Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

ডায়মণ্ড হারবারে

স্বপ্না তার দু-জন বান্ধবীকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল ডায়মণ্ড হারবারে। ওর এক বান্ধবীর পিসতুতো দাদা ওখানকার এস ডি ও। আগে থেকে খবর দিয়ে যায়নি, তাই এস ডি ও সাহেব টুরে বেরিয়ে গেছেন। সেই বান্ধবীটির নাম এষা। সে বলেছিল, আমার দাদার লঞ্চে করে তোদের কাকদ্বীপ পর্যন্ত ঘুরিয়ে নিয়ে আসব।

কিন্তু এবার দাদাও নেই, লঞ্চও নেই। এষার বউদি অবশ্য ওদের খুব যত্ন-টত্ন করলেন, কিন্তু ওরা তিনজনেই গঙ্গার ওপরে লঞ্চে চড়ে বেড়াবে এই আশা করেছিল খুব।

একটা উপায় অবশ্য আছে। ডায়মণ্ড হারবার থেকে ফেরি লঞ্চ যায় ওদিকের কুঁকড়োহাটি পর্যন্ত। প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগে, সেই ফেরিতে করে বেড়িয়ে আসা যায়।

অগত্যা ওরা তিনটি মেয়ে সেই ফেরিরই টিকিট কেটে চড়ে বসল। এষার বউদি অবশ্য অনেক বারণ করেছিলেন, ওরা শুনল না। সঙ্গে পুরুষমানুষ নেই বলে কি ওরা বেড়াতে পারবে না?

শীতের মনোরম বিকেল, গঙ্গার ওপর চমৎকার বাতাস। খুবই ভালো লাগবার কথা, কিন্তু স্বপ্না একটু গম্ভীর হয়ে গেল। এষা আর বাসবী কিন্তু খুশিতে ঝলমল করছে। ওরা জিজ্ঞেস করল, কী রে স্বপ্না, তোর হঠাৎ মুখ ভার হয়ে গেল কেন?

স্বপ্না ফ্যাকাশেভাবে হেসে বলল, কই, না তো।

এদিক থেকে হলদিয়ায় প্রচুর লোক যাতায়াত করে বলে লঞ্চে বেশ ভিড়। ওরা বসবার জায়গা পায়নি, দাঁড়িয়ে ছিল রেলিং-এ ভর দিয়ে। তিনটি সুন্দরী যুবতী–ওদের দিকে অন্যদের দৃষ্টি পড়বেই। কয়েকটি যুবক বেশি উৎসাহী হয়ে পড়ল। তারা ভিড় ঠেলেঠুলে এসে দাঁড়াল ওদের পাশে।

স্বপ্না জলের দিকে চেয়ে আছে। লঞ্চের ঘটঘট শব্দ, জলের ঢেউয়ের শব্দ ছাপিয়ে সেই ছেলেদের কথা তার কানে আসে। এরা সেই বঞ্চিত যুবকের দল, যারা কোনো মেয়েকে বান্ধবী হিসেবে পায়নি বলে যেন, প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই অন্য মেয়েদের দেখলে অপমান করার চেষ্টা করে। ওরা বুঝে গেছে, স্বপ্নাদের সঙ্গে কোনো পুরুষ দেহরক্ষী নেই। তাই ওরা অশ্লীল কথার বন্যা বইয়ে দিতে লাগল। বিশেষত ওদের চশমা পরা লম্বা শিড়িঙ্গে চেহারার একটি ছেলে এতসব কুৎসিত কথা বলতে লাগল যে সেসব কথা কেউ কখনো যে মুখে উচ্চারণ করতে পারে, স্বপ্না কল্পনাও করেনি।

স্বপ্না কোনো খারাপ কথা সহ্য করতে পারে না, তার গায়ে যেন বিষাক্ত তির ফুটতে লাগল। এষা আর বাসবী দু-একবার তাকাল কটমট করে সেই ছেলেগুলোর দিকে। তাতে যেন আরও বেড়ে গেল তাদের উৎসাহ।

ওরা দাঁড়িয়েছিল লঞ্চের ছাদে। স্বপ্না বলল, চল, নীচে যাই। নীচে যাওয়ার একটু পরেই সেখানেও হাজির হল ছেলেগুলো। আবার সেখানেও শুরু হল কুৎসিত কথার ফোয়ারা। অন্য কেউ ওদের বাধাও দিচ্ছে না। একসঙ্গে চার-পাঁচটি ছেলে যেকোনো অসভ্যতা করলেও অন্য কেউ বাধা দেওয়ার সাহস পায় না।

খেয়ালঞ্চের যাত্রী নানারকম হয়। কেউ কারুর ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। অনেকে লঞ্চে উঠলেই ঘুমিয়ে পড়ে। কয়েকজন বিস্মিতভাবে যুবকদের দিকে চেয়ে রইল, কেউ কেউ দুঃখিত হল, কিন্তু একটি প্রতিবাদের বাক্যও উচ্চারণ করল না কেউ। স্বপ্না দু-হাতে কান চাপা দিয়ে রইল। সে ভাবতে লাগল কখন এই যাত্রাটা ফুরোবে।

গঙ্গা এখানে বেশ চওড়া। দু-পাশের উত্তাল ঢেউয়ের দিকে তাকালে মুগ্ধ হওয়া যায়। কিন্তু স্বপ্নার আর সেদিকে মন নেই। সে চোখ বুজে আছে। পঁয়তাল্লিশ মিনিটকে মনে হল পাঁচ ঘণ্টা, তারপর লঞ্চ এসে পৌঁছোল কুঁকড়োহাটিতে। মেয়ে তিনটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

ভাটার সময় বলে লঞ্চটা ঠিকমতন জেটিতে ভিড়তে পারল না! একটা লম্বা তক্তা ফেলে দেওয়া হল। সেটার ওপর দিয়ে নামতে হবে খুব সাবধানে।

নামবার সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটল। একজন হঠাৎ ঝপাস করে পড়ে গেল নীচে। বহুলোক হইহই করে উঠল একসঙ্গে। সেখানে অবশ্য জল বেশি নেই, থকথকে কাদা। সেই কাদায় মাখামাখি হয়ে লোকটি যখন উঠে দাঁড়াল, তখন স্বপ্নারা দেখল, এই সেই চশমাপরা লম্বা শিড়িঙ্গে ছেলেটা। সে ছিল প্রায় স্বপ্নাদের পেছনেই। তখনও খারাপ কথা চালিয়ে যাচ্ছিল। ওরা তিনজন প্রথমটায় শিউরে উঠেছিল ভয়ে। তাড়াতাড়ি নীচে নেমে গিয়ে বাসবী আর এষা কুলকুল করে হাসতে লাগল।

এষা বলল, বেশ হয়েছে। ঠিক শাস্তি হয়েছে! অসভ্য কোথাকার!

বাসবী বলল, আমার ইচ্ছে করছিল, লোকটাকে ঠেলে ফেলে দিতে!

স্বপ্নার মুখখানা আরও ম্লান হয়ে গেছে। সে একটুও খুশি হয়নি। সে মৃদুস্বরে বলল, যদি লোকটা মরে যেত। হঠাৎ পড়ে গেলে, অনেক সময়

স্বপ্না অন্ধকারে চকিতে পেছনে একবার তাকিয়েই ঘুরিয়ে নিল মুখ। কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে সেই লোকটা তখনও চিৎকার করে কাকে যেন গালাগালি দিচ্ছে।

ফেরার লঞ্চ এক ঘণ্টা পরেই ছাড়বার কথা। কিন্তু কী-একটা যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য সেটা ছাড়ল তিন ঘণ্টা বাদে। বাসবী আর এষার ইচ্ছে ছিল হলদিয়া থেকে ঘুরে আসার। এখান থেকে খুব সহজেই বাসে হলদিয়া ঘুরে আসা যায়। তিন ঘণ্টা সময় তো হাতে আছেই। কিন্তু স্বপ্না রাজি হল না। সে আর বেশি দূর যেতে চায় না। খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর ওরা তিনজন লঞ্চে এসেই বসেছিল।

এষা জিজ্ঞেস করল, কী রে স্বপ্না, তুই এখনও মুখ গোমড়া করে আছিস কেন?

স্বপ্না বলল, ফেরার সময় নিশ্চয়ই ওই ছেলেগুলো আর আসবে না। সত্যি বড় জ্বালাতন করছিল। ছেলেগুলো কী ভাবে বলত? ওরকম খারাপ কথা বললে, কোনো দিনই তো কোনো মেয়ে ওদের পছন্দ করবে না।

এষা বলল, আলাপ করার সৎ সাহস নেই। আমাদের সঙ্গে ভদ্রভাবে আলাপ করতে এলে কি আমরা কথা বলতুম না?

ফেরার সময় কোনো ঝঞ্ঝাট হল না। চমৎকার জ্যোৎস্নায় নদী সফর খুব সুন্দরই হল। কিন্তু ফেরার পর ওরা আবিষ্কার করল যে, লাস্ট ট্রেন ছাড়া ওদের কলকাতায় ফেরার আর কোনো উপায় নেই। লাস্ট ট্রেনে গেলে ওদের বাড়ি পৌঁছোতে পৌঁছোতে রাত প্রায় বারোটা বেজে যাবে।

এষার দাদা টুর থেকে ফেরেননি। সেদিনও ফিরবেন না খবর পাঠিয়েছেন। বউদি বললেন, রাত্তিরে ডায়মণ্ড হারবারেই থেকে যেতে। লাস্ট ট্রেনে ফেরা ওদের পক্ষে বিপজ্জনক। প্রায় সব কামরাই ফাঁকা থাকে। হঠাৎ হঠাৎ ডাকাতির উপদ্রব হয়। মেয়েরা কেউই প্রায় ওই ট্রেনে যায় না।

কিন্তু স্বপ্নাকে বাড়ি ফিরতেই হবে। সে কিছু বলে আসেনি। না জানিয়ে বাড়ির বাইরে সারারাত থাকা স্বপ্না চিন্তাও করতে পারে না। মা-বাবা দারুণ ব্যস্ত হয়ে থানায় হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি শুরু করবেন। অথবা মাঝরাত্তিরে গাড়ি নিয়ে ছুটে আসবেন ডায়মণ্ড হারবারে।

এষার বউদি বললেন, ফোনে খবর দিয়ে দিতে।

ফোনে অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করা হল। কিন্তু টেলিফোন-দেবতার সে-দিন মেজাজ খারাপ। কিছুতেই লাইন পাওয়া গেল না। এদিকে লাস্ট ট্রেন ছেড়ে যাওয়ারও সময় হয়ে যাচ্ছে।

স্বপ্না উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে যেতেই হবে। তোরা থেকে যা বরং, আমি তোদের বাড়িতে খবর দিয়ে দেব।

স্বপ্নাকে একা যেতে দেওয়া যায় না। এষা আর বাসবী বলল, না, আমরাও যাব। ট্রেনে যদি ডাকাত আসে মেরে তো ফেলবে না… দেখাই যাক-না, একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে।

স্বপ্না ওদের বার বার বলল যে, সে একা ঠিকই চলে যেতে পারবে। তার জন্য ওদের ভ্রমণ নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। কিন্তু স্বপ্নার দুই বান্ধবী অবশ্য তাতে রাজি হতে পারে না। এতরাত্রে স্বপ্না একা ট্রেনে যাবে, এটা কখনো সম্ভব!

এষার বউদি ওদের সঙ্গে তাঁর স্বামীর অফিসের একজন আর্দালিকে পাঠাতে চাইলেন। তাতে আপত্তি করল তিনজনেই। ওরা তেমন অবলা নয় যে, পুরুষসঙ্গী ছাড়া ঘোরাফেরা করতে পারবে না।

ওরা বেছে বেছে উঠল একটা ভিড়ের কামরায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছেড়ে দিল। কিন্তু দু-তিনটে স্টেশনের মধ্যে নেমে গেল অনেকে। বেঞ্চগুলো প্রায় ফাঁকা হয়ে গেল। ওদের ভয় করতে লাগল একটু একটু।

মাঝে মাঝে গাড়ির গতি এমনি এমনিই আস্তে হয়ে আসে। হঠাৎ দু-তিন মিনিটের জন্য নিভে যায় আলো। মনে হয় যেকোনো মুহূর্তে হুড়মুড় করে উঠে আসবে ডাকাতের দল।

কিন্তু ডাকাতির বদলে শুরু হল সেই পুরোনো উৎপাত।

উলটো দিকের বেঞ্চ থেকে একটা লোক উঠে এসে ওদের ঠিক পাশে বসে পড়ে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কোথায় যাবেন?

লোকটার চোখদুটো লাল। কথা জড়ানো, মুখ দিয়ে ভকভক করে বেরোচ্ছে বিশ্রী গন্ধ।

স্বপ্নার যেমন অশ্লীল কথায় আপত্তি, এষার তেমনি আবার মাতালের ভয়। তার কাছে ভূত আর মাতাল প্রায় সমান। এষা শিউরে উঠে সরে গেল।

লোকটি বলল, ভয় পাচ্ছেন কেন? আমি থাকতে কোনো শালা এখানে আপনাদের ভয় দেখাতে আসবে না। আপনারা কোথায় যাবেন বলুন-না? আমি আছি, বডিগার্ড।

লোকটি পকেট থেকে একটা বাংলা মদের বোতল বার করে দিল একটা লম্বা চুমুক। অন্য বেঞ্চ থেকে একজন বলল, আমায় একটু দে। সবটা একাই মেরে দিস না শালা!

মেয়ে তিনটে আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল, গায়ে গা ঘেঁষে। বোঝা গেল এই মাতালটি একা নয়, তার দলে আরও লোক আছে। কামরার সবাই একই দলের কিনা, তাই-বা কে জানে!

বাসবী একটু সাহস করে লোকটিকে বলল, আপনি একটু সরে বসুন-না। আরও তো অনেক জায়গা রয়েছে।

লোকটি বলল, কেন ভাই? যার যেখানে খুশি বসবে। রেলের সম্পত্তি কারুর কেনা নয়, এখানে সিট রিজার্ভ করাও নেই।

অন্য দিকের লোকগুলো হেসে উঠল বিশ্রীভাবে।

এইসব লোকের সঙ্গে তর্ক করে কোনো লাভ নেই বুঝে মেয়ে তিনটি জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে।

কিন্তু মাতালরা নিস্তব্ধতা সহ্য করতে পারে না। লোকটি ওদের দিকে ঝুঁকে বলল, হ্যাঁ ভাই, আপনারা বুঝি ডায়মণ্ড হারবারে বেড়াতে এসেছিলেন?

ওরা কেউ উত্তর দিল না।

লোকটি আবার জড়ানো গলায় বলল, আমার নাম জগা। আমি থাকতে আপনাদের কোনো ভয় নেই। আমায় এ লাইনে সবাই চেনে। আপনারা কোথায় যাবেন বললেন না তো!

হঠাৎ এইসময়ে আর একবার আলো নিভে যেতেই এষা তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠল।

আলো আবার জ্বলে উঠল সঙ্গে সঙ্গে।

বাসবী জিজ্ঞেস করল, কী? কী হয়েছিল রে?

এষা বলল, ওই লোকটা আমার হাত ধরবার চেষ্টা করছিল।

লোকটার মুখে মিটিমিটি হাসি। নেশায় মাথাটা ঝুঁকে পড়ছে বুকের ওপর। সে বলল, হাত ধরব কেন ভাই? আমি পকেটে হাত দিয়ে বিড়ি বার করতে যাচ্ছিলাম… অন্ধকারের মধ্যে নিজের পকেট না অন্যের পকেট

কামরার একেবারে শেষপ্রান্তে একটি লোক চাদরমুড়ি দিয়ে, এই শীতের মধ্যে জানলা খুলে সর্বক্ষণ তাকিয়ে ছিল বাইরে। এবার লোকটি চাদর খুলে উঠে দাঁড়াল। তারপর ওদের কাছে এগিয়ে এল। দীর্ঘকায় পুরুষ মধুময়।

বাসবী বা এষাকে যেন সে দেখতেই পেল না। স্বপ্নার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে সে বেশ শান্ত গলায় বলল, আপনারা ওই দিকটায় গিয়ে বসুন, ফাঁকা আছে। আমি এখানে বসছি।

এষা এই লোকটিকেও অবিশ্বাস করে বলল, কেন আমরা উঠতে যাব? আমরা আগে এখানে এসে বসেছি, ওই লোকটাই ওদিকে চলে যাক-না।

মধুময় বলল, সেরকমভাবে বলে কোনো লাভ নেই। আপনারা আমার জায়গায় গিয়ে বসুন, আমি এর সঙ্গে কথাবার্তা বলছি।

এষা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, এই লোকটা অত্যন্ত অসভ্য, আমি চেন টানব।

মধুময় বলল, তাকিয়ে দেখুন, এদিককার লোকাল ট্রেনে চেন নেই। সেসব কবেই লোকে ছিঁড়ে-টিড়ে ফেলেছে।

এষা বলল, পরের স্টেশনে আমি পুলিশ ডাকব।

মধুময় বলল, এতরাত্রে কি আর স্টেশনে পুলিশ থাকবে? সন্দেহ আছে।

তারপর সে একটু হেসে বলল, আপনারা বিশ্বাস করুন, আমিই পুলিশ, আমি সব ব্যবস্থা করছি।

এষা তবু সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল, আপনি পুলিশ?

মধুময় কামরার চতুর্দিকে প্রত্যেকটি লোকের মুখের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বেশ জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ, আমি পুলিশ। এরা সব সাধারণ হাটুরে লোক, এদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

স্বপ্না চোখ নামিয়েই ছিল। এবার একটুখানি তুলে বলল, ইয়ে… আপনি এদিকে কেন এসেছিলেন?

মধুময় বলল, এই একটু বেড়াবার জন্য এসেছিলাম! আপনাদের অসুবিধে হচ্ছে এখানে, আপনারা বরং ওই দিকে গিয়ে বসুন, আমি এখানে বসছি।

এষা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। সে স্বপ্নার হাত ধরে টানল।

স্বপ্না আর কোনো কথা বলল না। ওরা তিন জনে চলে গেল কামরার অন্য দিকে।

স্বপ্নাদের পরিত্যক্ত জায়গায় মধুময় বেশ শব্দ করে বসল, তারপর মাতালটিকে বলল, আমি এখন ঘুমোব, সোনারপুর এসে গেলে আমাকে একটু ডেকে দিতে পারবেন দাদা?

মধুময়ের চেহারার মধ্যে এমন কিছু আছে, যেজন্য চট করে সাধারণ মস্তানরা তাকে ঘাঁটাতে সাহস করবে না।

বাসবী ফিসফিস করে স্বপ্নাকে জিজ্ঞেস করল, তুই ভদ্রলোককে চিনিস?

স্বপ্না জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে। যেন শুনতেই পাচ্ছে না। বাসবী দু-তিন বার জিজ্ঞেস করার পর সে বলল, হ্যাঁ-চিনি-মানে আমরা আগে যে-পাড়ায় থাকতাম, সেখানে থাকেন।

এষা বলল, লঞ্চে যাওয়ার সময়ও ওই ভদ্রলোককে দেখেছিলাম মনে হচ্ছে। তুই তখন দেখিসনি?

স্বপ্না কোনো উত্তর দিল না।

বাসবী বলল, বেশ হ্যাণ্ডসাম চেহারা।

এষা বলল, ভদ্রলোক বললেন উনি পুলিশ, সত্যি তাই? দেখে কিন্তু বিশ্বাস হয় না।

স্বপ্না এবারও কোনো উত্তর দিল না।

বাসবী বলল, ওইরকম উপকারী পুলিশ আজকাল সহজে দেখাই যায় না।

এষা বলল, ভদ্রলোকের সঙ্গে ওরা আবার কোনো গোলমাল বাধাবে না তো!

মধুময় কিন্তু ঘুমের ভান করে চোখ বুজে আছে মাথা হেলান দিয়ে। মাতালটি চুপ মেরে গেছে।

স্বপ্নারা নামল বালিগঞ্জ স্টেশনে। অনেক রাত হয়ে গেছে।

ওরা ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডের দিকে এগিয়ে গেল।

এত রাতে ট্যাক্সি পাওয়া বেশ শক্ত। দু-তিনটে ট্যাক্সি রয়েছে, কিন্তু কোনো অনির্দিষ্ট কারণে ওদের নিতে চায় না। তারপর একটা ট্যাক্সি নিতে রাজি হল কোনো রকমে।

দরজা খুলে ট্যাক্সিতে ওঠার মুহূর্তে স্বপ্না একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল পেছনে।

একটা দোকানের পাশে মধুময় দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। তার মুখ দেখলেই বোঝা যায় স্বপ্নারা ট্যাক্সি না-পাওয়া পর্যন্ত সে ওখান থেকে নড়বে না।

স্বপ্নার মুখখানা তবু কঠিন হয়ে হইল। ট্যাক্সি চলতে শুরু করার পর বাসবী বলল, ভাগ্যিস ওই ভদ্রলোক ছিলেন… নইলে আজ কী যে হত…

এষা বলল, মাতালটা আমার হাত ধরার চেষ্টা করেছিল, ইস ভাবলেই গা ঘিন ঘিন করে…।

স্বপ্না যোগ দিল না ওদের কথাবার্তায়।

ট্যাক্সিটা চলে যাওয়ার পর মধুময় সিগারেট কেনবার জন্য দাঁড়াল আর একটা দোকানের সামনে। এতক্ষণ তার শরীরের সমস্ত স্নায়ু টান টান হয়েছিল। যেকোনো মুহূর্তে সে লাফিয়ে পড়ে ঘায়েল করে দিতে পারত সাত-আটজন লোককে। এমনকী শেষ ট্যাক্সিওয়ালাটিও যদি রাজি না হত, তাহলে মধুময় গিয়ে চেপে ধরত ওর টুটি। কিন্তু শেষপর্যন্ত সে-রকম কিছু ঘটেনি। তবু ভেতরে ভেতরে সে উত্তেজনা বোধ করছে এখনও। তার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। স্বপ্না তাকে আপনি বলছে। লঞ্চে যাওয়ার সময় স্বপ্না তাকে দেখতে পেয়েও একটা কথা বলেনি।

স্বপ্না বলেছিল, তুমি আর আমাদের বাড়িতে কখনো এসো না। মধুময় তো স্বপ্নাদের বাড়িতে যায়নি। কিন্তু পথে বা নদীর বুকেও কি স্বপ্নার সঙ্গে তার দেখা করা নিষেধ? সেটা ভালো করে জেনে নিতে হবে।

রতনের দেড় বছর জেল হলেও আইনের নানান ফাঁকে ধনা ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল। ধনার ভালো নাম ধনঞ্জয়। তার বাড়ির অবস্থা খুবই খারাপ। দু-তিন মাস ধরে ভবিষ্যতচিন্তা করার মতো বিলাসিতা সে করতে পারে না।

তাকে দু-বেলা খাদ্য সংস্থানের ব্যবস্থা করতেই হবে। শুধু তার নিজের জন্য নয়, পরিবারের সকলের জন্য। ধনার ছোটোভাইটি পড়াশুনোয় খুব ভালো। ধনা নিজে লেখাপড়া শিখতে পারেনি, তাই ছোটোভাইটিকে লেখাপড়া শেখাবার জন্য তার খুব আগ্রহ।

বেআইনি টাকা জমিয়ে রাখা যায় না। ধনা আগে যা রোজগার করেছিল, তার কিছুই নেই। ধনার মা আবার তার শেষ গয়নাটি পর্যন্ত বন্ধক দিয়ে ধনার জন্য উকিল ঠিক করেছিলেন।

জেল থেকে বেরিয়েই ধনা একটা গেঞ্জির কারখানায় কাজ জোগাড় করে ফেলল। কারখানায় শ্রমিক নয় অবশ্য, খানিকটা কেরানিগিরি আর খানিকটা মালিকের ফাইফরমাশ খাটা। মাইনে খুবই সামান্য।

ধনা স্কুল ফাইনাল পাশ করেছিল কোনো রকমে। ছেলেবেলা থেকেই ব্যায়াম করে তার চেহারা খুব তাগড়া, সে অসম্ভবরকম খেতে ভালোবাসে, সামান্য একটু তরকারি দিয়ে সে পনেরো- কুড়িখানা রুটি খেয়ে ফেলতে পারে অনায়াসে।

ধনা মাইনে পায় দু-শো চল্লিশ টাকা। ওদের পরিবারে পাঁচজন লোক। সুতরাং প্রত্যেক দিন পনেরো কুড়িখানা রুটি ধনার ভাগ্যে জোটার কথা নয়।

এক শনিবার বিকেলে পার্ক সার্কাস মাঠের কাছে ধনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল মধুময়ের। মধুময় তার পুরোনো সঙ্গীদের সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলছিল। ধনাকে দেখেও তাই মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছিল অন্য দিকে, কিন্তু ধনাই এসে ধরল তাকে।

কীরে মধু, চিনতেই পারছিস না যে!

মধুময় লজ্জা পেয়ে গেল। এরা তো কেউ তাকে জোর করে খারাপ পথে নিয়ে যায়নি। সেই গিয়েছিল স্বেচ্ছায়। সুতরাং এদের তো দোষ দেওয়া উচিত নয়। মধুময় বলল, না রে, দেখতে পাইনি তোকে, কেমন আছিস?

ধনা বলল, আর আছি! রোজ দু-বেলা জুতো খাচ্ছি। একটা চাকরি জুটিয়েছি ভাই কোনো রকমে, কিন্তু মালিক যখন-তখন শোনায়, দাগি আসামি, তোমায় চাকরি দিয়েছি এই ঢের!

মধুময় এখনও কোনো কাজ-টাজ করে না শুনে ধনা অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, তাহলে তুই কী করবি ঠিক করেছিস? কিছু ভাবিসনি!

মধুময় দু-দিকে ঘাড় নাড়াল।

ধনা বলল, আমার ইচ্ছে করছে, এ শালার চাকরিতে লাথি মেরে বেরিয়ে আসি। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটিয়ে মাসে মাইনে দেবে মাত্র দু-শো চল্লিশ টাকা! আর মালিক দিন দিন মোটা হবে!

মধুময় সত্যি দুঃখবোধ করল ধনার জন্য। ছেলেটা খুব খেতে ভালোবাসে এত কম টাকায় ওর চলবে কী করে?

ধনা বলল, আয়, একটু বসি। দু-চারটে কথা বলি।

মধুময়ের ইচ্ছে নেই, তবু আপত্তি করতে পারল না। ওরা গিয়ে মাঠের মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় বসল। কাছাকাছি কোনোও লোকজন নেই।

প্রথমে কিছুক্ষণ পুরোনো বন্ধুবান্ধবদের কথা হল। রতন নাকি ইতিমধ্যে জেল থেকে একবার পালাবার চেষ্টা করেছিল, ধরাও পড়ে যায়। সেজন্য রতনের মেয়াদ বেড়ে গেছে আরও।

বেচারা রতন! তাকে কখনো ঠিক ঝানু অপরাধী বলে মনে হয়নি মধুময়ের। এই সমাজের ওপরে রতনের একটা তীব্র রাগ আছে, সে রাজনীতি ঠিক বোঝে না, কোনো রাজনৈতিক দলে গিয়ে ভেড়েওনি, সে একা একাই কিংবা কয়েকজন মিলে এই সমাজকে ভেঙেচুরে দিতে চায়। এজন্য লোকে তাকে অসামাজিক বলবে ঠিকই। মধুময় এখন বুঝেছে যে এ ধরনের কাজ অসামাজিকতাই, যুক্তি দিয়ে এর কোনো সমর্থন করা যায় না।

ধনার সঙ্গে পার্কে বসে থাকতেও তার একটু লজ্জা লজ্জা করছে। কেউ দেখলে ভাববে, সে বুঝি আবার পুরানো দলে ভিড়তে চাইছে।

ধনা বলল, এই চাকরি আমার পোষাবে না। এটা আমায় ছাড়তেই হবে। আমি অন্য একটা কাজের কথা ভাবছি, তুই যদি সঙ্গে আসতে রাজি থাকিস

মধুময় জিজ্ঞেস করল, কী কাজ?

দেখ, ডাকাতি-ফাকাতি আমাদের পোষাবে না। ওসব কাজে অনেক হ্যাপা। ওর জন্য আলাদা ট্রেনিং লাগে। তা ছাড়া বেশি লোক নিয়ে কাজ হয় না। দু-জনেই যথেষ্ট। তুই রাজি থাকলে লেগে পড়তে পারিস।

কী কাজ?

তুই তো গাড়ি চালাতে পারিস?

তা শিখেছিলাম একসময়।

ওতেই হবে। আয় তাহলে তোতে আমাতে মিলে একটা দোকান খুলি।

মধুময় হেসে বলল।–গাড়ি চালাবার সঙ্গে দোকান খোলার কী সম্পর্ক?

ধনা বলল, বড়ো ব্যবসা করবার জন্য আমাদের ক্যাপিটাল কেউ দেবে না। ব্যাঙ্কে ধার নিতে গেলে সিকিউরিটি চাইবে কিংবা বলবে টুয়েন্টি পার্সেন্ট টাকা নিজেরা ইনভেস্ট করো—

সেইজন্যই বলছি, আমরা ছোটোখাটো একটা দোকান খুলতে পারি অন্তত।

মধুময় খুব একটা উৎসাহ দেখাল না। ছোটোখাটো দোকানের দোকানদার হওয়ার ইচ্ছে তার নেই।

ধনা তার মনের ভাব বুঝেই বলল, আরে তা-বলে কি আমি তেলেভাজার দোকান কিংবা গেঞ্জির দোকান খুলতে বলছি তোকে? তুই ভালো ফ্যামিলির ছেলে, তোর প্রেস্টিজে লাগবে। কিন্তু ধর, যদি একটা ওষুধের দোকান খোলা যায়? কত বড়ো বড়ো লোক ওষুধের দোকান চালায়।

কিন্তু তাতে তো অনেক টাকা লাগে।

সে-টাকার ব্যবস্থা করতে হবে। তারও উপায় আছে।

অন্তত কুড়ি-পঁচিশ হাজার টাকার কমে কি ওষুধের দোকান হয়?

ঠিক তাই। আমিও ওইরকম হিসেব ধরেছি। টাকাটা কীভাবে জোগাড় হবে শোন। আমার সঙ্গে একটা লোকের আলাপ হয়েছে, তার মল্লিকবাজারে ব্যবসা আছে। সে বলেছে, মোটামুটি ভালো কণ্ডিশানের গাড়ি যদি ওকে এনে ডেলিভারি দিতে পারি, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ক্যাশ চার হাজার টাকা দেবে।

গাড়ি? কী গাড়ি?

এই ফিয়াট, অ্যাম্বাসাডার। ফিয়াটের রেট একটু বেশি, পাঁচ হাজার।

ওসব গাড়ি আমরা পাব কোথায়?

ধনা হাত তুলে বলল, এই যে, রাস্তাঘাট দিয়ে এত গাড়ি যাচ্ছে। এর থেকে দু-একখানা আমরা তুলে নিতে পারব, না?

মধুময় ঠিক বুঝতে পারল না। ভুরু কুঁচকে ধনার দিকে তাকিয়ে রইল।

শোন, আমি সব প্ল্যান ছকে রেখেছি। আর কারুকে বলিনি, তোকেই বলছি। কেষ্ট গণেশ ওরাও আমাকে বলছিল, একটা কিছু কাজে নেমে পড়তে। কিন্তু ওদের আমি রিলাই করি না। তোর সঙ্গে আমার পটবে ভালো। এটা জেনে রাখিস আমি বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কখনো নেমকহারামি করি না।

সে তো বুঝলাম। কিন্তু আমরা গাড়ি কেনাবেচার ব্যবসা করব কী করে?

আমরা গাড়ি কিনতে যাব না, বেচতেও যাব না। আমাদের কাজ শুধু, এক জায়গা থেকে গাড়ি নিয়ে গিয়ে আর এক জায়গায় ডেলিভারি দেওয়া। বাকি কাজ সেই মল্লিকবাজারের লোকটাই করবে। আমরা এক একটা গাড়ির জন্য চার-পাঁচ হাজার করে টাকা পাব।

তার মানে গাড়ি চুরি করব?

তুই একে চুরি বলছিস কেন? চুরি কথাটা শুনতে খুব খারাপ লাগে। এটা হচ্ছে ডেলিভারি কেস। এক জায়গায় গাড়ি আমরা অন্য জায়গায় ডেলিভারি দেব। কার গাড়ি, কীসের গাড়ি, সে সব তো আমাদের জানবার দরকার নেই। সেসব বুঝবে মল্লিকবাজারের সেই লোকটা।

মধুময় হেসে বলল, ধুৎ! তুই একটা পাগল নাকি!

ধনা বলল, বুঝতে পারলি না? ধর যদি আমরা পাঁচ ছ-খানা গাড়ি ডেলিভারি দিতে পারি

মধুময় বলল, ডেলিভারি মানে কী? অন্য লোকের গাড়ি সরিয়ে মল্লিকবাজারে পাচার করে টাকা নেওয়া চুরি নয়?

এটাই সবচেয়ে মজার কাজ। অ্যাম্বাসাডার গাড়ির চাবি প্রায় সব এক। আর না হলেও তিন চার রকমের চাবি জোগাড় করা এমন শক্ত কিছুই না। রাত্তির বেলা নাইট শো সিনেমায় কিংবা অনেক মদের দোকানের সামনে যেসব গাড়ি থাকে, তার থেকে একখানা সরিয়ে ফেলতে কতক্ষণ লাগবে? আমি ঘাঁতঘোঁত সব জেনে নেব, তুই শুধু গাড়ি চালিয়ে সরে পড়বি।

মধুময় বিস্মিতভাবে ধনার দিকে তাকিয়ে রইল।

কি–রাজি?

তুই কেন গাড়ি চালানো শিখে নিচ্ছিস না? তাহলে তুই নিজেই তো–

এসব কাজ ঠিক একা একা করা যায় না। অন্ততপক্ষে দু-জন চাই। একজনকে নজর রাখতে হবে … দেখ, আমরা যদি কুড়ি-পঁচিশ হাজার টাকা ক্যাপিটাল তুলতে পারি তাহলেই আমরা একটা ওষুধের দোকান খুলে ফেলতে পারব। তাহলে বাড়ির লোকও কিছু সন্দেহ করবে না।

বাড়ির লোকেরা জিজ্ঞেস করবে না, দোকান খোলার টাকা কোথা থেকে পেলাম?

তুই বলবি, আমি দিয়েছি ক্যাপিটাল। আমি বলব, তুই দিয়েছিস! সেই দোকান থেকে যদি প্রফিট হয় তো ভালোই, তাহলে আমরা অন্য লাইন একদম ছেড়ে দেব। আর যদি প্রফিট না হয় তাহলে দোকানটা চালু রেখে আমরা একখানা দু-খানা করে গাড়ি সরাব। একটা-কিছু ব্যবসা বা ঠিক জায়গায় চাকরি জোগাড় করে নিতে পারলে, তারপর তুই তলায় তলায় চুরি কর, ডাকাতি কর, কেউ কিছু বলবে না। যত দোষ শালা শুধু বেকারদের। এদিকে অন্যরা যে চুরি করে ফাঁক করে দিচ্ছে… কি, রাজি?

মধুময় অনেকক্ষণ চুপ করে চিন্তা করল। একবার ভাবল, পুরো প্রস্তাবটাই হেসে উড়িয়ে দেয়। ধনা তার মুখের দিকে ব্যগ্রভাবে চেয়ে আছে।

যদি আবার ধরা পড়ি?

কলকাতায় গাড়ি চুরি করতে গিয়ে কেউ কখনো ধরা পড়েছে, তুই শুনেছিস? কোনো রেকর্ড নেই। ছিঁচকে চোরেরা গাড়ির পার্টস-টার্টস চুরি করতে গিয়ে অনেকসময় ধরা পড়ে। আমরা এসবের মধ্যে নেই। আমরা দারুণ সেজেগুজে ফিটফাট হয়ে যাব। আর তোর এ রকম সুন্দর চেহারা। তোকে কে সন্দেহ করবে? ধর বাইচান্স কেউ দেখে ফেলল, তাতেই বা কী, তুই বলবি, ভুল হয়ে গেছে। অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে এ-রকম প্রায়ই ভুল হয়। কি–হয় না?

মধুময় বলল, তা হয়!

তাহলে? আমাদের একটু বেশি টাকা হলে আমরা নিজেরাই একটা গাড়ি কিনে পাশে রেখে দেব। কেউ যদি আমাদের ধরতে আসে, আমরা ফাঁটের ওপর বলব, আরে মশাই ভুল হয়ে গেছে, এই তো পাশেই আমাদের গাড়ি! কি বল, প্ল্যানটা খারাপ? তুই রাজি থাকিস তো–

মধুময় হাসতে হাসতে বলল, এত সহজ?

ধনা বলল, হ্যাঁ রে, সত্যি সহজ। একবার ট্রাই করেই দেখা যাক-না। যে ভদ্রলোক গাড়ি ডেলিভারি নেয়, তার আরও ক্লায়েন্ট আছে। প্রায়ই তারা গাড়ি ডেলিভারি দেয়। এ-পর্যন্ত কেউ ধরা পড়েনি!

আচ্ছা, ভেবে দেখি!

এরমধ্যে ভাবাভাবির কী আছে? আমাদের তো একটা-কিছু করে দাঁড়াতে হবে। কলকাতা শহরে যারা গাড়ি চড়ে ঘুড়ে বেড়ায় তাদের একটা গাড়ি হারিয়ে গেলেও আর একটা গাড়ি কিনে ফেলতে পারে অনায়াসে। আমরা বেশি লোভ করব না, মাসে দু-খানার বেশি গাড়ি ডেলিভারি দেব না। আর যদি দোকানটা ভালোভাবে চলে, আমরা পুরোপুরি ভদ্রলোক হয়ে যাব। তোকে দোকানের জন্য বেশি খাটতে হবে না, সব আমি ম্যানেজ করব।

ঠিক আছে, ভেবে দেখি ব্যাপারটা।

শোন মধু, তোকে একটা কথা বলব? দেরি করে লাভ কী? শুভস্যশীঘ্রম বলে একটা কথা আছে-না? আজ শনিবার, আকাশটা মেঘলা মেঘলা, বৃষ্টি নামতে পারে, আজই আইডিয়াল দিন … আজই কাজ শুরু করা যাক-না? একটা গাড়ি ডেলিভারি দিতে পারলেই তোর দু-হাজার, আমার দু-হাজার।

আজ পারব না আমি।

কেন? তোর আজ বিশেষ কিছু কাজ আছে?

সেজন্য নয়। আমি ঠিক এক মাস তেইশ দিন সময় চাই।

এক মাস তেইশ দিন? তার মানে?

এই সময়টা আমি একটা বিশেষ জিনিস নিয়ে চিন্তা করছি। এ কটা দিন কেটে গেলে তারপর আমি ঠিক করব, তোর সঙ্গে এই কাজে নামব কিনা। আমি না নামলেও তুই অন্য লোক পেয়ে যাবি।

যা বাবাঃ! তুই কি ব্রত-ট্রত নিয়েছিস নাকি? এক মাস তেইশ দিন ধরে চিন্তা? এ-রকম শুনিনি কক্ষনো!

মধুময় উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁ, ব্রতই বলতে পারিস। তার আগে আমার অন্য কিছু করার উপায় নেই। এ লাইনে যদি আবার ফিরে আসি তাহলে তোর প্ল্যানটা খুবই ভালো সন্দেহ নেই। তোর সঙ্গেই নেমে পড়ব।

ধনা সেখানেই বসে রইল অবাক হয়ে। মধুময় হন হন করে হেঁটে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেল।

দেশপ্রিয় পার্ক থেকে রাসবিহারীর মোড়। শুধু এই জায়গাটুকুতে মধুময় জীবনে আর কখনো যাবে না। এ ছাড়া কলকাতার বাকি অংশ বা কলকাতার বাইরে, কিংবা গোটা ভারতবর্ষ, সব জায়গাতেই মধুময়ের যাওয়ার অধিকার আছে। সে স্বাধীন, পুলিশও তার নামে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত করতে পারেনি।

মধুময় এখন প্রায় কোনো সময়েই বাড়িতে থাকে না। মা কোনো অভিযোগ করতে পারেন না। কারণ মধুময় মাকে খুব স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে যে, তাকে দু-মাস সময় দিতে হবে।

পা-জামা, পাঞ্জাবিপরা। আর একটা কালো রঙের শাল জড়ানো গায়, মধুময় যেন একজন সন্ন্যাসী, সে শহরের পথে পথে একলা একলা ঘুরে বেড়ায়। সামান্য চেনাশুনো কাউকে দেখলেই সে সরে যায় চট করে। কারুর সঙ্গে তার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। সন্ন্যাসীরা সবসময় ভগবানের কথা চিন্তা করে কি না কে জানে, কিন্তু মধুময়ের বুকের মধ্যে, সবসময় একটিই ছবি, স্বপ্নার মুখ।

এজন্য এক-এক সময় নিজের ওপরেই খুব বিরক্ত হয়ে ওঠে মধুময়। পৃথিবীতে স্বপ্না ছাড়া কি আর কিছু নেই? সে কি অন্য কিছু নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে না? ধরা যাক স্বপ্না মরে গেছে। জেল থেকে বেরিয়ে মধুময় যদি শুনত যে, হঠাৎ একটা অসুখে স্বপ্না মারা গেছে ইতিমধ্যে, তা হলে মধুময় কী করত? সে কি পাগল হয়ে যেত? কিংবা আত্মহত্যা করত? কতরকম কঠিন শোক সহ্য করেও তো মানুষ বেঁচে থাকে। ছেলের মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে মা, এর চেয়ে বড়োশোক তো আর নেই।

চাকরি ছাড়াও কি একজন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না? মধুময়ের গায়ে জোর আছে, শুধু শারীরিক শক্তি দিয়ে এখনও একজন মানুষ, এই শহরে নিজে বেঁচে থাকার মতন টাকা রোজগার করতে পারে।

রেলস্টেশনে কুলিরা কি বেঁচে নেই? সেইসব কুলিরাও কখনো কখনো হাসে, তারাও গান গায়, অর্থাৎ তাদের জীবনেও কিছু-না-কিছু সুখ আছে। কত বেকার ছেলে তো ফুটপাথে বসে ফ্রক কিংবা গেঞ্জি বিক্রি করে, মধুময় তাও পারে। সে পারে ট্রেনে ট্রেনে আশ্চর্যমলম কিংবা ডটপেন ফিরি করতে। এসব ব্যাপারে মধুময়ের কোনো লজ্জা নেই।

কিন্তু এগুলো করতে গেলে মধুময়কে একা হয়ে যেতে হবে। একা হলে সে যেভাবেই হোক নিজের জীবনটা কাটিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু সে একা নয়। তার দু-দিকে বাধা আছে। বাবা রিটায়ার করবেন শিগগিরই, সবাই আশা করে আছে, তারপর মধুময়ই সংসারের দায়িত্ব নেবে। মধ্যবিত্ত পরিবারে এ-রকমই নিয়ম।

সে এক ছেলে, তার দিদির বিয়ে হয়ে গেছে, ছোটবোন কলেজে পড়ে। এ-রকম সংসারে ছেলেটিকেই ঘাড় পেতে সংসারের দায়িত্ব নেবার জন্য তৈরি হতে হয়। সেইজন্যই তাকে শেখানো হয়েছে লেখাপড়া। সেই লেখাপড়া শেখার বিনিময়ে সরকার তাকে চাকরি দিতে অক্ষম, সেটাও কি মধুময়ের দোষ?

মধুময় স্টেশনের কুলি কিংবা ট্রেনের ফেরিওয়ালা হয়ে টাকা রোজগার করে সংসার চালাতে চাইলেও কেউ তা মেনে নেবে না। কারণ তারা ভদ্রলোক। ভদ্রলোকদের ওসব করতে নেই। সে স্টেশনের কুলি কিংবা ট্রেনের ফেরিওয়ালা হলে তার ছোটোবোনের ভালো জায়গায় বিয়ে হবে না পর্যন্ত! মা কেঁদে ভাসাবেন। মা তাঁর বড়োলোক ভাইদের কাছে কাকুতিমিনতি করবেন মধুময়ের যেকোনো একটা ভদ্রলোকের চাকরি জোগাড় করে দেওয়ার জন্য।

কারুকে ঘুস দিয়ে চাকরি জোগাড় করতেও মা-বাবাদের কোনো আপত্তি নেই। মধুময় গুণ্ডামি ডাকাতি করে টাকা রোজগার করলেই আপত্তি। ধরা না পড়লে বোধ হয় তাতেও আপত্তি থাকত না। যারা চোরাই মালের ব্যবসা করে, তারাও সবাই ভদ্রলোক।

স্বপ্নার প্রেমিক হিসেবেও সে কুলি কিংবা ফেরিওয়ালা হতে পারে না। স্বপ্নার প্রেমিক! মধুময়ের হাসি পায়।

স্বপ্না তাকে সারাজীবনের মতন তার সঙ্গে আর দেখা করতে বারণ করেছে। কখনো পথে দেখা হয়ে গেলেও মুখ ঘুরিয়ে নেয় সে। তবু মধুময়ের সন্দেহ হয়। স্বপ্না কি সত্যি সত্যিই তাকে ছেড়ে থাকতে পারবে?

মধুময় যেমন মনে করে, তার হৃদয়ের একটা টুকরো স্বপ্নার কাছে গচ্ছিত আছে, তেমনি স্বপ্নার হৃদয়েরও একটা টুকরো কি মধুময়ের কাছে গচ্ছিত নেই? হঠাৎ একসময় স্বপ্নারও কি মনে হবে না যে, মধুময়কে ছাড়া সে বাঁচতে পারবে না?

মধুময় একবার ভুল করেছে বলে কি স্বপ্না তাকে ক্ষমা করতে পারে না? মধুময়ের মুখ দেখে কি স্বপ্না বুঝতে পারে না যে, মধুময় জাত-অপরাধী নয়? মধুময় যদি প্রতিশ্রুতি দেয় তাও স্বপ্না মেনে নেবে না? মধুময় একবার বিশ্বাসভঙ্গ করেছে বলে স্বপ্না তাকে আর বিশ্বাস করবে না। খানিকটা অ্যাডভেঞ্চার আর সহজে টাকা রোজগারের লোভেই মধুময় রতনদের দলে গিয়ে ভিড়েছিল। সেজন্য মধুময় কখনো ঠিক অনুতাপ বোধ করে না। এই সমাজে যারা অন্যায়ভাবে টাকা রোজগার করে, তাদের অতিরিক্ত টাকা আছে, তাদের কাছ থেকে কিছু টাকা কেড়ে নেওয়াটা তেমন অন্যায় মনে করে না মধুময়। এই সমাজ যখন সমানভাবে ভাগ করে দিতে পারছে না, তখন কেউ কেউ তো নিজেদের দাবি আদায় করার চেষ্টা করবেই।

তবু স্বপ্নার কথাই চিন্তা করেই মধুময় ওই দিকটা একেবারে ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছে। সে চাকরি জোগাড় করে ভদ্রলোক সাজবে। মুম্বাইতে গেলে কিছু-একটা হয়ে যাবে মনে হয়। কিন্তু তার আগে জেনে নেওয়া দরকার, স্বপ্না তার কাছে ফিরে আসবে কি না। স্বপ্নার জন্যেই তো এতখানি আত্মত্যাগ। নইলে নিছক মধ্যবিত্তের মতন সে মুম্বাই গিয়ে চাকরির হ্যাংলামি করতে যাবে কেন?

যদি মধুময়ের বদলে স্বপ্না কোনো মারাত্মক ভুল করে ফেলত? না, স্বপ্না কোনো ভুল কিংবা অন্যায় করবে না, তার নীতিবোধ খুবই পরিচ্ছন্ন এবং গতানুগতিক। সততা আর সাফল্যের জন্যই স্বপ্না বেশি সুন্দর। তবু কোনো দুর্ঘটনাও তো ঘটতে পারে।

স্বপ্না খুব ট্যাক্সি চড়তে ভালোবাসে। স্বপ্না একা ট্যাক্সিতে যাওয়ার সময় স্বপ্নাকে হঠাৎ কেউ জোর করে ধরে নিয়ে যেতে পারত। তারপর স্বপ্নার ওপর বলাৎকার করে তাকে ছেড়ে দিল। হঠাৎ একদিন মধুময় জানতে পারল, স্বপ্না সন্তানসম্ভবা! তখন মধুময় কী করত? সে কি ঘৃণায় আর স্বপ্নার মুখ দেখতে চাইত না?

মধুময়ের পক্ষে তা কি সম্ভব? সেই বিপদের সময় সেই তো ছুটে গিয়ে স্বপ্নার পাশে দাঁড়াত। স্বপ্নার গর্ভের সন্তানের পিতৃত্ব দিত সে নিজে। সবচেয়ে বড়োকথা, স্বপ্নার মনে যাতে কোনো আঘাত না লাগে, সেটাই বেশি করে দেখত মধুময়।

কিংবা অন্যরকম কিছুও হতে পারত। স্বপ্না সবাইকে বিশ্বাস করে। মধুময় জানে, স্বপ্নার খুড়তুতো ভাই চাঁদু মোটেই ভালোছেলে নয়! অল্পবয়স থেকেই বখে গেছে। বাজে বাজে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেশে চাঁদু-জুয়া-টুয়া খেলে, আরও অন্য কিছু করে কিনা কে জানে!

মধুময় দু-এক বার স্বপ্নাকে চাঁদুর কথা বলেছে, স্বপ্না তা উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, যাঃ, চাঁদু খুব ভালো ছেলে, লেখাপড়ায় মাথা নেই, কিন্তু পাড়ার কত লোককে সাহায্য করে।

ধরা যাক, সেই চাঁদু ভুলিয়ে-ভালিয়ে স্বপ্নাকে কোথাও নিয়ে গেল। তারপর কোনো পাপচক্রে জড়িয়ে ফেলল তাকে। এমনও তো হতে পারে চাঁদুর বন্ধুরা খেপে উঠল স্বপ্নার জন্য, তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করতে করতে একজন খুন হয়ে গেল ওদের মধ্যে। সেইসময় পুলিশ গিয়ে গ্রেফতার করল সবাইকে। খুনের ব্যাপার, নিশ্চয়ই স্বপ্নাকেও জেলে আটকে রাখবে। হঠাৎ সেই খবর শুনে মধুময় কি অমনি ভেবে বসবে যে, স্বপ্না তার চোখের আড়ালে উচ্ছন্নে গেছে, সে আর স্বপ্নার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবে না!

রাস্তায় যেতে যেতে মধুময় থমকে দাঁড়ায়। যেন সে চোখের সামনে দেখতে পায় জেলখানার জেনানা ফাটকে বন্দিনি রয়েছে স্বপ্না। চোখের নীচে দুশ্চিন্তার কালি। ভিজিটার্স রুমে দেখা করতে গেছে মধুময়।

মধুময়কে দেখেই কেঁদে ফেলল স্বপ্না। মুখ ঢেকে সে বলছে, না না, আমি তোমার কাছে আর মুখ দেখাতে চাই না।

মধুময় স্বপ্নার হাতটা ছুঁয়ে বলল শান্ত হও!

স্বপ্না হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললে, না তুমি আমায় ছুঁয়ো না, আমি নষ্ট হয়ে গেছি।

মধুময় বলল, স্বপ্না, মুখ তোলো, আমায় দিকে তাকাও।

স্বপ্না বলল, আমার এখন মরে যাওয়াই ভালো।

মধুময় বলল, ছি:!

স্বপ্না বলল, আর তোমার পাশে দাঁড়াবার যোগ্যতা আমার নেই। এ পৃথিবীতে আমার আর স্থান নেই।

মধুময় দৃঢ় গলায় বলল, শোনো স্বপ্না, তোমায় যদি কেউ নরকে নিয়ে যেত, আমি সেখান থেকেও তোমায় খুঁজে আনতাম। আমি জানি, তোমার গায়ে ময়লা লাগলেও তোমার মনে কখনো ময়লা লাগতে পারে না। আমি কি কখনো তোমায় ছেড়ে…

রাস্তার লোক অবাক হয়ে মধুময়কে দেখে। সে পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছে। ঠিক যেন একটা পাগল।

এক সময় মধুময় চমকে উঠে সচেতন হয়ে যায়। লজ্জা পেয়ে সে দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। সত্যিই তো স্বপ্নার কথা ভেবে ভেবে সে পাগল হয়ে গেল নাকি?

সাময়িকভাবে ভুলে থাকার জন্য, মাঝেমধ্যে সে সিনেমা-থিয়েটার দেখতে যায়। তবু কিছুতেই সেখানেও মন বসে না। খানিকটা বাদে সে টের পায় যে সিনেমার গল্পটা সে কিছুই বুঝতে পারছে না। কারণ সে পর্দার দিকে চেয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু তার মনের মধ্যে চলছে স্বপ্নার চলচ্চিত্র।

অনেক সময় দেখা যায়, ময়দানে কোনো অখ্যাত ক্লাবের ছেলেরা ক্রিকেট প্র্যাকটিস করছে, গায়ে চাদর দেওয়া লম্বা চেহারার মধুময় তাদের একমাত্র দর্শক। সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। ইচ্ছে করলে কি মধুময়ও ওদেরই মতন খেলাধুলো করে আনন্দে মেতে থাকতে পারত না? কিন্তু তার জীবনটা বদলে গেছে। সে আর অন্য কারুর মতন নয়।

একদিন সন্ধ্যেবেলা একটা বাড়ির সামনে মধুময় খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

এই বাড়িটা তার খুব চেনা। পুরোনো আমলের বাড়ি, সামনে লোহার গেট, ভেতরে একটু ছোট্টবাগান, তারপর হলুদ রঙের তিনতলা। দোতলার ডান দিকে যে ছোট্ট ঝোলানো বারান্দা, সেখানে মধুময় কতদিন দাঁড়িয়ে থেকেছে।

এবাড়িতে অমল থাকে, মধুময়ের স্কুলের বন্ধু। এক সময় মধুময় এবাড়িতে প্রায় প্রতিদিন আসত, অমলের মা-বাবা, ভাই-বোনেরা সবাই তাকে চেনে। অমলের মা, তাকে নিজের ছেলের মতন ভালোবাসতেন। অমলেরও একসময় শখ ছিল ছবি আঁকার, কতদিন মধুময় আর অমল ওই ঝুল বারান্দায় বসে ছবি এঁকেছে একের-পর-এক।

একদিনের ঘটনার পর মধুময় আর এবাড়িতে আসে না। তখন মধুময় আর অমল ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে, ওরা দু-জনে বসে ছবি আঁকছিল এক দুপুরে, এমন সময় হঠাৎ অমলের বাবা সেখানে এলেন। অমলের বাবাকে অত রেগে যেতে মধুময় আগে কখনো দেখেনি। তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন, পড়াশোনা নেই, কিছু না, দিনরাত শুধু ছবি আর ছবি! তোরা কালীঘাটের পোটো হবি ভেবেছিস। নিকুচি করেছে ছবি আঁকার!

তারপর অমলের বাবা অমলের আঁকা ছবিগুলো খামচে তুলে নিয়ে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন।

খুব অপমানিত বোধ করেছিল মধুময়, সে নিঃশব্দে উঠে বেরিয়ে গিয়েছিল। আর আসেনি কোনোদিন।

এমনকী মধুময় পাটনা থেকে ফেরার পর খবর পেয়েছিল যে, অমলের মায়ের খুব অসুখ, তবু সে দেখা করতে আসেনি একবারও। অমলের মা মারা গেছেন।

মধুময় গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকে এসে কলিংবেল টিপল।

দরজা খুলে দিল একজন পুরোনো ভৃত্য। এর নাম রাখু। এও মধুময়কে চেনে। সে একটু হেসে বলল, দাদাবাবু অনেক দিন পর এলেন।

অমল আছে?

হ্যাঁ আছেন।

Pages: 1 2 3 4 5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *