ভালোবাসার বিষ
রোজকার মতো সেদিনও গিয়ে দেখলুম, বৈঠকখানা ঘরে প্রফেসার বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছেন। শূন্য মদের বোতল আর গেলাস গড়াচ্ছে ফরাসের ওপর। বই আর খাতা ফরাসের একপাশে রেখে চলে গেলুম ভিতরে। বাইরের সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক রইল না।
ভিতরের ঘরে ছোট টেবিলের পাশে গালে হাত রেখে প্রতিমা বসে আছে। সেই ফিকে নীল সুন্দর ছাপা শাড়িখানা পরনে। আমি তার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালুম। মুখ তুলে সে তাকাল। গভীর দুটো চোখে স্বপ্নাচ্ছন্ন দৃষ্টি। তার মুখখানা দু-হাত দিয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলুমকী ভাবছ?
বললে, তোমার কথা ভাবছি।
জিগ্যেস করলুম—সত্যি?
চোখের পাতা দুটো নাচিয়ে, সে নীরব ভাষায় জানাল, সত্যি।
ঘরের একপাশে খাট। খাটের ওপর ছোট্ট-নচিকেতা ঘুমোচ্ছে! নচিকেতা প্রতিমার ভাই। মাতৃহারা ছেলেটি দিদির স্নেহে মানুষ হচ্ছে। খাটের একপাশে বসতে যাচ্ছিলুম। প্রতিমা বারণ করল—বোসোনা, ও জেগে উঠবে। তার চেয়ে চলো আমরা ছাতে যাই।
ছোট্ট কাঠের সিঁড়ি বেয়ে খুঁড়ি মেরে আমরা ছাদে উঠতে লাগলুম। প্রতিমা আগে আগে, আমি তার পিছে পিছে। কী সুন্দর লাগছিল। কী একটা সুন্দর মিষ্টি গন্ধ। কী সব পুলকিত স্পর্শ।
ঝাপসা চাঁদের আলোয় আলোয় চারিপাশ ধোঁয়াটে। দূরে দূরে গাছের জটলা নিঃশব্দ প্রহরীর মতো রাতের অভিসার লক্ষ করছে।
জলের ট্যাঙ্কের পাশে, প্রতিমার নিজের হাতে পোতা ছোট্ট রজনীগন্ধার একগুচ্ছ ফুল। তারই পাশে আমাদের বসে থাকা। পরস্পরের নিঃশব্দ অবস্থিতি। বসে বসে ভাবি প্রতিমা আমায়। ভালোবাসে। আমি কৃতজ্ঞ। হঠাৎ কী মনে হল, হেলান দিয়ে বসে থাকা প্রতিমার সুন্দর পা দুখানার ওপর মুখ ঘষতে লাগলুম। প্রতিমা বাধা দিল,—ও কী করো, পাগলামি রাখো।
বললুম—না বাধা দিও না। আমি তোমায় ভালোবাসি। কিন্তু সে ভালোবাসা আমি তোমার কাছে কেমন করে প্রকাশ করব।
শুধু প্রতিশ্রুতি দাও তুমি আমাকে ভালোবাসবে, মনে রাখবে চিরকাল।
প্রতিমা বলল-বলো তুমিও আমায় মনে রাখবে অনন্তকাল।
বললুম-অনন্তকাল কেন, তোমাকে ভালোবেসে আমি তোমার সত্তায় লীন হয়ে যেতে চাই। আশ্বাস দাও, তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসবে না।
হঠাৎ নচিকেতা এসে, ‘দিদি’, বলে পেছন দিক থেকে প্রতিমার গলা জড়িয়ে ধরল।
তারপর আমাকে দেখে প্রশ্ন করল—দিদি, প্রকাশদার কী হয়েছে? তুমি বকেছ? তাই পায়ে ধরে ক্ষমা চাইছে।
প্রতিমা হেসে বলল—হ্যাঁরে, খুব বকেছি। ভারি দুষ্টু কিনা,–
আমার চে। নচিকেতা একগাল হেসে জিগ্যেস করল।
প্রতিমা বলল—হ্যাঁ তোমার চেয়েও। তুমি প্রকাশদাকে ভালোবাসো না?
হ্যাঁ
আমাকে বাসো না?
হ্যাঁ।
কাকে বেশি বাসো, ছোদ্দি।
প্রতিমা হেসে পালটা প্রশ্ন করল—তুই বল না।
আমাকে। নচিকেতা বুক চাপড়ে জানাল।
আমি এতক্ষণ প্রতিমার কোলে মাথা রেখে শুয়েছিলুম। নচিকেতা আমায় ঠেলা দিয়ে জিগ্যেস করল, প্রকাশদা তোমার ঘুম পেয়েছে। চলোনীচে শোবে চলো। দিদির কাপড়ে তোমার মাথার তেল লেগে যাবে। দিদির কষ্ট হবে।
আমি বললুম—তুমি নীচে যাও। তোমার ঠান্ডা লাগবে। আমি আর তোমার দিদি পরে যাব।
নচিকেতা প্রতিমার আর একপাশে ঘন হয়ে বসে বলল—তুমি নীচে যাও। আমি ছোদ্দির কাছে থাকব।
প্রতিমার নরম কোলে মাথা রেখে ভাবছিলুম:নচিকেতা আজ যদি না থাকত। যদি এই পৃথিবীর মাটিতে ওর পদস্পর্শ না পড়ত, তা হলে আজকের এই রাত আরও কত সুন্দর হয়ে উঠত। এই নিভৃত অবসরে গোপন হৃদয়ের দ্বার খুলে দিতুম প্রতিমার সামনে, কত ভাব আর কত ভাষায়। ভরে দিতুম তার হৃদয়।
নচিকেতা আমায় খোঁচাতে লাগল—ওঠো না, তোমার কি কোনও কাজ নেই।
তুমি খালি শুয়ে থাকো। দিদির যে লাগছে। তুমি নীচে আমার বিছানায় শোওগে যাও।
প্রতিমা বলল—প্রকাশচলোনীচে যাই। নচিকে খেতে দিতে হবে।
উঠে দাঁড়ালুম। দাঁড়ানো মাত্রই নচিকেতা, প্রতিমার কোলে শুয়ে পড়ল।
তুমি নীচে যাও, ঠান্ডা লাগবে তোমার। আমি আর দিদি পরে যাব।
নচিকেতা গম্ভীর গলায় বলল। প্রতিমা হেসে আদর করে বলল—দুষ্টু ছেলে কোথাকার।
আমি দাঁড়িয়ে রইলুম, নীরবে। এই প্রতিমার তো নীচে নামবার কোনও চেষ্টাই নেই।
জিগ্যেস করলুম শঙ্কিত গলায়—প্রতিমা তুমি কি আমায় ভুলে গেলে? তুমি কি আমায় ভালবাসো না।
প্রতিমা হেসে বলল—আচ্ছা পাগল। তুমি কিনচিকে হিংসে করো। ও ছোটো ছেলে, ও কী বোঝে বলো।
নচিকেতা বলল—দিদি ওকে যেতে বলো, আমরা পরে যাব।
না নচি নীচে চলো। প্রতিমা উঠে দাঁড়াল। ওরা নীচে চলে গেল। আমি ইচ্ছে করেই গেলুম না। আধোলোকিত ছাদে পদচারণা শুরু করলুম। হৃদয়ের রুদ্ধ আবেগ ঘোলাতে লাগল, প্রকাশের পথ না পেয়ে।
কতক্ষণ একা ঘুরলুম। তারপর একসময় অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলুম। সিঁড়ির শেষ ধাপে, হাঁটুর ওপর মাথা রেখে অন্ধকারে প্রতিমা বসেছিল। আনন্দে হৃদয় উছলে উঠল। সত্যি প্রতিমা ভালোবাসে আমায়। আমার পথ আটকে তাই বসে আছে। কিন্তু কী হল তাকে ঠেলে তার। হাত মাড়িয়ে দিয়ে, আমি চলে গেলুম হনহন করে বাইরের ঘরে। প্রতিমা আর্তনাদ করে উঠল, ওঃ প্রকাশ তুমি আমায় দেখতে পেলে না। আমি যে তোমারই জন্যে এখানে বসে আছি।
আমার গতিবেগ মুহূর্তের জন্যে স্তম্ভিত হল, কিন্তু ক্রুর হৃদয়ের কাছে আমার কোমল বৃত্তি পরাজয় স্বীকার করল। বই আর খাতাখানা তুলে নিয়ে হনহন করে চলে গেলুম।
প্রফেসর মদের নেশায় বিকৃত কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠলেন—জ্বলে গেল, জ্বলে গেল। তারপর হাসতে হাসতে বললেন—জ্বলুক, জ্বলুক।
সেদিন রাত্রি এল, কিন্তু নিদ্রা এল না। একরাশ তারার ভেতর দিয়ে প্রতিমার লক্ষ লক্ষ সজল চোখ চিকচিক করতে লাগল। অনুশোচনা ধীরে ধীরে দগ্ধ করতে লাগল অন্তর, অতন্দ্র চোখের সামনে নেমে এল শেষ রাতের ফ্যাকাসে চাঁদ। প্রথম রাতের অনুরাগের মূক সাক্ষী শেষ রাতে বিচ্ছেদের বেদনায় যেন পাণ্ডুর।
তাড়াতাড়ি উঠে পড়লুম। বাগানের গাছে তখন শেষ রাতের কনকচাঁপা প্রস্ফুটিত হয়েছে। একরাশ ফুল নিয়ে হাজির হলুম প্রতিমার শোবার ঘরের জানালায়। গিয়ে দেখলুম জানালার গরাদে মাথা রেখে ক্লান্ত প্রতিমা দাঁড়িয়ে রয়েছে, কোমল একফালি অনুভূতির মতো।
আমি তার সামনে দাঁড়াতেই সে চমকে উঠল, তারপর রুগ্ন একটুখানি হেসে তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে এল। শিশির ভেজা ঘাসের ওপর তার শুভ্র নগ্ন পা, কনকচাঁপার অঞ্জলিতে ভরে দিলুম। তার মাড়িয়ে যাওয়া আঙুলটা মুখে পুরে দিলুম, বললুম—
সেরে যাবে। তারপর বললুম—আমায় ক্ষমা করো। প্রতিমা ধীরে ধীরে আমার বুকে মাথা রাখল। হঠাৎ শেষ রাতের স্বপ্ন দেখে নচিকেতা ঘুমের ঘোরে চেঁচিয়ে উঠল—দিদি না, না।
প্রতিমা চমকে উঠল, গাঢ় গলায় বলল—আসি। তুমি যাও, ওই দেখো ভোর হল। এইবার সবাই জাগবে।
বললুম—জাগুক, আমি ভয় করি না। যারা জাগবে তারা কি জানবে আমরা আজ সারারাত জেগেছি, তারা কি জানবে কী ব্যথা আমাদের সারারাত দগ্ধ করেছে।
নচিকেতা ঘুম ভেঙে, ডাকতে লাগল—দিদি, দিদি। শেষের দিকে তার গলা ধরে এল।
আমি যাই। প্রতিমা মুহূর্তে চলে গেল। ভোরের পাখিরা সমস্বরে ডেকে উঠল। এল নতুন দিন।
দিন কেটে গেল সুখানুভূতির আমেজে। নেমে এল সন্ধ্যা, আর একটি মধুর সন্ধ্যা। বাইরে ঘরের সেই বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকা প্রফেসার। ফরাসের কোণে বই রেখে সেই ভিতরে চলে যাওয়া। সেই গালে হাত দিয়ে বসে থাকা প্রতিমা।
খাটের উপর বসে বসেনচিকেতা পড়ছে। আমাকে দেখেই প্রতিমা উঠে দাঁড়াল। গভীর উত্তেজনায় তার চোখদুটো চকচকে। সে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল—প্রকাশ, আর সহ্য হয় না। আর কতদিন চলবে এ অভিনয়। অভিনয় কবে বাস্তব হবে। তার হাত দুটো চেপে ধরে বললুম— কীসের অভিনয় প্রতিমা। আমার প্রেমকে কি তুমি অভিনয় মনে করো।
না, না তা নয়। এই মাতাল পিতার সৃষ্টিছাড়া সংসারে কর্তব্যনিষ্ঠার অভিনয়।
চুপ করে রইলুম। তার হাতের মুঠোয় আমার হাত দুটো নিষ্পেষিত হতে লাগল।
আমার জীবনে সাধ আছে, আছে স্বপ্ন। চলো প্রকাশ আমরা চলে যাই। পারবে না আমার ভার নিতে?
কেন পারব না প্রতিমা, আমার সুস্থ সবল দেহ আর অন্তরভরা ভালোবাসা সবই তো তোমার পূজার অর্ঘ।
হঠাৎ নচিকেতা খাট থেকে নেমে এল। পড়ে রইল তার ছবির বই।
কোথায় যাবে দিদি। তুমি আর প্রকাশদা? প্রতিমা উত্তর দিল—সে এক জায়গায়। আমাকে নিয়ে যাবে না?
সেখানে তোমাকে যেতে নেই।
আমাকে ফেলে যেও না দিদি। নচিকেতা তার দিদির কোমর জড়িয়ে ধরল।
না যাবে না। তোমার জন্য সারাদিন বসে থাকবে আর তোমার দুরন্তপনা সইবে।
বা-রে তো আজ সারাদিন তোমার সঙ্গে কাজ করেছি। লক্ষ্মী হয়ে থেকেছি।
দিদি তুমি ছাড়া আমায় যে কেউ ভালোবাসে না। নচিকেতা দিদির মুখের পানে সজল চোখ দুটো তুলে ধরল।
আমি বললুম—চলো প্রতিমা ছাতে যাই।
প্রতিমা বলল—চলো। নচিকেতা দৌড়ে গিয়ে তার ছবির বইটা তুলে রেখে এসে আমাদের সঙ্গ নিল।
জিগ্যেস করলুম কোথায় যাবে?
বলল—ছাতে।
বললুম–না, তুমি বসে বসে পড়ো। ছাতে যায় না।
না, যায় না! নিশ্চই যাব। আমি আমার দিদির সঙ্গে যাব, তোমার কী।
যাও, পড়োগে যাও, যা বলি শোনো।
তুমি যাও।
প্রতিমা এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি, হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে নচিকেতার গালে সজোরে এক চড় মারল।
বাঁদর ছেলে, মুখে মুখে জবাব। যা পড়গে। নচিকেতা হঠাৎ চড় খেয়ে কী রকম হতভম্ব হয়ে গেল। একটুও কাঁদল না। অসহ্য অভিমানে তার চোখ দুটো ছলছল করতে লাগল, নিশ্বাস পড়তে লাগল জোরে জোরে। সে ফিরে গেল। বালিশে মুখ ঢেকে, উপুড় হয়ে রইল। ফুলে ফুলে উঠতে লাগল, রুদ্ধ কান্নায়।
‘চলো’—প্রতিমা এগিয়ে গেল। অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে, দুজনে এসে উঠলুম, আলোকোজ্জ্বল ছাতে। চাঁদ হাসছে মাথার উপর। চারিদিকে থমথম করছে শান্ত জনপদের ছবি। দূরে, বহুদূরে, করুণ সুরে বেহালা বাজাচ্ছে, তারি রেশ ভেসে আসছে হাওয়ার ওঠা-পড়ায়।
হঠাৎ ফিরে দেখি প্রতিমা কাঁদছে হু হু করে জল গড়াচ্ছে তার দু-গাল বেয়ে। তার কাঁধে ধীরে ধীরে হাত রেখে জিগ্যেস করলুম—কেন কাঁদছ প্রতিমা। তাকে টেনে নিলুম বুকের মাঝে, কিন্তু সে একটুখানি স্থির থেকেই নিজেকে মুক্ত করে নিল।
বলল—আমি নীচে যাই, আমি যাই। নচিকেতার গভীর স্নেহ তাকে আকর্ষণ করে নিয়ে গেল। প্রকাশের প্রেম তাকে রাখতে পারল না অনুরাগের বাহুবন্ধনে।
এ প্রেমে উত্তাপ আছে কিন্তু নেই আকর্ষণ, নেই সব ভুলিয়ে দেওয়া ক্ষমতা। এক শিষ রজনীগন্ধা, মৃদু বাতাসে মাথা দোলাতে লাগল। যেন বলতে চাইল নেই, সে নেই।
হঠাৎ প্রশ্ন জাগল মনে, আমার প্রেমের কি কোনও গভীরতা নেই। যে প্রেমে প্রতিমা সম্পূর্ণ ডুবে যেতে পারে। পারে সব ভুলে যেতে। এসেছে সেই পরীক্ষার সময়। ক্রুর হৃদয় জেগে উঠল, কোমলতাকে ছাপিয়ে। মুহূর্তে রজনীগন্ধা ফুলগুলোকে তুলে, ছিঁড়ে ছড়িয়ে দিলুম চারপাশে। অনুরাগের সাক্ষীকে, বিরাগের ব্যঙ্গকারী রূপে দেখতে চাই না। এলোমেলো হাওয়ায় পাপড়িগুলো ছড়িয়ে গেল চারপাশে।
নীচে নেমে গেলুম। প্রতিমার বুকে মাথা গুঁজে নচিকেতা দিন ও দীর্ঘদিন তারই কোলে বসে আছে। প্রতিমা তার মাথার চুলের ভিতর ধীরে ধীরে আঙুল চালাচ্ছে।
আমি বললুম-চলো প্রতিমা, গঙ্গার ধারে বেরিয়ে আসি। প্রতিমা করুণ মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল—কিন্তু নচি।
ও থাক, ও বাড়িতেই থাক না। বসে বসে পড়ুক। নচিকেতাদু-হাত দিয়ে প্রতিমাকে জাপটে ধরল।
চলো।
প্রতিমা আবার চাইল। এ প্রস্তাব যে রাখা সম্ভব নয় তারই লিখন সে-মুখে। বললাম—সত্যই যদি আমাকে ভালোবাসো তাহলে আমার কথা তুমি আজ রাখবে।
প্রতিমা নচিকেতাকে নামিয়ে রেখে, আমার কাছে এগিয়ে এল—ভুল বুঝো না প্রকাশ, তুমি কি নচির মতোই ছেলেমানুষ? মুহূর্তে একটা আগুন জ্বলে উঠল ভিতরে—এগিয়ে আসা প্রতিমাকে; সজোরে ঠেলে দিলুম। পুরুষের সেই কঠিন ধাক্কায় প্রতিমা পড়ে গেল। খাটের কোণ লাগল কপালে। লাল রক্তের একটা ক্ষীণ ধারা পলকে গড়িয়ে পড়ল তার শুভ্র গাল বেয়ে। কিন্তু মুখে লেগে রইল ক্ষীণ একফালি হাসি।
অসহ্য সে হাসির বিদ্যুৎ ধার। ছিটকে চলে গেলুম বাইরে। কানে এল নচিকেতার আর্তনাদ, দিদি, দিদি।
সে রাত কেটে গেল পথে পথে। অনুশোচনা আর আত্মগ্লানির কশাঘাতে কখন মনে এল এ জীবন শেষ করে দিই, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল আত্মপীড়ন আর অনুশোচনার মর্মপীড়ায় দগ্ধ হওয়াই ভালো। সেদিন এক ভিন্ন প্রকাশ, অভিশপ্ত প্রেতাত্মার মতো বারে বারে পাক খেল প্রতিমার বাড়ি ফিরে। শেষ রাতে প্রফেসার চিৎকার করে উঠলেন—জ্বলুক, জ্বলুক। পূর্ব দিগন্তে জ্বলে উঠল বিষুব সূর্য। জানলার ধারে দাঁড়ানো আহত প্রতিমার দিকে তাকানো সে উষার সম্ভব হল না।
অপরাধীর মতো, তার অলক্ষ্যে চলে গেলুম, পালিয়ে গেলুম।
সে দিন এল না ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে দিয়ে কোনও মধুর আত্মতৃপ্তি। সেন্টিমেন্টের সঙ্গে চলল বোঝাপোড়া। উদভ্রান্ত নিদ্রাহীন লাল চোখ মেলে দিবসের দগ্ধ পৃথিবীকে দেখলুম, দেখলুম। রাতের ক্ষণিক স্বপ্নবিলাস সেখানে রূঢ় ভাবে অবহেলিত। এ পৃথিবী সে রঙিন পৃথিবী নয়। এ। পৃথিবীতে আমার স্থান হতে পারে না। কঠিন বাস্তব ছাড়া এখানে কিছু নেই। অনেক দ্বন্দ্বের পর স্থির করলুম আজ আমার জীবনকে শেষ করে দেব, প্রাণহীন দেহ পড়ে থাকবে প্রতিমার পদপ্রান্তে। সার্থক স্বপ্নবিলাসীর এই হবে অতি সার্থক বিদায় গ্রহণ।
সন্ধ্যা এল বেহুশ প্রফেসারের ফরাস ঘিরে। এ যেন কেমন মরা সন্ধ্যা। শীতের কুয়াশায় চারিপাশ ঝাপসা। পকেটে হাত দিয়ে অনুভব করে নিলুম পটাশিয়াম সায়ানাইডের ছোট্ট মোড়াটা। তারপর এসে দাঁড়ালুম প্রতিমার মুখোমুখি। কপালে ব্যান্ডেজ বাঁধা অসম্ভব উজ্জ্বল, রুগ্ন একখানি মুখ।
ক্ষমা করো।
প্রতিমা হাসল। হাত বাড়িয়ে আমার একখানি হাত চেপে ধরে।–কীসের জন্যে ক্ষমা?
নচিকেতা চিৎকার করে উঠল—দিদি আবার তুমি ওর সঙ্গে কথা বলছ। ও তোমাকে খুন করতে পারে।
প্রতিমা আমি অনুতপ্ত। আমায় আর একবার ক্ষমা করো। নচিকেতা চিৎকার করে উঠল—বেরিয়ে যাও তুমি। দিদির সঙ্গে তোমার কথা বলতে হবে না।
প্রতিমা থামিয়ে দিল—নচি চুপ কর।
আমাকে বলল—বোসো। সারারাত ঘুমোওনি কেন? পাগল।
আমি বসলুম মুখ নীচু করে। বসলুম প্রতিমার পাশে। আমার একটা হাত প্রতিমার গরম মুঠোয়। আর একটা হাত পকেটের মধ্যে, বিষ পুরিয়া স্পর্শ করে। সময় ঘনিয়ে আসছে। সত্যিই কি আজ জীবনের শেষ মধুর সন্ধ্যা।
নচিকেতা গজগজ করতে লাগল—তোমার কিছু মনে থাকে না দিদি। তুমি আবার প্রকাশদাকে ভালোবাসছ। যে তোমার মাথা ফাটাল কাল, আজই আবার তার সঙ্গে কথা বলছ। ওই লোকটা দেখছি যত নষ্টের গোড়া। ও না থাকলেই ভালো হত। আগে সন্ধ্যাবেলা তোমাতে আমাতে কত গল্প করতুম, কত বেড়াতুম, ও এসে সব মাটি করল।
ভাবলুম, আশ্চর্য, বিধাতার উপহাস, নচিকেতার হলুম আমি প্রতিদ্বন্দ্বী, আমার প্রতিদ্বন্দ্বী নচিকেতা। আমি চাই ও সরে যাক, ও চায় আমি যাই।
বিষ পুরিয়াটা জোর করে চেপে ধরলুমকে সরবে, আমি? আমি সরে যাব? বিদায় নেব? এই মধুর পৃথিবীর স্বপ্নবিলাস ছেড়ে।
প্রতিমা বলল কী ভাবছ। ও নিতান্ত ছোট। ও দিদি ছাড়া আর কিছুই জানে না।
ভাবলুম—আমি কিন্তু ওর চেয়ে অনেক কিছু জানি। জানি প্রেম, জানি অনুরাগ, চিনি জীবন।
প্রতিমা বলল—ওর কথায় যে রাগ করে সে পাগল।
নচিকেতা বলল—দিদি খাবে চলো।
প্রতিমা বলল—তুই খাবি চল আমি পরে খাব।
নচিকেতা ছিনিয়ে নিয়ে গেল প্রতিমাকে।
রাত বেড়ে চলল ধীরে ধীরে। আবার প্রতিমা এল, হাতে দুধের বাটিটা টেবিলের উপর রেখে সে চলে গেল। শুনলুম সে বলছে—নচি ঘরে দুধ আছে, লক্ষ্মী ছেলের মতো খাবে, খেয়ে শুয়ে পড়বে। শুনলুম নচি বলছে—তুমি ওকে যেতে বলো দিদি, ওকে আমার ভালো লাগে না।
মুহূর্তে জ্বলে উঠল অন্তর। তোমাকেও আমার ভালো লাগে নানচিকেতা। তুমি সরে দাঁড়াও, ছেড়ে দাও প্রতিমাকে। হঠাৎ খেলে গেল বিদ্যুৎ। দেখলুম সঙ্কল্প, তারই চকিত আলোকে পকেট থেকে হাত বেরিয়ে এল। বিষের পুরিয়া মিশে গেল দুধে। শুনলুম প্রতিমা বলছে, আর জ্বালাস নানচি, আর ভালো লাগে না।
নচিকেতা ঘরে এল ছোট্ট একফোঁটা ছেলে। দিদির মতোই ফুটফুটে সুন্দর। তাকাল আমার দিকে। ওইটুকু ছেলের চোখেও ঘৃণার দৃষ্টি। নচিকেতা দুধের বাটি তুলে ধরল ঠোঁটের আগায়। আমার বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনে। বিস্ময়ে আর্তনাদ করে উঠলুম—উঁহু—আমার আচ্ছন্ন দৃষ্টির সামনে দেখলুম নচিকেতার চোখ দুটো পাথর হয়ে গেল, তার ক্ষীণ কণ্ঠে শেষ আর্তনাদ উঠল—দিদি রে। আমার চেতনা যখন পরিষ্কার হল, তখন দেখলুম প্রাণহীন নচিকেতার দেহ কোলে নিয়ে প্রতিমা পাথরের মতো বসে আছে।
কী হল নচিকেতার? কী হয়েছে?
প্রতিমা হাসল, আশ্চর্য। স্পষ্ট একফালি হাসি। বলল—তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হয়েছে। এখন এসো।
আমি বললাম—আমার ইচ্ছা না তোমার ইচ্ছা। ভাইটাকে সরালে, অমন চাঁপাফুলের মতো ভাই।
প্রতিমা বসে রইল, কী অসহায় সে ছবি।
প্রফেসর বাইরের ঘরে আর্তনাদ করছেন—যাক সব যাক জ্বলে যাক পুড়ে যাক।
বললাম—পুলিশে খবর দেওয়া উচিত।
আরও কত কথাই বললাম। কিন্তু প্রতিমা আর একটাও কথা বলেনি। জীবনের সেই শেষদিন সেই শেষ কথা।
এরপর কাহিনি হয়েছে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। আজও প্রতিমা বেঁচে আছে। সে বেঁচে আছে কোনও এক কারার রুদ্ধ প্রাচীরের অন্তরালে। সে সুন্দর প্রতিমা নয়, দগ্ধ বীভৎস প্রতিমা। কাপড়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা তার ব্যর্থ হয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে নিজেকে আইনের চোখে নির্দোষ প্রমাণ করবার প্রচেষ্টা। পটাসিয়াম সায়ানাইডের খালি বাক্সটা তার হাতব্যাগ থেকে পুলিশ আবিষ্কার। করেছিল।
আমার নির্জন প্রকোষ্ঠে বসে ভাবি, এই সেই প্রতিমা যাকে আমি ভালোবেসেছিলুম, অন্তর থেকে যাকে ভালোবাসি আজ। যাকে আমি ছাড়া কেউ ভালোবাসেনি, বাসতে পারে না, পারবেও না, আর কোনওদিন। আমার একান্ত প্রেমধন্য প্রতিমা। এই সেই প্রতিমা যাকে আমার একটি মুখের কথা আবার সমাজে ফিরিয়ে আনতে পারে, রক্ষা করতে পারে অসহ্য কারা নির্য্যাতন।
কিন্তু না।
তার জীবনের এই শোচনীয় পরিণতির জন্যে আমিই দায়ী থাকতে চাই। তীব্র অনুশোচনায় আমার অন্তর দগ্ধ হয়ে যাক। প্রতিমার স্লাল মুখখানি সর্বদা ভাসুক আমার চোখের সামনে।
রাতের নিদ্রা আমায় ত্যাগ করে যাক, যৌবন গেছে, যাক, যাক স্বাস্থ্য। মর্মপীড়ার অসহ্য দহনে আমার হৃদয় জ্বলুক সদা সর্বদা। আমার অপরাধ, আমার নৃশংসতা অহরহ আমাকে জর্জরিত। করুক, সেই তো হবে আমার সার্থক প্রেমবিলাস, সেই তো হবে আমার প্রেমের সার্থক রূপায়ণ।
মনে হয় যেন কতযুগ আগে জন্মেছি, বিস্মত কোনও এক শতাব্দীর কোলে। দিনগুলো অতিমন্থর সন্ধ্যার অন্ধকারে বেদনা আর স্মৃতির জগদ্দল পাথর বুক চেপে ধরে, চেতনা আচ্ছন্ন করে প্রতিমার যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখশ্রী।
কী সে গভীর বেদনা, কী অসহ্য যন্ত্রণা। জানি স্বীকারে এখনই ঘটে সে যন্ত্রণার অবসান, কিন্তু যন্ত্রণাই প্রেম, যন্ত্রণা।