সন্তোষবাবুর অফিসে উপস্থিত হইলাম
পরদিন ঠিক ন’টার সময় আমরা দুইজনে সন্তোষবাবুর অফিসে উপস্থিত হইলাম। ক্লাইভ স্ট্রীটে প্রকাণ্ড সওদাগরী সৌধ, তাহার দ্বিতলে সন্তোষবাবুর অফিস।
সন্তোষবাবু সবেমাত্র অফিসে আসিয়াছেন, এত্তেলা পাইয়া আমাদের ডাকিয়া পাঠাইলেন। আমরা তাঁহার খাস কামরায় প্রবেশ করিলাম। টেবিলের উপর কাগজপত্রের ফাইল, দু’টি টেলিফোন, সন্তোষবাবু টেবিলের সামনে একাকী বসিয়া আছেন। আজ তাঁহার পরিধানে বিলাতি বেশ; কোট খুলিয়া রাখিয়াছেন; লিনেনের শার্টের সম্মুখভাগে দামী সিল্কের টাই শোভা পাইতেছে।
সন্তোষবাবু হাত নাড়িয়া আমাদের সম্ভাষণ করিলেন। আমরা টেবিলের পাশে উপবিষ্ট হইলে তিনি ভ্রূ তুলিয়া ব্যোমকেশকে প্রশ্ন করিলেন, ‘কি খবর?
ব্যোমকেশ বলিল, ‘শুনেছেন বোধহয়, পুলিস সাব্যস্ত করেছে হেনার মৃত্যু সম্পূর্ণ আকস্মিক ঘটনা।’
সন্তোষবাবু চকিত হইয়া বলিলেন, ‘তাই নাকি! আমি শুনিনি।’ তারপর আরামের একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ‘যাক, বাঁচা গেল। মনে একটা অস্বস্তি লেগে ছিল।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কিন্তু আমি এখনো নিঃসংশয় হতে পারিনি।’
সন্তোষবাবু একটু বিস্ময়ের সহিত তাহার পানে চাহিয়া রহিলেন, শেষে বলিলেন, ‘ও–মানে আপনার বিশ্বাস হেনাকে কেউ খুন করেছে?—কোন সূত্র পেয়েছেন কি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘প্রথমত, ঘরে আগুন লাগাটা স্বাভাবিক মনে হয় না।’
সন্তোষবাবু শূন্য পানে চাহিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, ‘তা বটে, ঘরে আগুন লাগাটা আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়। আর কিছু?’
ব্যোমকেশ তখন মাউথ-অগনিবাদকের কথা বলিল। সন্তোষবাবু গভীর মনোযোগের সহিত শুনিলেন, তারপর বলিলেন, ‘হুঁ। কিন্তু আমি যতদূর জানি এখানে হেনার চেনা-পরিচিত কেউ নেই।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘পাকিস্তানের লোক হতে পারে। হয়তো কাজের সূত্রে দশ-বারো দিন অন্তর কলকাতায় আসতো, আর হেনার সঙ্গে দেখা করে যেত।’
এই সময় টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। সন্তোষবাবু টেলিফোন কানে দিয়া শুনিলেন, দু’বার ই হু করিলেন, তারপর যন্ত্র রাখিয়া দিলেন। ব্যোমকেশের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘হতে পারে-হতে পারে। তা, আপনি এখন কি করতে চান?
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার যদি অনুমতি থাকে, আমি একবার বাড়ির সকলকে জেরা করে দেখতে পারি।’
সন্তোষবাবু একটু নীরব থাকিয়া বলিলেন, ‘দেখুন ব্যোমকেশবাবু্, আপনাকে আমি আমার পারিবারিক স্বার্থরক্ষার জন্যে নিযুক্ত করেছিলাম। কিন্তু পুলিস যখন বলছে এটা দুর্ঘটনা, তখন আপনার দায়িত্র শেষ হয়েছে। অবশ্য, আপনার পারিতোষিক আপনি পাবেন–’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘পারিতোষিকের জন্যে আমি ব্যগ্র নই মিস্টার সমাদার, এবং বেশি কাজ দেখিয়ে বেশি পারিতোষিক আদায় করার মতলবও আমার নেই। আমি শুধু সত্য আবিষ্কার করতে চাই।’
সন্তোষবাবু ঈষৎ অধীরভাবে বলিলেন, ‘সত্য আবিষ্কার! পুলিসের হাঙ্গামা থেকে যখন রেহাই পেয়েছি, তখন নিছক সত্য আবিষ্কারে আমার আগ্রহ নেই-?
আবার টেলিফোন বাজিল। সন্তোষবাবু ফোনে কথা বলা শেষ করিতে না করিতে অন্য ফোনটা বাজিয়া উঠিল। একে একে দুইটি ফোনে কথা বলা শেষ করিয়া তিনি আমাদের পানে চাহিয়া হাসিলেন। ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘কাজের সময় আপনাকে বিরক্ত করব না। তাহলে–আপনার আগ্রহ নেই?’
সন্তোষবাবু বলিলেন, ‘আগ্রহ নেই, তেমনি আপত্তিও নেই। আপনি বাড়ির সকলকে জেরা করুন।’
‘ধন্যবাদ। রবিবর্মা কি অফিসে আছেন?’
‘না, তার শরীর খারাপ, সে আজ অফিসে আসেনি। বাড়িতেই আছে।’
‘আচ্ছা। আপনি দয়া করে বাড়িতে জানিয়ে দেবেন। আমরা যাচ্ছি।’
‘আচ্ছা।’ তিনি টেলিফোন তুলিয়া নম্বর ঘুরাইতে লাগিলেন। আমরা চলিয়া আসিলাম।
সন্তোষবাবুর বাড়িতে পৌঁছিলাম আন্দাজ সাড়ে ন’টার সময়। দেউড়ি দিয়া প্রবেশ করিতে করিতে ব্যোমকেশ বলিল, ‘চল, আগে বাগানটা দেখে যাই।’
আমরা পূর্বদিকে মোড় ঘুরিলাম। বাড়ির কোণে হেনার ঘরের পোড়া কাঁচভাঙা জানালা দুটা গহ্বরের মত উন্মুক্ত হইয়া আছে। গোলাপের বাগানে সিলভার পাইনের ছায়া পড়িয়াছে, অজস্র শ্বেত-রক্ত-পীত ফুল ফুটিয়া আছে। এদিকে ভারা নাই, চুনকাম-করা দেয়াল রৌদ্র প্রতিফলিত করিতেছে। হেনা এই দেয়ালের পদমূলে পড়িয়া মরিয়াছিল, কিন্তু কোথাও কোনো চিহ্ন নাই। হত্যায় খচিত এই ধরণীর ধূলি, কিন্তু চিহ্ন থাকে না।
বাড়ির পিছন দিকে ভারা লাগানো আছে। মিস্ত্রিরা মেরামতের কাজ আরম্ভ করিয়াছে, দুইজন মজুর মাথায় লোহার কড়া লইয়া ভারা-সংলগ্ন মই দিয়া ওঠা-নামা করিতেছে। মন্থরভাবে কাজ চলিতেছে।
পিছন দিক বেড়িয়া আমরা বাড়ির পশ্চিমদিকে উপস্থিত হইলাম। এখানেও দেয়ালের গায়ে ভারা লাগানো, মিস্ত্রিরা কাজ করিতেছে, মজুর ওঠা-নমা করিতেছে। ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ ঊর্ধ্বমুখ হইয়া দেখিল, তারপর মই বাহিয়া তরুতর করিয়া উপরে উঠিয়া গেল।
তিনতলার আলিসার উপর দিয়া একবার ছাদে উঁকি মারিয়া সে আবার নামিয়া আসিল। আমি উত্তেজিত হইয়া বলিলাম, ‘কি ব্যাপার। ছাদে কী দেখলে?’
সে হাসিয়া বলিল, ‘ছাদে দর্শনীয় কিছু নেই। দর্শনীয় বস্তু ঐখানে।’ বলিয়া বাহিরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল।
ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলাম, খিড়কির ফটক। ব্যোমকেশ সেই দিকে অগ্রসর হইল, আমি চলিলাম। বাগানের এই দিকটাতে আম-লিচু-পেয়ারা-জামরুল প্রভৃতি ফলের গাছ; আমরা এই ফলের বাগান পার হইয়া বাড়ির বহিঃপ্রাচীরের নিকট উপস্থিত হইলাম।
খিড়কির ফটকটি সঙ্কীর্ণ লোহার শিক-যুক্ত কপট আন্দাজ পাঁচ ফুট উঁচু। তাঁহাতে তালা লাগাইবার ব্যবস্থা থাকিলেও মরিচা-ধরা অবস্থা দেখিয়া মনে হয়। বহুকাল তালা লাগানো হয় নাই। ফটকের বাহিরে একটি সরু গলি গিয়াছে। এই পথ দিয়া বাড়ির চাকর-বাকর যাতায়াত করে।
ব্যোমকেশ আমার দিকে ভ্রূ বাঁকাইয়া বলিল, ‘কি বুঝলে?’
বলিলাম, ‘এই বুঝলাম যে, বাইরে থেকে অলক্ষিতে বাগানে প্রবেশ করা যায় এবং বাগান থেকে মই বেয়ে ছাদে উঠে যাওয়াও শক্ত নয়।’
সে আমার পিঠ চাপড়াইয়া বলিল, ‘শাবাশ।-চল, এবার বাড়ির মধ্যে যাওয়া যাক।’
হল-ঘরে নেংটি হেনরি পোড়া ঘরের বাহিরে দাঁড়াইয়া সেই দিকে চাহিয়া ছিল, আমাদের দেখিয়া আগাইয়া আসিল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘কি দেখছিলে?’
নেংটি বলিল, ‘কিছু না। আজ সকালে মাসিম এসে ঘরে গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিয়েছেন। কাল থেকে মিস্ত্রি লাগবে। নতুন দোর-জানোলা বসানো হবে, ঘরের প্ল্যাস্টার তুলে ফেলে নতুন করে প্ল্যাস্টার লাগানো হবে। ভাগ্যিস আগাগোড়া কংক্রিটের বাড়ি, নইলে সারা বাড়িটাই পুড়ে ছাই হয়ে যেত। সেই সঙ্গে আমরাও।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ। বাড়ির সব কোথায়?’
নেংটি বলিল, ‘বাড়িতেই আছে, মেসোমশাই ফোন করেছিলেন। দাদারা কলেজে যায়নি। ডেকে আনিব?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘না, আমি প্রত্যেকের ঘরে গিয়ে দেখা করব। রবিবর্মা কোথায়?’
‘নিজের ঘরে।’ বলিয়া নেংটি আঙুল দেখাইল।
‘আচ্ছা। তুমি তাহলে দোতলায় গিয়ে সবাইকে জানিয়ে দাও। আমি রবিবর্মার সঙ্গে দেখা করেই যাচ্ছি।’
নেংটি দ্বিতলে চলিয়া গেল, আমরা রবিবর্মার দ্বারের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াইলাম। দ্বার ভেজানো ছিল, ব্যোমকেশ টোকা দিতেই খুলিয়া গেল। রবিবর্মা বলিল, ‘আসুন।’ তাহার গায়ে ধূসর। রঙের আলোয়ান জড়ানো, শীর্ণ মুখ আরও শুষ্ক দেখাইতেছে—’শরীরটা ভাল নেই, তাই অফিস যাইনি।’ বলিয়া কাশি চাপিবার চেষ্টা করিল।
আমরা ঘরে প্রবেশ করিলাম। ঘরটি আয়তনে হেনার ঘরের সমতুল্য। আসবাবও অনুরূপ; একহারা খাট, টেবিল, চেয়ার, বইয়ের শেলফ। ঘরটি রবিবর্মা বেশ পরিচ্ছন্ন রাখিয়াছে।
ব্যোমকেশ রব্বিমাকে কিছুক্ষণ মনোনিবেশ সহকারে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, ‘রবিবাবু্, তুমুপনি সত্যিই সন্তোষবাবুর নিভৃত কুঞ্জের ফোন নম্বর জানেন না?’
রবিবর্মা দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘আজ্ঞে না, সত্যি জানি না। কর্তা আমাকে জানাননি, তাই আমিও জািনবার চেষ্টা করিনি। আমি মাইনের চাকর, আমার কি দরকার বলুন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তা বটে। সুকুমারীর নিজের বাসার ফোন নম্বর তো আপনার জানা আছে, সেখানেও হেনার মৃত্যুর খবর দেননি?
‘আজ্ঞে না।’
‘সে-সময় অন্য কাউকে ফোন করতে দেখেছিলেন?’
‘আজ্ঞে-গোলমালের মধ্যে সব দিকে নজর ছিল না। মনে হচ্ছে পুলিস আসবার পর নেংটি কাউকে ফোন করেছিল।’
‘নেংটি আমাকে ফোন করেছিল। সে যাক। —বলুন দেখি, পরশু রাত্রে যখন হেনীর ঘরে আগুন লেগেছিল, আপনি কিছুই জানতে পারেননি?’
রবিবর্মা কাশিতে লাগিল, তারপর কাশি সংবরণ করিয়া রুদ্ধ কণ্ঠে বলিল, ‘আজ্ঞে না, আমি জানতে পারিনি।’
‘আশ্চর্য।’
‘আজ্ঞে আশ্চর্য নয়, আমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়েছিলাম। আমার মাঝে মাঝে অনিদ্ৰা হয়, সারা রাত জেগে থাকি। শনিবার ওই সব ব্যাপারের পর ভাবলাম ঘুম আসবে না। তাই শোবার সময় আসপিরিনের বড়ি খেয়েছিলাম। তারপর রাত্রে কী হয়েছে কিছু জানতে পারিনি।‘
ব্যোমকেশ এদিক-ওদিক চাহিল। টেবিলের উপর একটা শিশি রাখা ছিল, তুলিয়া দেখিল-অ্যাসপিরিনের শিশি; প্রায় ভরা অবস্থায় আছে। শিশি রাখিয়া দিয়া সে একথোলো চাবি তুলিয়া লইল। অনেকগুলি চাবি একটি রিংয়ে গ্রথিত, ওজনে ভারী। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘এগুলো কোথাকার চাবি?’
‘অফিসের চাবি।’ রবিবর্মা চাবির গোছা ব্যোমকেশের হাত হইতে লইয়া নিজের পকেটে রাখিল–’অফিসের বেশির ভাগ দেরাজ-আলমারির চাবি আমার কাছে থাকে।’
ব্যোমকেশ সহসা প্রশ্ন করিল, ‘রবিবাবু্, আপনার দেশ কোথায়?’
থতমত খাইয়া রবিবর্মা বলিল, ‘দেশ? কুমিল্লা জেলায়।’
‘হেনাকে আগে থাকতে চিনতেন?’
রবিবর্মার তির্যক চোখে শঙ্কার ছায়া পড়িল, সে কাশির উপক্রম দমন করিয়া বলিল, ‘আজ্ঞে না।’
‘তার বাপ কমল মল্লিককে চিনতেন না?’
‘অ্যাঞ্জে না।’
‘হেনার মৃত্যু সম্পর্কে আপনি কিছুই জানেন না?’ রবিবর্মা একটু ইতস্তত করিল, গলা বাড়াইয়া একবার হল-ঘরের দিকে উঁকি মারিল, তারপর চুপিচুপি বলিল, ‘কাউকে বলবেন না, একটা কথা আমি জানি।’
‘কি জানেন বলুন?’
‘সেদিন হেনার ঘরে দেখেছিলাম হেনা উলের জামা বুনছিল। কার জন্যে জামা বুনছিল জানেন? উদায়ের জন্যে।’
‘উদয়ের জন্যে! আপনি কি করে জানলেন?’
‘একদিন বিকেলবেলা আমি দেখে ফেলেছিলাম। উদয় এক বাণ্ডিল উল এনে হেনাকে দিচ্ছে। হেনা সেই উল দিয়ে সোয়েটার তৈরি করছিল।’
‘উদয়ের সঙ্গে তাহলে হেনার ঘনিষ্ঠতা ছিল?’ রবিবর্মা সশঙ্ক চক্ষে চুপ করিয়া রহিল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আর যুগলের সঙ্গে?’
‘আমি জানি না। ব্যোমকেশবাবু্, আমি যে আপনাকে কিছু বলেছি, তা যেন আর কেউ জানতে না পারে। বৌদি জানতে পারলে—’
বৌদি, অর্থাৎ, শ্ৰীমতী চামেলি। সকলেই তাঁহার ভয়ে আড়ষ্ট। মনে পড়িল, সে-রাত্ৰে সিঁড়ি দিয়া নামিবার সময় তাঁহার চাপা কণ্ঠস্বর শুনিয়াছিলাম, তুমি চুপ করে থাকবে, কোন কথা বলবে না।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার সঙ্গে হেনার ঘনিষ্ঠতা ছিল না?’
রবিবর্মা চমকিয়া উঠিল, ‘আমার সঙ্গে–আমি সারা জীবন মেয়েলোককে এড়িয়ে চলেছি। ওসব রোগ আমার নেই, ব্যোমকেশবাবু।’
‘ভাল। চল অজিত, ওপরে যাওয়া যাক।।’
দোতলায় যুগলের ঘরের উন্মুক্ত দ্বারের সম্মুখে গিয়া একটি নিভৃত দৃশ্য দেখিয়া ফেলিলাম। যুগল টেবিলের সামনে বসিয়া আছে, হাতে কলম, সম্মুখে খাতা, চিংড়ি চেয়ারের পিছনে দাঁড়াইয়া তাহার গলা জড়াইয়া কানে কানে ফিসফিস করিয়া কি বলিতেছে। আমাদের দেখিয়া সে ত্রস্তা হরিণীর মত চাহিল, তারপর আমাদের পাশ কাটাইয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল।
যুগল ঈষৎ লজ্জিতভাবে উঠিয়া দাঁড়াইল, ‘আসুন।’
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘আপনাকে দুতিনটে প্রশ্ন করেই ছেড়ে দেব, তারপর আপনি যদি কলেজে যেতে চান যেতে পারেন।’
যুগল ঘড়ি দেখিয়া বলিল, ‘দেরি হয়ে গেছে, সকালের দিকেই ক্লাস ছিল।’ সে টেবিলের নিকট হইতে সরিয়া আসিয়া খাটের পাশে বসিল, ‘কি জানতে চান বলুন? তাহার কথা বলিবার ভঙ্গীতে ধীর নম্রতা প্রকাশ পাইল। সে-রক্রির সেই বাজাহত বিভ্ৰান্তির ভাব আর নাই।
ব্যোমকেশ তাহারপাশে বসিয়া বলিল, ‘আপনি কবিতা লেখেন?’
যুগল অপ্রতিভ হইয়া পড়িল, ক্ষীণস্বরে বলিল, ‘মাঝে মাঝে লিখি।’
ব্যোমকেশ পকেট হইতে এক টুকরা গোলাপী কাগজ লইয়া যুগলের সম্মুখে ধরিল, বলিল, ‘দেখুন তো, এটা কি আপনার লেখা?
দেখিলাম যুগলের সুশ্ৰী মুখ ধীরে ধীরে লাল হইয়া উঠিতেছে। সে কাগজের টুকরা লইয়া সংশয়িত চিত্তে নাড়াচাড়া করিতেছে, আমি ইত্যবসরে টেবিলের উপর হইতে খাতা লইয়া চোখ বুলাইলাম। কবিতার খাতা, তাহাতে চতুষ্পদী জাতীয় কয়েকটি ক্ষুদ্র কবিতা লেখা রহিয়াছে। সবগুলিই অনুরাগের কবিতা, তার মধ্যে একটি মন্দ লাগিল না–
গোলাপ, তোমারে ধরিনু বুকের মাঝে
বিনিময়ে তুমি কাঁটায় ছিড়িলে বুক
রক্ত আমার দরদর ঝরিয়াছে
সেই শোণিমায় রাঙা করে নাও মুখ।
এখানে গোলাপ কে তাহা অনুমান করিতে কষ্ট হয় না।
ওদিকে যুগল দু’বার গলা খাঁকারি দিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ, আমারই লেখা।’
ব্যোমকেশ কণ্ঠস্বরে সমবেদনা ভরিয়া বলিল, ‘হেনার সঙ্গে আপনার ভালবাসা হয়েছিল।’
যুগল কিয়াৎকোল নতমুখে বসিয়া রহিল, তারপর মুখ তুলিয়া বলিল, ‘ভালবাসা-কি জানি। হেন যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন একটা নেশায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল–তারপর এখন—’
ব্যোমকেশ প্রফুল্লম্বরে বলিল, ‘নেশা কেটে যাচ্ছে। বেশ বেশ। জানালা দিয়ে গোলাপফুল আপনিই ফেলেছিলেন?’
‘হ্যাঁ।‘
‘হেনা তখন ঘরে ছিল না?’
‘না।‘
‘যুগলবাবু্, সে-রত্রে আপনার ভাই উদয়বাবু অভিযোগ করেছিলেন যে, আপনি হেনাকে মেরেছেন। এ অভিযোগের কারণ কি?’
যুগল ধীরে ধীরে বলিল, ‘কারণ-ঈর্ষা।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাহলে উদয়বাবুও কোর প্রতি আসক্ত হয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ।‘
সেই অতি পুরাতন নিশুম্ভ ও মোহিনীর কাহিনী। ভাগ্যক্রমে কাহিনীর উপসংহার ভিন্নপ্রকার দাঁড়াইয়াছে।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনাদের দু’জনের মধ্যে হেনা কাকে বেশি পছন্দ করত?’
যুগল ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিল, ‘এখন মনে হচ্ছে হেনা কাউকেই পছন্দ করত না।’
‘আপনারা দুভাই ছাড়া আর কেউ হেনার প্রতি আসক্ত হয়েছিল? যেমন ধরুন—রবিবর্মা?’
যুগল চকিতে মুখ তুলিল। তাহার মুখে অবিশ্বাসের ভাব ফুটিয়া উঠিল।
সে বলিল, ‘রবিবর্মা! কি জানি, বলতে পারি না।’
উদয় নিজের ঘরে বসিয়া টেনিস র্যাকেটের তাঁতে তেল লাগাইতেছিল, আমরা দ্বারের কাছে উপস্থিত হইতেই সে ঘন ভুরুর নীচে রূঢ় চক্ষু রাঙাইয়া বলিল, ‘আবার কি চাই?’
ব্যোমকেশের মুখ কঠিন হইয়া উঠিল, সে তর্জনী তুলিয়া বলিল, ‘তুমি হেনাকে উল এনে দিয়েছিলে তোমার সোয়েটার বুনে দেবার জন্যে।’
উদয় উদ্ধতস্বরে বলিল, ‘হ্যাঁ, দিয়েছিলাম। তাতে কী প্রমাণ হয়?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘প্রমাণ হয় তোমার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। সেদিন সে যখন ছাদে গেল, তখন তুমিও তার পিছন পিছন ছাদে গিয়েছিলে। সেখানে তার সঙ্গে তোমার ঝগড়া হয়, তুমি তাকে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলে।’
উদয় হতভম্ব হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার মুখ ফ্যাকাসে হইয়া গেল। সে সভয়ে বলিয়া উঠিল, ‘না-না! আমি ছাদে যাইনি। আমি হেনার পিছন পিছন সিঁড়ি দিয়ে উঠেছিলাম, কিন্তু ছাদে পৌঁছুবার আগেই হেনা দোরে শিকল তুলে দিয়েছিল। আমি-আমি তাকে ঠেলে ফেলে দিইনি-আমি তাকে ভালবাসতাম, সেও আমাকে ভালবাসতো।’
ব্যোমকেশ নিষ্ঠুরস্বরে বলিল, ‘হেনা আর যাকেই ভালবাসুক, তোমাকে ভালবাসতো না। সে তোমাকে বাঁদর-নাচ নাচাচ্ছিল। এস অজিত।’
আমরা হল-ঘরের মধ্যস্থিত গোল টেবিলের কাছে গিয়া বসিলাম। ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলাম, উদয় ক্ষণকাল আচ্ছল্লের মত দাঁড়াইয়া থাকিয়া নিঃশব্দে ঘরের দ্বার বন্ধ করিয়া দিল।
সামনে ফিরিয়া দেখি পিছনের সারির একটি ঘর হইতে শ্ৰীমতী চামেলি বাহির হইয়া আসিতেছেন। তিনি বোধ হয়। সদ্য স্নান করিয়াছেন, ভিজা চুলের প্রান্ত হইতে এখনো জল ঝরিয়া পড়িতেছে, শাড়ির আচলটা কোনমতে মাথাকে আবৃত করিয়াছে, চোখে সন্দিগ্ধ উদ্বেগ। আমরা উঠিয়া দাঁড়াইলাম।
শ্ৰীমতী চামেলি তীব্র অনুচ্চস্বরে ব্যোমকেশকে বলিলেন, ‘কী বলছিল উদয় আপনাকে?’ ব্যোমকেশ বলিল, ‘মারাত্মক কিছু বলেনি, আপনি ভয় পাবেন না। বসুন, আপনার কাছে দু-একটা কথা জানিবার আছে।’
শ্ৰীমতী চামেলি বসিলেন না, চেয়ারে বসিলে বোধ করি দেহ অশুচি হইয়া যাইবে। অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলিলেন, ‘আপনারা কেন আমাদের উত্ত্যক্ত করছেন। আপনারাই জানেন। কি জানতে চান বলুন?
দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া প্রশ্নালাপ হইল। ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, ‘আপনি আগে সন্ত্রাসবাদীদের দলে ছিলেন?’
শ্ৰীমতী চামেলি বলিলেন, ‘হ্যাঁ, ছিলাম।’
প্রশ্ন : আপনি অহিংসায় বিশ্বাস করেন না?
উত্তর: না, করি না।
প্রশ্ন : বর্তমানে স্বামীর সঙ্গে আপনার সদ্ভাব নেই?
উত্তর : সে-কথা সবাই জানে।
প্রশ্ন : অসদ্ভাবের কারণ কি?
উত্তর: যথেষ্ট কারণ আছে।
প্রশ্ন: আপনার সন্দেহ-হেনা আপনার স্বামীর উপপত্নী ছিল?
উত্তর : হ্যাঁ। আমার স্বামীর চরিত্র ভাল নয়।
এই নির্ভীক স্পষ্টবাদিতায় ব্যোমকেশ যেন ধাক্কা খাইয়া থামিয়া গেল। শেষে অন্য প্রসঙ্গ তুলিয়া বলিল, ‘নেংটি এবং চিংড়ি আপনার নিজের বোনপো বোনঝি?’
শ্ৰীমতী চামেলি একটু থমকিয়া গেলেন, তাঁহার উত্তরের উগ্রতাও একটু কমিল। তিনি বলিলেন, ‘না, ওদের মা আমার ছেলেবেলার সখী ছিল, তার সঙ্গে গঙ্গাজল পাতিয়েছিলুম। রক্তের সম্পর্ক নেই।’
প্রশ্ন: ওরা জানে?
উত্তর: না, এখনো বলিনি। সময় হলে বলব।
ব্যোমকেশ হাসিমুখে নমস্কার করিয়া বলিল, ‘ধন্যবাদ। আর আপনাকে উত্ত্যক্ত করব না। চললাম।’
শ্ৰীমন্ত্র চামেলি তীব্রটিতে আমাদের পানে চাহিয়া রছিলেন, আমরা নীচের তলায় নামিয়া নেংটি ফটক পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে আসিল। ব্যোমকেশের পানে রহস্যময় কটাক্ষপাত করিয়া বলিল, ‘কিছু বুঝতে পারলেন?’
ব্যোমকেশ একটু বিরক্তস্বরে বলিল, ‘না। তুমি বুঝতে পেরেছ নাকি?’
নেংটি বলিল, ‘আমার বোঝার কী দরকার। আপনি সত্যান্বেষী, আপনি বুঝবেন।’
ফুটপাথে আসিয়া ব্যোমকেশ ঘড়ি দেখিল–’সাড়ে দশটা। চল, এখনো সময় আছে, শ্ৰীমতী সুকুমারীকে দর্শন করে যাওয়া যাক।’