বৃত্তের বাইরে (Britter Baire) : 08
চারদিক থেকে অন্ধকার নেমে আসছে। দিনের প্রখর আলোতেও সে অন্ধকার সরে না। চারদিকে উজ্জ্বল পরিচ্ছন্ন আসবাব, ছবি, কার্পেট, সুশোভন গাছ, ফুলদান, সব বস্তুপিণ্ড। প্রাণ নেই, মানে নেই, আনন্দ দেবার, সুস্থিতি দেবার কোনও ক্ষমতাই নেই। সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় মুঠো মুঠো ঘুমের বড়ি গিলে চেতনাকে হত্যা করা যাক। কে তুমি তনুশ্রী রায়? আসলে তুমি কেউ না। তুমি যেটুকু বিজু রায়ের স্ত্রী সেইটুকু তোমার অর্থ আছে। সামাজিক পরিচয়। বিজু রায় আছেন, কোনও কারণে আসতে পারছেন না, তুমি শর্মার ছেলের বিয়ের পার্টিতে গেলে। ঠিক আছে। কিন্তু বিজু রায় নেই। বিজু রায়ের বিশাল ব্যবসার সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ছে, অব্যবহৃত জীর্ণ প্রাসাদের মতো। ভগ্নস্তূপ, খণ্ডহর। তুমি আসলে একটি প্রেতিনী। তুমি কোথায় যাবে? কেউ তোমায় ডাকবে না। যদি অগত্যা ডাকেও, গেলে সব তেরছা চোখে চাইবে, নানা ছলছুতো করে সরে যাবে। অন্যত্র। অন্য কারও কাছে। যে এখনও গোটা আছে, ভাঙেনি, তার কাছে। ঠিক এরকম একটা ঘটনা সম্প্রতি একটা পার্টিতে ঘটতে দেখেছে তনুশ্রী। মিঃ সরকার প্রধানত স্টিল পারমিটের সুবাদে ধনী। পারিবারিক ব্যবসাও আছে বহুদিনের। রোলিং মিল। ভাইয়েরা তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করল। ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদে পলিটিক্যাল প্রভাব গেল ভাইয়েদের দিকে, মিঃ সরকার একরকম নিঃস্ব হয়ে গেলেন। খুব দিল দরিয়া মেজাজের লোক ছিলেন, লোককে খাওয়াতে, পান করাতে, ভালবাসতেন, ভদ্রলোক সুইসাইড করলেন। বছর খানেক পরে মিসেস সরকার এইরকম একটা বিয়ে না কিসের পার্টিতে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। সাদা শিফন শাড়ি, রুপোর গয়না। একসময়ে খুব সুন্দরী ছিলেন মিসেস সরকার। ভাগ্য বিপর্যয়ে কেমন লাবণ্যহীন, ম্যাড়মেড়ে, ওই খণ্ডহর। তনুশ্রীকে ধরেছিলেন, দুজনে কথাবার্তা বলেছিলেন ওয়াইন হাতে নিয়ে, মিসেস শর্মা ছলছুতো করে ডেকে নিয়ে গেলেন— ‘ওটার সঙ্গে এত কী কথা বলছিলেন?’ ‘দ্যাট উওম্যান’ এই শব্দ ব্যবহার করেছিলেন মিসেস শর্মা। এখনও মনে আছে স্পষ্ট। এই মহিলাই একদিন কত জমকালো পার্টির কর্ত্রী, এঁর কৃপাদৃষ্টি পেলেই তনুশ্রী তো কোন ছার, মিসেস শর্মাই বর্তে যেতেন। পার্টি যখন খুব জমে উঠেছে তখন একবার দেখতে পেয়েছিলেন দূরে একটা কোণের সোফায় চুপ করে বসে আছেন মিসেস সরকার। বেয়ারারা ট্রে হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওঁর কাছটা এড়িয়ে যাচ্ছে। ওই বেয়ারা কেন, মাটি, ঘরের মেঝেটা, কার্পেটটাও চেনে কে সম্পন্ন, কে নয়, সে সম্পূর্ণ, কে ভাঙা। তখন তনুশ্রীরও মনে হয়েছিল ‘উইচ, শী ইজ আ উইচ’, রেণুকা শর্মার মতো। মনে হয়েছিল। এখন তনুশ্রী বুঝতে পারছেন না উইচ নয়, এক ভাগ্যহীনা, একাকিনী, কৃপার পাত্রী, তা-ও নয়, মর্মান্তিক ট্রাজেডি এক। তনুশ্রী শিউরে উঠলেন।
হঠাৎ তিনি চমকে বিছানায় উঠে বসলেন। সত্যিই তো। বিজু রায়ের বিজনেসের কী হবে? যদি সত্যিই না ফেরে? মাস ফুরিয়ে আসছে, সবাইকেই মাইনে-পত্র দিতে হবে। সব চেকেই নিশ্চয়ই বিজু রায়ের সই চাই। রাশি রাশি বিল আসবে কদিন পর থেকেই। তনুশ্রীর নিজস্ব অ্যাকাউন্ট আছে। তাতে তাঁর নিজের খরচ চলে, তনুশ্রী দু হাতে খরচ করেন। ছেলের মেয়ের নির্দিষ্ট হাত খরচ আছে, তাদেরও নিজস্ব অ্যাকাউন্ট আছে, তা থেকেই চলে। সংসার খরচের জন্য প্রতি মাসে বিজু রায় তাঁকে একটা মোটা অঙ্কের চেক দেন, তা ছাড়াও আছে কিছু জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট। কিন্তু তার পাস বই, চেক বুক সবই থাকে বিজু রায়ের কাছে। বিজু রায়ের টাকা-পয়সার বন্দোবস্তের কথা এর চেয়ে ভাল জানেন না তিনি। ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। কাকে ডাকবেন? ছেলেকে? অপদার্থ একটা। শিখেছে খালি শ্রাগ করতে আর ইংরিজি গালাগাল দিতে। মেয়েকে? মেয়েকে ডাকবেন? যা দেমাকি! কিসের এত দেমাক কে জানে। তনুশ্রীর মতো সুন্দরী নয়। লেখাপড়াতেও আহামরি কিছু নয়। কিসের অহঙ্কার এত! স্বামী ছাড়া প্রকৃতপক্ষে তাহলে একজন সন্তানবতী নারীরও কিছু থাকে না। তনুশ্রীরও বিজু রায় ছাড়া কেউ নেই। তনুশ্রী মাঝের বিশাল দরজাটা খুলে বিজু রায়ের ঘরে গেলেন। পরিষ্কার গোছানো। বিছানা টান-টান। দেয়ালে আলনা আলমারি। থাক থাক ড্রয়ার। ওয়ার্ডরোব। চাবি কোথায়? খাটে। বালিশের তলায়। গদি উল্টে ফেলে দেখছেন, হাঁফাচ্ছেন। সেরেছে। চাবিও নেই?
—‘মা, এখানে কী করছ?’ পেছনে মেয়ের গলা।’
প্রথমেই প্রচণ্ড রাগ হল তনুশ্রীর। তাঁর স্বামীর ঘরে ঢুকে কী করছেন তিনি, মেয়েকে কৈফিয়ত দিতে হবে?
পরক্ষণেই কুটো আঁকড়াবার মতো করে তিতির হাত আঁকড়ে লণ্ডভণ্ড বিছানার ওপরে বসে পড়লেন তনুশ্রী। এই শীতেও দরদর করে ঘামছেন। নিজের চুন্নির প্রান্ত নিয়ে মায়ের ঘাম মুছিয়ে দিতে দিতে তিতি বলল— ‘এত ঘামছ কেন? এ কী?’ সে ছুট্টে গিয়ে এয়ার কুলারটা চালিয়ে দিল। তারপর মায়ের পাশে বসে পড়ে কাঁধে নরম করে হাত রেখে বলল, ‘মা, তুমি এত নার্ভাস হচ্ছ কেন? আমরা তো সবাই আছি। সত্যি বাবা যে কী করে এমন একটা কাজ করল…’
তনুশ্রী আতঙ্কিত দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন— ‘কী কাজ! খোঁজ পেয়েছ?’
—‘খোঁজ পাব কী করে?’ তিতি অবাক হয়ে বলল।
—‘তবে যে বললে কী করে এমন কাজ! তোমরা তাহলে ধরেই নিয়েছ বাবা ইচ্ছে করে চলে গেছে? চলে গেছে আমায় ছেড়ে?’
—‘ভুল হয়ে গেছে মা, তা ছাড়া বাবা গেলে তো শুধু তোমায় ছেড়ে চলে যায়নি, আমাদের সবাইকেই ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু বাবা স্বেচ্ছায় ও ভাবে গেছে ভাবাটা ঠিক নয়।’
‘কিন্তু ধরো যদি কোনও কারণ থেকে থাকে, যদি ধরো অন্য কেউ, মানে অন্য কাউকে, মানে অন্য কারুর…’
—‘কী বলছ মা? ঠিক করে বলো।’ তিতি মায়ের হাত দুটো ঝাঁকিয়ে বলল, তনুশ্রী তখনও বড় বড় ভয় পাওয়া চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। তখন সে বুঝল। ভেতরটা হিম হয়ে গেল। অনেক কষ্টে গলায় স্বর এনে আস্তে আস্তে বলল—‘এরকম কেউ ছিল? তুমি জানো?’
তনুশ্রী কেঁদে ফেললেন— ‘না জানি না, কী করে জানব? শর্মাজি যখন তাঁর আগেকার বউকে ডিভোর্স করলেন সেক্রেটারি রেণুকাকে বিয়ে করবার জন্যে তখন সেই আগেকার বউ, অযোধ্যা অঞ্চলের দেহাতি মেয়ে নাকি একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছিল। মিসেস বসাকের কাছে শুনেছি। সে এতই মুখ্যু যে তাকে বিশেষ কিছু দিতেও হয়নি শর্মাজির।…’
তিতি বলল— ‘কিন্তু মা, শর্মাজির সেই বউ মুখ্যু, দেহাতি হতে পারে। তুমি তো তা নয়।
তুমি কি তেমন কিছু… মানে এররকম ভাবার কোনও কারণ আছে কি তোমার?’
—‘আমি জানি না। জানি না তিতি। আমি ওকে বিশ্বাস করতাম। এখন বুঝতে পারছি তোমাদের বাবাকে আমি বোধহয় খুব ভাল করে জানি না।’
মায়ের উদ্ভ্রান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তিতি ভেতরে ভেতরে কেমন ভয় পেয়ে গেল। তার পায়ের তলা থেকে কে যেন কার্পেট, মাটি, জমি, পৃথিবীটাই সরিয়ে নিচ্ছে। মায়ের কথাটা যেন মায়ের কথা নয়, একটা উদ্ধৃতি। ‘তোমার বাবাকে আমি বোধহয় খুব ভাল করে জানি না।’ সে নিজে, তিতি, সে-ইই কি বলতে পারে খুব ভাল ছেড়ে একটুও জানে কি না সে তার বাবাকে তার মাকে তার দাদাকে? তারাই কি কেউ একটুও জানে তাকে? কী ভয়ঙ্কর এই না জানা! এক ছাতের তলায়, এক পরিবারের মানুষ তারা, হঠাৎ একদিন একজন না-ফিরলে অন্যরা বলতে পারবে না সে কোথায় যেতে পারে, কেন গেল। সে, যখন অর্জুনদের চুঁচুড়ার বাড়িতে গিয়েছিল, শুধু বলে যায় বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে। কোথায়, কী বৃত্তান্ত কিছুই বলে যায়নি। তখন যদি তাকে বাড়িতে খুব দরকার হত! ধরা যাক, তার বাবার হঠাৎ স্ট্রোক হয়েছে কি মায়ের হঠাৎ হার্ট-ব্লক, তাহলে? তাহলে তাকে খবর দেবার কোনও উপায় কারও থাকত না।
তিতি বলল— ‘মা, সেজজ্যাঠার বাড়ি একটু খবর দিই। দিব্যদাকে বলি…
—‘না, না’ তনুশ্রী অস্থির হয়ে উঠলেন।
—‘কিন্তু কেন?’
—‘যদি স্ক্যান্ডাল কিছু হয়, আত্মীয়রা…না না তিতি না…।’
তিতি বলল— ‘মা, স্ক্যান্ডাল তো না-ও হতে পারে। যদি এটা বাবার প্রাণ সংশয় ব্যাপার হয়? তখন?’ বলতে বলতে তার গলা কেঁপে যাচ্ছে। ‘তখন কিন্তু সবাই আমাদের খুব দোষ দেবে। এখনই অনেক দেরি হয়ে গেছে।’
তনুশ্রী কিছু বলতে পারছেন না। ভয়ে একদম বোবা, হাতটা নেড়ে শুধু ‘না না’ বোঝাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অদ্ভুত দৃশ্যটা।
একটু পরে বাক্শক্তি ফিরে পেয়ে তনুশ্রী বললেন— ‘ঘরটা ভাল করে দেখো। দেখতে হবে, যদি কিছু থাকে। টাকাকড়িরও দরকার। আমি কোনও চাবি পাচ্ছি না।’
ডুপ্লিকেট চাবি রাখবার লুকোনো জায়গাটা তিতিই খুঁজে বার করল। ওয়ার্ডরোবটা খোলাই ছিল। ভেতরে কোণের দিকে একটা হ্যাঙারে বাবার জোব্বা ঝুলছে। জোব্বাটার পেছনে একটা ছোট্ট আংটা, সেটাতে টান দিতে একটা ছোট্ট খোপ খুলে গেল, তার মধ্যে চাবির গোছা। তিতি অবাক হয়ে গেল দেখে, মা এর কিছুই জানত না। জানে না। একবার মনে হল জিজ্ঞেস করে— ‘তুমি কোন জগতে বাস করো?’ অনেক কষ্টে প্রশ্নটাকে গিলে নিল। ড্রয়ার খুলতে পারল কয়েকটা। থাকে থাকে বাড়ির ট্যাক্সের রসিদ, টেলিফোনের, বিজলির সব আলাদা আলাদা থাক করা। পাস বই দু চারটে। ত্রিশ চল্লিশ হাজারের মতো প্রত্যেকটাতে। জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট এগুলো তনুশ্রীর সঙ্গে। যদিও তনুশ্রী কোনও দিন ব্যবহার করেননি। তিতি দেখে-শুনে বলল— ‘মা, আমাদের বাড়ির খরচ-খরচার ভাবনাটা আপাতত ঘুচল।’
টেলিফোনটা বাজছে ওদিকে। থেমে গেল। কেউ ধরেছে। কে? চিন্টু? একটু পরে চিন্টু ঘুমে ভারী চোখ, ভারী গলায় এ ঘরে ঢুকে বলল— ‘শর্মাজি ফোন করছেন মাম্মি, ড্যাডের খবর নিচ্ছেন, বলে দিয়েছি, হাই টেম্পরেচার।’
—‘কেন? একথা বললি কেন?’ তিতি জিজ্ঞেস করল, সে এই মিথ্যে কথা আর গোপনতার দুর্গ থেকে বেরোতে চায়। তার মন বলছে তারা নিজেদের চারপাশে ক্রমশই একটা শক্ত জাল বুনে চলেছে। এর ফলে নিজেরাই বিপদে পড়বে।
চিন্টু বিরক্ত গলায় বলল— ‘তাহলে কী বলব? পুলিশে খবর দিতে দেবে না। কাউকে কিছু বলা বারণ, আমার যা মনে আসে বলে দিয়েছি।’
তিতি বলল—‘এভাবে চলবে না কিন্তু মা। কারুর না কারুর সাহায্য আমাদের নিতেই হবে। থাকগে, তুমি এখন চান করতে যাও।’
ঠেলে-ঠুলে তনুশ্রীকে চানে পাঠিয়ে সে বলল— ‘দাদা, আমাদেরই পরামর্শ করে ঠিক করতে হবে কী করা উচিত। মার কিন্তু বুদ্ধি কাজ করছে না।’
হঠাৎ চিন্টু ঘরের ভেতরে চলে এল, দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারপর হ্যাঁচকা টানে ওয়ার্ডরোবের পাল্লাটা খুলে ফেলবার চেষ্টা করতে লাগল।
তিতি বলল— ‘ওটা কী করছিস, ওভাবে খুলতে পারবি? চাবিটা নে।’
চাবিটা হাতে নিয়ে চিন্টু অবাক চোখে তিতির দিকে তাকিয়ে বলল— ‘চাবি? ড্যাডের চাবি নাকি? কোথায় পেলি?’
—‘পেলাম। বাবা ঠিক যেখানে রেখেছিল সেখানে।’ সে রহস্যময় একটা হাসি হাসবার চেষ্টা করল, যদিও হাসিটা খুব শুকনো দেখাল।
একটার পর একটা পরীক্ষা করে দেখতে দেখতে ওয়ার্ডরোবের চাবিটা যেই লেগে গেল, একটা হ্যাঁচকা টান মেরে পাল্লাটা খুলে ফেলে চিন্টু দু লাফে সরে দাঁড়াল। তারপর কী রকম হতভম্ব মুখ করে তিতির দিকে তাকিয়ে রইল। তিতি বলল— ‘কী খুঁজছিস?’
—‘তুই একটু দেখবি, ভেতরটা?’
—‘একটু আগেই তো দেখলাম। ওয়ার্ডরোবটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেই তো চাবির গোছাটা বার করতে পারলাম।’
‘ও দেখেছিস? তো খাটের বক্সটা একটু দ্যাখ তো।’
—‘কেন?’
—‘যদি কিছু পাস?’
—‘কী পাব?’
—‘ধর, কোনও ইন্ডিকেশন যে একটা লোক এখানে মার্ডার্ড হয়েছে, কি এই ধরনের কিছু। এ ঘরটা দেখা হলে মাম্মির ঘরটাও দেখব।’
—‘কী বলছিস কি তুই? এই ঘরে, মার্ডার! মা থাকছে, বুঝতে পারবে না।’
—‘হয়ত জানে।’
তনুশ্রী কোনওরকমে হাত পা মুখ ধুয়ে বাথরোবটা চড়িয়ে চানঘর থেকে বেরোতে বেরোতে চিন্টুর শেষ কথাগুলো শুনতে পেলেন। মড়ার মতো ফ্যাকাশে মুখে তিনি সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলেন। কী বলছে চিন্টু? এ সব কথার মানে কী? কে মার্ডার হয়েছে। বিজু? তাঁর ঘরে? তিনি জানেন? বাইরে গলার আওয়াজ। অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। প্রমীলা চট করে গলা বাড়িয়ে জানিয়ে গেল শর্মাজি আসছেন। চিন্টু বেরিয়ে যাচ্ছে। তনুশ্রী বিছানায় শুয়ে পড়লেন। যেন তাঁর শরীরে আর এক ফোঁটাও শক্তি নেই। চিন্টু কী ভেবে কথাটা বলল? তিনি জানেন? বিজু মার্ডার্ড? তাঁর ঘরে? এ রকম অদ্ভুত ধারণা চিন্টুর, তাঁর নিজের ছেলের, তাঁর সম্পর্কে? কী ভয়ানক মুখ তাঁর? কী বীভৎস? খুনি মনে হয় তাঁকে? অথচ এতদিন তিনি আয়নাতে দেখেছিলেন— সুন্দর! ভারী সুন্দর। উঃ, হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে যেন?
তিতি ভয়ার্ত গলায় বলে উঠল— ‘মা, মা, তুমি অমন করছ কেন?’
দরজার গোড়া থেকে শর্মাজির গলা শোনা গেল— ‘আসতে পারি?’
তিতি মায়ের গায়ে একটা কম্বল চাপা দিয়ে দিল, বলল— ‘আসুন আঙ্কল।’
চিন্টুকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে ঢুকে শর্মাজি বললেন— ‘আমি কাছাকাছি এক বন্ধুর বাড়ি এসেছিলাম। খোঁজ নিতে নীলাদ্রি বলছে বাবার হাই টেম্পারেচার কিন্তু এসব কী শুনছি? এতো দেখছি মিসেস রয় শুয়ে আছেন? আমাকে ব্যাপারটা একটু খুলে বলবে? নানা রকম কানাঘুষো শুনছি।’
তনুশ্রী নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। তিতি সমস্তটা বর্ণনা করে বলল— ‘মা লজ্জায় আত্মীয়-স্বজনকে, পুলিশকে কাউকেই খবর দিতে দিচ্ছে না।’
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তনুশ্রীর দিকে একবার তাকিয়ে শর্মাজি বললেন— ‘দ্যাটস অলরাইট। মিসেস রয় ঘাবড়াবেন না কিছু। আমি দেখছি। একটা প্রাইভেট কনসার্ন আছে ভাল, তাদের দিয়ে…. কোনও ভাবনা নেই।’
শর্মাজি তিতি আর চিন্টুকে চোখের ইশারায় বাইরে ডেকে নিলেন। অতি বুদ্ধিমান লোক, শুধু বললেন— ‘ডোন্ট ওয়ারি, দেখি কী করা যায়।’ তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফোনের বোতাম টিপতে লাগলেন।
‘হালো। আমি কে.ডি. শর্মা বলছি, রক্সি আছে?’ তিতি আর চিন্টু দুজনেই বসে ওঁর কার্যকলাপ দেখছে।
—‘রক্সি! একটা কেস আছে, আটমোস্ট সিক্রেসি নীডেড। ..হ্যাঁ। আমি পার্টিকে নিয়ে যাচ্ছি, থাকো একটু। … হ্যাঁ উইদিন সে, টোয়েন্টি মিনিটস।’ ফোন ছেড়ে বললেন— ‘নীলাদ্রি চলো আমার সঙ্গে। এরা খুব কমপিটেন্ট, ডিসক্রীট। ঘাবড়িয়ো না।’
চিন্টু বলল— ‘এক মিনিট।’ গতকাল সারা রাতই প্রায় সে বাড়িতে ছিল না। ছিল তাদের নিজস্ব একটা গোপন ক্লাবে। ভোরের দিকে ফিরে একটু ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু এখন সে চট করে, একটা জীনস গলিয়ে নিল, আর একটা সোয়েট শার্ট গলিয়ে নিল, পায়ে স্নীকার্স। চুলে একটু চিরুনি চালাল কি না চালাল। বেরিয়ে এসে বলল— ‘চলুন আঙ্কল।’
—‘দ্যাটস লাইক আ স্মার্ট বয়’—শর্মা হাসলেন। তিতির দিকে চেয়ে বললেন—‘তুমি তোমার মাকে দেখো। বড্ড আপসেট হয়ে পড়েছে।’
তিতি ঘরে ঢুকে দেখল মা সিলিঙের দিকে চেয়ে কাঠের মত শুয়ে। চোখ দুটো লাল। সে বলল— ‘রাতে কি ঘুমোওনি?’
তনুশ্রী জবাব দিল না। সে আসলে তিতির অস্তিত্ব সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল। তার চোখের সামনে ভাসছিল সরু গলির মধ্যে একটা দোতলা বাড়ি। টানা বারান্দা। কতকগুলো ছাগল বাঁধা। ভেতরে ফরাস পাতা একটা ঘর। প্রচুর লোক বসে। সে-ও বসে। এক এক জনের ডাক আসছে, সে উঠে যাচ্ছে। ভেতরের একটা ঘরে। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসছে। কপালে একটা সিঁদুরের ফোঁটা। তনুশ্রীর ডাক এল। ভেতরের ঘরটা ছায়া-ছায়া, একতলায় ভেতর দিকের ঘর, আলো ঢোকে না। কম পাওয়ারের একটা বিজলিবাতি জ্বলছে। লাল কাপড় পরা জটাধারী একজন তান্ত্রিক বসে আছেন। পেছন ফিরে। তনুশ্রীর সামনে ছত্রিওলা খাটের মতো দেখতে একটা সিংহাসনে একটা লাল জিভ। জিভ শুধু, ফুলের ভারে আর সব ঢাকা পড়ে গেছে কিংবা নেই, বোঝা যাচ্ছে না। জিভটাকে বেড়ে লাল বেনারসী কাপড়ের আভাস চোখে পড়ল। আর চকচকে মোহরের মালা। মোহর কি না কে জানে কিন্তু মোহরের মতো।
বজ্রগম্ভীর গলায় তান্ত্রিক বললেন, —‘তোর আবার কী হল?’ যেন কতদিনের চেনা।
গলার আওয়াজে কাঁপুনি ধরে গেল তনুশ্রীর। সে বলল— ‘স্বামী পাঁচদিন হল নিরুদ্দেশ।’
—‘জয় মা, জয় মা,’ হুঙ্কার দিয়ে বলতে লাগলেন তান্ত্রিক। তারপর হঠাৎ দ্বিগুণ হুঙ্কার দিয়ে ভয়ঙ্কর সব মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন আর মুঠো মুঠো জবাফুল ছুঁড়ে ফেলতে লাগলেন কালীমায়ের জিভের তলায়। পরপর বললেন— ‘জয় মা হিরণ্যকালী, জয়, জয়। যাঃ তোর কাজ হয়ে গেছে।’ এ পাশ ফিরলেন। সিংহাসনটার একদিকে টাঙানো রাশীকৃত জবাফুলের মালার মধ্যে একটা টেনে নিয়ে দুবার ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিলেন তনুশ্রীর দিকে। মালাটা নির্ভুল লক্ষ্যভেদে তার গলায় পড়ল। সামনে গোলা-সিঁদুরের বাটি থেকে বুড়ো আঙুলে করে সিঁদুর গোলা তুলে নিয়ে তনুশ্রীর কপালে টিকা দিয়ে দিলেন।
কোনওক্রমে তনুশ্রী বলতে পারল— ‘কী হল? কী বুঝলেন বাবা?’
—‘বুঝলি না? বাণ মেরে দিলুম।’
—‘ক্ কাকে? ক্ কোথায়?’
—‘ওই যে সর্বনাশী তোর গড়া ঘর ভাঙছে! একেবারে সোজা বুকের মধ্যে গিয়ে লাগবে। যাঃ ভয় নেই, তোর স্বামী ফিরে আসবে, আবার স্বামীসোহাগী হবি।’
তনুশ্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলছিলেন সাধুটি। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। তনুশ্রী কেমন বিহ্বল হয়ে টাকার পার্স তার ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে থেকে বার করতে লাগল—এ বেটি সোনা ছাড়া আর কিছু বোঝে না। জানিস তো! এক কণা হলেও সোনা দিয়ে যাস। নইলে বেটির আমার বড্ড বদরাগ। জয় মা হিরণ্যকালী!
তনুশ্রী এক কণা সোনা কোথা থেকে পাবে? সে তার বাঁ হাতের মধ্যমা থেকে টেনে টেনে মুক্তোর আংটিটা খুলল। সাধুর হাতে দিতে গেল।
—‘ওইখানে দে। আমার হাতে কেন?’ সিংহাসনের সামনের জায়গাটা দেখিয়ে দিলেন সাধু চিমটে দিয়ে। তনুশ্রী আংটিটা সেখানে রাখল, কী যেন একটা রাখা ছিল তার ওপর। রাখার সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের মধ্যে দিয়ে যেন বিদ্যুৎ বয়ে গেল। সে সভয়ে হাত তুলে নিল।
—‘কী হল? বেটি নিলে তাহলে।’ সাধু আবার হুঙ্কার দিলেন। ‘তোর মনোরথ পূর্ণ হলে মুক্তোটা নিয়ে যাস। এ বেটি সোনা ছাড়া কিছু বোঝে না।’ গলায় জবাফুলের মালা। কপালে সিঁদুরের টিপ, হাতে একটা চ্যাঙারিতে প্রসাদ, তনুশ্রী বেরিয়ে আসতে একটি বব চুল আধুনিকা মহিলা আকুল হয়ে বললেন—‘আপনার কাজ হল?’
—‘হবে তো বললেন।’ তনুশ্রী যেন যন্ত্রের মতো বলছে— ‘আপনার কী?’
—‘ছেলের লিউকিমিয়া বলছে ডাক্তার’, মহিলা রুমাল দিয়ে নিজের মুখটা চেপে ধরলেন। একজন অপেক্ষমাণা শান্ত চেহারার শ্রীমতী মহিলা বললেন— ‘যান না দিদি যান, মায়ের কৃপা হলে ছেলে ভাল হয়ে যাবে। আমার স্বামীর লাং ক্যান্সার সেরে গেছে।’
—‘সেরে গেছে?’ ভদ্রমহিলা ব্যাকুল গলায় বললেন। ‘একেবারে? তাহলে এসেছেন?’ শান্ত চেহারার মহিলা বললেন— ‘উনি একেবারে ভাল হয়ে গেছেন। এবার এসেছি ছেলের চাকরির জন্যে। আমরা সব সময়ে মার কাছেই আসি, মা-ই ভরসা। গলায় হাত দিয়ে ব্লাউজের মধ্যে থেকে একটা মোটা বিছে হার টেনে বার করলেন তিনি।
—‘ওঁর আরোগ্যের জন্যে এটিও দেব,’ বলে তিনি হাত দুটো জড়ো করে নমস্কার করলেন।
তনুশ্রী বেরিয়ে এসেছে। যেন ভাল করে চলতে পারছে না। কোনওমতে গাড়িতে গিয়ে উঠল। তাহলে তার অনুমানই ঠিক? বিজু রায় এই বয়সে অন্য কোনও মহিলার, কিংবা কে জানে হয়ত মেয়ের, অনেক ছোট মেয়ের মোহে পড়লেন? তনুশ্রী আর ভাবতে পারছে না, ভাবতে পারছে না। কাগজে এই ‘সাধুবাবা’র বিজ্ঞাপন পড়ে সে ছুটে এসেছে। বাণ মেরে দিয়েছে। সম্ভব এভাবে বাণ-টান মেরে দেওয়া? আসলে বোধহয় ওইটুকুই ঠিক। বিজু রায়ের অন্য নারীর মোহে পড়ে চলে যাওয়াটা। বাকিটা কি আর ঠিক হবে? বাণ-টান এই যুগে?
তিতি বলল— ‘মা, তুমি এত কী ভাবছ? তুমি কিন্তু এখনও বাথরোব গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছ, ওঠো, ড্রেস করো।’ সে পাশের ঘর থেকে মায়ের হাউস কোট টোট নিয়ে এল। জোর করে একটু তুলে ধরল মাকে। এমন সময়ে টেলিফোনটা আবার বাজল।
তিতি দৌড়ে গিয়ে ধরল। — ‘হ্যালো?’
—‘নীলাদ্রি আছে?’ মেয়ে-গলা।
—‘এইমাত্র বেরিয়ে গেছে। কিছু বলতে হবে?’
—‘আপনি কে কথা বলছেন?’
—‘আমি নীলাদ্রির বোন।’
—‘আচ্ছা আঙ্কল ফিরে এসেছেন?’
—‘আপনি কে জিজ্ঞেস করতে পারি?’ তিতির গলা সতর্ক, রুক্ষ।
—‘আমি শুক্তি। নীলাদ্রির বন্ধু। ভীষণ ওয়ারিড হয়ে রয়েছি। নীল কোনও খবরও দিচ্ছে না।’
—‘না। বাবা এখনও ফেরেননি।’ তিতি টেলিফোনটা রেখে দিল। সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোনটা আবার বেজে উঠল। আচ্ছা নাছোড়বান্দা মেয়ে তো! গোপনতা সে পছন্দ করছে না ঠিকই। তাই বলে যে যেখানে আছে সে-ই তাদের পারিবারিক সমস্যার ব্যাপারে নাক গলাবে নাকি? আরও রুক্ষ হওয়া দরকার এই সমস্ত বড় নাকওয়ালিদের সঙ্গে।
—‘হ্যালো।’
—‘তিতি আছে?’
—‘বলছি।’
—‘আমি অর্জুন। কোনও খবর পেয়েছিস?’
—‘না।’
—‘ও। কোনও ব্যবস্থা করা হচ্ছে খোঁজার?’
—‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি।’ সংক্ষেপে বলল তিতি।
—‘ও, তনুমাসি কেমন আছেন?’
—‘ভাল না।’
—‘ও।’
—‘তিতি।… শুনছিস?’
—‘শুনছি।’
—‘ভাবিস না। আমি আছি।’
তিতি বলল— ‘ও’। বলে ফোনটা রেখে দিল।
তিতি সেন্টার পার্লারে ঠিক ভ্যান গখের আত্মপ্রতিকৃতিটার তলায় বসল। একটা পিঠ হেলানো চেয়ার ওখানে। হাতলগুলোর প্রান্ত বাঘ সিংহের থাবার মতো। পৌলোমীর বাবা নেই। মানে চলে গেছেন। অন্য এক মহিলাকে নিয়ে থাকেন। পৌলোমীর মা দাঁতে দাঁত চেপে আছেন। কিছুতেই ডিভোর্স দেবেন না। এইরকম অবস্থাতেই পৌলোমী বারো বছর থেকে উনিশ বছরের হয়ে উঠেছে। ছোটবেলায় পৌলোমীদের বাড়িতে গিয়ে অনেক আদর খেয়েছে তিতি। সে মাসিকে স্নেহশীলা বলেই জানত। এখন যায় না। যদি কখনও যেতে বাধ্য হয়, তার সামনেই উনি পৌলোমীকে অতি তুচ্ছ কারণে বিশ্রীভাবে বকাবকি করেন। রুক্ষ, শ্রীহীন চেহারা। তেমনি রুক্ষ স্বভাব। পৌলোমী মেয়েটা ভিতু-ভিতু, নরম প্রকৃতির। একেক সময়ে বলে— ‘আমার তেমন সাহসও নেই রে তিতি যে সুইসাইড করি।’ তার আরেক বন্ধু অনুভবের তো আরও খারাপ অবস্থা। বাবা কিছু না বলে, এতটুকু টের পেতে না দিয়ে কোনও বিদেশি য়ুনিভার্সিটিতে গিয়ে চাকরি নিয়ে বসে আছেন। সবাই অনুমান করে তিনি সেখানে দ্বিতীয় সংসার পেতেছেন। অনুভবের মা অনেক কষ্টে একটা ক্যানটিন করেছেন। সেইটা দিয়েই সংসার চালান। অনুভব ক্রমশই গম্ভীর, আরও গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে, দূরে সরে যাচ্ছে। তাকে নিয়ে অনেকে ঠাট্টা-তামাশাও করে। তিতি একদিন বলেছিল— ‘তুই ওরকম দূরে দূরে থাকিস কেন রে?’
—‘জানিস না?’ অনুভব বলেছিল— ‘আয়্যাম আ লেপার।’
তিতির মা বাবা উভয়েই আছে। যদিও তাদের কারও সঙ্গেই তার মনের কোনও যোগ নেই। কিন্তু সে যা চায় তাই পায়। যেমন ভাবে চায় তেমন ভাবে। অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে দিয়েছে তার বাবা-মা। তার বন্ধু শ্রীরাধাদের বাড়িতে সকলে খুব অন্তরঙ্গ। বাবা মা ঠাকুমা, ওরা দুই বোন, এক ভাই। একসঙ্গে খায় রাত্তিরে। বাবার সঙ্গে খুনসুটি করে, মাকে মনের প্রাণের কথা বলে, দোষ করলে ঠাকুমার আঁচলের তলায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু খুব আঁটোসাঁটো নিয়মও আছে তেমনি। কোনও আউটিং, এক্সকারশনে চট করে যাবে না, বলবে— ‘জানিস না তিতি, ঠাকুমা বুড়ি রাত্তিরে ঘুমোত পারবে না। ওই রে রাধু বুঝি ধর্ষিত হয়ে গেল। আমার দুঃখের কথা আর বলিস না রে।’
ওদের সবাইকার ভীষণ আড্ডা জমে যায় কোনওদিন, সাতটা বাজলেই শ্রীরাধা লাফিয়ে উঠবে— ‘ইস, আমি যাই।’ কী ব্যাপার, না ‘বাপিন এসে রাধুকে না দেখতে পেলে ফিট হয়ে যাবে।’ তিতি তাই অন্তরঙ্গতা চায়নি। তার বাড়িটা নীরস এটা সত্যি। কিন্তু নিজের মতো চলবার উপায়টা তো আছে। আবার এই স্বাধীনতাও তো একটা আপেক্ষিক ব্যাপার? বাবা না থাকলে তিতির নিজেকে-নিয়ে-ব্যস্ত থাকতে ভালবাসা মা যদি হঠাৎ পৌলোমীর মায়ের মতো বাঘিনী হয়ে যায়, যদি হয়ে যায় অনুভবের মায়ের মতো নিঃস্ব ভিখারিনী। তিতিও তো হয়ে যাবে আরেক অনুভব। হয়ত আরেক পৌলোমী। এই বাড়ি, আসবাব, দাস-দাসী? বিলাস, গাড়ি, সম্মান সব, সবই তো বাবার! তার নিজস্ব নয় তো কোনওটাই।
সিঁড়ি বেয়ে শব্দহীন কিন্তু দ্রুত পায়ে উঠে আসছে অর্জুন। তিতি এতই চিন্তামগ্ন যে সে দেখতেও পাচ্ছে না। বুঝতেও পারছে না। অর্জুনের পরনে একটা পা চাপা যোধপুরী পায়জামা, একটা খাদির পাঞ্জাবি। একটা গরম জহরকোট। সিঁড়ির মাথায় চটি জোড়া খুলে একপাশে সরিয়ে রেখে সে এদিক ওদিক দেখল। আগে দু একবার সে এখানে এসেছে। তিতির বন্ধুর দলের সঙ্গে। মোটামুটি তিতির ঘরটা চেনে। কিন্তু ঘর অবধি যাবার দরকার হল না। ভ্যান গখের নীচে অবিকল ওইরকম অসুখী চেহারা নিয়ে বসে আছে তিতি। সে সামনে গিয়ে দাঁড়াতে তিতি চমকে তাকাল। বলল— ‘তুই?’
—‘কাছেই একটা পাবলিক বুথ থেকে ফোন করছিলাম। চলে এলাম। তনুমাসি কোথায়?’
বাবার শোবার ঘরের দিকে আঙুল দেখাল তিতি। অর্জুন খুব স্বচ্ছন্দ ঋজু ভঙ্গিতে চলে গেল ঘরটার দরজার কাছে। পর্দায় হাত রেখে বলল— ‘আসব?’
—‘কে?’
—‘তনুমাসি আমি। আমি অর্জুন। মঞ্জুর ছেলে। চুঁচড়োর মঞ্জু। মঞ্জু পাঠাল আমায়।’
তনুশ্রী অবাক হয়ে উঠে বসলেন। তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন— ‘মঞ্জুদি? চুঁচড়োর?’
—‘হ্যাঁ। তোমার যদি কিছু দরকার থাকে তো বলো। আমাকে নিঃসঙ্কোচে বলতে পারো। আমি অনেক রকম জানি। জানি। পারি।’
—‘কী পারো। কী জানো?’ তনুশ্রীর অবাক হওয়া এখনও ফুরোয়নি।
—‘এই ধরো মন্ত্রতন্ত্র, ঝাঁড়ফুক’ ঠাট্টার মতো করে বলল অর্জুন, তারপরে আরেকটু গম্ভীর হয়ে বলল— ‘মেসো রেসপনসিব্ল লোক, এতগুলো মানুষ চরাচ্ছেন, এত ভয় পাচ্ছ কেন? ঠিক চলে আসবেন?’
—‘কিন্তু যদি গুণ্ডাদের হাতে পড়ে থাকে?’ তনুশ্রী এতক্ষণে বললেন।
—‘সেটাই। কিন্তু কেন পড়বেন?’ অর্জুন উঠে দাঁড়াল।
—‘মঞ্জুদি কেমন আছে? আর হরিশঙ্করদা?’
—‘মা ভালই আছে। আর ছোট কাকা? ছোটকাকা তো আজ চার বছর তিন মাস বাইশদিন হল নেই।’
—‘নেই?’ তনুশ্রী কীরকম ফাঁকা গলায় বললেন।
—‘নেই।’ অর্জুন হাসল।
‘মেসোকে আমরা খুঁজে বার করবই— তুমি ভেবো না।’ অর্জুন বেরিয়ে এল। তিতি এই পুরো ব্যাপারটায় কোনও অংশ নেয়নি। সে হাঁ করে দেখছিল, যেন একটা নাটক। অর্জুন যখন একটু নুয়ে তার বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে এল তার অর্জুনকে খুব লম্বা লাগল। অর্জুন লম্বাই। কিন্তু আরও যেন লম্বা লাগল। তার পেছন পেছন তনুশ্রী বেরিয়ে এসেছেন।
—‘অর্জুন, এই তিতি, আমার মেয়ে, তিতি, অর্জুন আমার মাসতুতো দিদি মঞ্জুদির ছেলে। মঞ্জুদি আমায় ভীষণ ভালবাসত। এখন তোর বাবার খবর জানতে পেরে অর্জুনকে পাঠিয়ে দিয়েছে। অর্জুন তুমি খেয়ে যাবে, তিতির সঙ্গে গল্প করো। তিতি হয়ত তোমারই বয়সী হবে।’ সমস্তটাই ধৈর্য ধরে শুনে গেল দুজনে। তিতি শেষকালে বলল, ‘মা, অর্জুন আর আমি যে একসঙ্গে পড়ি। ও আমাদের বাড়ি আগেও এসেছে।’
—‘সে কী? কখনও বলিসনি তো!’
—‘না, মানে জানতুম না তখন, সম্প্রতি জেনেছি,’ অর্জুন আরও খানিকটা লম্বা হয়ে বলল।
—‘আমি একটু তেতলার ঘরে যাব? মাসি?’
—‘হ্যাঁ হ্যাঁ যাও না।’ তনুশ্রী সাগ্রহে বললেন কেন কে জানে! শ্বশুরবাড়ির কাউকে জানানো তাঁর মত নয়। কিন্তু বাপের বাড়ির দিকে কেউ যখন জেনে গেছে! মঞ্জুদি ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছে, মনে হচ্ছে বেশ বুদ্ধিমান, বলিষ্ঠ, নির্ভরযোগ্য ছেলে তখন… তনুশ্রীর এতক্ষণের ভারী-হয়ে-থাকা বুকটা যেন একটু হালকা লাগছে। এই বিপদের মুহূর্তে মা-বাবা না-থাকাটাই যথেষ্ট দুঃখের। দিদিরাও সব দূরে দূরে। কিন্তু মঞ্জুদি। মঞ্জুদি আছে। খোঁজ নিচ্ছে। অর্জুন এসেছে, অর্জুন। আ-হ!
অর্জুন আর তিতি ওপরে চলে যাবার পর ফোনটা আবার বাজল। ওরা কেউ নেই, যে ধরে? তনুশ্রী ফোন-যন্ত্রটার দিকে বিরক্ত দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইলেন। কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এভাবে বেজে যেতে দেওয়া তো ঠিক নয়! একটু পরে তাঁকে ধরতেই হল।
—‘তনুশ্রী আছে?’
‘বলছি।’
‘আমি সেজদিভাই। আজকের ‘আনন্দবাজারটা’ দেখেছ?’
‘আনন্দবাজার’ তাঁদের বাড়িতে আসে না। কিন্তু এত কথা তনুশ্রী বললেন না। সংক্ষেপে বললেন— ‘না। কেন?’
—‘বড়দি মারা গেছে। শাঁটুল কাগজে দিয়েছে। আমি এইমাত্র দেখলুম তোমার ভাসুর দেখালেন। কী কাণ্ড! বলা নেই, কওয়া নেই। কতদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই! হুট করে…’
তনুশ্রী বললেন, ‘বয়স হয়েছিল…’
—‘তাই বলে এমন হুট করে? মা তো কমাস আগেই গেলেন। তখনই দেখেছিলুম অবশ্য চেহারাটা খুব খারাপ। তা তোমরা কী ভাবছ?’
—‘কী ভাবব? আমি তো এইমাত্র শুনলাম।’
—‘বিজুকে অফিসে একটা ফোন করো না, আমাদের সবারই তো কিছু সামাজিক কর্তব্য আছে! এ সময়ে ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো দরকার। সবাই মিলে একসঙ্গে যাওয়াই তো ভাল!’
তনুশ্রী চুপ করে রইল। সেজজা বললেন— ‘কী হল?’
—‘আমি এখন কিছুতেই যেতে পারব না সেজদিভাই!’ একেবারে ন্যাড়া-ন্যাড়া গলায় বলতে বলতে কীরকম ফুঁপিয়ে উঠলেন তনুশ্রী।
সেজজা বললেন— ‘কী হয়েছে? তোমাদের অ্যাসোসিয়েশনের কিছু চলছে নাকি? তুমি যদি যেতে না-ও চাও বিজুকে তো যেতেই হবে।’
‘না না, ও যেতে পারবে না।’ তনুশ্রী কথা শেষ করতে দিলেন না।
সেজজা তনুশ্রীর খেয়ালিপনার সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত। দু চোখে দেখতে পারেন না এসব। তবু ধনী মানী আত্মীয়। সেভাবে কিছু বলতে পারেন না। আজ উষ্মা সামান্য প্রকাশ করে ফেললেন— ‘বিজু কি নিজে বলেছে যে সে তার একমাত্র দিদির মৃত্যুর খবর শুনেও যাবে না? তুমি না হয় না যেতে পারো। তোমার সেজদা বলছেন দিব্যকে ওর অফিস থেকে গাড়ি জোগাড় করতে বলবেন, দিব্যর অফিসের গাড়িতেই আমরা চলে যাব, বিজুকে ওর অফিস থেকে তুলে নেব না হয়। তুমি বরং বিজুকে একটা ফোন করে রেখো। আচ্ছা আমিই করছি।’
সেজজা গাড়ির ব্যাপারটা ইচ্ছে করেই বললেন। তাঁদের গাড়ি নেই। কিন্তু দিব্য ইচ্ছে করলে গাড়ি পেতে পারে। এখন সে সি. ই. এস. সি-তে রয়েছে। এই ধনী আত্মীয়রা একসঙ্গে কোথাও যাবার প্রসঙ্গ উঠলেই মনে করে তাদের গাড়িগুলোর সুবিধে আদায় করার জন্যে সবাই মুখিয়ে আছে। নিজেরা নিজেদের অকাজে শত সহস্রবার বেরোবে। স্বামীর আলাদা, স্ত্রীর আলাদা, ছেলের আলাদা, মেয়েরও বোধহয়। কিন্তু কোনও সামাজিক কাজে ব্যবহারের সুদূরতম সম্ভাবনা দেখলেই এরা গুটিয়ে যায়। তিনি এসব জানেন। তাই আশ্বস্ত করলেন ধনী ছোটজা-কে। কিন্তু তনুশ্রী রিসিভারের ওপর যেন ঝাঁপিয়ে পড়লেন— ‘না না, সেজদিভাই ওকে অফিসে ফোন করতে হবে না, কোরো না।’
খুব অপমানিত বোধ করলেন সেজজা। ইচ্ছে হল বলেন— তিনি ফোন করলে কি বিজুর অফিসখানা ক্ষয়ে যাবে? কিন্তু এইসময়ে তাঁর কানে ধরা পড়ল ফোনের ওদিকে তনুশ্রীর গলাটা যেন কেমন বিকৃত। তিনি বললেন—‘কী হল, তনুশ্রী, তোমার কি শরীর খারাপ? বিজুর কিছু হয়েছে!’
‘ও এখানে নেই।’ এখনও গলাটা কেমন বিকৃত। সেজজা বললেন—‘আচ্ছা, ঠিক আছে। দেখা যাক, আমরাই… আচ্ছা ছাড়ছি।’
ফোনটা রেখে অদূরে-বসা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন— ‘কী ব্যাপার বলো তো? তনুশ্রীকে খুব ডিসটার্বড্ মনে হল! বিজুর সঙ্গে ঝগড়া-টগড়া হয়েছে, নাকি?’
‘ওদের ব্যাপার ওরাই জানে।’ বিজু রায়ের সেজদা কাগজটা পাট করতে করতে বললেন। ….‘যাবে না বলেছে যখন, না-ই যাক। বিজুর সঙ্গে বড়দির কি-ই বা সম্পর্ক! বড়দি আমাদের যতখানি ছিল…’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কাননবিহারী।
‘কই কোনদিন তো বড়দির সঙ্গে তোমাদের তেমন কোনও ‘এসো বসো’ দেখিনি!’
সে বড়দি দূরে থাকত, শ্বশুরবাড়ি খুব গোঁড়া…’ ঢোক গিলে বললেন কানন।
‘সুখচর এমন কী দূর! গোঁড়ার সঙ্গে সম্পর্ক কী!’
কোনও জবাব পেলেন না ভদ্রমহিলা। পরিবর্তে তাঁর স্বামী বললেন, —‘বলছে যখন যেতে পারবে না, নিশ্চয়ই কিছু অসুবিধে আছে। কী দরকার ঘাঁটিয়ে। থাকতে দাও না নিজেদের মতো!’
‘তাই বলে নিজের দিদির মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে একবার গিয়ে দাঁড়াবে না? কিছু মনে কোরো না— অমন বড়লোকের মুখে আগুন।’ বলে মহিলা আর দাঁড়ালেন না। স্ত্রী একেবারে দৃষ্টিপথের বাইরে চলে গেলে, কানন ধীরে-সুস্থে মেজদা গগনের বাড়ি ফোন করলেন। হ্যাঁ মেজদা জানে, ওরাও কাগজে দেখেছে। চিঠি আসেনি শাঁটুল নিজে এল না সুতরাং মেজদা যেতে চায় না। কানন বললেন—‘কাজে যাবে কি না সে না হয় পরে ঠিক করা যাবে। আপাতত তো ঘুরে আসা যাক।’
‘দিদিকে দেখতে পাব না। শাঁটলোটা বকে গেছে। কী একটা বেজাত বিয়ে করেছে শুনতে পাই। কার কাছে যাব? অসুখের খবরটা পর্যন্ত জানত পারলুম না!’ সখেদে বললেন মেজ গগন।
‘হয়ত অসুখ কিছু হয়নি। হঠাৎ সেরিব্র্যাল কি করোনারি অ্যাটাক!’ কানন বললেন।
‘হ্যাঁ, তা অবশ্য হতে পারে। আমায় দুটো দিন সময় দাও। তোমার বউদির আর্থরাইটিসটা বড় বেড়েছে।’
এবার বিজুর অফিসে ফোন করলেন কানন।
‘বি. বি. রায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারি?’
‘আপনি কে বলছেন।’
‘আমি ওঁর দাদা, সেজদা।’
ফোনটা হাতে নিয়ে সাধন বিশ্বাস খুব দ্রুত চিন্তা করে নিলেন। বউদি ওদিকে থেকে আদেশ দিয়ে রেখেছেন কেউ যেন জানতে না পারে। এদিকে সাহেবের নিজের দাদা ফোন করছেন। তিনি বললেন— ‘উনি তো এখন, অর্থাৎ এখানে নেই।’
‘কবে ফিরবে?’
‘তা তো কিছু জানিয়ে যাননি।’
‘আচ্ছা। উনি এলে জানিয়ে দেবেন ওঁর বড়দি, সুখচরের, মারা গেছেন হঠাৎ।’ ফোনটা চুপ হয়ে গেল। রিসিভারটার দিকে বিচলিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সাধন বিশ্বাস। তিনি ছাপোষা মানুষ, ছেলেপিলে নিয়ে ঘর করেন। এ কী কাণ্ড! সাহেবের দিদি মারা গেলেন, তিনি জানতেও পারলেন না? কোথায় গেলেন? ছেলেমেয়ে বউদিদি সবাই অদ্ভুত ব্যবহার করছে! সাহেব কি কোনও বিপদে পড়েছেন? এতদিন হয়ে গেল না একটা খবর, না কিচ্ছু!