সন্তোষবাবু মারা গেছেন
পরদিন বেলা ন’টার সময় সন্তোষবাবুর অফিসে উপস্থিত হইলাম।
সন্তোষবাবু সবেমাত্র আসিয়া অফিসে বসিয়াছেন, ব্যোমকেশকে দেখিয়া সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিলেন, ‘একি! আপনি এখনো এখানে?’
ব্যোমকেশ পূর্ণদৃষ্টিতে তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, ‘আপনার জন্যে ফাঁদ পাতব ভেবেছিলাম, তা আর দরকার হল না। হ্যাঁ , উড়িষ্যা সরকারের নিমন্ত্রণ আমি পেয়েছি, কিন্তু এখনো যাওয়া হয়নি। বসতে পারি?’ অনুমতির অপেক্ষা না করিয়াই সে চেয়ারে বসিল। আমিও বসিলাম।
বেফাঁস কথা মুখ দিয়া বাহির হইয়া গিয়াছে। সন্তোষবাবুর মুখ ক্ষণকালের জন্য লাল হইয়া উঠিল। তারপর তিনি আত্মসংবরণ করিয়া বলিলেন, ‘উড়িষ্যা সরকার!’
ব্যোমকেশের ঠোঁটে একটু হাসি খেলিয়া গেল, সে বলিল, ‘আপনার সুপারিশে উড়িষ্যা সরকার আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন; আপনার উদ্দেশ্য তো তাঁরা জানেন না। কিন্তু ও-কথা যাক। সন্তোষবাবু্, হেনা মল্লিককে কে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল আমি জানতে পেরেছি।’
আমি সন্তোষবাবুকে লক্ষ্য করিতেছিলাম, দেখিলাম তাঁহার মুখ পাঙাস হইয়া যাইতেছে, সঙ্গে সঙ্গে চক্ষু দুটা সৰ্পচক্ষুর ন্যায় হিংস্র হইয়া উঠিতেছে। তিনি যে কিরূপ ভয়ঙ্কর প্রকৃতির লোক, কোণঠাসা বন-বিড়ালের মত তাঁহার সম্মুখীন হওয়া যে অতিশয় বিপজ্জনক কাজ, তাহা নিমেষ মধ্যে পরিস্ফুট হইয়া উঠিল। দাঁতে দাঁত চাপিয়া তিনি বলিলেন, ‘কে তাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল?
ব্যোমকেশ সহজ সুরে বলিল, ‘আপনি।’
যেন কেহ তাঁহার গলা চাপিয়া ধরিয়াছে এমনি স্বরে সন্তোষবাবু বলিলেন, ‘প্রমাণ করতে পারেন?’
ব্যোমকেশ শান্তভাবে মাথা নাড়িল, ‘না। তবে আপনার মোটিভ আছে তা প্রমাণ করা যায়।’
‘তাই নাকি। আমি আপনার নামে মানহানির মোকদ্দমা করে আপনাকে জেলে পাঠাতে পারি তা জানেন?’
‘আমার নামে মোকদ্দমা করবার সাহস আপনার নেই, সন্তোষবাবু! আমার কাছে আস্ফালন করেও লাভ নেই। শুনুন, আপনি আমাকে আপনার পরিবারিক স্বার্থরক্ষার কাজে নিযুক্ত করেছিলেন, সে কাজ আমি করেছি। যে কারণেই হোক, পুলিস হেনার মৃত্যুর তদন্ত বন্ধ করে দিয়েছে, আমার ও-বিষয়ে কোন কর্তব্য নেই। কিন্তু সত্য কথা জানিবার অধিকার সকলেরই আছে। আমি সত্য কথা জানতে পেরেছি।’
সন্তোষবাবু কিয়ৎকাল চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার চোখের মধ্যে কত প্রকার চিন্তা বিদ্যুতের মত খেলিয়া গেল তাহা নির্ণয় করা যায় না। শেষে তিনি বলিলেন, ‘কি সত্য কথা জানতে পেরেছেন আপনি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনি যা খুঁজেছিলেন, কিন্তু আপনি পাননি, যার জন্যে আপনি ঘরে আগুন দিয়েছিলেন, আমি তাই পেয়েছি! একখানা বই-রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম, আর কয়েকটা চিঠি।’
সন্তোষবাবুর রগের শিরা ফুলিয়া উঠিল। তিনি অসহায় বিষাক্ত চোখে চাহিয়া বলিলেন, ‘কি চান আপনি? টাকা?’
ব্যোমকেশ শুষ্কস্বরে বলিল, ‘আমাকে ঘুষ দিতে পারেন এত টাকা আপনারও নেই, সম্ভোষবাবু। আপনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, দেশদ্রোহিতা করেছেন, তার শাস্তি পেতে হবে।’
সন্তোষবাবু নির্বাক চাহিয়া রহিলেন, তাঁহার রাগের শিরা দপদপ করিতে লাগিল।
‘হেনার মা মীনার সঙ্গে আপনার প্রণয় ছিল। দেশ ভাগাভাগির সময় আপনি ঢাকায় যেতেন, মীনার সঙ্গে দেখা করতেন। আপনি জানতেন মীনা বিপক্ষ দলের গুপ্তচর, তা জেনেও আপনি নিজের দলের গুপ্তকথা তাকে বলতেন। শুধু মুখে বলেই নিশ্চিন্ত হননি, চিঠি লিখে নিজের দলের সমস্ত সলা-পরামর্শ তাকে জানাতেন। তার ফলে পদে পদে আমাদের হার হয়েছে, আমাদের প্রাপ্য ভূখণ্ড আমরা হারিয়েছি।
‘আপনার চিঠিগুলো মীনা রেখে দিয়েছিল। তারপর হঠাৎ সে মরে গেল, চিঠিগুলো তার মেয়ে হেনার হাতে এল। হেনার একজন দোসর ছিল-ওমর শিরাজি। দু’জনে মিলে ষড়যন্ত্র করল, তারপর হেনা এসে আপনার বুকে চেপে বসে ব্ল্যাকমেল শুরু করল।’
সন্তোষবাবুর চোখ দুটা রক্তবর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল, তিনি হঠাৎ হাত বাড়াইয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘এক লাখ টাকা দেব, চিঠিগুলো আমায় ফেরৎ দিন।’
ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল, সঙ্গে সঙ্গে সন্তোষবাবু দাঁড়াইলেন, রক্তাক্ত ভীষণ চক্ষে চাহিয়া বলিলেন, ‘দেবেন না?’
ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল, তারপর আস্তে আস্তে বলিল, ‘কাল থেকে একটি বিশিষ্ট দৈনিক সংবাদপত্রে আপনার চিঠিগুলির ফ্যাকসিমিলি একে একে ছাপা হবে। প্রস্তুত থাকবেন।’
সন্তোষবাবু দুই চক্ষে অগ্নি বিকীর্ণ করিতে করিতে বসিয়া পড়িলেন। ব্যোমকেশ আমাকে ইশারা করিল, আমরা দ্বারের দিকে চলিলাম।
পিছন হইতে ডাক আসিল, ‘ব্যোমকেশবাবু!’
আমরা ফিরিয়া গিয়া সন্তোষবাবুর সামনে দাঁড়াইলাম, তিনি টেবিলের উপর দুই কনুই রাখিয়া দুহাতে চোখ ঢাকিয়া বসিয়া আছেন। এক মিনিট পরে তিনি হাত নামাইলেন; দেখিলাম তাঁহার মুখ ভাবলেশহীন। তিনি বলিলেন, ‘আমাকে একদিন সময় দেবেন? আজ বিকেল পাঁচটার সময় পার্ক সার্কাস মাঠে আমার বক্তৃতা আছে—‘
ব্যোমকেশ তাঁহার মুখের উপর গভীর দৃষ্টি রাখিয়া ধীরস্বরে বলিল, ‘একদিন সময় দিলাম। কাল, সকালে সংবাদপত্রে আপনার চিঠি ছাপা হবে না। কিন্তু একটা কথা জানিয়ে রাখি। গুণ্ডা লাগিয়ে আমাকে খুন করালেও কোনো লাভ হবে না, চিঠিগুলির নাগাল আপনি পাবেন না। যথাসময়ে সেগুলি ছাপা হবে।’
‘ধন্যবাদ।’
সারাদিন ব্যোমকেশ তক্তপোশে শুইয়া কড়িকাঠ গণনা করিল, কথা বলিল না। বেলা চারটের সময় চা আসিলে উঠিয়া বসিয়া চা পান করিল, তারপর বলিল, ‘চল, বেরনো যাক।।’
‘কোথায় যাবে?
‘সন্তোষবাবুর লেকচার শুনতে।’
সুতরাং বাহির হইলাম। মাথার উপর যাহার খাঁড়া ঝুলিতেছে, সে কিরূপ বক্তৃতা দিবে। শুনিবার কৌতূহল বোধকরি স্বাভাবিক।
পার্ক সার্কাসের মাঠে মঞ্চ রচিত হইয়াছে, মঞ্চের উপর এক সারি গণ্যমান্য ব্যক্তি উপবিষ্ট, প্রধান সচিবও আছেন। সম্মুখে বৃহৎ জনতা। রাজনৈতিক কোনো একটা গুরুতর প্রসঙ্গ জনসাধারণের গোচর করার উদ্দেশ্যে এই সভা আহূত হইয়াছে। আমরা জনতার পিছনে গিয়া দাঁড়াইলাম।
প্রথমে প্রধানমন্ত্রী উঠিলেন, তিনিই সভাপতি। মাইকের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বিষয়বস্তুর অবতারণা করিলেন। তারপর একে একে বক্তারা উঠিলেন। সামান্য যুক্তিতর্কের ফোড়ন দিয়া প্রবল হৃদয়বেগপূর্ণ বক্তৃতা। মুগ্ধ হইয়া বাক্যতরঙ্গে ভাসিয়া চলিলাম।
সর্বশেষে মাইকের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন সন্তোষবাবু। তাঁহার মুখের দৃঢ় গাম্ভীর্য বিষয়বস্তুর গুরুত্র সূচনা করিতেছে। ক্ষণকাল নীরবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া তিনি ধীরে ধীরে বলিতে আরম্ভ করিলেন।
লোকটির বক্তৃতা দিবার ক্ষমতা আছে। উচ্ছ্বাস নাই, ভাবালুতা নাই, কেবল দুনিবার যুক্তির দ্বারা তিনি শ্রোতার সমগ্র মনোযোগ আকর্ষণ করিয়া লইলেন। ক্রমে তাঁহার ভাষণের ছন্দ দ্রুত হইতে লাগিল, অন্তৰ্গঢ় আবেগে কণ্ঠস্বর মৃদঙ্গর ন্যায় ধ্বনিত হইয়া উঠিল। তারপর তিনি যখন বস্তৃক্ততার শেষে উদাত্ত কণ্ঠে বন্দে মাতরম উচ্চারণ করিলেন, তখন শ্রোতাদের কণ্ঠ হইতেও স্বতরুৎসারিত জয়ধ্বনি উত্থিত হইল।
ভাষণ শেষ করিয়া সন্তোষবাবু নিজ আসনে গিয়া বসিলেন।’ আমার দৃষ্টি তাঁহার উপরেই নিবদ্ধ ছিল, দেখিলাম। তিনি পকেট হইতে একটি কোটা বাহির করিয়া কিছু মুখে দিলেন। ভাবিলাম, হয়তো পেনিসিলিনের বড়ি।
ইতিমধ্যে প্রধান সচিব আসিয়া সভা সংবরণের ভাষণ আরম্ভ করিয়াছেন, শ্রোতারা উঠি-উঠি করিতেছে, এমন সময় হঠাৎ মঞ্চের উপর একটা চাঞ্চল্য দেখা গেল। মুহুর্তে আমার দৃষ্টি সেইদিকে ছুটিয়া গেল; দেখিলাম সন্তোষবাবু নিজ আসনে এলাইয়া পড়িয়াছেন, আশেপাশে যাঁহারা ছিলেন তাঁহারা উদ্বিগ্নভাবে তাঁহার দিকে ঝুকিয়া দেখিতেছেন। প্রধানমন্ত্রী ভাষণ থামাইয়া সেইদিকে ছুটিয়া গেলেন। শ্রোতাদের মধ্যে একটা উত্তেজিত গুঞ্জন উঠিল।
পাঁচ মিনিট পরে প্রধানমন্ত্রী মাইকের কাছে ফিরিয়া আসিয়া আবেগপূর্ণ স্বরে বলিলেন, ‘মর্মান্তিক দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমাদের প্রিয় সুহৃৎ, দেশের সুসন্তান সন্তোষ সমাদ্দার ইহলোক ত্যাগ করেছেন—?
তিনি ভগ্নস্বরে বলিয়া চলিলেন। ব্যোমকেশ আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইল, বলিল, ‘চল। পঞ্চমাঙ্কে যবনিকা পতন হয়েছে।’
পার্কের বাহিরে আসিয়া ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইল, বলিল, ‘চল, হাঁটা যাক।’
পথ অনেকখানি, তবু ট্রামে-বাসে চড়িবার ইচ্ছা হইল না। আমিও সিগারেট ধরাইয়া বলিলাম, ‘চল।’
পাশাপাশি চলিতে চলিতে ব্যোমকেশ বলিতে আরম্ভ করিল–
‘সন্তোষবাবু প্রতিভাবান পুরুষ ছিলেন, কিন্তু তিনি চরিত্রবান ছিলেন না। ইংরেজিতে কথা আছে-নাবিকদের বন্দরে বন্দরে বৌ, সন্তোষবাবুরও ছিল তাই। তিনি কাজের সূত্রে মাদ্রাজ বোম্বাই দিল্লী সর্বত্র ঘুরে বেড়াতেন, আমার বিশ্বাস প্রত্যেক শহরেই তাঁর একটি করে প্ৰেয়সী ছিল। বুড়ো বয়সেও তাঁর ও-রোগ সারেনি।
‘কলকাতাতে যেমন তাঁর ছিল সুকুমারী, ঢাকায় তেমনি ছিল মীনা। মীনা ধর্মে মুসলমানী ছিল। সকল দেশে সকল সভ্য সমাজেই এক শ্রেণীর স্ত্রীলোক থাকে যারা বাইরে বেশ সভ্য-ভাব্য, কিন্তু ভিতরে ভিতরে বিলাসিনীর ব্যবসা চালায়। পাশ্চাত্য দেশে ওদের নাম-ডেমি মনডোন। মীনা ছিল ডেমি মনডোন। তার স্বামী ছিল কিনা জানি না, বোধহয় সাক্ষীগোপাল গোছের একজন কেউ ছিল, তার নাম কমল মল্লিক। কমল মল্লিক নামটা হিন্দু নাম, আবার কামাল মল্লিক বললে মুসলমান নাম হয়ে যায়। হেনা মল্লিক নামটাও তাই। মল্লিক পদবী হিন্দুদের মধ্যে আছে, কিন্তু আসলে ওটা মুসলমানী খেতাব।
‘মীনার ছবি দেখেছ, সে ছিল অপরূপ সুন্দরী। সমাজের উঁচু মহলে তার প্রসার ছিল। সন্তোষবাবুকেও সে কুহকের নাগপাশে বেঁধে ফেলেছিল, যখনই তিনি ঢাকায় যেতেন। মীনার সঙ্গে তাঁর দেখা হত। সে বোধহয় তাঁকে গজল শোনাতো।
‘তারপর এল স্বাধীনতা, এল দেশ-ভাগাভাগির যুদ্ধ। সে যে কী নৃশংস যুদ্ধ তা কারুর ভোলবার কথা নয়। এই সময় সন্তোষবাবু আমাদের দলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা। দুই পক্ষের মধ্যে যখন দূতের প্রয়োজন হল, তখন সন্তোষবাবু আমাদের পক্ষ থেকে দৌত্যকার্যে নিযুক্ত হলেন। তিনি বারবার কলকাতা থেকে ঢাকা যাতায়াত করতে লাগলেন। স্বভাবতাই মীনার সঙ্গে তাঁর দেখা-সাক্ষাৎ হতে লাগিল।
সন্তোষবাবু তখন মীনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন, তিনি নিজের দলের অতিবড় গুপ্তকথাগুলিও মীনার কাছে প্রকাশ করে ফেলতে লাগলেন। মীনা রঙ্গিণী মেয়ে হলেও নিজের দলের স্বার্থচিস্তা তার মনে ছিল, সে গুপ্ত সংবাদগুলি যথাস্থানে পৌঁছে দিতে লাগল। অবস্থাটা ভেবে দেখ, রাজনৈতিক কূটযুদ্ধ চলছে, ওদের গুপ্ত অভিপ্ৰায় আমরা কিছুই জানি না, ওরা আমাদের গুপ্ত অভিপ্ৰায় সমস্ত জানে। ফল অনিবাৰ্য।
‘সন্তোষবাবুর তখন এমন মোহমত্ত অবস্থা যে, তিনি মীনাকে কেবল মৌখিক গুপ্তকথা জানিয়ে নিরস্ত হননি, যখন কলকাতায় থাকতেন তখন চিঠি লিখে তাকে গুপ্ত সংবাদ জানাতেন। এই বিশ্বাসঘাতকতার কারণ কী আমি জানি না, সম্ভবত অন্য কোন দেশনেতার প্রতি ব্যক্তিগত ঈর্ষা। কিন্তু তিনি যে জেনেশুনে মীনাকে খবর পাঠাতেন, তাতে সন্দেহ মাত্র নেই। রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম বইয়ের উপহার পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছিলেন—মীনা মাতাহারি। তিনি জানতেন মীনা বিপক্ষ দলের গুপ্তচর।
যাহোক, দেশ-ভাগাভাগির লড়াই একদিন শেষ হল। তারপর কয়েক বছর কেটে গেল। মীনা সন্তোষবাবুর চিঠিগুলি যত্ন করে রেখে দিয়েছিল, নষ্ট করেনি। তার কি মতলব ছিল বলতে পারি না, হয়তো ভেবেছিল কোনদিন সন্তোষবাবু যদি বাঁধন ছেঁড়বার চেষ্টা করেন তখন চিঠিগুলো কাজে লাগবে। কিন্তু হঠাৎ একদিন মীনা মারা গেল। বোধহয় অ্যাকসিডেন্টেই মারা গিয়েছিল।
‘মীনার একটি মেয়ে ছিল–হেনা। মা যখন মারা গেল তখন সে সাবালিকা হয়েছে। সে মায়ের কাগজপত্রের মধ্যে সন্তোষবাবুর চিঠিগুলো খুঁজে পেল। হেনার নিশ্চয় দু-চারজন উমেদার ছিল, তাদের মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর নাম ওমর শিরাজি। শিরাজি বিমান কোম্পানিতে কাজ করত, এরোপ্লেনের ন্যাভিগেটর। দেশে দেশে উড়ে বেড়াতো, তার প্লেনের দৌড় সিঙ্গাপুর থেকে কায়রো। দশ-বারো দিন অন্তর তার প্লেন দমদমে নামতো।
‘হেনা ওমর শিরাজিকে চিঠির কথা বলল, দু’জনে পরামর্শ করল সন্তোষবাবুকে ব্ল্যাকমেল করবে। তারা কলকাতায় এসে সোজাসুজি তাদের মতলব সন্তোষবাবুকে জানালো। হেনা এসে তাঁর বাড়িতে জাঁকিয়ে বসল। ওরা ভেবে দেখেছিল সন্তোষবাবুর বাড়িই হেনার পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। সন্তোষবাবু জাঁতিকালে পড়ে গেলেন। ইচ্ছে থাকলেও হেনাকে খুন করতে পারেন না, তাহলেই ওমর শিরাজি তাঁর গুপ্তকথা ফাঁস করে দেবে। তিনি ব্ল্যাকমেলের টাকা শুনতে লাগলেন।
মারাত্মক চিঠিগুলো হেনা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে সন্তোষবাবু আবিষ্কার করতে পারেননি, তবে সন্দেহ করেছিলেন যে হেনা তাঁর বাড়িতে নিজের ঘরে চিঠিগুলো লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু নিজের বাড়ি বলেই সেখানে তল্লাশ করবার সুবিধা নেই। হেন সর্বদা নিজের ঘরে থাকে, কেবল সন্ধ্যেবেলা নমাজ পড়বার জন্যে একবার ছাদে যায়। তাও দোরে তালা লাগিয়ে।
‘ওমর শিরাজি ইন্দো-পাক হোটেলে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিল। সেই ঘরে ওদের সাক্ষী প্রমাণ যাবতীয় চিঠিপত্র ওরা লুকিয়ে রেখেছিল। বোধহয় ব্যবস্থা ছিল, সন্তোষবাবু হেনাকে হগুয় হগুপ্তায় টাকা দেবেন। কত টাকা দিতেন জানি না, সন্তোষবাবুর ব্যাঙ্কের হিসেব পরীক্ষা করলে জানা যাবে। যাহোক, টাকা নিয়ে হেনা ওমর শিরাজির অপেক্ষা করত। যথাসময়ে শিরাজি এসে মাউথ-অর্গান বাজিয়ে তাকে সঙ্কেত জানাতো, তারপর দু’জনে ইন্দো-পাক হোটেলে যেত। সেখানে হেনা শিরাজিকে টাকা দিত, শিরাজি টাকা নিয়ে পাকিস্তানে চলে যেত। এই ছিল তাদের মোটামুটি কর্মপদ্ধতি।’
বলিলাম, ‘ভারতীয় টাকা নিয়ে যেত?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘টাকা নিয়ে যেত, কিংবা সোনা কিনে নিয়ে যেত, কিংবা কলকাতার কোন ব্যাঙ্কে টাকা জমা রেখে যেত। আমার বিশ্বাস টাকা নিয়ে যেত।’
‘তারপর বলো।’
‘হেনা যে সন্তোষবাবুর অনাথ বন্ধু-কন্যা নয়, সে তাঁর রক্ত-শোষণ করছে, একথা কেবল একজনই সন্দেহ করেছিল। রবিবর্মা। সে সন্তোষবাবুর সেক্রেটারি, তার ওপর ভীষণ ধূর্ত ধড়িবাজ লোক। হেনাকে সে আগে থাকতে চিনত কিনা বলা যায় না, কিন্তু কোন সময় সে হেনার পিছু নিয়ে ইন্দো-পাক হোটেলের সন্ধান পেয়েছিল, বুঝেছিল যে ৭ নম্বর ঘরে মারাত্মক দলিল আছে। সে এক গোছা চাবি যোগাড় করে তাক বুঝে ৭ নম্বর ঘরে ঢোকবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু দরজা খুলতে পারেনি। তার বোধহয় মতলব ছিল দলিলগুলো হস্তগত করতে পারলে সে-ই সন্তোষবাবুকে ব্ল্যাকমেল করবে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়নি। হেনার মৃত্যুর পর সে একবার চেষ্টা করেছিল। বিকাশ তার পিছনে লেগেছিল, সে দেখে ফেলল। বিকাশ যদি তাকে ইন্দো-পাক হোটেলের ৭ নম্বর ঘরের সামনে দেখতে না পেত, তাহলে সন্তোষবাবুকে ধরা যেত না।’
আমি বলিলাম, ‘একটা কথা। এমন কি হতে পারে না যে, সন্তোষবাবুই রবিবর্মাকে নিযুক্ত করেছিলেন দলিলগুলো উদ্ধার করার জন্যে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘না। সন্তোষবাবু এর মধ্যে থাকলে ছিঁচকে চোরের মত কাজ করতেন না। ম্যানেজারকে মোটা ঘুষ দিয়ে কার্যসিদ্ধি করতেন। যাহোক, পরের কথা আগে বলব না। সন্তোষবাবু জাঁতিকালে পড়ে যন্ত্রণা ভোগ করছেন, ছ-মাস কেটে গেছে, আরো কতদিন চলবে ঠিক নেই, এমন সময় এক ব্যাপার ঘটল। একদিন সকালবেলা খবরের কাগজ খুলে সন্তোষবাবু দেখলেন একটি পাকিস্তানী বিমান সমুদ্রে ডুবেছে, মৃতদের মধ্যে নাম পেলেন-ওমর শিরাজি।
‘ব্যাস, সন্তোষবাবু উদ্ধারের পথ দেখতে পেলেন। হেনা খবরের কাগজ পড়ে না, সে এখনো জানতে পারেনি; সে খবর পাবার আগেই তাকে শেষ করতে হবে। তিনি জানতেন, হেনা রোজ সন্ধ্যেবেলা নমাজ পড়তে ছাদে যায়। বর্তমানে বাড়ি মেরামত হচ্ছে, ভারা বেয়ে বাইরে থেকে ছাদে ওঠা সহজ। তিনি ঠিক করে ফেললেন কী করে হেনাকে মারবেন। এমনভাবে মারবেন যাতে অপঘাত মৃত্যু বলে মনে হয়।
‘দিনটা ছিল শনিবার। বিকেলবেলা তিনি সুকুমারীর কাছে গেলেন, সুকুমারীর সঙ্গে পরামর্শ করে নিজের অ্যালিবাই তৈরি করলেন। আট-ঘাট বেঁধে কাজ করতে হবে।’
আমি বলিলাম, ‘সুকুমারী যে আমাদের কাছে ডাহা মিথ্যে কথা বলেছিল তা বুঝতে পারিনি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ। সন্তোষবাবুর প্রতি সুকুমারীর প্রাণের টান ছিল, নইলে সে তাঁর জন্যে নিজেকে খুনের মামলায় জড়িয়ে ফেলত না। সন্তোষবাবুর মৃত্যুতে যদি কেউ দুঃখ পায় তো সে সুকুমারী।
‘খিড়কির ফটক দিয়ে সন্তোষবাবু নিজের বাড়িতে প্রবেশ করলেন, ভারা বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন। হেনা বোধ হয় তখন মাদুর পেতে পশ্চিমদিকে মুখ করে নামাজ পড়বার উপক্রম করছিল, দেখল সন্তোষবাবু উঠে আসছেন। তাঁর অভিপ্ৰায় বুঝতে হেনার দেরি হল না, সে ভয় পেয়ে ছাদের পুবদিকে পালাতে লাগল। কিন্তু পালিয়ে যাবে কোথায়? আলসের কাছে আসতেই সন্তোষবাবু পিছন থেকে ছুটে এসে তাকে ধাক্কা দিলেন, সে ছাদ থেকে নীচে পড়ে গেল।
‘সন্তোষবাবু ছাদের শিকল খুলে দিয়ে, যেমন এসেছিলেন তেমনি ভারা বেয়ে নেমে গেলেন। শিকল খুলে দেবার কারণ—যদিও কেউ হেনার মৃত্যুকে খুন বলে সন্দেহ করে, তাহলেও আততায়ী কোন দিক থেকে ছাদে উঠেছে তা অনিশ্চিত থেকে যাবে।
‘সন্তোষবাবু বাড়িতে এসেছিলেন তা কেউ জানল না, তিনি কর্তব্যকর্ম সুসম্পন্ন করে সুকুমারীর কাছে ফিরে গেলেন। কিন্তু একটা কাজ বাকি ছিল।
‘চিঠিগুলো নিশ্চয় হেনার ঘরে আছে। পুলিস খুঁজে পায়নি বটে, কিন্তু পরে পেতে পারে। গভীর রাত্রে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন তিনি চুপি চুপি নেমে এসে হেনার ঘর তল্লাশ করলেন। কিন্তু চিঠি খুঁজে পেলেন না। তখন তিনি পেট্রোল ঢেলে হেনার ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলেন। ঢাকীসুদ্ধ বিসর্জন।’
ব্যোমকেশ চুপ করিল। কিছুক্ষণ নীরবে চলিবার পর জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সন্তোষবাবুকে টেলিফোন করেছিল কে?’
সে বলিল, ‘কেউ না। ওটা কপোলকল্পিত। নিভৃত নিকুঞ্জগৃহে ফিরে গিয়ে সন্তোষবাবু নিশ্চিন্ত হতে পারেননি, হেনা যদি দৈবাৎ না মরে থাকে! তাছাড়া চিঠিগুলো হেনার ঘর থেকে সরাতে হবে। তাই তিনি একটি অজ্ঞাত সংবাদদাতা সৃষ্টি করলেন; সুকুমারীকে টেলিফোন সম্বন্ধে তালিম দিয়ে বাড়িতে ফিরে এলেন।’
‘অদ্ভূত অভিনেতা কিন্তু সন্তোষবাবু।’
‘হ্যাঁ। অদ্ভুত বক্তা, অদ্ভুত অভিনেতা-এরা সব এক জাতের।’
‘আচ্ছা ব্যোমকেশ, সন্তোষবাবু তোমাকে পারিবারিক স্বার্থরক্ষার জন্যে নিযুক্ত করলেন কেন? গোড়াতেই তোমাকে বিদেয় করলেন না কেন?’
‘নেংটি একটা দুষ্কার্য করে ফেলেছিল, আমাকে ডেকেছিল। আমাকে বিদেয় করে দিলে তাঁর ওপর সকলের সন্দেহ হত, তাই তিনি সাধু সেজে আমাকে তাঁর পরিবারিক স্বার্থরক্ষার জন্যে নিযুক্ত করলেন। পরে অবশ্য ছাড়াবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তখন কমলি নেহি ছোড়তি।’
‘তুমি কখন ওঁকে সন্দেহ করলে?’
‘ঘরে আগুন লাগার খবর পেয়ে বুঝলাম কোনো দাহ্য পদার্থ পুড়িয়ে দেবার জন্যেই ঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে। কি রকম দাহ্য পদাৰ্থ? নিশ্চয় এমন কোনো দাহ্য পদার্থ, যা সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। স্বভাবতাই দলিলের কথা মনে আসে। কি রকম দলিল? যার সাহায্যে ব্ল্যাকমেল করা যায়। তাহলে হেনা কাউকে ব্ল্যাকমেলা করছিল? কাকে ব্ল্যাকমেল করছিল? যুগল আর উদয়কে বাদ দেওয়া যায়; বাকি রইল রবিবর্মা এবং সন্তোষবাবু। কিন্তু রবিবর্মা সামান্য লোক, তাকে ব্ল্যাকমেল করে বেশি টাকা আদায় করা যায় না। অপর পক্ষে সন্তোষবাবু বড়লোক, তাঁর পূর্ববঙ্গে নিত্য যাতায়াত, হেনাকে তিনি নিজের বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। পুলিসের শৈথিল্যের পিছনেও হয়তো তাঁর প্রভাব কাজ করছে। আমাকে কলকাতা থেকে সরিয়ে কটকে পাঠানোর চেষ্টার পিছনেও তিনি আছেন। সুতরাং তিনিই সব দিক দিয়ে যোগ্য পাত্র।–ভাল কথা কাল সকালে কটকে একটি টেলিগ্রাম পাঠাতে হবে, জানা দরকার তারা এখনো আমাকে চায় কিনা।’
‘বেশ। সন্তোষবাবুর চিঠিগুলো কি করবে?’
‘পুড়িয়ে ফেলব। ও চিঠির কাজ শেষ হয়েছে। সন্তোষবাবু প্ৰায়শ্চিত্ত করেছেন, তাঁর সুনাম নষ্ট করে কারুর লাভ নেই। মগ্নমৈনাক মগ্নই থাক।’
বাসায় ফিরিয়া দেখি নেংটি বসিয়া আছে। সত্যবতীর নিকট হইতে চা ও সিগারেট সংগ্রহ করিয়া পরম আরামে সেবন করিতেছে। সে সন্তোষবাবুর মৃত্যু-সংবাদ পায় নাই। ব্যোমকেশকে দেখিয়া ভ্রূ তুলিয়া ব্যগ্রভরে বলিল, ‘কী, এখনো হেনার খুনীকে ধরতে পারলেন না।’
ব্যোমকেশ বিরক্ত স্বরে বলিল, ‘পেরেছি। তুমি এখানে কি করছ?’
নেংটি সচকিত অবিশ্বাসের স্বরে বলিয়া উঠিল, ‘পেরেছেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ। তুমি পেরেছ নাকি।’
নেংটি আমতা আমতা করিয়া বলিল, ‘আমি–আমি তো গোড়া থেকেই জানি।’
‘গোড়া থেকেই জানো! কি করে জানলে? বুদ্ধি খাটিয়ে বের করেছ? আততায়ীর নাম বল তো শুনি?’
নেংটি স্খলিত স্বরে বলিল, ‘মেসোমশাই।’
ব্যোমকেশ ক্ষণকাল অবাক বিস্ময়ে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, ‘তুমি জানো! কি করে জানলে?’
নেংটি দ্রুত বিহ্বল কণ্ঠে বলিল, ‘আমি যে স্বচক্ষে দেখেছি, ব্যোমকেশদা। আমি বাড়ির পিছন দিকের পাইনগাছে উঠে সিগারেট খাচ্ছিলাম। এমন সময় হেনা ছাদে এল, মাদুরটা পেতে বসতে যাবে, হঠাৎ মেসোমশাই পশ্চিমদিকের ভারা বেয়ে উঠে এলেন। তাঁকে দেখেই হেনা দৌড়ে পুবদিকে গেল, তিনিও তার পিছনে ছুটলেন, তাকে ঠেলা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দিলেন।’
ব্যোমকেশ কঠোর চক্ষে চাহিয়া বলিল, ‘তুমি এতদিন একথা বলনি কেন?’
নেংটি কাতর স্বরে বলিল, ‘কি করে বলি, ব্যোমকেশদা। উনি আমাদের অন্নদাতা, ওঁকে পুলিসে ধরিয়ে দেব কি বলে? তবু আপনাকে খবর দিয়েছিলাম, জানতাম, কেউ যদি অপরাধীকে ধরতে পারে তো সে আপনি।’
ব্যোমকেশের মুখ নরম হইল, সে নেংটির-কাঁধে হাত রাখিয়া বলিল, ‘নেংটি, তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও। সন্তোষবাবু মারা গেছেন।’