বেয়ারিং ছাঁট – Tenida Samagra
পটলডাঙার টেনিদা, আমি আর হাবুল সেন চাটুজ্যেদের রকে বসে মন দিয়ে পেয়ারা খাচ্ছি। হঠাৎ দেখি, ক্যাবলা বেশ কায়দা করে–নাকটাকে উচ্চিংড়ের মতো আকাশে তুলে সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। কেমন একটা আলেকজাণ্ডারের মতো ভঙ্গি যেন দিগ্বিজয় করতে বেরিয়েছে।
টেনিদা খপ করে একটা লম্বা হাত বাড়িয়ে ক্যাবলাকে ধরে ফেলল।
বলি, অমন তালেবরের মতো যাওয়া হচ্ছে কোথায়? নাকের ডগায় একটা চশমা চড়িয়েছিস বলে বুঝি আমাদের দেখতেই পাসনি।
ক্যাবলা বললেন, দেখতে পাব না কেন? একটু কাজে যাচ্ছি
–এই রোববার সকালে কী এমন রাজকার্যে যাচ্ছিস র্যা! নেমন্তন্ন খেতে নাকি? তা হলে আমরাও সঙ্গে যাই।
ক্যাবলা গম্ভীর হয়ে বললে, না–নেমন্তন্ন না। আমি চুল ছাঁটতে যাচ্ছি।
চুল ছাঁটতে?–টেনিদা শুনে দারুণ খুশি হল : ডিলা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস। চল- আমিও যাচ্ছি।
এইবার আমার পালা। আমি চেঁচিয়ে বললুম, খবরদার ক্যাবলা, টেনিদাকে সঙ্গে নিয়েছিস কি মরেছিস! গত বছর টেনিদা আমাকে এমন একখানা গ্রেট-ছাঁটাই লাগিয়েছিল যে আমার বউভাতের নেমন্তন্ন খাওয়া একদম বরবাদ।
টেনিদা বটে বললে, তুই একটা পয়লা নম্বরের পেঁয়াজ-চচ্চড়ি। বেশ ডিরেকশন দিয়ে দিয়ে চুল ছাঁটাচ্ছিলুম- চেঁচিয়ে-মেচিয়ে ভণ্ডুল করে দিলি। না রে ক্যাবলা, তোর কোনও ভয় নেই। আমি অ্যায়সা কায়দা করে তোর চুল ছাঁটিয়ে আনব যে, কী বলে- তোর মাথা দিয়ে কী বলে–একেবারে শিখা বেরুতে থাকবে।
হাবুল বললে, হ, শিখাই বাইর হইব। শিখার মানে হইল গিয়া টিকি।
আমি বললুম, তা বেশ তো তুই টিকিই রাখ ক্যাবলা। আমরা সবাই বেশ করে টানতে পারব!
টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, টেক কেয়ার! টিকি নিয়ে টিকটিকির মতো টিকটিক করবিনে– বলে দিচ্ছি? শিখা মানে বুঝি আর কিছু হয় না? তা হলে আলোর শিখা মানে কী? আলোর টিকি? আলোর কখনও টিকি হয়? কোন্ দিন বলবি, অন্ধকারের টিকি চাঁদের টিকি–
হাবুল খুব জ্ঞানীর মতো বললে, চাঁদের টিকি ধইর্যা রাশিয়ানরা তো টান মারছে।
আমি বাধা দিয়ে বললুম, কক্ষনো না। চাঁদের মাথা ন্যাড়া আমাদের পাড়ার নকুলবাবুর মতো। চাঁদের টিকি নেই।
ক্যাবলা বললে, উঃ–এরা তো মাথা ধরিয়ে দিলে দেখছি। ঘাট হয়েছে, আমি আর চুল ছাঁটতে চাই না। এই বসছি।
টেনিদা হতাশ হয়ে বলল,বসলি?
হ্যাঁ, বসলুম।
–আমাকে নিয়ে চুল ছাঁটতে যাবিনে?
না। ক্যাবলার মুখে একটা কঠিন প্রতিজ্ঞা দেখা দিলে : তোমাকে নিয়ে তো নয়ই। প্যালার সেই গ্রেট ছাঁটাই আমি দেখেছি, ও যে গল্পটা লিখেছিল মনের দুঃখে, সেটাও পড়েছি।
টেনিদা মন খারাপ করে বললে, তোর ভালোর জন্যেই বলেছিলুম। মানে আমার ভুলোদার মতো সস্তায় কিস্তিমাত করতে গিয়ে না পস্তাস, সেইজন্যেই বলছিলুম।
আমি বললুম, ব্যাপারটা খুলে বলো তা হলে। কী হয়েছিল তোমার ভুলোদার?
-কী হয়েছিল ভুলোদার? টেনিদা টকাং করে আমার চাঁদিতে ছোট্ট একটা গাঁট্টা মারলে : ফাঁকি দিয়ে গপ্পোটা বাগাবার চেষ্টা আর সেইটে পত্রিকায় লিখে দেবার মতলব? ও-সব চালাকি চলবে না। ভুলোদার সেই প্যাথেটিক কাহিনী শুনতে হলে চার আনার তেলেভাজা আগে আনো-কুইক।
আমার পকেটে দুআনা ছিল, আরও দুআনা হাবুলের কাছ থেকে আমায় ধার করতে হল।
.
দুখানা বেগুনি একসঙ্গে মুখে পুরে দিয়ে টেনিদা বললে, আমার ভুলোদা– মানে আমাদের দূর সম্পর্কের জ্যাঠামশাইয়ের এক ছেলে পয়সাকড়ির ব্যাপারে ছিল বেজায় টাইট। জ্যাঠামশাইয়ের টাকার অভাব ছিল না, ভুলোদাও কী সব ধানপাটের ব্যবসা করত কিন্তু একটা পয়সা খরচ করতে হলে ভুলোদার চোখ কপালে উঠে যেত।
বললে বিশ্বাস করবিনে, একদিন বাজারে গিয়ে টুক করে একটা নয়া পয়সা পড়ে গেল নালার ভেতরে। বাজারের নালা- বুঝতেই পারছিস! যেমন নোংরা– তেমনি বদখত গন্ধ তার ওপরে এক হাত পাঁক। দেখলেই নাড়ি উলটে আসে। কিন্তু ভুলোদা ছাড়বার পাত্তর নয়। এক ঘণ্টা ধরে দুহাতে সেই নালা ঘাঁটলে। আর একটার বদলে চার-চারটে নয়া পয়সা মিলল তার ভেতর থেকে, একটা অচল সিকি পেলে দুটো মরা শিঙিমাছ আর জ্যান্ত একটা খলসে মাছও পেয়ে গেল! তিনটে নয়া পয়সা নগদ লাভ হল, সেদিন আর মাছও কিনতে হল না।
হাবুল বললে, এ রাম?-থু-থু
টেনিদা বললে, থু-থু? জানিস, ভুলোদা এখন কত বড়লোক? বাড়িতে গামছা পরে বসে থাকে, কিন্তু ব্যাঙ্কে তার কত টাকা!
ক্যাবলা বললে, আমাদের বড়লোক হয়ে কাজ নেই, বেশ আছি। পচা ড্রেন থেকে মরা শিঙিমাছ খেতে পারব না– গামছা পরেও বসে থাকতে পারব না।
টেনিদা বললে না, না পারবি তো যা–কচুপোড়া খে গে।
আমি ব্যস্ত হয়ে বললুম, আঃ-ঝগড়া করছ কেন? গল্পটা বলতে দাও না।
টেনিদা গজগজ করতে লাগল; ই– বড়লোক হবেন না। না হলি তো না হলি– অত তড়পানি কিসের জন্যে র্যা? মরা শিঙিমাছ খেতে না চাস, জ্যান্ত তিমি মাছ খা গামছা পরতে না চাস আলোয়ান পরে বসে থাক। ওসব ধ্যাষ্টামো আমার ভালো লাগে না—হুঁ!
আমি বললুম, গপ্পোটা–
গপ্পোটা! টেনিদা মুখটাকে ডিম-ভাজার মতো করে বললে, ধ্যৎ। খালি কুরুবকের মতো বকবক করলে গপ্পো হয়?
ক্যাবলা বললে, কুরুবক এক রকমের ফুল। ফুল কখনও বকবক করে না।
টেনিদা চেঁচিয়ে বললে, শাট আপ? আমি বলছি কুরুবক এক রকমের বক– খুব বিচ্ছিরি বক। ফের যদি আমার সঙ্গে তক্কো করবি, তা হলে আমি এক্ষুনি কাঁচি এনে তোকে একটা গ্রেট ছাঁটাই লাগিয়ে দেব।
শুনে ক্যাবলার মুখ টুখ একবারে শুঁটকী মাছের মতো হয়ে গেল। বললে, নানা, তুমি বলে যাও। আমি আর তক্কো করব না।
করিসনি। বেঘোরে মারা যাবি তা হলে। বলে কুরুবক একরকমের ফুল। তা হলে। গোরুও একরকমের ফল, রসগোল্লা একরকমের পাখি, বানরগুলোও একরকমের পাকা তাল! যা–যা–চালাকি করিসনি।
আমি বললুম, কিন্তু ভুলোদা
–আরে গেল যা! এটা যে ভুলোদা-ভুলোদা করে খেপে যাবে দেখছি!–টেনিদা আমার চাঁদিতে আর একটা গাঁট্টা মারলে; শিঙিমাছ দিয়ে নিজেও পটোলের ঝোল খায় কিনা– তাই এত ফুর্তি হয়েছে। বলে তেলেভাজার ঠোঙা থেকে শেষ আলুর চপটা মুখে পুরে দিয়ে বললে, একদম সাইলেন্স! নইলে গল্প আমি আর বলব না।
আমরা বললুম, আচ্ছা–আচ্ছা!
টেনিদা শুরু করল :
ভুলোদা পশ্চিমে কোথায় ব্যবসা করত। ওদেশে থাকবার জন্যে আর পয়সা বাঁচাবার জন্যে তো বটেই, একেবারে পুরোপুরি দেশোয়ালি বনে গিয়েছিল। মোটা কুর্তা পরত, পায়ে দিত কাঁচা চামড়ার নাগরা গড়গড়িয়ে দেহাতী তালুতে সব সময় খইনি ডলত। পানকে বলতে পানোয়া–সাপকে বলত সাঁপোয়া। আমরা কিছু জিগ্যেস করলে অন্যমনস্কভাবে জবাব দিত–কুছ, কহলি হো?
কামাতে খরচ হবে বলে দাড়ি রেখেছিল। তাতে বেশ সাধু সাধু দেখাত আর গাঁয়ের সাদাসিধে মানুষ কিছু ভক্তি-ছেদ্দাও করত। কিন্তু চুলটা মাঝে-মাঝে না কাটলে মাথা কুটকুট করে। তা ছাড়া কী বলে- রাত-দিন টাকার ধান্দায় ঘুরে ভুলোদা খুব সাফসুফ থাকতেও পারে না। জামা কাচে মাসে একবার, চান করে বছরে চারবার। তাই চুল একটু বেশি বড় হলেই উকুন এসে বাসা বাঁধে। কিন্তু চুল ছাঁটাইয়েও ভুলোদার খরচ ছিল না। বেশ একটা কায়দা করে নিয়েছিল। কী কায়দা বল দিকি?
আমি বললুম, বোধ হয় নিজেই কাঁচি দিয়ে ছাঁটাই করত।
টেনিদা সুকুমার রায়ের হযবরলর কাকটার মতো দুলে-দুলে বললে, হয় নি হয় নি–ফেল!
হাবুল বললে, হ, বুঝছি। নিজের মাথার চুল খামচা খামচা কইরা টাইন্যা তুলত।
–ইঃ–কী বুদ্ধি! মগজ তো নয়–যেন নিরেট একটা খাজা কাঁঠাল বসে আছে। আয় ইদিক–খিমচে খিমচে তোর খানিক চুল তুলে দি। কেমন লাগে, টের পাবি।
টেনিদা হাত বাড়াতেই হাবুল সড়াৎ করে এক লাফে রক থেকে নেমে পড়ল।
ক্যাবলা বললে, আমরা ও-সব কায়দা-ফায়দার খবর জানব কোত্থেকে। তুমিই বলো।
টেনিদা তেলেভাজার ফাঁকা ঠোঙাটা খুঁজে একটা কিসের ভাঙা টুকরো পেলে। অগত্যা সেইটেই মুখে পুরে দিয়ে বললে, কায়দাটা বেশ মজার। ভুলোদা নজর করে দেখেছিল দেহাতী নাপিতদের মধ্যে বেশ সুন্দর একটা নিয়ম আছে। চুল-দাড়ি ছাঁটতে স্বজাতির কাছ থেকে ওরা কখনও পয়সা নেয় না। গিয়ে নমস্কার করে সামনে বসলেই বুঝে নেবে– এ আমার সমাজের লোক। তখন দিব্যি একখানা ফ্রি হেয়ার কাট! আসবার সময় আর-একটা নমস্কার করে উঠে এলেই হল– একটা পয়সা খরচ নেই।
ভুলোদাও শিখে গিয়েছিল। ব্যবসার কাজে এ-গাঁয়ে ঘুরে বেড়াতে, আসতে-যেতে দুটি নমস্কার ঠুকলেই ব্যস, কাজ হাসিল।
সেদিনও তাই করেছে। রাম রাম ভেইয়া বলে তো বসে পড়েছে এক নাপিতের সামনে, চুল ছাঁটাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে দেহাতী ভাষায় নানান গপ্পো চলছে। চাষের অবস্থা কেমন, কোথায় ভাণ্ডা কে ভর্তা মানে বেগুনের ঘণ্ট দিয়ে আচ্ছা পুরী খাওয়া যায়, কোন গাছে তিনোয়া চুড়ৈল- মানে তিনটে পেত্নী রহতী বা। এই সব সদালাপের ভেতর দিয়ে ভুলোদার চুল কাটা তো শেষ হল।
চলে ভেইয়া–রাম রাম– বলে ভুলোদা পা বাড়াতে যাবে, তক্ষুনি একটা কাণ্ড হল।
সামনেই গঙ্গা। একটা খেয়া নৌকো ওপার থেকে এপারে লাগল। আর দেখা গেল, সেই নৌকো থেকে জনা পনেরো লোক এদিক পানেই আসছে। বুড়ো থেকে ছোকরা পর্যন্ত সব বয়সের লোক আছে তাদের ভেতর।
দেখেই নাপিতের চোখ কপালে উঠল। হায় রাম বলে খাবি খেল একটা। ভুলোদা গুটি-গুটি চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ নাপিত খপ করে হাত চেপে ধরলে তার।
–এই ভাগতা কেঁও? বৈঠো।
ভুলোদা অবাক। পয়সা চায় নাকি? দেহাতী ভাষায় বললে, আমি পয়সা দেব কেন? আমি তো তোমার স্বজাত।
নাপিত বললে, সে বলতে হবে না আমি জানি। ওই যে পনেরোজন লোক আসছে, দেখছ না? ওদের কামাতে হবে এখন। আমি একা পারব কেন? তুমিও আমাদের স্বজাত-হাত লাগাও।
অ্যাঁ!
নাপিত টেনে ভুলোদাকে পাশে বসিয়ে দিলে। বললে, কী করবে ভেইয়া-দেশ গাঁয়ের নিয়ম তো মানতে হয়। ওরাও আমাদের জাত-কুটুম। গাঁয়ের লোক মরছে- তাই সবাই কামাতে আসছে এপারে।
নাপিত একটা খাবি খেয়েছিল, ভুলোদা চারটে বিষম খেল।
তা-তা–ওরা এপারে কেন? ওপারে কামালেই তো পারত।
নাপিত রেগে বললে, বুদ্ধ! স্বজাত হয়েও যেন কিছু জানো না। কামাবে কে–সবারই তো অশৌচ।
ভুলোদা ততক্ষণে হাঁ করে বসে পড়েছে। মুখের ভেতর টপাং করে একটা পাকা বটের ফল পড়ল, টেরও পেলে না। ব্যাপারটা এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে। আর বুঝেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তার।
বুঝলি! আরও সব মজার নিয়ম রয়েছে ওদের দেশে। গাঁয়ে কেউ মরলেই সমস্ত পুরুষমানুষকে মাথা কামাতে হবে- দাড়ি চাঁছতে হবে। তাই সবসুদ্ধু এপারে এসে পৌঁছেছে।
ভুলোদা তবু একবার শেষ চেষ্টা করলে। আমার বহু কাজ আছে পেটমে দরদ হচ্ছে–
এর মধ্যে পনেরোজন লোক এসে পড়েছে। নাপিত ধমক দিয়ে বললে আভি চুপ করো–ক্ষুর লে লেও। বলেই ভুলোদার হাতে ক্ষুর ধরিয়ে দিলে একখানা।
পনেরোজন এসে তো রাম রাম বলে নমস্কার করে গোল হয়ে বসে পড়ল। ভুলোদার তখন মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরছে-হাত-পা একেবারে হিম। ম্যালেরিয়ায় ভোগ্য রোগাপটকা লোক তো নয়–ইয়া ইয়া সব জোয়ান। সঙ্গে পাকা পাকা বাঁশের লাঠি। এমন করে ঘিরে বসেছে যে, পালানোর রাস্তাঘাট সব বন্ধ।
পয়সা দিয়ে দাড়ি কামাবার ভয়ে কোনওদিন ক্ষুর ধরেনি– চুলছাঁটা তো বেয়ারিং পোস্টেই চালিয়েছে এতকাল। মাথা-মুখ কামাবে কী– কিছুই জানে না। কিন্তু সে কথা বলবারও জো নেই। এক্ষুনি দিব্যি বিনি-পয়সায় চুল কেটে নিয়েছে। যদি বলতে যায়, আমি তোমাদের সমাজের লোক নই- তা হলে কেবল নাপিতই নয়, সবসুদ্ধ ষোলোজন লোক তাকে অ্যায়সা ঠ্যাভানি দেবে যে, ভুলোদা কেবল তক্তা নয়–একেবারে তক্তাপোশ হয়ে যাবে। চেয়ার টেবিল হয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়।
নাপিত ততক্ষণে একজনের মাথা জলে ভিজিয়েছে একটুখানি, তারপর ঘচাঘচ ক্ষুর চালাতে শুরু করেছে। আর একজন দিব্যি উবু হয়ে ভুলোদার দিকে মাথা বাড়িয়ে দিয়ে ঘুঘুর মতো বসে আছে।
ওদিকে ভুলোদা চোখ বুজে বলছে : হে মা কালী, এ যাত্রা আমায় বাঁচাও। তোমায় আমি সোয়া পাঁচ আনার নানাবড্ড বেশি হয়ে গেল সোয়া পাঁচ পয়সার পুজো দেব।
হাবুল চুকচুক করে বললে, ইস ইস! আইচ্ছা ফ্যাচাঙে তো পইড়া গেছে তোমার ভুলোদা।
আমি বললুম, কিন্তু কী কিপটে দেখেছিস! তখনও পয়সার দিকে নজরটা ঠিক আছে।
টেনিদা বললে, তা আছে! ওই জন্যেই তো মা কালী ওকে দয়া করলেন না। সাদাসিধে মানুষগুলোর হকের পয়সা এইভাবে ঠকানো! এখন বোঝ মজাটা।
ভুলোদা তো সমানে জপ করছে : মা–মা–সোয়া পাঁচ আনা না–না-সোয়া পাঁচ পয়সার পুজো দেব–আর এদিকে যে-লোকটা মাথা পেতে ঠায় বসেই ছিল, তার ঘাড়ে ব্যথা হয়ে গেছে। সে রেগে ভুলোদার পেটে একটা খোঁচা দিয়ে বললে, আরে হাঁ করকে কাহে বৈঠা হায়।হাত লাগাও–
ভুলোদা দেখল, আর উপায় নেই। তক্ষুনি লোকটার মাথায় ক্ষুর বসিয়ে দে এক টান।
জল-টল কিছু দেয়নি- চুল ভেজেনি ওভাবে ক্ষুর লাগালে কী হয়, বুঝতেই পারিস।
আরে হাঁ-হাঁ-ক্যা করতা–বলে লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, আর ভুলোদা গি-গি-গি–বলে আওয়াজ তুলেই ঠায় অজ্ঞান।
সত্যি সত্যিই কি অজ্ঞান। আরে, না না। প্রাণটা তো বাঁচাতে হবে। তাই অজ্ঞান হওয়া ছাড়া ভুলোদা আর কোনও রাস্তা খুঁজে পেলে না।
তখন চারিদিকে ভারি গোলমাল শুরু হল।
–আরে, ক্যা ভৈল? ক্যা ভৈল? মর গেইল বা?– ক্ষুরের ঘায়ে যে-লোকটার চাঁদি ছুলে দিয়েছে সে পর্যন্ত তার পেল্লায় চাঁদিটা সামলে নিলে।
–এ জী, তুমারা ক্যা ভৈল? মানে– ওহে, তোমার কী হল?
ভুলোদা বলে চলল : গি-গি গি
তখন একজন বললে, ভূত পাকড়লি, কা?–মানে ভূতে ধরল।
সকলে একবাক্যে বললে, তাই হবে।
ব্যস আর কথা নেই। ষোলোজন লোক তক্ষুনি ভুলোদাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলল, যেভাবে শুয়োর নিয়ে যায় আর কি। ভুলোদার হাত-পা যেন ছিঁড়ে যেতে লাগল–একটুখানি নধর হুঁড়ি হয়েছিল, সেটা নাচতে লাগল ফুটবলের মতো কিন্তু ষোলোজনের কাছ থেকে বাঁচতে হলে চুপ করে থাকা ছাড়া উপায় নেই। তখন গলা দিয়ে গি গি নয়–সত্যিকারের গোঁ গোঁ বেরুচ্ছে।
নিয়ে ফেললে এক রোজার বাড়িতে। সবাই মিলে চেঁচিয়ে বললে, ভূত পাকড়লি।
রোজা বললে, ঠিক হ্যায়–আচ্ছাসে পাকড়ো।
অমনি সবাই মিলে ভুলোদার হাত-পা ঠেসে ধরলে। ভুলোদা তেমনি গোঁ-গোঁ করতে লাগল।
এদিকে রোজা কতকগুলো শুকনো লঙ্কার মতো কী পুড়িয়ে ভুলোদার নাকে ধোঁয়া দিতে শুরু করলে। ফ্যাঁচচো ফ্যাচচো করে হাঁচতে-হাঁচতে ভুলোদার তো নাড়ি ছিঁড়ে যাবার দাখিল।
তারপরেই রোজা করেছে কি কোত্থেকে একটা খ্যাংড়াঝাঁটা এনে– কীসব বিড়বিড় করে বকতে বকতে ভুলোদাকে ঝপাং ঝপাং করে পিটতে আরম্ভ করেছে।
ভুলোদার অবস্থা তখন বুঝতেই পারছিস! গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল : বাবা-রে–মা-রে-ঠনঠনের কালী-রে– আমার দফা সারলে রে–আমি গেলুম রে!
নাপিতরা চোখ বড় বড় করে বললে, বাংলা বোল রহা।
তখন সবাই বললে, আঁ–বাঙালি ভূত পাকড়ালি। রাম রাম রাম।
রোজা মাথা নাড়লে। বললে, বাঙালির ভূত বহুৎ জব্বর ভূত। আরও জোরে ঝাঁটা চালাতে হবে।
ঝপাং ঝপাং ঝপাং! তার ওপরে নাকে সেই লঙ্কাপোড়ার গন্ধ। ভুলোদা আর কিছু টের পেল না।
উঠে বসল তিনঘণ্টা পরে। একটু একটু করে ব্যাপারটা খেয়াল হচ্ছে তখন। দেখলে, দুশো গাঁয়ের লোক তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। তার মাথা পরিষ্কার করে কামানো–একেবারে ন্যাড়া মুখে একটি দাড়ির চিহ্ন নেই, এমন কি ভুরু পর্যন্ত নিটোলভাবে চাঁছা। চাঁদির ওপরে দুর্গন্ধ কী একটা প্রলেপ মাখানো-গা-ভর্তি জল আর কাদা।
হেসে রোজা বললে, হাঁ, অব ঠিক হেই। ভূত ভাগ গইল বা।
হাঁ সেই থেকে ভূত সত্যিই পালিয়েছে ভুলোদার। এখন আর সস্তায় কিস্তিমাত করতে চায় না। নিয়মিত সেলুনে গিয়ে নগদ আটগণ্ডা পয়সা খরচ করে চুল ছেঁটে আসে।
তাই বলছিলুম, ওরে ক্যাবলা–
রেগে ক্যাবলা উঠে দাঁড়াল : আমি তোমার ভুলোদার মতো বিনি পয়সায় চুল ছাঁটতে চাইছিলুম–এ কথা তোমায় কে বলে?
তারপর তেমনি কায়দা করে নাকের ওপর চশমাটাকে আরও উঁচুতে তুলে, আলেকজাণ্ডারের ভঙ্গিতে গটমটিয়ে চলে গেল সে।