তারপর সন্তোষবাবু আসিয়া
তারপর সন্তোষবাবু আসিয়া টেবিলের শীর্ষস্থিত চেয়ারে বসিলেন। তিনি শৌখিন কেশ-বাস ত্যাগ করিয়া মামুলি আটপৌরে জাম-কাপড় পরিয়াছেন। উপবেশন করিয়া বলিলেন, ‘রবি, সিগারেট নিয়ে এস।’
রবিবর্মা তাড়াতাড়ি সিগারেট আনিতে গেল, সন্তোষবাবু এ কে রে’র পানে চাহিয়া বলিলেন, ‘আপনি বোধহয় হেনা সম্বন্ধে আমাকে প্রশ্ন করতে চান? দুঃখের বিষয়, তার কথা আমি বিশেষ কিছু জানি না। মেয়েটাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম বটে, কিন্তু তাকে ভাল করে জানিবার সুযোগ হয়নি। একে তো আমি বাড়িতে কম থাকি, তাছাড়া হেনাও খুব মিশুকে মেয়ে ছিল না। যাহোক—‘
রবিবর্মা সিগারেটের কৌটা ও দেশলাই আনিয়া সন্তোষবাবুর সম্মুখে রাখিল, তিনি কৌটার ঢাকা খুলিয়া আমাদের সম্মুখে ধরিলেন—’আসুন।’ সিগারেট লাইতে লইতে ব্যোমকেশ একটু হাসিয়া বলিল, ‘শুনেছিলাম এ বাড়িতে ধূমপান নিষিদ্ধ।’
সন্তোষবাবু ঈষৎ ভ্রূকুটি করিয়া বলিলেন, ‘আপনাদের জন্যে নিষিদ্ধ নয়।’ তিনি নিজে একটা সিগারেট মুখে দিলেন, দেশলাই জ্বলিয়া আমাদের দিকে বাড়াইয়া দিলেন।
‘এবার কি প্রশ্ন করবেন করুন।’
এ কে রে রাইটার জমাদারকে ইশারা করিলেন, সে খাতা-পেন্সিল বাহির করিল। তখন প্রশ্নোত্তর আরম্ভ হইল।
প্রশ্ন : হেনার বাবার নাম কি?
উত্তর : কমল মল্লিক।
প্রশ্ন : কমল মল্লিক আপনার বন্ধু ছিলেন?
উত্তর : হ্যাঁ। তাঁকে প্রায় পনেরো বছর ধরে চিনতাম। ব্যবসার সূত্রে আমাকে ভারতবর্ষের সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে হত, এখনো হয়। কমল মল্লিকের সঙ্গে ঢাকায় জানাশোনা হয়েছিল, তারপর ক্রমে ঘনিষ্ঠতা হয়।
প্রশ্ন : তাহলে হেন কলকাতায় আসবার আগেও তাকে দেখেছেন?
উত্তর; অনেক বার। ওর তিন-চার বছর বয়স থেকে ওকে দেখছি।
প্রশ্ন; ওকে আশ্রয় দেবার ফলে বাড়িতে কোন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল কি?
একটু থমকিয়া গিয়া সন্তোষবাবু বলিলেন, ‘আমার স্ত্রী অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর শুচিবাই আছে; হেনা পাকিস্তানের মেয়ে, তার আচার-বিচার নেই, এই অছিলায় তিনি হেনাকে নিজের হাঁড়ি-হেঁশেল থেকে খেতে দিতে অসম্মত হয়েছিলেন। কাছেই একটা হোটেল আছে, সেখান থেকে হেনার খাবার আনার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম।’
প্রশ্ন; আর কেউ আপত্তি করেনি?
উত্তর : আর কারুর আপত্তি করার সাহস নেই।
প্রশ্ন : বাড়িতে কারুর সঙ্গে হেনার মেলামেশা ছিল না?
উত্তর : মেলামেশার বাধা ছিল না। তবে হেনা মিশুকে মেয়ে ছিল না, বাপ-মায়ের মৃত্যুর শকটাও বোধহয় সামলে উঠতে পারেনি। তাই সে একা-একাই থাকতো, নিজের ঘর ছেড়ে বড় একটা বেরতো না।
প্রশ্ন : সে রোজ সন্ধ্যেবেলা তেতলার ছাদে উঠে। বেড়াতে আপনি জানেন?
উত্তর : আগে জানতাম না, আজ জানতে পেরেছি।
প্রশ্ন; কার কাছে জানতে পারলেন?
উত্তর : যে আমাকে টেলিফোনে মৃত্যু-সংবাদ দিয়েছিল তার কাছে।
প্রশ্ন: কে মৃত্যু-সংবাদ দিয়েছিল?
সন্তোষবাবু কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়া রহিলেন, তারপর মুখ তুলিয়া বলিলেন, ‘তাই তো, কে খবর দিয়েছিল তা তো লক্ষ্য করিনি। আমি যেখানে ছিলাম। সেখানকার ঠিকানাও তো কেউ জানে না।’ তিনি হঠাৎ রবিবর্মার দিকে তীব্র চক্ষু ফিরাইয়া বলিলেন, ‘রবি।’
রবিবর্মা গাঢ়স্বরে বলিল, ‘আৰ্জেজ্ঞ না, আমি ফোন করিনি।’
আমরা একবার মুখ তাকাতাকি করিলাম। এ কে রে বলিলেন, ‘টেলিফোনে গলার আওয়াজ শুনে চিনতে পারেননি?’
সন্তোষবাবু বলিলেন, ‘খবরটা পাবার পর অন্য কোন প্রশ্ন মনেই আসেনি। কিন্তু–’
এ কে রে এবার অনিবাৰ্য প্রশ্ন করিলেন, ‘আপনি কোথায় ছিলেন?’
সন্তোষবাবুর মুখে ঈষৎ রক্তসঞ্চার হইল, তিনি একে একে আমাদের সকলের মুখের উপর দৃষ্টি বুলাইয়া বলিলেন, ‘একথা জানা কি নিতান্তাই দরকার?’
এ কে রে একটু অস্বস্তি বোধ করিতেছেন, তাহা তাঁহার ভাবভঙ্গী হইতে প্রকাশ পাইল; তিনি অপ্রতিভভাবে বলিলেন, ‘আমাকে ক্ষমা করবেন, কিন্তু হেন মল্লিকের মৃত্যু সম্বন্ধে আমি এখনো নিঃসংশয় হতে পারিনি। খুব সম্ভব সে অসাবধানে ছাদ থেকে নিজেই পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু কেউ তাকে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল— এ সম্ভাবনাও একেবারে বাদ দেওয়া যায় না। তাই সব কথা আমাদের জানা দরকার।’
সন্তোষবাবু ভ্রূ তুলিয়া কিছুক্ষণ এ কে রে’র পানে চাহিয়া রহিলেন, তারপর বলিলেন, ‘হেনকে কেউ ঠেলে ফেলে দিয়েছিল এ সম্ভাবনাও আছে?’
এ কে রে বলিলেন, ‘আজ্ঞে আছে।’
সন্তোষবাবু ঈষৎ গলা চড়াইয়া বলিলেন, ‘কিন্তু কে তাকে মারবে? কেন মারবে?’
এ কে রে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ‘তা এখনো জানি না। কিন্তু সব সম্ভাবনাই আমাদের অনুসন্ধান করে দেখতে হবে।’
সন্তোষবাবু আবার কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়া বসিয়া রহিলেন, তারপর সহসা খাড়া হইয়া বসিলেন; কড়া চোখে আমাদের সকলকে নিরীক্ষণ করিয়া কড়া সুরে বলিলেন, ‘বেশ, কোথায় ছিলাম বলছি। কিন্তু এটা আমার জীবনের একটা গুপ্তকথা, এ নিয়ে যেন কথা-চালাচালি না। হয়।’
‘কথা-চালাচালি হবে না। আপনি যা বলবেন, অফ-রেকর্ড থাকবে।’ এ কে রে অন্য পুলিস কর্মচারীদের ইশারা করিলেন, তাহারা উঠিয়া হল-ঘরে গেল, রাইটার জমাদারও খাতা বন্ধ করিয়া শুনা করিল। ব্যোমকেশ উঠিবার উপক্রম করিয়া বলিল, ‘আমরাও তাহলে পাশের ঘরে গিয়ে বসি।‘
সন্তোষবাবু হাত তুলিয়া দৃঢ়স্বরে বলিলেন, ‘না, আপনারা বসুন। আপনি উপস্থিত আছেন ভালই হল, আমি আপনাকে আমার পারিবারিক স্বার্থরক্ষার কাজে নিযুক্ত করলাম।’
ব্যোমকেশ আবার বসিয়া পড়িল। সন্তোষবাবু আর-একটা সিগারেট ধরাইয়া মৃদু মৃদু টান দিতে লাগিলেন, আমরা অপেক্ষা করিয়া রহিলাম।
চিংড়ি দ্বারের নিকট হইতে গলা বাড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, চা নিয়ে আসব?
সন্তোষবাবু বলিলেন, ‘এস।’
চিংড়ি ঘরে প্রবেশ করিল। তাহার পিছনে খাবার ও চায়ের ট্ৰে লইয়া দুইজন ভৃত্য। চিংড়ি আমাদের সামনে চা ও জলখাবারের রেকবি রাখিতে রাখিতে একবার বিস্মফারিত নেত্ৰে ব্যোমকেশের পানে চাহিল। নেংটির নিকট নিশ্চয় ব্যোমকেশের পরিচয় শুনিয়াছে। তাহার দৃষ্টিতে কৌতূহল ছাড়াও এমন কিছু ছিল, যাহা নির্ণয় করা কঠিন। বোধহয় সে মনে মনে ভয় পাইয়াছে।
সন্তোষবাবু বলিলেন, ‘বাইরে যাঁরা আছেন তাঁদেরও দাও।’
চিংড়ি চাকরদের লইয়া হল-ঘরে গেল, রবিবর্মা বাহিরে গিয়া নিঃশব্দে দ্বার ভেজাইয়া দিল।
আমরা পানাহারে মনোনিবেশ করিলাম। সন্তোষবাবু কেবল এক পেয়ালা চা লইয়াছিলেন, তিনি তাহাতে একটু মৃদু চুমুক দিয়া আমাদের দিকে না চাহিয়াই বলিতে আরম্ভ করিলেন, ‘আমি অকলঙ্ক চরিত্রের লোক নই, কিন্তু সেজন্যে নিজেকে ছাড়া কাউকে দোষ দিই না। আমার অসংখ্য দোষের মধ্যে একটা দোষ, আমি কীর্তন শুনতে ভালবাসি।’
আমরা মুখ তুলিয়া চাহিলাম। রাজনীতির ক্ষেত্রে সন্তোষবাবু বিখ্যাত বক্তা্্, তিনি যে তাঁহার গুপ্তকথা মৰ্মস্পশীী ভঙ্গীতে বলিবেন তাহাতে সন্দেহ রহিল না। বস্তুত তাঁহার প্রস্তাবনার বৈচিত্র্যে তিনি আমাদের অখণ্ড মনোযোগ আকর্ষণ করিয়া লইলেন।
আর-এক চুমুক চা পান করিয়া তিনি সিগারেটে লম্বা টান দিলেন, তারপর পেয়ালার মধ্যে সিগারেটের দগ্ধাংশ ফেলিয়া এক পাশে সরাইয়া রাখিতে রাখিতে বলিতে আরম্ভ করিলেন,–
‘কীৰ্তন-গাইয়ে সুকুমারীর নাম বোধহয় আপনারা শুনেছেন। গান গাওয়া তার ব্যবসা, টাকা নিয়ে সভায়-মজলিশে গান গায়। দশ বছর আগে তার গান শুনে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমার দাম্পত্য-জীবন সুখের নয়, আমি সুকুমারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। তখন সুকুমারীর বয়স বাইশ-তেইশ বছর। কিছুদিন লুকিয়ে তার বাড়িতে যাতায়াত করেছিলাম, তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। কিন্তু তার বাড়িতে নানা রকম লোক আসত, কেউ গান শুনতে আসত, কেউ বায়না দিতে আসত। দেখলাম, এখানে যাতায়াত করা আমার পক্ষে নিরাপদ নয়।
‘আপনারা জানেন, আমার জীবন রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। স্বাধীনতার যুদ্ধে দেশ-বিভাগের সময় দুই পক্ষের মধ্যে দূতের কাজ করেছি। রাজনীতির ক্ষেত্রে আমার খ্যাতি আছে, প্রতিপত্তি আছে। তেমনি আবার শত্ৰুও আছে। শত্রুপক্ষ যদি আমার নামে কলঙ্ক রটাবার সুযোগ পায়, তাহলে আমার যশ পদমর্যাদা কিছুই থাকবে না। ভেবে-চিন্তে আমি এক কাজ করলাম, বেনামে একটি ছোট্ট বাড়ি ভাড়া নিলাম। উদ্দেশ্য, সুকুমারীকে সেখানে নিয়ে গিয়ে তুলিব, তার প্রকাশ্য গায়িক-জীবন শেষ হবে। কিন্তু সুকুমারী তাতে রাজী হল না। শেষ পর্যন্ত স্থির হল সে নিজের বাসাতেই থাকবে এবং গানের ব্যবসা চালাবে, কেবল হগুপ্তার মধ্যে দুদিন, শনিবার এবং রবিবার, সে আমার ভাড়া-করা গোপন বাড়িতে এসে থাকবে। আমি সেখানে এমনভাবে যাতায়াত করব যে কেউ জানতে পারবে না।
‘গত দশ বছর ধরে এইভাবে চলেছে। আমি শনিবার বিকেলের দিকে অফিসের কাজ সেরে সেখানে চলে যাই, তারপর সোমবার সকালে সেখান থেকে সটান অফিসে যাই। আজও তাই হয়েছিল, বেলা আন্দাজ সাড়ে তিনটের সময় সেখানে গিয়েছিলাম। তারপর— রাত্রি আটটার সময় টেলিফোন পেয়ে তৎক্ষণাৎ চলে এলাম।’ তাঁহার মুখে নীরস ব্যঙ্গ ফুটিয়া উঠিল, ‘এই আমার অ্যালিবাই।’
ব্যঙ্গের খোঁচা হজম করিয়া এ কে রে বিনীত স্বরে বলিলেন, ‘ধন্যবাদ। খৃষ্টতা ক্ষমা করবেন, আর দু-একটা প্রশ্ন করেই আপনাকে নিস্কৃতি দেব। ভাড়াটে বাড়িতে চাকর-বাকর কেউ আছে?
সন্তোষবাবু বলিলেন, ‘না, ইচ্ছে করেই চাকর রাখিনি। প্রত্যেক শনিবার দুপুরবেলা সুকুমারী নিজের বাসা থেকে ভাড়াটে বাসায় চলে আসে, ঘরদের পরিষ্কার করে রাখে। আমি বিকেলবেলা যাই। তারপর সোমবারে আমি অফিসে চলে যাবার পর, সে বাড়িতে তালা দিয়ে নিজের বাসায় ফিরে যায়। হাপ্তার বাকি দিন বাড়ি বন্ধ থাকে।’
প্রশ্ন : টেলিফোন রেখেছেন কেন?
উত্তর : নিজের জন্য নয়, সুকুমারীর জন্যে। সে যে-সময় ভাড়াটে বাড়িতে থাকে, সে-সময় নিজের বাসার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চায়। কিন্তু প্ৰাইভেট নম্বর, ডিরেকটরিতে পাবেন না।
প্রশ্ন : সেক্রেটারিকে নম্বর বলেননি?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : কার জানা সম্ভব?
উত্তর : কারুর জানা সম্ভব নয়। আমি কাউকে বলিনি, সুকুমারীও কাউকে বলবে না।
প্রশ্ন : তাঁকে আপনি বিশ্বাস করেন?
উত্তর : করি। আমি তাকে মাসে হাজার টাকা দিই। সে নির্বোধ নয়, নিজের পায়ে কুডুল মারবে না।
প্রশ্ন; আজ যখন টেলিফোন পেলেন, তখন আপনি কি করছিলেন?
উত্তর : কীর্তন শুনছিলাম। সুকুমারী চণ্ডীদাসের পদ গাইছিল।
এ কে রে ব্যোমকেশের পানে চক্ষু ফিরাইলেন; ব্যোমকেশ নিঃশব্দে মাথা নাড়িল, অর্থাৎ, আর কোন প্রশ্ন নাই। তখন এ কে রে গাত্ৰোত্থান করিয়া বলিলেন, ‘আজ এই পর্যন্ত থাক। কষ্ট দিলাম, কিছু মনে করবেন না। আজ কি আপনি আবার–?’
‘না, ফিরে যাব না, বাড়িতেই থাকব।’ সন্তোষবাবুর গভীর চোখে কৌতুকের কটাক্ষ খেলিয়া গেল, তিনি বলিলেন, ‘আমার পিছনে গুপ্তচর লাগিয়ে আমার বাসার সন্ধান পাবেন না।’
এ কে রে জিভ কাটিয়া বলিলেন, ‘না না, সে কি কথা! আপনার গুপ্ত বাসা সম্বন্ধে আমার তিলমাত্র কৌতূহল নেই। আপনি যা বললেন, আমাদের তদন্তের পক্ষে তাই যথেষ্ট। কেবল-শ্ৰীমতী সুকুমারীর সঙ্গে একবার দেখা করতে পারলে ভাল হত।’
‘তাকে তার বাসার ঠিকানায় পাবেন।’ সন্তোষবাবু সুকুমারীর ঠিকানা দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন, ‘দশটা বাজে। আপনার কাজ বোধহয় এখনো শেষ হয়নি, যতক্ষণ দরকার থাকুন।। ব্যোমকেশবাবু্, আপনি আমার পক্ষ থেকে ইন্সপেক্টরের সঙ্গে থাকবেন তো?’
‘নিশ্চয়’ বলিয়া ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল।
সন্তোষবাবু বলিলেন, ‘আচ্ছা, আমি তাহলে বিশ্রাম করি গিয়ে। একটু ক্লান্তি বোধ হচ্ছে।’
তিনি দৃঢ়পদে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। তাঁহার শরীরে ক্লান্তির কোন লক্ষণ চোখে পড়িল না। বোধহয় মনের ক্লান্তি। বাড়িতে এতবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়া যাইবার পর–
সন্তোষবাবু যেভাবে তাঁহার গুপ্তকথা প্রকাশ করিলেন তাহাতে ঢাকাঢাকা গুড়গুড় নাই, নিজের সম্বন্ধে সাফাই গাঁহিবার চেষ্টা নাই—জীবনের গৃঢ় সত্য কথা যখন বলিতেই হইবে তখন স্পষ্টভাবে বলাই ভাল। তবু তাঁহার নির্মম সত্যবাদিতা আমার মনকে পীড়া না দিয়া পারিল না। তিনি পাকা ব্যবসায়ী এবং ঝানু রাজনীতিজ্ঞ, তাঁহার চরিত্রে এই কালো দাগটা না থাকিলেই বোধহয় ভাল হইত।
এ কে রে ব্যোমকেশকে প্রশ্ন করিলেন, ‘অতঃপর?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘চল, হেনার ঘরটা একবার দেখে যাই।’
‘চল।–ছাদে যাবে নাকি?’
‘যাব। এসেছি। যখন, যা-যা দ্রষ্টব্য আছে সবই দেখে যাই।’
হল-ঘরের গোল টেবিলের কাছে বসিয়া পুলিসের বাকি কর্মচারীরা নিম্নস্বরে বাক্যালাপ করিতেছিলেন, রবিবর্মা ছাড়া বাড়ির লোক আর কেহ উপস্থিত ছিল না। হেনীর ঘর ডাইনিং-রুম হইতে কোনাকুনিভাবে হল-ঘরের অপর প্রান্তে। [প্ল্যান পশ্য]। হেনার ঘরের দ্বার ঈষৎ উন্মুক্ত, আলো জ্বলিতেছে। আমরা তিনজনে ঘরে প্রবেশ করিলাম। রবিবর্মা আমাদের পিছন পিছন আসিল।
ঘরটি বেশ বড়। সদরের দিকে ধনুরাকৃতি বড় জানালা, পূর্বদিকের দেয়ালেও একটি সাধারণ জানালা আছে। এই জানালার সামনে টেবিল ও চেয়ার, পাশে বইয়ের শেলফ। ঘরের অন্য পাশে সংকীর্ণ একহারা খাটের উপর বিছানা পাতা; খাটের নীচে বড় বড় দু’টি সুটকেস দেখা যাইতেছে। উত্তরদিকের দেয়ালের কোণে একটি সরু দরজা সংলগ্ন বাথরুমের সহিত সংযোগ স্থাপন করিয়াছে। ঘরে আসবাবের বাহুল্য নাই, তাই ঘরটি বেশ পরিচ্ছন্ন দেখাইতেছে। সম্ভবত হেনাও পরিচ্ছন্ন স্বভাবের মেয়ে ছিল।
ঘরের মাঝখানে দাঁড়াইয়া চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিতে করিতে ব্যোমকেশ বলিল, ‘ঘরের দরজা কি খোলা ছিল?’
এ কে রে বলিলেন, ‘না, তালা লাগানো ছিল। মৃতদেহের হাতে একটা চামড়ার হ্যান্ড-ব্যাগ ছিল, তার মধ্যে চাবির রিঙ পাওয়া গেছে। এই যে।’ তিনি পকেট হইতে একটি চাবির গোছা বাহির করিয়া দিলেন।
চাবি হাতে লইয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘হেনা তাহলে ঘরে তালা দিয়ে ছাদে গিয়েছিল।’
এ কে রে বলিলেন, ‘তাই তো দেখা যাচ্ছে।’
রবিবর্মা মুখের সামনে মুষ্টি রাখিয়া কাশির মত একটা শব্দ করিল। ব্যোমকেশ তাহার দিকে চক্ষু ফিরাইলে সে বলিল, ‘হেনা দোর খুলে রেখে ঘর থেকে কখনো এক পা বেরুতো না, যখনি বেরুতে দোরে তালা দিয়ে বেরুতো।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাই নাকি? গোড়া থেকেই এই রকম, না, কোন উপলক্ষ হয়েছিল?’
‘গোড়া থেকেই এই রকম।’
ব্যোমকেশ আর কিছু বলিল না, চাবির রিঙ পর্যবেক্ষণ করিয়া বলিল, ‘পাঁচটা চাবি রয়েছে দেখছি। একটা তো দোরের তালার চাবি। আর অন্যগুলো?’
এ কে রে বলিলেন, ‘বাকিগুলোর মধ্যে দুটো হচ্ছে সুটকেসের চাবি। অন্য দুটো কোথাকার চাবি জানা গেল না।’
ব্যোমকেশ চাবিগুলি একে একে পরীক্ষা করিয়া বলিল, ‘একটা চাবিতে নম্বর খোদাই করা রয়েছে-৭ নম্বর। দেখ তো, এ চাবিটা কোথাও লাগে কি না।’
এ কে রে চাবিটি দেখিয়া বলিলেন, ‘না। যে চাবি দুটোর তালা পাওয়া যাচ্ছে না, এটা তারই একটা।’
‘টেবিলের দেরাজে। গা-তালা নেই?’
‘আছে। কিন্তু দেরাজগুলো সব খোলা। চাবি নেই।’
‘হুঁ।–কি মনে হয়?’
দু’জনে চোখে চোখে ক্ষণেক চাহিয়া রহিল, শেষে এ কে রে বলিলেন, ‘বলা শক্ত। অনেক সময় দেখা যায়। তালা হারিয়ে গেছে, কিন্তু চাবিটা রিঙে রয়ে গেছে।’
ব্যোমকেশ রবিবর্মার দিকে চাহিয়া বলিল, ‘আপনি কিছু বলতে পারেন?’
রবিবাম ঘাড় নাড়িল, ‘এ-ঘরের ভিতরের কথা আমি কিছু বলতে পারি না। এই প্রথম ঘরে ঢুকলাম।’
ব্যোমকেশ গলার মধ্যে শব্দ করিল, চাবির গোছা এ কে রে-কে ফেরৎ দিয়া টেবিলের সামনে গিয়া দাঁড়াইল।
একদিকে দেরাজযুক্ত টেবিল, লাল বনাত দিয়া ঢাকা, তাহার উপর দু-একটি বই ছাড়া আর কিছু নাই। তারপর চোখে পড়িল লাল বানাতের উপর একটি লাল গোলাপফুল পড়িয়া আছে। ঘরে ফুলদানি নাই, গোলাপফুলটা এমন অনাদৃতভাবে পড়িয়া আছে যে, আশ্চর্য লাগে।
ব্যোমকেশ ফুলটিকে স্পর্শ করিল না, সম্মুখে ঝুকিয়া সেটি ভালভাবে দেখিল, তারপর টেবিলের শিয়রে খোলা জানালার দিকে চোখ তুলিয়া বলিল, ‘তাজা ফুল। বাগানে গোলাপফুল আছে?’ জানালার বহিভাগের দৃশ্য অন্ধকারে দেখা যাইতেছিল না।
রবিবর্মা বলিল, ‘আছে।’
ব্যোমকেশ এ কে রে-কে বলিল, ‘গোলাপটা দেখে কী মনে হয়? এমনভাবে টেবিলের ওপর পড়ে আছে কেন?’
এ কে রে নীরবে জানালার বাহিরে অঙ্গুলি নির্দেশ করিলেন।
ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল, ‘আমারও তাই মনে হচ্ছে। হেনা যখন ঘরে ছিল না, সেই সময় কেউ বাগান থেকে ফুলটা তুলে জানালার গরাদের ফাঁকে টেবিলের ওপর ফেলে দিয়েছে।’ আমাদের সকলের চক্ষু রবিবর্মার দিকে ফিরিল, সকলের চোখে একই প্রশ্ন-কে ফেলতে পারে?
রবিবর্মা কিন্তু আমাদের জিজ্ঞাসু চক্ষু এড়াইয়া এদিকে-ওদিকে চাহিতে লাগিল, শেষে বলিল, ‘আমি কিছু জানি না।’
ব্যোমকেশ নিশ্বাস ফেলিয়া দেরাজগুলি খুলিয়া খুলিয়া দেখিতে লাগিল, আমি বইয়ের শেলফের সামনে গিয়া দাঁড়াইলাম।
দু-সারি বই। প্রথম সারিতে রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা, সত্যেন দত্তের কাব্যসঞ্চয়ন, নজরুলের সঞ্চিতা এবং আধুনিক লেখকদের রচিত কয়েকটি কথােকাহিনীর পুস্তক। দ্বিতীয় সারিতে অনেকগুলি ইংরেজি উপন্যাসের সুলভ সংস্করণ। হেনা বিদেশী রহস্য-রোমাঞ্চের বইও পড়িত।
‘অজিত, দ্যাখো।’
আমি ফিরিয়া দেখিলাম, ব্যোমকেশ দেরাজ হইতে একটি ফটোগ্রাফ বাহির করিয়াছে এবং একদৃষ্টি তাহা দেখিতেছে। কার্ডবোর্ডের উপর আটা পোস্টকার্ড সাইজের ছবিতে কেবল একটি রমণীর প্রতিকৃতি! আমি এক নজর দেখিয়া বলিয়া উঠিলাম, ‘হেনার ফটো।’
ব্যোমকেশ মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘না। ছবিটা কয়েক বছরের পুরনো, দেখছি না হলদে হয়ে গেছে, অথচ মহিলাটির বয়স পঁচিশের কম নয়। হেনা হতে পারে না, বোধহয় হেনার মা। হেনা এত রূপ কোথা থেকে পেয়েছিল বোঝা যাচ্ছে।’
হেনাকে জীবিত অবস্থায় দেখি নাই, মৃতদেহ দেখিয়া রূপ অনুমান করিয়াছিলাম। এখন এই ফটো দেখিয়া মনে হইল, হেনাকে জীবন্ত অবস্থায় দেখিতেছি। শুধু রূপ নয়, অফুরন্ত প্রাণশক্তি সর্বাঙ্গ দিয়া বিছুরিত হইতেছে।
ব্যোমকেশ ছবিটা এ কে রে-র হাতে দিয়া বলিল, ‘এটা রাখো। সন্তোষবাবুকে জিজ্ঞেস করতে হবে ছবিটা হেনার মায়ের কিনা।’
এ কে রে ছবিটি লইয়া চোখ বুলইলেন, রবিবর্মা গলা বাড়াইয়া দেখিয়া লইল। লোকটির চোখ-মুখ দেখিয়া কিছু বোঝা যায় না, কিন্তু প্ৰাণে যথেষ্ট কৌতূহল আছে।
এ কে রে ফটো পকেটে রাখিলেন, বলিলেন, ‘আচ্ছা। দেরাজে আর কিছু পেলে?’
না। খুচরো দু-চারটে পয়সা আছে; এমন কিছু নেই। রবিবাবু্, হেনার নামে চিঠিপত্র আসত কিনা। আপনি জানেন?’
রবিবর্মা বলিল, ‘চিঠি আসার সময় আমি বাড়িতে থাকি না। নেংটি কিংবা চিংড়ি বলতে পারে।’
আর কিছু না বলিয়া ব্যোমকেশ বইয়ের শেলফের কাছে আসিল, বইগুলির মলাটের উপর একবার চোখ বুলাইয়া সঞ্চয়িতা বইখানি হাতে লইল। মলাট খুলিতেই দেখা গেল, এক টুকরা গোলাপী কাগজ ভাঁজের মধ্যে রহিয়াছে। কাগজের উপর চার ছত্র হাতের লেখা! ব্যোমকেশ কাগজটি দু’ আঙুলে তুলিয়া ধরিয়া দেখিতেছে, রবিবর্মা বকের মত সেদিকে গলা বাড়াইল। ব্যোমকেশ কিন্তু তাহাকে লেখাটি পড়িতে দিল না, চট্ করিয়া কাগজ পকেটে পুরিল। রবিবর্মার মুখে ভাবোস্তর হইল না বটে, কিন্তু তাহার প্রাণটা যে ঐ লেখাটি পড়িবার জন্য আকুলি-বিকুলি করিতেছে, তাহা অনুমান করা শক্ত হইল না।
ব্যোমকেশ একে একে অন্য বইগুলি খুলিয়া দেখিতে আরম্ভ করিল, এ কে রে এবং আমি দুইপাশে দাঁড়াইয়া তাহার কার্যকলাপ দেখিতে লাগিলাম। আমাদের পিছনে রবিবাম অতৃপ্ত প্রেতীয়ার মত ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। আমাদের পিছনে থাকিয়া সে দেখিতে পাইতেছে না। আমরা কি করিতেছি, তাই দুৰ্নিবার কৌতূহলে ছটফট করিতেছে। এত কৌতূহল কিসের?
উপরের থাকে বাংলা বইগুলিতে আর কিছু পাওয়া গেল না। বইগুলির প্রথম পৃষ্ঠায় পরিচ্ছন্ন মেয়েলি ছাঁদে লেখা আছে-হেন মল্লিক।
নীচের থাকের ইংরেজি বইগুলিতেও কাগজপত্র কিছু নাই, কিন্তু একটি বিষয়ে ব্যোমকেশ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। কয়েকটি বইয়ের নাম-পৃষ্ঠায় রবারস্ট্যাম্প দিয়া ঢাকার একটি পুস্তক-বিক্রেতার নাম ছাপা আছে। এ কে রে ভ্রূ তুলিয়া ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন, আমিও লু তুলিলাম। কিন্তু ব্যোমকেশ কিছু বলিল না; রবিবর্মার সান্নিধ্যবশতাই বোধহয় মুখ খুলিল না।
বই দেখা শেষ হইলে ব্যোমকেশ বলিল, ‘সুটকেস দুটোতে কি আছে, খোল না একবার দেখি।‘
এ কে রে চাবির গোছা বাহির করিয়া সুটকেস দু’টি খুলিলেন। দেখা গেল, তাদের মধ্যে নানা জাতীয় মেয়েলি পোশাক থরে থরে সাজানো রহিয়াছে। শাড়ি-স্কার্ট-ঘাঘরাওড়না-কামিজ-পায়জামা প্রভৃতি সর্বজাতীয় পরিচ্ছদ। সবই দামী জিনিস। ব্যোমকেশ সেগুলি উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিল, তারপর নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘না, কাজের জিনিস কিছু নেই। বাথরুমটা তো তুমি দেখেছ?’
এ কে রে বলিলেন, ‘দেখেছি। বিশেষ দ্রষ্টব্য কিছু নেই।’
‘আমিও একবার দেখে যাই।’ ব্যোমকেশ বাথরুমে প্রবেশ করিল। মিনিট দুই-তিন পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ‘চল, এবার ছাদে যাওয়া যাক।’
ঘরের দরজা হইতে কয়েক পা সামনের দিকে সিঁড়ি আরম্ভ হইয়াছে। বেশ চওড়া বাহারে সিঁড়ি। ব্যোমকেশ সিঁড়ির নীচের ধাপে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, রবিবাবু্, আপনি আর আমাদের সঙ্গে আসবেন না, ছাদ আমরা নিজেরাই দেখে নিতে পারব।’ কথাগুলি বলার ভঙ্গীতে এমন একটি দৃঢ়তা ছিল যে, রবিবর্মা আর অগ্রসর হইল না, সিঁড়ির পদমূলে দাঁড়াইয়া রহিল। আমরা উপরে উঠিয়া গেলাম।
দোতলাকে স্পর্শ করিয়া সিঁড়ি তেতলায় উঠিয়া গিয়াছে, মোড় ঘুরিয়াব্র সময় দ্বিতল যতখানি দেখা গেল এক নজরে দেখিয়া লইলাম। হল-ঘরের উপরে অবিকল আর একটি হল-ঘর, সামনের দিকে দুই কোণে দু’টি ঘর। তফাৎ এই যে, নীচের তলায় পিছনের দেয়ালের দরজা ছিল না, দ্বিতলে সারি সারি তিনটি দরজা। অথাৎ, নীচের রান্নাঘর ভাঁড়ারঘর প্রভৃতির উপরে কয়েকটি শয়নকক্ষ, দরজাগুলি উপরের হল-ঘরের সহিত তাহদের যোগসাধন করিয়াছে।
ত্ৰিতলে সিঁড়ি যেখানে শেষ হইয়াছে সেখানে একটি বন্ধ দ্বার। এ কে রে ছিটিকিনি খুলিয়া দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দিলেন এবং দ্বারের পাশে একটি সুইচ টিপিয়া ছাদের আলো জ্বলিলেন; ফ্লাড় লাইটের আলোয় প্রকাণ্ড ছাদ উদভাসিত হইল।
আমরা তিনজনে ছাদে পদাৰ্পণ করিলাম। ব্যোমকেশ প্রথমেই দরজাটা পরীক্ষা করিয়া বলিল, ‘ভিতরে এবং বাইরে দুদিক থেকেই দরজা বন্ধ করার ব্যবস্থা আছে দেখছি; ভিতরে ছিটিকিনি বাইরে শিকল। এ কে রে, তুমি যখন ছাদে এসেছিলে তখন কি দরজা বন্ধ ছিল?’
এ কে রে বলিলেন, ‘না, দুদিক থেকেই খোলা ছিল।’
বৈদ্যুতিক বন্যালোক তো ছিলই, উপরন্তু এতক্ষণে কৃষ্ণপক্ষের খণ্ডচন্দ্র মাথা তুলিয়াছে। আমরা ছাদের মাঝখানে গিয়া দাঁড়াইলাম।
ছাদটি প্রকাণ্ড, ইহার উপর সুন্দর একটি টেনিস-কোর্ট তৈরি করা চলে। ছাদ ঘিরিয়া নিরেট গাঁথুনির আলিসা, আলিসার গায়ে বাহির হইতে বাঁশের ডগা উচু হইয়া আছে, কেবল পূর্বদিকে
দূরে বাগানের সীমানায় একসারি দীর্ঘ সিলভার পাইনের গাছ। সমব্যবধানে দাঁড়াইয়া বাড়িটিকে যেন প্রহরীর মত ঘিরিয়া রাখিয়াছে। ছাদ হইতে তাহাদের উধ্বঙ্গি মন্দিরের চুড়ার মত দেখাইতেছে।
ব্যোমকেশ একবার চারিদিকে মুণ্ড ঘুরাইয়া সমগ্র দৃশ্যটা দেখিয়া লইল, তারপর তাহার দৃষ্টি ছাদের অভ্যস্তরে ফিরিয়া আসিল। ছাদে অন্য কিছু নাই, কেবল মধ্যস্থলে একটু পশ্চিমদিকে ৰ্ঘেষিয়া একটি মাদুর পাতা রহিয়াছে এবং তাহার পাশে একজোড়া মেয়েলি চটিজুতা।
একটি চিত্র মনশ্চক্ষে ভাসিয়া উঠিল; হেনা ছাদে আসিয়া মাদুর পাতিল, চটিজুতা খুলিয়া তাহার উপর বসিল। তারপর-?
রহিল, তারপর মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘হেনা কোন দিকে পড়েছিল?’
যেদিকে ভারা বাঁধা নাই সেই দিকে নির্দেশ করিয়া এ কে রে বলিলেন, ‘এই দিকে।’
তিনজনে পূর্বদিকের আলিসার কিনারায় গিয়া দাঁড়াইলাম। সামনেই চাঁদ। পঁচিশ হাত দূরে পাইনগাছের সারি মৃদু বাতাসে মর্মরধ্বনি করিতেছে, যেন হেনার অপমৃত্যু সম্বন্ধে হ্রস্বকণ্ঠে জল্পনা করিতেছে। তাহারা যদি মানুষের ভাষায় কথা বলিতে পারিত বোধহয় প্রত্যক্ষদশীর সাক্ষ্য পাইতাম। ‘ঐখানে পড়েছিল!’ এ কে রে নীচের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইলেন। আমরা উঁকি মারিয়া দেখিলাম। পাইনগাছের ছায়ায় বিশেষ কিছু দেখা গেল না। আলিসাটা আমার কোমর পর্যন্ত উঁচু, এক ফুট চওড়া। হেনা আমার চেয়ে দৈর্ঘ্যে ছোটই ছিল নিশ্চয়, সে যদি কোনো কারণে নীচের দিকে উঁকি মারিয়াও থাকে, আলিসা ডিঙাইয়া পড়িয়া যাইবার সম্ভাবনা কম।
ব্যোমকেশও বোধকরি মনে মনে মাপজোক করিতেছিল, এ কে রে’র দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘হুঁ। আলসের খাড়াই আন্দাজ চার ফুট। হেনরি খাড়াই কত ছিল?
এ কে রে ব্যোমকেশের মনের কথা বুঝিয়া বলিলেন, ‘আন্দাজ পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি। কিন্তু তাহলেও অসম্ভব নয়।’
‘অসম্ভব বলিনি।’ ব্যোমকেশ ধীরে ধীরে আলিসার ধারা দিয়া পরিক্রমণ করিল। ভারাগুলি মাটি হইতে ছাদ পর্যন্ত মই রচনা করিয়াছে, একটু শক্ত-সমর্থ মানুষ সহজেই মই দিয়া উপরে উঠিয়া আসিতে পারে।
ছাদ পরিদর্শন শেষ করিয়া ব্যোমকেশ ঈষৎ নিরাশ স্বরে বলিল, অনেক রাত হয়েছে, আজ এই পর্যন্ত থাক। —হেনীর ঘরটা কি সীল করবে?’
এ কে রে বলিলেন, ‘সীল করার দরকার দেখি না। ও-ঘরে হেনার মৃত্যুর হয়নি। উপরন্তু আমরা দু’জনেই ঘরটা খানাতল্লাশ করেছি।’
ব্যোমকেশ আর কিছু বলিল না। এ কে রে আলো নিভাইয়া সিঁড়ি দিয়া নামিয়া চলিলেন, আমরা তাঁহার পিছনে চলিলাম।
নিঃশব্দে নামিতেছি। দ্বিতল পর্যন্ত নামিয়া মোড় ঘুরিবার উপক্রম করিতেছি, পাশের দিক হইতে একটা চাপা তীক্ষ্ণ স্বর কানে আসিল—’তুমি চুপ করে থাকবে, কোনো কথা কইবে না।’
চকিতে ঘাড় ফিরাইয়া দেখি দ্বিতলে হল-ঘরের অন্য প্রাস্তে রবিবর্মার্ণ ও শ্ৰীমতী চামেলি মুখোমুখি দাঁড়াইয়া আছেন। রবিবর্মা আমাদের দেখিতে পাইয়া বোধহয় নিঃশব্দে শ্ৰীমতী চামেলিকে ইশারা করিল, তিনি আমাদের দিকে ফিরিয়া চাহিলেন। তারপর ধারালো চোখে প্রখর অসহিষ্ণুতা ফুটাইয়া তিনি দ্রুতপদে পিছনের একটি ঘরে প্রবেশ করিলেন।
নীচে নামিয়া আসিয়া ব্যোমকেশ এ কে রে’র দিকে বঙ্কিম কটাক্ষপাত করিয়া বলিল, ‘শুনলে?’
এ কে রে একটু ঘাড় নাড়িলেন, বলিলেন, ‘চল, পুলিস-ভ্যানে তোমাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে যাই।’