Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ব্রেন ডিটেকটিভ || Adrish Bardhan

ব্রেন ডিটেকটিভ || Adrish Bardhan

ব্রেন ডিটেকটিভ

বাইশটা টেলিভিশন আমার সামনে অর্ধচন্দ্রাকারে সাজানো রয়েছে। রাডারও বলা চলে। এদের কাজই নাকি তাই। বায়োর্যাডিয়েশন অর্থাৎ চিন্তাকে লুফে নিয়ে ফুটিয়ে তোলা পরদার বুকে। দেখানো রঙের খেলা। সেই সঙ্গে উত্তাল সঙ্গীত।

ঘরটা বেশ বড়ই। ডক্টর বাসু মিত্রের গবেষণা কক্ষ। ঘরভরতি মেশিনের সব মেশিন আমি নিজেও চিনি না। যদিও আমি ডাক্তার, ইলেকট্রো-এনকেফালোগ্রাফি চার্টটা চিনতে পারছি। কিন্তু তার পাশে যেসব কিম্ভুতকিমাকার মেশিন পরিপাটিভাবে সাজানো, তাতে শয়ে-শয়ে রেডিও টিউব দেখতে পাচ্ছি। শয়ে-শয়ে প্যানেলও রয়েছে ঘরময়। দেখেশুনে হঠাৎ মনে হবে বেশ কয়েকজন সুদক্ষ অপারেটর দরকার এসব মেশিন চালানোর জন্যে।

কিন্তু মনে হওয়াটা যে মিথ্যে, তা একদিন কাজের সময়ে ঘরে ঢুকলেই বোঝা যাবে। টাকমাথা প্রৌঢ় ডক্টর বাসু মিত্র একাই অপারেট করেন যাবতীয় মেশিন। বহু মেশিন তিনি নিজে বানিয়ে নিয়েছেন। ভদ্রলোক কদাকার। ছেলেবেলায় পড়ে গিয়ে পিঠ বেঁকে গিয়েছিল–সেই থেকে কুঁজো। মুখে অজস্র আব–হঠাৎ দেখলে ভয় হয়। আব ঝুলছে হাত থেকে, ঘাড় থেকে, কপাল থেকে, চিবুক থেকে। আবের জঙ্গলের মধ্যে চোখ জোড়া কিন্তু আশ্চর্য সুন্দর। স্বপ্নময়, উদাস এবং আত্মনিমগ্ন।

বাসু মিত্র সত্যই ভোলা মহেশ্বর। মালা মিত্র তার পার্বতী। উমার মতোই পরমাসুন্দরী। বয়সের তফাত বিশ বছরের। মালা শুধু রূপসি নয়–গুণবতীও। রেডিও, মিউজিক কনফারেন্স, ছায়াছবি সব মহলে সে নাইটিঙ্গেল আখ্যা পেয়েছে তার সুরেলা কণ্ঠের জন্যে। মালা মন দিয়ে গান গাইলে শুকনো আকাশে বৃষ্টি ঝরতে পারে–মোমবাতিতে আগুন লাগতে পারে।

এ-সব অবশ্য স্তাবকদের প্রশস্তি। মালা মিত্র ভ্রূক্ষেপ করে না। বাসু মিত্র নাকি তার গান শুনেই বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু এখন শোনেন না। মালার সঙ্গে সব দিন দেখাও হয় না…গবেষণা কক্ষে রাত কাটান।

আমি বিলেত ফেরত ডাক্তার। ব্রেন স্পেশালিস্ট। বিলেতে থাকতেই কয়েকটা পেপারে তার প্রবন্ধ পড়েছিলাম। মানুষের মস্তিষ্ক আজও চিররহস্যে ঘেরা। তিনি সেই মস্তিষ্ক নিয়েই গবেষণা করছেন। ফিংগার প্রিন্ট আর ব্রেনপ্রিন্ট–দুটো দিয়েই নাকি ক্রিমিন্যাল ধরা যায়। ফিংগারপ্রিন্ট যেমন অপরাধীদের সনাক্ত করে–ব্রেনপ্রিন্টও তেমনি ব্রেনের গন্ডগোলের খবর দিতে পারে।

পশ্চিমের প্রেসে ডক্টর বাসু মিত্রকে নিয়ে তাই কার্টুন আর ব্যঙ্গ বেরিয়েছিল। ব্রেন ডিটেকটিভ–এই আখ্যা পেয়েছিলেন তিনি। দেশে ফেরার পর সুযোগমতো গেলাম তার বাড়ি। আলাপ করলাম। এবং দুটি জিনিস ভালো লাগল।

একটি তার টপোস্কোপি–অর্থাৎ বাইশটা টেলিভিশন সমন্বিত ব্রেন ডিটেকটিভ মেশিন। দ্বিতীয়টি মালা মিত্র।

বাসু মিত্রের বাড়ি যাওয়া বেড়ে গেল এরপর থেকে টপোস্কোপির জন্যে নয়–মালার জন্যে। মালার গান শুনতে, ওর সঙ্গে কথা বলতে। বাসু মিত্রের সঙ্গে অর্ধেকদিন দেখাই হত না। উনি গবেষণাকক্ষে বসে টপোস্কোপি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। ব্রেনের ইলেকট্রিক্যাল রিকে উনি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক মেশিনের মধ্যে দিয়ে এনে ইলেকট্রন গ্যাজেটের ভেতরে চালান করে ফ্ল্যাশ আর সাউন্ডে রূপান্তর করতে পেরেছেন। এখন চাইছেন চিন্তা অর্থাৎ বায়োর্যাডিয়েশনকে যন্ত্রের মধ্যে টেনে আনতে।

আমি ব্রেন স্পেশালিস্ট বলেই বুঝেছিলাম, আবিষ্কারটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমার ব্রেন তখন অন্য বিষয়ে নিমগ্ন–মালা একটু-একটু করে যেন আমাকে সম্মোহিত করে ফেলছিল। আমি বিলেতে দশবছর ছিলাম। বহু মেয়ের সঙ্গে মিশেছি। কিন্তু মালার মতো কেউ আমাকে এভাবে আকর্ষণ করেনি। ও যখন হাসত মনে হত যেন দুচোখে দুটো জোনাকি জ্বলছে–ওর সমস্ত রূপ জড়ো হয়েছিল আশ্চর্য সুন্দর বুদ্ধি উজ্জ্বল ওই দুটি জোনাকি চোখের মধ্যে। সে চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না–মনে হয় একজোড়া ফিল্ড বাইনাকুলার আমার মনের অন্তস্থল পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে।

মালাও দেখেছিল। মালা আমার মন বুঝেছিল। কিন্তু আমি বুঝিনি। আমিও মালাকে দুর্বারভাবে টেনেছি আমার দিকে। আমি লেডি কিলার নই। কিন্তু লোকে বলে আমি হ্যান্ডসাম, স্মার্ট, টল। তারপর ব্যাচেলর। সেইজন্যেই কি মালা ওর জোনাকি চক্ষু দিয়ে বশ করল আমাকে? না, কদাকার বাসু মিত্রের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য একটা অবলম্বনই শুধু চেয়েছিল? সে প্রশ্নের জবাব আজও পাইনি।

মন জানাজানি কিন্তু একদিনে হয়নি। আমরা দুজনেই পূর্ণবয়স্ক। অথচ যে অন্ধ আবেগ, প্রচণ্ড আকর্ষণ, অপরিসীম শূন্যতা বুকের মধ্যে বহন করতাম সারাটা দিন–তা কিশোর বয়সেই মানায়। কিন্তু প্রেম বয়স মানে না, স্থান-কাল-পাত্রের তোয়াক্কা করে না। তাই প্রেম দরিয়ায় পুরোপুরি হাবুডুবু খেয়ে গেলাম বিজ্ঞান সাধক বাসু মিত্রের রূপসি যুবতী সঙ্গীত সাধিকা স্ত্রীর সঙ্গে।

যে দিনের কথা বলছি, সেদিন ডক্টর মিত্র আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। টপোস্কোপি নাকি শেষ হয়ে এল। আমি যেন একবার এসে দেখে যাই। খবরটা মুচকি হেসে দিল মালা। গাল টিপে দিয়ে বললে, যাও, খেলাঘরে খেলা করে এসো।

মালা ডক্টর মিত্রের ল্যাবোরেটরিকে বলত খেলাঘর। আর, স্বামীদেবতাকে বলত বুড়ো খোকা। এটুকু বুঝতাম, মালা হাঁপিয়ে উঠেছে। ওর জগৎ অন্য রুক্ষ নীরস তাপসের সঙ্গে গ্রন্থিতে আবদ্ধ থাকলে তার চলে না। তাই মুক্তি চায়। গত পূর্ণিমায় গঙ্গার পাড়ে বসে আমার কাঁধে কাঁধ রেখে বিশাল চাঁদের পানে চেয়ে বলেছিল ফিসফিস করে, পারবে না আমাকে নিয়ে যেতে? অনেক দূরে…যেখানে কেবল গান আর গান…বিজ্ঞান নেই, মেশিন নেই, অঙ্ক নেই?

গাঢ় কণ্ঠে বলেছিলাম, পারব, মালা।

বাইশটা টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম সেদিনের কথা। মালা নিউমার্কেটে গেছে। ডক্টর মিত্র আমাকে বসতে বলে লাইব্রেরিতে গেছেন। আমি বসে বসে ভাবছি সেদিনের কথা। সেদিন মালা আমার অনেক কাছে এসেছিল…অনেক…অনেক কাছে।

পায়ের আওয়াজ পেলাম। ঘরে ঢুকলেন বাসু মিত্র। কুঁজো হয়ে থাকার দরুন ভদ্রলোকের চাউনির ধরনটা অদ্ভুত। তীক্ষ্ণ চোখে আমার পানে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর অদ্ভুতভাবে হেসে বললেন, দিবাস্বপ্ন দেখছিলেন বুঝি?

চমকে উঠলাম। পরক্ষণেই জোর করে মুখে হাসি টেনে এনে বললাম, না, না, আপনার মেশিনগুলোর কথা ভাবছিলাম।

সারি-সারি প্যানেল বসানো অদ্ভুতদর্শন টপোস্কোপির পানে উদাস চোখে তাকিয়ে রইলেন বাসু মিত্র। আবার চোখের তারায় দেখলাম সুদূরের সেই স্বপ্ন।

আবার সেইরকম বিচিত্র হেসে বললেন, হ্যাঁ, আজব মেশিন। ব্রেন ডিটেকটিভ। তাই না?

ফরেন কমেন্ট তাই বটে।

খুব মিথ্যে কমেন্ট নয় কিন্তু। ব্রেনপ্রিন্ট থেকে সার্কিট বানিয়ে নিয়ে মেমারি ব্যাঙ্কেও গোয়েন্দাগিরি করা যায়। একটু হেসে বললেন, যে মেমারি আপনি ডিজক্লোজ করতে চান না তাও।

শেষ কথাটা ডক্টর মিত্র কীরকম যেন ফিসফিস করে বললেন। ওঁর কথা বলার ধরন এমনিতে কর্কশ। গলা নামিয়ে নরম গলায় কথা বলতে জানেন না। তাই গলার স্বর হঠাৎ খাদে নেমে আসায় অস্বাভাবিক শোনাল।

উনি কুঁজো পিঠ নিয়ে শরীরটাকে দুলিয়ে দুলিয়ে ততক্ষণে প্যানেলগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। পটাপট কয়েকটা সুইচ টিপে দিতেই ঘর অন্ধকার হয়েই মৃদু নীলাভ আলোয় আলোকিত হয়ে রইল। চারিদিকে যেন তারার আলো জ্বলতে লাগল–মাঝখানে আমি নরম কুশন মোড়া কালো। চেয়ারে বসলাম।

ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম, আমার পানে নির্নিমেষে চেয়ে রয়েছেন বাসু মিত্র। নীলাভ অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না কিন্তু মনে হচ্ছে যেন দু-টুকরো নীল আগুন জ্বলছে দুই চোখে। পরক্ষণেই বুঝলাম, চোখের ভুল। নীলাভ আলোর রিফ্লেকশনে নীল আগুনের মতো জ্বলছে চশমার কাঁচ।

বললাম, আপনার টপোস্কোপ রেডি?

হ্যাঁ, রেডি, কাটা-কাটা স্বর ভেসে এল নীলাভ অন্ধকার পেরিয়ে, এখুনি দেখবেন ব্রেন ডিটেকটিভদের গোয়েন্দাগিরি–শুনতেও পাবেন।

বিরক্তি লাগছিল ডক্টর মিত্রের হেঁয়ালিতে। আমি প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। সময়ের দাম অনেক। অনেকক্ষণ ধরে বসিয়ে রাখার জন্যে বিরক্ত হইনি মালা-স্বপ্নে বিভোর ছিলাম বলে। কিন্তু এবার হলাম।

বললাম ঈষৎ উষ্ণ স্বরে, একটু তাড়াতাড়ি করুন। চেম্বারে যেতে হবে।

উত্তরে হাসির শব্দ শুনলাম। কর্কশ হাসি। কিন্তু কথাগুলো ছুঁড়ে-ছুঁড়ে দিলেন যেন বিনয়ের রসে ডুবিয়ে-ডুবিয়ে।

বললেন, ডাক্তার, আপনি ভালোবাসার রং জানেন? ঊষার আলোর মতো কখনও গোলাপি। রাগলে এই রঙই কালো। ঈর্ষায় ধূসর বাদামি। কামনায় ড্রাগন-লাল।

কী বলতে চান ডক্টর? ধাঁধায় পড়লাম। কথায় বলে, কানা খোঁড়া কুঁজো–তিন চলে না উজো। এরা কখনওই সোজা পথে যায় না কুঁজো বাসু মিত্রও কোন পথে আসছেন বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকাই মঙ্গল মনে করলাম।

নীলাভ অন্ধকারের মধ্যে সেইরকম পাথরে পাথর ঘষার মতো কর্কশ স্বরে ডক্টর তখনও বলে চলেছেন–ঠিক তেমনি মানুষের মাথার মধ্যে সুর আছে–গানের সুর, আনন্দের সুর, উদ্বেগের সুর, ভালোবাসার সুর মনের ভাবতরঙ্গ যেরকম ঠিক সেইমতো ইলেকট্রিক্যাল রিদম উঠছে ব্রেনের মধ্যেও। এতদিন আপনি চার্টে আলোর নাচ দেখেছেন–এবার দেখবেন শব্দ আর রঙের মধ্যে। একটু থেমে গলা নামিয়ে বললেন খসখসে গলায়, সেই সঙ্গে চেহারা চিন্তার চেহারা!

বলার সঙ্গে-সঙ্গে খটাং করে একটা আওয়াজ হল। আমার চোখের পরদার ওপর ফেটে পড়ল একসঙ্গে বাইশটা টেলিভিশনের রক্তলাল আলোক উচ্ছ্বাস। ক্ষণেকের জন্যে অতি উজ্জ্বল রক্তাক্ত ফ্লাশে আমি যেন অন্ধ হয়ে গেলাম। একই সঙ্গে কানের পরদার ওপরেও ফেটে পড়ল প্রমত্ত ঝড়ের অট্টনিনাদ। কানের টিমপ্যানিক মেমব্র্যান যেন ফেটে চৌচির হয়ে গেল। সারা ঘরটাকে যেন নিমেষ মধ্যে লক্ষ করতালি বাজিয়ে উড়িয়ে ফাটিয়ে শূন্যমার্গে বিলীন করে দিতে চাইল সেই শব্দ বিস্ফোরণ।

চোখ বন্ধ করে কানে হাত চাপা দিয়ে চিৎকার করে বললাম, একী করছেন? অ্যাডজাস্ট করুন–তাড়াতাড়ি।

কর্ণবধিরকারী সেই প্রলয়ংকর শব্দ ছাপিয়ে বাসু মিত্রের জবাব শুনতে পেলাম না বটে, কিন্তু আস্তে-আস্তে ক্ষীণ হয়ে এল বাইশটা অ্যামপ্লিফায়ারের সম্মিলিত বজ্রনির্ঘোষ। চোখের পাতার ওপরেও আলোয় ঝলক স্তিমিত হয়ে আসতে চোখ খুললাম ধীরে-ধীরে।

কী দেখলাম? দেখলাম, ড্রাগন-লাল ঘোর লোহিতবর্ণ তিরোহিত হচ্ছে বাইশটা পরদার বুক থেকে। যেন বাইশটা ঘূর্ণিপাক রক্তের সাগরে মিলিয়ে যাচ্ছে আস্তে-আস্তে।

কানের কাছে শুনলাম ফিসফিসানি, কামনার রং।

চমকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম, আমার ঠিক পেছনটিতে এসে দাঁড়িয়েছেন বাসু মিত্র। পিঠ বেঁকিয়ে প্রোজ্জ্বল চোখ দুটো নিবদ্ধ রেখেছেন অর্ধচন্দ্রাকারে সাজানো বাইশটা পরদার দিকে। বাইশটা রক্তলাল ঘূর্ণিপাকের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে চশমার কাছে।

ফিসফিস করে ফের বললেন ডক্টর, দেখুন, দেখুন ভালোবাসার রং।

বজ্রগর্জন মিলিয়ে গেল। কান জুড়িয়ে গেল যেন বীণার ঝংকারে। অজানা অপার্থিব রাগরাগিনী অশ্রুতপূর্ব অর্কেস্ট্রায় বেজে চলেছে…চলেছে। পৃথিবীর কোনও ভাষা কোনও সঙ্গীতের স্বরলিপি দিয়ে অলৌকিক সেই সঙ্গীতের ব্যাখ্যা করা যায় না। পরদার বুকে সেইসঙ্গে আরম্ভ হয়েছে। গোলাপি রঙের খেলা। অজস্র গোলাপ ফুল যেন নিংড়ে রং ঢেলে দিয়েছে বাইশটা পরদায়। দেখতে দেখতে অদৃষ্টপুর্ব সেই রঙের জোয়ার বর্ণালীর ওপর দিয়ে ধেয়ে গিয়ে ভোরের রাঙা আকাশের মতো অপরূপ হয়ে উঠল। কানের ওপর সুরের খেলাও বুঝলাম মোড় নিয়েছে।

ফিসফিস করে বললেন বাসু মিত্র, প্রথমে যা দেখলেন–তা মালার ব্রেনপ্রিন্ট। গত পূর্ণিমায় গঙ্গার ঘাট থেকে ফিরে ও যখন ঘুমন্ত, তখন মেমারি ব্যাঙ্ক থেকে লুঠ করেছি চিন্তার রং কামনার রং। আর এখন যা দেখলেন তা আপনার ব্রেনপ্রিন্ট–একটু আগের ভাবনার রং। আপনি বড় রোম্যান্টিক, ডক্টর, তাই না? বড় বেশি রোম্যান্টিক।

আমি মুখ খুলতে গেলাম, কিন্তু তার আগেই হাত তুলে বাইশটা পরদার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ডক্টর বললেন, ধূমকেতু! ধূমকেতু!

সচমকে দেখলাম, রক্তবর্ণ অগ্নিগোলক পেছনে কালচে বেগুনি রঙের পুচ্ছ উড়িয়ে বনবন করে পাক দিচ্ছে বাইশটা পরদায়। ফুলঝুড়ির মতো অজস্র লাল কালো বাদামি বেগুনি রং ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে। ঘোরার পথে ঘন-ঘন প্রদীপ্ত হয়েই যেন নিস্তেজ হয়ে আসছে ধূমকেতুর মুণ্ড পরক্ষণেই জ্বলে উঠছে দ্বিগুণ তেজে। পরদা জুড়ে অতিপ্রাকৃত অনৈসর্গিক সেই আলোর খেলা পৃথিবীর কোনও বর্ণালীতে আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি।–ডক্টরের কথাই যদি সত্য হয়–এ রং মনের রং– চোখ কখনও দেখেনি।

আলোক তরঙ্গ কিন্তু অত্যন্ত চঞ্চল, অস্থির। ঘন-ঘন নতুন-নতুন কোণ থেকে মোচড় নিয়ে আছড়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে সম্পূর্ণ নতুন আওয়াজে মুখরিত হয়েছে বাইশটা অ্যামপ্লিফায়ার। জল স্থল অন্তরীক্ষ যেন একসাথে প্রলয় নাচে নেচে চলেছে। অট্ট-অট্ট হাসি হেসে লক্ষ করে তালি দিয়ে যেন জল ফুঁসছে, ঢেউ আছড়াচ্ছে, শিলাময় বিস্তীর্ণ উপকূলে হু-হুঁঙ্কারে ভেঙে পড়ছে সাইক্লোন তাড়িত দানবিক তরঙ্গ। বাড়ছে জলোচ্ছ্বাসের শব্দ–সেই সঙ্গে ফাটছে যেন কানের পরদা। তালে তাল মিলিয়ে জল যেন ঘুরছে, শূন্যে উঠছে; আকাশ যেন নীচু হয়ে চুম্বন করতে চাইছে সাগরের জলকে আকাশ আর সাগর যেন মুখে মুখ দিয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে চাইছে, যেন জলস্তম্ভ রচিত হচ্ছে। ঘুরন্ত জলরাশি আর ঘূর্ণিঝড়ের সম্মিলিত দাপটে।

ধ্বনিময় জলনির্ঘোষ যখন রূপময় হয়ে উঠেছে মনের পরদায়, ঠিক তখনি যেন যাদুমন্ত্রবলে ক্ষীণ ক্ষীণতর ক্ষীণতম হয়ে মিলিয়ে গেল বাইশটা পরদায় ধূমকেতুর ঘূর্ণন–অপার্থিব নাচন। মিলিয়ে গেল মহাশূন্যতায়–ধূ-ধূ শূন্যতার মধ্যে বাইশটা পরদায় যেন কুয়াশার মতো অস্বচ্ছ অস্পষ্ট কৃষ্টালদানা শূন্য হতে এসে জমা হতে লাগল পরদার বুকে…যেন অগুন্তি নক্ষত্রখচিত বাইশটা ছায়াপথ লাটুর মতো বনবন করে ঘুরতে-ঘুরতে জমাট বাঁধতে লাগল মধ্যিখানে…জ্যোতির্ময় হাজারটা সুপার রামধনু যেন একযোগে পাকসাট খেয়ে গেল পরদার বুকে..তারপর অকস্মাৎ, নেহাতই আচম্বিতে, আমার মনের ঘোর সন্দেহকে প্রকট করে দিয়ে নিমেষ মধ্যে আবছা আকারে জেগে উঠল দুটি মুখ– অজস্র রঙে রঞ্জিত, আবেগে বিহ্বল, আবেশে স্নিগ্ধ শুধু দুটি মুখসৃষ্টির শুরুতে যেভাবে আদম আর ঈভ চেয়েছিল পরস্পরের পানে–একান্ত সন্নিকটে ঠিক তেমনিভাবে ওরা নিষ্পলকে চেয়ে আছে পরস্পরের পানে এবং সে মুখ আমার আর….

কানের ওপর সমুদ্রনির্ঘোষ নায়াগারূপ বজ্রনাদে ফেটে পড়ল। পৃথিবীর কোনও জানা রূপক দিয়ে ভাষা দিয়েও সেই গুরুগম্ভীর সঙ্গীতকে বোঝানো যায় না। দেহমন অবশ করা অবর্ণনীয় সেই নিনাদের বুক চিরে শোনা গেল বাসু মিত্রের পাথরে পাথর ঘষা কণ্ঠে একটি মাত্র চিরন্তন শব্দ। কানের কাছে মুখ এনে নীরস উদাস বিষণ্ণ কণ্ঠে শুধু বললেন : চুম্বন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress