ভালোবাসার রঙ-আলো
আজ নাচের ক্লাসটা বন্ধ করবে না যাবে, সকালে উঠেই সেটা ভেবে চলেছে তৃপ্তি । কিন্তু কিছুই ঠিক করতে পারছেনা।
এই দোলের দিনটাতে তার মন বির্বণ হয়ে যায়।ঠিক তিন বছর আগে এই দিনেই নাচের ক্লাসেই তার সাথে সৈকতের ব্রেকআপ হয়ে যায়।তেমন কিছুই কারণ ছিলো না ।হঠাৎই দু এক কথা বাড়তে বাড়তে কি ভাবে যে ভাঙনের পথে পা বাড়ায় ওরা দুজনে, নিজেরাও বোঝেনি।তারপর থেকে ওরা দুজনেই কেউ কারোর সাথে আর কথা বলেনি। যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি ওদের মাঝে তিক্ত দেওয়াল তুলে দিয়েছিল।তাই এই দিনটা আসলেই তৃপ্তির মনের ভিতর কালো মেঘ করে আসে।
সৈকত তৃপ্তির থেকে দুই বছরের বড়,প্রথম দিন নাচ শিখতে গিয়ে সৈকতের চোখ পড়ে আকাশি চুড়িদার পরা মেয়েটার দিকে। চুল গুলো খোলা থাকায় বারবার চোখে মুখে উড়ে এসে পড়ছিল আর মেয়েটা খুব যত্নে গুঁজে নিচ্ছিল কানের পাশে। সৈকত মুগ্ধ হয়ে দেখছিল একদৃষ্টে।
এক দিকে ছেলেরা বসে অন্যদিকে মেয়েরা।প্রথমে কিছু যোগাসন করানো হয় তারপর নাচ শুরু হয়।নাচের ম্যাম অর্পিতা রায় বলে উঠলেন –
‘তৃপ্তি তোমার প্রতিটা স্টেপ দারুণ ক্লিয়ার হয়েছে’।
তৃপ্তি হেসে বলল –
‘থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম’।
ব্যস নামটা জেনে গেল গল্পের হিরো।কয়েক দিনের মধ্যেই একটা টিম তৈরী হল পাঁচ জনের।মিলি-রিয়া-তৃপ্তি-বর্ণ আর সৈকত।নাচের ক্লাসে সব সময় এই পাঁচ মূর্তিকে এক সাথে দেখা যেত।মিলি আর তৃপ্তি একই কলেজে পড়ত।সৈকত এম .এ ফার্স্ট ইয়ারে পড়ত তার সাথে একটা পার্ট টাইম জবও করত।
কিছু দিন পরেই দোল এলো,আজ তৃপ্তি সাদা রঙের শাড়ি আর লাল রঙের ব্লাউজ পরে এসেছে। সৈকত সেদিন আসতে একটু দেরি করেছিল। ঘরে ঢুকেই তৃপ্তিকে নাচতে দেখে সে কিছুতেই তার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না।একশো পাহাড়ি ঝর্ণা যেন তার হৃৎপিণ্ডে তাথৈ তাথৈ করছিল। যদিও সে কিছুই ঠিক করে আসেনি , তার মনের কথা বলবে বলে। তবু যেন মনে হল আজ এই এক আকাশ জুঁই ফুল কে(তৃপ্তিকে) চিৎকার করে বলতে-
‘ভালোবাসি’।
ক্লাস শেষে সে তৃপ্তিকে ডেকে বলল –
‘শোন একটা কথা বলব’?
তৃপ্তি বলল –
‘কি রে বল তাড়াতাড়ি,আমার সাতটা(সন্ধ্যে)থেকে জীবন স্যারের কাছে পড়া আছে’।
সৈকত বলল –
‘এটাও আমার জীবন মরণের কথা’।
তৃপ্তি এবার অবাক হয়ে সৈকতের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো।তখনো কিছুই বুঝতে পারেনি তৃপ্তি। সৈকত তার হাতে তৃপ্তির হাতটা টেনে নিয়ে বলল –
‘তোকে প্রথম যেদিন দেখেছি, সেদিনই নিজেকে শুধু তোর বলে মনে হয়েছে ।কিন্তু আমি বলিনি ।রঙটাকে আরো পুষ্ট হতে দিয়েছি । কিন্ত সরি রে ,আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না, ভীষণ রকম ডুবে গেছি তোর মধ্যে।খুব ভালোবেসে ফেলেছি তোকে’।
তৃপ্তি যেন আকাশ থেকে পড়ল,ওর যেন কিছুই মাথায় ঢুকছে না,গুলিয়ে যাচ্ছে সব। তৃপ্তি হাতটা শুধু ছাড়িয়ে নিয়ে বলল- ‘আজ একটু তাড়া আছে নেক্সট ডে-তে কথা বলছি তোর সাথে’।
তৃপ্তি চলে গেল। যতগুলো আলোর পাপড়ি দিয়ে ফুল বুনেছিল সৈকত, মুহূর্তেই যেন নিভে গেল সব ।এত দিন অপেক্ষা করেছে হাসি মুখে কিন্তু আজ যেন এই অল্প অপেক্ষাটাও আকাশ সমান মনে হল।
তৃপ্তি একটা বড় ক্যাডবেরি সেলিব্রেশন প্যাক কিনে বাড়ি ঢুকল।তার প্রিয় বার্বি ডল অ্যাঞ্জেলাকে দিয়ে বলল-
‘রাতে তোর সাথে অনেক কথা আছে,এখন বাই। তৃপ্তির মা তৃপ্তিকে কিছু খেয়ে নিতে বললে সে বলে –
আজ এমনিতেই খুব দেরী হয়ে গেছে আর কিছু সে খাবেনা ,একদম রাতে ফিরে খাবে।পড়তে গিয়েও আজ ওর মনটা একটু অন্যমনস্ক ছিল এটাই স্বাভাবিক।
রাতে বাড়ি ফিরে খাবার খেয়ে মা ঘুমাতে যাচ্ছি বলে ও নিজের ঘরে ঢুকে গেল।অন্যদিন খাবার পরে কিছুক্ষণ বসে ও বাবা মায়ের সাথে গল্প করে কিন্তু আজ আর করল না।
মেয়ে সারাদিন পর একটু রেস্ট নেবে জেনে তৃপ্তির মা-ও আজ কিছু বলল না।
এই শুক্রবারটাই ওর দুবেলা টিউশন কলেজ নাচের ক্লাস সব থাকে।দিনটা খুবই ব্যস্ততার মধ্যেই কাটে।
তৃপ্তি একা ওর ভাই-বোন-দাদা-দিদি কেউ নেই।
একটা বার্বিডল আছে যেটা ওর বাবা ওর প্রথম জন্মদিনে দিয়েছিল।দারুণ দেখতে পুতুলটা। হলুদ টপ আর কালো মিডি পরা গলায় সাদা মোটা পুঁতির মালা কোঁকড়ানো কালো লম্বাচুল,কানে ছোট্ট দুল।যখন তৃপ্তি বড় হয়, ওর নাম রাখে অ্যাঞ্জেলা।এই অ্যাঞ্জেলাই তার ভাই বোন গল্পের সঙ্গী সব।রোজ রাতে অ্যাঞ্জেলার সাথে সারাদিনের সব গল্প করে তবেই ও ঘুমোয়।
অ্যাঞ্জেলা বুঝতে পারলি কেন সেলিব্রেশন প্যাক পেলি?
আজ সেই বিশেষ দিন রে,তোকে বলেছিলাম না সৈকত যদি আমাকে ভালোবাসে তবে সেদিন তোকে মিষ্টি মুখ করাব,-আজ সে আমার এই হাত ধরে প্রোপজ করল- বলে তৃপ্তি
হাতটা বাড়িয়ে দিল অ্যাঞ্জেলার দিকে।হাসতে হাসতে আয়নায় নিজের মুখটা বারবার দেখতে লাগল।আসলে ও নিজে সেভাবে কিছু জানতোনা,মিলি মাঝে মাঝেই কলেজে বলতো তৃপ্তি জানিস সৈকত হয়তো তোকে ভালোবাসে।
‘তোর কেন এমন মনে হয়’?মিলি বলতো –
‘ও কেমন যেন ভাবুক চোখে তোর দিকে তাকিয়ে থাকে’।
‘ও কবি মানুষরা ভাবুক হয় সবাই জানে তাতে নতুন কি আছে’? আসলে সৈকত দারুণ আবৃত্তি করে আর লেখালেখিও করে।তৃপ্তি ও শুনেছে ওর আবৃত্তি। প্রথম দিকে যেদিন অর্পিতা ম্যাম আসতে দেরি করেছিলেন, জুনিয়র ছেলে মেয়েরা সবাই ছেঁকে ধরেছিল সৈকতকে-
‘সৈকতদা একটা আবৃত্তি করো’।
সৈকত আবৃত্তি করেছিল-
“তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার”
হ্যাঁ প্রাণের ঠাকুর প্রেমের ঠাকুরের কবিতা ‘অনন্ত প্রেম’।
তৃপ্তি, তৃপ্তি করে শুনেছিল।আর এমন ভালো লেগেছিল ওর যে, বন্ধ ঘরেও যেন সেই আবৃত্তি ও শুনতে পেত।কিন্ত তখন ভালোলাগাটা অন্যরকম ছিল আজ মনে হচ্ছে আবৃত্তিটা সৈকত ওর জন্যই করেছিল। এ ভালোলাগাটা সম্পূর্ণ আলাদা , এই স্বাদ সব মিষ্টিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। কিন্তু সত্যি এর আগে সেভাবে তৃপ্তি ভাবেনি যে এত ট্যালেন্টেড স্মার্ট হ্যান্ডসাম একটা ছেলে তৃপ্তিকে ভালোবাসবে।মিলির একই কথা শুনতে শুনতে সে একদিন অ্যাঞ্জেলাকে এসে বলেছিল- -‘অ্যাঞ্জেলা ব্যাপারটা সত্যি হলে মিষ্টিমুখ করাব তোকে’।
তাই এই উপহার।
অন্যদিকে সৈকতের মনে নানান প্রশ্নের ঢেউ ওঠা নামা করছে।তৃপ্তি কি রাগ করেছে? ও কি আর কথা বলবে না?
আমাদের বন্ধুত্বটাও কি নষ্ট হয়ে যাবে?এসব চিন্তা করতে করতে সে অস্থির হয়ে যাচ্ছিল।তৃপ্তির থেকে বড় হলেও সৈকত তাকে দাদা বলতে মানা করেছিল।বলেছিল –
‘তৃপ্তি তুই আমাকে সৈকত বলেই ডাকিস আমরা বন্ধু হলাম’।সৈকতের বাড়িতে ওর বাবা মা আর ভাই আছে।রাতে ওর কাছে ওর ভাই সাহিলও ঘুমায়। আজ সাহিল তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেছে তাই, না হলে দাদার এই চঞ্চল প্রাণ দেখে একশো প্রশ্ন করত।এমনিতে সৈকত আর তৃপ্তির ফোনে যোগাযোগ আছে। হোয়াটসআপ মেসেঞ্জার সবেতেই আড্ডা হয় কিন্তু এ ঘটনার পর দুজনেই ফোন বা মেসেজ কিছু করতেই যেন হোঁচট খাচ্ছে।
আবার শুক্রবারে নাচের ক্লাসে দুজনেই মুখোমুখি হয় কিন্তু সেদিন রোজগার মতো দুজনের ব্যবহার সহজ সরল ছিল না।দুজনেই যেন একে অপরের দিকে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছিল।ক্লাস শেষে সৈকত আগের থেকে কিছু বলতে পারল না কারণ সে তৃপ্তির উত্তরের অপেক্ষা করছিল।তৃপ্তি সৈকতের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল –
‘আমার মন খারাপ থাকলে কবিতা লিখবি তো আমার জন্য? ঘুম না আসলে আবৃত্তি শোনাবি’?
প্রথমটা থতমত খেয়ে গেছিল সৈকত পরে হাসতে হাসতে হাতটা ধরতে গিয়েও ঝট করে সরিয়ে নিয়েছিল কিন্তু তৃপ্তি খুব যত্নে হাতের মধ্যে হাতটা নিয়ে বলেছিল –
‘সত্যি রে তুই খুব ভালো, তোর সাথেই পৃথিবীর সব পথ ঘুরব।আমাদের প্রতিটা পায়ের চিহ্ন একেকটা ঘর হবে,ভালবাসার ঘর’।
সৈকত মাথায় টোকা দিয়ে বলেছিল –
‘কিরে আমার ছোঁয়া লাগল নাকি? কাব্য করেছিস যে বড়’।দুজনেই ঝিলমিল করে হেসে উঠেছিল।
ঠিক যেন আকাশে আজ এই দুটিই তারা।
এরপর থেকে ওদের জীবন পাল্টে গেছে। রাতে ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে আড্ডা চলত।দু চার লাইন লিখে প্রেম নিবেদন চলত।মাঝে মাঝে সিনেমা হলে যাওয়া রেষ্টুরেন্টে খাওয়া ঘুরতে যাওয়া সবই চলত। কোনো কোনো সময় মিলি রিয়া বর্ণকেও ওরা সঙ্গে নিত।মিলিরা ওদেরকে ‘লাভ বার্ড’ বলত।
সব ঠিকই চলছিল। হঠাৎ সেদিন, এদিক ওদিকের কথা নিয়ে একটা ছোট্ট ঝড় ওদের ভালো সম্পর্কে আঁচড় কেটে দিল।
কেউই আর আগে থেকে কোনো কথা বলেনি বা ভুল বোঝাবুঝি মেটাতে চায় নি।নিজেকে আরো সময় দিতে চেয়েছিল, নতুন ভাবে ভাবতে চেয়েছিল ভুল পথে পা বাড়িয়েছে নাকি।
ব্রেকআপের পর দুই শুক্রবার দুজনের দেখা হলেও তারপর আর দেখা হয়নি।বন্ধুদের মুখে শুনেছে সৈকত এখন কলকাতার কোনো একটা বড় কোম্পানিতে কাজ করে আর কোম্পানির ফ্ল্যাটেই থাকে।মাসে একবার বাড়ি আসে।এর মধ্যে কেউই নিজের চেষ্টায় যোগাযোগ করেনি ব্যথার আগুনে জ্বলেছে শুধু।ফোন নাম্বার দেখেছে সারাদিন ধরে ফোন করেনি। ডি পি দেখেছে ঘন ঘন কিন্তু একটা মেসেজও কেউ কাউকে করেনি।দুজনের মধ্যেই দুটো ভাবনা কাজ করছিল ,একবার ওরা ভাবছে ঠিক হয়েছে যা হয়েছে ,একবার ভাবছে কেন এরকম করলাম?
তাই এরপর থেকে এই দোলের দিনে তৃপ্তি আর নাচের ক্লাসে যেত না।দোলের দিন সবচেয়ে সুন্দর যে রঙ পেয়েছিল সেই দোলের দিনেই সব রঙ হারিয়ে শূন্যতা মেখেছিল।সকালে উঠেই তাই ফোনে সৈকতের ডি পি দেখতে দেখতে উদাস হয়ে ভাবছিল যাবে কি যাবে না নাচে?
হঠাৎ মিলির ফোন আসে।
‘কি রে এবারও নাচে যাবিনা তুই নিশ্চয়? এতদিনেও কিছু ভুলতে পারলি না’?
তৃপ্তি কোনো উত্তর দেয় না।তৃপ্তির মা ,চা হাতে তৃপ্তির ঘরে ঢোকে।
‘পরে কল করছি তোকে’ বলে ফোন কেটে দেয় তৃপ্তি।
‘মা-রে আজ কোথাও বেড়াতে যাস না যেন’।
‘কেন গো মা ,কি হয়েছে’?
‘আজ পাত্রপক্ষ আসছে তোকে দেখতে ।দোলের ছুটিতে ছেলে বাড়ি এসেছে এ সুযোগেই পাত্রী দেখবেন তারা’। এই বলেই বেরিয়ে যায় তৃপ্তির মা।
ঘরের দরজা আটকে তৃপ্তি অ্যাঞ্জেলাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে।বলে- ‘অ্যাঞ্জেলা সব শেষ হয়ে গেল রে’।
তৃপ্তি ওর বাবা মাকে সৈকতের ব্যাপারে কিছুই বলেনি লজ্জায় ভয়ে। সারাদিন তৃপ্তি একরকম অনাহারেই কাটাল। কি করবে বা বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।আজ ওর বাড়িতে থাকতেই ইচ্ছে করছে না।ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে কোনো দিকে।কিন্তু মায়ের কথার অবাধ্য ও কোনো দিনই নয়।মিলি তারপর থেকে অনেকবার ফোন করেছে কিন্তু তৃপ্তির সব কথাই মনে হচ্ছে ফুরিয়ে গেছে আজ।
তৃপ্তির মা এক ফাঁকে বলে গেছে দুপুরে বেশিক্ষণ ঘুমিয়ে থেকে যাস না মা ,একটু রেষ্ট নিয়ে নিজের মতো করে সেজে নিস একটু। আমার আজ অনেক কাজ।তৃপ্তির মুখ শুকিয়ে গেল পুরো,অন্য একটা ছেলের সামনে সেজে বসা মানেই যেন মৃত্যু।বাড়ির পাশের কয়েকজনকেও সেদিন দোল উপলক্ষ্যে নেমন্তন্ন করেছিল তৃপ্তির বাবা।বিকাল পাঁচটায় ছেলেপক্ষের আসবার কথা, এখন ঘড়িতে সাড়ে চারটে বাজে ,এতক্ষণ ধরে তৃপ্তি পুরোনো স্মৃতির ঘরেই তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছিল হারিয়ে যাওয়া রঙ। কেঁদে কেঁদে ওর চোখ ঠোঁট সব লাল হয়ে গেছে।আর যাইহোক ও কোনোদিনও সৈকতকে ভুলতে পারবেনা ।এক মুহূর্তের জন্যও অন্য কারোর কথা ভাবতে পারবে না।একে একে সব স্মৃতিগুলো যেন চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে যাচ্ছে।
মনে পড়ছে এক গোধূলি বেলায় সৈকত তৃপ্তির হাত ধরে বলেছিল- ‘জীবনের সব ঋতুগুলো তোকে পেয়ে সুন্দর কাটবে’।
দরজায় কড়া নাড়লো তৃপ্তির মা।
‘কি রে রেডি হলি তুই আয় নীচে আয়। সবাই চলে এসেছে’।
তৃপ্তির মাথায় যেন বাজ পড়ল।ও তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বলল –
‘আসছি পাঁচ মিনিট’।
আলমারি খুলে এত শাড়ির মধ্যে ওর হাত চলে গেল সেই সাদা শাড়িটাতেই। কোনোরকমে ও শাড়ি পরে তৈরি হল। তৃপ্তির মা এসে তৃপ্তিকে নীচে নিয়ে গেল। ছেলের মা বলল- ‘বসো মা’।
‘কি মিষ্টি দেখতে মন ভরে গেল’।
‘কোনোরকম সাজসজ্জা ছাড়াও কি অপূর্ব লাগছে’।
তৃপ্তির বাবা পাশেই দাঁড়িয়েছিল।
তৃপ্তি মুখ না তুলেই সবাইকে প্রণাম করল।সাধারণ কিছু কথাবার্তা নিজেদের মধ্যে হচ্ছিল।হঠাৎ ছেলের বাবা বলল – ‘মেঘ তুই আলাদা করে কথা বলতে চাইলে বল, আমাদের কোনো আপত্তি নেই’।
তৃপ্তির মা হাসতে হাসতে বলল –
‘সারাজীবন একসঙ্গে কাটাবে ওরা, ওদেরকে তো একটু নিজেদের মতো কথা বলতেই হবে’।তৃপ্তি মুখ নীচু করেই বসেই আছে ,ওর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।তৃপ্তির মা বলল –
‘সোনা মা ,যা ওকে তোর ঘরটা দেখিয়ে নিয়ে আয়’।
অনিচ্ছাকৃতভাবে তৃপ্তিকে উঠে যেতেই হল। তৃপ্তির চোখ জলে ভরা ,ও কোনো কথা বলতেও পারছে না। মুখ তুলে তাকাতেও পারছেনা।মেঘ ওর পেছন পেছন উঠে গেল।এদিকে বাড়িতে অন্যান্য প্রতিবেশীরাও আসতে শুরু করেছে,আবীর মাখা মিষ্টিমুখ ও হাল্কা আলাপচারিতা চলছে।
তৃপ্তি ঘরে ঢুকল মেঘ ওর পেছন পেছন এল।তৃপ্তি মুখ নীচু করেই দাঁড়িয়েছিল।মেঘ হঠাৎ তৃপ্তির খুব কাছে এসে দাঁড়াল।তৃপ্তি খুবই অস্বস্তি বোধ করছে।মেঘ ওর মুখটা দু হাত দিয়ে তুলে ধরতে গেলে তৃপ্তি ‘কি করছেন’ বলে চোখ মুছতে মুছতে পিছিয়ে যায়।মুখ তুলে তাকাতেই ও খুব অবাক হয়ে যায়।দুচোখের বাঁধ ভেঙ্গে যায়।তাড়াতড়ি কাছে এসে জিঞ্জাসা করে –
‘তুমি কি করে এখানে’?মেঘ বলে –
‘তুমিই তো ঘর দেখাতে নিয়ে এলে’।
‘দূর ,বল কি করে এসব হল’?
মেঘ বলল –
‘আমি মাকে সব বলেছিলাম প্রথমেই।সেখান থেকে বাবা জানে। মিলি মাঝে একদিন ফোন করে বললো –
‘সৈকতদা তৃপ্তি সবসময় তোমার নাম করে,আরেকটু সাহস পেলাম। যেদিন কলকাতার চাকরিটা পাই ,সেদিন চলে যাবার আগে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল তোমাকে কিন্তু নিজেকে আটকে নিয়েছি।বাবা মা আমার এই দীর্ঘদিন চুপ করে থাকা দেখে দুমাস আগেই তোমার বাড়িতে ফোন করে সব কথা তোমার বাবাকে জানায় আর লাকিলি তোমার বাবা এককথায় রাজি হয়ে যায়।কিন্তু আমি কিছুই জানতাম না সাহিল সব বলেছে আমাকে।এই দোলের ছুটিতে বাড়ি এলে বাবা গম্ভীর মুখে বলে তোর জন্য মেয়ে দেখেছি বিয়েটা এবার করতেই হবে।আমি খুবই ঘাবড়ে যাই। ভাইয়ের মুখের ঈশারা দেখে বাবাকে এসে জড়িয়ে ধরি।মা পাশ থেকে হোহো করে হাসতে শুরু করে’।
এতক্ষণ ধরে সব কথা তৃপ্তি মন দিয়ে শুনছিল। ওর চোখে মুখে আলোর বন্যা।বলল- ‘তোমার নাম মেঘ কৈ আগে বলোনি তো? সৈকত হেসে বলল – ‘বাড়িতে বাবা মা মেঘ বলেই ডাকে
ওটা ডাক নাম’।
তৃপ্তির আনন্দের সীমা নেই,বলল –
‘এত দিনের দূরত্বে একটা ছোট্ট পরিবর্তন দুজনেরই হয়েছে ,লক্ষ্য করেছ’ ?
সৈকত খুব অবাক হয়ে বলল -‘কি’?
‘এই যে আমরা তুই থেকে তুমিতে চলে এসেছি’। সৈকত তৃপ্তিকে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা কিস করে বলল – ‘এখন থেকে তো তুমিই বলতে হবে’। ‘আর হ্যাঁ
সেদিনকার সেই ছোট্ট ঝগড়ার জন্যে সরি’।
তৃপ্তি হেসে বলল –
‘ওই ঝগড়াটাকেই আমি থ্যাঙ্কস জানাই’।
‘তোমার মূল্য আমার জীবনে কতটা ,আমি প্রতি অণুপল অনুভব করেছি’।
তৃপ্তি আলতো করে সৈকতের ঠোঁটে ঠোঁট চুবিয়ে বলল – ‘এবার নীচে চল’।
সৈকত একটা আবীরের কৌটো পকেট থেকে বের করে বলল –
‘চলো বাবা মাদের প্রণাম করি গে’ ।
ঘর থেকে বেরনোর আগে অ্যাঞ্জেলাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে তৃপ্তি বলল-
‘আজ আমার আবার নতুন জন্ম হল রে’।
দুজনে হাত ধরে নীচে নেমে গেল।নীচের সবার মুখে আজ আবীর, হাসি কথার গন্ধে ঘর ম ম করছে।ওরা বড়দের পায়ে আবীর দিয়ে আশীর্বাদ নিল।