Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভয় || Sanjib Chattopadhyay

ভয় || Sanjib Chattopadhyay

ভয়

আমার ভীষণ ভয় করে। কী করে কী হবে! শেষ পর্যন্ত পারব তো!

সমরেশকে দেখে এলুম। প্যারালিসিস হয়ে পড়ে আছে। ছেলে আর মেয়ে দুটো শুকনো মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখনও বড় হতে অনেক দেরি। ছেলেটা সবার ছোট। মাথায় মাথায় দুটো মেয়ে। স্কুল শেষ করে কলেজে। কলেজ শেষ করে হয় বিয়ে, না হয় চাকরির চেষ্টা। এই গোলাকার। পৃথিবীর ঘোর-প্যাঁচ তো অনেক। হায়না, নেকড়ে, শেয়াল, ষাঁড়ে ভর্তি। কেউ গুতোবে, কেউ খাবলাবে, কেউ আঁচড়াবে কামড়াবে। সবই সহ্য করতে হবে, কায়দা করে পাশ কাটাতে হবে। নিজের জীবন যেন, নিজেরই পায়ে ফুটবল। পেলের মতো পায়ে পায়ে কাটিয়ে এধার-ওধার করে গোলের জালে জড়িয়ে দিতে হবে। গোলাকারের গোলেমালে গোলের খেলা। খেলতেই হবে। যতদিন বাঁচা ততদিন খেলা। মাঠেই আমাদের জন্ম, মাঠ থেকেই চিতায়। দর্শক হওয়ার উপায় নেই। সবাই খেলোয়াড়। এ খেলার আইনে ফাউল নেই, পেনাল্টি নেই।

সমরেশের বিছানার মাথার দিকে তার স্ত্রী সুপ্রিয়া বসেছিল। বেশ রূপসি। সমরেশের বিয়ের দিন আমরা কম হইচই করেছি! একটু হিংসে যে হয়নি তা-ও নয়। সুন্দরী বউ। নিখুঁত সুন্দরী। বন্ধুবান্ধবের ভালো চাকরি হলে, সুন্দরী বউ হলে, প্রোমোশান হলে হিংসে হবে না! তাহলে আর বাঙালি হয়ে জন্মালুম কী করতে। সুপ্রিয়া খুব খোলামেলা, হাসিখুশি, হুল্লোড়ে মেয়ে ছিল। বিছানার মাথার দিকে বসে আছে। সুপ্রিয়ার ধ্বংসাবশেষ। সমরেশের কেউ কোথাও নেই। সংসারের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ল সুপ্রিয়ার ওপর। লেখাপড়া জানে। সমরেশের অফিসেই একটা চাকরিও পেতে পারে। মধ্যবয়সি, সুন্দরী মেয়েও কি খুব নিরাপদ। মনে হয় না। দেখছি তো চারপাশে। মানুষের খিদে বেড়েই চলেছে।

কী হবে, কে জানে! আমার ভীষণ ভয় করছে।

সুপ্রিয়া বলেছিল, ‘কেমন আছেন?’

ভদ্রতার প্রশ্ন। ভালো আছি, বলতে সংকোচ হল। কেউ অসুস্থ থাকলে নিজে ভালো আছি বলতে লজ্জা করে। অপরাধী বলে মনে হয়। তাই বানিয়ে, বানিয়ে নিজের কিছু অসুখের কথা বললুম। হার্ট দোল খাচ্ছে। রক্ত মিঠে হয়েছে। চাপ বেড়েছে।

সুপ্রিয়া বলেছিল, ‘সাবধান, এই লোকটাকে আমি বলে বলে পারিনি। স্বামীরা যদি স্ত্রী-র কথা একটুও শুনত।’

আমি আর বেশিক্ষণ বসিনি। ওই অবস্থায় যে কথাই বলি বোকা বোকা মনে হয়। একটা চলমান সংসার ব্রেকডাউন হয়ে মাঝপথে গোঁত্তা খেয়ে পড়ছে। এ এমন গাড়ি, ঠেলে স্টার্ট করানো যাবে না। মিস্ত্রি এনে মেরামত করানো যাবে না। গাড়ি পড়েই থাকবে। আরোহীরা এইবার যে যার ব্যবস্থা দেখে নাও।

রাস্তায় নেমে লোকজনের ভিড়ে নিজেকে বেশ হারিয়ে ফেলেছিলুম। সবাই চলছে। সবই চলমান। দোকানপাট, কেনাবেচা। মনে হল, এইভাবেই যখন সব চলে, চলে যাবে ঠিকই। কোথায় কোন ঘরে কে কাত হয়ে পড়ল, তা নিয়ে অত ভাবার কী আছে! মানুষের বরাত বলে তো একটা কথা আছে। যার যেমন বরাত। এইভাবেই আজ কাল হবে, কাল পরশু হবে। মনে মোটামুটি একটা বল এসে গেল। প্রবীণরা বলেন, ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখো। তাই না হয় রাখব। একটা মাদুলি, কি পাথর পরব। মাসে একবার মন্দিরে যাব। পাপ-টাপ আর তেমন না-ই বা করলাম। আর আমার পাপ তো একটাই। মেয়েদের দিকে চোরাগোপ্তা তাকানো। সেটা মনে হয় এমন কিছু পাপ নয়। একটা বদ অভ্যাস। চুরি-জোচ্চুরি করি না। তোক ঠকাইনা। ভেজালের কারবার করি না। রাজনীতি করি না। বায়োস্কোপ করি না। আমার বউ চিত্রাকে আমি ভালোই বাসি। বধূ-নির্য্যাতন করি না। আমার বাবাও নেই, মা-ও নেই। বউয়ের কথায় তাঁদের অসম্মানের পাপ ইচ্ছে। থাকলেও করতে পারব না। তাঁরা আমার পথ পরিষ্কার করে রেখে গেছেন। অকারণে, বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার হচ্ছে ভেবে, আমার শালিকে বউয়ের মতো করে আদর করেছিলুম। তা-ও জোর করে নয়। অনেক তেল দিয়ে তার অনুমতি নিয়ে। ‘আসতে পারি’,বলে নিপাট ভদ্রলোক। যেমন অন্যের দরজা ভেজানো ঘরে ঢোকে। তা ছাড়া শালিদের আদর করার অধিকার সব। জামাইবাবুরই আছে। শাস্ত্রসম্মত। এর জন্যে পক্ষাঘাত হবে না, বা হঠাৎ চাকরি চলে যাবে না। গেলে গোটা পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ বেকার হয়ে যেত। সবার আগে চাকরি যেত আমার অফিসের বড়কর্তার। তিনি তো সব মেয়েকেই ‘আবার খাবো’ সন্দেশ ভাবেন। কী কাণ্ডই যে করে বেচারা! মনটা সব সময় যেন ফলুই মাছের মতো লাফাচ্ছে তার। ওটা একটা রোগ। এক দাগ পালসেটিলা থারটি খেলেই সেরে যেতে পারে। কিছু অসুখ অনেকে ইচ্ছে করেই ভালো করে না। বেশ মজা লাগে। যেমন অনেকে দাদ পোষে। চুলকোতে ভালো লাগে বলে।

এই সব আলোচনা করতে করতে যেই বড় রাস্তায় এসে পড়েছি, চোখের সামনে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। এক স্কুটার আরোহীকে মেরে বেরিয়ে গেল একটা লরি। স্কুটারটা তালগোল পাকিয়ে গেল। মানুষটা চুরমার। চারপাশ থেকে লোক ছুটে এল। একদল ধাওয়া করল লরিটার পেছনে।

শান্ত, সুন্দর একটা পরিবেশ নিমেষে রক্তাক্ত। একটা ট্যাক্সি থেকে আরোহীদের টেনে টেনে নামিয়ে লোকটিকে তোলা হল। সবাই বললে, অকারণ। শেষ হয়ে গেছে। একেবারে দলা পাকিয়ে গেছে।

আমি হাঁ করে দাঁড়িয়েছিলুম। হাত পা কাঁপছে। চোখের সামনে ভয়াবহ মৃত্যু সহ্য করা যায়! সুন্দর লাল রঙের স্কুটারটাও মারা গেছে। মানুষ নয় বলে পড়ে রইল পথের পাশে। এক সেকেন্ড আগে আর এক সেকেন্ড পরে। সময়ের ওই সাংঘাতিক মুহূর্তটা কোনওরকমে পাশ কাটাতে পারলে স্কুটার আরোহী এতক্ষণে কত দূরে চলে যেত। কোথাও কোনও বাড়িতে তাঁর স্ত্রী হয়তো ঘড়ি দেখছেন আর ভাবছেন স্বামীর আসার সময় হল। মাছের কচুরি বেলছেন। এলেই ভেজে দেবেন। গরম, গরম। কেন আসছে না, কেন আসছে না করে সময় এগোবে। একসময় মৃত্যুদূত এসে দরজার কলিংবেল টিপবে। ছোট মেয়েটি ছুটে আসবে, বাবা, বাবা! বলে। বাবা নয়। এসেছে বাবার মৃত্যুসংবাদ। সব আলো জ্বলছে, অথচ কী ভীষণ অন্ধকার। আমি ভাবছি এইসব, তার মধ্যেই সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। আবার সেই রাজপথ। নতুন গাড়ি। নতুন মানুষ। পারে। রেস্তোরাঁয় তিনটে ষণ্ডা মতো লোক, হাতের চেটোর মতো চওড়া কাটলেটে কামড় মারছে। পাশে চায়ের কাপ ধোঁয়া ছাড়ছে। ঠিক ওই জায়গার ওপর দিয়েই দু-চাকা ছুটছে। পেছনে ধাওয়া করে আসছে লরি। মানুষটির চলে যাওয়ার চেয়েও আমি ভাবছি তাঁর পরিবারের কথা। বুড়ি মা বেঁচে নেই তো। অবিবাহিত বোন। তিন দিন পরেই যার বিয়ে। ছেলে হওয়ার জন্যে স্ত্রী হাসপাতালে ভর্তি ছিল না তো!

কে জানে বাবা! আমার ভীষণ ভয় করছে। ঠিক এক সেকেন্ড পরে কী হবে তাই তো জানি না, অথচ কেমন ঘুরে বেড়াচ্ছি। আজকে দাঁড়িয়ে পরিকল্পনা করছি বিশ বছর পরের। এই তো আজই ষাট হাজার টাকার ইনসিওরেন্স করেছি। পাকবে সেই বিশবছর পরে, আমার বয়েস তখন হবে ষাট। কোনও মানে হয়। এই সাংঘাতিক ভয়ের পৃথিবীতে এক মিনিট পরে কী হবে কেউ। জানে! না আমি জানি না আমার বউ! সেদিন এক ফার্নিচার-এর দোকানের মালিক বেশ বললেন। একটা খাট কিনতে গেছি। তা বললুম, ভাই এমন একটা খাট দিন, যা সারাজীবন চলে যাবে। ভদ্রলোক আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘আপনি কত বছর আছেন, জানতে পারলে আমার সুবিধে হয়। দশবছর, বিশ বছর। আপনার জানা আছে?’

খুব বোকা বনে গেলুম। সারাজীবন বলার সময় আমার কোনও ধারণাই ছিল না সেটা কতটা? কত দূর! ভদ্রলোক তখন ভগবানের মতো হেসে বললেন, ‘মশাই জীবন বড়ই অনিশ্চিত। পদ্মপাতায় জলের মতো। এই আছে, এই নেই। একটা খাট দিচ্ছি। নিয়ে যান। তারপর দেখা যাক, খাট আগে যায় না মানুষ আগে যায়। আমার অভিজ্ঞতায় বলে, যেমনই হোক, মানুষই আগে যায়।’

একটু বেশঝালে ঝালে মেখে তরিবত করে খাওয়াদাওয়া সারা হল। ঢেউ শব্দে বেশ জমাটি ঢেকুর উঠল। ছুটির দিন, ভাবছি একটু গড়িয়ে নিলে ষোলোকলা পূর্ণ হয়। দিবানিদ্রার মহাসুখ। যখন যেমন পারা যায় জীবন থেকে সুখ বের করে নিতে হয় নিংড়ে।

বউ বললে, ‘এখন আর গড়িয়ে পোড়োনা। পিসিমাকে একবার দেখে এসো। অবস্থা খুব খারাপ।’ তাই তো! পিসিমাকে তো একবার দেখতে যাওয়া দরকার! কী থেকে কী হয়ে গেল! মুহূর্তের ব্যাপার। অমন এক সাধিকার মতো মহিলা। সারাজীবন যাঁর দুঃখের সঙ্গে লড়াই করে কেটেছে। কত কাণ্ড করে বিধবা মহিলা ছেলেটিকে মানুষ করলেন। ভালো চাকরি হল। ভালো মাইনে হল। বিয়ে হল ছেলের। দুই নাতি। জীবনের একেবারে শেষকালে সুখ ছোঁব, ছোঁব করছে। প্রায় ছোঁয় আর কি! ভগবান পায়ের তলায় জমিটা সামান্য একটু টেনে দিলেন খুচ করে। ভোরবেলা মহিলা জপে বসবেন বলে ঠাকুরঘরে যাবেন। চৌকাঠের ওপর দিয়ে পা বাড়ালেন। এঘর থেকে ওঘরে। কিছুই না, টাল খেয়ে পড়ে গেলেন। কোমরের হাড়ে একটু চোট লাগল। যা হয়। কেউ বললে, জল দাও, কেউ বললে মলম দাও, আনিকা। সামান্য চোট। আরে বাবা, বৃদ্ধ। বয়সের হাড়। একেবারে পাঠকাঠির মতো। সেই হল। হিপজয়েন্টে ফ্রাকচার। তিন মাস পড়ে থাকো বিছানায়। যে মানুষ রাতে ঘণ্টা চারেকের জন্যে বিছানা নিতেন তাঁর এ কী শাস্তি! বিছানা তাঁকে ভালোবেসে বললে—কিছু মানুষ আসে সেবা করার জন্যে কিছু আসে সেবা নেওয়ার। জন্যে। তুমি এসেছিল সেবা করার জন্যে। এইবার তুমি আমার সেবা নাও। চোট লাগা পা-টা ভুল সেটিং-এর জন্যে বিকল হয়ে গেল। শরীরের যেখানে যত গোলোযোগ ছিল, ব্যাধিশত্রু, সব তেড়েফুঁড়ে বেরিয়ে এল। রণক্লান্ত সৈনিক এইবার ঘরে ফেরার ডাক পেয়েছেন। চেতন, অচেতন, অর্ধচেতন স্তরে মন ভাসছে। অলৌকিক দৃশ্য দেখছেন মাঝে মাঝে। আজ অথবা কাল, যে কোনও দিন বীণানীরব হবে।

ভীষণ ভয় করে। ভগবানকে বিশ্বাস করে তো তাহলে কোনও লাভ নেই। তিনি তো কোনও রক্ষাকবচ নন। আমার পিসিমার চেয়ে ধার্মিক ক-জন আছেন! আর জীবনে অত কষ্টই বা কে করেছেন। সুখের পেয়ালাটি সবে এগিয়ে এসে ঠোঁট স্পর্শ করব করব করছে। ভাগ্যের হাত থেকে হাতলটি খুলে গেল। হাতলের জোড় খুলে কাপ পড়ে গেল। হল না। এবারটাও হল না। সব দৌড়ে সবাই কি ফিতে ছুঁতে পারে। পরের বার। পিসিমা পরের বার। নেকস্ট টাইম বেটার লাক।

চৌকির ওপর বিছানা। চাদর ঢাকা পিসিমা। মুখটাই শুধু বেরিয়ে আছে। মুখ না বলে কঙ্কাল বলাই ভালো। শুধু পাতলা একটা চামড়ার আস্তরণ। ভীত, সন্ত্রস্ত, করুণ দুটো চোখ। চোখ দেখলেই বন্দি মানুষকে চেনা যায়। বনের পাখি আর খাঁচার পাখি। পিসিমার চোখ মুক্তি খুঁজছে। অনেক দিন এসেছি। ভাগ্যের চাবুক অনেক সহ্য করেছি। অসম্ভব সম্ভব হবে ভেবেছি। ভেবেইছি। আর আমি ভাবতেও পারছি না। পাখি এবার তুমি উড়ে যাও। প্রভু! খাঁচা আমার খুলে দাও।

পিসিমা চাদরের তলা থেকে শীর্ণ হাত বের করে আমাকে স্পর্শ করতে চাইলেন। শক্তি নিঃশেষ। আমি কোনওভাবেই জিগ্যেস করতে পারলুম না, কেমন আছেন? দেখতেই তো পাচ্ছি! বলতেও পারলুম না ভালো থাকুন! সাবধানে থাকুন। ও কথার কোনও মানে হয় না। যার জীবন তিনিই। জানেন কে কতদিন ভালো থাকবে! কে কখন ভালো হয়ে উঠবে। আমার পিতার তরফের শেষ। প্রতিনিধি। যেই চলে যাবেন, বন্ধ হয়ে যাবে বইয়ের মলাট। কেউ কোনও দিন আর খুলবে না। খোলার প্রয়োজনও হবে না। বিছানার পাশে বসে রইলুম বহুক্ষণ। পিসিমার ভেতরে অদৃশ্য এক নৌকা বেয়ে চলেছে কেউ মোহনার দিকে। আমি যেন শুনতে পাচ্ছি দাঁড়ের শব্দ। জলকল্লোলের শব্দ।

পথে নেমে এলুম। বড় অসহায় লাগছে নিজেকে। মানুষকে একদিন না একদিন যেতে হবে। ঠিকই। কিন্তু এইভাবে কেন? যাবে তো বিস্ফোরণের মতো যাও। ধনুক থেকে ছোড়া তিরের মতো যাও। অথবা যেভাবে মানুষ বেড়াতে যায় সেই ভাবে যাও। রেলগাড়ির জানালার ধারে মুখ বের করে বোসো। হাসতে হাসতে হাত নাড়তে নাড়তে চলে যাও। আমরাও রুমাল নাড়ি তুমিও রুমাল নাড়ো।

একটা হিসেব করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আমার ছেলে, শানুর বয়স এখন পাঁচ। তার মানে এখনও কুড়িটা বছর। কুড়ি বছর টেনে যেতে হবে। স্কুল, কলেজ, জীবিকা। তারপর রাখে ভালো টান মেরে ফেলে দেয় সেও ভালো। সে হবে ভয়ংকর ভালো। কোথায় যাব। কোন আস্তানায় থাকব তখন তো অর্থব। লোলচর্ম। বিস্মৃতিপ্রবণ। ঘৃণিত এক বৃদ্ধ। দুটো জিনিস বর্তমান জগতে অতিশয় ঘণার, এক, দারিদ্র, দুই বার্ধক্য। ঘৃণা নিয়েই মরতে হবে। সসম্মানে আর ক-জন যেতে পারে। এই যে আমার পিসিমা। সবাই এখন ফিশফাশ করছে, এই অবস্থায় যাওয়াই ভালো। ভালো হওয়ার যখন আশা নেই তখন যাওয়াই ভালো। হিসেব তো মিলছেনা আমার। কুড়িটা বছর আমাকে টাকার পাইপলাইন ঠিক রাখতে হবে। কল ঘোরালেই যেন টাকা পড়ে। ছেলের নিজের পায়ে দাঁড়ানো। দুটো মেয়ের প্রায় একই সঙ্গে বিয়ে। এর মধ্যে কতবার সব অসুখে। পড়বে। চিত্রার অপারেশান। মেয়েদের একটা না একটা বড় রকমের অপারেশান হবেই হবে। এমন খুব কম বউই আছে যারা অক্ষত জীবন শেষ করেছে। বলা তো যায় না। যদি ব্রেস্ট ক্যানসার হয়। ইউটেরাসে ক্যানসার! হবে না—এ কথা তোতা জোর করে বলা যায় না। আমারও তো ক্যানসার হতে পারে। আজকাল তো প্রতি পাঁচজনে একজনের ক্যানসার।

ভীষণ ভয়। এখন চিত্রা যদি আমার আগে চলে যায়, আমি নিঃসঙ্গ! আর আমি যদি আগেই যাই। চিত্রা কী করে সামলাবে। পুরো পরিবার ভেসে যাবে। ছেলেটা বদ সঙ্গে পড়ে বখে যাবে। আজকাল তো দুটো ভবিষ্যৎ মানুষের ছেলের। হয় মানুষ হও, না হয় গুন্ডা হও। গুন্ডারা যেন চৌবাচ্চার কই মাছ। নেতারা এসে বেছে বেছে তুলে নেবেন। মদত দেবেন। শেল্টার দেবেন। নেতারা হলেন রাজনীতির ইস্ক্রপ। গুন্ডারা হল ত্রু-ড্রাইভার। গদির প্লাইউডে ফিট করে দেবে। বাঁচবে না বেশিদিন। অপঘাতেই মরবে। তবু তো জীবিকা। বোম মেরে, ছুরি মেরে বাঁচা অথবা মরা। তাবীরই বলা চলে। মেয়ে দুটোরই বা কী করবে চিত্রা। প্রেম তো করবেই করবে। দেখতে শুনতে কেউ খারাপ নয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা যেমন হবেই হবে প্রেমও হবে। বিয়ে হবে। তারপর। ডির্ভোস। এক নম্বর স্বামী। স্বামী নম্বর দুই। তিন-চার। আজকাল একটা গান কানে আসে, এক, দো, তিন, চারপাঁচ, ছয়, সাত আট নয়, দশ, এগারো বারহ। মনে হয় ওটা বিয়েরই গান। চিত্রা যায় যাক, শিবির আগলে আমাকেই বসে থাকতে হবে। যুগকে ঠেকাতে পারব না, তবু চেষ্টা। বেঁচে থাকাটা কী সাংঘাতিক ভয়ের। আগুন নিয়ে খেলা। অপরেশ এল ম্লান মুখে। সুন্দর চেহারা ছিল। অভিনয় করত এক সময় শখের থিয়েটারে। প্রাইভেট ফার্মে ভালো চাকরি করত। আজ টানা তিন বছর প্রতিষ্ঠান বন্ধ। আজকাল এটা খুব জরুরি। কলকারখানা বন্ধ না হলে মানুষের ভালো হবে না। যেমন অপরেশের হচ্ছে। কাঠের মতো শরীর হয়েছে। লোহার মতো মুখ। কতরকমের চেষ্টা করছে সংসার চালাবার জন্যে। কিছু আর বাকি নেই। কোনওটাই তেমন লাগছে না।

অপরেশচিত্রাকে বলছে—’ছেঁড়াখোঁড়া, ফেলে দিলেই হয় এই রকম দু-একটা শাড়ি আছে? বড় উপকার হয়।’ এই অপরেশ আমার বাল্যবন্ধু। একই সঙ্গে জীবন শুরু করেছি। একই স্কুলে পড়েছি। একই মাঠে খেলেছি। অপরেশের কী প্রাণ ছিল! বন্ধুবান্ধব স্বজন, সবাই তাকে ত্যাগ করেছে। ওই যে বললুম, দারিদ্র বড় ঘৃণার।

চিত্রা দুটো নতুন শাড়ি অপরেশকে দিতে গেল। অপরেশ হাতজোড় করে বললে, ‘নতুন শাড়ি চাইনা বউঠান। ছেঁড়াখোঁড়া থাকে তো দিন। যা আপনি ফেলে দেবেন বা বাসনওলাকে দিয়ে দেবেন।

কিছুতেই নিলে না নতুন শাড়ি। চিত্রা বোঝাতে শেষে কেঁদে ফেললে।

অপরেশ বললে, ‘বউঠান, মন খারাপ করবেন না। জগতে কেউ ভালো থাকে, কেউ খারাপ থাকে। আবার আজ যে ভালো আছে, কাল সে খারাপ। দিনের এইটাই মজা। কখনও একরকম যায় না। চেষ্টাটাই বড় কথা। বেঁচে থাকার চেষ্টা, ভালো থাকার চেষ্টা। ভয় পেলে চলবে না। হাল ছাড়লে চলবে না। এইটাই তো পরীক্ষা। মানুষ নাগরদোলায় চেপে আনন্দ পায় কেন? ওই যে ওঠা-পড়ার ভয়ের আনন্দ।

অপরেশ চলে গেল। তবু আমার ভয় গেল না। কতটা পথ এই একা একা যেতে হবে তা তো। জানি না। সেদিন একটা আধপাগল লোক আমাদের রকে বসে আছে। প্রায় উদোম, পরনের ফুলপ্যান্ট কোলের ওপর ফেলে বোতাম বসাচ্ছে। আমাকে দেখে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে, ‘আমার

আবার ভয় কী! আমার ছুঁচ, সুতো, বোতাম সবই আছে। বোতাম ছিড়বে, নিজে নিজেই বসিয়ে নোব। আর যেদিন প্যান্টটাই ছিঁড়ে যাবে সেদিন কী করব! বোতাম তুমি বসবে কোথায়।’ আমাকে বললে, ‘শোনো’। কাছে গেলুম। খুব চুপিচুপি বললে,—’দারা পুত্র পরিবার সবই হল বোতাম। বুঝলি ব্যাটা ফুলপ্যান্ট!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *