Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

হারাধনের অন্তর্ধান

যে সময়ের কথা বলছি, তখন খবরের কাগজের অফিস থেকে আমি কোনও গাড়ি পাইনি এবং কর্নেল তার লাল রঙের পুরনো ল্যান্ডরোভার গাড়িটিও বেচে দিয়েছেন। তাই কোথাও যেতে হলে ট্রাম বাস ট্যাক্সি দুজনেরই সম্বল। তবে আগেই বলেছি কর্নেলকে কোনও রহস্যময় কারণে কোনও ট্যাক্সি না বলে না।

ব্র্যাবোর্ন রোডে যেতে যেতে একখানে ট্যাক্সি থামিয়ে কর্নেল নামলেন। তখন বিকেল পৌনে পাঁচটা বাজে। শীতের শেষ বেলায় এখনই রাস্তার ধারে আলো জ্বলে উঠেছে। দোকানপাটেও আলো জ্বলেছে। কর্নেল মুখ তুলে সাইনবোর্ডে দেখে নিয়ে বললেন, পেয়ে গেছি। এস।

আগেই জিজ্ঞেস করেছি, আমরা কোথায় যাচ্ছি। কিন্তু কর্নেল শুধু বলেছেন, এস তো! এতক্ষণে একটা সাততলা বাড়ির সিঁড়িতে উঠে বিশাল দরজার পর লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে কর্নেল বললেন, তরুণ মুখার্জির কোম্পানির অফিসে যাচ্ছি।

পাঁচতলায় করুণাময়ী ট্রেডিং কোম্পানির অফিস। বেসরকারি বাণিজ্য সংস্থায় কর্মচারীদের দেখেছি ঘাড় গোঁজ করে কাজ করতে হয়। বাঁধা কাজের সময় বলে কিছু থাকে না। তখনও পুরোদমে কাজ চলেছে। কর্নেল একজন বেয়ারাকে তার নেমকার্ড দিলেন। একটু পরে তরুণবাবুর ঘরে আমাদের ডাক পড়ল।

বৈমাত্রেয় দাদার একেবারে উল্টো স্বভাবের মানুষ তরুণ মুখার্জি। বছর তিরিশ-বত্রিশ বয়স। ফিটফাট ধোপদুরস্ত পোশাক এবং স্মার্ট চেহারা। পরনে স্যুট-টাই। মুখে পাইপ। ইংরেজিতে সম্ভাষণ এবং করমর্দন করে আমাদের বসতে বললেন। দেখলাম কর্নেল তার পরিচিত।

তরুণবাবু সহাস্যে বললেন, আবার কোথাও ডেডবডি দেখেছেন নাকি কর্নেল সরকার?

কর্নেল একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, না। আমি একটা কথা জানতে এসেছি।

আর কী কথা?

আপনাদের বংশের বিগ্রহ রাধাকৃষ্ণ সম্পর্কে।

আমাকে তো দাদা তাঁর বংশের লোক বলে স্বীকারই করেন না। তরুণবাবুর মুখে হঠাৎ বিকৃতি ফুটে উঠল। আপনাকে বলেছিলাম, ছাত্রাবস্থায় আমাকে এবং মাকে ওই ভদ্রলোক আমার পৈতৃক বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অনেক লড়াই করে আমি এই অবস্থায় পৌঁছেছি। আপনাকে এ-ও বলেছিলাম, প্রকাশ্য আদালতে উনি আমার মাকে আমার বাবার বিবাহিতা স্ত্রী বলে মানতে চাননি।

প্লিজ মিঃ মুখার্জি! আমি আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন তুলতে আসিনি। আমি ওই বিগ্রহ সম্পর্কে আপনার কাছে কিছু তথ্য জানতে এসেছি। কারণ এ ব্যাপারে আপনি আমাকে কিছু জানাননি।

আপনি জিজ্ঞেস করেননি, তাই বলিনি।

এখন জিজ্ঞেস করছি।

তরুণবাবু গুম হয়ে বললেন, কফি খাবেন, না চা?

কিছু না। আপনি বিগ্রহ সম্পর্কে বলুন।

হরি গাঙ্গুলি নামে দাদার একজন ক্লার্ক ছিল। সে—

তরুণবাবু থেমে গেলেন। কর্নেল বললেন, বলুন।

সে–গোপন করতে চাই না, আমাকে দাদার লিগ্যাল লড়াইয়ের প্ল্যান সম্পর্কে আগাম খবর পাচার করত। তাকে টাকা দিতাম। তার এক আত্মীয়কে আমার ফার্মে চাকরিও দিয়েছিলাম।

শ্যামসুন্দর নাম ছিল তার?

আপনি জানেন দেখছি!

জেনেছি। আপনি বলুন।

অনেক বছর আগের কথা। হঠাৎ একদিন কাগজে পড়লাম ভবানীপুরে আমাদের পৈতৃক বাড়ি থেকে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ চুরি গেছে। মা তখন বেঁচে নেই। আমি বিচলিত হয়ে উঠেছিলাম। ওই বিগ্রহ নাকি স্বয়ং শ্রীচৈতন্যের আশীর্বাদ–

শুনেছি। আপনার দাদার সঙ্গে আমি দেখা করেই আপনার কাছে এসেছি।

তো কদিন পরে হরি এসে একটা সাংঘাতিক কথা বলল। দাদা নাকি নিজেই বিগ্রহ চুরি করে আমাকে ফাঁসানোর জন্য তার হাত দিয়ে আমার বাড়িতে পাচার করতে চেয়েছিলেন। সেই বিগ্রহ হরির ঘর থেকে চুরি গেছে। হরির বাসাতেই শ্যামসুন্দর থাকত। সে নাকি পালিয়েছে বিগ্রহ নিয়ে।

শ্যামবাবু হরিবাবুর বাসায় থাকতেন?

হ্যাঁ। শ্যাম সেখানে থেকেই আমার অফিসে কাজ করতে আসত। তবে এর সত্যমিথ্যা জানি না।

হরিবাবু আমাকে অন্য কথা বলেছেন। শ্যামবাবু নাকি বাউণ্ডুলে ছিলেন এবং মাঝে মাঝে ওঁর বাসায় হাজির হতেন!

তরুণবাবু রুষ্টমুখে বললেন, হরি বড্ড পাচালো স্বভাবের লোক। হবে না কেন? হাড়ে-হাড়ে প্যাঁচালো বুদ্ধির এক আইনকারবারির সঙ্গদোষে সেও ওইরকম হয়ে পড়েছিল।

তারপর কী হল বলুন?

ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম। শ্যাম তারপর থেকে উধাও। আমার অফিসে আসছে না দেখে বুঝলাম হরি ঠিক বলেছে। তারপর এতগুলো বছর চলে গেল। আর শ্যামের পাত্তা নেই।

হরিবাবু আপনার কাছে আসেন?

নাহ্। তার সম্পর্কে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। এলেও তার সঙ্গে দেখা করব না। বাই-দাবাই, এখন কোথায় আছে সে? কী করে?

পাইকপাড়ায় সেই বাসায় আছেন। আলিপুর কোর্ট চত্বরে স্বাধীনভাবে টাইপিংয়ের কাজ করেন।

তরুণবাবু আস্তে বললেন, কিন্তু আপনি আমাদের ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড কেন?

আপনাকে বলেছিলাম বরমডিহিতে আপনাদের বাড়িতে—

হ্যাঁ। কিন্তু বাড়িটার ভুতুড়ে বলে বদনাম আছে। আমি যে মামলা লড়ছি, তা নিছক ওই পোডড়া বাড়ির জন্য নয়। আমার মায়ের সম্মান রক্ষার জন্য। এটা আপনার বোঝা উচিত

বুঝি মিঃ মুখার্জি! আসলে আমি আগে ওই ভৌতিক রহস্য সম্পর্কে আগ্রহী ছিলাম। এবার আমি বিগ্রহ চুরি এবং শ্যামবাবুর অন্তর্ধান সম্পর্কে আগ্রহী। আমার ধারণা, এই ঘটনাগুলোর মধ্যে যোগসূত্র আছে।

তরুণবাবু ঘড়ি দেখে বললেন, ওয়েল, কর্নেল সরকার। আমার সহযোগিতা পাবেন। বিগ্রহ উদ্ধার করলে আমি আপনাকে—

হাত তুলে কর্নেল বললেন, পুরস্কৃত করবেন তো? না মিঃ মুখার্জি! আমার এই এক স্বভাব। রহস্য ফাঁস করা আমার হবি। যাই হোক, শ্যামবাবু আপনার কর্মচারী ছিলেন। তার কোনও ছবি আপনার অফিসে কি আছে?

থাকা সম্ভব। জাস্ট আ মিনিট। বলে উনি টেবিলের সুইচ টিপে বেয়ারাকে ডাকলেন। সে এসে সেলাম দিলে, বললেন, অবনীবাবুকে ডাকো।

একটু পরে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক চেম্বারে ঢুকে আড়ষ্টভাবে দাঁড়ালেন। তরুণবাবু বললেন, আচ্ছা অবনীবাবু! সেই শ্যামসুন্দর–আই মিন, যে ক্লার্ক নিপাত্তা হয়ে গিয়েছিল–

অবনীবাবু বললেন, শ্যামসুন্দর ভট্টাচার্যের কথা বলছে কি স্যার? হ্যাঁ। তার কোনও ছবি অফিসে আছে? থাকা তো উচিত। পার্সোনেল ডিপার্টমেন্টের ফাঁইলে খুঁজলে নিশ্চয় পাবেন। তবে সাত-আট বছর আগের ফাইল ঘাঁটতে হবে। সময় লাগবে। তাই না?

স্যার! একটা গ্রুপ ফোটোতে শ্যামবাবুর ছবি আছে মনে হচ্ছে।

দেখুন তো! এখনই চাই কিন্তু। আমি বেরুব।

অনীবাবু বেরিয়ে গেলেন। তারপর দু-মিনিটের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড বাঁধানো গ্রুপ ফোটো ঝাড়তে ঝাড়তে ঘরে ঢুকলেন। বললেন, পেছনের সারিতে দাঁড়ানো বাঁ-দিকের থার্ড ম্যান স্যার!

ওঁকে দেখান। বলে তরুণবাবু কর্নেলের দিকে আঙুল তুললেন। কর্নেল ছবিটা দেখার পর বললেন, একটা অনুরোধ মিঃ মুখার্জি! এটা আমার এক রাত্রির জন্য দরকার। আপনি আগামীকালই অফিস খোলার সময় ফেরত পাবেন। কথা দিচ্ছি।

কী করবেন ওটা নিয়ে?

আমার ক্যামেরা এবং নিজস্ব ডার্করুম আছে। শ্যামবাবুর ছবিটা থেকে একটা পোট্রেট করে নেব।

কেন বলুন তো?

আপনার পূর্বপুরুষের ঐতিহাসিক বিগ্রহ উদ্ধারের জন্যই শ্যামবাবুর ছবি আমার দরকার।

একটু ইতস্তত করে তরুণবাবু বললেন, ঠিক আছে। নিয়ে যান। অবনীবাবু, ছবিটা ওঁকে কাগজে ভালভাবে প্যাক করে দিন।

কিছুক্ষণ পরে ছবিটা বগলদাবা করে কর্নেল বেরুলেন। রাস্তায় তখন যানবাহনের জ্যাম। আলো আরও ঝলমলে হয়েছে। এবার আমরা বাসে না এসপ্ল্যানেড এবং সেখান থেকে ভিড়েঠাসা ট্রামে চেপে ইলিয়ট রোডে পৌ৮ সারা পথ আমার কিন্তু গা ছমছম করছিল। কেউ যেন হঠাৎ ছবিটা কেড়ে পালাবে মনে হচ্ছিল। কেন কেড়ে নিয়ে পালাবে, তা অবশ্য বুঝতে পার না। তবে আশঙ্কায় বুক দুরদুরু কাঁপছিল। প্রত্যেকটি যাত্রীর গা ঘেঁষে দাঁড় সন্দেহজনক মনে হচ্ছিল।

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে ভয়টা কেটে গেল। কর্নেল ষষ্ঠীকে কs, করতে বলে ওঁর স্টুডিওতে ঢুকলেন। ওখানে ওঁর আরেক হবির নিদর্শন। মা জায়গায় তোলা পাখি প্রজাপতি অর্কিড ক্যাকটাসের ছবি নিজেই ডেভালান্স এবং প্রিন্ট করেন। এমন কি, ওঁর একটা পোর্টে স্টুডিও আছে বলা চলে। কতবার ডেভালাপ প্রিন্টের সরঞ্জাম বয়ে নিয়ে নানা জায়গায় পাড়ি জমান। তখন কোনও বাংলোর বাথরুম ওঁর ডার্করুমে পরিণত হয়।

প্রায় আধঘণ্টা পরে কর্নেল বেরিয়ে এসে ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন। বললেন, খব। পাকা ফোটোগ্রাফারের তোলা ছবি। নেগেটিভটা ভালই আসবে আশা করছি। পাসপোর্ট ফোটোর সাইজে ফিগারটা এনেছি।

বললাম, আমি ক্লান্ত। এবার বাড়ি ফিরতে চাই।

ঠিক আছে। কাল সকালে কিন্তু এসো। একটা রহস্য সম্ভবত ফাঁস হবে।

কোন রহস্য?

কর্নেল হাসলেন। সকালে এলে টের পাবে।…

.

পরদিন সকালে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে হাজির হয়ে দেখি, উনি কয়েকটা পাসপোর্ট সাইজের ফোটো টেবিলে সাজিয়ে রেখেছেন এবং একটা ছবিতে তুলি বুলোচ্ছেন।

আমাকে দেখে বললেন, অসাধারণ এসেছে।

টেবিলের একটা ফোটো তুলে নিয়ে বললাম, এই শ্যামবাবু? চেহারা কিন্তু অমায়িক প্রকৃতির এক যুবকের।

প্রায় ৮ বছর আগের ছবি। তবে চেহারায় মানুষের চরিত্রের ছাপ ফোটে কি

তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সাদারণত ছ্যাচড়া প্রকৃতির অপরাধী নিজের চেহারায় ইচ্ছে করেই দুৰ্বত্তের ছাপ ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু তথাকথিত ভদ্রলোক অপরাধীরা চেহারায় ভেতরকার আসল রূপ ফুটতে দেয় না এবং এ বিষয়ে তারা খুব সচেতন।

পাশের আর একটা ছবি দেখে বললাম, এটা আবার কার? যেন চেনা-চেনা মনে হচ্ছে।

তরুণবাবুর অফিসের এক বেয়ারার।

কিন্তু একে যেন কোথায় দেখেছি। কাল ওই অফিসেই কি?

তা দেখে থাকতে পারো তুমি। আমি লক্ষ্য করিনি।

এর ছবি তুললেন কেন?

কাল তরুণবাবুর অফিসে আমি একে লক্ষ্য না করলেও গ্রুপ ফোটো দেখে আমার চেনা মনে হচ্ছিল। তাই এর ছবিটাও তুলেছি।

ছবিটা তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে বললাম, আশ্চর্য! একে কোথাও দেখেছি। নাহ্। কাল ওই অফিসে নয়। অন্য কোথাও।

কর্নেল আস্তে বললেন, তা হলে আমি নিঃসন্দেহ হলাম।

কী ব্যাপারে?

তুমি এবং আমি দুজনেরই যখন চেনা লাগছে, তখন এ সেই লোকটাই বটে। তবে ভূত নয়, জলজ্যান্ত মানুষ।

কর্নেল! বরমডিহির পোড়ো বাড়িতে লণ্ঠন হাতে যে লোকটা নিজেকে ভোলা বলেছিল–

কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন, হ্যাঁ। এ সেই-ই বটে। মানুষের চেহারা চল্লিশের পর পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত খুব একটা বদলায় না। তবে নাহ্, উত্তেজিত হয়ো না। মুখ বুজে থাকো। লোকটা এখনও তরুণবাবুর অফিসে কাজ করছে। কি না জানা দরকার।

আপনি শ্যামবাবুর ছবিটা রিটাচ করছেন কেন?

বয়স বাড়াচ্ছি। কারণ শ্যামবাবু এই ছবিতে বড়জোর পঁচিশ বছর বয়সী যুবক। আট বছর পরে তার চেহারাটা কেমন দাঁড়াতে পারে, এক্সপেরিমেন্ট করছি ৪টে ছবিতে।

এই সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল ছবি এবং তুলি রেখে নিজেই ফোন ধরলেন…হ্যাঁ। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।…না, না মিঃ মুখার্জি! আমি রাগ করিনি। আপনার অনুতপ্ত হওয়ার কারণ নেই।…ঠিক আছে। অবশ্যই যাব।…না, না। কথা দিচ্ছি।…এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে পৌঁছে যাব।…নাহ্! গাড়ি পাঠাতে হবে না। ধন্যবাদ! রাখছি।

বললাম, অ্যাডভোকেট ভদ্রলোক মনে হল?

কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ!

কর্নেল! সাবধান কিন্তু!

কেন?

আপনি ওঁর বাড়িতে বসে ওঁকে চোর বলেছেন। তার প্রতিশোধ নিতে হয় তো এ একটা ফাঁদ।

কর্নেল স্বভাবসিদ্ধ অট্টহাসি হেসে বললেন ঘুঘুধরা ফাঁদ বলতে চাও! হরিবাবুকে লেখা চিঠিতেও ঘুঘু এবং ফাঁদের কথা ছিল! এই কথাটাও ছিল, এ বড় সেয়ানা ঘুঘু।

হাসতে হাসতে বললাম ভাষাটা কিন্তু কোর্ট চত্বরের সেই ছোকরান।

ছোকরা বোলো না ডার্লিং! ওর প্রতিভা আছে। আমি ওই প্রতি ছেলেটির সঙ্গে আবার দেখা করে তাকে পুরস্কৃত করব ভেবে রেখেছি।

কর্নেল ফোটোশুলো গুছিয়ে টেবিলের ড্রয়ারে ঢোকালেন। তারপর পোয় বদলে এলেন। ওঁর হাতে এবার তরুণবাবুর অফিস থেকে আনা সেই প্রকাণ্ড গ্রুপফোটো। আগের মতো প্যাকেট করা। বললেন, চলো! এই ছবিটা কথামতো ফেরত দিতে হবে। তারপর যাব শচীনবাবুর বাড়ি।…

ব্র্যাবোর্ন রোডের সেই বাড়িতে যখন পৌঁছুলাম, তখন প্রায় সওয়া দশটা বাজে। কর্নেল আমাকে নিচে দাঁড় করিয়ে রেখে লিফটের সামনে লাইন দিলে, বাড়িটাতে অজস্র কোম্পানির অফিস। দেখলাম, অনেকে লিফটের লাইন দেখে পাশের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল, এ সময় যদি দৈবাৎ বরমডিহিতে দেখা সেই ভোলার দেখা পেয়ে যাই, কী করব? জাপটে ধরে হইচই বাধানো কি ঠিক হবে? তবে এ কথা ঠিক, তাকে এখন মুখোমুখি পেলে সোজাসুজি চার্জ করব। তাতে ভিড় জমে তো জমুক। ব্যাটাচ্ছেলে আমাদের বোকা বানিয়ে ছেড়েছিল!

একটু পরে অবশ্য উত্তেজনাটা চলে গেল। কর্নেল নিজস্ব লাইন ধরে এগোচ্ছেন। কাজেই আমার চুপচাপ থাকাই উচিত।

কর্নেল ফিরলেন প্রায় আধঘণ্টা পরে। তাঁকে দেখামাত্র আবার উত্তেজনাটা ফিরে এসেছিল। ফুটপাতে নেমে জিজ্ঞেস করলাম, সেই দুনম্বর ভোলাকে দেখলেন তরুণবাবুর অফিসে?

নাহ্। হারাধন কাল বিকেলে নাকি বউয়ের সাংঘাতিক অসুখের খবর পেয়ে বর্ধমানের গ্রামে গেছে। বর্ধমান থেকে ট্রাঙ্ককল এসেছিল। অবনীবাবু বললেন।

লোকটার নাম তাহলে হারাধন?

হ্যাঁ। হারাধন বাগ। কর্নেল হাসলেন। বাঘ বলা চলে। চেহারা দেখে আমার ওইরকম ধারণা হয়েছিল।

আমারও।

তবে হাবভাব বেশ অমায়িক ছিল। ঠিক পুরাতন ভৃত্যমার্কা।

কর্নেল! আমার ধারণা, কাল বিকেলে ওই অফিসে আপনাকে ঢুকতে দেখেই ব্যাটাচ্ছেলে কিছু আঁচ করেছিল। তাই গা-ঢাকা দিয়েছে। আপনার মার্কামারা চেহারা তার মনে থাকারই কথা।

কর্নেল হাসলেন। অবনীবাবুর সঙ্গে কৌশলে কথা বলে জেনেছি, আমি যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে ভোলার কাছে টেলিফোন এসেছিল। তবে সত্যি ট্রাঙ্ককল। কি না বলা কঠিন। মোট কথা, টেলিফোন এসেছিল।

তরুণবাবুর সঙ্গে দেখা হল?

নাহ্। উনি আসেন বারোটায়।

হাঁটতে হাঁটতে বললাম, হঠাৎ লোকটা ঠিক এই সময়ই দেশের বাড়িতে গেল? মুখোমুখি তাকে পেলে আপনার সুবিধে হত!

কর্নেল বললেন, কিছু হত না। অস্বীকার করত। বলে, ট্যাক্সি! ট্যাক্সি! চিৎকার করে উনি প্রায় ঝাঁপিয়ে রাস্তায় গেলেন। একটুর জন্য একটা প্রাইভেট কারের ধাক্কা থেকে বেঁচে গেলেন।

কিন্তু কথাটা বললেই তো বর্মার জঙ্গলে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিংয়ের পুরনো কথা তুলবেন। এরকম কত চুলচেরা হিসেবি ঝাঁপ দিয়ে নাকি জাপানি গুলি থেকে বেঁচেছিলেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress