Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভৌতিক সারমেয় || Sankar Brahma

ভৌতিক সারমেয় || Sankar Brahma

ভাদ্র মাসের শেষ। পুরো এলাকা বন্যার জলে ডুবে আছে। উপরে ধান গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকায় পুরো মাঠটা ধানক্ষেত বলে মনে হচ্ছে। দিগন্তজোড়া সবুজের সমারোহ। ধান গাছের নিচেই একবুক,একগলা পরিমাণ জল। জল কমতে শুরু করেছে। প্রচুর মাছ ধরা পড়ছে। আমরাও মাছ ধরার জন্য ধান ক্ষেতের আলে চাঁই পেতেছি।
বাড়ির পিছনেই ছোট নালা। গভীর নয়। এক হাঁটু পরিমাণ জল। বর্ষা শেষে এখান দিয়ে উজানের জল নেমে যায়। বাড়ি থেকে দু-তিন’শ গজ দক্ষিণে এবং রাস্তা থেকে পঞ্চাশ গজ পশ্চিমে একটা ঝাঁকড়া কুলগাছ। এই কুল গাছের তলাতেই কয়েক বছর আগে মিনতি সান্যাল সন্ধ্যায় জ্ঞান হারিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল। সবাই ভূতুড়ে গাছ বলে জানে। গাছ থেকে পশ্চিমে নালার অপর প্রান্ত পর্যন্ত পুরো নালাটিই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘের দেয়া হয়েছে।
প্রায় দুই থেকে আড়াইশ গজ বাঁশের বেড়ার মাঝে মাঝে দশ পনরো হাত পরপর চার ছয় ইঞ্চি ফাঁক রেখে সেই ফাঁকের মুখে একটি করে চাঁই বসানো আছে। ভাদ্র মাসের শেষ সময়ে চাঁইয়ে প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। বড় বড় মাছ চাঁইয়ের ভিতর আটকা পড়লে বের হওয়ার জন্য দাপাদাপি করে চাঁই ভেঙে ফেলে। দিনে বড় মাছের শব্দ শুনলে তাড়াতাড়ি গিয়ে চাঁই ভাঙার আগেই মাছ উঠানো যায়। কিন্তু রাতে পাহাড়া না দিয়ে ঘুমিয়ে থাকলে অনেক সময় মাছ চাঁই ভেঙে বেরিয়ে যায়।
সন্ধ্যার সময় বাড়ির চাকর চাঁদু বলল. দাদাবাবু আজ রাতে চাঁই পাহাড়া দেওয়া লাগবে। আজ অনেক মাছ পড়তে পারে।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,কিভাবে বুঝলি?
সে বলল, আজ সারা দিন অনেক চড়া রোদ গেছে। জল অনেক শুকিয়েছে। জলে খুব টান ধরছে তো, যে কারণে মাছ ধরা পড়বো। মাছ পাহাড়া না দিলে বড় বড় মাছগুলা চাঁই ভেঙে বেরিয়ে যাবে।
আমি তার কথায় সায় দিয়ে বললাম, ঠিক বলেছিস।
রাত আটটা নয়টার মধ্যে দু’জনেই ভাত খেয়ে দু’টো বালিশ একটা চাটাই আর দু’জনে দু’টা বাঁশের লাঠি নিয়ে চাঁইয়ের কাছাকাছি রাস্তায় চলে এলাম। রাস্তাটি জল থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে। রাস্তার উপরে চাটাই পেতে বসে আছি। চাঁদনী রাত। অনেক দুর পর্যন্ত দেখা যায়। মাঝে মাঝে রাত চোরা পাখির ফুরুৎ ফুরুৎ শব্দ কানে আসে। মশার উৎপাতও কম নয়। চাঁদু মশার উৎপাত সহ্য করতে না পেরে ধানের খড় দিয়ে ভূতি বানিয়ে তাতে আগুন জ্বেলেছে। ভূতির ধোয়ায় মশার উপদ্রব কিছুটা কমেছে । অনেক রাত হলে আমি খালি চাটাইয়ের উপর বালিশে মাথা রেখে শুয়ে আছি। চাঁদুও তার বালিশে মাথা রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের তারা গুনছে।
রাত বারোটার সময় দুই জনে জলে নেমে চাঁই উঠিয়ে কিছু মাছ তুলে এনেছি। মাছগুলো রাস্তার কাছাকাছি বড় একটি চাঁইয়ের মধ্যে ঢেলে অর্ধেক জলে ডুবিয়ে রেখেছি। চাঁই অর্ধেক জলে ডুবিয়ে রাখার কারণে মাছ মরবে না, তাজা থাকবে। মাছগুলো চাঁইয়ের ভিতর রাখার পর বন্দী অবস্থায় কিছুক্ষণ লাফালাফি করে ক্লান্ত হয়ে আস্তে আস্তে নীরব হয়েছে।
রাত একটা দেড়টার দিকে দুইচোখে খুব ঘুম জড়িয়ে এসেছে। আকাশে পুরো চাঁদ। হঠাৎ পশ্চিম দিক থেকে জলের উপর দিয়ে কোনও প্রাণী হেঁটে আসার শব্দ কানে ভেসে এলো। আমরা তেমন কোন গুরুত্ব না দিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছি। জলের উপর দিয়ে হেঁটে আসার শব্দ ক্রমশ বাড়ছে। বোঝা যাচ্ছ প্রাণীটি জলের উপর দিয়ে আমাদের দিকেই আসছে। মাথা তুলে পশ্চিম দিকে তাকিয়ে দেখি একটা। কালো কুকুর। আমি চাঁদুকে বললাম, কুকুর কি চাঁইয়ের মাছ খাবে নাকি?
চাঁদু বলল, আমি তো জানি, কুকুর কাঁচা মাছ খায় না।
— তাহলে পশ্চিম দিক থেকে ওটা আসছে কেন?
এ’কথা শুনে শুয়ে থাকা থেকে সে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল। পশ্চিম দিকে তাকিয়ে বলল, দেখতে তো কুকুরের মতোই । ধান গাছের উপর দিয়ে হেঁটে আসছে। চাঁদুর কথা শুনে আমিও উঠে বসলাম। পশ্চিম দিকে মুখ করে বসে তাকিয়ে দেখি সত্যিই ধান গাছের উপর দিয়ে চার পা ফেলে কালো কুকুরটা আমাদের দিকেই আসছে। চাঁদু হাতের লাঠি উঁচিয়ে বলল, এই কুত্তা, এদিকে আসবি তো মাজা ভেঙে দেবো। চাঁদু একথা বলার পরও একই ভাবে জলের উপর দিয়ে ছোপ ছোপ শব্দ করে কুকুরটা হেঁটে আসছে আমাদের দিকে।
আমি বললাম, এটা কোন বাড়ির কুত্তা রে, এত রাতে পশ্চিমে গেছিলো কি করতে? চাঁদুও আমার কথায় সায় দিয়ে বলল, হ্যাঁ দাদাবাবু , আমিও তো তাই ভাবছি। এক বুক জল ভেঙে পশ্চিমে কার বাড়ি গেছিল?

চাঁদুর মুখে একবুক জলের কথা শোনার সাথে সাথে আমার সম্বিৎ ফিরে এলো। কুকুর তো কখনও এক বুক জলের উপর দিয়ে হেঁটে আসতে পারে না? এক হাঁটু জলেই যেখানে কুকুরের সাঁতার দিতে হয় সেখানে একবুক জল তো অনেক। নিশ্চয় এটা কুকুর নয় অন্য কিছু। এ কথা মনে হতেই ভয়ে শরীরের ভিতরটা ঝাঁকি দিয়ে উঠল। সাথে সাথে লাঠি নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। চাঁদুকে উদ্দেশ্য করে বললাম, চাঁদু তাড়াতাড়ি লাঠি নিয়া দাঁড়া । এ শালা তো কুত্তা না। এক বুক জলের উপর দিয়া কুকুর কখনও হেঁটে আসে?
আমার কথা শুনে সে সায় দিয়ে বলল, হ্যাঁ দাদাবাবু, ঠিকই তো! এক হাঁটু জলে যেখানে কুকুরের সাঁতার কাটতে হয় সেখানে এক বুক জলের উপর দিয়া কুকুর হেঁটে আসবে কেমনে করে? বলেই সে লুঙ্গি মালকোছা দিতে দিতে বলল, দাদাবাবু লুঙ্গি কাছা দিয়া রেডি হন। এইডা কুত্তা না, অন্য কিছু! বলেই সে বলে উঠল, এই কুত্তা, আর এক পা সামনে আসবি তো ঠ্যাং ভেঙে দেবো।
কিন্তু কুকুর সেই আগের মত একই গতিতে এগিয়ে আসছে। চাঁদের আলোতে কালো লম্বা চারটি ঠ্যাং দেখে ঠিক কুকুরের মতই মনে হচ্ছে। আমিও চাঁদুর দেখাদেখি জোরে জোরে ধমক দিয়ে বললাম, এই কুত্তা, আর এক পা সামনে আসবি তো লাঠি দিয়া মাথা ছেঁচে দেব।
আমরা যত ধমকই দেই না কেন, কোন কিছুতেই কুকুর থামছে না। কুকুর একই গতিতে আমদের দিকে হেঁটে আসছে। মুখে জোরে জোরে যাই বলি না কেন এদিকে ভয়ে আমাদের হাত পা থর থর করে কাঁপছে। ওদিকে কুকুর প্রায় একশ’ গজের মধ্যে চলে এসেছে। আমাদের থেকে পঞ্চাশ গজ দুরে সেই ভুতুরে ঝাঁকড়া কুল গাছ। যে গাছের নিচে আট দশ বছর আগে মিনতি সান্যাল নামের সদ্য বিবাহিতা মহিলা রাতে দুইবার চিৎকার করে,পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল। ওই ঘটনার পরে আরও অনেকেই ভয় পেয়েছে। আমরাও মাঝে মাঝে গভীর রাতে এই কুল গাছের নীচেই আলোর নাচানাচি দেখেছি। কুকুরটি ঠিক ঐ কুল গাছের দিকেই আসছে। ভয়ে শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। মনে মনে ভাবছি আরেকটু সামনে আসলেই চাঁটাই বালিশ ফেলেই বাড়ির দিকে দৌড় দেব। চাঁদু একটু দূরে ছিল, ভয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়াল। দু’জনে মিলেই খুব ধমক ধামক দিচ্ছি কিন্তু কোন কিছুতেই সে বাঁধা মানছে না।
এই দৃশ্য দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। শরীরের লোম খাড়া হয়ে উঠল। কুকুর প্রায় কুল গাছের কাছাকাছি এসে গেছে। চাঁদু আমকে উদ্দেশ্য করে বলল, দাদাবাবু আর থাকা ঠিক হবে না। এবার বাড়ির দিকে দৌড় দেন।
দৌড় দিতে যাবো এমন সময় আমাদের পাশের বাড়ি থেকে বাবার বন্ধু ওঝা সীধু জ্যাঠার গলা শোনা গেল। তিনি বললেন , এই চাঁদু কি হয়েছে রে?
চাঁদু জবাব দিল, জ্যাঠা একটা কুকুর জলের উপর দিয়ে আমাদের দিকে আসছে। ধমক দিলেও থামে না।
এ কথা শুনে তিনি বলল, ঐখানেই থাক, আমি আসছি।
তিনি কিছুটা এগিয়ে এসে বললেন, এই চাঁদু, কুকুর এখনও আসছে রে?
চাঁদু বলল, হ্যাঁ এখনও আসছে, থামেনি।
চাঁদুর কথা শুনে তিনি কুকুরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কিরে পোলাপানে মাছ ধরতে এসেছে তোর সহ্য হল না? ভয় দেখাতে এসেছিস। যেখান থেকে এসেছিস সেখানে ফিরে যা, নইলে কিন্তু লাঠির ঘা খেয়ে মরবি। মনে করেছিস আমি ঘুমিয়ে পড়েছি তাই না?
বলেই জোরে জোরে তিনবার গলা খাকারী দিতেই কুকুর থেমে গেল।
কুকুর থেমে যাওয়ায় জলের উপর দিয়ে হেঁটে আসার ছোপ ছোপ শব্দও বন্ধ হয়ে গেল। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, কিরে কুকুর কি এখনও আসছে না থামছে?
চাঁদু বলল, কুত্তা থামছে।
তিনি বললেন, খালি থামলে তো হবে না। যেখান থেকে এসেছে সেখানে চলে যেতে বল বলেই তিনি কুকুরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কিরে ফিরে যাবি, না আমার হাতের মার খাবি? একথা বলেই তিনি আবার জোরে গলা খাঁকারি দিলেন তিনবার। তার গলা খাঁকারী শুনে কুকুর তার দিকে ফিরে কিছুক্ষণ কটমট করে তাকিয়ে থাকল। এরপর আস্তে আস্তে যে দিক থেকে এসেছিল সেদিকেই ফিরে গেল।

সীধু জ্যাঠা ইতিমধ্যেই আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছেন। কুকুর পিছন ফিরে কিছুদুর যাওয়ার পরেই আর কোন সাড়া শব্দ নেই। ভাল করে তাকিয়ে দেখি কুকুরের কোন চিহ্নই নেই আর কোথায়ও ।
তিনি আবার কুকুরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কই মিশে গেলিরে আবার? এই এলাকায় যেন আর না দেখি ।
সোজা গোঁসাইয়ের ভিটায় চলে যা।
সম্পূর্ণ পোড়ো ভিটা। আগাছা এবং নানা ধরণের গাছগাছালিতে ভরা। রাতের আঁধারে মাঝে মাঝে ভুতের আলো জ্বলে উঠে। আলো জ্বলে এক জায়গায় থাকে না, মাঝে মাঝে সোজা গাছের উপরে উঠে যায় আবার সরাৎ করে নিচে নেমে আসে। যে কারণে এই ভিটাকে সবাই ভুতুরে ভিটা বলে জানে।
সন্ধ্যার পরে কেউ ঐ ভিটায় মরে গেলেও একা যায় না।
কুকুরকে ধমক দিয়ে তিনি বললেন, যা ওখানে গিয়ে থাক। কেউ ওদিকে যায় না। তারপর আমাদের বললেন, যা বাড়ি চলে যা। বাকী রাত আর থাকার দরকার নাই। ওই হারামজাদা আবারও আসতে পারে।
চাঁদু মাছসহ চাঁইটি জল থেকে উঠিয়ে আনল। চাঁই জলের উপরে উঠাতেই অনেক মাছ একসাথে ফরফর শব্দ করে লাফাতে লাগল। আমি বালিশ দু’টি দু’হাতের বগলতলায় নিয়ে নিলাম। চাটাই নিলাম হাতে। বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *