বেগম মেরী বিশ্বাস (Begum Meri Biswas) : 04
কলকাতার অন্ধকার কেল্লার ভেতরে দাঁড়িয়েও নবাব সিরাজ-উ-দৌল্লাও যেন দিশেহারা হয়ে গেছেন। পেছনে রাজা মানিকচাঁদ, মিরজাফর, তারাও দাঁড়িয়ে। হাতে হাতকড়া বাঁধা হলওয়েল সঙ্গে। হলওয়েল সাহেব পালাতে পারেনি শেষপর্যন্ত। ফিরিঙ্গি মেমসাহেবরা ভয়ে গিয়ে লুকিয়ে ছিল একটা গুদামঘরের মধ্যে। ওদিকে লুঠপাট চলেছে, কেউ পেয়েছে ঘড়ি, কেউ বোতাম, কেউ বগলশ। কিছুই বাদ দেয়নি সেপাইরা। চাপা কান্নার শব্দে সমস্ত কেল্লাটা যেন গুমগুম করছে। এতদিন যে-আক্রোশ বাংলার ইতিহাসের দরজায় মাথা কুটছিল দিন-রাত, তা যেন আজ চৌচির হয়ে ফেটে পড়ে আকাশ বাতাসে ছড়িয়ে গেল। ফিরিঙ্গিদের সাধের কলকাতা তখন পুড়ছে। বির্জিতলা, দর্জিপাড়া, গোবিন্দপুর, বাদামতলা থেকে শুরু করে ক্যাপ্টেন পেরিন সাহেবের বাগানের পাশের বারুদখানাটাও বাদ যায়নি। সেই আগুনের মধ্যে ষষ্ঠীপদ এধার থেকে ওধার দৌড়োচ্ছে। উমিচাঁদ সাহেবের বাড়িতেই বেশি টাকা থাকা সম্ভব। সেদিকটাতেই দৌড়ে গেল ষষ্ঠীপদ।
কিন্তু বাড়ির সামনে গিয়ে হতবাক। উমিচাঁদ সাহেবের দরোয়ান জগমন্ত সিং সেখানে সবকিছু জড়ো করেছে। উমিচাঁদের বাড়ির জিনিসপত্রগুলো এনে এনে ফেলছে সেখানে।
একী, দরোয়ান সাহেব, তুমি? তুমি একলা এসব কী করছ? কেয়া করতা হ্যায়?
জগমন্ত সিং এসব দু’দিন আগে নিজেই পুড়িয়ে গিয়েছিল। শুধু এই-ই পোড়ায়নি। মালিকের বাড়ির জেনানাদেরও পুড়িয়েছে। আজ আর আগুনে পুড়ে মরবার কেউ নেই। ফিরিঙ্গি সাহেবরা এতদিন কেল্লার মধ্যে জগমন্ত সিংকে আটক করে রেখেছিল। কৃষ্ণবল্লভ, উমিচাঁদ, জগমন্ত সিং সবাই নজরবন্দি হয়ে ছিল কেল্লায়। কিন্তু যখন সবাই পালিয়ে যাবার তোড়জোড় করছিল, জগমন্ত সিংও মালিককে এসে বলেছিল–হুজুর, আপ ভি পালিয়ে চলুন–এই-ই সুযোগ ফিরিঙ্গিলোগ ভাগ যা রাহা হ্যায়
সে রাত্রে সত্যিই কেউ কিছু ঠিক করতে পারেনি কী হবে শেষপর্যন্ত, সে অবস্থায় কী করা উচিত। রাজা রাজবল্লভের ছেলে কৃষ্ণবল্লভ মুখ ভার করে বসে ছিল। নবাবের হাতে তার নিস্তার নেই তা সে জানতই। কিন্তু পাঞ্জাবি মানুষ উমিচাঁদ অত সহজে ভেঙে পড়বার লোক নয়। অনেক ঝড়ঝাপটা তার মাথার ওপর দিয়ে গেছে। উমিচাঁদ সাহেব সুদূর পাঞ্জাব থেকে বাংলাদেশের নরম মাটিতে এসে রসের সন্ধান পেয়ে এইটুকু বুঝে নিয়েছে যে, এ-দেশে নরম হয়ে থাকলে সুনাম হয়তো হয়, কিন্তু বড়লোক হওয়া যায় না। বুঝে নিয়েছে যে টাকার মালিক হতে গেলে সম্মান অপমান জ্ঞান থাকলে চলে না। আর যারা টাকা কামাই করতে চায় তাদের পক্ষে এই-ই উপযুক্ত সময়–যখন দেশের রাজা বদলায়। দেশের রাজা বদলাবার সময়েই যা কিছু উন্নতি করতে হয় করে নাও। এর পর যখন শান্তির সময় আসবে তখন আর ভাগ্য-উন্নতি করবার সুযোগ পাওয়া যাবে না।
উমিচাঁদ সাহেব এক ধমক দিয়ে উঠেছিল–যা, তু ভাগ যা ইহাসে–
এরপর জগমন্ত সিং আর সময় নষ্ট করেনি। কেল্লায় তখন আর পল্টনদের পাহারাও নেই। সোজা পাঁচিল টপকে একেবারে মালিকের বাড়ির সামনে এসে হাজির। আগেই সবকিছু পুড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখনও অনেক কিছু বাকি ছিল পুড়তে। জগমন্ত সিং জানত কোথায় থাকে সাহেবের সিন্দুক, কোথা কোন ঘরের কোন মেঝের তলায় সোনা-রুপো পোঁতা আছে। জগমন্ত সিং সেখানে ঢুকতে যাচ্ছিল হঠাৎ বেভারিজ সাহেবের মুনশিকে দেখে অবাক হয়ে গেল। মুনশিজি, তুমি?
ষষ্ঠীপদ বললে–আমার নোকরি গেছে দরোয়ানজি, আমি এখন কী করব?
বলতে বলতে ষষ্ঠীপদ সেই আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়েই হাউহাউ করে কেঁদে ফেললে।
কাঁদছিস কেন বেল্লিক?
ষষ্ঠীপদ কাঁদতে কাঁদতে বললে–চাকরি গেলে আমি খাব কী দরোয়ানজি?
জগমন্ত সিং ষষ্ঠীপদর দিকে চেয়ে ভেংচি কেটে উঠল। তুই এখন খাবার কথা ভাবছিস, উল্লকা-পাট্টা? দুনিয়া বরবাদ হয়ে যাচ্ছে, জমানা ভি বদল হয়ে যাচ্ছে, এখন কেউ তোর মন খাওয়া নিয়ে ভাবছে? মরতে পারবি?
ষষ্ঠীপদ চমকে উঠল। একবার জগমন্ত সিংয়ের মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। আগুনের হলকা লেগে মুখখানা তার যেন বীভৎস হয়ে উঠেছে তখন।
হ্যাঁ, মরতে পারব দরোয়ানজি! খুব মরতে পারব। আর মরেই তো আছি আমি—
তব ইধর আ
বলে সেই বাড়ির মধ্যে ঢুকল। উমিচাঁদ সাহেবের এত সাধের সাজানো বাড়ি। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষের দ্বনাশ করা টাকার জমানো সোনা রুপো-হিরে ভরা বাড়ির মালখানার ভেতরে ঢুকল দু’জনে। তারপর জগমন্ত সিং মালখানার দরজাটা নিজের ব্ল্যাকের চাবি দিয়ে খুলে ফেললে। কী রকম একটা ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হল। জগমন্ত এক হঁচকা টানে সিন্দুকের ডালাটাও খুলে ফেললে। খুলে ফেলতেই ষষ্ঠীপদর চোখ দুটোয় ধাঁধা লেগে গেল। এত সোনা, এত রুপো, এত মোহর, এত টাকা! মা মা, পতিতোদ্ধারিণী, তুমি কি আমার মনের কথা শুনেছ তা হলে মা?
আগ জ্বালাও, আগ জ্বালাও
বলে কী জগমন্ত সিংটা। ষষ্ঠীপদ হাঁ করে চেয়ে রইল দরোয়ানজির দিকে! জগমন্ত সিং সত্যি সত্যিই আগুন জ্বালিয়ে দিলে সিন্দুকের চারিদিকে। আগুনটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল।
জগমন্ত সিং বলে–এই আগুনের ভেতর লাফিয়ে পড়–আগে তুই ঝাঁপ দে, তারপর হাম ষষ্ঠীপদ কী করবে বুঝতে পারলে না। এমন হবে তা তো ভাবেনি সে। সোনা-রুপো-মোহর-টাকার সঙ্গে একাকার হয়ে যাবার কথা তো সে কল্পনা করেনি। তুমি বাপু প্রভুভক্ত চাকর হতে পারে কিন্তু আমি তো পারব না একাজ। আমার তো এই সব টাকা চাই। আমি যে বড়লোক হব গো! তোমার মালিক উমিচাঁদ সাহেবের চেয়েও বড়লোক।
নে, লাফিয়ে পড় ভেতরে
ষষ্ঠীপদ আর দেরি করলে না। দু’হাতে জগমন্ত সিংকে ধাক্কা দিয়ে সিন্দুকের ভেতরে ফেলে দিয়েই ভারী ডালাটা বন্ধ করে দিয়েছে এক মুহূর্তে। থাক, পুড়ে মরুক ওর ভেতরে। তারপর আগুনটা নিভে গেলেই আবার বার করে নিলে চলবে। তখন সমস্ত সোনা-রুপো-মোহর-টাকার মালিক সে। সেই ষষ্ঠীপদ। ষষ্ঠীপদ আবার মাকে ডাকলে।…
নবাব সিরাজ-উ-দৌল্লাও তখন কেল্লার মালখানার ভেতরে খোলা সিন্দুকটার সামনে দাঁড়িয়ে। রাজা মানিকচাঁদ, মেহেদি নেসার, কৃষ্ণবল্লভ, উমিচাঁদ, সফিউল্লা, ইয়ারজান সবাই পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
আর টাকা? আর টাকা নেই?
হলওয়েল সাহেব হাত বাঁধা অবস্থায় তখন থরথর করে কাঁপছিল। বললে–আর টাকা নেই জাঁহাপনা, এই-ই সব
স্রেফ পঞ্চাশ হাজার টাকা? এতদিনের কারবার তোমাদের, এত আমদানি-রপ্তানি, স্রেফ পঞ্চাশ হাজার টাকা তোমাদের মালখানায়?
আর কোনও কথা নয়। রাজা মানিকচাঁদ সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। নবাব বললেন–হলওয়েলকে গ্রেফতার করে মুর্শিদাবাদ পাঠিয়ে দাও আর কৃষ্ণবল্লভ, উমিচাঁদ ওরাও আমার সঙ্গে যাবে…
ষষ্ঠীপদর আর দেরি সহ্য হল না। সিন্দুকের ডালাটা খুলে ফেললে একটা শাবল দিয়ে। ভেতরের আগুন তখন নিভেছে। কিন্তু কালো কালো জমাট ধোঁয়া শুধু গুমিয়ে গুমিয়ে নিঃশব্দে কুণ্ডলী পাকিয়ে ওপরে ওঠবার চেষ্টা করছে। ষষ্ঠীপদ নাকে কাপড় দিয়ে নিচু হয়ে দেখলে একবার। জগমন্ত সিং তখন বেগুনপোড়া হয়ে পড়ে আছে ভেতরে। মা পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গে, তা হলে আমাকে সত্যি-সত্যিই রাজা করে দিলে মা–সত্যিই রাজা হলুম
চেহেল্-সুতুনের ভুলভুলাইয়ার মধ্যে যদি কোনও রহস্য থাকে তো সে রহস্য ইতিহাসের। ইতিহাসের অমোঘ নির্দেশেই সেখানে নারীসুরা আর রোমাঞ্চের আমদানি হয়েছে। তার জন্যে যদি কাউকে দায়ী করতে হয় তো সে মোগলবাদশা সুলতান আকবর নয়, সুলতান শাহজাহান নয়, সুলতান জাহাঙ্গির নয়, সুলতান আরঙ্গজেবও নয়। এমনকী মুর্শিদকুলি খাঁ, সরফরাজ খাঁ, আলিবর্দি খাঁ-ও নয়। নবাব মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলাও নয়। চকবাজারের সারাফত আলি যতই বলুক, হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই যতই কষ্ট পাক, শোভারাম বিশ্বাস যতই পাগল হোক, ইতিহাসের পথ নির্মম নিষ্ঠুর গতিতে এগিয়ে চলবে। তার গতি কেউ থামাতে পারবে না।
১৭৩০ সালে যে-ছেলেটির জন্ম হয়েছিল, সে দেখে এসেছে এমনি করেই বাংলার নবাবিয়ানা চালাতে হয়, এমনি করেই মারাঠাদের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। আলিবর্দি খাঁর বড় পেয়ারের নাতি সে। সে জানে লড়াই কাকে বলে, সে জানে মেয়েমানুষকে কেন সৃষ্টি করেছে খোদাতালা, সে জানে নবাব হলে তার দুশমনি করবার লোকের অভাব হয় না। এই ফিরিঙ্গি, এই মিরজাফর, এই জগৎশেঠ, এই মেহেদি নেসার, এদের সকলকে নিয়েই তার চলতে হবে। ক্ষমতা যতদিন থাকবে ততদিন তার বন্ধুও থাকবে, দুশমনও থাকবে। এদের বাদ দিয়ে যে ক্ষমতা চায় সে উজবুক, সে আনাড়ি!
তাই চেহেল্-সুতুনের ভেতরের চেহারাটাও কোনওদিন বদলায়নি। বদলাতও না। কিন্তু কেন যে বদলাল সেই কাহিনীই বলতে বসেছি।
অন্ধকারে তখনও মরালী আর একবার গলা ছেড়ে ডাকবার চেষ্টা করলে নজর মহম্মদ, নজর মহম্মদ
হয় সে স্বপ্ন দেখছে, নয়তো সে বোবা হয়ে গেছে। তখনও নহবতটা বাজছে। নবাব ফিরে আসছে। হয়তো কাল, কিংবা পরশু, কিংবা হয়তো তার পরদিন, তারপর? তার আগে যদি নজর মহম্মদ সত্যিই তাকে নিয়ে আসে।
সামনেই যেন কার পায়ের শব্দ হল। অস্পষ্ট ঝাপসা আলোয় ভাল দেখা যায় না। তবু নজর মহম্মদ ভুল করেনি চিনতে। নজর মহম্মদরা সাধারণত ইচ্ছে করে কখনও ভুল করে না।
বেগমসাহেবা!
মরালী যেন নিজের চোখ দুটোকেও বিশ্বাস করতে পারলে না। পেছনেই কান্ত।
মরালী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে তুমি?
কান্তর তখন বোধহয় বাকরোধ হয়ে গেছে। তার মুখে তখন সব কথা যেন ফুরিয়ে গিয়েছে। খানিকটা ভয়ে, খানিক আনন্দে, খানিকটা রোমাঞ্চে, আর খানিকটা হয়তো বা বিস্ময়ে।
দুর্গা সহজে ছাড়বার পাত্রী নয়। এই যে হাতিয়াগড়ের রাজবাড়ি, এর বাইরে তো খাজাঞ্চিবাবু আছে, সরকারবাবু আছে, প্রজা-পাঠক, পাইক, বরকন্দাজ সবই আছে। অতিথিশালার রান্নাবাড়ি, চাকর-ঝি-ঠিকে লোক, বুড়োশিবের মন্দিরের পুরুত, জোগানদার, কিছুই বাদ নেই। কিন্তু রাজবাড়ির মধ্যে দুর্গার মাথার ওপরে কেউ নেই। সে-ই সর্বেসর্বা। দুর্গার কথার ওপর কথা বলার ক্ষমতা কারওই নেই।
পরদিন সকালবেলাই সোজা বড় বউরানির ঘরে গিয়ে হাজির।
রানিমা!
ভেতরে আয়
খাজাঞ্চিবাবু শোভারামের বদলা যাকে রেখেছে সে সুবিধের লোক নয়। জনার্দন না কী তার নাম, লোকটা সেদিন রাত্তিরে একেবারে ভেতরবাড়ির মহলের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল।
তা মাধব ঢালিকে বললিনে কেন? কেটে ফেলে নদীতে ভাসিয়ে দিত!
দুর্গা বললে–আমি অত সাহস করিনি রানিমা, এমনিতে সময়টা খারাপ চলছে, তখন বাঁ-নাক দিয়ে নিশ্বেস পড়ছিল, আমি তাই সামলে গেলুম। হইচই করলে আবার যদি ডিহিদার মিনসের কানে যায়! তই ধমক দিয়ে সাবধান করে দিয়েছি, বলেছি, আর যদি মিনসেকে এ-দিগরে দেখি তো ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব
তা মতলব কী তার? কেন ভেতরবাড়িতে এসেছিল?
দুর্গা বললে–আমার তো রানিমা সন্দেহ হয় ও ঠিক ডিহিদার মিনসের লোক, খবর নিতে পাঠিয়েছে ছোট বউরানিকে ঠিক মুর্শিদাবাদে পাঠিয়েছি কিনা!
তা শোভারামের মেয়েটা তো ভালয় ভালয় সেখানে পৌঁছে গেছে। তার পরেও আবার এ মিনসের এত সন্দেহবাই কেন?
দুর্গা বললে–কে জানে রানিমা কার কী মতলব। আমি তো দিনরাত আগলে আগলে রাখছি, কিংবা হয়তো সে মুখপুড়ি চাপে পড়ে সব বলে দিয়েছে। সেসব হালচাল তো সেখানকার আলাদা। যে-তেজি মেয়ে, ভেবেছে এখন তো যা হবার হয়ে গেছে, এখন আর বললে–ক্ষেতিটা কী!
বড় বউরানি বললেন–তা হলে চোখে চোখে রাখ লোকটাকে, দেখ দু-চার দিন কী করে, তারপর আমাকে বলিস, আমি মাধব ঢালিকে বলে দেব না হয়
দুর্গা বললে–তার দরকার নেই, তার চেয়ে বরং তুমি জগা খাজাঞ্চিবাবুকে ডেকে ওকে ছাড়িয়ে দিতে বলো
হঠাৎ গোকুল এসে সামনে দাঁড়াল।
বড় বউরানি গোকুলকে দেখেই বললেন–ছোটমশাই বুঝি ডাকছেন আমাকে? চল, যাচ্ছি
তারপর যাবার সময় দুর্গার দিকে চেয়ে বললেন–তুই যা ভাল বুঝিস কর, চারদিক বুঝেসুঝে করবি বাছা, আর কী বলব–
জনার্দন ততক্ষণে দৌড়োত দৌড়োতে একবারে রেজা আলির বাড়ির সামনে গিয়ে হাজির হয়েছে। রেজা আলির সঙ্গে জনার্দনের রোজকার দেখাশোনা চলে। রোজই এসে খবর দিয়ে যায় আড়ালে। শুধু হাতিয়াগড়ের রাজবাড়িরই খবর নয়, এ ডিহির সব খবরই রাখতে হয় রেজা আলিকে। কে কোথায় কখন যাচ্ছে, কার কী রকম অবস্থা ফিরছে কে দালান-কোঠা বানাচ্ছে, কার রিস্তাদার বাড়িতে এল কী উদ্দেশ্য নিয়ে, এসব খবর না রাখলে ডিহিদারের কাজ চালানো যায় না। নিজামত সরকারকে ওয়াকিবহাল করতে হয় দেশের অবস্থা কেমন। কোথায় কোন লোক ষড়যন্ত্র করছে সরকারের বিরুদ্ধে তারও হদিশ রাখতে হয় তাকে।
কী দেখলি জনার্দন?
জনার্দন বললে–হুজুর, কেল্লা ফতে হয়ে গেছে
তার মানে?
মানে ওরাই লুকিয়ে রেখেছে রানিবিবিকে, হাতেনাতে ধরা পড়ে গিয়েছে কাল রাত্তিরে। একতলার একটা কুঠুরিতে তাকে লুকিয়ে রেখেছে ওই কুটনি মাগিটা। ও বেটিকে আমি জব্দ করব তবে ছাড়ব হুজুর! ও হারামজাদি আমার পেছনে লেগেছে কাল থেকে।
সঙ্গে কাউকে নিবি?
জনার্দন বললে–না হুজুর, মেয়েমানুষের সঙ্গে লড়তে হলে একলাই যথেষ্ট, দু’জন হলে লজ্জার। কথা। আপনার শুধু একটু মদত চাই হুজুর।
কী মদত?
সে তো আপনাকে আমি বাতলেছি আজ্ঞে, শুধু নজর রাখবেন গরিবের ওপর। বড় গরিব আমি হুজুর, তিনটে মেয়ের বিয়ে দিলুম, তিনটেই রাড় হয়েছে, একফোঁটা জমিজিরেত নেই যে চাষবাস করে খাই। দশ সন আগে হলে এমন করে বলতুম না আজ্ঞে, কিন্তু কী যে বিষনজরে পড়ে গেলাম পাট্টাদারের, সব কেড়ে নিলে!
কেন, পাট্টাদারের বিষ-নজরে পড়লি কেন?
জনার্দন বললে–হুজুরের দেখছি কিছু মনে থাকে না, হুজুরকে তো সব খুলে বলেছিলুম। সোমত্ত মেয়েদের তো তা বলে ঘরে আটকে রাখতে পারিনে, পুকুরঘাটে যায়, বাগানে ছোলা-মটর খেতে যায়, কোন ফাঁকে দেখে ফেলেছে। তা আমি বাপ হয়ে কি তাতে রাজি হতে পারি হুজুর? তাই গা ছেড়ে পালিয়ে এলুম একদিন। তারপর আমার শ্বশুরবাড়িতে তাদের রেখে এখেনে এলুম কাজের চেষ্টায়, তখন হুজুর দয়া করে এই কাজটা দিলেন।
রেজা আলি গড়গড়া টানতে টানতে বললে–তা কী মদত চাস তুই বল না!
হুজুর, খুনোখুনি যদি বাধে তো তখন যেন আমার চাকরিটা না চলে যায়
খুননাখুনি বাধবে কেন?
হুজুর, মাধব ঢালিকে দিয়ে দুগ্যা আমাকে কোতল করবে বলে শাসিয়েছে যে!
রেজা আলি বললে–ঠিক আছে, যা ভাল বুঝিস তাই কর, চারদিক বুঝেসুঝে করবি, তারপর যদি ফৌজদার হই তো তোর আর ভাবনা নেই, তুই যা এখন
জনার্দন আর দাঁড়াল না সেখানে। কুর্নিশ করে ঘুরপথে আবার গিয়ে রাজবাড়ির দেউড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। বিশু নাপিত ছোটমশাইকে খেউরি করবার জন্যে তখনও বসে ছিল। জনার্দনকে দেখেই জিজ্ঞেস করলে কী রে জনার্দন, এত দেরি হল যে তোর?
জনার্দনের মুখটা শুকিয়ে গেল। কেন? ছোটমশাই খুঁজছিলেন নাকি আমাকে?
ছোটমশাই খুঁজুন আর না-খুঁজুন, কিংবা দরকার থাক আর না-থাক, যার যার কাজ সকলের সমস্ত করে যাওয়াই এ-বাড়ির নিয়ম। জনার্দন বললে–অনেকদিন মেয়ে তিনটের খবর পাইনি কিনা তাই একবার খবর নিতে গিয়েছিলুম বামুনপাড়ার দিকে। জগদীশ বাঁড়ুজ্যের বেয়াই থাকে কিনা জনাইতে। তা ছোটমশাই আজ নীচেয় নামবেন নাকি?
হঠাৎ অতিথিশালার দিক থেকে কার গান ভেসে এল।
বিশু পরামানিক বললে–ওই এসেছে রে–
কে গো? কে এসেছে?
তখন গানটা বেশ স্পষ্ট ভেসে আসছে–
আর ভুলালে ভুলব না গো।
আমি, অভয়পদ সার করেছি।
ভয়ে হেলব দুলব না গো ॥
আশাবায়ুগ্রস্ত হয়ে
মনের কথা খুলব না গো।
মায়াপাশে বদ্ধ হয়ে
প্রেমের গাছে ঝুলব না গো ॥
এখন আমি দুধ খেয়েছি।
ঘোলে মিশে ঘুলব না গো ॥…
জনার্দন আবার জিজ্ঞেস করলে ও কে গো? কে গান গাইছে?
ওই তো পাগলা উদ্ধব দাস।
উদ্ধব দাস কে?
উদ্ধব দাসের নাম শুনিসনি? শোভারামের মেয়েকে যে বিয়ে করেছিল রে? অনেকদিন পরে আবার আমাদের অতিথশালায় এয়েছে–আবার জ্বালাবে
জনার্দন আর দাঁড়াল না। বললে–দাঁড়াও, অতিথশালায় গিয়ে গানটা শুনে আসি।
বলে উঠে ভেতরের দিকে গেল।
বড় বউরানি ঘরে গিয়ে দেখলেন ছোটমশাই বিছানায় তেমনি করে শুয়ে আছেন। পাশে গিয়ে পঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন–ডাকছিলে নাকি আমাকে?
ছোটমশাই আরও দুর্বল হয়ে গেছেন তখন। জিজ্ঞেস করলেন–তোমার পুজো করা শেষ হয়েছে?
কেন? তোমার কিছু দরকার?
ছোটমশাই বললেন না, তা নয়, বেশিক্ষণ একলা থাকতে ভাল লাগে না তাই
বড় বউরানি আরও কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালেন। বললেন–তোমার ভালর জন্যেই তো পুজো করি! পুজো কি আমি আমার নিজের জন্যে করি ভেবেছ?
ছোটমশাই কিছু কথা বললেন না। তারপর একটু পরে বললেন–এত পুজো করে কী এমন ভাল হল আমার?
বড় বউরানি বললেন–নিশ্চয় ভাল হবে, দেখো! তুমি অত ভাবো কেন?
ছোটমশাই বললেন–তা ভাবব না! তুমি বলছ কী? সারা দিনরাতই তো ভাবি! সমস্ত পুরনো কথাগুলো যে মনে পড়ে যায়!
একটু চেষ্টা করো, নিশ্চয়ই ভুলতে পারবে।
ছোটমশাই চোখ বুজলেন। এমনি ক’দিন ধরেই চলছে। সেই কৃষ্ণনগর থেকে আসার পর সেই যে বিছানা নিয়েছেন আর ওঠেননি। হাতিয়াগড়ের সমস্ত প্রজারা কেবল রোজ খবর নিচ্ছে ছোটমশাই কেমন আছে! ছোটমশাই যদি এতদিন ধরে বিছানায় পড়ে থাকে তো জমিদারি চলে কেমন করে। প্রজা-পাঠকদেরই কষ্ট। কত আর্জি, কত আবেদন-নিবেদন পেশ করতে হয় ছোটমশাইয়ের কাছে। জগা খাজাঞ্চিবাবুর কাছে গেলে তো খেঁকিয়ে ওঠে। বলে–যা যা, খাজনা দিবিনে তার আবার মায়া-দয়া কী রে? সবাই আশা করে আছে কবে ছোটমশাই আবার উঠে হেঁটে কানুনগো কাছারিতে এসে বসবে। কবে তার পা দুটো ধরে খাজনা মকুব করিয়ে নেবে!
বড় বউরানি রোজই আশা দেন–ভেবো না কিছু, তুমি নিশ্চয়ই ভাল হয়ে যাবে
ছোটমশাই বলেন কিন্তু তুমিই তো ভাল হতে দিলে না আমাকে! কেন তুমি আমার এ সর্বনাশ করলে বলো তো? আমি তোমার কী করেছিলুম?
এসব কথায় বড় বউরানি চুপ করে থাকেন। তারপর অনেকবার একই কথা বলে বলে যখন কোনও সুরাহা হয় না তখন ছোটমশাই চুপ করে যান। শুধু চোখের কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে টপটপ করে। বড় বউরানি নিজের আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেন চোখ দুটো!
বলেন–দেখো, আমার ওপর রাগ কোরো না তুমি! আমি যা করেছি তোমার ভালর জন্যেই করেছি, এ বংশের ভালর জন্যেই করেছি। এ-বংশের বউ হয়ে মুসলমানের হারেমে গিয়ে থাকলে তাতে তোমার আমার ছোটর কারওই সম্মান বাড়ত না। তার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভাল হয়েছে
ছোটমশাইয়ের গলাটায় যেন ব্যথা করে আসে। বলেন–তা তুমি মেরে ফেলবে তাই বলে? আর কোনও উপায় ছিল না?
তা তোমার চেয়ে আমি কি তাকে কম ভালবাসতুম মনে করো? আমার বুঝি মেরে ফেলতে কষ্ট হয়নি? আমি বুঝি তাকে নিজে পছন্দ করে এ বাড়ির বউ করে নিয়ে আসিনি? আমি বুঝি তোমাদের দু’জনের মুখ দেখে সুখ পাইনি? আমি বুঝি চাইনি যে এবংশের একটা ছেলে হোক। বড়মশাইয়ের বংশে বাতি দিতে কেউ থাকুক?
অনেকক্ষণ ছোটমশাইয়ের উত্তর দেবার আর কিছু থাকে না।
বলেন–মরবার সময় সে কিছু বলেনি? কিছু বলে যায়নি তোমাকে?
বড় বউরানি বলেন–তুমি আগে আমার কথার উত্তর দাও যে সম্মান বড় না প্রাণটা বড়?
ছোটমশাই বলেন–তুমি যদি জানতে পারতে আমার বুকের মধ্যে কী তোলপাড়টা চলেছে
তা সম্মান কি তার চেয়েও বড় নয়? আর এ তো শুধু তোমার একলার সম্মান নয়, সমস্ত হাতিয়াগড়ের সম্মানের প্রশ্ন যেখানে, সেখানে তুমি নিজের কষ্টটার কথাই ভাবলে?
কিন্তু ডিহিদারকে তুমি এখন কী বলে জবাবদিহি করবে? মেহেদি নেসার সাহেবকে কী বলে ঠেকাবে? তারা যদি আবার পরওয়ানা পাঠায়, তখন?
সে ব্যবস্থা আমি করেছি।
ছোটমশাই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন বিছানায় শুয়ে শুয়েই।
বলেন–সেকী? কী ব্যবস্থা করলে?
সে সব তোমায় ভাবতে হবে না। যে ব্যবস্থা করলে সব কুল রক্ষে হয়, সেই ব্যবস্থাই করেছি।
বলো না, কী ব্যবস্থা করলে? আমার যে জানতে বড় ইচ্ছে হচ্ছে। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আমাকে বারবার বারণ করে দিয়েছিলেন এমন সর্বাশ আপনি করবেন না। জগৎশেঠজি, মিরজাফরসাহেব সবাই আমাকে বারণ করেছিল। আমি কিছুতেই কিছু উপায় খুঁজে পাচ্ছিলুম না।
বড় বউরানি বলেন আমিও কি ভাবিনি মনে করেছ! ভেবে ভেবে আমার রাতে ঘুম হত না জানো। সেই যেদিন থেকে ডিহিদারের লোক এল পরোয়ানা নিয়ে, আমি একদিনও রাত্তিরে ঘুমোইনি। কেবল ভেবেছি এর কী প্রতিকার! কেবল মন্দিরে গিয়ে ঠাকুরকে ডেকেছি, বলেছি, আমাকে একটা উপায় বলে দাও ঠাকুর! আমার স্বামী, আমার শ্বশুরের বংশ, আমার হাতিয়াগড়ের প্রজাদের সম্মান কেমন করে রক্ষে করব বলে দাও!
তারপর একটু থেমে বলেন–তুমি ভাবতে আমি বুঝি কেবল ঠাকুরপুজো নিয়ে মেতে আছি। কিন্তু আমার যে কী যন্ত্রণা হত তা যদি তুমি বুঝতে! ছোটর সামনে গিয়ে মুখোমুখি চাইতে পারতুম না। বুক। ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইত–তবু সংসারের রোজকার কাজ হাসিমুখে করে যেতুম! তখন তুমিও জানতে না আমার বুকের মধ্যে কী আগুন জ্বলছে! তোমাকে তো তখন ডিহিদারের সে-চিঠি আমি দেখাইনি। আমি জানতুম তুমি সে চিঠি পড়ে ভেঙে পড়বে ।
এর পরে আর ছোটমশাইয়ের কিছু কথা বলবারও থাকে না। সত্যিই তো, বড় বউরানি যা করেছে, তা ছাড়া আর কী উপায়ই বা ছিল। সেই কত পুরুষ আগে থেকে এমনি একটার পর একটা বড়ঝাপটা চলে আসছে। বড়মশাইয়ের কাছে ছোটবেলায় সব শুনেছেন ছোটমশাই। বখতিয়ার খিলজির আমল থেকেই মোগল-পাঠানের লড়াই শুরু হল। এই হাতিয়াগড়ই কি সামান্য ছিল তখন? এই হাতিয়াগড়েরই নিজের সৈন্য ছিল সামন্ত ছিল। টোডরমল যখন এলেন আকবর বাদশার সনদ নিয়ে, তিনি পর্যন্ত হাতিয়াগড়কে দলে টানতে পারেননি। তারপরে এল ওমরাহ আজিম খা–আর ওদিক থেকে পাঠান সর্দার কতলু খাঁ দলবল নিয়ে হাজির হয়ে তছনছ করে দিলে সমস্ত বাংলাদেশ। তখনও। হাতিয়াগড় মাথা খাড়া করে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর এলেন মানসিংহ। তিনিই পাঠানদের প্রথম মূলোচ্ছেদ করে দিলেন চিরকালের মতো। তারপর এল পর্তুগিজরা। তারা এখানকার নীচজাতের মেয়েদের সঙ্গে থেকে নিজেদের বংশবৃদ্ধি করতে লাগল হুউঁহুড় করে। পর্তুগিজে ছেয়ে গেল দেশ। তাদের অত্যাচারে আর কেউ টিকতে পারে না। বিশেষ করে সমুদ্রের কাছাকাছি গ্রামগুলোতে। যাকে পারে ধরে নিয়ে যায়, ধরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয় বাইরের সব দেশে। তারপর বাদশা হলেন শাহানশা শাহজাহান। সব দেশটা মোগলের হাতে চলে গেল। চট্টগ্রামের নাম হল ইসলামাবাদ। কিন্তু বাদশার শেষ বয়েসে আবার আরম্ভ হল লড়াই-মারামারি। সুজা, মিরজুমলা, সবাই এক-একজন ডাকাত। কেবল বাংলাদেশে এসেছে আর চাকরি করেছে, লুঠপাট করেছে। তারপর এলেন বাদশা আওরংজেব। হাতিয়াগড়ের অবস্থা সেই সময় থেকেই খারাপ হতে শুরু হয়েছে। সেই আওরংজেবের শিষ্য শায়েস্তা খাঁ এসেও শান্তি দেয়নি কাউকে। হাতিয়াগড়ের গৌরব গেছে, প্রতিষ্ঠা গেছে, মান-সম্ভ্রম সব গেছে। এখন নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার আমলে এসে হিরণ্যনারায়ণ রায়কে আজ চরম অপমানের ডালা মাথা পেতে নিতে হল! আজ বড়মশাই থাকলে কী করতেন কে জানে। দিনকাল বদলে গেছে। হয়তো বড়মশাইকেও এই অপমান মাথা পেতেই নিতে হত। এ-অপমানের জ্বালা যেন হাজার চেষ্টা করলেও দূর হবে না। তাই শুধু শুয়ে থাকেন আর ভাবেন। ভেবে ভেবেই কূল কিনারা হারিয়ে ফেলেন।
হঠাৎ বাইরে গোকুল এসে দাঁড়াল।
বড় বউরানি এসে জিজ্ঞেস করলেন-কী রে?
কেষ্টনগর থেকে মহারাজার লোক এসেছে চিঠি নিয়ে, ছোটমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে চায়, আমার হাতে চিঠি দেবে না
আচ্ছা, ডেকে নিয়ে আয় ভেতরে।
বলে বড় বউরানি বাইরে চলে গেলেন।
বুড়ো মতন মানুষটা। এসেই মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে উবু হয়ে প্রণাম করলে অনেকক্ষণ ধরে। তারপর নিচু গলায় বললে–আমি মহারাজার চিঠি নিয়ে এসেছি হুজুরের নামে। এ-চিঠি আপনার হাতে ছাড়া আর কারও হাতে দেবার হুকুম নেই হুজুর
ছোটমশাই চিঠিটা নিলেন। বললেন–এর উত্তর চাই?
আজ্ঞে, সে হুকুম নেই আমার ওপর।
আপনি তা হলে অতিথিশালায় গিয়ে বিশ্রাম করুন। তারপর আমার খাজাঞ্চিবাবুকে বলবেন, সে আপনার তদারক করবে। যদি এর উত্তর দেবার দরকার থাকে আমি ডেকে পাঠাব
লোকটা আবার মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে চলে গেল। গোকুল তাকে সোজা অতিথিশালায় নিয়ে গেল।
ওদিকে অতিথিশালায় বহুদিন পরে আবার উদ্ধব দাস এসেছে। সাড়া পড়ে গেছে। আবার বেশ দু’হাতে তাল দিয়ে দিয়ে গান ধরেছে
আর ভুলালে ভুলব না গো!
আমি অভয়পদ সার করেছি
ভয়ে হেলব দুলব না গো।
আশাবায়ুগ্রস্ত হয়ে
মনের কথা খুলব না গো।
সুখ-দুঃখ সমান ভেবে
মনের আগুন তুলব না গো।
মায়াপাশে বদ্ধ হয়ে
প্রেমের গাছে ঝুলব না গো।
এবার আমি দুধ খেয়েছি,
ঘোলে মিশে ঘুলব না গো।
বাহবা, বাহবা! বেড়ে গান গাও তো ভাই তুমি? তুমি কে বট?
উদ্ধব দাস গান থামিয়ে হাতজোড় করে বললে–অধীন উদ্ধব দাস প্রভু, অধীন ভক্ত হরিদাস–তা আপনি কে?
আমি জনার্দন। শোভারামকে চেনো তো? তুমি যার মেয়েকে বিয়ে করেছিলে, তার বদলা চাকরি করি এখেনে। শোভারাম তো পাগল হয়ে গেছে, শুনেছ?
উদ্ধব হাসল। বললে–আমিও তো পাগল প্রভু, খলু সংসারে কে পাগল নয়? আমি পাগল, শোভারাম বিশ্বাস পাগল, সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ পাগল, কান্তবাবু পাগল, নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা পাগল, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র পাগল–কেউ বিষয়-পাগল, কেউ মেয়েমানুষ-পাগল, কেউ ভগবান-পাগল। কেউ আবার নামের-পাগল, পাগলে পাগলে খলুসংসার যে ছেয়ে গেছে প্রভু! বদনাম শুধু আমার আর শোভারামের।
বলে উদ্ধব দাস যেন একটা মস্ত রসিকতা করেছে এমনি করে হেসে উঠল।
জনার্দন কিন্তু হাসল না। এতদিনে বোধহয় কার্যসিদ্ধি হবে বলে মনে হল। খুব ভাব জমিয়ে উদ্ধব দাসের আরও কাছে সরে বসল। আশেপাশে চারদিকে চেয়ে দেখলে কাছাকাছি কেউ কোথাও নেই। অতিথিশালায় আর যারা আছে তারা সবাই পুকুরে চান করতে গেছে, কেউ কেউ পুঁটলি মাথায় দিয়ে এক কোণে চিতপাত হয়ে শুয়ে।
উদ্ধব দাসের দিকে মুখ নিচু করে বললে–একটা কথা তোমায় জিজ্ঞেস করব দাসমশাই
উদ্ধব দাস বললে–একটা কথা কেন প্রভু, হাজারটা করুন না, অধীনের কাছে কিছু লুকোছাপা নেই। আমার বউ পালিয়ে গেছে কিনা এই কথাটাই তো আমাকে জিজ্ঞেস করবেন প্রভু? প্রভুরা বাই। আমাকে ওই নিয়ে ঠাট্টা করেন। আমি বলি বউ পালিয়েছে, বেশ করেছে। আমার বউ পালাবে না তো কার বউ পালাবে? নবাবের বউ পালাবে?
জনার্দন আবার চারদিকে চেয়ে নিলে, বললে–অত জোরে কথা বোলো না দাসমশাই, সবাই শুনে ফেলবে।
তা শুনে ফেললেই বা প্রভু, আমার তো কিছু গোপন নাই!
জনার্দন বললে–না দাশমশাই, তোমাকে একটা গোপন খবর দিই। তোমার বউকে ছোটমশাই মুর্শিদাবাদে নবাবের হারেমে পাঠিয়ে দিয়েছে, সেখানে মরিয়ম বেগম হয়ে গেছে তোমার বউ; সে খবর রাখো?
অতিথিশালার ভেতর দিকের দরজার আড়ালে আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল দুর্গা। আর একটু হলেই হারামজাদা বলে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল দুর্গা জনার্দনের ওপর। কিন্তু নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিলে। আর সঙ্গে সঙ্গে বুড়োমতন মানুষটাকে নিয়ে সেখানে কল গোকুল।
গোকুলও অবাক হয়ে গেছে উদ্ধব দাসকে দেখে। জিজ্ঞেস করলে–কী গো, অনেকদিন পরে যে? তোমার শ্বশুর মেয়ের শোকে পাগল হয়ে গেছে, শুনেছ তো? তা তুমি তো বেশ দিব্যি বহাল তবিয়তে আছ? তোমার তো দেখছি বিকার নেই?
উদ্ধব দাস কিন্তু সে কথায় কান দিলে না। বুড়ো মানুষটার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলে কী গো সরখেলমশাই, আপনি মুহুরি মানুষ, কেষ্টনগরের সেরেস্তা ছেড়ে এখেনে কেন?
সরখেল মশাইও বোধহয় অবাক হয়ে গিয়েছিল। বললে–আমি তো সরকারি কাজে এসেছি মহারাজের চিঠি নিয়ে, তা তুমি এখেনেও আসো?
উদ্ধব দাস বললে–আমার গতি বায়ুর মতো সর্বত্র প্রভু
তা কেষ্টনগরে আবার কবে যাচ্ছ? মুগের ডাল খেতে যাবে না?
মহারাজ কেমন আছেন প্রভু?
জনার্দনের এসব কথা ভাল লাগছিল না। আসল কথাটা না বলে দিলে যেন তৃপ্তি হচ্ছিল না তার। উদ্ধব দাসকে আড়ালে ডেকে এনে বললে–তা তোমার বউকে ছোটমশাই যে নিজের বউ বলে চালিয়ে দিয়ে নবাবের কাছে পাঠিয়ে দিলে, তুমি কিছু বলবে না?
উদ্ধব দাস বললে–আমি কী বলব প্রভু?
কেন, তুমি নিজামত-কাছারিতে গিয়ে ছোটমশাইয়ের নামে নালিশ করতে পারো না?
আমি প্রভু নালিশ করব?
নিশ্চয়ই করবে! তুমি নালিশ করলেই দেখবে ছোটমশাইকে কোতোয়াল নাকে দড়ি দিয়ে নিজামত কাছারিতে ধরে নিয়ে যাবে। নিজের বউকে না পাঠিয়ে তোমার বউকে পাঠালে, তাতে তুমি কিছু বলবে না?
সরখেলমশাই দূর থেকে ডাকলে-কী গো দাসমশাই, এসো, দুটো গান শুনি তোমার
জনার্দম বললে–যদি আমার কথা শোনো দাসমশাই তো তোমায় ভাল হবে, তা বলে দিচ্ছি
উদ্ধব দাসকে যেন তবু উত্তেজিত করা গেল না। উদ্ধব দাসের যেন বিকার নেই, বিরাগ নেই, বললে–আমি নালিশ করলে কি আমার বউকে আমি ফিরিয়ে পাব প্রভু? তাকে নিয়ে কি আমি। ঘরসংসার করতে পারব?
কেন পারবে মা দাসমশাই? তোমার ভো অগ্নিসাক্ষী রেখে বিয়ে করা ইস্ত্রী!
উদ্ধব দাস বলে বউ যদি আমার ঘরই করবে তো সে পালিয়ে গেল কেন? ধরে-বেঁধে কি পিরিত হয় প্রভু?
আলবত হয়। যদি ঘরসংসার না করে তো চুলের মুঠি ধরে তাকে বশে রাখবে। মেয়েমানুষের আবার অত তেজ কেন গো?
উদ্ধব দাস বললে–তাকে অত গাল দিয়ো না গো।
বলেই গান গেয়ে উঠল
শ্যামা তো সামান্য নয় গো।
মহাকাল কুন্তল-জাল।
শঙ্কর পদতলে, মগনা রিপুদলে,
তনুরুচি তরুণ তমাল।
উদ্ধব দাস হয়তো আরও অনেকক্ষণ গান গাইত, কিন্তু জনার্দন থামিয়ে দিলে। বললে–থামো তুমি, পাগলের মতো গান গেয়ো না। যদি কিছু টাকা কামাতে চাও তো ডিহিদারের কাছে খবরটা দিয়ে এসো যে, তোমার বউকে ছোটমশাই নাম ভাড়িয়ে চেহেলসূতুনে পাঠিয়ে দিয়েছে।
এবার সরখেল মশাই এসে হাজির, বললে–কী গো উদ্ধব বাবাজি, কেষ্টনগরে যাবে আমার সঙ্গে আমি আজ যাচ্ছি
উদ্ধব দাস সবতাতেই রাজি। বললে–~চলুন, আমার কাছে হাতিয়াগড়ও যা, কেষ্টনগরও তাই
জনার্দনের আর কথা বলা হল না। আস্তে আস্তে বেরোল অতিথিশালা থেকে। তারপর পায়ে পায়ে একেবারে চলতে লাগল উত্তর দিকে। সেখান থেকে দক্ষিণে। তারপর পুবে, তারপর পশ্চিমে।
দুর্গা এতক্ষশ সব ছিল। জনার্দন বেরোতেই সেও বেরোল, পেছন পেছন চলতে লাগল। প্রথমে উত্তর দিকে, সেখান থেকে দক্ষিণে। তারপর পুবে। তারপর পশ্চিমে। তারপর যেই ডিহিদারের দফতরখানা এসেছে অমনি টুপ করে সেখানে ঢুকে পড়ল জনার্দন। দুর্গা দূর থেকে দাঁড়িয়ে সব নজর করে দেখলে। হারামজাদা মিনসে। ভূতের কাছে মামদোবাজি ফলাতে এসেছে।
বড় বউরানি ছোটমশাইয়ের ঘরে ঢুকতেই হোমশাই মুখ তুললেন একবার।
কার চিঠি?
ছোটমশাই বিছানায় শুয়ে শুয়েই চিঠিটা পড়ছিলেন। বারবার পড়েও যেন মানে বুঝতে পারছিলেন না। আবার পড়তে লাগলেন মনে মনে।
শ্রীল শ্রীযুক্ত হিরণ্যনারায়ণ রায়,
বরাবরেষু— অত্র পত্রে সবিশেষ সংবাদ আপনার বাহক মারফত বিজ্ঞাপন করিতেছি। লোকপরম্পরায় জ্ঞাত হইলাম আপনার আপন প্রাণাধিকা পত্নীকে লোকলজ্জা অগ্রাহ্য করতঃ চেহেল্-সুতুনে পাঠাইয়া হিন্দুধর্মীয়দের মস্তক অবনত করাইয়া দিয়াছেন। জগৎশেঠজি, মিরজাফর আলি সাহেব প্রমুখাৎ যেসংবাদ সংগ্রহ করিয়াছি তাহা সবিশেষ বেদনাদায়ক। নবাব সম্প্রতি ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করতঃ উদ্ধত আচরণ করিয়া ধরাকে সরা জ্ঞান করিতেছেন। এমত সময়ে আপনার ন্যায় বিচক্ষণ ব্যক্তির এমন করিয়া স্বমর্যাদার মূলে কুঠারাঘাতকরণ অতীব ঘৃণাহ। ইহাপেক্ষা আপনার প্রাণাধিকা পত্নীকে হত্যা করা অনেকগুণে শ্ৰেয় ছিল। আপনি প্রাণভয়ে ভীত পীড়িত হইয়া নিজ-পত্নীর ধর্মনাশে সহায়তা করিয়া সমগ্র হিন্দুরপতিকুলে কলঙ্ক লেপন করিয়াছেন। অধিক কী লিখিব। আমাদিগের সমস্ত প্রচেষ্টা এমনভাবে নষ্ট করিয়া আপনি সকলের ক্ষতিসাধন করিয়াছেন। ইহার প্রতিকার সত্বর আবশ্যক। আশু কর্তব্য সম্বন্ধে স্থিরমস্তিষ্কে বিবেচনা করিবার মানসে আমি যথাবিহিত ব্যবস্থা করিতেছি। আপনার সাক্ষাৎ প্রয়োজন জানিবেন। কবে আসিতে পারিবেন পত্রবাহকের হস্তে পত্র দ্বারা জ্ঞাত করিবেন। ইতি—ভবদীয়
বড় বউরানি আবার জিজ্ঞেস করলেন–কার চিঠি?
ছোটমশাই বললেন–মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের।
কী লিখেছেন?
লিখেছেন আপনি আপনার স্ত্রীকে কেন পাঠালেন চেহেল্-সুতুনে? তাকে খুন করতে পারলেন না? আমাকে যেতে লিখেছেন–
বড় বউরানি বললেন–তুমি যাবে নাকি?
তাই তো ভাবছি। অতিথিশালায় লোক অপেক্ষা করছে
বড় বউরানি বললেন–তুমি যেন আবার বলে দিয়ো না সব। জিজ্ঞেস করলে বোলো কোনও উপায় না পেয়ে বউকে পাঠিয়ে দিয়েছিলে। বোলো ভয় পেয়েই এমন কাজ করে ফেলেছ, বুঝলে? নইলে সব মাটি হয়ে যাবে
নজর মহম্মদ কান্তকে পৌঁছিয়ে দিয়েই আড়ালে সরে পড়েছিল। কিন্তু মুখোমুখি দাঁড়িয়েও কান্ত বা মরালী কারও মুখেই কোনও কথা ছিল না। ওদিকে নহবতখানায় তখনও ইমনকল্যাণের রাগিনী মীড়ে-মূর্ঘনায় সমস্ত আবহাওয়াটা উদ্দাম করে তুলেছে।
মরালী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অধৈর্য হয়ে উঠেছিল। বললে–আপনি কেন এলেন এখানে? কী করে এলেন? কোন সাহসে এলেন?
ওই নজর মহম্মদকে একটা মোহর দিতে হল।
মোহর? মোহর কোথায় পেলেন? কে দিলে?
কান্ত তখনও হাঁফাচ্ছে। কোনওরকমে বললে–সারাফত আলি দিলে। তার অনেক টাকা। তার গন্ধতেলের দোকান আছে চকবাজারে, তার বাড়ির একটা ঘরে আমাকে থাকতে দিয়েছে, আমার কাছে। ভাড়া নেয় না।
সারাফত আলির নামটা শুনেই মরালীর মনে পড়ল গুলসনের কথা। লোকটা আরক বেচে বেগমদের জন্যে।
সে কেন আপনার হয়ে মোহর দিলে?
তা জানি না। বোধহয় তার রাগ আছে হাজি আহম্মদের বংশের ওপর। সে চায় এই চেহেল্-সুতুন ভেঙে গুঁড়িয়ে পিষে গোরস্থান করে দিতে!
কিন্তু আপনাকে সে এখানে পাঠালে কেন? নজর মহম্মদকে দিয়েই তো সেকাজ হত!
না, তা হলে তাই-ই করত সারাফত আলি। আমি সারাফত আলিকে বলেছিলুম আপনার সঙ্গে দেখা করবার ব্যবস্থা করে দেবার জন্যে। আমার খুব দেখা করবার ইচ্ছে হয়েছিল আপনার সঙ্গে।
কেন?
আমি এ’কদিন ঘুমোতে পারিনি রাত্তিরে। কেবল মনে হয়েছে আমি পাপ করেছি। আমি সে-পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। কটা টাকার জন্য আমি আপনার সর্বনাশ করেছি। আপনার ধর্ম নষ্ট করেছি। আপনি কাটোয়ার সেই সরাইখানাতেই পালিয়ে যেৰ্তে চেয়েছিলেন আমার সঙ্গে। শেষপর্যন্ত ডিহিদারের লোক এসে পড়াতে তা আর হয়ে ওঠেনি। এখন যদি বলেন তো আমি তার ব্যবস্থা করতে পারি। আপনি এখান থেকে পালিয়ে চলুন–
মরালী চমকে উঠল–এ আপনি বলছেন কী? এখান থেকে কেউ পালাতে পারে?
পারে, পারে! সারাফত আলির অনেক টাকা আছে, সে সব ব্যবস্থা করে দিতে পারে। আপনি শুধু বলুন যে আপনি রাজি, তা হলে আমি সব বন্দোবস্ত করব। আপনার কিছু ভাবনা নেই।
মরালী বললে–আপনার কি প্রাণের ভয়ও নেই? জানেন না যে এখানে এসে কেউ দেখে ফেললে। সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে কোতল করে ফেলবে!
তা করুক, আপনাকে উদ্ধার করার পর আমার যা হয় হোক, তার জন্যে আমি ভাবিনে–
মরালী খানিকক্ষণ কী যেন ভাবলে। তারপর বললে–আমি বলছি আপনি এখান থেকে চলে যান। এখানে আর কখনও আসবেন না এমন করে। এখানকার সব খবর আপনি জানেন না। আমি একদিনে সব শুনেছি, এরা মানুষ নয়, পশু। এদের মায়া-দয়া কিছু নেই–
সেই জন্যেই তো আপনাকে আমি নিয়ে যেতে এসেছি! নবাব ফিরে আসছে, এসেই আপনার ধর্ম নষ্ট করবে। তার আগেই আপনাকে আমি এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাই
মরালী কী যেন ভাবলে। বললেন, আমি যাব না—
কেন? যাবেন না কেন? এখনও তো উপায় আছে?
না, তবু যাব না, তাতে হাতিয়াগড়ের ছোটমশাইয়ের ক্ষতি হবে! আমি পালিয়ে গেলে তাদের ওপর অত্যাচার হবে।
এর পর আর কান্তর কী বলবার থাকতে পারে! তবু কান্ত খানিকক্ষণ ভাবতে লাগল সেইখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
মরালী বললে–আর দাঁড়িয়ে থাকবেন না আপনি, আমাকেও বিপদে ফেলবেন আপনিও বিপদে পড়বেন, আপনি যান
কান্ত চলেই আসছিল। এত কষ্ট করে এত চেষ্টা করে এখানে এসেছে অথচ এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করছিল না। বললে–একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করব?
কী?
আমাকে সেই বশির মিঞা বলছিল আপনি নাকি হাতিয়াগড়ের রানিবিবি নন, অন্য কেউ!
অন্য কেউ? হাতিয়াগড়ের রানিবিবি নই তো কে আমি?
কান্ত বললে–আমার অবিশ্যি বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু অবিশ্বাস করতেও ইচ্ছে হচ্ছে না। বশির মিঞার কথাই যদি সত্যি হয় তা হলে আমার কিন্তু আর আফশোসের শেষ থাকবে না–
কেন বলুন তো? বশির মিঞা কী বলেছে?
কান্ত বললে–কে নাকি বশির মিঞাকে বলেছে আপনি আসলে হাতিয়াগড়ের শোভারাম বিশ্বাস মশাইয়ের মেয়ে মরালী, যার সঙ্গে আমারই বিয়ে হবার কথা ছিল। আমি তো তাকে দেখিনি, তাই আমি কিছু বলতে পারলুম না–
কিন্তু এ আজগুবি খবরটা কে দিলে তাকে?
কান্ত বললে–হাতিয়াগড়ের ডিহিদার এখানে খবর পাঠিয়েছে–আমিও তাকে বলেছি এটা একেবারে আজগুবি খবর
তারপর একটু থেমে বললে–আচ্ছা, তা হলে আমি চলি-যদি কখনও আপনার কিছু দরকার হয় ওই নজর মহম্মদকে বলবেন, তা হলেই আমি আসব আপনার যদি কখনও এখান থেকে চলে যাবারও ইচ্ছে হয়, তাও জানাবেন
অন্ধকারের আড়ালে কোথায় নজর মহম্মদ পঁড়িয়ে ছিল। কান্ত চলে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই সে সঙ্গ নিলে।
শুনুন!
মরালী পেছন থেকে অস্ফুট স্বরে আবার ডাকলে। শুনুন।
কান্ত ফিরতেই মরালী জিজ্ঞেস করলে আর একটা কথা জানবার ছিল, আপনি কি হাতিয়াগড়ে আর গিয়েছিলেন?
না, কেন?
যদি যান তো একটা কাজ করতে পারবেন? যে-মেয়েটা বিয়ের রাত্তিরে পালিয়েছিল তার বাবা শোভারাম বিশ্বাস ছিল আমাদের নফর। তিনি কেমন আছেন একবার দেখে এনে আমায় জানানে?
নহবতখানায় ইনসাফ মিঞা ইমন থামিয়ে এবার বেহাগে আলাপ শুরু করল। কোথায় দূর থেকে আবার নাচের ঘুঙুর বেজে উঠল। আর হঠাৎ কে যেন বড় করুণ একটা আর্তনাদ করে কান্নায় ফেটে পড়ল। সমস্ত চেহেল্-সুকুন যেন একটা নতু রোমাঞ্চে রিনরিন করে উঠল।
একবার খবরটা জানাবেন আমায়?
কান্ত অবাক হয়ে গেল অনুরোধটা শুনে। আরও কাছে সরে এল। বললে–তা হলে আমি যা শুনেছি তাই-ই সত্যি? আপনিই কি মরালী?
মরালী ভয়ে দু’পা পিছিয়ে এল। তারপর শিউরে উঠে পেছন দিকে সরে গেল। বললে–না না, আমি মরালী নই, আমি লস্করপুরের তালুকদার কাশিম আলির মেয়ে মরিয়ম বেগম
বলতে বলতে দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়ল।
নজর মহম্মদের কথায় কান্তর চমক ভাঙল। বললেচলিয়ে জনাব–চলিয়ে
ঝাঁঝাঁ করছে রোদ। বর্ষা আসার আগে এই সময়টাই বাংলাদেশে টেকা দায় হয়ে ওঠে। সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানের পেছনে তখন আগুনের মতো গরম। না আছে একটু হাওয়া, না আছে একটু ঠান্ডা। তবু রাস্তায় চলতে চলতে পুঁটলি থেকে গামছাটা বার করে ঘাড়-মুখ-মাথা মুছে নিয়েছে। বোশেখ মাসে জায়গায় জায়গায় জলসত্র থাকে। জমিদারবাবুদের কাছারিঘরের লাগোয়া একটা চালাঘরে বড় মাটির জালা মাটিতে পোঁতা থাকে। রাস্তার লোক জল-তেষ্টা পেলে এসে জল খেতে চাইলেই কাছারির লোক জল দেয়, বাতাসা দেয়। এক মুঠো বাতাসা চিবিয়ে এক ঘটি জল খেয়ে সেখানেই বাঁশের মাচার ওপর বসে জিরিয়ে নেয়। তারপর রোদটা একটু পড়লে আবার হাঁটা দিতে শুরু করে।
এমনিতে একা একা হাঁটা উচিত নয়। রাস্তায় যেতে যেতে এক-একটা দল গড়ে ওঠে। দলের সঙ্গে চললে বিপদ কম। নইলে কোথায় কখন কী ঘটে বলা যায় না। ঠ্যাঙাড়ে আছে, ঠগিরা আছে। বেশ ভাবসাব করে তোমার সঙ্গে মিলেমিশে চলতে লাগল। একসঙ্গে চিড়ে-মুড়ি খেয়ে তোমাকে আপন করে নিলে। তারপর কখন তোমায় খুন করে তোমার টাকাকড়ি নিয়ে পালিয়ে যাবে তার ঠিক নেই। এ হামেশাই চলছে। তাই অন্ধকার হবার পর রাস্তায় আর কেউ বেরোয় না। দিনমানে-দিনমানে কোথাও অতিথিশালায় উঠে পড়লে আর ভয় নেই। কিংবা কোনও দোকানে।
মোল্লাহাটির মধুসূদন কর্মকারের দোকান এমনি একটা জায়গা। দোকানের লাগোয়া একটা বড় ঘর আছে। সেখানে মধুসূদন রাস্তার লোকদের থাকবার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। লোকে একদিনদুদিন থাকে, রান্নাবান্না করে খায়, আর তারপর যে-যার কাজে চলে যায়। তার বদলে কিছু কড়ি দিতে হয় মধুসূদনকে। সেইটেই মধুসূদনের আয়।
বশির মিঞা সব বলে কয়ে ঠিক করে দিয়েছিল।
বশির বলেছিল–তোর কিছু ডর নেই, মধুসূদনের ওখানে গিয়ে তুই উঠবি–দোকান থেকে চাল ডাল ফুটিয়ে খাবি, যদি তোকে জিজ্ঞেস করে কোথায় যাবি তুই, তা হলে বলবি নিজামতের নোকরির চেষ্টা করতে মুর্শিদাবাদ যাচ্ছিস–ব্যস, চুকে গেল ল্যাঠা!
বশির মিঞা যেমন যেমন বলেছিল ঠিক তেমন তেমন করেছিল কান্ত। কোনও অসুবিধে হয়নি৷ মধুসূদন কর্মকার লোকটা ভাল। মধুসূদন বলেছিল–আমার দোকানে সব্বাই ওঠে আজ্ঞে, এখেনে তো থাকবার ব্যবস্থা নেই আর, আপনার যতদিন ইচ্ছে থাকুন
কান্ত মোল্লাহাটিতে এসে ওঠবার পর থেকেই চারদিকে নজর রাখছিল। বশির মিঞা বলে দিয়েছিল লোকটা বুড়ো মানুষ। কাঁচা-পাকা চুল মাথায়। ছাড়া ছাড়া দাড়ি আছে মুখে। হাতে একটা থলি আছে। সেই থলিটার ভেতরেই তার গামছা, খড়ম, চকমকি, সবকিছু থাকে। তারই ভেতরে একটা চিঠি আছে। সে-চিঠিটা হাতিয়াগড়ের রাজা লিখছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে। লোকটা এসে ওই মোল্লাহাটির মধুসূদনের দোকানে উঠবে। বিকেল নাগাদ আসবে আর ভোরবেলা উঠেই আবার হাঁটা দেবে। রাত্তিরের মধ্যেই সেই চিঠিটা হাতসাফাই করে এনে দিতে হবে।
সে-চিঠিতে কী লেখা আছে?
সে জেনে তোর কী ফায়দা? খতটা আনলেই তোর কাম হাসিল হয়ে যাবে—
এর পরে আর কিছু বলবার ছিল না। রানিবিবির সঙ্গে দেখা করার পরদিনই মুর্শিদাবাদ থেকে বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল। সারাফত আলি ভোরবেলাই ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল–কী রে কান্তবাবু, মুলাকাত হল রানিবিবির সঙ্গে?
কান্ত বলেছিল–হয়েছে মিঞাসাহেব
কাম হল?
হ্যাঁ মিঞাসাহেব।
তা হলে যা বলেছি তা করতে পারবি তো? নবাব সুজাউদ্দিন,নবাব সরফরাজ খাঁ’র হাড় গুড়ো করে দিতে পারবি তো? নবাব আলিবর্দির চেহেল্-সুতুন ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে সেকবি তো? রানিবিবিকে রাজি করাতে পারবি তো?
কান্ত বললে–না মিঞাসাহেব, রানিবিবি পালাতে চাইছে না–
পালাতে তো চাইবেই না। নবাবি আরাম পেলে কেউ পালাতে চায়? পালালে চলবে না। তুই রোজ যাবি। রোজ রোজ গিয়ে হালচাল দেখবি। যত মোহর লাগবে খুদ আমি দেব। কাউকে পরোয়া করবি না। নজর মহম্মদরা মোহরের বান্দা, মোহর পেলেই ওরা জব্দ। আমি তোর হাতে আরক দেব, সেই। আরক খাইয়ে দিবি সকলকে
আরক? কান্ত বুঝতে পারেনি কথাটা।
সারাফত আলি বলেছিল–হা রে কান্তবাবু, আরক। আমার এ খুশবু তেল তো বাহারকা ভড়ং, আসলি চিজ তো আমার আরক।
এ আরক খেলে কী হয়?
এতে সাপকা জহর আছে, বিষ। এ জহর খেলে সব জিন্দগি বরবাদ হয়ে যায়। চেহেল-সুতুনে যিনি বেগম আছে সব কোইকো হাম আরক পিয়া। সব বেগমকো জিন্দগি বরবাদ কর দেঙ্গে। চেহেল সুতুন মিষ্টি মে গিরায়েঙ্গে। কাল ভি যাও চেহেল-সুতুন মেকাল ভি নজর মহম্মদকে মোহর দেঙ্গে
কান্ত অবাক হয়ে গিয়েছিল। শুধু কাল কেন, বরাবর যদি যেতে বলে মিঞাসাহেব তো বরাবরই যাবে।
পরের দিন সকালবেলা থেকেই আবার তৈরি হয়ে ছিল। নজর মহম্মদ পরের দিনও আসবে। সমস্ত রাতটা সমস্ত দিনটা সেই কথাটা ভেবে ভেবে কাটাবে ভেবেছিল। আবার সন্ধেবেলা হলেইনজর মহম্মদ তাকে ভেতরে নিয়ে যাবে। ভেবেছিল এবার গিয়ে অন্য কথা জিজ্ঞেস করবে। জিজ্ঞেস করবে–আপনি বলুন আপনি কে? আমার সন্দেহ হচ্ছে আপনি রানিবিবি নন, আপনি উদ্ধব দাসের স্ত্রী মরালী
সমস্ত দিনটা কান্তর কেমন কল্পনা করতে ভাল লাগল যে, রানিবিবি ঠিক আসল রানিবিবি নয়। রানিবিবি আসলে মরালী। অথচ মরালী হলেই বা তার লাভটা কী তাও ভেবে পেলে না। বারবার গিয়ে সারাফত আলিকে জিজ্ঞেস করলে–আচ্ছা মিঞাসাহেব, নজর মহম্মদ এসেছিল আজ?
প্রত্যেকবারই সারাফত আলি বলেছিল–নেহি আয়া
কান্তর মনে কেমন যেন ভয় হয়েছিল। যদি নজর মহম্মদ না আসে আজ?
চকবাজারের সামনের রাস্তায় গিয়েও দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ। রাস্তায় ভিড়, সেই ভিড়ের মধ্যেই উট চলেছে, নবাবের হাতি চলেছে, কোতোয়াল, সেপাই, তাঞ্জাম চলেছে। কাছারি থেকে দলে দলে লোক চলেছে। কিন্তু কোথাও নজর মহম্মদের দেখা নেই। হঠাৎ দেখলে বশির মিঞা আসছে।
বশির মিঞাকে দেখেই কান্ত ভয় পেয়ে গিয়েছে। আবার যদি কোনও কাজে পাঠায়? সত্যিই যা ভয় করেছিল তাই-ই সত্যি হল। বশির মিঞা বললে–তোকেই খুঁজতে এসেছিলুম তোকে এক জায়গায় যেতে হবে
কোথায়? কখন?
এখনই গেলে ভাল হয়। মোল্লাহাটিতে।
কান্ত বললে–মোল্লাহাটি কোথায়?
সে তোকে আমি সব সমঝিয়ে দেব। মোল্লাহাটিতে মধুসূদন কর্মকারের দুকান আছে। সেখানে গিয়ে তোকে উঠতে হবে। সেখানে একটা বুড়ো এসে উঠবে, সে যাবে কিষ্টোনগরে। মহারাজ কিষ্টেচন্দরের কাছারির সেরেস্তার লোক সে। তার সঙ্গে ভাব জমিয়ে একঠো কাম হাসিল করতে হবে!
কী কাজ?
সব বলব তোকে। কোনও ডর নেই। তার কাছে একটা খত আছে। হাতিয়াগড়ের রাজার লেখা খত, সেই খতটা হাতসাফাই করে নিয়ে আসতে হবে!
সে চিঠিতে কী লেখা আছে?
তাই তো দেখতে হবে। মনসুর আলি সাহেব জরুরি হুকুম দিয়েছে সেই খতটা এনে দিতে হবে মেহেদি নেসার সাহেব কলকাতা থেকে ফিরে এলেই পেশ করতে হবে তার বরাবর।
কাজটার কথা শুনে মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল কান্তর। হাতসাফাই মানেই তো চুরি! শেষকালে চুরি করতে হবে চাকরির জন্যে। একবার একটা মেয়েমানুষ এনে দিয়েছে হারেমে, এবার আর একটা চিঠি চুরি করতে হবে!
কান্ত বললে–ওকাজ আমি পারব না ভাই, ওকাজ আমার দ্বারা হবে না–আমি পরের চিঠি চুরি করতে পারব না
বশির মিঞা যেন কথাটা শুনে আকাশ থেকে পড়ল। বললে–চুরি? চুরি বলছিস কেন? দেশের কাম করবি তাকে তুই চুরি বলছিস? দেশকা সওয়াল ঠিক রাখতে হবে না? দেশের দুশমনদের শায়েস্তা রাখতে চুরি-রাহাজানি বাটপাড়ি করা কি খারাব কাম? তুই তো নবাবের কাম করছিস! নিজামতের পরওয়ানা আছে তোর কাছে, তোর কীসের ডর?
বশির মিঞা তাকে অনেকক্ষণ ধরে বোঝালে। দেশের স্বার্থের জন্যে কোনও পাপই পাপ নয়। তুই যে রানিবিবিকে এনেছিস সেও পাপ কাজ নয়। নবাবের সেবা কি পাপ? নবাব হল খোদা। আসলে খোদাতালার চেয়েও বড় হল নবাব। নবাবের সেবার জন্যে খুন করাকেও পাপ বলে না। দরকার হলে খুনও করতে হতে পারে। নবাব আলিবর্দি খাঁ যে সরফরাজ খাঁকে খুন করে মুর্শিদাবাদের নবাব হয়েছে, সেটা কি পাপ? বাদশা ঔরঙ্গজেব নিজের ভাইয়াকে খুন করেছে, সে কি পাপ? আসলে রাজার কামে পাপ নেই। তবে হ্যাঁ, আমাদের নিজের কামে পাপ আছে। আমার নিজের মামলার ফয়সালা করতে যদি আমি বিবিকে খুন করি, সেটা গুণাহ, লেকিন নবাবকে খুশি করবার জন্যে যদি আমার বিবিকে নবাবের হারেমে ভেজিয়ে দিই তো তাতে পাপ নেই। যত আদমি নবাবকে আওরাত জুগিয়েছে, সবাই বেহেস্তে যাবে। আমাদের দুনিয়ায় নবাব বাদশাই তো খোদাতালা রে ইয়ার। নবাব খুশ হলেই তো খোদাতালা খুশ হয়।
এসব কথা কান্ত অনেকবার শুনেছে বশিরের মুখ থেকে। শুনেছে, কিন্তু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি। ছোটবেলা থেকে দিদিমার কাছে অন্য কথা শুনে এসেছে কান্ত। দিদিমা কান্তকে সৎ হতে শিখিয়েছিল, ধার্মিক হতে শিখিয়েছিল। দেবদ্বিজে ভক্তি করতে শিখিয়েছিল। দিদিমা শিখিয়েছিল–ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সূর্যের দিকে মুখ করে তিনবার প্রণাম করতে। পরের জিনিসের ওপর লোভ করতে বারণ করেছিল। ব্রাহ্মণ দেখলেই প্রণাম করতে শিখিয়েছিল। নিচু জাতের লোকদেরও ঘেন্না করতে বারণ করেছিল। কিন্তু কোথায় গেল সেই দিদিমার শিক্ষা! কলকাতায় বেভারিজ সাহেবের গদিতে চাকরি করতে আসার পর থেকেই যেন সব জিনিস উলটেপালটে গেল। মুর্শিদাবাদে আসার পর থেকে তার আর কিছুই রইল না। এখানে সবই যেন উলটো। চুরি করলেও দোষ নেই যদি তা নবাবের জন্যে করা হয়। মিথ্যে কথা বললেও দোষ নেই যদি তা নবাবের জন্যে বলা হয়।
কান্ত জিজ্ঞেস করেছিল–তা হলে তোরা কার দলে? নবাবের দলে না মিরজাফর সাহেবের দলে?
বশির মিঞা বলেছিল যে যখন নবাব হবে আমরা তার দলে!
যদি এখনকার নবাবকে সরিয়ে মিরজাফর আলি সাহেব নবাব হয়, তখন?
বশির মিঞা মুচকে হেসে চুপি চুপি বলেছিল-আরে মিরজাফর আলি সাহেবই তো আখেরে নবাব হবে।
তার মানে?
বশির মিঞা এক মুহূর্তেই আবার গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। তারপর বলেছিল–তুই কাউকে বাতলাসনি। যদি খোদাতালার মর্জি হয় তো দেখবি মসনদ পালটে যাবে, মুর্শিদাবাদের সকল ভি পালটে যাবে। একবার যদি মিরজাফর সাহেব নবাব হয় তো তখন দেখবি আমিই তখন হব হুজুরনবিশ। আর তুই যদি ইমানদারিসে কাম করিস তো তোকেও আমি আমার সেরেস্তায় ভাল কাম দেব। আর তুই যদি চাস তোকে মিরতোজক করে দেব
মিরতোজক?
হ্যাঁ হ্যাঁ, মির তোজক। দরবার দেখাশোনা করবি, জৌলুস দেখাশোনা করবি। নবাবের কাছাকাছি থাকতে পারবি। মোটা ঘুষ আছে ও নোকরিতে
সত্যিই অনেক লোভ দেখিয়েছিল বশির মিঞা। তবু কান্তর মন টলেনি। সারাফত আলির দোকানে বসে বসে মনটা পড়ে থাকত চেহেল্-সুতুনের ভেতরে। কিছুই জিজ্ঞেস করা হয়নি। কী রকম করে দিন কাটছে, কী খেতে দিচ্ছে।
মোল্লাহাটির রাস্তাতেও কেবল সেই কথাই ভেবেছে সে। আবার কবে দেখা হবে কে জানে। সারাফত আলি আসবার দিন জিজ্ঞেস করেছিল–কী রে, কোথায় চলেছিস আবার? কোন বিবিকে আনতে?
কান্ত বলেছিল–বিবি নয় মিঞাসায়েব, এবার অন্য কাম—
দুত্তোর কাম! কাম তুই ছেড়ে দে!
কাম ছাড়লে আমি খাব কী?
কাম আমি দেব তোকে। তুই খালি চেহেল্-সুতুনে গিয়ে সব বরবাদ করে দে, আমি তোকে খিলাব। তোকে টাকা দিতে হবে না। মুফোত খিলাব। তোর অন্য কিছু কাম করতে হবে না
অদ্ভুত মানুষটা ওই সারাফত আলি! কত বছর ধরে ওই দোকান খুলে বসে আছে নিজের চোখে চেহে-সূতুনের ধ্বংস দেখবে বলে। রাত্রে নেশার ঘোরেও বোধহয় সারাফত আলি চেহেল্-সুতুনের ধ্বংসের স্বপ্ন দেখে।
রাস্তার একটা লোককে দেখে কান্ত জিজ্ঞেস করলো মশাই, মোল্লাহাটির রাস্তাটা কোনদিকে বলতে পারেন?
মোল্লাহাটি? আমিও তো মোল্লাহাটিতেই যাচ্ছি—
আজ্ঞে, আমি যাব মোল্লাহাটির মধুসূদন কর্মকারের দোকানে।
তা আমি তো ওখানেই যাব। আজ রাতটা ওখানেই থাকব! মশাইয়ের নিবাস?
কান্ত বললে–চাকলা বর্ধমান, গ্রাম বড়চাতরা
মশাই কী কর্ম করেন?
কান্ত একটু চমকে উঠল, তার চাকরি তো বলবার মতন নয়। ভাল করে লোকটার দিকে চেয়ে দেখলে। বশির মিঞার যেমন যেমন বর্ণনা তার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, মুখে কাঁচা-পাকা গোঁফ-দাড়ি। বয়স ষাট-সত্তর। হাতে একটা পোঁটলা।
তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কায়দা করে কান্ত প্রশ্ন করলে মশাইয়ের কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
ভদ্রলোক বললে–আমি আসছি হাতিয়াগড় থেকে
হাতিয়াগড় নামটা শুনেই আরও সতর্ক হয়ে উঠল কান্ত। আশ্চর্য, যার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে এখানে তারই সঙ্গে এমনভাবে রাস্তায় এত সহজে দেখা হয়ে যাবে ভাবা যায়নি। লোকটা কিন্তু বেশ নিশ্চিন্ত হল একটা সঙ্গী পেয়ে। বললে–যা দিনকাল পড়েছে মশাই, পথে একা একা চলাই বিপদ, এই সেদিন একটা লোককে খুন করে ফেলে রেখে গেছে পুঁটিয়ার রাস্তায় দেখলাম
আপনাকে বুঝি সব জায়গায়ই ঘুরতে হয়?
ভদ্রলোক বললে–জমিদারি-সেরেস্তার কাজ হল ঝকমারির কাজ। ঘুরতে ঘুরতেই প্রাণ বেরিয়ে যায়। এই তো হাতিয়াগড় থেকে আসছি মোল্লাহাটিতে, এখান থেকে সোজা যাব কেষ্টনগরে। আবার কেষ্টনগরে একদিন থাকি কি না-থাকি, যেখানে মহারাজের হুকুম হবে যেতে হবে। আমি না হলে তো কাজ চলে না মহারাজার
কান্ত পুঁটলিটার দিকে চেয়ে দেখলে। বেশ পেট-ফোলা পোঁটলা। ওরই ভেতর বোধহয় চিঠিটা আছে। কী বিচ্ছিরি চাকরি। এমন বিশ্বাসী লোককে ঠকাতে হবে! অথচ লোকটা তো কোনও দোষ করেনি।
দেখতে দেখতে মধুসূদনের দোকানটা এসে গেল। ভদ্রলোককে দেখেই দোকানদার দু’হাত জোড় করে অভ্যর্থনা করলে আসুন সরখেলমশাই, আসুন–কাজটা হল?
বেশ বর্ধিষ্ণু লোক মধুসূদন কর্মকার। দোকানটা বেশ সাজানো। গোবর দিয়ে পরিপাটি করে নিকোনো দাওয়া। চালের বাতা থেকে শিকের ওপর কয়েকটা চালকুমড়ো ঝুলছে।
সঙ্গে উনি কে?
উনি আমার পথের সঙ্গী। কান্তবাবু। কান্ত সরকার মশাই। চাকলা বর্ধমানের বড়চাতরা গ্রামে বাড়ি, উনিও এখেনে একরাত্তির থেকে মুর্শিদাবাদে যাবেন নিজামতের কাছারির কাজে। আজকাল রাস্তায় সৎসঙ্গী পাওয়াই সৌভাগ্যের কথা কর্মকারমশাই। এবার হাতিয়াগড়েও বেশ কাটল একটা রাত
মধুসূদন জিজ্ঞেস করলে-কী রকম?
আমাদের সেই উদ্ধব দাসমশাই নতুন গান বেঁধেছে, শোনালে আমাকে।
তা তাকে নিয়ে এলেন না কেন সঙ্গে করে?
সরখেলমশাই বললে–দাসমশাই কি আর সেইরকম লোক? আমাকে বললে–মুগের ডাল খেতে আসবে কেষ্টনগরে, তারপরে আবার কী মতি হল, বললে–না, অনেকদিন লস্করপুরে যাইনি, সেখানে রথের মেলায় ভাল আনারস পাওয়া যায়, তাই খেতে যাব। আর এল না।
সরখেলমশাইয়ের সঙ্গে কর্মকার মশাইয়ের বেশ ভাব বোঝা গেল। পোঁটলাটা দাওয়ার ওপর নামিয়ে গামছা দিয়ে গায়ের ঘাম মুছতে মুছতে সরখেলমশাই বললে–দাসমশাই একটা কাণ্ড করে ফেলেছে, শুনেছেন?
কী কাণ্ড?
সে এক আজব কাণ্ড। রাজবাড়ির গোকুলের কাছে শুনলুম। হঠাৎ নাকি শোভারাম বিশ্বাসের মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছিল। তা মজার কাণ্ড, বিয়ের রাত্তিরেই বউ বাসরঘর থেকে পালিয়ে গেছে। দাসমশাই আবার হাসতে হাসতে সবিস্তারে বললে–সেই ঘটনা।
মধুসূদন কর্মকার বললে–সে তো আমি শুনেছি, আমাকে বলেছে
আর সেই গানটা শোনেননি?
কোন গান?
বউয়ের শোকে যে-গানটা লিখেছে দাসমশাই আমার তো মুখস্থ হয়ে গিয়েছে–
শোনো হে শিব শ্রবণে।
আমি রব না ভব-ভবনে ॥
যে-নারী করে নাথ।
পতিবক্ষে পদাঘাত
তুমি তারই বশীভূততা।
আমি তা সব কেমনে ॥
আহা বেড়ে গান লিখেছে, কর্মকারমশাই।
মধুসূদন বললে–দাসমশাই আমাকে বলে গেছে তার বউকে নিয়ে একটা কাব্য লিখবে। আপনাদের রায় গুণাকর যেমন অন্নদামঙ্গল’ লিখেছেন, অমনি ওর চেয়েও ভাল কাব্য লিখবে।
সরখেলমশাই হেসে উঠল–পাগলছাগল মানুষ তো,বউ পালিয়ে গেছে তাতে বিকার নেই মনে
মধুসূদন বললে–মহাপুরুষ মাত্রই তো পাগল
তা যা বলেছেন। অমন মন পেলে আমরা বেঁচে যেতুম। এদিকে আর একটা কাণ্ড শুনে এলাম–দ্বাসমশাইয়ের শ্বশুর সেই শোভারাম বিশ্বাস মশাই কিন্তু মেয়ের শোকে পাগল হয়ে গেছে!
কান্ত চমকে উঠল। এতক্ষণ কান্ত কোনও কথা বলেনি। মন দিয়ে দু’জনের কথা শুনছিল। আর সরখেলমশাইয়ের পুঁটলিটার দিকে চেয়ে দেখছিল। যে এতখানি বিশ্বাস করেছে তাকে, তার কাছ থেকে চিঠি চুরি করতে হবে? এমন কী জরুরি চিঠি যা চুরি না করলে বশির মিঞার চলছে না। যে-চিঠি না স্লেখতে পেলে নবাব-নিজামত লাটে উঠবে! কিন্তু হঠাৎ শোভারামের পাগল হওয়ার কথা কানে যেতেই আর চেপে রাখতে পারলে না। জিজ্ঞেস করলে–শোভারাম বিশ্বাসমশাই পাগল হয়ে গেছেন?
দু’জনেই চাইলে কান্তর দিকে।
মশাই কি শোভারামকে চেনেন নাকি?
কান্ত বললো, হ্যাঁ চিনতাম তাঁকে!
তাকে কী করে চিনলেন? মশাইয়ের কি হাতিয়াগড়ে যাওয়া-আসা আছে?
হ্যাঁ, বার দু-এক গিয়েছিলাম।
কী সূত্রে?
কর্মসূত্রে!
এরপর আর কথা এগোল না। মধুসূদন কর্মকারের চাকর হাত-মুখ ধোবার জল নিয়ে এল। হাত-মুখ ধুতেই ব্যস্ত হয়ে উঠল সরখেলমশাই। কিন্তু পুঁটলিটা দাওয়ায় রেখে গেল না। সেটা ছাড়তে যেন ভয় হল সরখেলমশাইয়ের। সেটাও সঙ্গে নিয়ে সয়ত্নে পাশে রেখে মুখ-হাত-পা ধুয়ে গামছা দিয়ে মুছে আবার দাওয়ায় এসে বসল। কান্ত বুঝল বশির মিঞা যা বলেছে তার একবর্ণও মিথ্যে নয়। নিশ্চয় কোনও গোপনীয় চিঠি আছে ওর মধ্যে। কান্ত কিন্তু নিজের পুঁটলিটা দাওয়ায় রেখে মুখ-হাত ধুতে গেল।
গুলসন মেয়েটা সেদিন এসেই বললে–চলল ভাই, চলো–
মুরালীর প্রথমটায় একটু সংকোচ হয়েছিল। যদি নজর মহম্মদরা কিছু বলে! যদি নজর মহম্মদ, কি বরকত আলিদের সর্দার পিরালি খাঁ জানতে পারে! কিন্তু সেই যেদিন কান্ত এসেছিল সেইদিন থেকেই নজর মহম্মদ যেন একটু অন্যরকম ব্যবহার শুরু করেছে। হয়তো এক মোহর ঘুষ পেয়েছে বলে। একটু অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করেছে। চোখে যে তীক্ষ্ণতা ছিল সেটা যেন একটু কমে এসেছে। আর সেরকম নজরবন্দি করে রাখবার চেষ্টা নেই। কিংবা হয়তো নজর রাখে আড়াল থেকে। আড়াল থেকে হয়তো দেখে মরালী কী করছে, কী খাচ্ছে, কার সঙ্গে কথা বলছে। আর বাঁদিটাও অদ্ভুত। যেন মাটির পুতুল। কথা শুনতে পাচ্ছে কি না তাও বোঝা যায় না। তার সঙ্গে যে বসে বসে একটু আজেবাজে দুটো কথা বলে সময় কাটাবে তারও উপায় নেই। তার কী নাম তাও কেউ বলে না। ঘাগরা পরা, মাথায় বেণী ঝোলে, চুপি চুপি আসে, দাঁড়িয়ে থাকে, খাওয়ার সময় অপেক্ষা করে। তারপর এঁটো বাসনগুলো নিয়ে চলে যায়। আর বিরক্ত করে না। বাঁদিটা সামনে না-এলেই মরালীর ভাল লাগে।
গুলসন কিন্তু সেই তখনই এসেছিল। সেই কান্ত চলে যাবার পরই।
এসেই বলেছিল–কী হল? কে এসেছিল? সত্যিই তোমার কোনও জানাশোনা লোক নাকি ভাই?
তারপর মরালীর মুখের দিকে চেয়ে বলেছিল–একী ভাই, তুমি কাঁদছ নাকি?
বলে নিজের ওড়নি দিয়ে মরালীর চোখ-মুখ মুছিয়ে দিয়েছিল।
মরালী বলেছিল–তুমি যাও, শেষকালে কেউ দেখে ফেললে তোমাকেই হয়তো কষ্ট দেবে ওরা। তখন আবার তম্বি করবে!
হু, তম্বি করবে। তম্বি অমনি করলেই হল কিনা। প্রথম প্রথম আমিও তোমার মতন ভয় পেতাম। আমিও তোমার মতন কাঁদতাম! শেষে মরিয়া হয়ে উঠলাম। ভাবলাম জীবনটা যখন নষ্টই হয়ে গেছে তখন কাকে আর ভয় করতে যাব! আমাকে চোখে চোখে রাখত, আরক খেতে দিতে চাইত! শেষকালে ভাই একদিন আর পারলাম না, আরক খেলাম।
খেলে?
হ্যাঁ, এখনও খাই, রোজ খাই। রোজ না-খেলে চলে না। না-খেলে ভাই আমার মাথা ঘোরে, গা বমিবমি করে। এখন একেবারে নেশা ধরে গেছে।
কিন্তু তুমিই তো বলেছিলে ওতে সাপের বিষ মেশানো থাকে!
তা থাকুক, সাপের চেয়েও কত বড় বড় জানোয়ারের ছোবল খাচ্ছি, সাপ তো তার কাছে তুচ্ছ। তুমিও ছোবল খাবে। তুমি তো ভাই এখন সবেমাত্তর এসেছ, কিছুদিন থাকো এখেনে, তখন সব টের পাবে
বলেই বললে–না না, তোমার ভয় পাবার কিছু নেই, আমি যখন আছি, তখন তোমার কিচ্ছু ভয় পাবার নেই–আমি তোমাকে ঠিক বাঁচিয়ে দেব। তুমি কিন্তু ভাই কথা দাও আরক খাবে না তুমি, মোটে আরক ছোবে না?
মরালী বললে–তুমি যখন এত বলছ, তখন কেন ও-বিষ খেতে যাব?
হ্যাঁ ভাই, খেয়ো না। ও বিষই বটে! সারাফত আলির ওই বিষেরই ব্যাবসা। আমরা একবার বিষ খেয়ে ফেলেছি, তাই আর উপায় নেই। এখন মরে গেলেও আর ছাড়তে পারব না
মরালী বললে–তা হলে আমি কী করব বলল তো?
গুলসন বললে–আমি তো তোমাকে বলেছি, আমি যখন আছি, তখন তোমার কোনও ভয় নেই। কিন্তু ও-লোকটা কে? কাকে নজর মহম্মদ ভেতরে নিয়ে এসেছিল? কী মতলব ওর?
মরালী খানিকক্ষণ চুপ করে রইল! কী জবাব দেবে সে?
ও বুঝেছি, ওই নজর মহম্মদ ওকে নিয়ে এসেছিল তোমার কাছে, তোমাকে যাচাই করতে, না? এইরকম করেই ওরা যাচাই করে মেয়েদের। একবার যদি ওদের কথায় ভাই ভুলে যাও তো গেলে তুমি!
কী করবে তা হলে?
তখন আর তোমার রক্ষে নেই। তখন ওরা দু’হাতে টাকা লুটবে। একেবারে দু’হাতে টাকা লুটবে। শহর থেকে সব বদমাইস মরদদের এনে তোমার ঘরে ঢুকিয়ে দেবে, তোমার ঘরে তাদের বসাতে হবে, তাদের খাতির করতে হবে–তুমি তখন ইচ্ছে না করলেও কোনও উপায় থাকবে না।
তা এতগুলো বেগম নিয়ে নবাবের কী লাভ?
গুলসন বললে–লাভ নয়? আজ এটা, কাল সেটা, এমনি করেই সকলকে চেখে-চেখে বেড়াবে
কিন্তু নবাবের সময় কখন? নবাব কি এই চেহেল-সুতুনের ভেতরে আসে?
গুলসন বললে–নবাবের মাথায় হাজারটা ঝামেলা, নবাবের সময় না-থাকলেই বা, তার ইয়াররা তো আছে। তার ইয়ারদের জ্বালাতেই তো আমরা অস্থির! কাজির চেয়ে যে প্যায়দার হুমকি বেশি এখেনে!
মরালী বললে–আমি সেই সব ভেবে ভেবে একেবারে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছি। আমি তো বাইরে থেকে এসব টের পাইনি। আমি জানতুম এখানে বুঝি তোমরা খুব আরামে থাকো!
আরাম না ছাই! কত বেগম এখানে গলায় দড়ি দিয়েছে তা জানো?
ওমা, তাই নাকি?
তা দেবে না? আমারই তো মাঝে মাঝে গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে করে। আগেকার একনবাবের পনেরোশো বেগম ছিল, তা জানো? পনেরোশো বেগম আর একজন মাত্তর নবাব। ভাবো তো ভাই। অবস্থাটা কী!
তা নবাব কী করে সামলাত অতগুলো বেগমকে?
সামলাবার কী আছে? ওই যেমন তোমার কাছে বাইরে থেকে লোক নিয়ে এসেছিল নজর মহম্মদ, তেমনি তাদের কাছেও বাইরে থেকে তোক আসত। ঘেন্নার কথা বলব কী ভাই, এখেনে এসে পর্যন্ত যে কত কাণ্ড দেখেছি কী বলব। এখেনে বোজ আঁতুড় হচ্ছে আর রোজ আঁতুড় উঠছে। এখানকার মেথররা তাই নিয়ে গিয়ে বাইরে ফেলে দিচ্ছে
বাইরে কোথায় ফেলে?
ফেলবার কি আর জায়গার অভাব আছে এদের। কাছেই গঙ্গা রয়েছে, দেয় তাতে ভাসিয়ে। মা-গঙ্গাকে যে কত সহ্য করতে হয়, তা তুমি যদি হিন্দু হতে তো বুঝতে পারতে! আর কাগ-চিল-শকুনের কি অভাব আছে শহরে?
মরালীর মুখ দিয়ে ছি ছি শব্দ বেরিয়ে এল।
বললে–তা হলে আমি কী করব বলো তো ভাই? আবার যদি ওই লোকটাকে নিয়ে আসে নজর মহম্মদ? আবার যদি আরক খাওয়াতে আসে?
গুলসন একটু চুপ করে রইল। তারপর বললে–তোমার মরতে ভয় করে?
মরালী বললে–মরতে ভয় করবে না? কী বলছ তুমি? মরতে কার না ভয় করে?
না, আমি তা বলছিনে! বলছি যদি তোমার সাহস থাকে তোনানিবেগমকে গিয়ে সব বলে দিতে পারো।
নানিবেগমের কাছে যাব কী করে?
সে আমি সব ব্যবস্থা করে দের। নজর মহম্মদ, বরকত আলি, পিরালি খাঁ ওরা কেউ জানতে পারবে, আমি তোমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে নিয়ে যাব।
কিন্তু গিয়ে তাকে কী বলব?
তুমি বলবে যে খোজারা তোমাকে কেবল আরক খাওয়াতে চেষ্টা করছে, বাইরের লোকদের এনে তোমার ঘরে ঢোকাচ্ছে, এইসব বলবে!
কিন্তু খোজারা যদি জানতে পারে? তারা আমার ওপর রেগে যাবে না?
সেই জন্যেই তো বলছিলুম তোমার মরতে ভয় করে?
কেন? জানতে পারলে আমাকে মেরে ফেলবে নাকি?
ওমা, তা মারবে না? তুমি তাদের নামে নালিশ করবে আর তারা মুখ বুজে সব সইবে? কত মেয়েকে ওরা ওইরকম মেরে ফেলেছে যে।
তা কেউ কিছু বলে না ওদের? ওদের ধরে কেউ গারদে পোরে না?
গুলসন বললে–তা হলে তুমি এতক্ষণ ছাই বুঝেছ, ওরাই তো হল এখানকার সব! ওরাই তো এইসব চালাচ্ছে। ওরা খুশি থাকলে তোমাকে একেবারে নবাবের খাস বেগম করে দিতে পারে। একেবারে লুৎফুন্নিসা বেগমকে হটিয়ে দিয়ে তোমাকে নবাবের কোলে বসিয়ে দিতে পারে। ওদের এত ক্ষেমতা।
মরালী বললে–তা হলে নানিবেগমের কাছে নালিশ করলে তো আমারই ক্ষতি
সে ভাই তুমি যা ভাল বোঝো করো! এ হল সেই শাঁখের করাত দু’দিকেই কাটে। এগোলেও নির্বংশের বেটি, পেছোলেও নির্বংশের বেটি। আমাদের হয়েছে তাই, তাই তো আমরা মুখ বুজে সব সহ্য করি আর বিষ খাই। তা যদি বলো তো বিষই খাও
মরালী বললে–না, তবু একবার নানিবেগমের কাছে গিয়েই দেখি না। গেলে তো আমার গলাটা আর কেটে দেবে না। কেউ না জানতে পারলেই হল! তারপর যদি ভাল বুঝি তো বলব! তা আমি যে। এখেনে এসেছি তা জানে তো নানিবেগম?
কে আর জানাবে! জানে না বলেই তো তোমাকে এখেনে একটেরে লুকিয়ে রেখে দিয়েছে। পাছে নানিবেগম জানতে পারে। নানিবেগম জানতে পারলেই ওদের জিজ্ঞেস করবে কে তুমি, কোত্থেকে এলে, কবে কখন এলে; হেনতেন সব কথার জবাবও ওরা দিতে পারবে না
তা নানিবেগম কি এখানকার সবাইকে চেনে?
সবাইকে চেনে। শুধু তোমাকেই এখনও দেখেনি। আগে তো এখেনে অনেক বেগম ছিল। সব একে একে দূর হয়েছে। বুড়ি হয়ে গেলে তাদের খোজারা বাইরে তাড়িয়ে দিয়ে আসে। যতদিন জোয়ান বয়েস থাকে তদ্দিনই খাতির। নানিবেগম না থাকলে আরও কত জোয়ান মেয়ে আসত।
এখন ক’জন বেগম আছে?
তা ভাই গুনে দেখিনি। গোনা যায় না।
তারপর একটু থেমে বললে–তা এখন যাবে তুমি নানিবেগমের কাছে? এখন তো অনেক রাত, এখন গেলে কেউ দেখতে পাবে না, আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারি
মরালী বললে–কিছু মনে করবে না তো?
না, মনে আবার করবে কী!
কিন্তু এখন কি জেগে আছে নানিবেগম?
রাত্তিরে প্রায় ঘুমোয়ই না নানিবেগম! আর আজ তো জুম্মাবার। জুম্মাবারে সারাদিন কোরান পড়ে, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে এসে ঘরে বসে কোরান পড়ে খালি। আর পাশে থাকে নবাবের বিবি লুৎফুন্নিসা বেগম। তোমার কিছু ভয় নেই। আমি তোমাকে দূর থেকে ঘরটা দেখিয়ে দেব, তুমি ঢুকে পড়ে কুর্নিশ করবে। তারপর যা জিজ্ঞেস করবে বলবে–
মনে আছে, সেদিনই প্রথম গুলসন এক অদ্ভুত পথ দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল মরালীকে। সেসব পথ সকলে জানে না। গুলসন মেয়েটা এমহলের কানাচ দিয়ে ও-মহলের পেছন দিয়ে, কোথা দিয়ে কোথায় নিয়ে চলেছিল তার কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। সব যেন ঝাপসা। চারদিকে যেন ফিসফিস শব্দ। চারদিকে যেন সবাই ফিসফিস করে ষড়যন্ত্র করছে। কোথাও কান্না, কোথাও হাসি, কোথাও বিদ্রূপ, কোথাও খোশামোদ। হাসি, কান্না, বিদ্রূপ, খোশামোদ নিয়েই যেন চেহেল্-সুতুনের কারবার। চেহেল্-সুতুন অনেক দেখেছে, অনেক ভুগেছে, অনেক লজ্জা পেয়েছে, আবার অনেক ভয়ও পেয়েছে। তবু যেন তার দেখা, ভোগা,লজ্জা পাওয়া আর ভয় পাওয়ার তখনও শেষ হয়নি। শেষ পরিচ্ছেদটা দেখবার জন্যেই বুঝি তখন মরালীকে আনতে হয়েছে তার ভেতর। মরালীই বুঝি চেহ্নেসূতুনের শেষ পরিচ্ছেদের শেষ জিজ্ঞাসার চিহ্ন।
চলতে চলতে হঠাৎ কোথায় কী একটা শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠেছে গুলসন। গুলসন বললে–শিগগির এদিকে চলে এসো ভাই, পিরালি খাঁ…
বলেই গুলসন পাশের দিকে সরে পড়ল। মরালীও সঙ্গে সঙ্গে পেছনে পেছনে গেল। এত নিঃশব্দে কাণ্ডটা ঘটল যে কারও জানবার কথা নয়। মরালী লক্ষ করলে পাশ দিয়ে পিরালি খাঁ চলে গেল, টেরও পেল না কিছু। তারপর সেই আড়ালটা থেকে বেরিয়ে চারদিকে চেয়ে দেখলে। কোথায় গেল গুলসন! ডাকতেও ভরসা হল না। যদি খোজারা শুনতে পায়। আসবার সময় মরালী নিজের ঘর অন্ধকার করে। রেখে এসেছিল। সবাই জানবে মরিয়ম বেগম ঘুমিয়ে পড়েছে। মরালী পাশের একটা সরু গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল। গুলসন বোধহয় তারই মধ্যে আছে। কিন্তু গলিটার যেন আর শেষ নেই। গলিটা যতদুর গিয়েছে ততদূর গেল মরালী। সেখানেও যেন শেষ নয় গলিটার। সেদিকেও এগিয়ে যেতে লাগল মরালী। তার পরেও যেন গলিটা আছে। আরও অনেক দূর গেলেই যেন বেরোবার রাস্তা পাওয়া যাবে। মরালী আরও এগিয়ে চলল। আরও আরও আরও অনেক দূরে। শেষকালে পা ব্যথা করতে লাগল। এ কোথায় এসে পড়ল সে। কোনদিকে এর শুরু কোনদিকে এর শেষ! কোথায় এনে ফেললে তাকে গুলসন! একবার ভাবলে গুলসনের নাম ধরে ডাকে। আবার ভয়ও করতে লাগল। যদি কেউ টের পায়। যদি কেউ জানতে পারে। মরালী সমস্ত রাত ধরে কেবল ছটফট করতে লাগল সেখানে ঘুরে ঘুরে। চিৎকার করবার উপায় নেই, পালাবার উপায় নেই, সাহায্য পাবারও উপায় নেই। সে এক অমানুষিক যন্ত্রণা। সমস্ত হাতিয়াগড়টাই যেন সে ঘুরে ঘুরে হয়রান হয়ে গেল। তারপর একসময় আর পারলে না। সেখানেই বসে পড়ল। তারপর একেবারে সেই ঠান্ডা পাথরের মেঝের ওপরটাতে লুটিয়ে পড়ল। তখন আর তার জ্ঞান নেই..
পরের দিন সকালবেলা গুলসনই এসে ডাকলে।
মরালী চেয়ে দেখে চিনতে পারলো বললে–আমি কোথায় আছি ভাই?
গুলসন বললে–আমি তোমাকে বললুম আমার সঙ্গে আসতে, তুমি কোনদিকে চলে গেলে বুঝতে পারলুম না ভাবলুম বোধহয় তোমার নিজের ঘরেই গিয়েছ, সেখানেও নেই। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম। শেষকালে মনে সন্দেহ হল। ভাবলাম একবার ভুলভুলাইয়াটা দেখে আসি
ভুলভুলাইয়া?
ভুলভুলাইয়া মানে যাকে আমরা বলি গোলকধাঁধা। শেষকালে তুমি ভয় পেয়ে ভুলভুলাইয়ার মধ্যে ঢুকে পড়েছিলে! ভাগ্যিস আমি দেখতে পেলাম।
তারপর মরালীকে ধরে তুলে বললে–চলল চলল, এখনও কেউ কিছু টের পায়নি-কী সব্বনাশ হত বলো দিকিনি
বলে মরালীকে ঘরে এনে পৌঁছিয়ে দিয়ে গেল চুপি চুপি। বললে–রাত্তিরে আবার আসব ভাই। আজ ঠিক তৈরি থেকো, নানিবেগমের কাছে নিয়ে যাব আমি এখন যাই–বুঝলে
সমস্ত রাত ঘুম হয়নি মরালীরা আর ঘুমের ঘোরেই কেটে গেল দিনটা। নজর মহম্মদ বোধহয় একবার ঘরে এসেছিল। কিন্তু ঘুমোচ্ছে দেখে কিছু বলেনি। বাঁদিটাও এসে গোসলখানায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল। চান করিয়ে চুল বেঁধে দিতে চেয়েছিল। খাবার এনে মাথার কাছে রেখেছিল। মরালী সারাদিন ওঠেনি, চান করেনি, চুল বাঁধেনি, খায়নি। কিছুই করেনি। কেবল নিজের মনেই আকাশ-পাতাল ভেবেছিল। এ কী রকম ভুলভুলাইয়া। তার জীবনটার মতোই যেন ভুলভুলাইয়ার জালে জড়িয়ে পড়েছিল সে। কোথায় হাতিয়াগড় আর কোথায় এই ভুলভুলাইয়ার গোলকধাঁধা। একদিনের মধ্যে যেন সমস্ত জীবনটা তার গোলকধাঁধায় জড়িয়ে গেল।
আবার অনেক রাত্রের দিকে চুপি চুপি গুলসন এসে হাজির। বললে–চলল ভাই, আজ যেন আর রাস্তা ভুলে যেয়ো না, আমার হাত ধরে থাকবে
বলে বেরোতে যাবার মুখেই হঠাৎ চারদিকে একটা তুমুল শোরগোল উঠল। চেহেল সুতুনের বাইরে যেন হাজার হাজার মানুষের চিৎকার শোনা গেল। নবাব মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলা হেবাৎ জঙশাকুলি খান বাহাদুর আলমগির কি ফতে
আর সঙ্গে সঙ্গে দুমদাম শব্দে আতস বাজি ফুটতে লাগল। হাউই বাজি আকাশের গায়ে উঠে গিয়ে ফুলঝুরি ফুটিয়ে তুলতে লাগল। চেহেলসূতুনের ভেতরেও যেন দৌড়োদৌড়ি শুরু হল। যারা ঘুমিয়ে পড়েছিল তারা জেগে উঠেছে। জেগে উঠে বাইরে এসে আকাশের দিকে চেয়ে দেখতে লাগল। নহবতখানায় ইনসাফ মিঞা মুলতান রাগে সুর ধরল। ছোট শাগরেদ ডুগি-তবলায় চাটি দিয়ে বলে উঠল-বহোত আচ্ছা মিঞাসাব-বহোত আচ্ছা
চেঁচামেচি শুনেই গুলসন মরালীর হাতটা ছেড়ে দিয়েছে। খানিকক্ষণ কান পেতে রইল বাইরের দিকে। তারপর বললে–সব্বনাশ হয়েছে ভাই, নবাব ফিরে এসেছে-তুমি দরজায় খিল দিয়ে শুয়ে পড়ো, আমি যাই এখন–
বলে নিঃশব্দে পাশের গুপ্ত দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
মধুসূদন কর্মকারের দোকানের পেছন দিকে সরখেলমশাই তখন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। মোল্লাহাটি নিঃঝুম হয়ে এসেছে। সেই সকালে এসে পর্যন্ত অনেক খাতির করেছে সরখেলমশাই। বলেছে–এ মোল্লাহাটিতে আর কীই বা খাবার জিনিস আছে, একবার দয়া করে যাঝে আমাদের কেষ্টনগরে, এমন সরভাজা খাওয়াব যে ভুলতে পারবেন না
সারাদিনই খাবার গল্প করেছে। নিজের হাতে রান্না করেছে। কিন্তু হাতের পুঁটলিটা একবারও হাতছাড়া করেনি। বড় সাবধানী মানুষ সরখেলমশাই।
রাত্তিরবেলা সরখেলমশাইয়ের নাক ডেকে উঠতেই কান্ত আস্তে আস্তে উঠল। পুঁটলিটাকে বালিশ করেই শুয়েছিল সরখেলমশাই। কিন্তু ঘুমের ঘোরে বালিশ থেকে মাথা সরে গেছে।
কান্ত আস্তে আস্তে পুঁটলিটা টেনে নিয়ে তার ভেতরে হাত পুরে দিলে। ওপরেই ছিল তেলচিটচিটে গামছাখানা। তার নীচে একটা ফেরো ঘটি। তার নীচে পানের ডিবে। চকমকি পাথর একটা। তার নীচেয় খড়মজোড়া। একে একে সবগুলো বার করলে। বশির মিঞা বলেছিল চিঠি একটা থাকবেই। হাতিয়াগড়ের রাজার নিজের হাতে লেখা চিঠি। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে লেখা। জরুরি।
বাইরে কোথায় একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ভয় পেয়ে সরে আসতে গিয়েই পানের ডিবেটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে ঝনঝন আওয়াজ করে উঠল।
কিন্তু না, সরখেলমশাইয়ের ঘুম বড় গাঢ়। একবার শুধু পাশ ফিরে শুল। ঘুমের ঘোরে পুঁটলিটার কথা আর মনেও পড়ল না।
কান্তর কেমন মনে হতে লাগল এ সে করছে কী! চাকরির জন্যে চুরি করতে যাচ্ছে সে! পুঁটলিটার তলার দিকে একটা চিঠি বেশ ভাজ করে রাখা। সেখানা নিতে গিয়েও কেমন হাতটা কেঁপে উঠল তার। কেন সে চিঠিটা চুরি করবে! বশির বলেছে নবাবের কাজ। নবাব মানেই ভগবান। যে-ভগবানকে সে রোজ ডাকে সেই ভগবানই কি নবাব। ভগবান তো কোনও অন্যায় করে না। কিন্তু নবাব কেন অন্যায় করে। কেন হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকে নিজের চেহেল্-সুতুনে নিয়ে আসে ভোগের জন্যে! নবাবের রাজত্বে কেন এত অত্যাচার। সারাফত আলি তা হলে কেন হাজি আহম্মদের বংশকে দিনরাত অভিশাপ দেয়।
কিন্তু আবার মনে হল, নবাব যদি অত্যাচার করে তো তার ফল ভোগ করবে নবাবই। সে কেন অন্যায় করবে। তার অন্যায়ের ফল ভোগ তো তাকেই করতে হবে।
বাইরে কুকুরটা আবার ডেকে উঠল।
কিন্তু না, এবার সরখেলমশাই আর পাশ ফিরল না। কান্ত আস্তে আস্তে ভাঁজ করা কাগজটা হাত ঢুকিয়ে নিয়ে নিলে। বাইরের দাওয়ায় মালসায় খুঁটের আগুন জ্বলছিল। সেখানে এসে দাঁড়াল। সামনেই মুর্শিদাবাদের রাস্তাটা সোজা চলে গিয়েছে। এত রাত্রে রাস্তায় বেরোতে ভয় করতে লাগল। চিঠিটা নিয়ে হাতের মুঠোয় রাখলে। তারপর নিজের পুঁটলিতে পুরল। আর একটু ভোর হলেই এখান থেকে হাঁটা দিতে হবে। মধুসূদন কর্মকার ওঠবার আগেই।
কিন্তু একটা অদ্ভুত ইচ্ছে সমস্ত মনকে আচ্ছন্ন করে দিলে। চিঠিটার ভেতর কী লিখেছে হাতিয়াগড়ের রাজা! কী এমন লিখেছে যার জন্যে তাকে পাঠাতে হল এই মোল্লাহাটিতে!
চারদিক নিঃসাড়। কান্ত আগুনের মালসাটার কাছে এল। তারপর চিঠিটা বার করলে পুঁটলি থেকে। তারপর ভাজ খুলে সেই অল্প আলোয় পড়তে লাগল
শ্রীল শ্রীযুক্ত নবদ্বীপাধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার
নৃপতিবরেষু
আপনার পত্রবাহক মারফত আপনার পত্রটি পাইলাম। আপনি যে-দোষে আমাকে দোষান্বিত করিয়াছেন। আমি সে-দোষে দুষ্ট নহি। আমিও আপনার মতোই নবাবের পতনাকাঙ্ক্ষী! আপনার মতোই আমিও মনে-প্রাণে নবাবের নিপাত কামনা করি। অপিচ আপনার শরণাপন্ন হইয়া আমি আমার এই অভিপ্রায়ই ব্যক্ত করিয়াছিলাম। কিন্তু আপনি ভুল শুনিয়াছেন। আসলে আমি আমার প্রাণাধিকা পত্নীকে বের চেহেল্-সুতুনে পাঠাইনাই। বরং তাহাকে হত্যা করাই শ্রেয় মনে করিয়া তাহাই সাধন করিয়াছি। আমার পত্নী আর ইহজগতে নাই জানিবেন। হাতিয়াগড়ের মর্যাদা রক্ষার্থে নিজ পত্নীকে হত্যা করা উপযুক্ত কর্ম বিধায় তাহা সাধন করিতে দ্বিধা করি নাই। তবে নবাবের রোষভাজন না হওনের জন্য কিঞ্চিৎ ছল-চাতুরির আশ্রয় লইতে বাধ্য হইয়াছি। আমার নফর শোভারাম বিশ্বাসের বিবাহিতা কন্যাকে তাহার পরিবর্তে পাঠাইয়াছি। এই স্বকৃত পাপের জন্য ঈস্বর আমাকে ক্ষমা করিবেন কিনা জানি না। তবে যাহা করিয়াছি তাহা স্বীয় দেশের মুখ চাহিয়াই করিয়াছি। যদি ঈশ্বর আমাদিগের সহায় হন তাহা হইলে নবাবের অপরাধের প্রতিশোধ গ্রহণ করিয়া একদিন এই স্বকৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিব প্রতিজ্ঞা করিতে মনস্থ করিলাম। অলমিতি বিস্তরেণ–ভবদীয়…
চিঠিটা পড়তে পড়তে কাস্তর হাতটা থরথর করে কাঁপতে লাগল। তা হলে সত্যিই সেই রানিবিরিকে সে আনেনি, মরালীকে সঙ্গে করে এনেছিল সেদিন। তা হলে কাটোয়ার সরাইখানাতে মরালীর সঙ্গেই কথা বলেছিল। চেহেল্-সুতুনের ভেতরে গিয়ে তা হলে মরালীর সঙ্গেই দেখা করেছিল। মোল্লাহাটির সেই মধুসূদন কর্মকারের দোকানের দাওয়ায় বসে সেই রাত্রেই যেন নিজের সমস্ত জীবনটা সে পরিক্রমা করে এল!
কান্ত দাঁড়িয়ে উঠল।
তারপর ঘরের ভেতরে ঢুকে দেখলে সরখেলমশাই তখনও নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। পাশেই তার পুঁটলিটা পড়ে আছে ঠিক তেমনি ভাবে। কান্ত আস্তে আস্তে আবার সব জিনিসগুলি বার করলে। গামছা, পানের ডিবে, চকমকি পাথর, খড়মজোড়া। ভাজকরা চিঠিখানা ভেতরে যেমন ছিল তেমনই রেখে দিয়ে সব জিনিসগুলো আবার একটার পর একটা সাজিয়ে রাখলে। তারপর বাইরে দাওয়ায় এসে বসে তারাভরা আকাশটার দিকে চেয়ে রইল। আমাকে তুমি শাস্তি দিয়ো ভগবান। আমি নবাবের কাজে অবহেলা করলাম, আমি হুকুম তামিল করতে পারলাম না, তার জন্যে তুমি আমাকে মার্জনা কোরো না। আমি পাপ করলাম, এ-চিঠি আমি বশির মিঞার হাতে তুলে দিতে পারব না। এর জন্যে যা শাস্তি তুমি। আমাকে দেবে সব আমি মাথা পেতে নেব। অপরাধ হলেও কিন্তু এ আমার অজ্ঞাত অপরাধ। আমার অপরাধের জন্যে মরালীর যেন কোনও ক্ষতি না হয়। মরালীর যেন ধর্ম নষ্ট না হয়। মরালী যেন চেহেল্-সুতুনের কয়েদখানা থেকে সসম্মানে মুক্তি পায়। তাকে তুমি দেখো ভগবান, তাকে তুমি রক্ষে কোরো।
তারপর সেই নিঃশব্দ নিঃসীম রাত্রির তারাভরা আকাশের অদৃশ্য দেবতাকে উদ্দেশ করে কান্ত বারবার দুই হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করতে লাগল। মরালীর যেন কোনও অনিষ্ট না হয় ভগবান, কোনও অনিষ্ট হয়।
খানিক পরেই আবার এল গুলসন। চারদিকে তখন বেশ ব্যস্ততা। সমস্ত চেহেল্-সুতুনে বেশ সাড়া পড়ে গেছে। সাজ সাজ রব উঠে গেছে মহলে মহলে। নানিবেগমের ঘরেও খবরটা দিয়ে এসেছিল পিরালি খা।
কলকাতার লড়াই ফতেহ করে এসেছে নবাব। সঙ্গে এনেছে হলওয়েল সাহেবকে। উমিচাঁদ, রাজবল্লভ, কৃষ্ণবল্লভ, সবাইকে।
তাদের কোথায় এনে রেখেছে?
পিরালি বললে–মতিঝিলে, বেগমসাহেবা! নেয়ামতের কাছে খবর পেয়েছি
চেহেল-সুতুনে আসবে না মির্জা?
মালুম নেই বেগমসাহেবা!
কেউ জানে না নবাবের কী মর্জি। খোদাও বলতে পারে না নবাবের কী মতিগতি। কিন্তু তা না বলতে পারুক, তৈরি থাকতেই হবে সকলকে। সকলকে সেজেগুজে আসর গুলজার করবার জন্যে তৈরি থাকতে হবে। কিংবা হয়তো কারও ডাক পড়বে। হয় তক্কি বেগম, নয় বব্বু বেগম, নয় গুলসন বেগম। যার ডাক পড়বে সে সেদিন বড় ভাগ্যবতী। তার ভাগ্য এক রাত্রের জন্যে ফিরে যাবে। নবাবকে যদি খুশি করতে পারে, তা সে যে-কোনও ভাবেই হোক, হয় গান শুনিয়ে, নয় বীণ বাজিয়ে, নয় তো বা নেচে, তার হাতে আকাশের চাঁদ নেমে আসতে পারে। সবই নির্ভর করছে নসিবের ওপর। চেহেল সুতুনে যখন যার নসিব খুলেছে সে রাতারাতি মুর্শিদাবাদের মসনদ পেয়ে গেছে। আগে একবার পেয়েছিল ফৈজি বেগম। একটা মুঠোর মধ্যে ধরা যেত তার কোমরটা। তার একটা কথায় মুর্শিদাবাদের যে-কোনও। মানুষের গর্দান যেত। আলিবর্দির আমলেও ফৈজির মুখের কথাই ছিল নবাবের মুখের কথা। ফৈজির জন্যে তাঞ্জাম তৈরি থাকবে দিনরাত। সে যেখানে খুশি যাবে, যেখানে খুশি বেড়াবে, তার জন্যে কাউকে কৈফিয়ত দেবার পরোয়া ছিল না তার। কিন্তু বড় বাড় বেড়েছিল সে। মুখের ওপর যাকে-তাকে যা-তা বলত। নবাবের মাকেই একদিন যা-তা বলে বসল ফৈজি! সেদিন উঠতি নবাবজাদা সে অপমান আর। সহ্য করেনি।
ওই যে দেখছ উঠোনের ওপাশে ওই ঘরটা?
মরালী দেখেছিল সেটা। উঠোনের উলটো দিকে একটা ছোট ঘর। দরজা নেই, জানালা নেই, ঘুলঘুলি নেই, কিছু নেই, চারদিক থেকে ইট দিয়ে থরে থরে গাঁথা। দেখলেই মনে হয় যেন চেহেল্-সুতুনের একটা আর্তনাদ ওখানে যোবা হয়ে বন্দি হয়ে রয়েছে। জলে রোদে শীতে সে আর্তনাদ বছরের পর বছরের পরিক্রমায় নির্জীব নিষ্প্রাণ হয়ে পাথরে পরিণত হয়েছে।
ওই-ই তো ফৈজি! নবাবজাদা রাগ করে একদিন ফৈজিকে ওইখানে রাজমিস্ত্রি ডেকে ইট দিয়ে চারদিক থেকে গেঁথে দিয়েছিল।
কেন?
নবাবের মা-তুলে কথা বলেছিল যে সে!
মরালী বললে–তা নবাবের মা-ও ওইরকম নাকি?
গুলসন বললে–সবাই-ই তো ওইরকম। বাদটা কে আছে? নানিবেগমের মেয়েরা কেউ ভাল নয়, জানো। একটা করে রাত কাটাবার লোক কারও বাকি নেই। জামাইরা সব বাইরে বাইরে ষড়যন্ত্র করে বেড়াচ্ছে, কার কাছ থেকে টাকা মেরে দেওয়া যায় সেই চেষ্টা করছে, আর মেয়েরা বাড়ির ভেতর বসে ওই করছে! বড় জামাই নওয়াজেস মহম্মদ সাহেব তো কেবল এই মুর্শিদাবাদেই পড়ে থাকত শ্বশুরের কাছে, আর মেয়ে পড়ে থাকত ঢাকায়, সেখানকার দেওয়ানের সঙ্গে তার লটঘটি চলত–
কে দেওয়ান?
ওই যে কেষ্টবল্লভের বাবা রাজা রাজবল্লভ! যাকে কলকাতা থেকে ধরে নিয়ে এসেছে নবাব। সেই বড় মেয়েই তো হল সবকিছুর মূল। তাকেই তো ধরে রেখেছে এখেনে। কারও সঙ্গে কথা বলতে দেয় না, ঘরের বাইরে বেরোতে দেয় না,-নবাবজাদি হওয়ার এই তো সুখ!
গুলসন মেয়েটা অনেক রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে আসত আর চুপিচুপি অনেক কথা গল্প করত। বোধহয় নেশা করত। নেশার ঘোরে আর চুপ করে থাকতে পারত না। মরালীর বিছানায় শুয়ে শুয়ে অন্ধকারে মরালীকেই জড়িয়ে ধরত। মরালীকে আদর করত। গালে মুখে ঠোঁটে চুমু খেত। আদরে আদরে একেবারে ভাসিয়ে দিত মরালীকে। বলত–তোমায় আদর করছি বলে কিছু মনে যেন কোরো না ভাই
মরালী গুলসনের আদরে আদরে আড়ষ্ট হয়ে উঠত।
গুলসন বলত–তুমি যদি বেটাছেলে হতে তো খুব ভাল হত ভাই, দু’জনে বেশ একসঙ্গে এমনি করে জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকতুম।
মরালী প্রথম প্রথম লজ্জায় কিছু বলতে পারত না। নতুন জায়গায় এসেছে, তখনও কারও সঙ্গে জানাশোনা হয়নি, কেমন যেন ভয় ভয় করত কিছু বলতে।
একদিন আর পারলে না, গুলসনকে ঠেলে সরিয়ে দিলে। বললে–তুমি নেশা করেছ, আমার কাছ থেকে চলে যাও
গুসন কিছু কথা বললে–না। গুম হয়ে মাথা নিচু করে রইল। তারপর বললে–ঠিক আছে, আমি আর তোমার কাছে আসব না–আমি চললুম
অল্প আলোয় মরালী দেখলে গুলসনের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে। মনে বড় কষ্ট হল। এমন করে কষ্ট দেওয়া উচিত হয়নি মেয়েটাকে। কাছে গিয়ে বললে–তুমি কেঁদো না ভাই, আমি বুঝতে পারিনি।
গুলসন মরালীর হাতটা ছাড়িয়ে নিলে। তার বোধহয় তখন চৈতন্য হয়েছে। একেবারে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বললে–তুমি ঠিক করেছ ভাই, আমাকে তুমি তাড়িয়ে দিয়ে ভালই করলে আমি আর আসব না তোমার কাছে-কথা দিচ্ছি আর আসব না
বলে চলেই যাচ্ছিল। কিন্তু মরালী তবু ছাড়ল না। বললে–কিন্তু তুমি কাঁদছ কেন?
গুলসন বললে–তুমি যদি ভাই আমাদের কষ্টটা জানতে তো আজকে আমাকে এমন করে অপমান করতে পারতে না–তা অপমান করেছ ভালই করেছ। আমার আগেই জানা উচিত ছিল–তুমি মুসলমান আর আমি হিন্দু মেয়ে–
মরালী বললেছি ছি, তুমিও শেষকালে আমাকে ভুল বুঝলে? আমি কি তাই বলেছি?
গুলসন বললে–না ভাই, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। এই চেহেসতুনের ভেতরে থেকে থেকে আমি একেবারে পাথর হয়ে গেছি। তাই ভালবাসার কাউকে পেলে একেবারে বত্তে যাই আমরা, কেউ ভালবাসলেও আমরা কিন্তু হয়ে যাই কিন্তু তুমি আমায় ঠিক শিক্ষা দিয়েছ, আমি আর এমন কাজ কক্ষনও করব না ।
বলতে বলতে সেই যে ফস করে গুলসন চলে গিয়েছিল আর আসেনি। একদিন নানিবেগমের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে দু’জনে চলতে গিয়ে ভুলভুলাইয়ার মধ্যে আটকে গিয়েছিল মরালী, তারপর নবাব এসে পড়াতে আর কিছুই করা হয়নি। গুলসনও আগেকার মতন রাত্রে আর আসেনা। সেই যে সে রাগ করে চলে গেছে আর তার দেখা নেই। কেন সে অমন করে বলতে গেল।
সেদিন রাত্রে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরোল মরালী। কোথায় কোন মহলে গুলসন থাকে তা জানে না। তবু যদি তার দেখা পাওয়া যায়, গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আসবে তার কাছে। বাইরে সেই রকমই ঝাপসা অন্ধকার, কোন কোণে টিমটিম করে একটা আলো জ্বলছে। পথ দেখে দেখে চলতে চলতে যদি কোথাও হঠাৎ কাউকে দেখতে পাওয়া যায়, তাকেই জিজ্ঞেস করবে গুলশনের কথা।
এবার চিনতে পারলে মরালী সেই ভুলভুলাইয়ার রাস্তাটা। সেটাকে এড়িয়ে আরও ভেতরে চলে গেল। অনেক হাসি, অনেক গান চলেছে কোথাও। মরালী সাবধানে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল। চেহেল-সুতুন তো নয়, এও যেন একটা ছোটখাটো হাতিয়াগড়। মাথার ওপর একটা ছাদ। আশেপাশে বারান্দা-ঘর।
একটা ঘরের সামনে এসে চুপ করে দাঁড়াল মরালী। মনে হল ভেতরে যেন আলো জ্বলছে। আলো যখন জ্বলছে তখন ভেতরে যে আছে সে নিশ্চয়ই জেগে আছে। মরালী অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে সে কে, তা হলে সে কী উত্তর দেবে?
আশেপাশে চারদিকে চেয়ে দেখলে মরালী। বরকত আলি কি নজর মহম্মদরা যদি কেউ দেখতে পায় তা হলে হয়তো বিপদ হতে পারে।
মরালী আস্তে আস্তে দরজায় টোকা মারলে।
ভেতর থেকে মেয়েলি গলায় সাড়া এল–কে?
আর তারপর দরজাটা খুলে গেল! মরালী ভেবেছিল দরজা খুলে হয়তো দেখবে গুলসনকে। কিন্তু এ অন্য আর একজন। যে দরজা খুলে দিলে সে চিনতে পারলে না মরালীকে। একজন বাঁদি।
আপ কৌন?
মরালী বললে–এ-ঘরে গুলসন বেগম থাকে?
ততক্ষণে ভেতর থেকে আর একজন বেরিয়ে এসেছে। বড় সুন্দর এর মুখখানা। কিন্তু বড় করুণ এর চেহারা। বেশি গয়নাগাঁটি গায়ে নেই। ফিকে জর্দা রঙের একটা ঘাগরা আর ফিকে সবুজ ওড়নি পরেছে গায়ে।
তুমি কে?
কী বলবে মরালী বুঝতে পারলে না। কিন্তু মেয়েটার মুখখানা দেখে মনে হল একে যেন সব কথা খুলে বলা যায়।
গুলসন বেগমকে আমি খুঁজতে এসেছিলাম। তার মহলটা কোন দিকে?
মেয়েটি জিজ্ঞেস করলে তুমি কে? তুমি কি নয়া এসেছ এখানে?
মরালী তবু জবাব দিতে পারলে না। মেয়েটি বললে–এসো, ভেতরে এসো তুমি, এত রাত্তিরে। তুমি গুলসনকে খুঁজতে বেরিয়েছ কেন? ডর কী? ভেতরে এসো
মরালী ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকল। সাদাসিধে একটা বিছানা। মখমলের চকচকে চাদর। পায়ে একজোড়া জরিদার চটি। হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসাল। তারপর বাঁদিটাকে বললে–সিরিনা, তু যা ইহাসে
বাঁদিটা চলে গেল। মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করলে তোমাকে তো চেহেল-সূতুনে আগে দেখিনি কখনও, তুমি কি নয়া এসেছ?
হা!
কতদিন এসেছ?
অনেকদিন। ঠিক করতে পারছি না কতদিন। মনে হচ্ছে যেন কত বচ্ছর এখানে এসেছি। ঘরের মধ্যেই থাকি কিনা দিনরাত!
মেয়েটি গলায় মিষ্টি সুর দিয়ে জিজ্ঞেস করলে–তোমার নাম কী?
মরিয়ম বেগম।
সাকিন?
লস্করপুর। সেদিন গুলসনের ওপর খুব রাগ করেছিলুম বলে আর যায়নি আমার মহলে, তাই খুঁজতে বেরিয়েছি। এখানকার খোজারা আমাকে মোটে ঘরের বাইরে বেরোতে দেয় না। গুলসন লুকিয়ে লুকিয়ে আমার মহলে আসত, কেউ জানতে পারত না। আজ কদিন থেকে মোটে আসছে না সে, তাই রাত্তিরে বেরিয়েছিলাম খুঁজতে
কিন্তু গুলসনকে তো এখন মিলবে না!
মিলবে না? কেন?
সে মতিঝিলে গেছে, সেখানে মহফিল হচ্ছে–
গুলসনের কথাটা মনে পড়ল। গুলসন বলেছিল, যার মতিঝিলে ডাক পড়বে সে ভাগ্যবতী! এক রাত্রেই তার কপাল ফিরে যাবে! হয়তো শেষপর্যন্ত গুলসনের কপাল ফিরল।
আপনি কে?
আমি? আমার নাম লুৎফুন্নিসা বেগম।
মরালীর মাথায় যেন সঙ্গে সঙ্গে বজ্রাঘাত হল। নবাবের আসল বেগম। ভয়ে দাঁড়িয়ে উঠল মরালী। বললে–আমায় মাফ করবেন বেগমসাহেবা, আমি না-জেনে আপনার ঘরে ঢুকে পড়েছি, আমি নতুন মেয়ে, কিছুই জানতুম না
লুৎফুন্নিসা একটু ম্লান হাসি হাসল। বললে–বোসো, তোমার কোনও গুনাহ হয়নি। তুমিও যা আমিও তাই তুমি বোসো
তবুমরালীর বসতে কেমন সংকোচ হল। বললে–আপনার কথা গুলসন আমাকে বলেছে, আমরা আপনার বাঁদি, আপনার সঙ্গে কি আমাদের তুলনা?
লুৎফুন্নিসা বললে–কে বাঁদি আর কে মালকিন তা খোদাই জানে ভাই! গুলসন তোমাকে সব ঝুট বাত বলেছে! তুমি নতুন এসেছ তাই কিছুই জানো না এখনও, পরে সব জানতে পারবে। তা ছাড়া তুমি কেন আসতে গেলে এখানে? তুমি গলায় দড়ি দিতে পারলে না? যখন তোমাকে এরা এখানে নিয়ে আসছিল তুমি নদীতে ঝাঁপ দিতে পারলে না? জানো, তোমার মতো কত বেগম আছে এখানে? জানো, তাদের কী হেনস্থা?
বলতে বলতে লুৎফুন্নিসা একটু থামল। তারপর আবার বলতে লাগল আর তা ছাড়া আমিই কি সাধ করে এখেনে এসেছি? আমি কি চেয়েছিলুম এই নবাবের বেগম হতে? আমি গান গাইতে এসেছিলুম এই মুর্শিদাবাদে মুজরো নিয়ে। আমি দেহলীর নটুনি। গান গাওয়া ছিল আমার পেশা। তারপর খোদার মর্জিতে এখানে এসে পড়েছি, আর বেরোতে পারিনি!
বলে হাসতে লাগল লুৎফুন্নিসা বেগম ঠিক তেমনি করে।
তারপর বললে–যাক গে এসব কথা, তুমি নতুন এসেছ, তোমাকে মিছিমিছি ভয় পাইয়ে দেব না–তোমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?
মরালী বললে–গুলসন আমাকে বলেছিল নানিবেগমসাহেবার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে।
কী জন্যে নানিবেগমের সঙ্গে দেখা করতে চাও?
মরালী বললে–শুনেছি তিনি খুব ভাল লোক—
গুলসন বলেছে ভাল লোক?
গুলসন আপনারও খুব প্রশংসা করেছে।
আমার কথা থাক, তুমি এত রাত্তিরে নানিবেগমের সঙ্গে দেখা করতে চাওই বা কেন? তিনি তো এখন কোরান পড়েন
তাও শুনেছি। কিন্তু রাত ছাড়া আর কী করেই বা দেখা করব তাঁর সঙ্গে! দিনেরবেলা নজর মহম্মদ আমার ঘরে নজর রাখে। কোথাও বেরোতে দেয় না। কারও ঘরে যেতে আমাকে বারণ করেছে। কারও সঙ্গে কথা বলতেও দেয় না। যে বাঁদিটা আসে সেও বোবা, কথা বলতে পারে না। আমি যে এরকম একলা থাকতে থাকতে মারা যাব শেষকালে!
লুৎফুন্নিসা হাসতে হাসতে বললে–নতুন এসেছ তো, এখন একটু একটু অসুবিধে হবেই, তারপর আস্তে আস্তে সব গা-সওয়া হয়ে যাবে, তখন অন্য বেগমরা যেমন করে দিন কাটায়, তুমিও তেমনি করে দিন কাটাবে! তা নানিবেগমকে কিছু বলতে হবে?
মরালী বললে–শুধু বলব, আমি যেন এখানকার সকলের সঙ্গে মিশতে পারি, কথা বলতে পারি
লুৎফুন্নিসা বললে–আচ্ছা তুমি যাও, আমি নানিবেগমকে তোমার কথা বলব, তুমি কিছু ভেবো না–তুমি একলা মহলে ফিরে যেতে পারবে তো? সিরিনাকে পাঠাব তোমার সঙ্গে?
মরালী বললে–না, তার দরকার নেই, আমি যেতে পারব একলা–
বলে লুৎফুন্নিসা বেগমকে মুসলমানি কায়দায় কুর্নিশ করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। এতক্ষণ যেন আড়ষ্ট হয়ে কথা কইছিল মরালী। কিন্তু তবু ভাল লাগল। এ যেন গুলসনের মতো নয়। অত গায়ে পড়ে আলাপ করতেও চাইলে না, আবার গায়ে পড়ে উপকার করতেও আগ্রহ দেখালে না। অথচ আদবকায়দার কোনও ত্রুটিও রাখলে না। নবাবের খাস বেগম, নবাব ফিরে এসেছে মুর্শিদাবাদে, তবু তো খাস বেগমের কাছে একবার দেখাও করতে এল না। আর এত রাতে একা একা জেগেই বা বসে আছে কেন? কার জন্যে বসে আছে? এই খাস বেগম থাকতে নবাব কেন গুলসনকে ডেকে পাঠিয়েছে। মতিঝিলে? গুলসরে কি আজ এক রাত্রেই ভাগ্য ফিরে যাবে?
বেগমসাহেবা।
পেছন থেকে ডাক শুনে মরালী মুখ ফেরাল। সেই বাঁদিটা। সিরিনা।
বেগমসাহেবাকে এত্তেলা দিয়েছেন!
মরালী আবার লুৎফুন্নিসার ঘরে ফিরে গেল। বেগমসাহেবা বললে–একটা কথা শোনো
মরালী অবাক হয়ে গেছে। আবার কী জরুরি কথা বলবে তাকে।
আর একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। তুমি বহেন নয়া এসেছ, রাত্তিরে এখানে দরওয়াজা বন্ধ করে। শোবে।
মরালী বললে–তা তো শুই-ই!
এখানকার কোনও বেগমও যদি দরওয়াজা খুলতে বলে তো খুলো না, জানো। কোনও বেগমকেও তোমার ঘরে রাত্তিরে শুতে দিয়ো না। এখানকার বেগমরাও ভাল নয়, বিশ্বাস করে কোনও কথাই কাউকে বোলো না। এখানকার ইটেরও কান আছে। এখানকার বেগমরা পুরুষদের চেয়েও খারাপ! যাও
মরালী হতবাক হয়ে গেল কথাগুলো শুনে। তারপর যেমন এসেছিল তেমনি আবার ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তারপর রাস্তা চিনে চিনে নিজের মহলের কাছে আসতেই দেখলে নজর মহম্মদ ঘরের সামনের রোয়াকের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। নজর মহম্মদকে দেখেই বুকটা হুঁত করে উঠল। যদি বকে!
কিন্তু না, কিছুই বললে–না!
মরালী নিঃশব্দে নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়েই যেন সাপ দেখে এক হাত পিছিয়ে এল। বেশ ফরসা টকটকে গায়ের রং, ছোট একটু দাড়ি, গোঁফ জোড়া পাকিয়ে দু’পাশে ছুঁচোলো করে দেওয়া। চোস্ত-পাজামা, মেরজাই পরা একজন লোক যেন এতক্ষণ মরালীর জন্যেই তার ঘরের ভেতরে অপেক্ষা করছিল।
মরালী ঘরে ঢুকতেই লোকটা সসম্ভমে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে কুর্নিশ করলে!
বন্দেগি বেগমসাহেবা।
মরালী নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। ভয়ে বুকটা তার থরথর করে কাঁপছে তখন।
আমাকে চিনতে পারছেন না বেগমসাহেবা! মির্জার শাদির সময় বেগমসাহেবাকে হাতিয়াগড়ের বজরার জানালাতে দেখেছিলুম। এমন খুবসুরত শকল জিন্দগিতে কখনও দেখিনি, তাই ভেবেছিলাম বসোরার গুলাব কি হাতিয়াগড়ের মরুভূমিতে মানায়! তাই তো ডিহিদারকে দিয়ে পরোয়ানা ভেজিয়ে চেহেলসতুনে নিয়ে এসেছি রানিবিবিকে!
বলে লোকটা একটা বিজয়োল্লাসের চাপা হাসি হেসে উঠল!
মরালী তখনও কী করবে বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারছে না কে এ লোকটা! বাইরের অন্ধকারে নজর মহম্মদ তখনও পঁড়িয়ে আছে। লোকটা কি রাত্তিরে তার ঘরেই থাকতে চায় নাকি!
হাতিয়াগড়ের জমিনদার সাহাবের তবিয়ত কেমন আছে বেগমসাহেবা? খ্যয়রিয়ত তো?
মরালীর মনে হল এক থাপ্পড় কষে দেয় লোকটার গালের ওপর। কিন্তু ভয়ও করতে লাগল। লোকটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তখন একমনে দেখছে মরালীকে। যেন যাচাই করে নিচ্ছে। হয়তো সন্দেহ হচ্ছে ঠিক রানিবিবি না অন্য কেউ। কিংবা হয়তো ভাবছে অনেকদিন আগে নবাবের বিয়ের সময় দূর থেকে দেখা মুখটার সঙ্গে এ-মুখের মিল আছে কি না!
বেগমসাহেবা বসুন না!
মরালীর মনে হল আরও কাছে থেকে দেখতে চায় তাকে! তবুমরালী বসল না।
লোকটা এবার নিজেই দাঁড়িয়ে উঠল।
বেগমসাহেবা না বসলে বান্দা তো বসে থাকতে পারে না।
কিন্তু পঁড়িয়ে উঠে সোজা হয়ে ঠিক দাঁড়াতেও পারলে না। টলতে লাগল। হয়তো মাতাল। মরালীর নাকে একটা কড়া গন্ধ এসে লাগল। চারদিকে এত আতর, পান-জর্দা, খুশবু তেলের গন্ধ, তবু যেন মদের গন্ধটা সকলকে ছাপিয়ে উঠে নাকে এসে লাগল।
বেগমসাহেবা বুঝি টহল দিতে বেরিয়েছিলেন! এত রাতে টহল দিলে নিদ কখন যাবেন। বেগমসাহেবা!
হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই নজর মহম্মদ ঘরে ঢুকে পড়ল খোদাবন্দ, নানিবেগম
নানিবেগমের নাম শুনেই লোকটা যেন জ্ঞান ফিরে পেল। চমকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। আর ঠিক তার পরেই এসে ঢুকল লুৎফুন্নিসা বেগম। সঙ্গে আর একজন। এই-ই বোধহয় নানিবেগম।
মহলে কে এসেছিল বহেন?
মরালী ঘটনার আকস্মিকতায় এমনিতেই হতবাক হয়ে গিয়েছিল। এবার আরও বাকরোধ হয়ে এল তার।
নানিবেগম মাথায় হাত দিয়ে আদর করতে করতে বললে–বেটি।
বড় আদরের সুর গলায় বেজে উঠল নানিবেগমের। মরালীর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।
কব আয়ি বেটি!
বেশ বয়েস হয়েছে। মরালীর মনে হল যেন ঠিক তার ঠাকুমার মত। ঠাকুমাকে ভাল করে দেখেওনি কখনও। খুব ছোটবেলায় আবছা আবছা মনে পড়ত। নয়ানপিসিও কখনও যেন এমন করে আদর করেনি। নয়ানপিসি চুল বেঁধে দিয়েছে। সাজিমাটি দিয়ে গা ঘষে মেজে দিয়েছে। কিন্তু নানিবেগমকে নয়ানপিসির চেয়েও দেখতে আরও সুন্দর। সাদা পাতলা পোশাক।
ইহা কিউ আয়ি বিটি? কৌন লায়া? কে তোমাকে নিয়ে এল এখানে মা?
মরালী নানিবেগমের বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে দিয়ে অঝোরে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। নানিবেগমও মরালীকে দুই হাতে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিলে।
মেহেদি নেসার বাইরের নহবতখানার নীচে দাঁড়িয়ে যেন একটু স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লে। তাঞ্জাম। তৈরিই ছিল। নজর মহম্মদকে কাছে ডেকে বললে–খুব হুঁশিয়ার নজর মহম্মদ, বড়ি খুবসুরত জেনানা–লেকন
নজর মহম্মদ হুকুম শোনবার অপেক্ষায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল।
লেকন, নাচা গানা সব শেখাতে হবে। একদম আনাড়ি জেনানা, ভাল করে আদব কায়দা এখনও শেখেনি, আমির-ওমরাহদের কেমন করে কুর্নিশ করতে হয় তাই-ই জানে না এখনও। ওস্তাদজিকে হুকুম দিয়ে দেবে খুব জলদি তালিম দিতে। মির্জাকে খুশ করতে হবে তো-বনের চিড়িয়াকে পিজরায় পুরলে কী হবে, তাকে তো বুলি শেখাতে হবে
বলে তাড়াতাড়ি তাঞ্জামে উঠে পড়ল নেসার সাহেব।
মেহেদি নেসার চলে যেতেই পিরালি খাঁ আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। চলতি তাঞ্জামটা ফটক দিয়ে বেরিয়ে যেতেই নজর মহম্মদ মুখ ফিরিয়ে বললে–সর্দার, শালা হারামির বাচ্চা
পিরালি গম্ভীর মানুষ। বললে–নানিবেগমকে খবর দিলে কে? তুই?
নজর মহম্মদ বললে–জি সর্দার–নেসার সাহেব কাছারিতে আমার নামে নালিশ পেশ করেছে সর্দার, আমি নাকি বাইরের জওয়ানদের চেহেল্-সুতুনের অন্দরে ঢোকাই মোহর নিয়ে। আমি নাকি ঘুষ নিই। তাই নানিবেগমকে খবর দিয়ে দিলুম,খবর দিয়ে শালাকে বেইজ্জৎ করে দিলুম। খোজাদের সঙ্গে বেত্তমিজি করতে এসেছে।
আরও সব কত কী কথা রাগের মাথায় বলতে লাগল নজর মহম্মদ। কলকাতার লড়াই ফতে করে এসে মাথা গরম হয়ে গেছে আমির-ওমরাহদের। মাথা গরম করবে বাইরে গরম করো। চেহেলসূতুনের বাইরে। মতিঝিলে নেয়ামতকে পেটো। চেহেল্-সুতুন তোমার এক্তিয়ারে নয়। এখানে আমি খোজা সর্দার পিরালির নৌকর। পিরালি খাঁ হুকুম করলে আমি তা মাথা পেতে তামিল করব। এতদিন এত নবাব এসেছে গেছে, এতদিন এত বেগম এসেছে গেছে, কেউ খোজাদের এক্তিয়ারে কখনও হাত দেয়নি। তুমি যে-ই হও, আমি খোঁজা। আমি তোমার চেহেল সুতুন মর্জি হলে ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলতে পারি, আবার বানাতেও পারি। কোন ফঁক দিয়ে তোমার নুকসান করব তুমি জানতেও পারবে না। তোমার বনের চিড়িয়া আমার মর্জি হলে আমি আশমানে উড়িয়ে দিতে পারি। আমার মর্জি আমি মোহর নিই, তাতে তোমার কী? তুমি ঘুষ নাও না? জমিদার তালুকদার ডিহিদার ফৌজদার তাদের কাছ থেকে তুমি রিসশোয়ত নাও না? হাজারি মনসবদার বানাতে–তুমি ঘুষ নাও না? কেয়া সর্দার, ঠিক বাত বলিনি?
পিরালি খাঁ বললে–বেশ করেছিস
নজর মহম্মদের তখনও গোঁসা যায়নি। বললে–আমি মেহেদি নেসার সাহেবের দুশমনি ভাঙব সর্দার, আমাদের এক্তিয়ারে হাত দিয়েছে, আমি শালাকে রেহাই দেব না
পিরালি খাঁ ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞেস করলে–মতিঝিলে আজ কাকে পাঠালি?
নজর মহম্মদ বললে–গুলসন বেগমকে, বেচারি বহোত রোজ ধরে আমার খুশামোদ করছিল, কেবল বলছিল, আমাকে একবার নবাবের সামনে পাঠিয়ে দাও নজর! তা দিলুম আজ পাঠিয়ে। যদি গুলসনের নসিব ফেরে তো ফিরুক না, আমার কী!
বেশ করেছিস!
তারপর নজর মহম্মদ হঠাৎ নিচু গলা করে পিরালিকে বললে–সর্দার, আর একটা খবর, জুবেদার বাচ্চা হবে!
পিরালির চোখ দুটো গোল হয়ে উঠল।
কৌন জুবেদা?
মরিয়ম বেগমের বাঁদিটা!
কে করলে? কোন বেল্লিক?
নজর মহম্মদ বললে–তালাস পাচ্ছি না।
ওকে পুছেছিস?
ও কী বলবে? ও তো বোবা! কোন উল্লু-কি পাঠটা বেইমানি করে গেছে।
তা হলে লটকে দে ওকে!
দেব লটকে?
আলবত দিবি! নানিবেগম যদি কিছু বলে তো বলিস, পিরালি খাঁ’র হুকুম। আমাকে এত্তেলা দিলে যা বলবার আমি বলব–
বলে পিরালি খাঁ নিজের কাজে চলে গেল।
ওদিকে তখন সারারাত মহফিল চলেছে মতিঝিলে। কলকাতার লড়াই ফতেহ করে নবাবি ফৌজের লোকরা শহরে এসে ফুর্তির ফোয়ারা ছুটিয়েছে। কলকাতা থেকে যা পেয়েছে লুঠপাট করে এনেছে। কেউ লুঠেছে চাদি, কেউ লুঠেছে মেয়েমানুষ, কেউ লুঠেছে ফিরিঙ্গিদের জামা, জুতো। যে কিছু পায়নি, সেও একটা বকলেস কি একটা পালকের কলম নিয়ে এসেছে। কলকাতার কেল্লায় মানিকচাঁদকে একলা রেখে নবাব হলওয়েলকে গ্রেফতার করে নিয়ে এসেছে মুর্শিদাবাদে। আর আছে কৃষ্ণবল্লভ, আর উমিচাঁদ। উমিচাঁদের বাড়িটাও লুঠপাট করতে গিয়েছিল নবাবি ফৌজের লোকেরা। কোটি কোটি টাকার মালিক উমিচাঁদ সাহেব। কিন্তু গিয়ে দেখলে, কেউ বাড়িটাতে আগেই আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। বাড়ির ভেতরে একটা সিন্দুক ছিল। তার ভেতরে মোহর সোনা চদি কেউ আগেই সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তার পাশেই উমিচাঁদের সেপাই জগমন্ত সিংয়ের পোড়া দেহটা পড়ে আছে। আগাগোড়া পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে গেছে। চেনা যায়নি তাকে।
আগে ফুর্তি হোক, আগে মহফিল হোক, তারপরে বিচার হবে হলওয়েলের। ফিরিঙ্গিরা জাহাজ নিয়ে একেবারে ফলতার মোহানায় গিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে। মেহেদি নেসার, ইয়ারজান, সফিউল্লা, তারা সবাই নবাবকে বুঝিয়েছে এ-রাতটায় আর কোনও কাজ নয়, শুধু মহফিল! নজর মহম্মদকে হুকুম করেছিল মেহেদি নেসার যে, চেহেল্-সুতুন থেকে ভাল বাইজি পাঠিয়ে দিতে হবে মতিঝিলে। যে ভাল নাচতে পারবে, গাইতে পারবে, নবাবের দিল খুশ করতে পারবে
তারপর সেখান থেকে এসেছিল গুলসন বেগম।
তা গুলসন নেচেছে ভাল। এককালে হিন্দু মেয়ে ছিল বটে। কিন্তু চেহেল্-সুতুনে এসে আচ্ছা ওস্তাদের হাতে পড়ে নাচ-গান সব রপ্ত করে নিয়েছে। গুলসন একাই মহফিল মশগুল করে দিয়েছে। মতিঝিলের মেঝের ওপর সাদা কিংখাবের চাদর পেতে দেওয়া হয়েছিল। চাদরের নীচেয় আবির ছড়ানো ছিল। চাদরের ওপর নেচে নেচে পায়ের ঘা দিয়ে দিয়ে একটা আস্ত ফোঁটা পদ্মফুল এঁকে ফেলেছিল গুলসন। তারপর সেই আবিরের লালে-লাল কিংখাবের চাদরের ওপর মেহেদি নেসার একটা মোহর ফেলে দিয়েছিল। গুলসনের কেরামতি আছে বলতে হবে। নাচতে নাচতে কোমর বেঁকিয়ে ঠোঁট দিয়ে কামড়ে সেই মোহর তুলে নিয়ে নবাবের কপালের ওপর রেখে দিয়েছিল।
ভারী খুশি নবাব মির্জা মহম্মদ!
অনেকদিন পরে নবাবের মুখে হাসি ফুটতে দেখে মেহেদি নেসারের মুখেও হাসি আর ধরেনি। নবাবের খুশির জন্যেই তো মহফিল। নবাব খুশি থাকলেই তো হিন্দুস্থান খুশি রইল। নবাব খুশি থাকলেই তো খোদাতালা খুশি থাকল। আসলে দিন-দুনিয়ার নবাবই তো দিন-দুনিয়ার খোদাতালা!
সোহানাল্লা, সোহানাল্লা
শেষপর্যন্ত যখন নেয়ামত আলি সরাবের ভাড়ার খুলে উজাড় করে দিয়েছিল তখন কে-ই বা নবাব
আর কে-ই বা বান্দা। তখন কে-ই বা বেগম আর কে-ই বা জারিয়া। তখন মতিঝিলের মহফিলের ফুর্তির ফোয়ারায় নবাব বান্দাবাদি বেগম সব একাকার হয়ে যায়!
কিন্তু বশির মিঞা শেষপর্যন্ত সবটা দেখতে পায়নি। এসব মহফিলের মধ্যে বশির মিঞার মতো। ছুটকো লোকদের থাকবার এক্তিয়ার নেই। লুকিয়ে লুকিয়ে নেয়ামতকে তোয়াজ করে যতটুকু ফাঁকি দিয়ে ভোগ করে নেওয়া যায় সেইটুকুই ফায়দা। জাফরির ফাঁক দিয়ে নবাব-আমির ওমরাহদের কেচ্ছা কেলেঙ্কারি বশির মিঞা বরাবর এমনি করেই ফাঁকি দিয়ে দেখে এসেছে। দুটো বিবি আছে বশিরের। কিন্তু দুটো বিবিই বশিরের কাছে পুরনো হয়ে এসেছে। আর নতুন বিবি রাখবার হিম্মৎ নেই। আজকাল বিবি পোষবার খরচা বেড়ে গেছে। বিবিদের খাই বেড়ে গেছে। বিবিরা একটু সুবিধে পেলেই বড় বড় আমির ওমরাহ পাকড়াতে চায়। একটু খুবসুরত বিবি হলেই আমির ওমরাহদের নজর পড়ে যায় তার ওপর। আর, একবার নজর পড়লে আর তাদের ঘরে পুরে রাখা দায়। সবাই চায় চেহেল্-সুতুনে গিয়ে বেগম বনতে। একবার বেগম হতে পারলে আখের ভাল হয়ে যাবে। নসিবে থাকলে নবাবের নজরে পড়ে যেতেও পারে। তখন হিন্দুস্থানের বাদশাই বা কে আর সে-ই বা কে। তখন হিন্দুস্থানের সনদে বসে খোদাতালাকেও শায়েস্তা করতে চাইবে!
যা হোক, সেটা আসল কথা নয়। আসল কথা বশির মিঞা ভেবেছিল মতিঝিলের মহফিলে হাতিয়াগড়ের রানিবিবির ডাক পড়বে। নতুন আমদানি বেগম। হয়তো মেহেদি নেসার সাহেব তাকেই এত্তেলা দেবে। তাই একবার দেখবার ইচ্ছে হয়েছিল নতুন আমদানিটা কেমন!
নেয়ামতকেও খোশামোদ করে অনেক কষ্টে ভজিয়ে রেখেছিল। বলেছিল–থোড়া মুঝে ভি দারু পিলাও নেয়ামত ভাইয়া আমিই তো রানিবিবিকে হাতিয়াগড় থেকে আনাবার ইন্তেজাম করেছি।
আমিও থোড়া দেখব নতুন আমদানিটা ক্যায়সি চিজ
কিন্তু গুলসন বেগম আসাতে মনটা একটু ভেঙে গিয়েছিল বশির মিঞার। এত কোশিস করেও কোনও নাফা হল না। বরবাদ হয়ে গেল খোশামোদি। শেষপর্যন্ত যখন ফুর্তির ফিকির টুটে গেল তখন যে কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি একটু ভাল করে নজর করে দেখবে তারও উপায় রাখলে না নেয়ামত আলি। তাড়াতাড়ি এসে হাঁকিয়ে দিলে। বললে–ভেগে যা এখান থেকে, ভেগে যা
বশির মিঞা একটু রেগে গিয়েছিল। সবে মহফিল জমেছে, এখনই ভেগে যেতে বলছে?
তা হলে দারু দিলি কেন? দারু পিয়ে তবিয়ত গরম হয়ে গেল, এখন ভাগা যায়?
তুই ভাগ এখন, আমি বাত শুনতে চাই না, নেসারসাহেব এখন বেসামাল হয়ে পড়বে
সে তো ভালই, আমি তো তাই দেখতে এসেছি।
দুর বেল্লিক, যদি নবাব ভি বেসামাল হয়ে পড়ে?
তাও দেখব!
দুর বেত্তমিজ! কেউ জানতে পারলে আমার নৌকরি খতম হয়ে যাবে যে ভেগে যা ভেগে যা–
শেষকালে একেবারে জোর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল নেয়ামত মতিঝিল থেকে। মতিঝিলের ত্রিসীমানায় আর থাকতে দেয়নি বশিরকে। সেই যে মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে গিয়েছিল তা আর ঠান্ডা হল না। সারারাত ঘুমই হল না। ভোরবেলাই উঠে পড়েছিল। আর ঠিক সেই সময়েই কান্ত এসে ডেকেছে।
কী রে, এত সকালে? কখন এলি মোল্লাহাটি থেকে?
কান্ত বললে–এই তো সোজা সেখান থেকে আসছি।
তা সরখেলের সঙ্গে দেখা হল? চিঠি পেলি?
কান্ত একটু দ্বিধা করতে লাগল।
বশির আবার জিজ্ঞেস করলে–চিঠি পাসনি?
কান্ত বললে–না
না মানে? ডিহিদার কি ঝুট-খবর পাঠিয়েছে? সে যে জানিয়েছে হাতিয়াগড়ের রাজা মহারাজার সেরেস্তার লোকের হাতে চিঠি পাঠিয়েছে? তুই উজবুক নাকি? তার সঙ্গে মুলাকাত হল তোর, আর চিঠিটা সরাতে পারলি না? আমি আমার ফুপাকে কী জবাব দেব? তুই কোনও কম্মের নয়–একটা আস্ত পাঁঠা
কান্ত অনেকক্ষণ পরে বললে–আমি এ-চাকরি করতে পারব না ভাই–সেই কথা তোর কাছে বলতে এসেছি
সেদিন কান্তর কথাটা শুনে হতবাক হয়ে গিয়েছিল বশির মিঞা। দুনিয়ায় এমন আহাম্মক কেউ আছে নাকি যে নিজামতি নোকরি ছেড়ে দিতে চায়। সারা হিন্দুস্থান থেকে লোক এসে ভিড় করে মুর্শিদাবাদের দরবারে। এমন দেশ কোথায় পাবে হিন্দুস্থানে? এমন সস্তা-গণ্ডার দেশ? তবু সব নিমকহারামের বাচ্চা, নিজামতের নোকরি করবে আর নিজামতকেই গালাগালি দেবে!
কান্ত বললে–না ভাই, এ-নোকরিতে মনে শান্তি পাচ্ছি না—
শান্তি? টাকা থাকলেই তো শান্তি বাপ বাপ করে আসবে! তুই তলব পাচ্ছিস না? আরামসে আছিস, তলব পাচ্ছিস আর ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। আজ হাতিয়াগড় কাল মোল্লাহাটি পরশু কেষ্টনগর। কত দেশে বেড়াতে পাচ্ছিস–তা তোর তকলিফটা কী? কী কষ্ট হচ্ছে তোর?
কান্ত বললে–আমার আর ভাল লাগছে না ভাই
কাম করতে তো ভাল লাগবেই না। বেশ নবাবের মতো পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করবার নোকরি কে তোকে দেবে? আর নোকরি করবি না তো খাবি কী?
সে কথাটা সত্যি বটে! কিন্তু এ কাজ ছাড়া কি আর কোনও রকমের চাকরি নেই? নিজামতে কি সবাই এই চরের চাকরি করছে? সেরেস্তার চাকরি নেই? কাছারির চাকরি নেই? খালসা-দেওয়ানজির দফতরে চাকরি নেই? তার জন্যেই ঠিক বেছে বেছে কেবল এই চাকরি?
আচ্ছা, ঠিক আছে, এখন তুই ঘরে যা, আরাম কর গে যা। এখন তোর মাথা গরম আছে, পরে বাত বলব তোর সঙ্গে। তুই এই সহজ কামটা করতে পারলি না, আর তুই করবি খালসা দেওয়ানজির দফতরের কাম? সেকাম তো আরও কড়া রে–সেখানে কেবল দফতরে বসে বসে হিসেব লিখতে হবে–সে যে আরও শক্ত কাম
সেদিন তখন আর বেশিক্ষণ কথা হল না। মোল্লাহাটির মধুসূদন কর্মকারের দোকান থেকে ভোরবেলাই বেরিয়ে এসেছিল কান্ত। বেশ ভোর। শেষরাতেই বলা যায়। বড় বিশ্বাস করেছিল তাকে সরখেলমশাই। আহা, চাল-ডাল কিনে নিজের হাতে রান্না করে খাইয়েছিল। তার কাছ থেকে চিঠি চুরি করতে কেমন যেন মায়া হয়েছিল কান্তর। বিশেষ করে চিঠিটা পড়বার পর আর সেটা নিতে সাহস হয়নি। চিঠিটা দেখবার পর যদি মরালীর ওপর অত্যাচার আরও বেড়ে যায়। যদি সবাই জানতে পারে হাতিয়াগড়ের রাজা নিজের রানিবিবিকে না-পাঠিয়ে তার বদলে তার নফরের মেয়েকে পাঠিয়েছে, তা হলে তো দু’জনেরই ক্ষতি হবে। শোভারাম বিশ্বাস মশাইকেও গিয়ে ডিহিদারের লোক জিজ্ঞেস করবে, তোমার মেয়ে কোথায় বলো! হাতিয়াগড়ের রাজাসাহেবকে গিয়েও বলবে তোমার বউরানি কোথায় বলো! তার চেয়ে যা হয়ে গেছে তা গেছে। নতুন করে আবার কেন সে তাদের বিপদ ডেকে আনে।
সমস্ত রাস্তাটাই সে ভেবেছে কেবল। মোল্লাহাটি থেকে বেরিয়ে নৌকো করতে হয়েছে। গহনার নৌকো। নৌকোর মাঝিটা ছিল বুড়ো। এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল কলকাতার খবর কিছু রাখেন নাকি বাবু?
কলকাতার কীসের খবর?
মাঝি বলেছিল–শুনলাম নাকি আমাদের নবাবের সঙ্গে ফিরিঙ্গিদের লড়াই হয়েছিল?
হ্যাঁ, শুনেছি হয়েছিল। তা তোমরা কোথায় শুনলে?
কান্ত মাঝির মুখের দিকে চাইলে। একটু দাড়ি রয়েছে। আধ ঘণ্টা অন্তর অন্তর নামাজ পড়ে কেবল। মাটির হাঁড়িতে রাখা পান্তভাত একটু নুন লঙ্কা দিয়ে খেয়ে সারা দিন-রাত নৌকো চালায়। বুড়ো মাঝি আর তার জোয়ান ছেলে। ওরা জলের মানুষ, জলের ওপরেই সারাজীবন কাটিয়ে দেয় ওরা। কিন্তু ডাঙার খবরের ওপর আগ্রহ আছে। আজ এখানে কাল ওখানে করে করে দুমাস একবছর পরে একদিন হয়তো নিজের দেশে গিয়ে হাজির হয়। বিবির জন্যে জাহাঙ্গিরাবাদের শাড়ি কিংবা মেয়ের জন্যে বহরমপুরের খাডু কিনে নিয়ে যায়। একদিন কি দু’দিন বাড়িতে থেকেই আবার পাড়ি দেয় নদীতে। যখন ফরাসডাঙায় যায় তখন সেখানকার খবর শোনে। তারপর যখন আবার কলকাতায় যায় তখন সেখানকার খবর শোনে। আবার যখন মুর্শিদাবাদে আসে তখন শোনে নবাবের খবর। এইরকম করেই এক দেশ থেকে আর এক দেশে খবর আনা-নেওয়া করে।
এদের কাছে থেকে কান্তর একবার মনে হয়েছিল, এদের সঙ্গে জলে জলে ভেসে বেড়ালে কেমন হয়। কোনও আর ভাবনা থাকে না তা হলে। ফিরিঙ্গিদের চাকরিও তার টিকল না, নবাবের চাকরিও তার টিকবে না। তার চেয়ে এই-ই ভাল।
মাঝির কথায় কিন্তু কান্ত অবাক হয়ে গিয়েছিল। মাঝিটা বলেছিল–ডাঙায় যেমন বাঘ আছে বাবু, জলেও তেমনি কুমির আছে, কোথাও স্বস্তি নেই গো বাবু, কোথাও শান্তি নেই
বশির মিঞার সঙ্গে দেখা করে সোজা সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানে এসে পড়ল। বাদশা। সকাল-সকালই উঠেছে। বাদশা দেখতে পেয়েছে। বললে–কোথায় ছিলেন কান্তবাবু?
কেন? কেউ খুঁজছিল নাকি আমাকে?
আবার কে খুঁজবে? মালিক খুঁজছিল! আমাকে পুছছিল–কান্তবাবু কোন রোজ আসবে—
এখন মিঞাসায়েব উঠেছে?
না বাবু, এখন তো মালিকের মাঝরাত!
সকালবেলার দিকে চকবাজার ঠান্ডা থাকে। দোকানপাট দেরি করে খোলল। তখন গঙ্গা থেকে ভারীরা বাঁকে করে হাঁড়ি-ভরতি জল দিয়ে যায় বাড়িতে বাড়িতে। মুরগিগুলো ভোর থেকে রাস্তায়। বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু যত বেলা বাড়ে তত কাজকর্ম বাড়তে থাকে। তখন কাছারিতে আসতে শুরু করে। ভিনদেশি মানুষ। মামলার তদবিরে কাজির কাছারিতে এসে ধরনা দেয়। কাছারির কাজেও আসে, আবার রাজধানীর দোকান-পসরা থেকে মালপত্র গস্ত করে নিয়ে যায়। ভাল শাখা কেনে, চকবাজারের কামারের দোকান থেকে ভাল হাতাখুন্তি কেনে। কিন্তু রাত্তিরবেলাতেই চকবাজারের আসল শোভা। তখন নবাবের হাতির দল রাস্তা কাঁপিয়ে চান করে ফেরে গঙ্গা থেকে। তখন চেহেলসূতুন থেকে দু’-একটা তাঞ্জাম বেরোয়। তখন গণতকাররা রাস্তার ধারে পাঁজি-পুঁথি-খড়ি নিয়ে বসে যায় ভাগ্যগণনা করতে। তখন সারাফত আলি দোকানের সামনে গিয়ে বসে। আগরবাতি জ্বেলে দেয়, গড়গড়ার মাথায় কলকে বসিয়ে দিয়ে যায় বাদশা, তখন ভুড়ুক ভুড়ুক করে ধোয়া ছাড়ে সারাফত আলি। তখন আফিমের মৌতাত জমে ওঠে।
নজর মহম্মদ একদিন রোজ এসেছে। এত বড় যে একটা লড়াই হয়ে গেল ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে, তাতে। মুর্শিদাবাদের কিছুই ইতর-বিশেষ হয়নি। দোকানের কেনা-বেচা, খদ্দেরের আনাগোনায় কোনও তফাত-ফারাক হয়নি। নজর মহম্মদ যেমন আগেও আসত তেমনিই রোজ এসেছে। লড়াই হচ্ছে, সে তো নবাবের সঙ্গে ফিরিঙ্গিদের, তাতে তোমার আমার কী? একদিন এসে বলেছিল–সেই বাবু কোথায়। গেল মিঞাসাহেব?
বোধহয় মোহরের মোহ লেগে গিয়েছিল নজর মহম্মদের।
মিঞাসাহেব বলেছিল–সে বাবু বাইরের কামে গেছে। তা চেহেল্-সুতুনের খবর কী নজর মহম্মদ?
খবর মিঞাসাহেব খুব জবর!
ক্যায়সা?
নজর মহম্মদ গলাটা নিচু করে বললে–জুবেদার লেড়কা হবে
তৌবা! তৌবা! সারাফত আলি জিভ আর তালু দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করলে। অর্থাৎ হায়-হায়—
পিরালি খাঁকে বলেছি। পিরালি বলেছে লটকে দিতে দেব লটকে
সারাফত আলির লাল চোখ দুটো আরও লাল হয়ে উঠল আতঙ্কে। বললে–সাচ সাচ লটকে দিবি?
হরগিজ লটকে দেব। বেগমদের শায়েস্তা করতে জুবেদাকে না লটকালে আর চলছে না মিঞাসাহেব! কাল তো গুলসন বেগমকে পাঠিয়েছিলাম মতিঝিলে। আমার কী! যদি নবাবকে খুশ করে নিজের নসিব ফিরিয়ে নিতে পারে তো নিক না। কাল তো খুব মহফিল হয়েছে সারি রাত। মেহেদি নেসার সাহেব, ইয়ারজান সাহেব, সফিউল্লা সাহেব একেবারে বুজদিল হয়ে ফুর্তি করেছে। গুলসন খুব নেচেছে, খুব ইনাম পেয়েছে নেসার সাহেবের কাছ থেকে। বড়ি খুশি হয়েছে বেগমসাহেবা।
সারাফত আলি মৌতাতের মধ্যেও কান পেতে শুনছিল। জিজ্ঞেস করলে–তারপর?
তারপর মিঞাসাহেব, রাত তখন অনেক, মেহেদি নেসার সাহেব আমার চেহেল্-সুতুনে এসে হাজির। বললে, মতিঝিলে মহফিল হবে, হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকে দেখব! আমি নেসার সাহেবকে নিয়ে মরিয়ম বেগমের ঘরে গেলুম। দেখি ঘর ফাঁকা, কেউ নেই। মেহেদি নেসার সাহেব ঘরে বসে রইল–
মরিয়ম বেগম কঁহা চলি গয়ি?
মিঞাসাহেব, মরিয়ম বিবি গিয়েছিল লুৎফুন্নিসা বেগমসাহেবার কাছে। আমি সব নজর রেখেছিলাম, কিন্তু নেসার সাহেবকে কিছু বলিনি। কিন্তু ওই মেহেদি নেসার শালা আমার নামে কাছারিতে নালিশ পেশ করেছে আমি নাকি ঘুষ নিয়ে বাইরের আদমিকে চেহেল্-সুতুনের ভেতরে নিয়ে যাই। আমি ভাবতুম, দেখি নেসার সাহেব কী করে! যেই মরিয়ম বেগম ঘরে এসেছে নেসার সাহেব হেসে হেসে বাত বলতে শুরু করেছে। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে লুৎফুন্নিসা বেগমসাহেবাকে গিয়ে খবর দিয়ে এসেছি যে, নেসার সাহেব মরিয়ম বিবির ঘরে ঘুষেছে। খবর দিতেই লুৎফুন্নিসা বেগমসাহেবা একেবারে নানিবেগমকে নিয়ে বরাবর এসে হাজির। একেবারে হাতেনাতে ধরে ফেলেছে নেসার সাহেবকে!
তারপর?
মৌতাতের মধ্যেও সারাফত আলির টনটনে কৌতূহল জেগে উঠল–ঠিক কিয়া! উসকা বাদ? তারপর?
তারপর নেসার সাহেব নানিবেগমকে দেখেই ঘর থেকে ছুটে ভেগে গেল। বাইরে সাহেবের তাঞ্জাম দাঁড়িয়ে ছিল। তাতে ওঠবার আগে আমাকে বলে গেল, রানিবিবিকে মতিঝিলে আজ পাঠাতে হবে না, অন্য কাউকে পাঠিয়ে দে। বনের চিড়িয়াকে পহেলে নাচা-গানা শিখলাতে হবে, তবে তো বুলি বলবে! আমি শুনে মনে মনে হাসলুম মিঞাসাহেব। ভাবলুম আমিও খোজা নজর মহম্মদ, আমি তোমার মতো বহোত আমির-ওমরাহ দেখেছি, আমার নামে নালিশ পেশ করা! তা মিঞাসাহেব আমিও একটা মতলব ঠিক করেছি
কী? ক্যা মতলব?
ঠিক করেছি, আমিও নানিবেগমের দরবারে নালিশ পেশ করব নেসার সাহেবের নামে!
কী নালিশ?
বলব মরিয়ম বেগম লস্করপুরের তালুকদার কাশিম আলির লেড়কিনয়, ও হাতিয়াগড়ের জমিদারের দোসরা তরফের বিবি ছোটি রানিবিবি–
সারাফত আলি অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে–এখনও নানিবেগমের মালুম হয়নি যে ও রানিবিবি
না মিঞাসাহেব, আভি তক মালুম নেহি। সবকুছ নেসার সাহেবের বদমাসি। নানিবেগমের কাছে কোরান ছুঁয়ে কসম খেয়েছে নেসার সাহেব যে ও হাতিয়াগড়ের রানিবিবি নয়। হাতিয়াগড়ের বড়ি রানিবিবি যে নানিবেগমের কাছে চিঠি লিখেছিল–
তা তুই এক কাম কর নজর।
সারাফত আলি গড়গড়ার নলে দু’বার দম টেনে ধোঁয়া ছেড়ে বললে–তুই এক কাম কর, সকলকে আমার আরক পিলিয়ে দে। আরও বেশি করে আরক পিলিয়ে দে। ওই নানিবেগম, লুৎফুন্নিসা বেগম, কাউকে ভি ছাড়িসনি। চেহেল্-সুতুন ভেঙে গুঁড়িয়ে দে, গোরস্তান বানিয়ে দে
নজর মহম্মদ বললে–নেহি মিঞাসাহেব, এ কভি নেহি হো সকতা। চেহেল্-সুতুন চলে গেলে আমরা কী খাব মিঞাসাহেব, নোকরি কে দেবে? আমরা কোথায় যাব?
সারাফত আলি বললে, তোরা মরে যাবি, আমরা ভি মরে যাব। নবাব, বাদশা, আমির-ওমরা সবাই মরে যাবে, আবার নয়া দুনিয়া বনবে চেহেল্-সুতুনের গোরস্থানের ওপর
আপনার বড় গোঁসা মিঞাসাহেব চেহেল্-সুতুনের ওপর!
না রে নজর, নয়া দুনিয়া হলে ইনসানের ভাল হবে, তাই জন্যেই তো বলছি। চেহেল্-সুতুন থাকলে ইনসানের ভাল হবে না। সারা হিন্দুস্থানটাকে আজ বাদশা চেহেল-সুতুন বানিয়ে ফেলেছে। চকবাজারের মানুষরা মরে যাচ্ছে রে নজর। খেতে পাচ্ছে না গরিব লোকেরা, দুমুঠো ভিক্ষে দিলে তাদের কোনও ফায়দা হবে না, তাতে কেবল ফকির ভিখিরির দল বেড়ে যাবে রে নজর আসলি ফায়দা হবে না হিন্দুস্থানের
নজর মহম্মদ এত কথা বুঝতে পারে না। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সারাফত আলির মুখের দিকে। তার কাছে এসব আজব কথা। চেহেল্-সুতুনের ভেতরে সে বরাবর দেখে এসেছে সচ্ছলতা। সে দেখেছে টাকা-মোহর আর মেয়েমানুষের ছড়াছড়ি। দারিদ্র্য কাকে বলে তা তাকে দেখতে হয়নি কখনও। বুড়ো মিঞাসাহেবের কথা শুনে সে যেন ঘাবড়ে গেল।
এ কী আজব বাত বলছেন মিঞাসাহেব? নয়া-দুনিয়া কী করে বনবে? নবাব তো দুনিয়ার মালিক, নবাব তো খোদাতালা
সারাফত আলি হেসে উঠল দাঁত বার করে। বললে–খোদাতালা হল ফিরিঙ্গিরা
ফিরিঙ্গিরা?
হা রে, ফিরিঙ্গিরা। খোদাতালাই ফিরিঙ্গি বাচ্চাদের পাঠিয়ে দিয়েছে হিন্দুস্থানে চেহেল্-সুতুন ভাঙবে বলে, দুনিয়া থেকে চেহেলসূতুন বিলকুল বরবাদ করবে বলে।
বলে সারাফত আলি আরও জোরে হাসতে লাগল।
পেছনের ঘরের মেঝের ওপর কান্ত শুয়ে শুয়ে সব শুনছিল। সারারাত মাঝিদের সঙ্গে গল্পগাছা করেছে, অনেকখানি রাস্তা হেঁটেছে, তারপর বশির মিঞার কাছে গিয়ে দেখা করেছে। আর তারপর খাওয়াদাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আসলে মনটাই ভাল ছিল না তার। তার মধ্যে মনে হচ্ছিল কার গলা যেন শুনতে পাচ্ছে। আস্তে আস্তে তন্দ্রাটা কেটে যেতেই স্পষ্ট শুনতে পাওয়া গেল সারাফত আলির গলা। বোধহয় খদ্দেরের সঙ্গে কথা বলছে মিঞাসাহেব। কিন্তু তার পরেই বুঝতে পারলে খদ্দের আর কেউ নয়, নজর মহম্মদ। বুঝতে পেরেই উঠে বসল। বুঝল, মরালীকে নিয়েই কথা হচ্ছে। মরালীকে মেহেদি নেসার সাহেব দেখতে এসেছিল। তারপর নানিবেগম আসাতে বেঁচে গেছে সে।
তারপর আরও কথা শোনবার জন্যে কান পেতে রইল।
নজর মহম্মদ বললে–চেহেল সুতুন কখনও বরবাদ হতে পারে মিঞাসাহেব?
সারাফত আলি বললে–চেহেল্-সুতুন তো চেহেল্ সুতুন, হিন্দুস্থানের বাদশা ভি বরবাদ হতে পারে। তোরাই তো বাদশাকে বাদশা বানিয়েছিস, তোরাই ফিন মরজি হলে বাদশাকে হটিয়ে দিতে পারিস। যে বাদশা চেহেল্-সুতুন বানায় সেবাদশাকে তোরা কেন রেখেছিস? তাকে হটিয়ে দে। না হটাতে পারিস তো বাদশার চেহেল্-সুতুন হটিয়ে দে!
নজর মহম্মদ আর বোধহয় শুনতে পারলে না। তার বোধহয় ভয়ভয় করতে লাগল। হিন্দুস্থানের মোগল-পাঠান নবাববাদশার নিমক খেয়ে খেয়ে যার হাড়মাংস সমস্ত কিছু বেড়ে উঠেছে, তার এসব কথা শুনলে তো ভয় করবেই।
আমি তা হলে আসি মিঞাসাহেব, আদাব
আর সঙ্গে সঙ্গে কান্ত এসে হাজির হয়েছে সামনে।
আরে কান্তবাবু? তুই কখন লৌট এলি?
নজর মহম্মদও ফিরতে গিয়ে কান্তকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। এই বাবুজিকে চেহেল্-সুতুনে নিয়ে গেলেই একটা মোহর দেবে সারাফত আলি। এক ফুঁ দিয়ে এক মোহরের মালিক হওয়া যাবে। অত সহজে এ বাবুজিকে এড়ানো যায় না।
আজ ভি চেহেল্-সুতুন যায়েঙ্গে জনাব?
সারাফত আলি জিজ্ঞেস করলে–কখন এলি রে তুই কান্তবাবু? আমার তো মালুম পড়েনি
কান্ত সেকথার উত্তর না-দিয়ে বললে–আমি আর ওনোকরি করব না মিঞাসাহেব। আমার আর ভাল লাগছে না। আমার আর ভাল লাগছে না ওনোকরি করতে!
তা না করিস ছেড়ে দে। আমি তো তোকে বলেই দিয়েছি আমি তোকে খিলাব। লেক চেহেল্-সুতুন পে যানে হোগা, ওই যা তাকে বলেছি সব করতে হবে!
নজর মহম্মদ আবার জিজ্ঞেস করলে–আজ ভি যাইয়ে গা জনাব?
সারাফত আলি বললো রে বাবা, যাবে, যাবে! তোকেও তো বলেছি মোহর মিলেগা
কথা আদায় করে নিয়ে নজর মহম্মদ চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ রাস্তার দিকে একটা হইহই হল্লা উঠল। চকবাজারের সমস্ত লোক হইহই করে ভিড় করে উঠল কাকে ঘিরে। ক্যা হুয়া? কী হয়েছে? সকলের মুখেই এক কথা। চকবাজারের দোকানদাররা পর্যন্ত ছুটে গিয়ে হাজির হল রাস্তার মধ্যে। একটা বুড়ো মানুষ মাথায় করে সরাব নিয়ে যাচ্ছিল। মাটির হাঁড়িতে সরাব ছিল। পাশ দিয়ে নবাবের হাতির দল পিলখানায় যাচ্ছিল, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে বুড়োকে। জায়গাটা গন্ধে ভুরভুর করছে একেবারে।
কান্ত কাছে গিয়ে দাঁড়াল। চারদিকে মানুষের ভিড়। ভেতর দিয়ে ঢোকা দায়।
কী হয়েছে লোকটার?
আরে মশাই, মিঞাসাহেব আর একটু হলে হাতির পায়ের তলায় চাপা পড়ত। খোদা বাঁচিয়ে দিয়েছে–
লোকটা কে?
ইব্রাহিম খাঁ।
কে ইব্রাহিম খা?
আরে ইব্রাহিম খাঁ-কে চেনেন না জনাব? মতিঝিলে সরাবখানায় কাম করে। সত্তর বছরের বুড়ো মিঞাসাহেব।
ততক্ষণে অন্য লোকেরা বেশ মজা পেয়ে গিয়েছে। খাঁটি সরাব। নবাব নবাবজাদাদের খাবার জন্যে সরাবখানায় নিয়ে যাচ্ছিল। খুব দামি মাল। চকবাজারের ভাটিখানায় যে-সরাব বিক্রি হয় এ তা নয়। এর অনেক কিম্মৎ। রাস্তায় পড়ে গিয়ে সরাব চারদিকে ছত্রাকার হয়ে গিয়েছিল। ভাঙা হাঁড়ির টুকরোর মধ্যে যেটুকু এখানে-ওখানে পড়ে ছিল তাই নিয়েই কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল তখন। হাঁড়ির কানাগুলো যারা পেয়েছে তারা তা চেটে খাচ্ছে। আহা, খাসা মাল। খাস খোরাসান ইস্তানবুল থেকে আমদানি! বেগম বাদশা-নবাবদের জন্যে বাছাই করা আঙুরের রস দিয়ে বানানো। বঢ়িয়া চিজ। লোকে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মাটির ওপর। তখনও যদি কিছু পড়ে থাকে তলানি। কিন্তু ইব্রাহিম খাঁ তখনও কাতরাচ্ছে। সে-দিকে কারও নজর নেই।
নজর মহম্মদও দেখছিল। বললে–খুদ দারু পিয়েছে—
হাতির দল যেমন যাচ্ছিল তেমনই সোজা চলে গেছে পিলখানায়। নবাবের হাতি। ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই ফতেহ করে এসেছে, কে মরল কে বেঁচে রইল তা দেখবার দায় নেই তাদের। নবাবের নিজামতে মানুষের চেয়ে হাতির কদর বেশি। মানুষ মরে মরুক, কিন্তু একটা হাতির অনেক দাম।
হঠাৎ হইহই করে কোতোয়ালের লোক এসে হাজির। ভিড় হটাও ভিড় হটাও। লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করতে শুরু করেছে তারা। বড়ে আদমি লোকদের তাঞ্জামের রাস্তা ছাড়ো। নবাববাদশাদের ঘোড়া যেতে পারবে না, হাতি যেতে পারবে না, পালকি যেতে পারবে না। হটো হারামজাদা
কোতোয়ালের লোকদের এরা ভারী ভয় করে। ঊর্ধ্বশ্বাসে যে-যেদিকে পারলে দৌড়োতে লাগল। নজর মহম্মদ এক ফাঁকে কান্তর হাতটা ধরলে। বললে–চলিয়ে জনাব ইধার আইয়ে, এবার মারপিট শুরু হবে।
কিন্তু ইব্রাহিম খাঁ তখনও কাতরাচ্ছে। তার দিকে কেউ দেখছে না।
কান্ত কাছে গিয়ে ইব্রাহিম খাঁ’র মুখখানা নিচু হয়ে দেখলে। তারপর পেছন থেকে তার পিঠেও একটা লাঠির চোট এসে পড়ল।
নজর মহম্মদ দূর থেকে দেখছিল। সেখান থেকেই কলে-ইধার আইয়ে বাবুজি, ভাগ যাইয়ে—
কান্তর মনে হল পিঠটা যেন তার ভেঙে গেছে। কিন্তু ইব্রাহিম খাঁ’র চোটটা বোধহয় আরও বেশি। সে তখনও কাতরাচ্ছে।
কান্ত নিচু হয়ে জিজ্ঞেস করলে হাঁটতে পারবে খা-সাহেব–হেঁটে যেতে পারবে?
ইব্রাহিম খাঁ উত্তর দিতে পারলে না। কান্ত আর দেরি করলে না। কোতোয়ালের সেপাইরা তখন পাগলের মতো যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই পিটছে।
কান্ত তাড়াতাড়ি ইব্রাহিমকে পাঁজাকোলা করে তুলল। সত্তর বছরের বুড়ো হলে কী হবে, একেবারে ফাঁপা। শুকনো ক’খানা হাড় শুধু শরীরে, আর কিছু নেই। কোনওরকমে তুলে নিয়েই সারাফত আলির দোকানে এসে নামিয়ে দিলে৷
বললে–মিঞাসাহেব, এখনও মরেনি লোকটা, একটু জল দেব মুখে যদি বেঁচে যায়—
বাদশা এল। কান্ত বললে–একটু জল আনো তো
সারাফত আলি মুখে কিছু বললে–না। কিন্তু মুখের ভাব দেখে মনে হল খুশি হয়নি। নবাব-নিজামতের কোনও লোকের ওপরই সে খুশি নয়। জিজ্ঞেস করলে এ কৌন হ্যায়?
কান্ত বললে–শুনলাম, মতিঝিলে সরাবখানায় খিদমদগারের কাজ করে ইব্রাহিম খাঁ
সারাফত আলি কিছু বললে–না। শুধু জোরে শব্দ করে গড়গড়ার নলে তাম্বাকুর ধোঁয়া টানতে লাগল।
বখতিয়ার খিলিজির পর থেকে নবাব আলিবর্দি খাঁ পর্যন্ত ইতিহাসের একটা গতিপথ আছে। সে-গতিপথে অনেক অত্যাচার অনাচার অবিচার ঘটলেও মুর্শিদকুলি খাঁ’র পর থেকে দেশে একটা শৃঙ্খলা আনবার চেষ্টা হয়েছিল। সে চেষ্টার খানিকটা এসেছে মোগল-পাঠানদের নিজেদের লড়াই মারামারি থেকে। আর খানিকটা এসেছিল দেশের মানুষের আত্মরক্ষার তাগিদ থেকে।
হয়তো এই-ই নিয়ম। হয়তো এমনিই হয়ে থাকে।
হয়তো অন্ধকারের পাশেই আলো থাকে। অত্যাচারের পাশেই থাকে ন্যায়বিচার। একদিকে ইতিহাস যখন অত্যাচারের কলঙ্কে পঙ্কিল হয়ে উঠেছে, তখনই আর একদিকে উদয় হয়েছে তথাগত বুদ্ধদেবের, চৈতন্যদেবের, আর শঙ্করাচার্যের। কিন্তু মুর্শিদকুলি খাঁ’র চেহেলসূতুনের মধ্যে তখনও সেই। প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার। তার এপাশেও আলো নেই, ওপাশেও হতাশা। ওর ভেতরে দিন-রাত, ধর্ম-অধর্ম, পাপ-পুণ্য, সংস্কার কুসংস্কার সব একাকার। ওখানে তখন পৃথিবী তার আদিম অবয়ব নিয়ে নিশ্চল দারুভূত হয়ে আছে। বুদ্ধদেবের নির্বাণ-মন্ত্র ওখানে পৌঁছোতে পারেনি,–চৈতন্যদেবের আচণ্ডালপ্রীতি কোনও রেখাপাত করেনি, শঙ্করাচার্যের ব্রাহ্মণ্য বাণী ওদের কাছে গিয়ে বোবা হয়ে গেছে।
তাই যেদিন বোবা জুবেদার শরীরটা নিয়ে চেহেল্-সুতুনের ভেতরে টানাহ্যাঁচড়া চলল সেদিন কারও কাছে সে-ঘটনা নতুন মনে হয়নি। এ আর এমন কী! এ তো সহজ! এ তো স্বাভাবিক। আদিযুগ থেকে তো এমনিই হয়ে আসছে। আবার অনন্তকাল ধরেও এমনিই চলবে! ও নিয়ে অত বিচলিত হচ্ছ কেন? যে বাচ্চার বাপের ঠিক নেই, সেই বাচ্চাকে যে পেটে ধরেছে তার শাস্তি হবে না? তার শাস্তি যদি না হয় তো চেহেল্-সুতুন, যে অনাসৃষ্টিতে ভরে যাবে!
চেহেল-সুতুনের চবুতরের আরও পুবে যেখানে ধোবিখানা, সেই দিকটাতে সকাল থেকেই ছুতোর মিস্ত্রিদের কাজ চলছিল। একটা উঁচু লম্বা কাঠের কাঠগড়া। দু’পাশে দুটো কাঠের খুঁটি। তার মাথায় শক্ত দুটো হাতল। ওদিকটায় বেশি কেউ যায় না। রাতের বেলায় জায়গাটা খাঁখাঁ করে। লাল পাথরে বাঁধানো জায়গাটার ওপর দিনেরবেলা কিছু ঘাগরা-ওড়নিকঁচুলি কেচে শুকোতে দেয় ধোপারা যখন তাও দেয় না তখন খিলেনের ভেতর থেকে পোষা পায়রার ঝক এসে ওইখানে বসে পাখা চুলকোয়। পেখম তোলে। চানা খায়। কিন্তু সেদিন সকাল থেকেই যেন চাপা-চাপা কানাঘুষো চলেছে। চেহেল-সুতুনের মহলে মহলে ফিসফিস গুজগুজ।
কে? কাকে লটকাবে বললে?
বাঁদিরা বেগমদের কাছে খবরটা দিয়ে তারিফ পাবার আশা করে।
ওমা, তাই নাকি? বোবা মাগির পেটে পেটে এত? কে করলে রে? মানুষটা কে?
সবাই যেন বেশ খুশি-খুশি। সবাই-ই ডুবে ডুবে জল খায়, তবু যে ধরা পড়েছে তার ওপরেই যেন সকলের বিষনজর। নাগর তো আমাদের ঘরেও আসে বাছা, ঘরে এসে রাত কাটায়, কিন্তু এমন করে ধরা তো পড়ি না। কতদিন ন্যাকড়া-জড়ানো রক্ত-মাখানো ডেলাটা চেহেল্-সুতুনের পাঁচিল ডিঙিয়ে বাইরে চুপি চুপি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। ভোরবেলা কাক-চিল-শকুনের ভিড় হবার আগে পর্যন্ত কেউ-ই টের পায়নি। আর টের পেলেও পিরালি খাঁ’র হাতে কিছু গুঁজে দিলেই সব ধামাচাপা পড়ে গেছে। কেউ জানতে পারেনি কোন বেগমের ঘর থেকে তা ফেলা হয়েছে, আর কে-ই বা দায়ী!
বেগমসাহেবা, চলো চলো, দেখবে চলো জুবেদাকে ধরে এনেছে
ও-ও তো একটা কাজ। সারা দিনরাত খেয়েদেয়ে ঘুমিয়েও তো সময় কাটে না কারও। কত আরক খাবে, কত রাত জাগবে, কত গান গাইবে, কত নাচ নাচবে! তবু যে ওদের সময় ফুরোতে চায় না। তক্কি বেগম জাফরিটার আড়ালে গিয়ে দেখছে। বব্বু বেগম গিয়ে দেখছে, গুলসন বেগম গিয়ে দেখছে। সবাই জড়ো হয়েছে আড়ালে। সবাই লুকিয়ে লুকিয়ে দেখবে। জাফরির ফাঁক দিয়ে বাইরের সব জিনিস স্পষ্ট দেখা যাবে, কিন্তু বাইরের লোক ভেতরের কিছুই দেখতে পাবে না।
পিরালি খাঁ তদারকি করছিল কাঠগড়ার কাজে। ওদিক থেকে চারজন খোঁজা জুবেদাকে ধরে নিয়ে এল হিড়হিড় করে। বাঁদিটার কাপড়জামা কঁচুলি সব খুলে নিয়েছে। উদোম চেহারা একেবারে। আহা, আসতে কি চায়। কথাও বলতে পারে না, চেঁচিয়ে কাঁদতেও পারে না; শুধু গলা দিয়ে এক রকম গো গোঁ আওয়াজ বেরোচ্ছে। আর নজর মহম্মদ, বরকত আলি ওরা চাবুক নিয়ে শাসাচ্ছে
টানতে টানতে হিচড়োতে হিচড়োতে একেবারে সোজা কাঠগড়াটার সামনে নিয়ে এল। তারপর একজন ধরলে জুবেদার পা দুটো, আর একজন ঘাড়টা। ধরে ঝুলিয়ে দিলে। পা দুটো ওপরের হাতলের সঙ্গে বেঁধে মাটির দিকে মাথাটা ঝুলিয়ে দিলে।
সমস্ত চেহেল্-সুতুনের যেন আনন্দে একেবারে দম বন্ধ হয়ে পড়বার অবস্থা।
তারপর নীচেয় গর্ত করে, হাত দুটো মাটিতে পুঁতে জম্পেশ করে কাঠের খুঁটির সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিলে। যেন হাত না নাড়তে পারে।
ভয়ে আতঙ্কে বোবা বাঁদিটা গোঁ গোঁ করে গোঙাতে লাগল প্রাণপণ! বেশ চলছিল সব। চারদিকে বেশ মজা দেখবার ভিড় জমেছিল। এমনি করেই পাপীর শাস্তি হয়ে থাকে চেহেল্-সুতুনে। পাপের ভাঁড়ারের মধ্যে পাপীকে প্রশ্রয় দেওয়ার রীতি নেই। তাই এমনি করেই পাপীর শাস্তি চিরকাল ধরে এখানে চলে আসছে। যেদিন থেকে পৃথিবীতে সূর্যোদয় শুরু হয়েছে সেই দিন থেকেই এই রেওয়াজ। জাফরির ফাঁক দিয়ে যারা এ-দৃশ্য দেখছে, তাদের কাছে এ-কিছু নতুন নয়। এমনি করে তিন দিন ধরে ঝুলিয়ে রাখা হবে জুবেদাকে। এক কণা রুটি দেওয়া হবে না, এক ফোঁটা জল দেওয়া হবে না, এক মুঠো করুণাও কেউ দেবে না। তিন দিন পরেও যদি জুবেদা বেঁচে থাকে তো তখন…
হয়তো এমনি করেই আরও অনেকক্ষণ ধরে মজা দেখত চেহেল্-সুতুনের মানুষরা।
কিন্তু হঠাৎ একটা কাণ্ড ঘটল।
ওদিক থেকে পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এসেছে মরিয়ম বেগমসাহেবা।
পিরালি খাঁ দেখতে পেয়েই ইঙ্গিত করলে নজর মহম্মদকে। আর নজর মহম্মদও ইঙ্গিতটা বুঝল। বোঝবার সঙ্গে সঙ্গে মরিয়ম বেগমসাহেবার পথ আটকে দাঁড়িয়েছে।
আমার বাঁদি। আমার বাঁদিকে তোমরা ও কী করছ? ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও ওকে
মরালীর চিৎকারটা আর্তনাদ হয়ে যেন সমস্ত চেহেল্-সুতুনটা একেবারে কাঁপিয়ে তুলল। সকলের মনে হল যেন এতদিন পরে যোবা চেহেল্-সুতুনটারও মুখে কথা ফুটল। মরিয়ম বেগম যেন চেহেল সুতুনের সকলের হয়ে এই প্রথম এক প্রবল প্রতিবাদ পেশ করল।
জাফরির ফাঁকে তক্কি বেগম পাশের বাঁদিকে জিজ্ঞেস করলে–উও কৌন?
বাদি বললে–কোই নয়ি বেগমসাহেবা হোঙ্গি
বব্বু বেগমও অবাক হয়ে গেছে। আগে কখনও মরিয়ম বেগমকে দেখেনি। সেও জিজ্ঞেস করলে তার বাঁদিকে–উও কৌন?
জাফরির ফাঁকে ফাঁকে যত বেগমসাহেবা ছিল সকলের মুখেই ওই একই জিজ্ঞাসা? উও কৌন? এত সাহস তো এতদিন কারও হয়নি। এর আগেও কত বেগমসাহেবার কত বাঁদির ঠিক এমনি করেই শাস্তি হয়েছে, কিন্তু আগে তোকই এমন করে কেউ প্রতিবাদ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েনি এখানে?
কাঠগড়ার ওপর তখনও উলঙ্গ বাঁদিটার পাপী দেহ ঝুলছে আর মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ করে গোঙাচ্ছে।
খোলো, ওকে খুলে দাও, ওর পায়ের দড়ি খুলে দাও–ও মরে যাবে যে—
পিরালি খাঁ নজর মহম্মদকে আর একবার চোখ টিপে ইঙ্গিত করলে। নজর মহম্মদও আর দেরি করলে না। মরালী কাঠগড়ার ওপর উঠে নিজেই বাদিটার পায়ের দড়ি খুলে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই নজর মহম্মদ মরিয়ম বেগমসাহেবার একটা হাত ধরে ফেলেছে।
মরালী এক ঝটকায় সঙ্গে সঙ্গে নজর মহম্মদের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়েছে।
তোমরা ভেবেছ কী? বোবা মেয়েমানুষ পেয়ে ভেবেছ যা খুশি তাই করবে? সরে যাও এখান থেকে, সরে যাও–
এবার নজর মহম্মদের সঙ্গে বরকত আলিও এল মরিয়ম বেগমকে সামলাতে।
মরালী এবার যেন একেবারে ফেটে চৌচির হয়ে গেল।
নানিবেগমসাহেবা–নানিবেগমসাহেবা
চেহেল-সুতুন যেন তোলপাড় হয়ে যাবে মরিয়ম বেগমের চিৎকারে। নজর মহম্মদ তাড়াতাড়ি এসে মরালীর মুখটা চাপা দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু হাতিয়াগড়ের শোভারাম বিশ্বাসের মেয়ে অমন অনেক নজর মহম্মদকে দেখেছে। একদিন মরালীর ভয়ে সমস্ত হাতিয়াগড়ের মানুষ কাঁপত। সেই মরালীকে অত সহজে কাবু করা সম্ভব নয়। মরালী নজর মহম্মদের হাতটা দাঁত দিয়ে জোরে কামড়ে ধরলে। কামড়াতেই নজর মহম্মদ গিয়া গিয়া বলে চেঁচিয়ে উঠে হাত ছেড়ে দিয়েছে।
এবার পিরালি খাঁ আর দেরি করলে না। নিজেই এগিয়ে এসে মরিয়ম বেগমকে ধরতে গেল।
কিন্তু তার আগেই নানিবেগম এসে হাজির হয়েছে। সঙ্গে লুৎফুন্নিসা বেগম।
নানিবেগম শান্ত গলায় ডাকলে–পিরালি খাঁ
পিরালি সঙ্গে সঙ্গে নানিবেগমের দিকে মুখ করে তিনবার কুর্নিশ করে মাথা নিচু করে দাঁড়াল।
মরিয়ম বেগমসাহেবাকো ছোড় দো
বেগমসাহেবা, জুবেদাকে কাঠগড়ায় লটকে দিয়েছি, নেসার সাহেবের হুকুমে মরিয়ম বেগমসাহেবা বাধা দিচ্ছে
মরালী দৌড়ে নানিবেগমের কাছে এসে দাঁড়াল।
বললে–ও যে মরে যাবে নানিবেগমসাহেবা, ও মেয়েমানুষ বলে কি ওর এত হেনস্থা, ওকে কেউ দেখবে না–ওকে ছেড়ে দিতে বলুন না আপনি–
নানিবেগম মরালীর দিকে চাইলে। তারপর শান্ত গলায় বললে–তুমি মা ওদের ব্যাপারে কেন মাথা ঘামাচ্ছ? ওদের কাজ ওরা করুক, ওতে বাধা দিতে নেই–
কিন্তু ও যে বোবা! ও যে কথা বলতে পারে না।
কিন্তু যা নিয়ম তা তো মানবেই ওরা। ওদের কাজ ওরা করবেই!
মরালী বললে–নানিবেগমসাহেবা, আপনি আমার মায়ের মতন, আপনি জুবেদারও মায়ের মতন, আপনার চোখের সামনে এত বড় অন্যায়টা ঘটবে আর আপনি কিছু বলবেন না ওদের? নিয়মটাই বড় হবে আপনার কাছে? মায়া-দয়াটা কিছু নয়? আপনার নিজের পেটের মেয়ের বেলায় যদি অমনি হত, তা হলে? আপনি তা চোখ দিয়ে দেখতে পারতেন?
নানিবেগম প্রথমে কিছু বললে–না। তারপর বললে–তুমি মা নতুন এসেছ এখানে, তাই অত বিচলিত হয়ে উঠেছ, আর কিছুদিন থাকলেই সব বুঝতে পারবে
মরালী বললে–সে যখন বুঝতে পারব তখন বুঝব, এখন ওকে ছেড়ে দিতে বলুন আপনি ও গোঁ গোঁ করছে, ও নির্ঘাত মরে যাবে, আর বাঁচবে না–
নানিবেগম শান্ত গলায় বললে–তুমি মা ওসব কথা ভেবো না, তুমি এখান থেকে চলে যাও, আমিও চলে যাচ্ছি, চেহেলসূতুনের নিয়ম ওরা মানবেই, ও কেউ ঠেকাতে পারবে না
কিন্তু তা হলে আপনি আছেন কী করতে? আপনি তা হলে কোরান পড়েন কী করতে? কোরানে কি এইসব কথা লেখা আছে?
এবার লুৎফুন্নিসা বেগম এগিয়ে এল। বললে–বহেন, এ চেহেল্-সুতুন, এখানে দুনিয়াদারির কানুন খাটবে না–তুমি কেঁদো না বহেন, রোও মাত–
বলে মরালীর চোখের জল নিজের ওড়নি দিয়ে মুছিয়ে দিতে লাগল।
ওদিকে বুঝি নজর মহম্মদ নেসার সাহেবকে কখন গিয়ে খবর দিয়ে এসেছিল। হঠাৎ এরই মধ্যিখানে মেহেদি নেসার সাহেব আসতেই সব আবহাওয়া যেন থমথমে হয়ে এল। শুধু ঝুলে থাকা উলঙ্গ বাদিটার গলা থেকে বেরোনো গোঁ গোঁ শব্দ ছাড়া আর সবকিছু নিস্তব্ধ।
বেগমসাহেবা!
নানিবেগম নেসার সাহেবের দিকে চেয়ে রইল।
মেহেদি নেসার তেমনি মাথা নিচু করে বললে–বেগমসাহেবা, নবাব মির্জা মহম্মদ মরিয়ম বেগমসাহেবাকে মতিঝিলে এত্তেলা দিয়েছে–
কথাটা শেষ হবার আগেই মরালী চিৎকার করে উঠল–আমি মতিঝিলে যাব না নানিবেগমসাহেবা, আমি মতিঝিলে যাব না
নেসার সাহেব বললেনবাবের হুকুম যে এটা মরিয়ম বেগমসাহেবা।
আমি যাব না, আমি কিছুতেই যাব না মতিঝিলে বলে মরালী হঠাৎ নানিবেগমকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল প্রাণপণে। আর কিছুতেই ছাড়তে চায় না। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য!
বললে–আপনার পায়ে পড়ি নানিবেগমসাহেবা, আমি আপনার মেয়ের মতন
কিন্তু মির্জা যে তোমাকে ডেকেছে মা, না গেলে সে যে গোঁসা করবে! সে যে খুব রাগী মানুষ! মরিয়ম বেগমের নাম করে যখন ডেকেছে, তখন না-গেলে নবাবের অপমান হয়। না মা মরিয়ম, তোমার কোনও ডর নেই, আমি বলছি তুমি যাও
হঠাৎ মরালী নানিবেগমের মুখের ওপর মুখ রেখে বললে–কিন্তু মা, আমি তো মরিয়ম বেগম নই
মরিয়ম বেগম নও? লস্করপুরের তালুকদার কাশিম আলির লেড়কি নও
মরালী বললে–না মা, আমি হাতিয়াগড়ের জমিদারের ছোটবউ, আমি আজ সত্যি কথাই বলি, আমি হাতিয়াগড়ের রানিবিবি!
কথাটা বলবার সঙ্গে সঙ্গে যেন সারা চেহেল্-সুতুনে বিদ্যুৎ চমকে গেল। নানিবেগম অবাক হয়ে মেহেদি নেসার সাহেবের দিকে চেয়ে বললে–হাতিয়াগড়ের রানিবিবি!
কিন্তু মেহেদি নেসার তখন সেখান থেকে নিঃশব্দে সরে গেছে। নানিবেগমের হঠাৎ মনে পড়ল বহুদিন আগে হাতিয়াগড়ের বড় রানিবিবি তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে একটা খত্ লিখেছিল। তখন নেসার বলেছিল সেসব মিথ্যে কথা। শেষকালে সেই খল্টার কথাই সত্যি হল?
নানিবেগম মরালীকে বুকের মধ্যে আরও জোরে জড়িয়ে ধরল।
লুৎফুন্নিসা বেগমও তখন মরালীকে সান্ত্বনা দিতে লাগল–বহেন, তোমার কোনও ডর নেই, তুমি কেঁদো না বহেন
ওদিকে কাঠগড়ার ওপরে বোবা জুবেদা তখনও গোঁ গোঁ করে গোঙাচ্ছে, আর তার মুখ দিয়ে গলগল করে সাদা সাদা ফেনা বেরোচ্ছে।