতা।
ডিরোজিওর শিক্ষাপ্রণালী এতটাই অভিনব ছিল যে, গতানুগতিক শিক্ষকরা ধরতেই পারতেন না কী হচ্ছে। হিন্দু কলেজের শিক্ষকদের প্রতিমাসে প্রধান শিক্ষকের কাছে ছাত্রদের প্রগ্রেস রিপোর্ট জমা দিতে হত। ডিরোজিও এই ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন না। পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে ছাত্রদের আত্মবিকাশের দিকেই তাঁর নজর ছিল। সেই সময় প্রধান শিক্ষক ছিলেন ডি. আনসেলম। ডিরোজিওর রিপোর্ট তাঁর পছন্দ হত না। একবার তিনি এতটাই রেগে উঠলেন যে, ডিরোজিওকে প্রহার করার জন্য হাত ওঠালেন! ডিরোজিও পিছনে সরে গিয়ে সেই আঘাত থেকে নিজেকে বাঁচান। তাঁকে ঘিরে একটি ছাত্র গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। তাঁরা ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে সচেষ্ট হলেন।
ডিরোজিও একটি ছাত্রসভা স্থাপন করেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন, অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন। দক্ষিণারঞ্জন এই সভার সভ্য ছিলেন। ডিরোজিওর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন আর-এক বিদেশি–হেয়ার সাহেব। এই হেয়ার সাহেব দক্ষিণারঞ্জনকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। সাহেবের সংবর্ধনার জন্য ডিরোজিওর ছাত্ররা উৎসাহী হলেন। শিক্ষা বিস্তারে তাঁর অনন্য প্রচেষ্টা সকলের মুখে মুখে। মাধবচন্দ্রমল্লিক তাঁর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে একটি পরামর্শ সভা আহ্বান করলেন। আলোচনার বিষয়–ডেভিড হেয়ারের সংবর্ধনা। দুটি সভা হল। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ ২৮ নভেম্বর প্রথম সভা। উপস্থিত ছিলেন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৮৩১ সালের ৩০ জানুয়ারি দ্বিতীয় সভা। সভাপতি রসিককৃষ্ণ মল্লিক। দুটি সভাতেই বক্তৃতা করলেন কৃষ্ণমোহন, রসিককৃষ্ণ, দক্ষিণারঞ্জন, রাধানাথ শিকদার প্রমুখ কয়েকজন। সিদ্ধান্ত হল চাঁদা করে হেয়ার সাহেবের একটি তৈল চিত্র আঁকা ও সেই ছবি প্রতিষ্ঠিত হবে উপযুক্ত স্থানে।
১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ ১৭ ফেব্রুয়ারি। ডেভিড হেয়ারের জন্মদিন। হেয়ার স্কুলে তাঁর সংবর্ধনা। দক্ষিণারঞ্জনের নেতৃত্বে হেয়ারের অসংখ্য ছাত্র সেই সভায় মিলিত হলেন। সুন্দর একটি অভিনন্দন পত্র পাঠ করে তাঁর হাতে দেওয়া হল। দক্ষিণারঞ্জন অসাধারণ একটি বক্তৃতা দিলেন। এই বক্তৃতাতেই হেয়ার সম্পর্কে তাঁর বিখ্যাত উক্তি–আপনি আমাদিগকে জননীর ন্যায় স্তন্য দিয়াছেন।হেয়ার সাহেব মাথাটি ধীর ভাবে নাড়তে নাড়তে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন। দক্ষিণারঞ্জনের চেষ্টায় চিত্রকর চার্লস পোট ডেভিড হেয়ারের সুন্দর একটি তৈলচিত্র সযত্নে আঁকলেন। ছবিটি হেয়ার স্কুলে আছে। ওই ছবির পাশে একটি বালকের প্রতিকৃতি। বালকটি আর কেউ নন, তাঁর প্রিয়তম শিষ্য দক্ষিণারঞ্জন।
ডিরোজিও তখন হিন্দু সমাজের পক্ষে ভয়ংকর এক সমস্যা। তিনি যে সভা স্থাপন করেছিলেন সেই সভায় ধর্ম ও সমাজ সংস্কার নিয়ে অগ্নিগর্ভ সব আলোচনা হত। প্রথম সারির সদস্যরা, কৃষ্ণমোহন, রামগোপাল, দক্ষিণারঞ্জন আর রসিককৃষ্ণ। তাঁরাই প্রধানত আলোচনা করতেন। সমাজের কয়েকজন বিশিষ্ট ক্ষমতাবান ব্যক্তিও আসতেন–তদানীন্তন চিফ জাস্টিস স্যার এডওয়ার্ড রায়ান, লর্ড উইলিয়ামস বেন্টিঙ্কের প্রাইভেট সেক্রেটারি কর্নেল বেনসন, কর্নেল বিটসন, পরে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হয়েছিলেন, বিশপ কলেজের অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ডরু এইচ মিল। তাঁরা এসে তরুণদের উৎসাহ দিতেন। তরুণরা অতি উৎসাহের ফলে হিন্দুধর্মের প্রতি ভয়ংকর অবজ্ঞা ও অশালীন আচরণ করতে শুরু করলেন। পারলে শাস্ত্র ও শাস্ত্রবিধিকে প্রকাশ্যে লাথি মারবেন, এইরকম একটা উচ্ছঙ্খলতা।
পাদরিরা দেখলেন, এই হল খ্রিস্টধর্ম ঢোকাবার সুবর্ণ সুযোগ। উঠে পড়ে লেগে গেলেন ডাক্তার ডফ ও আর্চ ডিকন ডিয়্যালট্রি। তাঁরাও অতি উৎসাহে ধর্মপ্রচারকদের বলতেন, কলেজের পাশেই সকাল, সন্ধ্যা পথসভা করে হিন্দুধর্মকে গালাগাল দাও আর খ্রিস্টধর্মের জয়গান করো, একদিকে ডিরোজিওর ছেলেরা ও অন্যদিকে পাদরিরা। খেলা খুব জমে উঠল।
পাদরিদের হিন্দুধর্ম-বিদ্বেষ ডিরোজিওর শিষ্যদেরও গ্রাস করল। ঘৃণার ওপর ঘৃণা–যেন ডবল ডোজ। তাঁদের আচার-আচরণে ভয়ংকর রকমের একটা উগ্রতা দেখা দিল। যা অবশ্যই ছেলেমানুষির শামিল। যার একটি হল–নিষিদ্ধ মাংস চ্যালেঞ্জ করে খাওয়া। এইরকম একটা জটিল সময়ে দক্ষিণারঞ্জন হিন্দু কলেজের পাঠ সমাপ্ত করলেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন। মায়ের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রায় দেড় লক্ষ টাকার সম্পত্তির অধিকারী হয়েছেন। অর্থের প্রতি অবশ্য তাঁর কোনও আসক্তি ছিল না। স্বদেশ কল্যাণে মুক্ত হস্তে দান করতেন। মাথায় ছিল একটি স্বদেশি সংবাদপত্রের প্রয়োজন। যার মাধ্যমে জাতির জাগরণ ঘটানো যেতে পারে। কুসংস্কার মুক্ত একটি ধর্মের পক্ষে প্রচার জোরদার করা যায়। তিনি নিজেই প্রকাশ করলেন একটি সাপ্তাহিক পত্র, নাম জ্ঞানান্বেষণ। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে এই পত্রিকার প্রথম প্রকাশ। প্রায় তেরো বছর ধরে শিক্ষিত হিন্দু ছাত্রদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরিত হয়েছিল। সম্পাদক ছিলেন দুজন। দক্ষিণারঞ্জন ও রসিককৃষ্ণ মল্লিক। তেরো বছরের সময়কালে পালা করে এক-একজন সম্পাদক হয়েছিলেন–যেমন প্যারীচাঁদ মিত্র, তারিণী বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, রামচন্দ্র মিত্র ও হরমোহন চট্টোপাধ্যায়। সুপণ্ডিত গোবিন্দচন্দ্র বসাক মাঝে মাঝে প্রবন্ধ লিখতেন। প্রকাশের এক বছর পরে পত্রিকাটি হল দ্বিভাষী–ইংরেজি ও বাংলা। এই কাগজে প্রায়ই হিন্দুধর্মকে নানাভাবে আক্রমণ করা হত। হিন্দুধর্মের কুসংস্কারই ছিল আঘাতের লক্ষ্য। দক্ষিণারঞ্জনের পিতা জগন্মোহন নিষ্ঠাবান গোঁড়া হিন্দু। তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হলেন। পিতার সঙ্গে পুত্রের বাদানুবাদ। দক্ষিণারঞ্জন অভিমানে গৃহত্যাগ করলেন। কোথায় যাবেন! সার্কুলার রোডে গুরু ডিরোজিওর বাড়ির পাশে একটি বাড়ি ভাড়া করলেন। অর্থের তো অভাব নেই। দক্ষিণারঞ্জন পিতাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন, ভালোবাসতেন। বেশিদিন ছেড়ে থাকা সম্ভব হল না। পিতা-পুত্রের আবার মিলন ঘটল। এই সময় ডিরোজিও উইলসনকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে তাঁর প্রিয় ছাত্র দক্ষিণারঞ্জনের গৃহত্যাগের উল্লেখ আছে–দুই থেকে তিন মাস আগে দক্ষিণারঞ্জন আমাকে বলল, তার পিতার ব্যবহার ও আচরণ অসহ্য হয়ে উঠেছে। কিছুতেই সমর্থন করা যাচ্ছে না। অতএব বাড়ি ছাড়তেই হবে। আমি জানতুম কী ঘটেছে। এও জানতুম সে সত্য কথা বলছে। কিন্তু আমি বলেছিলুম, তোমার গৃহত্যাগ আমি সমর্থন করি না। পিতার ব্যবহার যাই হোক না, সন্তানের সহ্য করা উচিত। তোমার প্রতিবাদ ও আচরণ জগৎ সমর্থন করবে না। তিনি তো তোমাকে চলে যেতে। বলেননি। তুমি স্বেচ্ছায় তাঁকে পরিত্যাগ করবে কেন! মনে হয়েছিল দক্ষিণারঞ্জন আমার যুক্তি মানবে। দুঃখের বিষয় কিছু দিনের মধ্যেই সে ধৈর্য হারিয়ে যা ভেবেছিল তাই করল। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে সে গৃহত্যাগ করল। অবাক হয়ে দেখলুম, আমারই এলাকায় একটি বাড়ি ভাড়া করে উঠে এসেছে।