গহনার গতি গৃহিণীর দিকে
বেলা আন্দাজ সাড়ে ন’টার সময় আমরা দু’জনে আমাদের বসিবার ঘরে চৌকির উপর মুখোমুখি উপবিষ্ট ছিলাম। সত্যবতীকে আর এক প্রস্থ চায়ের ফরমাশ দেওয়া হইয়াছে। নেকলেস-পর্বের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চলিতেছে।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘অনর্থক হয়রানি। ডাক-বাক্সটা দোরের পাশেই আছে। এটা যদি প্রথমে নজরে পড়ত তাহলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব নিস্পত্তি হয়ে যেত। কলকাতা শহরে দেয়ালে-গাঁথা অসংখ্য ডাক-বাক্স আছে, কিন্তু হঠাৎ চোখে পড়ে না। ডাক-বাক্সের রাঙা গায়ে ইস্তাহারের কাগজ জুড়ে তাকে প্রায় অদৃশ্য করে তুলেছে। যারা জানে তাদের কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু যারা জানে না তাদের পক্ষে খুঁজে বার করা মুশকিল।
‘প্রথম যখন নেকলেস চুরির বয়ান শুনলাম, তখন তিনজনের ওপর সন্দেহ হল। ভোলা, মণিময় এবং মণিময়ের স্ত্রী, এদের মধ্যে একজন চোর। কিংবা এমনও হতে পারে যে, এই তিনজনের মধ্যে দু’জন ষড় করে চুরি করেছে। মণিময় এবং ভোলার মধ্যে ষড় থাকতে পারে, আবার স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ষড় থাকতে পারে। ভোলা এবং মণিময়ের স্ত্রীর মধ্যে সাজশ থাকার সম্ভাবনাটা বাদ দেওয়া যায়।
‘কিন্তু চুরি যে-ই করুক, চোরাই মাল গেল কোথায়? চুরি জানাজানি হবার একঘন্টার মধ্যে পুলিস এসে বাড়ির দোতলা তেতলা খানাতল্লাশ করেছিল, কিন্তু বাড়িতে মাল পাওয়া গেল না। একমাত্র ভোলাই দুপুর রাত্রে রাস্তায় নেমেছিল। কিন্তু সে বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল, দূরে যায়নি। অন্য কোনও লোকের সঙ্গে তার দেখাও হয়নি। ভোলা যদি চুরি করে থাকে, তবে সে নেকলেস নিয়ে করল। কী? মণিময় এবং তার স্ত্রীর সম্বন্ধে ওই একই প্রশ্ন-তারা গয়নাটা কোথায় লুকিয়ে রাখল?
‘তিনজনের ওপর সন্দেহ হলেও প্রধান সন্দেহভাজন ব্যক্তি অবশ্য ভোলা। মণিময় যখন নেকলেস এনে বাবাকে দিল তখন সে উপস্থিত ছিল। কেসের মধ্যে দামী গয়না আছে তা অনুমান করা তার পক্ষে শক্ত নয়। সন্ধ্যের সময় সে গামছা কেনার ছুতো করে বাইরে গিয়েছিল; এইটেই তার সবচেয়ে সন্দেহজনক কাজ। সে যদি বাইরের লোকের সঙ্গে সাজশ করে চুরির মতলব করে থাকে। তবে সহকারীকে খবর দিতে যাওয়া তার পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু সে গয়না। চুরি করে সহকারীকে দিল কী করে?
‘তারপর ধর মণিময়ের কথা। মনে কর, মণিময় আর তার স্ত্রীর মধ্যে সাজশ ছিল। মনে কর, রাত্রি এগারটার সময় মণিময় ক্লাব থেকে বাড়ি এসেছিল, বাপের দেরাজ থেকে গয়না চুরি করে আবার বেরিয়ে গিয়েছিল; তারপর গয়নাটা কোথাও লুকিয়ে রেখে পৌঁনে বারটার সময় বাড়ি ফিরে এসেছিল। অসম্ভব নয়; কিন্তু তা যদি হয়, তাহলে ভোলা কি জানতে পারত না? জানতে পারলে সে কি চুপ করে থাকত?
এই সময় সত্যবতী চা লইয়া প্রবেশ করিল এবং আমাদের সামনে পেয়ালা রাখিয়া হাসি-হাসি মুখে বলিল, ‘এই যে, কচ্ছপের মুখে বুলি ফুটেছে দেখছি।’
ব্যোমকেশ কটমট করিয়া চাহিল। কিন্তু সত্যবতী তাহার রোষদৃষ্টি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়া বলিল, ‘বলছ বল, এখন আমার হাত জোড়া। পরে কিন্তু আবার বলতে হবে।’ বলিয়া সে চলিয়া গেল।
আমরা কিছুক্ষণ নীরবে বসিয়া চা পান করিলাম। কচ্ছপের উপমাটা ব্যোমকেশের পছন্দ হয় নাই, তাহা বুঝিতে কষ্ট হইল না। মনে আমোদ অনুভব করিলাম। এবার সুবিধা পাইলেই তাহাকে কচ্ছপ বলিব।
যাহোক, কিছুক্ষণ পরে সে আবার বলিতে আরম্ভ করিল, ‘মণিময় আর বৌয়ের ওপর যে সন্দেহ হয়েছিল, সেটা স্রেফ সুযোগের কথা ভেবে। মোটিভের কথা তখনও ভাবিনি। মণিময়ের মোটা টাকার দরকার হতে পারে, তার বৌয়ের গয়নার প্রতি লোভ থাকতে পারে; কিন্তু ওদের পারিবারিক জীবন যতটা দেখলাম তাতে চুরি করার দরকার আছে বলে মনে হয় না। রসময়বাবু স্নেহময় পিতা, স্নেহময় শ্বশুর। ছেলে এবং পুত্রবধূকে তাঁর অদেয় কিছুই নেই। যা চাইলেই পাওয়া যায় তা কেউ চুরি করে না।
‘ভোলার কথা কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। সুযোগ এবং মোটিভ, দুই-ই তার পুরোমাত্রায় আছে। লোকটা ভারী ধূর্ত আর স্থিরবুদ্ধি। হয়তো চাকরিতে ঢুকে অবধি সে চুরির মতলব আঁটছিল এবং মনে মনে প্ল্যান ঠিক করে রেখেছিল। কাল বিকালবেলা মস্ত দাঁও মারবার সুযোগ জুটে গেল। বাড়িতে দামী গয়না এসেছে, কিন্তু গিন্নী সিন্দুকের চাবি নিয়ে তীর্থ করতে চলে গেছেন।
‘ভোলার সাজশ ছিল তার বড় ভাই ভূতনাথের সঙ্গে। ভেবে দেখ, কেমন যোগাযোগ। ভূতনাথ পোস্ট-অফিসে কাজ করে; তার কাজ হচ্ছে রাস্তার ধারের ডাক-বাক্স থেকে চিঠি নিয়ে ঝোলায় ভরে পোস্ট-অফিসে পৌঁছে দেওয়া। হালফিল বৌবাজার এলাকায় তার কোজ; সকাল বিকেল দুপুরে তিনবার এসে সে ডাক-বাক্স পরিষ্কার করে নিয়ে যায়।
‘ভোলা গামছা কেনার ছুতো করে ভূতনাথের কাছে গেল। তাকে বলে এল, সকালবেলা ডাক পরিষ্কার করতে গিয়ে সে ওই ডাক-বাক্সটার মধ্যে একটা প্যাকেট পাবে, সেটা যেন সে নিয়ে না যায়, ডাক-বাক্সতেই রেখে দেয়। তারপর পুলিসের হাঙ্গামা কেটে যাবার পর সেটা বাড়ি নিয়ে যাবে। সাধারণ ডাক-বাক্সে প্যাকেট কেউ ফেলে না, তাই প্যাকেট চিনতে কোনও কষ্ট নেই। বিশেষত এই প্যাকেটে সম্ভবত ঠিকানা লেখা থাকবে না।
‘ভূতনাথ লোকটা ভালমানুষ গোছের। কিন্তু সে লোভে পড়ে গেল। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। চাকরি তো যাবেই, সম্ভবত শ্ৰীঘর বাসও হবে।
‘কাল বিকেল পর্যন্ত আমি অন্ধকারে হাতড়াচ্ছিলাম। তারপর যেই দেখলাম মণিময় ডাক-বাক্সে চিঠি ফেলছে অমনি সব পরিষ্কার হয়ে গেল। ভোলা বলেছিল তার এক ভাই পোস্ট-অফিসে চাকরি করে। কে চোর, কী চুরি করেছে, চোরাই মাল কোথায় আছে, কিছু অজানা রইল না। ভোলা সিঁড়ি দিয়ে নেমে টুক করে প্যাকেটটা ডাক-বাক্সে ফেলে আবার উপরে উঠে গিয়েছিল। হয়তো দরজার সামনে মিনিটখানেক দাঁড়িয়েছিল হাঁফ নেবার জন্যে। মণিময় যে ক্লাব থেকে ফেরেনি এবং মণিময়ের বৌ যে জানালায় দাঁড়িয়ে স্বামীর পথ চেয়ে আছে তা সে জানত না।
‘আমি যখন ব্যাপার বুঝতে পারলাম, তখন সটান অমরেশবাবুর কাছে গেলাম। ভোলার দাদা ভূতনাথ কী কাজ করে, পোস্ট-অফিসে খবর নিয়ে জানা গেল। তখন বাকী রইল। শুধু আসামীদের ফাঁদ পেতে ধরা এবং স্বীকারোক্তি আদায় করা।’
দরজায় ঠক্ ঠহ্ শব্দ শুনিয়া দ্বার খুলিলাম। মণিময় দাঁড়াইয়া আছে। হাসিমুখে বলিল, ‘বাবা পাঠালেন।’
ব্যোমকেশ ভিতর হইতে বলিল, ‘আসুন মণিময়বাবু।’
মণিময় ভিতরে আসিয়া বসিল, পকেট হইতে একটি ছোট্ট নীল মখমলের কোঁটা লইয়া ব্যোমকেশের সম্মুখে রাখিল, ‘বাবা এটি আপনার জন্যে পাঠালেন। তিনি নিজেই আসতেন, কিন্তু তাঁর পা—’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘না না, উপযুক্ত ছেলে থাকতে তিনি বুড়োমানুষ আসবেন কেন? তা–নেকলেস পেয়ে তিনি খুশি হয়েছেন?’
মণিময় হাসিয়া ঘাড় নাড়িল, ‘সে আর বলতে! তিনি আমাকে বলতে বলেছেন, এই সামান্য জিনিসটা আপনার প্রতিভার উপযুক্ত নয়, তবু আপনাকে নিতে হবে।’
‘কী সামান্য জিনিস?’ ব্যোমকেশ কোঁটা লইয়া খুলিল; একটা মটরের মত হীরা ঝকঝক করিয়া উঠিল। হীরার আংটি? ব্যোমকেশ আংটিটা সসন্ত্রম চক্ষে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, ‘ধন্যবাদ। আপনার বাবাকে বলবেন আংটি আমি নিলাম। এটাকে দেখে মনে হচ্ছে। আমি এর উপযুক্ত নই। চললেন না কি? চা খেয়ে যাবেন না?’
মণিময় বলিল, ‘আজ একটু তাড়া আছে। দুপুরের প্লেনে দিল্লী যেতে হবে। ফিরে এসে আর একদিন আসব, তখন চা খাব।’
মণিময় চলিয়া গেল। প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গে ভিতর দিক হইতে সত্যবতী প্রবেশ করিল। বোধ হয়। পর্দার আড়ালে ছিল। ললিতকণ্ঠে বলিল, ‘দেখি দেখি, কী পেলে?’
ব্যোমকেশ আংটির কোঁটা লুকাইয়া ফেলিবার তালে ছিল, আমি কাড়িয়া লইয়া সত্যবতীকে দিলাম। বলিলাম, ‘এই নাও। এটা ব্যোমকেশের প্রতিভার উপযুক্ত নয়, এবং ব্যোমকেশ এর উপযুক্ত নয়। সুতরাং এটা তোমার।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আরো আরে, এ কী?’
আংটি দেখিয়া সত্যবতীর চক্ষু আনন্দে বিস্ফারিত হইল, ‘ও মা, হীরের আংটি, ভীষণ দামী আংটি! হীরেটারই দাম হাজার খানেক।’ আংটি নিজের আঙুলে পরিয়া সত্যবতী ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিল, ‘কেমন মানিয়েছে বল দেখি!-ঐ যাঃ, মাছের ঝোল চড়িয়ে এসেছি, এতক্ষণে বোধহয় পুড়ে ঝুড়ে শেষ হয়ে গেল।’ সত্যবতী আংটি পরিয়া চকিতে অন্তৰ্হিত হইল।
ব্যোমকেশ তক্তপোশে এলাইয়া পড়িয়া গভীর নিশ্বাস মোচন করিল, বলিল, ‘গহনা কৰ্মণো গতিঃ।
বলিলাম, ঠিক কথা। এবং গহনার গতি গৃহিণীর দিকে।’