বেশি দূরে নয় – ০২
সাইকেলের হ্যাণ্ডেলের দু’ধারে দুটো আর ক্যারিয়ারে আরও একটা পেল্লায় সাইজের ঠাস- ভর্তি নাইলনের ভারী ব্যাগ চাপিয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে যে লোকটা সে হল গঙ্গারামপুর বাজারের ছোট দোকানদার প্রীতম। সপ্তাহে দু’দিন বিকেল চারটে ছত্রিশের লোকালে এসে নামে। কুতুবের দোকানের পিছনে সাইকেলের খোঁয়াড় থেকে নিজের দীনদরিদ্র সাইকেলখানায় মালপত্র চাপিয়ে সেই গন্ধমাদন ঠেলতে ঠেলতে গঙ্গারামপুর পর্র্যন্ত যায়। কোনও দিকে তাকায় না। অত বোঝা টানলে কি আর মানুষ মানুষের মতো থাকে? হালের বলদের মতো হয়ে যায়। কিন্তু তাকালে, এই কার্তিকের বিকেলের মায়াময় আলোয় শিকদারবাড়ির বারান্দায় শেফালিকে ঠিক দেখতে পেত। প্রীতম শেফালিকে দেখতে পায় না বটে, কিন্তু শেফালি প্রীতমকে দেখতে পায় এবং দেখে। বলতে নেই, শত কাজ থাকলেও সপ্তাহে দু’দিন ঠিক সাড়ে চারটের লোকাল আসার সময়টায় শেফালি বারান্দায় এসে দাঁড়াবেই।
না, প্রীতম ঠিক মানুষ নয়, খানিকটা মানুষ, বাকিটা এক বলশালী, গোঁয়ার অবুঝ জন্তু। টালমাটাল সাইকেলখানাকে ওই ভারী মাল সমেত সামলানোর জন্য গায়ের জোর লাগে। প্রীতমের সেটা আছে। কিন্তু শুধু গায়ের জোর থাকলেই তো হবে না গো! তোমার আর কিছু নেই? চোখ নেই তোমার? দেখতে পাও না, তোমার জন্যই একটা তাজা বয়সের মেয়ে কেমন লাতন হয়ে, বিভোর হয়ে চোখ বিছিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে? তাও তো রোজ তোমার দেখা নেই। সপ্তাহে মোটে দুটো দিন।
যত দূর দেখা গেল চেয়ে রইল শেফালি। কী চওড়া পিঠ, দু’খানা শাবলের মতো হাত, একটু কুঁজো হয়ে সাইকেল ঠেলে নিয়ে চলেছে। যেন এ ছাড়া ওর আর কোনও কাজ নেই দুনিয়ায়।
প্রীতম চলে গেলে শেফালির বিকেল ফুরিয়ে যায়। অনেক ক্ষণ আর কিছুই থাকে না। সব ‘না’ হয়ে যায়। সে যে খুব সুন্দরী মেয়ে তা নয়, আবার কুচ্ছিতও নয়। তাকে দেখে কেউ কখনও বলেনি, ‘বাঃ, কী সুন্দর মুখখানা’, বা বলেনি, ‘ইস কী কুচ্ছিত রে’! বড্ড মাঝারি মেয়ে সে। নিজেকে আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার করে দেখে সে। কখনও পছন্দ হয়, কখনও হয় না। কিন্তু চেহারা ছাড়া কি মেয়েদের আর কিছু নেই? শুধু দেখনসই হলেই হল?
‘পিউ স্টোর্স’- এ সে এক আধবার গেছে। প্রীতমের দোকান। চোখ তুলে দোকানির দিকে চাইতে সাহস হয়নি। পেনসিল, মাথার তেল বা ওই রকম কিছু কিনে কাঁপা হাতে দাম দিয়ে মুখ নিচু করে চলে এসেছে। তার বেশি এগোতে পারেনি কখনও। ও সব জিনিস পাড়ার দোকানেই পাওয়া যায়। তবু যে এত দূর কষ্ট করে যায় সে তা কি কেউ টের পায়, বোঝে?
আজও একটু সেজেই দাঁড়িয়ে ছিল শেফালি। কোনও কাজে লাগল না। মধুমিতাকে সে সব বলে। তার গলাগলি বন্ধু। মধুমিতা বলে, দাঁড়া না, ঠিক একটা ব্যবস্থা হবে। তবে প্রীতমদারা কিন্তু বড্ড গরিব। এখন অবশ্য ততটা গরিব আর নেই।
—গরিব তো কী? গরিবরাই ভাল।